বিশ্ব
গরুর গোবর দিয়ে তৈরি টুথপেস্ট, ফেইসওয়াশ, কফি, আয় কোটি টাকা!
ভারতে গরু নিয়ে নানান ধরনের হইচই চলছে বিগত কয়েক বছর ধরে। হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে শুরু হওয়া এই হইচই দিন দিন আরও বাড়ছে। – এই সময়
গো-হত্যা ও গো-রক্ষাকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে শতাধিক সংখ্যালঘু মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে ভারতজুড়ে। বিয়োগাত্মক এসব ঘটনার পাশপাশি চলছে গরুজাত পণ্য উদ্ভাবন, বাজারজাতকরণের নানা পদের উদ্যোগ।
সম্প্রতি ভারত সরকার ঘোষণা করে গরুজাত পণ্যের কোনো উদ্যোগ নিলে তাতে সরকার ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেবে। সেই ঘোষণা অনেককেই আগ্রহী করে তুলেছে নতুন এই খাতের ব্যবসায়। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট নতুন বছরের প্রথম দিন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতে গরুকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন বিভিন্ন ব্যবসা ও উদ্ভাবন নিয়ে।
“Would you use a cow dung face wash? They do in India” শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয় কিভাবে ধীরে ধীরে ভারতের বাজারে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে গরুজাত এমন অনেক পণ্য, যেগুলো এক সময় বানানো যায়- এমনটাই ভাবা যায়নি।
চীনা সংবাদমাধ্যমটি জানায়, ভারতে গরুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন ব্যবসা ও উদ্ভাবন। পণ্য বিক্রির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে আমাজন, ফ্লিপকার্ট বা ই-বে’র মতো বড় বড় ই-কমার্স সাইটগুলো।
বিশেষ করে গোবর থেকে তৈরি সাবান, ফেসওয়াশ, শ্যাম্পু এমনকি টুথপেস্ট পর্যন্ত বাজারজাত করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এসব পণ্যের জনপ্রিয়তাও লক্ষ্য করা গেছে। ই-কমার্স সাইটগুলোতেও সহজে এসব পণ্য মেলে।
মুম্বাইয়ের বাসিন্দা উমেশ সনি প্রতিষ্ঠা করেছেন কাওপ্যাথি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১২ সাল থেকে গরুর গোবর দিয়ে নানান পণ্য তৈরি করছেন ৩৬ বছর বয়সী এই মাইক্রোবায়োলজিস্ট। গরুর মূত্র থেকে প্রক্রিয়াজাত করছেন কফিও। তার তৈরি করা সাবান এর মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
তিনি জানান, প্রথম দিকে এসব পণ্য উপহার হিসেবে নানাজনকে দিতেন। এর মধ্যে পণ্যের প্রচারও হয়। ফলে পরবর্তীতে তার পণ্যের চাহিদাও তৈরি হয়। এখন ১৪টি দেশের ৪০০ এর বেশি হোলসেল দোকানে পণ্য সরবরাহ করেন তিনি। বর্তমানে তার কোম্পানি কাওপ্যাথির বার্ষিক আয় আড়াই কোটি রুপিরও বেশি।
প্রসঙ্গত, বর্তমান শাসক দল বিজেপি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে গরু কেন্দ্রিক মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। বিগত কয়েক বছর ধরে গরু নিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা শতাধিক সংখ্যালঘু মুসলিমকেও প্রাণ দিতে হয়েছে দেশটিতে।
গরুকে দেশটিতে জাতীয় পবিত্র প্রাণী হিসেবে দেখা হয় এখন। ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে এই প্রাণীজাত যে কোনো বস্তু বা জিনিসও পবিত্র হিসেবে গণ্য করে থাকে বিপুলসংখ্যক মানুষ।
বাংলাদেশ
ঐতিহ্যবাহী দেশীয় মাছ – দা এগ্রো নিউজ
আমাদের দেশের অধিকাংশ ঐতিহ্যবাহী দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কিছু টিকে আছে আমাদের মাছ চাষিদের কল্যাণে। আসুন ছবির মাধ্যমে আজ আমরা কিছু ঐতিহ্যবাহী দেশীয় মাছ দেখে নেই।
ফসল
ফাতেমা ধান’ চাষে বাম্পার ফলন – দা এগ্রো নিউজ
বাগেরহাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক নারীর চাষ করা ধান ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। একটি শীষে ধান পাওয়া গেছে এক হাজার এক শর বেশি। দেশে বর্তমান যেসব জাতের ধান চাষ হয় সেসবের চেয়ে এই ধানের ফলন দ্বিগুণ। ফাতেমা বেগমের জমিতে এই ধানের চাষ হওয়ায় এরই মধ্যে তা ‘ফাতেমা ধান’ নামে পরিচিতি পেয়েছে এলাকায়।
ফাতেমা ধানের গাছ, ফলন, পাতা, শীষ সবকিছু অন্য যে কোনো জাতের ধানের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতি গোছে একটি চারা রোপণ করা হয়, যা বেড়ে ৮-১২টি হয়। প্রতিটি ধান গাছ ১১৫ থেকে ১৩০ সেন্টিমিটার লম্বা। একেকটি ছড়ার দৈর্ঘ্য ৩৬-৪০ সেন্টিমিটার। প্রতি ছড়ায় দানার সংখ্যা এক হাজার থেকে ১২০০টি। যার ওজন ৩০-৩৫ গ্রাম। ধানগাছের পাতা লম্বা ৮৮ সেন্টিমিটার, ফ্লাগলিপ (ছড়ার সঙ্গের পাতা) ৪৪ সেন্টিমিটার। ধানগাছের পাতা চওড়ায় দেড় ইঞ্চি। এই জাতের গাছের কাণ্ড ও পাতা দেখতে অনেকটা আখ গাছের মতো এবং অনেক বেশি শক্ত। তাই এই ধান ঝড়-বৃষ্টিতে হেলে পড়ার কোন আশঙ্কা নেই। ফাতেমা ধান একরপ্রতি ফলন হয় প্রায় ১৩০ মণ। তাই অন্য যে কোনো জাতের তুলনায় এই জাতের ধান অনেক ব্যতিক্রম।
গতকাল শুক্রবার চাকুলিয়া গ্রামে ফাতেমা বেগমের বাড়িতে গিয়ে বেশ কিছু মানুষের ভিড় দেখা যায়। দূর-দূরান্ত থেকে তারা ফাতেমার ধানের বীজ কিনতে এসেছে। কেউ কেউ যে জমিতে ওই ধান ফলেছে, তা ঘুরে দেখে। তবে কয়েক দিন আগেই ওই ধানের বীজ শেষ হয়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে।
ফাতেমা বেগম জানান, ২০১৬ সালে বোরো মৌসুমে তাঁর বাড়ির পাশে জমিতে হাইব্রিড আফতাব-৫ জাতের ধান কাটার সময় তিনটি ভিন্ন জাতের ধানের শীষ দেখতে পান তিনি। ওই তিনটি শীষ অন্যগুলোর চেয়ে অনেক বড় এবং শীষে ধানের দানার পরিমাণও অনেক বেশি ছিল। এরপর ওই ধানের শীষ তিনটি বাড়িতে এনে শুকিয়ে প্রক্রিয়া করে বীজ হিসেবে রেখে দেন। পরের বছর ছেলে লেবুয়াতকে ধান চাষ চাষ করতে বলেন। সে বছর আড়াই কেজি ধান পাওয়া যায়। এবার আরো বেশি জমিতে চাষ করার পর ধানে ধানে সয়লাব হয়ে গেছে। সাড়া ফেলেছে তা এলাকার বাইরেও। ওই ধান দেখতে ব্রি-২৮ ধানের মতো। লেবুয়াত শেখ জানান, বাড়ির পাশে দেড় বিঘার মৎস্যঘেরের মধ্যে প্রায় ৪২ শতক জমিতে আলাদাভাবে এ বছর ওই ধানের চাষ করেন তাঁরা। অন্য ধানের মতোই সাধারণ পরিচর্চা করেন। জমিতে দুই দফায় ২০ কেজি ইউরিয়া এবং ৩০ কেজি পটাশ সার ব্যবহার করা হয়েছে। পোকামাকড় তাড়াতে দুই দফায় কীটনাশক ছিটানো হয়েছে। অন্য জাতের ধানগাছের চেয়ে এই ধানগাছ অনেক লম্বা। ধানের শীষও অনেক বড়। প্রতিটি শীষে এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ দানা হয়। ওই জমিতে প্রায় দুই হাজার ৬০০ কেজি ধান ফলেছে। নিজেদের জন্য কিছু পরিমাণ বীজ ধান রাখার পর ৪০০ টাকা কেজিদরে ওই ধান বিক্রি করে দিয়েছেন। তাতে আয় হয়েছে সাত লাখ ২০ হাজার টাকা। সিলেট, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, খুলনাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এসে ওই ধান ক্রয় করেছে। ফকিরহাটের মাসকাটা ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. সোলায়মান আলী জানান, ওই ধান রোপণ করার পর তাঁরা তত্ত্বাবধান করেন। চাষি তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী ধান চাষ করেছেন।
কৃষক রিয়াজুল ইসলাম জানান, ইউটিউবের মাধ্যমে ফাতেমা ধানের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রায় ৬ মাস অপেক্ষা করার পর বাগেরহাটের কৃষক লেবুয়াতের মায়ের নিকট থেকে বীজ সংগ্রহ করি। এরপর প্রাথমিকভাবে আমার ৭৫ শতাংশ জমিতে এ ধানের চাষ করি। এতে সবকিছু মিলে মাত্র ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আমি আশাবাদী এ জমিতে প্রায় ৯৫-১০০ মণ ধান হবে। এই ধান উপজেলাব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার বলেও তিনি মনে করেন। তিনি আরও জানান, এই ধান চাষ করে লাভবান হতে পারব বলে আশা করছি। নিজেও স্বাবলম্বী হতে পারব। এ বছর আরও জমিতে আবাদ করব এই ধান।
আলফাডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রিপন প্রসাদ সাহা জানান, বাগেরহাটের কৃষক কর্তৃক উদ্ভাবিত ফাতেমা জাতের ধানের রয়েছে নানা বৈশিষ্ট্য। এ ধানের ফলন শুধু দেশ নয়, গোটা বিশ্বকে তাক লাগাতে পারে। যা দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা যেতে পারে। তিনি আরও জানান, উপজেলাতে এ ধানের আবাদ বৃদ্ধিতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
এগ্রোটেক
জমি এবং কৃষক ছাড়াই যেভাবে কৃষিকাজে বিপ্লব আনছে জাপান – দা এগ্রো নিউজ
ফলমূল এবং সবজি মাঠে চাষ করেন না ইয়ুচি মোরি। তার ক্ষেত্রে আসলে মাটি বলে কোন জিনিস নেই।
বরং এই জাপানি বিজ্ঞানী চাষাবাদের জন্য এমন একটি জিনিসের ওপর নির্ভর করেন, যেটি আসলে মানুষের বৃক্ক বা কিডনির চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হতো- আর তা হছে পরিষ্কার এবং সহজ ভেদ্য পলিমারের ঝিল্লি।
ওই ঝিল্লির ওপরে উদ্ভিদ বড় হয়ে ওঠে, যা তরল এবং পুষ্টি মজুদ করে রাখে।
যেকোনো পরিবেশে সবজি গাছগুলোকে বড় হওয়ার সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি, এই প্রযুক্তি প্রচলিত কৃষিকাজের তুলনায় ৯০ শতাংশ কম পানি ব্যবহার করে। সেই সঙ্গে কীটনাশকও ব্যবহার করতে হয় না- কারণ পলিমার নিজেই ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে।
এটি একটি উদাহরণ মাত্র, যা দিয়ে ভূমি এবং কর্ম শক্তির ঘাটতিতে থাকা জাপান কৃষি কাজে বিপ্লব ঘটিয়ে দিচ্ছে।
”কিডনি ডায়ালাইসিসের কাজে যে ঝিল্লি ব্যবহার করা হতো, আমি সেসব বস্তু এখানে ব্যবহার করছি,” বিবিসিকে বলেছেন এই বিজ্ঞানী।
তার কোম্পানি মেবাইওল প্রায় ১২০টি দেশে এই আবিষ্কারের পেটেন্ট বা স্বত্বাধিকার নিশ্চিত করেছে।
এটা আসলে জাপানের অব্যাহত একটি কৃষি বিপ্লবকে সামনে তুলে ধরেছে। মাঠগুলো এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট আর সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একেকটা টেকনোলজি সেন্টারে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।
কৃষিকাজে ব্যবহৃত প্রযুক্তি অদূর ভবিষ্যতে ভালোভাবে ফসলের নজরদারি এবং রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা আরো বাড়িয়ে দেবে।
এ বছর পানিসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক জাতিসংঘের বিশ্ব প্রতিবেদনে ধারণা করা হয়েছে যে, বর্তমানে যে হারে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে এবং পানির ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় ৪০ শতাংশ শস্য উৎপাদন এবং ৪৫ শতাংশ বিশ্বের দেশজ পণ্য উৎপাদন ঝুঁকিতে পড়বে।
ইয়ুচি মোরির আবিষ্কৃত কৃষি পদ্ধতি এর মধ্যেই জাপানের ১৫০টি এলাকায় ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে আরব আমিরাতের মতো অনেক দেশ এই প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে।
বড় ভূমিকম্প প্রবণ এবং ২০১১ সালের মার্চে পারমাণবিক বিপর্যয়ে পড়া এলাকাগুলোয় নতুন করে কৃষিকাজ শুরু করার জন্য এই পদ্ধতি বিশেষভাবে সহায়তা করছে।
রোবট ট্র্যাক্টর
ধারণা করা হয়, বিশ্বের জনসংখ্যা সাতশো সত্তর কোটি থেকে বেড়ে ২০৫০ সাল নাগাদ নয়শো আশি কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে। ফলে বিশ্বের খাদ্য চাহিদা মেটানোর বিষয়টিকে বড় ব্যবসায়িক সুযোগ হিসাবে দেখছে কোম্পানিগুলো, পাশাপাশি যন্ত্রপাতির বড় বাজারও তৈরি হচ্ছে।
বর্তমানে বিশ ধরণের রোবট তৈরির ব্যাপারে ভর্তুকি দিয়ে সহায়তা করছে জাপানের সরকার, যেগুলো কৃষিকাজের নানা পর্যায়ে সহায়তা করতে পারবে। নানা ধরণের ফসলের বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল সংগ্রহের কাজ করবে এসব রোবট।
হাক্কাইডো ইউনিভার্সিটির সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মেশিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইয়ানমার একটি রোবট ট্র্যাক্টর তৈরি করেছে, যেটি এর মধ্যেই ক্ষেতে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
একজন ব্যক্তি একই সময়ে দুইটি ট্র্যাক্টর চালাতে পারবে। সেন্সরের কারণে এসব ট্র্যাক্টর সামনে বাধা সনাক্ত করতে পারে এবং সংঘর্ষ এড়িয়ে যেতে পারে।
এ বছরের শুরুর দিকে গাড়ি নির্মাতা নিশান সৌর শক্তি চালিত একটি রোবট তৈরি করে যেটি জিপিএস এবং ওয়াইফাই রয়েছে। ডাক নামের ওই বাক্স আকৃতির রোবটটি বন্যার শিকার হওয়া ধান ক্ষেতে ঢুকে পানি নিষ্কাশন, কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস আর পরিবেশগত প্রভাব নির্ণয়ে সহায়তা করেছে।
কম মানুষকে নিয়ে খামারের কাজ
প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে জাপানের সরকার তরুণ প্রজন্মকে আকর্ষিত করতে চায়, যাদের সরাসরি কৃষি ক্ষেতে কাজ করার আগ্রহ নেই, কিন্তু প্রযুক্তিতে দক্ষতা রয়েছে।
এটি আসলে অর্থনীতির এমন একটি খাতকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা, যেখানে শ্রম শক্তি হারিয়ে যেতে বসেছে।
গত এক দশকে জাপানে কৃষিকাজের সাথে জড়িত জাপানির সংখ্যা বাইশ লাখ থেকে কমে সতেরো লাখে দাঁড়িয়েছে।
আরো জটিল ব্যাপার হলো, এখন একজন কৃষকের গড় বয়স হলো ৬৭ বছর এবং বেশিরভাগ খামারি খণ্ডকালীন কাজ করেন।
জমির সংকট জাপানের কৃষিকাজের আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা, যেখান থেকে দেশটির মোট খাদ্য চাহিদার মাত্র চল্লিশ শতাংশ এসে থাকে।
দেশটির প্রায় ৮৫ শতাংশ জমি হচ্ছে পাহাড়ি। চাষযোগ্য বেশিরভাগ জমিতে ধান চাষ করা হয়।
ধান জাপানের প্রধান খাদ্য এবং এটি চাষের জন্য ধানচাষীদের ভর্তুকি দিয়ে থাকে সরকার।
কিন্তু মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলে গেছে।
আকাশ থেকে ছিটানো
১৯৬২ সালে একজন জাপানি বছরে ১১৮ কেজি চাল খেতেন। ২০০৬ সালে সেটি নেমে দাঁড়িয়েছে ৬০ কেজিতে। এর ফলে জাপানের কৃষিকাজেও ধানের বাইরে গিয়ে বৈচিত্র্য আনার উদ্যোগ শুরু হয়েছে।
কিন্তু শ্রমিক সংখ্যা কম থাকায় জাপানের কৃষকদের যন্ত্র এবং জৈবপ্রযুক্তির দ্বারস্থ হতে হচ্ছে।
চালক বিহীন যান বা ড্রোনের মাধ্যমে আকাশ থেকে বীজ বা কীটনাশক জমিতে ছিটিয়ে দেয়া হচ্ছে। একটি ড্রোন যা মাত্র আধঘণ্টা করতে পারে, একজন মানুষের হয়তো সেটা করতে পুরো একটি দিন লাগবে।
উন্নত প্রযুক্তির ফলে এমনকি জমি ছাড়াই ফসলের বিস্তৃতিও ঘটানো যায়।
গ্রিনহাউজ প্রযুক্তি এবং জল-চাষ প্রযুক্তি (যাতে মাটির পরিবর্তে খনিজ সমৃদ্ধ পানিতে উদ্ভিদ চাষ করা হয়) প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাপান ফলমূল এবং সবজি উৎপাদন করছে।
চিবার একটি প্রতিষ্ঠান, মিরাই গ্রুপ মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত তাক তাক করে খাদ্যশস্য উৎপাদন শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে প্রতিদিন ১০ হাজার লেটুস সংগ্রহ করছে।
প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় এভাবে প্রায় একশোগুণ বেশি ফসল পাওয়া যায়।
একটি সেন্সর যন্ত্রের মাধ্যমে কোম্পানি কৃত্রিম আলো, তরল পুষ্টি, কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা এবং তাপমাত্রা পরিমাপ করতে পারে।
কৃত্রিম আলো এসব উদ্ভিদকে দ্রুত বেড়ে উঠতে সাহায্য করে এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা রোগবালাইয়ের সম্ভাবনা দূর করে দেয়।
তবে অতিরিক্ত শক্তি খরচের পরেও, জাপানে এ ধরণের ‘ উদ্ভিদ কারখানা গত এক দশকে তিনগুণ বেড়ে গেছে। বর্তমানে এরকম দুইশো প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
বিশ্ব বাজারে বর্তমানে জল-চাষ প্রযুক্তিতে দেড়শ কোটি ডলারের ব্যবসা হচ্ছে। কিন্তু পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অ্যালিয়েড মার্কেট রিসার্চ ভবিষ্যতবাণী করেছে যে, ২০২৩ সাল নাগাদ এই বাজারের আকার দাঁড়াবে ছয়শ চল্লিশ কোটি ডলারে।
প্রযুক্তির হস্তান্তর
জাপান প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে আফ্রিকান দেশগুলোর বার্ষিক ধান উৎপাদনের হার দ্বিগুণ করে বছরে পাঁচ কোটি টনে নিয়ে যাওয়া হবে। এজন্য বেশ কিছু প্রকল্পও গ্রহণ করা হচ্ছে।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সেনেগালে জাপান কৃষি প্রযুক্তি প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করেছে এবং সেচ বিষয়ক প্রযুক্তি হস্তান্তর করেছে।
ফলে, দেশটিতে প্রতি হেক্টরে ধানের উৎপাদন চার টন থেকে বেড়ে সাত টন হয়েছে এবং কৃষকদের আয় বিশ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাপানের কৌশল হলো, বেসরকারি বিনিয়োগ বিস্তারে সহায়তা করা এবং আফ্রিকা মহাদেশে টেকসই কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবসা বিস্তৃত করা।
ভিয়েতনাম, মিয়ানমার এবং ব্রাজিলের সঙ্গেও দেশটির সহযোগিতার নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
কিন্তু জাপানের কৃষি বিপ্লবের আসল উদ্দেশ্য হলো নিজেদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ২০৫০ সালের মধ্যে দেশটি মোট খাদ্য চাহিদার অন্তত ৫৫ শতাংশ নিজেরা উৎপাদন করতে চায়।
আর সেটি তারা প্রযুক্তির সহায়তায় বাস্তবায়ন করতে চায়।
বাংলাদেশ
পঞ্চাশে বাংলাদেশ: এক টেলিভিশন তারকা আর দরিদ্র কৃষকের সন্তান এক বিজ্ঞানী যেভাবে পাল্টে দিয়েছেন বাংলাদেশের কৃষি – দা এগ্রো নিউজ
শাইখ সিরাজ
বাংলাদেশে আধুনিক কৃষি প্রচলনের প্রথম চেষ্টা হয়েছিল কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে, ষাটের দশকে। এটির প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খানের উদ্যোগে জাপান থেকে আনা উন্নত জাতের একটি ধানের পরীক্ষামূলক চাষের উদ্যোগ নেয়া হলো। কিন্তু এই ধানের চাষের জন্য কৃত্রিম সেচের দরকার হবে। গ্রামে সেজন্য গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছিল।
“নলকূপ দিয়ে যখন মাটির নীচ থেকে পানি তোলা হচ্ছিল, তখন গ্রামের কিছু মানুষ ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তারা এটিকে দেখেছিল আল্লাহর ওপর খবরদারি হিসেবে। বুঝতেই পারছেন কৃষিতে নতুন প্রযুক্তি বা ধ্যানধারণার ব্যাপারে শুরুতে বাংলাদেশের কৃষকের মনোভাব কেমন ছিল”, বলছিলেন শাইখ সিরাজ, বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় এক টেলিভিশন উপস্থাপক।
হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে, জলপাই সবুজ রঙের ট্রেডমার্ক শার্ট পরে ক্যামেরা হাতে শাইখ সিরাজ এখন বাংলাদেশের যেখানেই যান, সেখানেই তাকে কৃষকরা সাদরে বরণ করে নেন।
কিন্তু যখন তিনি প্রথম রাষ্ট্রায়ত্ব বাংলাদেশ টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন, তখন পরিস্থিতি ছিল একেবারেই প্রতিকূল।
“তখন আমরা যেসব বিশাল ক্যামেরা নিয়ে গ্রামে যেতাম, সেগুলো দেখে লোকে ভয় পেত। তারা ভাবতো এটা বুঝি কামান। মাইক্রোফোনকে ভাবতো বন্দুকের নল। গ্রামগুলো আর্থ সামাজিক দিক দিয়ে তখন এতটাই পিছিয়ে। ক্যামেরার সামনে লোকজনকে কথা বলানো কঠিন ছিল, এতটাই লাজুক তখন গ্রামের মানুষ,” তিনি বলেন।
‘মাটি ও মানুষ’
বাংলাদেশের কৃষিতে গত কয়েক দশকে যে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে, শাইখ সিরাজকে বর্ণনা করা হয় সেই পরিবর্তনের পেছনে অন্যতম প্রধান এক চরিত্র হিসেবে।
বাংলাদেশে যখন বিজ্ঞানীরা একের পর এক নতুন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করে চলেছেন, কৃষিতে নতুন ধ্যান ধারণা এবং কৌশল চালুর জন্য সরকারের নানা পর্যায় থেকে চেষ্টা চলছে, সেগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে বিরাট ভূমিকা রাখে তার কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান, ‘মাটি ও মানুষ।’
“শুরুতে এই অনুষ্ঠানটা হতো আমার দেশ নামে। তখন এটি ৫০ মিনিটের পাক্ষিক অনুষ্ঠান। পরে এটিকেই ‘মাটি ও মানুষ’ নামে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করি। আমার মনে হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের চেয়ে বেশি দরকার শিক্ষামূলক মোটিভেশনাল অনুষ্ঠান। কৃষকদের যদি নতুন বীজ, নতুন প্রযুক্তি, নতুন কৌশল, এসব ঠিকমত বোঝানো যায়, তাহলে কৃষিতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব।”
গত চার দশক ধরে শাইখ সিরাজ হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে কৃষি বিষয়ক তথ্যের প্রধান উৎস। উনিশ’শ আশির দশকে, যখনো টেলিভিশন ঘরে ঘরে পৌঁছায়নি, তখনো গ্রামের হাটেবাজারে, কমিউনিটি সেন্টারে প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় ‘মাটি ও মানুষ’ দেখার জন্য ভিড় করতো মানুষ।
তবে কৃষকদের নতুন ধরণের কৃষিতে উৎসাহিত করার কাজটা সহজ ছিল না।
“আজকের কৃষক এবং তিরিশ বছর আগের কৃষকের মধ্যে তফাৎ আকাশ আর পাতাল। তখন কৃষকের কাছে একজন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা যে কথা বলতেন, একজন টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে আমি যেকথা বলতাম, সেটা তারা মানতে চাইতো না। তারা ভাবতো, আমরা যেধরণের কৃষির কথা বলছি, যদি সেটাতে ভালো ফসল না হয়? এ কারণে সে সহজে মোটিভেট হতে চাইতো না। সহজে নতুন প্রযুক্তি নিতে চাইতো না।”
“আমি যখন আশির দশকে উচ্চফলনশীল নতুন জাতের ধানের কথা বলছি, গমের কথা বলছি, তখন পরিস্কার তারা আমাকে বলতো এই রাবার ভাত খাবো না। তখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধানের মান তেমন ভালো ছিল না। ভাতটা ছিল রাবারের মতো, ভাতের দানা উপর থেকে থালার উপর ফেললে সেটি রাবারের মতো ড্রপ করতো।”
কিন্তু বিজ্ঞানীরা যখন তাদের গবেষণায় নতুন নতুন সাফল্য পাচ্ছিলেন, আর সেই সঙ্গে শাইখ সিরাজও তার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকদের মন জয় করার জন্য নতুন কৌশল নিচ্ছিলেন।
ভাষার পরিবর্তন
“তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে প্রমিত উচ্চারণে কথা বলতে হতো। আমি বুঝতে পারছিলাম গ্রামের মানুষের সঙ্গে আমার একটা দূরত্ব থেকে যাচ্ছিল। কৃষক আমার কথা কিছু বুঝতে পারছে, কিছু বুঝতে পারছে না। অন্যদিকে আমি যখন কৃষকের সঙ্গে কথা বলছি, সেও নিজেকে প্রকাশ করতে পারছে না,” তিনি বলেন।
টেলিভিশন অনুষ্ঠানে শাইখ সিরাজ তার মুখের ভাষায় পরিবর্তন আনলেন, গ্রামের মানুষের সঙ্গে তাদের কথ্য ভাষার ব্যবহার শুরু করলেন। পরিবর্তন এলো তার পোষাকেও। কেতাদুরস্থ শহুরে পোষাকের জায়গা নিল তার এখনকার ট্রেডমার্ক জলপাই রঙা শার্ট।
টাঙ্গাইলের এক গ্রামে ঝকঝকে নতুন টিনের চালার এক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে শহর থেকে আসা কজন মানুষ। ফসলের মাঠ ঘুরে দেখে এসে ক্লান্ত হয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন। স্থানীয় জাতের চামারা ধানের জায়গায় উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান-চাষ শুরু হওয়ার পর এলাকাটির অবস্থা কী, সেটা দেখতে গেছেন তারা।
শহুরে মানুষ দেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলেন গৃহস্থ। জানতে চাইলেন, আপনারা কারা।
“আমরা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের লোক,” জানালেন তারা।
“এরপর যা ঘটলো তার জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না”, বলছিলেন ডঃ এম এ সালাম, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক বিজ্ঞানী।
“লোকটি খুশিতে চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বললো, আল্লাহ আপনাদের ফেরেশতা হিসেবে পাঠিয়েছেন। আমরা হতচকিত। কী ঘটছে বুঝতে পারছি না।”
ঘটনাটি ১৯৯৬ সালের। যমুনা সেতু নির্মাণের জন্য যে নদী শাসন করা হয়েছে, তার ফলে এলাকাটি তখন বন্যামুক্ত। আগে সেখানে চাষ হতো কেবল স্থানীয় জাতের চামারা ধান, যেটি বন্যার পানির সঙ্গে বাড়ে, তিন-চার ফুট পানিতেও চাষ করা যায়। কিন্তু ফলন হতো খুব কম। বন্যামুক্ত এলাকায় সেই প্রথম কৃষকরা উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ শুরু করেছেন।
সেই কৃষক এরপর ডঃ সালাম এবং তার সহকর্মীদের হাত ধরে টানতে টানতে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলেন। বললেন, “এই যে টিনের চালার বাড়ি দেখছেন, এটা আমি ধান বিক্রির টাকায় করেছি। আমার চৌদ্দ পুরুষ কুঁড়েঘরে থাকতো। চামারা ধান চাষ করে আমাদের দিন চলতো খেয়ে-না খেয়ে। এখন দেখেন আমার কত ধান। আপনারা আমাদের জীবন বদলে দিয়েছেন।”
একজন সফল ধান বিজ্ঞানী হিসেবে কয়েক দশকের দীর্ঘ কর্মজীবনে এটি ডঃ সালামের সবচেয়ে মধুর স্মৃতিগুলোর একটি।
“আউশ, আমন এবং বোরো- এই তিন মৌসুম মিলে এখন আমাদের দেশে মোট ১১ হতে সাড়ে ১১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে চাষ হয়। এখন গড়ে আমরা প্রতি হেক্টরে চার টন ফলন পাই। যার ফলে এখন আমরা ধান উৎপাদনে উদ্বৃত্তে এসেছি। তা না হলে, আমরা যদি প্রতি হেক্টরে দেড় হতে দুই টন ফলনে থেকে যেতাম, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষকে খাওয়ানো-পরানো অসম্ভব ছিল,” বলছিলেন তিনি।
দুর্ভিক্ষের স্মৃতি
ময়মনসিংহ শহর থেকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী পেরিয়ে চর ইশ্বরদিয়া গ্রাম। উনিশ’শ চুয়াত্তর সালের শরৎকালে বাংলাদেশ যখন তার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর এক খাদ্য সংকটের মোকাবেলা করছে, তখন সেই গ্রামেও হানা দিয়েছে তীব্র অভাব।
চর ইশ্বরদিয়ার রশিদা তখন কিশোরী। প্রতিদিন খাবারের জন্য তাকে লাইনে দাঁড়াতে হতো বাড়ির কাছের এক লঙ্গরখানায়।
“লাইনে দাঁড়াইলে কোনদিন রুটি দিত, কোনদিন গোলা আটা দিত। অভাব চলছে মনে করেন প্রায় বছরখানিক। চাউল থাকলেও আমরা কিন্যা আইনা খাওনের মতো সামর্থ্য আছিল না। ফরে আটা আইন্যা খাই, আলু আইন্যা খাই। কোনদিন না খাইয়া থাকি। কোনদিন মনে করেন কচুর শাক তুইল্যা খাই। এইরকম কইরা দিন কাটাইছি।”
এম এ সালাম তখন চর ঈশ্বরদিয়া থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। লজিং থাকেন যে পরিবারের সঙ্গে, তাদের আর্থিক অবস্থাও খুবই খারাপ।
“ওরা তখন যা করছিল, সেটা আমি কোনদিন ভুলিনি। প্রতিদিন তারা কষ্ট করে হলেও আমাকে ভাত খেতে দিত, কিন্তু তারা নিজেরা জাউ খেয়ে থাকতো। এত ভালোবাসতো ওরা আমাকে।”
এম এ সালাম স্বপ্ন দেখছিলেন একজন কৃষি বিজ্ঞানী হওয়ার। অল্প বয়সে তার মধ্যে এই স্বপ্ন উস্কে দেন দরিদ্র কৃষক পিতা।
“আমি যখন ক্লাশ থ্রীতে পড়ি, তখন একদিন ধান কাটার মওসুমে আমার বাবার সঙ্গে আমি গরুর গাড়িতে করে মাঠে গেছি ধান তুলতে। কিছুক্ষণ পর আমার গাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। তখন আমার বাবা বলছে, দ্যাখো বাবা, কৃষিকাজ কত কঠিন। কত পরিশ্রমের। তুমি যদি লেখাপড়া শিখতে পারো, তাহলে তোমার এই পরিশ্রম করা লাগবে না। তুমি ভালো থাকবে, আমরাও ভালো থাকবো,” শৈশবের কথা বলতে গিয়ে ডঃ সালামের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে।
ডঃ এম এ সালাম এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে কৃতি ধানবিজ্ঞানীদের একজন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে যত রকমের উন্নত জাতের ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে, তার অন্তত ২০টির গবেষণায় সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি।
তাদের উদ্ভাবন পাল্টে দিয়েছে বাংলাদেশের কৃষি। ঢাকার গুলশানে যে প্রতিষ্ঠানে তিনি এখন নতুন গবেষণায় নিয়োজিত সেখানে বসে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে।
উনিশ’শ সাতাত্তর সালে যখন তিনি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে যোগ দিলেন, তখন দুর্ভিক্ষ পরবর্তী বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, কীভাবে এই দেশটির বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যের সংস্থান করা যায়।
“তখন বাংলাদেশে একজন মানুষ হয়তো সারাদিনে একবারই খায় এবং সেটা হয়তো এক সের চালের ভাত। ভাতই তার প্রোটিন, ভাতই তার ভিটামিন, এটাই তার সবকিছু। বাংলাদেশ ধানের দেশ। অথচ কী দুর্ভিক্ষ আমাদের, কী করুণ অবস্থা।”
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের সামনে তখন বড় চ্যালেঞ্জ কীভাবে ধানের উৎপাদন বাড়ানো যায়।
“আমি যখন কাজে যোগ দিলাম, তখন আমাদের সিনিয়র বিজ্ঞানীরা বললেন, আমাদেরকে এটা করতেই হবে। আমাদেরও প্রতিজ্ঞা, এই দেশকে আমরা বদলে দেব।”
বিআর-৩ বিপ্লব
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর শুরুর দিকে একটি মাত্র উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ হচ্ছিল পরীক্ষামূলক ভাবে, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত ইরি-৮।
কিন্তু বাংলাদেশে এই জাতটির চাষের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা ছিল এটির জীবনকাল ছিল বেশ দীর্ঘ। তা ছাড়া বোরো মওসুমে চাষ করতে হলে জমিতে সেচের দরকার ছিল, তখনো বাংলাদেশে আধুনিক সেচের পদ্ধতি গড়ে উঠেনি।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা তখন ইরি-৮ এর সঙ্গে বাংলাদেশের একটি স্থানীয় জাতের লতিশাইল ধানের সংকর ঘটিয়ে উদ্ভাবন করলেন নতুন জাত বিআর-৩, যেটির আরেক নাম ছিল বিপ্লব।
কিন্তু এটিও ধান চাষে প্রত্যাশিত সাফল্য আনতে ব্যর্থ হলো।
“মূল সমস্যা হলো ফটো পিরিয়ড সেনসিটিভিটি, অর্থাৎ আলোক সংবেদনশীলতা। বাংলাদেশে রোাপা আমন মওসুমে যত স্থানীয় জাতের ধান লাগানো হতো, তার সবগুলোই ছিল আলোক সংবেদনশীল। যার ফলে এগুলো মাঠে লাগানোর পর হতে ধান কাটার আগে পর্যন্ত সময়টা ছিল অনেক দীর্ঘ। আমাদের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ হলো, কীভাবে স্থানীয় জাতের ধানগুলো থেকে আমরা আলোক সংবেদনশীলতা তুলে নিতে পারি।”
উনিশ’শ পঁচাশি সালে এম এ সালাম ঠিক এই ফটো পিরিয়ড সেনসিটিভিটি বা আলোক সংবেদনশীলতা নিয়ে পিএইচডি করতে গেলেন ফিলিপিন্সে। ফিরে এলেন ১৯৮৮ সালে।
“এবার আমাদের চেষ্টা শুরু হলো কীভাবে স্থানীয় জাতের ধান থেকে আমরা ফটো পিরিয়ড সেনসিটিভিটি আলাদা করতে পারি। এটা যদি করা যায়, এই ধানের চাষ তিন মাসেই করা সম্ভব। এটার বিজ্ঞান আমাদের জানা। এটা পিউর জেনেটিক্স।”
ব্রি-২৯ ঘটালো বিপ্লব
ধান গবেষণায় বাংলাদেশে ধীরে ধীরে সাফল্য আসতে শুরু করলো। একের পর এক উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের প্রচলনের ফলে বাড়তে শুরু করলো খাদ্য উৎপাদন। সবচেয়ে বড় সাফল্য আসলো নব্বুই এর দশকের মাঝামাঝি। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন ব্রি-২৮ এবং ব্রি-২৯ অবশেষে বিপ্লব ঘটিয়ে দিল।
“বাংলাদেশে এখন বছরে যত ধান উৎপাদন হয়, তার অর্ধেক আসে কেবল এই দুটি উফশী জাতের ধান থেকে। ব্রি-২৮ থেকে প্রতি হেক্টরে পাঁচ টন পর্যন্ত ফলন হয়। আর ব্রি-২৯ থেকে প্রতি হেক্টরে ফলন পাওয়া যায় ছয় টন পর্যন্ত। এটা প্রমানিত।”
ডঃ সালাম এ পর্যন্ত যত জাতের ধান গবেষণায় জড়িত ছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম সফল একটি উদ্ভাবন হচ্ছে ব্রি-৫০। ২০০৮ সালে উদ্ভাবিত এই জাতটির জনপ্রিয় নাম বাংলামতি। এই সুগন্ধি জাতের চালের মান অনেকটা বাসমতির মতো।
ধান গবেষণায় তার অবদানের জন্য ডঃ এম এ সালাম ২০০৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রাইস কংগ্রেসে সেরা বিজ্ঞানীর পুরস্কার পান।
ইসলাম
সিরিয়ার বিখ্যাত যে মসজিদে ঈসা (আ.)-এর আগমন ঘটবে – দা এগ্রো নিউজ
হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ। এটি মুসলিম বিশ্বের বৃহদায়তনের প্রাচীনতম মসজিদগুলোর একটি। উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদ এই মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু করেন এবং ৭১৫ খ্রিস্টাব্দে তা সম্পন্ন হয়। খ্রিস্টান ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে এই মসজিদের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে।
হাদিসের বর্ণনা অনুসারে এই মসজিদে কিয়ামতের আগে ঈসা (আ.) আগমন করবেন এবং পৃথিবী থেকে জুলুমের অবসান ঘটাবেন। এ ছাড়া এই মসজিদের সঙ্গে কারবালার ময়দানে শহীদ হুসাইন বিন আলী (রা.) এবং কারবালার ময়দানে বন্দি যোদ্ধাদের নানা স্মৃতি সংরক্ষিত আছে। মসজিদের পাশেই একটি বাগানে শায়িত আছেন ক্রুসেড বিজয়ী মুসলিম শাসক সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি (রহ.)। তিনি খ্রিস্টানদের কাছ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধার করেন।
ধর্মীয় তীর্থ হিসেবে এই স্থানের ইতিহাস আরো প্রাচীন। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুসারে, লৌহ যুগে অ্যারামিয়ানরা এখানে দেবতা হাদাদের মন্দির নির্মাণ করে। ৬৪ খ্রিস্টাব্দে রোমান শাসকরা সেই মন্দির ভেঙে নির্মাণ করেন দেবতা জুপিটারের মন্দির। খ্রিস্টান বাইজেন্টাইনরা দামেস্ক জয় করার পর জুপিটারের মন্দির ভেঙে নির্মাণ করেন জন দ্য ব্যাপ্টিস্টের গির্জা ও ক্যাথেড্রাল।কোনো ঐতিহাসিকের মতে, জন হলেন কোরআনে বর্ণিত নবী ইয়াহইয়া (আ.)।
৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ দামেস্ক জয় করার পর ক্যাথেড্রালের ছোট একটি অংশে মুসলমানদের নামাজ পড়ার স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর খলিফা আল ওয়ালিদ ক্যাথেড্রালের বেশির ভাগ অংশ নিয়ে একটি বৃহৎ আয়তনের মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। বিনিময়ে তিনি শহরের অন্য গির্জাগুলো খ্রিস্টানদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। ক্যাথেড্রালের পূর্ব অংশে খ্রিস্টানদের প্রার্থনার সুযোগ রাখা হয়।
প্রায় ৯ বছর কাজ করার পর ৭১৫ খ্রিস্টাব্দে খলিফা সুলাইমান ইবনে আবদুল মালিকের যুগে মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ঐতিহাসিক ইবনুল ফকিহের বর্ণনা অনুসারে, উমাইয়া মসজিদের নির্মাণকাজে ৬ থেকে ১০ লাখ স্বর্ণ মুদ্রা ব্যয় করা হয়। এতে পারস্য, ভারত, গ্রিক ও মরক্কোর প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক কাজ করে। খলিফা ওয়ালিদ মোজাইকের কাজের জন্য ২০০ সুদক্ষ বাইজেন্টাইন শ্রমিক নিযুক্ত করেন। মসজিদের মার্বেল পাথর এবং ৪৩ হাজার বর্গফুটের সোনালি মোজাইক বিস্ময়কর সৌন্দর্যের জন্ম দিয়েছিল।
পরবর্তী যুগের সব মুসলিম শাসকই উমাইয়া মসজিদের উন্নয়ন ও সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। যেমন—আব্বাসীয় আমলে ‘কুব্বাতুল খাজানা’ (ধনভাণ্ডারের গম্বুজ) এবং ‘মিনারেত অব দ্য ব্রাইড’ নির্মাণ করেন। সেলজুক আমলে মসজিদে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে রাজা তুতুশ এটির পুনর্নির্মাণ করেন।
মামলুক সুলতান কাইতবাই নিজের নামানুসারে উমাইয়া মসজিদে কাতিবাই মিনার স্থাপন করেন। এ ছাড়া মামলুক সুলতানরা মসজিদের বিভিন্ন অংশ মার্বেল পাথর দ্বারা সুশোভিত করেন। উসমানীয় সুলতান প্রথম সেলিম উমাইয়া মসজিদের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ওয়াকফ করেন। সেই ওয়াকফ সম্পদ পরিচালনার জন্য ৫৯৬ জন কর্মী নিযুক্ত করা হয়। সিরিয়ার সাবেক স্বৈরশাসক হাফেজ আল-আসাদ দীর্ঘ সংস্কারকাজের মাধ্যমে উমাইয়া মসজিদের উমাইয়াশৈলী ফিরিয়ে আনেন।
উমাইয়া মসজিদের আয়তন দৈর্ঘে ৩১৮ ফুট এবং প্রস্থে ৫১২ ফুট। মসজিদ কমপ্লেক্সের উত্তরাংশজুড়ে আছে বিশাল আঙিনা এবং দক্ষিণাংশকে বলা হয় হারাম বা পবিত্র সীমানা। পুরো মসজিদ কমপ্লেক্স পাথরের সীমানাপ্রাচীর দ্বারা সংরক্ষিত। সীমানাপ্রাচীরে একাধিক তোরণ আছে। দেয়ালের প্রতিটি দুই কলামের মধ্যে আছে একটি জোড় স্তম্ভ।
মসজিদের প্রধান নামাজ কক্ষে আছে তিনটি তোরণ। মূল প্রার্থনা কক্ষের ওপর মসজিদের সর্ববৃহৎ গম্বুজ ‘কুব্বাতু নিসর’ (ঈগল গম্বুজ) স্থাপিত। আগে এটি কাঠের তৈরি ছিল। ১৮৯৩ সালে এক অগ্নিকাণ্ডে তা ধ্বংস হয়ে গেলে পাথরের গম্বুজ নির্মাণ করা হয়। ঐতিহাসিক উমাইয়া মসজিদে মোট তিনটি মিনার রয়েছে। তা ভিন্ন ভিন্ন তিন সময়ে নির্মাণ করা হয়েছে।
নিম্নে মিনারগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেওয়া হলো—
১. মানারাতে আরুস : যাকে ইংরেজিতে মিনারেত অব দ্য ব্রাই বলা হয়। এটিই মসজিদের প্রথম মিনার এবং তা উত্তর দিকের দেয়ালে অবস্থিত।
২. মিনারাতে ঈসা : এই মিনারটি মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এর উচ্চতা ২৫৩ ফুট। মিনারটি আব্বাসীয় আমলে নির্মিত। তবে বর্তমান কাঠামোটি ১২৪৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করা হয়।
৩. মিনারাতে গারবিয়্যা : এটি পশ্চিম মিনার বা কাতিবাই মিনার নামেও পরিচিত। মামলুক সুলতান কাইতবাই ১৪৮৮ খ্রিস্টাব্দে মিনারটি নির্মাণ করেন।
সূত্র : আর্কনেট ডটঅর্গ, স্টাডি ডটকম ও উইকিপিডিয়া
বীজ পরিচর্যা করবেন কিভাবে: বীজ পরিচর্যার গুরুত্ব ও উন্নত ফলনের জন্য সঠিক পদ্ধতি – দা এগ্রো নিউজ
মাছ চাষে স্মার্ট প্রযুক্তির উদ্ভাবন বাংলাদেশি তরুণের – দা এগ্রো নিউজ
স্মার্ট এরিয়েটর এর সাথে অটো ফিডিং সিস্টেম – লাভজনক মাছ চাষ করার প্রযুক্তি – দা এগ্রো নিউজ
ফাতেমা ধান’ চাষে বাম্পার ফলন – দা এগ্রো নিউজ
ফল বাগানে সঠিক স্প্রে যন্ত্রের ব্যবহার – দা এগ্রো নিউজ
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন