অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে ব্রিটিশরা আসাম ও তত্সংলগ্ন এলাকায় প্রথম চা চাষ শুরু করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী তীরবর্তী এলাকায় চা চাষের জন্য জমি বরাদ্দ দেয়া হয় ১৮২৮ সালে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেটি বিলম্বিত হয়। যদিও বাংলাদেশে প্রথম অবাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয় ব্যক্তি পর্যায়ে। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম শহরের টাইগার পাস, লালখান বাজার, বাটালি হিল, বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব, লেডিস ক্লাব পাহাড় এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে চা চাষ শুরু হয়। এ চা বাগান কুণ্ডুদের বাগান নামে পরিচিত ছিল। ওই সময়ে বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব এলাকাটি ছিল চা উৎপাদনের কারখানা এবং সার্কিট হাউজ অংশটি ছিল চা বাগান সম্পর্কিত অফিস। পরবর্তী সমেয় ব্রিটিশদের এ চা উৎপাদনের অবাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। হিসাবমতে, দেশের প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয় চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়া উপজেলার কোদালা চা বাগানে। ১৮৪৬ সালে কোদালা টি এস্টেটে প্রথম চায়ের চারা রোপণ করা হয়। কিন্তু ভৌগোলিক কারণে তৎকালীন সময়ে দুর্গম এ এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়। ১৮৫৪ সালে সিলেটের এয়ারপোর্ট রোডের সন্নিকটে মালনীছড়া চা বাগানের কার্যক্রম শুরু করে ব্রিটিশরা। এখানেই বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদনে সাফল্য আসে। এ হিসাবে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা বাগান বলা হয় মালনীছড়াকে। যদিও ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামের কোদালা চা বাগানে ফের চা উৎপাদন বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়। দেশ স্বাধীনের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধু দুটি জেলায় চা আবাদ করা হতো, একটি সিলেট জেলায়, যা ‘সুরমা ভ্যালি’ নামে পরিচিত ছিল। অন্যটি চট্টগ্রাম জেলায় যা ‘হালদা ভ্যালি’ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে বৃহত্তর সিলেটের সুরমা ভ্যালিকে ছয়টি ভ্যালিতে ভাগ করা হয়েছে যথাক্রমে লস্করপুর ভ্যালি, বালিশিরা ভ্যালি, মনু-দলই ভ্যালি, লংলা ভ্যালি ও নর্থ সিলেট ভ্যালি। তাছাড়া হালদা ভ্যালিকে চট্টগ্রাম ভ্যালি নামকরণ করা হয়েছে। এ দেশের আবহাওয়া চা চাষে উপযোগী হওয়া ও বাণিজ্যিকভাবে চা চাষে সাফল্য আসায় ব্রিটিশ আমল থেকেই চা উৎপাদনে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। এক পর্যায়ে ১৯৭০ সালেই বাংলাদেশে চা বাগানের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫০। ২০০২ সাল থেকে সিলেট ও চট্টগ্রামের পাশাপাশি বাংলাদেশ চা বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুরের সমতল ভূমি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় ক্ষুদ্রায়তনে চা আবাদ শুরু করেছে। বাংলাদেশে ১৯৭০ সালে চায়ের বার্ষিক উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ১৩ লাখ ৮০ হাজার কেজি। ২০১৬ সালে উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে ৮ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার কেজিতে উন্নীত হয়। ২০১৮ সালে উৎপাদনের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ৮ কোটি ২১ লাখ ২০ হাজার কেজি ও ২০১৯ বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড ৯ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার কেজিতে উন্নীত হয়। যদিও বিরূপ আবহাওয়ার কারণে ২০২০ সালে উৎপাদন কিছুটা কমে ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজার কেজিকে নেমে আসে। অতীতে বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ চা রফতানি হলেও দীর্ঘদিন পর ২০২০ সালে রেকর্ড ২১ লাখ ৭০ হাজার কেজি চা বিশ্ববাজারে রফতানি হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট টি এস্টেট/চা বাগানের সংখ্যা ১৬৭, যার মধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় সবচেয়ে বেশি ৯১টি বাগান বা টি এস্টেট রয়েছে। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা হবিগঞ্জে ২৫টি, চট্টগ্রামে ২১, সিলেট ১৯, রাঙ্গামাটিতে দুই, পঞ্চগড়ে আট ও ঠাকুরগাঁওয়ে একটি চা বাগান/টি এস্টেট রয়েছে। এর মধ্যে টি এস্টেট হচ্ছে চা গাছ থেকে কুঁড়ি উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণ, বাজারজাত ছাড়াও শ্রমিক/কর্মচারীদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা হয় এসব বাগানে। অন্যদিকে চা বাগান বলতে শুধু চা গাছ সৃজন, চা উৎপাদনসহ এ প্রক্রিয়া যেকোনো একটি বা দুটি কাজ সম্পন্ন হয় এখানে। এ হিসাবে দেশে টি এস্টেট রয়েছে ১২৯টি, চা বাগান রয়েছে ৩৮টি। চায়ের ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ, রফতানি বাজার সম্প্রসারণ, গুণগত মানসম্পন্ন চা উৎপাদন বৃদ্ধি, চা শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার উন্নয়নের পথনকশা: বাংলাদেশ চা শিল্প প্রণয়ন করেছে। এ পথনকশা ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার অনুমোদন করে। এতে স্বল্পমেয়াদি (২০১৬-২০২০), মধ্যমেয়াদি (২০১৬-২০২৫) ও দীর্ঘমেয়াদি (২০১৬-২০৩০) মোট ১১টি কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরই মধ্যে স্বল্পমেয়াদি কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে দেশে রেকর্ড ৯৬ দশমিক শূন্য ৭ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। যদিও কভিডের কারণে ২০২০ সালে উৎপাদন কিছুটা কমে ৮৬ দশমিক ৩৯ মিলিয়নে নেমে আসে। এর পরও পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ১৪০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্বে শীর্ষ চা উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় নাম লেখাতে চায়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে চা খাতে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা জাগাচ্ছে উত্তরাঞ্চলের সমতলে ক্ষুদ্রায়তনে চা চাষ। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন সরকার সমতলে চা চাষের কার্যক্রম শুরু করে। ২০২০ সালে এ অঞ্চল থেকে ১০ দশমিক ১৩ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামেও ক্ষুদ্রায়তনে চা চাষ কার্যক্রম শুরু করেছে চা বোর্ড। উত্তরাঞ্চলের জন্য চা বোর্ডের দুটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। পাশাপাশি পার্বত্য এলাকায় চা চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বান্দরবানে একটি চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপন করা হয়েছে।
টলটলে লিকার। উগ্র সুবাস যেন প্রাণশক্তি ও উৎসাহের উৎস। সত্যিই চা জাগ্রত জীবনীশক্তির ভাণ্ডার। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে চা শিল্পকে ভারতীয়রা মনে করত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তার পিতামহের চা ব্যবসাসংক্রান্ত সব দস্তাবেজ পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু যে পণ্যটিকে ভারতীয়রা, বিশেষ করে বাঙালিরা দীর্ঘদিন যুক্তির মোড়কে দূরে সরিয়ে রেখেছে, ব্রিটিশ বিদায়ের পর তা এখন সংস্কৃতির অংশ। পাড়ার দোকান থেকে শুরু করে শহরের মোড়ে মোড়ে। শুধু শিক্ষিত সমাজ নয়; কৃষক, কুলি, মজুর, শ্রমিক, ব্যবসায়ী—সব মানুষই চায়ের অনুরাগী। দেশের গ্রামীণ আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনে চায়ের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। গত এক দশকে বাংলাদেশে চায়ের মাথাপিছু ভোগ বেড়েছে ঈর্ষণীয় হারে। চায়ের বাড়তি চাহিদার পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাড়তি ভোগের কারণে আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধি পেলেও কয়েক বছরের মধ্যেই রফতানিমুখী হতে পারে বাংলাদেশ। সেক্ষেত্রে চা শিল্পের উন্নয়নে গ্রীহিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বাংলাদেশ চা বোর্ড (বিটিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে দেশে চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার কেজি। এ সময়ে ভোগের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৬৯ লাখ ৫০ হাজার কেজি। ফলে ওই বছরে ১ কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজার কেজি চা রফতানি করা সম্ভব হয়েছিল। আর রফতানির মাধ্যমে আয় হয়েছিল প্রায় ৮৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু ২০১৯ সালে দেশে এ-যাবৎকালের সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার কেজি। এ সময়ে দেশের ভোগ ছিল ৯ কোটি ৫২ লাখ কেজি। ফলে রফতানি হয় মাত্র ছয় লাখ কেজি, যার মাধ্যমে রফতানি আয় হয় ১৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ফলে প্রায় দুই দশকের ব্যবধানে উৎপাদন ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে ১৬০ শতাংশ। ভোগের এই বাড়তি বৃদ্ধির কারণে চা রফতানিকারক দেশ থেকে অনেকটাই আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। গ্রামীন অর্থনীতি: প্রাণশক্তি ও উদ্দীপনার অন্যতম জোগানদাতা হিসেবে বাসাবাড়ি, অফিস, মোড়ের দোকান সর্বত্রই জনপ্রিয় চা। এজন্যই দেশে চায়ের ভোগ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি প্রয়োজনের তাগিদেই বেড়েছে চায়ের দোকান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে দেশে চায়ের দোকান প্রায় ৪ লাখ ৯১ হাজার ২৭৯টি, যা ২০১৩ সালে ছিল ৪ লাখ ১১ হাজার ৩৩০টি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে চায়ের দোকান বেড়েছে ৭৯ হাজার ৯৪৯টি বা প্রায় ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ। আর এসব চায়ের দোকানে কাজ করছে প্রায় ১০ লাখ ৭৮ হাজার জন। যদিও ২০১৩ সালে ছিল ৮ লাখ ৮২ হাজার টনের। পাঁচ বছরের ব্যবধানে কর্মসংস্থান বেড়েছে ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৩ সালে প্রতিটি চায়ের দোকানে গড়ে ২ দশমিক ১২ জনের কর্মসংস্থান ছিল, যা ২০১৮ সালে চায়ের দোকানে কর্মসংস্থান হয়েছে ২ দশমিক ১৯ জনের। চা ভোগের ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে গত এক দশকে গ্রামীণ অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনের পাশাপাশি খাদ্যগুণের উপকারিতাও বিবেচনায় নিচ্ছে সাধারণ মানুষ। ভোগের পরিমাণ এ হারে বাড়তে থাকলে সামনের দিনগুলোয় চাহিদা মেটাতে এখনই এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। কার্যকরভাবে বাগানের ব্যবহার করতে হবে। বাড়াতে হবে উৎপাদনশীলতা। সেজন্য বাগানগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক আরো জোরদার করতে হবে। কেননা উৎপাদনশীলতায় বিশ্ব গড়ের নিচে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বিশ্বের শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশগুলোতে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন আড়াই হাজার কেজির কাছাকাছি হলেও বাংলাদেশের আবহাওয়া অনুকূল থাকলেও হেক্টরপ্রতি বাংলাদেশের উৎপাদন মাত্র এক-দেড় হাজার কেজির কাছাকাছি। দেশে গত কয়েক দশকে এ শিল্পের উন্নয়নে বিনিয়োগ তুলনামূলকভাবে কম। প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বিবিধ প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ চা শিল্পের পর্যায়ে চা রোপণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, কারখানা উন্নয়ন, উৎপাদন প্রক্রিয়া সুসংহতকরণ, শ্রমকল্যাণ, অবকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে এরই মধ্যে বেশকিছু সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ১৯৭০ সালের ৩ কোটি ১৩ লাখ ৮০ হাজার কেজি থেকে ২০১৯ সালে উৎপাদন ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজিতে উন্নীত হয়েছে। চা চাষাধীন জমি ১৯৭০ সালে ৪৩ হাজার হেক্টর থেকে প্রায় ৬০ হাজার হেক্টরে উন্নীত হয়েছে। চা বাগানের সংখ্যা ১৯৭০ সালে ১৫০ থেকে বর্তমানে ১৬৬তে উন্নীত হয়েছে। দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ এবং রফতানি বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা ভিশন-২০২৫ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের সাতটি জেলায় প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে চা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। দেশে আরো ৪ হাজার ৬৯৮ হেক্টর অনাবাদি জমিতে ১২ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করা সম্ভব। সম্প্রতি এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন, যার সিংহভাগই ঋণভিত্তিক পেলেও কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে। বাকি কিছু অর্থ অনুদান বা প্রকল্প সহায়তার মাধ্যমে নেয়া যেতে পারে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিপুল পরিমাণ উন্নত মানের চা রফতানি করা সম্ভব হবে। চায়ের হারানোর গৌরব ফিরিয়ে এনে রফতানিযোগ্য করার লক্ষ্যে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ চা বোর্ড। বিদেশী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে চায়ের শ্রেণীবিন্যাস করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। যে চা আমাদের দেশে ব্ল্যাক টি নামে পরিচিত এটির উৎপাদন বৃদ্ধিসহ ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঠাণ্ডা চা, সুগন্ধি চা, মসলাযুক্ত চা, ওষুধি চায়ের মতো বিশেষ ক্যাটাগরির চা রফতানি করা হবে। রফতানিযোগ্য চা বস্তায় নয়, উন্নত মোড়কে প্যাকেটজাত এবং চা উৎপাদন ও গুণাগুণ সম্পর্কিত পর্যাপ্ত তথ্যাবলিসহ রফতানি করা হবে। এর মাধ্যমে বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশের চায়ের গৌরব পুনরুদ্ধার হবে। সাধারণ চাকেই বিশেষ চায়ে রূপান্তর করে রফতানি বাজারে বিদেশী ক্রেতাকে আকৃষ্ট করা যেতে পারে। বিশেষ চা তৈরি করতে কোনো সুগন্ধ বা হারবাল কেমিক্যল মিশ্রণের প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে কী পরিমাণ কেমিক্যাল দেয়া হলে চায়ের গুণগত মান বজায় থাকবে এবং স্বাস্থ্যকর হবে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে বলা যাবে না। সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে মানসম্মত চা উৎপাদন বৃদ্ধি। দেশের অভ্যন্তরে যে পরিমাণ চাহিদা বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাইব্রিড প্রজাতির চা প্লান্টেশন করা না হলে রফতানিযোগ্য চা উৎপাদন করা কঠিন হবে। বিটিআরআই নতুন ক্লোন টি (বিটি-১৮) উদ্ভাবন করেছে। চারা বিভিন্ন বাগান মালিকরা নিচ্ছেন, এসব চা গাছ পরিপক্ব হলে উৎপাদন বাড়বে নিঃসন্দেহে এবং এর গুণগত মানও ভালো থাকবে। প্রয়োজন কার্যকর উদ্যোগ: বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলের মাটি উন্নত মানের চা উৎপাদনের জন্য বেশ উপযোগী। সেখানে চা উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। বাড়তি চাহিদা মেটাতে দেশের উত্তরাঞ্চলে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট জেলায় উন্নত মানের চা উৎপাদন বেগবান করতে হবে। সরকার চা উৎপাদনকারীদের প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করে যাচ্ছে। সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগালে চা উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করে বিপুল পরিমাণ চা বিদেশে রফতানি করা সম্ভব। তাছাড়া চা আমদানি নিরুৎসাহিত করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে চা উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তাই জাত উদ্ভাবনে উষ্ণতাকে বিবেচনায় নিতে হবে। চায়ের বাজার ধরে রাখতে হলে আমাদের উচ্চফলনশীল জাতের চা চাষ বাড়াতে হবে। এ খাতের উন্নয়নে ব্যাংক সুদের হার কমানো, আমদানিকে নিরুৎসাহিত, নিরবিচ্ছন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, শ্রম অসন্তুষ্টি কমাতে আরো সুবিধা বাড়ানো, জমি ইজারা নিয়ে বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। পাশাপাশি চা আবাদ অঞ্চল বৃদ্ধির জন্য সরকার জমি ইজারার হার এখনো ন্যূনতম পর্যায়ে রেখেছে, সেটি বাড়ানোর মাধ্যমে যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। চা শিল্প শ্রমিকদের উন্নয়নেও নানা কর্মসূচি নিতে হবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে রয়েছে প্রণোদনা। এছাড়া গবেষণাকাজে সরকারি বরাদ্দ আগের তুলনায় অনেক বাড়াতে হবে। চা শিল্পের উন্নয়নে বাংলাদেশ চা বোর্ড: অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ এবং রফতানির জন্য চা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ চা বোর্ড। বেশকিছু লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সংবিধিবদ্ধ এ প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো চা বাগানের জন্য চায়ের আবাদযোগ্য জমি চিহ্নিতকরণ, এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত, ক্ষুদ্রায়তনের চা চাষে উৎসাহ প্রদান, উৎপাদন ও মান বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ এবং পণ্যটি রফতানিতে হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার। বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে চা শিল্পের উন্নয়ন তথা চা উৎপাদন, বিপণন ও রফতানি বৃদ্ধির জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, নতুন চা বাগান প্রতিষ্ঠা ও পরিত্যক্ত বাগানের পুনর্বাসন, বাংলাদেশে উৎপাদিত চায়ের ওপর উপকর আরোপ এবং সহায়ক অন্যান্য বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ ও সামগ্রিকভাবে দেশে চা শিল্পের কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ। পাকিস্তান টি অ্যাক্ট-১৯৫০-এর অধীনে ১৯৫১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গঠন করা হয়েছিল সে সময়কার পাকিস্তান টি বোর্ড। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালের ৪ জুন থেকে ১৯৫৮ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত তৎকালীন টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বঙ্গবন্ধুই ছিলেন প্রথম বাঙালি, যিনি চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। চেয়ারম্যান হওয়ার পর চা-সংক্রান্ত গবেষণা কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি এবং এ পদে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায়ই শ্রীমঙ্গলে চা গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেন তিনি, যার সুফল এ দেশের জনগণ এখন ভোগ করছে। তার সরাসরি নির্দেশনাতেই চায়ের ওপর ব্যাপক হারে গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয় এবং এ ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত ২০টি অত্যন্ত উন্নত মানের ফলন ও গুণসম্পন্ন চায়ের ক্লোন উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। এসব ক্লোন বা জাত রোপণের মাধ্যমে দেশের চা উৎপাদনকারী ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছেন। ১৯৫৯ সালের ৮ আগস্ট পাকিস্তান টি অ্যাক্ট-১৯৫০ বাতিল করে টি বোর্ড পরিচালনার লক্ষ্যে জারি করা হয় চা অধ্যাদেশ ১৯৫৯। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে এটিকেও বাতিল করে ঘোষণা করা হয় চা অধ্যাদেশ-১৯৭৭। এ অধ্যাদেশের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ চা বোর্ড। অধ্যাদেশ বলবৎ থাকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। ওই বছরের ১ আগস্ট জারি করা এক গেজেটের মাধ্যমে চা অধ্যাদেশ-১৯৭৭ রহিত করে জারি করা হয় চা আইন-২০১৬। দেশে চা শিল্পের বিকাশ: ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চা বাগানগুলো প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ শিল্পকে টেকসই খাতের ওপর দাঁড় করানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। চা বাগান মালিকদের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহ করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটি (বিটিআইএমসি) গঠন করে যুদ্ধোত্তর মালিকানাবিহীন/পরিত্যাক্ত চা বাগান পুনর্বাসন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এছাড়া যুদ্ধে বিধ্বস্ত পরিত্যক্ত বাগানগুলোকে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাগান মালিকদের কাছে পুনরায় হস্তান্তর করেন। চা কারখানাগুলোর পুনর্বাসনের জন্য তৎকালীন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া থেকে ৩০ লাখ রুপি ঋণ নিয়ে চা শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি করেন। বাগান মালিকদের ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা সংরক্ষণের অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি। একই সঙ্গে চা শ্রমিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকারও দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। চা শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর সরকার চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুকি প্রদান করার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এ প্রতিষ্ঠানকে প্রথমে বাংলাদেশ চা গবেষণা স্টেশন (বিটিআরএস) নাম দেয়া হয়। এরপর ১৯৭৩ সালে এটিকে পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করে নাম দেয়া হয় বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই)। এসব উদ্যোগের কারণেই দেশের চা শিল্প আজ বিশেষ অবস্থান নিতে সমর্থ হয়েছে। নতুন নতুন বিনিয়োগ আসছে এ শিল্পে। তেমনি দেশের মানুষের চাহিদা মেটাতে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়েছে। ২০০ বছরের চা পণ্য দেশের মানুষের সংস্কৃতির অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে।
করোনায় বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। স্থবির হয়ে গেছে সব কর্মকাণ্ড। চরম আঘাত এসেছে অর্থনীতিতে। বিশ্বের মতো বাংলাদেশকেও বেশ ধাক্কা দিয়েছে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস। অর্থনীতির গতি সচল রেখেছে...
হবিগঞ্জ তথা বৃহত্তর সিলেটের চা শিল্প এবার বৃষ্টির অভাবে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি নতুন মৌসুম। সেচের অভাবে গাছের পাতা নষ্ট হয়ে...
পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমে বিধানসভা নির্বাচনের আগে চা শিল্পের জন্য ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ঘোষণা করে রাজনৈতিক চমক দিতে চাইছে বিজেপি। এটা মানুষকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া...
সর্বশেষ মন্তব্য