মৎস্য
দুষ্প্রাপ্য মাছ ‘বাচা’
বর্তমানে বাংলাদেশে মহাসংকটাপন্ন এবং বিলুপ্তপ্রায় মাছ বাচা। আমাদের দেশে স্বাদু পানি বা মিঠাপানির মাছ রয়েছে প্রায় ২৯৬ প্রজাতির। শিং-মাগুর-কই, চেলা-ঢ্যালা-মলা, পুঁটি-খলিশা-টাকিসহ দেশীয় আনুমানিক ২৬০ প্রজাতির মাছ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়গুলোতে এখনো বিচরণ করছে বা এগুলোর চাষাবাদ চলছে। দেশীয় এই প্রজাতিগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি বিপন্ন অবস্থায়, কোনো কোনো প্রজাতি সংকটাপন্ন অবস্থায় আর কিছু প্রজাতি রয়েছে একেবারে মহাবিপন্ন অবস্থায়। বিগত ৩০–৪০ বছরের মধ্যে চন্দনবাউশ, নান্দিল, অ্যালং, বাইটক্যা ইত্যাদি অতি উৎকৃষ্ট স্বাদের মাছগুলো বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিলুপ্তই হয়ে গেছে।
পরিচিতি
বাচা মিঠা পানির মাছ। এ মাছ সিপ্রিনিফরমিস
বা সিলুরিফরমিস বর্গের অন্তর্ভুক্ত। একই বর্গের অন্যান্য মাছের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কাজলি, ঘাউরা, বাতাসি, শিলং ইত্যাদি।
বাচা মাছের মাথা এবং শরীর চাপা। থুতনির আগা ছুঁচালো। ওপরের চোয়াল সামান্য লম্বা, মুখের চিড় গভীর এবং চোখের নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত। দাঁত তীক্ষ্ণ এবং ধারালো। আঁশযুক্ত দাড়ি মোট ৪ জোড়া। দণ্ডযুক্ত পিঠের পাখনাটি ছোট। পিঠের কাটার পেছন দিকটি রাতের দাঁতের মতো। বুকের পাখনা শ্রেণি পাখনার কাছাকাছি। শ্রেণি পাখনা ছোট। লেজের পাখনা গভীরভাবে বিভক্ত। পিঠ ঈষৎ ধূসর হলেও মাছটির রং রুপালি। বুকের পাখনা ও লেজের পাখনার কিনারা কালো। মাছটি লম্বায় ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে।
বাচা মাছের আবাস সাধারণত নদীতে। স্রোতময় নদীর পানিতে এরা ঝাঁক বেঁধে চলাফেরা করে। মাছটি ভ্রমণপ্রিয়। মাছটি নদী থেকে প্লাবনভূমি এবং প্লাবনভূমি থেকে নদীতে বেশি আনাগোনা করতে ভালোবাসে। পানির উপরিতলেই বেশি থাকে। এরা বর্ষাকালে নদীতে প্রজনন করে। রাত্রিকালে সাধারণত খাদ্য গ্রহণ বেশি করে থাকে। খাদ্যতালিকায় রয়েছে পতঙ্গ, ছোট মাছ, শামুক ও শেওলা। বাংলাদেশের নদ–নদীগুলোর মধ্যে পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র নদে এই মাছটি বেশি দেখা যায়। কাপ্তাই হ্রদে একসময় প্রচুর পরিমাণে বাচা মাছ ছিল। বর্তমানে সেখানে প্রায় বিলুপ্তির পর্যায়ে।
আরেক জাতের বাচা রয়েছে যেটি স্থানীয়ভাবে ‘মুরি বাচা’ নামে পরিচিত। এটি অনেকটা খাটো আকারের হয়ে থাকে।
পুষ্টিমান
বাচা মাছের পুষ্টিমান উল্লেখ করার মতো।
১০০ গ্রাম বাচা মাছে জলীয় অংশ রয়েছে ৬৮.৮ গ্রাম, আমিষের অংশ রয়েছে ১৮.১
গ্রাম, চর্বি রয়েছে ৫.৬ গ্রাম, শর্করা ৬.১ গ্রাম, খনিজ পদার্থের পরিমাণ ১.৪
গ্রাম, ক্যালসিয়াম রয়েছে ৫২০ মিলিগ্রাম, লৌহ ০.৭ মিলিগ্রাম, ক্যালরি বা
খাদ্যশক্তি ১৪৭ মিলিগ্রাম এবং ভিটামিনের পরিমাণ ১৩.০ মিলিগ্রাম।
মৌসুম ও মোকাম
অভিজাত শ্রেণির মাছ বাচা। বর্ষাকাল
হচ্ছে বাচা মাছের প্রধান মৌসুম। পুরো শীতকালেও পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও
মেঘনা নদ–নদীর কাছের বাজারগুলোতে বাচা মাছের আমদানি হয়ে থাকে। বাচা মাছের
বড় মোকামগুলোর মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় রাজশাহী মহানগরীর সাহেববাজার,
সিরাজগঞ্জ বাজার, ভৈরব বাজার, চাঁদপুর বাজার, অষ্টগ্রাম, কুলিয়ারচর,
গোয়ালন্দ ঘাট, মাওয়া ঘাট ইত্যাদি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশেষ করে ভৈরব
বাজারের বিশাল মাছের আড়ত থেকে বাচা মাছের বড় চালান ঢাকার মাছের
বাজারগুলোতে আসে।
বাচা গোত্রের অন্যান্য মাছ
বাচা কিংবা মুরি বাচা
মাছের মতো আকৃতির আরেকটি মাছ রয়েছে, যার নাম শিলং। এর স্থানীয় নাম
সিলোন্দা, ধাইন, ঢাইং, সিলোং ইত্যাদি। মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম সিলোনিয়া
সিলোডিয়া এবং ইংরেজি নাম সিলোনিয়া ভাচা। এ মাছটি আকারে অনেক বড় হয়। কোনো
কোনো মাছ লম্বায় ১.৮০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। শিলং মাছের ঠোঁট লাল হয়ে
থাকে। গাত্র বর্ণ রুপালি। শিলং মাছের চোয়াল লম্বা।
বাচা, মুরি বাচা ও শিলং মাছের মতোই প্রায় দেখতে ঘাউরা মাছ (ক্লাপিজমা গারুয়া)। তবে বাচা, মুরি বাচা এবং শিলং মাছের মুখ লম্বাটে কিন্তু ঘাউরা মাছের মুখ অনেকটা চওড়া ও গোলাকার। অনেক সময় বাচা, শিলং ও ঘাউরা মাছের পার্থক্য করা কষ্টকর হয়ে ওঠে। ঘাউরা মাছের রং এবং আকৃতি বাচা মাছের মতোই। ঘাউরা মাছের পিঠে ডানা রয়েছে মাত্র একটি। বাচা ও শিলং মাছের দ্বিতীয় ডানাটি পুচ্ছ পাখনার প্রায় কাছাকাছি অবস্থানে দেখা যায়। ঘাউরা মাছের পিঠের একমাত্র ডানাটি মাথার প্রায় কাছাকাছি অবস্থানে দেখা যায়। ঘাউরার মুখ অনেকটা মোটা। বাচা, মুরি বাচা, শিলং ও ঘাউরা এই মাছগুলো কিন্তু প্রায় একই স্বাদের। চলনবিল অঞ্চলের গাঙ ঘাউরা স্বাদে অতুলনীয়। মাছগুলো কাটাবহুল নয় বলে খেতে বেশ নিরাপদ। তবে ঘাউরা মাছের খাদ্যতালিকায় নোংরা জাতীয় বস্তু থাকায় সাধারণভাবে এর কদর খুব একটা নেই।
বাচা মাছের জীবনযাত্রা
প্রখ্যাত মৎস্য বিজ্ঞানী এফ
হ্যামিলটন (১৮২২) রচিত ‘অন অ্যাকাউন্ট অব দ্য ফিশেস ফাউন্ড অন দ্য রিভার
গ্যাঞ্জেজ অ্যান্ড ইটস ব্র্যান্সেস’ নামক আকর গ্রন্থে বাচা এবং মুরি বাচা
মাছ নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। বাচা মাছ বাংলাদেশের প্রায় সব নদীগুলোতে
দেখা গেলেও মূলত এটি পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও যমুনা নদ–নদীতে বেশি দেখা
যায়। যমুনা ও পদ্মা নদীতে বর্ষার শুরুতে নতুন পানিতে মা মাছ ডিম দেয়। আবার
অনেক সময় মা মাছ ডিম দেওয়ার জন্য চলনবিলসহ বাংলাদেশের হাওর, বাঁওড় এবং
উল্লিখিত নদীগুলোর কাছাকাছি যে বিলগুলো রয়েছে, সেগুলোতে চলে যায়। একটা সময়
ছিল যখন বড়াল এবং হুড়াসাগর নদীর নাব্যতা ছিল। সে সময় বাচা মাছসহ শত শত
প্রজাতির মিঠা পানির মা মাছ কিংবা রেণু মাছ বড়াল, আত্রাই, নারদ, হুড়াসাগর
ইত্যাদি নদীর মাধ্যমে চলনবিলে প্রবেশ করত। চলনবিলে রয়েছে এ জাতীয় মাছের
বিশাল খাদ্যের ভান্ডার। সেখানে মাছগুলো বৃদ্ধি পেত। বর্ষার শেষে মাছগুলো
মূল নদীতে ফিরে যেত। বর্ষাকালে কিংবা বর্ষার শেষে বিশাল চলনবিল অঞ্চলে
অবস্থিত আত্রাই, নলডাঙ্গা, সিংড়া, গুরুদাসপুর, তাড়াশ, চাটমোহর, উল্লাপাড়া,
শাহজাদপুর, ভাঙ্গুরা, ফরিদপুর এবং সাঁথিয়া থানার হাটবাজারে বাচা মাছের
আমদানি ছিল দেখার মতো। ইদানীং তেমনটা আর নেই। হুড়াসাগর সেই কোন কালে ভরাট
হয়ে গেছে। বড়ালে ভরা বর্ষাতেও পদ্মা থেকে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে পানির প্রবাহ
দেখা করা যায় না। যমুনা থেকে মে–জুন মাসে পানি বাঘাবাড়ী হয়ে চলনবিলে প্রবেশ
করে। প্রায় একই সময়ে আত্রাই নদে দিয়ে পানি চলন বিলে আসতে থাকে। বড়াল হয়ে
নন্দকুজার মাধ্যমে পদ্মার পানি চলনবিলে প্রবেশ করতে শুরু করে জুলাই মাস
থেকে। এ সময় বাচা মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে পানিতে খেলে বেড়ায়। এরা নদী থেকে
প্লাবনভূমি এবং প্লাবনভূমি থেকে নদীতে ভ্রমণ করে। বিশাল চলনবিল এবং এর
পাশের জনপদগুলোর বিরাট একটি অংশ হচ্ছে পদ্মা, যমুনা ও আত্রাই নদের
প্লাবনভূমি। বিগত দেড় যুগ থেকে নদীতে পানিই নেই, তাই প্লাবনও নেই। নদী ভরাট
হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত মাত্রায় ফসলের খেতে কীটনাশক প্রয়োগ ইত্যাদি কারণে
মাছের আবাস নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে অনেক দেশীয় মাছের মতো বাচা মাছও বিলুপ্তির
পথে।
বাচা মাছের মতো বিলুপ্তপ্রায় অতুলনীয় স্বাদের মাছের প্রজাতি রক্ষার জন্য আমাদের সবাইকে হতে হবে সচেতন। শুধু নির্দিষ্ট বিভাগের লোকজনের ওপর এর দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে দেশের সচেতন নাগরিকদের দায়িত্ব শেষ হয়েছে বলে আমরা ভাবতে পারি না। এই দুর্লভ এবং দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির মাছগুলো আমাদের অমূল্য সম্পদ এবং ঐতিহ্য। আমাদের অবহেলার কারণে বেশ কিছু স্বাদু পানির মাছকে আমরা চিরদিনের জন্য হারিয়েছি। আমাদের নতুন প্রজন্মকে শুধু গল্পের মাধ্যমে বিলুপ্ত মাছের কথা জানাচ্ছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা আর বিলুপ্ত মাছের কাহিনি শোনাতে চাই না।
মৎস্য
খাঁচায় মাছ চাষ

আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে খাঁচায় মাছ চাষ নতুন আঙ্গিকে শুরু হলেও বিশ্ব অ্যাকুয়াকালচারে খাঁচায় মাছ চাষের ইতিহাস অনেক পুরোনো। খাঁচায় মাছ চাষ শুরু হয় চীনের ইয়াংঝি নদীতে আনুমানিক ৭৫০ বছর আগে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার কারণে আধুনিক কালে খাঁচায় মাছ চাষ ক্রমাগতভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিভিন্ন ধরনের জলাশয়ে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ উপযোগী আকারের খাঁচা স্থাপন করে অধিক ঘনত্বে বাণিজ্যিক ভাবে মাছ উৎপাদনের প্রযুক্তি হলো খাঁচায় মাছ চাষ।
বাংলাদেশে খাঁচায় মাছ চাষের সূচনাঃ
অতীতে আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে খাঁচায় মাছ চাষের উদ্যোগ নেয়া হলেও সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদপুর জেলার ডাকাতিয়া নদীতে থাইল্যান্ডের প্রযুক্তি অনুকরণে খাঁচায় মাছ চাষ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ উদ্যোগের অগ্রপথিক হলেন কুমিল্লার শিল্প নগরী এলাকায় (বিসিক) অবস্থিত জাল ও সুতা ফ্যাক্টরী “ফরিদ ফাইবার এন্ড উইভিং লিমিটেড” এর সত্বাধিকারী জনাব মো: বেল্লাল হোসেন। ২০০২ সাল থেকে শুরু করে মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে বর্তমানে চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদী ও লক্ষীপুর জেলায় মেঘনা নদীর রহমতখালী চ্যানেলে যথাক্রমে সাড়ে চারশত এবং পাঁচশত খাঁচায় মনোসেক্স তেলাপিয়া করা হচ্ছে; যা থেকে উৎপাদিত হচ্ছে বছরে ৭০০ মেঃ টন রপ্তানিযোগ্য তেলাপিয়া। বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে সফলতার সাথে খাঁচায় মাছ চাষের এ অধ্যায় শুরু হয় চাঁদপুর জেলার ডাকাতিয়া নদীতে। এজন্য এখানকার ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন মডেলকে “ডাকাতিয়া মডেল” নামে অভিহিত করা হয়।
খাঁচায় মাছ চাষে সুবিধা:
- ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ করলে পুকুরের ন্যায় জলাশয়ের প্রয়োজন হয় না।
- প্রবাহমান নদীর পানিকে যথাযথ ব্যবহার করে মাছ উৎপাদন বাড়ানো যায়।
- মাছের বর্জ্য প্রবাহমান পানির সাথে অপসারিত হয় বিধায় পানিকে দূষিত করতে পারে না।
- মাছের উচ্ছিষ্ট খাদ্য খেয়ে নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজাতির প্রাচুর্য্য বৃদ্ধি পায়।
- প্রবাহমান থাকায় প্রতিনিয়ত খাঁচার অভ্যন্তরের পানি পরিবর্তন হতে থাকে ফলে পুকুরের চেয়ে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ করা যায়।
খাঁচা স্থাপনের উপযোগী স্থানঃ
- খাঁচা স্থাপনের জন্য উপযোগী, নদীর এমন অংশ যেখানে একমূখী প্রবাহ কিংবা জোয়ার ভাটার শান্ত প্রবাহ বিদ্যমান। নদীর মূল প্রবাহ যেখানে অত্যধিক তীব্র স্রোত বিদ্যমান সে অঞ্চলে খাঁচা স্থাপন না করায় ভাল। নদীতে প্রতি সেকেন্ডে ৪-৮ ইঞ্চি মাত্রার পানি প্রবাহে খাঁচা স্থাপন মাছের জন্য উপযোগী, তবে প্রবাহের এ মাত্রা সর্বোচ্চ সেকেন্ডে ১৬ ইঞ্চি এর বেশী না হওয়া উচিত।
- মূল খাঁচা পানিতে ঝুলন্ত রাখার জন্য নূন্যতম ১০ ফুট গভীরতা থাকা প্রয়োজন। যদিও প্রবাহমান পানিতে তলদেশে বর্জ্য জমে গ্যাস দ্বারা খাঁচার মাছের ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা কম তথাপি খাঁচার তলদেশ নীচের কাদা থেকে নূন্যতম ৩ ফুট ব্যবধান থাকা আবশ্যক।
- স্থানটি লোকালয়ের নিকটে হতে হবে যাতে সহজে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
- খাঁচা স্থাপনের স্থান থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থা সুন্দর হতে হবে যাতে সহজে উৎপাদিত মাছ বাজারজাত করা যায়।
- খাঁচা স্থাপনের কারণে যাতে কোনভাবেই নৌ চলাচলে বিঘ্ন না ঘটে এমন স্থান হতে হবে।
- সর্বোপরি খাঁচা স্থাপনের জায়গাটি এমন হতে হবে যাতে শিল্প বা কলকারখানার বর্জ্য কিংবা পয়ঃনিষ্কাশন পানি অথবা কৃষিজমি থেকে বন্যা বা বৃষ্টি বিধৌত কীটনাশক প্রভাবিত পানি নদীতে পতিত হয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে খাঁচার মাছ মারা যেতে না পারে।
ভাসমান খাঁচা তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণঃ
খাঁচা তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ এখন আমাদের দেশেই পাওয়া যায়। উপকরণ সমূহের তালিকা হলোঃ
- খাঁচা তৈরীর মূল পলিইথিলিন জাল (৩/৪ ইঞ্চি থেকে ১ ইঞ্চি মেসের)
- রাসেল নেট (খাদ্য আটকানোর বেড়া তৈরীতে)
- নাইলনের দড়ি ও কাছি
- কভার নেট বা ঢাকনা জাল (পাখির উপদ্রব থেকে রক্ষার জন্য)
- ১ ইঞ্চি জিআই পাইপ (৭০ ফুট প্রতিটি খাঁচার জন্য)
- ফ্রেম ভাসমান রাখার জন্য শূন্য ব্যারেল/ড্রাম (২০০ লিটারের পিভিসি ড্রাম, ওজন ৯ কেজি’র উর্ধ্বে)
- খাঁচা স্থির রাখার জন্য গেরাপি (অ্যাঙ্কর)
- ফ্রেমের সাথে বাঁধার জন্য মাঝারী আকারের সোজা বাঁশ (প্রয়োজনীয় সংখ্যক)
খাঁচার আকারঃ
খাঁচা তৈরির জন্য এমন জাল ব্যবহার করতে হবে যেন কাঁকড়া, গুইসাপ, কচ্ছপ ইত্যাদি ক্ষতিকর প্রাণী জালগুলো কাটতে না পারে। ডাকাতিয়া মডেলের খাঁচার জন্য সাধারণতঃ দুই আকারের জাল তৈরি করা হয়, যেমনঃ ২০ ফুটx ১০ ফুটx ৬ ফুট এবং ১০ ফুটx ১০ ফুটx ৬ ফুট। খাঁচা তৈরির জন্য জালগুলো মেস ৩/৪ ইঞ্চি থেকে ১১/৪ ইঞ্চির মধ্যে হওয়া ভাল। এতে সহজে নদীর পরিস্কার পানি প্রতিনিয়ত খাঁচার ভিতরে সঞ্চালিত হতে পারে।
ফ্রেম তৈরি ও স্থাপনঃ
খাঁচাগুলোর ফ্রেম তৈরী করতে প্রথমতঃ ১ ইঞ্চি জিআই পাইপ দ্বারা আয়তকার ২০ ফুটx ১০ ফুট ফ্রেম তৈরি করা হয়। আর মাঝে ১০ ফুট আরেকটি পাইপ বসিয়ে ঝালাই করে ফ্রেম তৈরি করা হয়। এতে একটি ফ্রেমে সরাসরি ২০ ফুটx ১০ ফুট আকারের খাঁচা বসানো যায় আবার প্রয়োজনবোধে ১০ ফুটx ১০ ফুট আকারের দু’টি খাঁচাও বসানো যায়। প্রতি দুই ফ্রেমের মাঝে ৩টি ড্রাম স্থাপন করে সারিবদ্ধভাবে ফ্রেমগুলো স্থাপন করা হয়। প্রয়োজনীয় সংখ্যক গেরাপী বা নোঙর দিয়ে খাঁচা নদীর নির্দিষ্ট স্থানে শক্তভাবে বসানো হয়। এরপর প্রতিটি ফ্রেমের সাথে পৃথক পৃথক জাল সেট করা হয়।
খাঁচায় মাছের মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণঃ
পানির স্রোত, জালের ফাঁসের আকার, পানির গভীরতা, প্রত্যাশিত আকারের মাছ উৎপাদন, খাদ্যের গুণগতমান এবং বিনিয়োগ ক্ষমতা ইত্যাদি বিবেচনা করেই মজুদ ঘনত্ব নির্ধরণ করা হয়। স্থাপিত খাঁচায় মাছের প্রজাতি ভেদে যেমন প্রতি ঘনমিটারে ৩০ থেকে ৪০টি পর্যন্ত মনোসেক্স তেলাপিয়া পোনা মজুত করা যাবে। মজুদকালে পোনার আকার এমন হতে হবে যাতে জালের মেসের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে। নূন্যতম ২৫-৩০ গ্রাম আকারের পোনা মজুত করতে হবে।
খাঁচায় সম্পূরক খাদ্য প্রদানঃ
বাণিজ্যিকভাবে খাঁচায় মাছ চাষ পরিচালনার জন্য প্রবাহমান পানিতে ভাসমান খাদ্যের বিকল্প নেই। বর্তমানে বেসরকারি উদ্যোগে মাছের খাদ্য বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করার জন্য বহু খাদ্য কারখানা স্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানি পিলেট আকারের পানিতে ভাসমান সম্পূরক খাদ্য তৈরি করে থাকে।
মাছ খাঁচায় মজুদের পর হতে বাজারজাত করার পূর্ব পর্যন্ত দৈহিক ওজনের বিবেচনায় খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা ৮ শতাংশ হতে ৩ শতাংশ এর মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। মাছের ওজন ৩০০-৫০০ গ্রাম হওয়া পর্যন্ত সম্পূরক খাদ্য প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে। বর্তমানে কারখানায় তৈরি ভাসমান খাবার ব্যবহার করে দেখা গেছে যে, মজুদ থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত ৭৫০-১০০০ গ্রাম ওজনের মাছ উৎপাদন করতে সর্বোচ্চ ১.৫ কেজি খাদ্যের প্রয়োজন হয়।
খাঁচায় মাছ বাছাইকরণঃ
সাধারণত প্রত্যাশিত উৎপাদনের জন্য খাঁচায় পোনা মজুদের তিন সপ্তাহ পর প্রথম বার খাঁচার মাছ বাছাই করতে হবে (তবে জাত ভেদে ভিন্ন সময় হতে পারে । দিনের তাপমাত্রার দিকে লক্ষ্য রেখে সকাল বেলা কিংবা পড়ন্ত বিকেলে খাঁচার মাছ বাছাই করা উচিত। যখন নদীর পানি বেশি প্রবাহমান থাকে তখন খাঁচার পানি দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। এ সময় খাঁচার মাছ বাছাই করা অধিক উপযোগী। বাজারজাত করার পূর্বে প্রয়োজন অনুসারে দুই তিনবার বাছাই করতে হবে।
বর্তমান বাজারমূল্যে ৫০টি খাঁচা স্থাপনের জন্য স্থায়ী খরচঃ
ক্রম উপকরণের নাম পরিমাণ/সংখ্যা একক মূল্য (টাকা) মোট মূল্য (টাকা)
১. সেলাই করা জাল ৫০টি ৩৫০০.০০ ১৭৫০০০.০০
২. খালি বা শূন্য ড্রাম/ব্যারেল ১৫৩টি ১৪৫০.০০ ২২১৮৫০.০০
৩. ১ ইঞ্চি জিআই পাইপ ৩৬০০ ফুট ৮০.০০ ২৮৮০০০.০০
৪. ফ্রেমের সংযোগ লৌহ ৩৫০টি ১০০.০০ ৩৫০০০.০০
৫. গেরাপী (অ্যাঙ্কর) ১২টি (২০ কেজি প্রতিটি) ২৪০০.০০ ২৮৮০০.০০
৬. গেরাপী বাঁধার কাছি ৫ কয়েল ৫০০০.০০ ২৫০০০.০০
৭. বাঁশ ১০০ টি ২০০.০০ ২০০০০.০০
৮. নাইলনের সুতা ও রাশি ৫০০০.০০
৫০ টি খাঁচার এক ফসলের উৎপাদন খরচঃ
ক্রম উপকরণের নাম পরিমাণ/সংখ্যা একক মূল্য (টাকা) মোট মূল্য (টাকা)
১. মাছের পোনা সংগ্রহ ৬০০০০ ২.০০ ১২০০০০.০০
২. মাছের খাদ্য ২৪৫০০ কেজি ২৮.০০ ৬৮৬০০০.০০
৩. শ্রমিক খরচ ছয় মাসের জন্য ৩ জন (১৮ শ্রম মাস) ৩০০০.০০ ৫৪০০০.০০
মোট ৮৬০০০০.০০
মাছের উৎপাদন (যেমন মনোসেক্স তেলাটিয়ার ক্ষেত্রে):
প্রতিটি খাঁচায় একটি ফসলে সর্বনিম্ন উৎপদন = ৩৫০ কেজি
৫০টি খাঁচায় (৩৫০x ৫০) = ১৭৫০০ কেজি
প্রতি কেজি মাছের পাইকারী বাজারমূল্য = ১০০ টাকা
মোট মাছ বিক্রয় = ১৭৫০০০০ টাকা
নিট লাভ = (১৭৫০০০০-৮৬০০০০) = ৮৯০০০০.০০ টাকা
(এখানে এককালীন স্থায়ী স্থাপনা খরচ হিসাব করা হয়নি)
উপসংহার
আমাদের দেশে প্রচুর উপযোগী নদী রয়েছে। সারা বছর খাঁচায় মাছ চাষ করে মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। আমাদের দেশে এবং বিদেশেও তেলাপিয়া মাছের প্রচুর চাহিদা আছে। আমাদের দেশের নদী কিনারায় বসবাসরত জনগণ বিশেষ করে দরিদ্র জেলেগোষ্ঠি শুধুমাত্র নদী থেকে প্রাকৃতিক মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এসব মৎসজীবীকে সংগঠিত করে মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব, সে সাথে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষ করে নদীর প্রাকৃতিক মৎস প্রজাতিগুলোর প্রজনন মৌসুমে তাদের নিবৃত্ত করে নদীর প্রাকৃতিক মাছের মজুদ বাড়ানো ও বিভিন্ন মাছের প্রজাতি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব। এশিয়ার অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও খাঁচায় উৎপাদিত মানসম্পন্ন তেলাপিয়া রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক তেলাপিয়া বাজারে প্রবেশের জন্য নীতিনির্ধারণী মহলসহ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ঠ সকলের এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন।
মৎস্য
মৎস্য হ্যাচারি ও নার্সারিতে রোগ সংক্রমণে করণীয়

অধুনা বাংলাদেশে আশাতীত দ্রুত গতিতে উন্নত প্রযুক্তির মৎস্য চাষের সম্প্রসারণ ঘটছে। পাশাপাশি মাছ চাষের জন্য মানসম্পন্ন পোনা প্রাপ্তিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্মর্তব্য যে, নব্বই দশকের শুরু থেকে এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রমান্বয়ে বিপুল সংখ্যক মৎস্য হ্যাচারি গড়ে উঠে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৭৬টি সরকারি ও ৮৪৫টি বেসরকারিসহ মোট ৯২১টি মৎস্য হ্যাচারি এবং ১০,৪০২টি নার্সারি রয়েছে। লক্ষণীয় যে, এসব হ্যাচারি ও নার্সারিতে রোগ সংক্রমণ এখন প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে এবং নানা রোগে আক্রান্ত পোনার মৃত্যু ত্বরান্বিত হচ্ছে, যা নিয়ে খামারি ও পোনা চাষিদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, অন্যান্য প্রাণির মতোই শরীরের ইমিউনসিস্টেম মাছের রোগ প্রতিরোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ইমিউনসিস্টেম পানিতে বিরাজমান রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে অবিরত যুদ্ধ করে মাছকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।
হ্যাচারি ও নার্সারিতে পোনা স্বভাবতই নাজুক অবস্থায় থাকে, ফলে অপরিপক্ব ইমিউনসিস্টেমের কারণে তারা অতিসহজেই নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া, রোগাক্রান্ত হ্যাচারি থেকে যেসমস্ত পোনা চাষের পুকুরে স্থানান্তর করা হয় তারা সেখানে রোগজীবাণু বহন করে নিয়ে আসে, যা পুকুরে মজুদকৃত মাছের পোনার অনিবার্য মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মাছের হ্যাচারি ও নার্সারিতে সাধারণত (১) ছত্রাকজনিত রোগ (২) ভাইরাসজনিত রোগ (৩) ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ (৪) পরিবেশজনিত রোগ (৫) পরজীবী ঘটিত রোগ (৬) মিক্সো সম্পরিডিয়াসিস (৭) উকুনজনিত রোগ (৮) ট্রাইকোডিনিয়াসিস ও (৯) কৃমিজাতীয় রোগ সংক্রমণ হয়ে থাকে।

ছত্রাকজনিত রোগ : ছত্রাক জনিত রোগে প্রধানত মাছের ডিম ও রেণু আক্রান্ত হতে দেখা যায়। হ্যাচারিতে ডিম স্ফুটনের সময় ছত্রাকের সংক্রমণ জটিল সমস্যার সৃষ্টি করে। প্রথমে ছত্রাকগুলো মৃত ও অনিষিক্ত ডিমগুলোর শরীরে পাকা পোক্ত স্থান করে নেয় এবং ধীরে ধীরে সুস্থ সবল ডিমগুলোর ওপর ছড়িয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে সমুদয় ডিমই ধ্বংস করে দেয়।
ডিম ধৌত করে, নষ্ট ও অনিষিক্ত ডিমগুলো সরিয়ে পানির প্রবাহ বাড়িয়ে এবং ডিমের ঘনত্ব হ্রাস করে হ্যাচারিতে এ রোগ প্রতিরোধ করা যেতে পারে। অ্যালাকাইট গ্রিন হচ্ছে ছত্রাক জনিত রোগের সর্বোত্তম ও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা।
হ্যাচারিতে লালনকৃত ডিমগুলোকে ২৫০ পিপিএম ফরমালিন দিয়ে ধুয়ে অথবা আক্রান্ত মাছগুলোকে শতকরা ৩-৫ ভাগ ফরমালিন দিয়ে ২-৩ মিনিট গোসল দেয়া যেতে পারে। এছাড়া অ্যালাকাইট গ্রিন ০.১৫-০.২০ পিপি এম হারে পুকুরে প্রতি সপ্তাহে একবার করে ২-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রয়োগ করা হলে আশাব্যঞ্জক ফলাফল পাওয়া যায়।
ভাইরাসজনিত রোগ : গ্রাস কার্প হেমোরেজিক ভাইরাস চাইনিজ কার্পের পোনার মৃত্যুর জন্য দায়ী এ বিষয়ে নানা সূত্রে নির্ভরশীল তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া, টক হারপিস ভাইরাস নামক এক ধরনের ভাইরাস কমনকার্প ও কৈ কার্পের রোগ সৃষ্টি করে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের সূত্র থেকে জানা গেছে, ভাইরাস জনিত রোগের মূলত কোনো চিকিৎসা নেই। একমাত্র পরিচ্ছন্নতা ও জৈব নিরাপত্তা পদ্ধতির নিয়মিত অনুসরণই হচ্ছে ভাইরাসজনিত রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ : বিভিন্ন প্রকার ব্যাকটেরিয়া যেমন, Motile, Aeromonas ও Vibrio প্রায়শ মাছের হ্যাচারি ও নার্সারির পোনার মৃত্যুর কারণ হয়ে থাকে। এসব ব্যাকটেরিয়া প্রাথমিক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু অথবা সুবিধাবোগী অনুপ্রবেশকারী জীবাণু হিসেবে রোগ সৃষ্টি করে। লেজ পচা ও পাখনাপচা জাতীয় রোগগুলো সাধারণত উল্লিখিত বিভিন্ন প্রজাতির জীবাণু দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। কার্পজাতীয় মাছের পোনার জন্য Aeromonas hydrophila ঘটিত ব্যাকটেরিয়াল হেমোরেজিক সেপটি সেমিয়া একটি গুরুতর সমস্যা।
পানির গুণাগুণ নষ্ট হওয়া, তাপমাত্রার তারতম্য, জৈব দূষণ এবং অধিক মজুদ ঘনত্ব মাছের পোনায় ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ব্যাকটেরিয়া বিশেষ করে পোনার পেটফোলা রোগের জন্য আক্রান্ত পুকুরে ৫ পিপিএম হারে পটাশ প্রয়োগ করে সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া যায়। এছাড়া খাবারের সাথে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ৫০-৬০ মি.গ্রা/ প্রতি কেজি মাছের ওজনের জন্য ১০দিন পর্যন্ত দেয়া যেতে পারে। এ ওষুধ ব্যবহারের ২৫ দিনের মধ্যে মাছ আহরণ করা মোটেই সমীচীন নয়।
পরিবেশজনিত রোগ : পুকুরে অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের মাত্রাতিরিক্ত দ্রবণ এবং পুকুরের তলায় অধিক জৈব পদার্থের উপস্থিতির কারণে মাছের পোনা গ্যাস বাবল রোগের কবলে পড়তে পারে। নার্সারি পুকুরে মাঝে মধ্যে হাঁস পোকার আক্রমণ এবং হ্যাচারিতে অজ্ঞাত কারণে ব্যাপক হারে রেণু ও পোনার মৃত্যুর সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এছাড়া কোনো কোনো সময় অত্যধিক ঠাণ্ডা ও অক্সিজেন স্বল্পতায় আকস্মিকভাবে রেণু মৃত্যুর সিকার হতে পারে।
পরজীবী ঘটিত রোগ : ইকবায়োপথিরিয়াসিস নামক এককোষী পরজীবী এ রোগ সৃষ্টি করে। এটিকে সাদা দাগ রোগও বলা হয়। কার্পজাতীয় মাছের পোনার ক্ষেত্রে ও রোগ সংক্রমণের তীব্রতা অধিক। এ রোগের ফলে মাছের পাখনা, ত্বক ও ফুলকায় সাদা সাদা দাগ দেখা যায়। পুকুরে অতিরিক্ত পোনা মজুদ এ রোগের অন্যতম সহায়ক কারণ। এ রোগ প্রতিরোধে আক্রান্ত পুকুরে পোনা না ছাড়াই উত্তম। পরজীবী আক্রান্ত পুকুরে ম্যালরাকাইট গ্রিণ, পটাসিয়াম পারমাঙ্গানেট ও সোডিয়াম ক্লোরাইড দ্বারা এ রোগের চিকিৎসা সম্ভব। আক্রান্ত মাছকে ম্যালাকাইট গ্রিণের ০.১৫-০.২০ পিপিএম দ্রবণে প্রতিদিন ১ ঘণ্টা করে ২/৩ দিন গোসল করালে সুফল পাওয়া যায়।
মিক্সোসম্পারিডিয়াসিস : মিক্সোবোলাস গণের কয়েকটি প্রজাতির সংক্রমণের কারণে এ রোগের উৎপত্তি হয়। পরজীবীগুলোর পূর্ণবয়স্ক স্পোর এ রোগের মূল কারণ হিসেবে মৎস্য বিজ্ঞানীরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সাধারণত কার্পজাতীয় মাছের পোনা এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। আক্রান্ত মাছ পুকুর থেকে সরিয়ে ফেলা এবং পুকুর জীবাণু মুক্তকরণ এ রোগ নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক ফলপ্রসূ পন্থা। মহুয়া খৈল দ্বারা চিকিৎসা করা হলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়া প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগে পানির অম্লত্ব দূরীভূত হয়। এ প্রক্রিয়ায় এক পর্যায়ে পরজীবীগুলো অদৃশ্য হয়ে যায় এবং মাছে সুস্থতা ফিরে পায়।
উকুনজনিত রোগ : এ জাতীয় পরজীবী আঙ্গুলে ও বড় মাছসহ সব ধরনের মাছেরই ক্ষতিসাধন করে। নার্সারি পুকুর, লালন পুকুর ও মজুদ পুকুরে এ পরজীবীগুলোর ব্যাপক সংক্রমণ ঘটতে দেখা যায়। এ জাতীয় বহুকোষী পরজীবী দ্বারা সংঘটিত একটি প্রধান রোগের নাম আরগুলোসিস। এ পরজীবীকে মাছের উকুনও বলা হয়। এ রোগ প্রতিরোধে সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে পুকুরে পরজীবীটিকে ঢুকতে না দেয়া। এছাড়া আক্রান্ত পুকুরে বাঁশের খুঁটি পুতে রাখা যেতে পারে। যেখানে এরা ডিম নিঃসরণ করবে। কিছু দিন পর পর ডিমগুলো তুলে এনে ধ্বংস করে আরগুলোসিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আক্রান্ত পুকুরে ০.৫ পিপিএস হারে ডিপটারেক্স সপ্তাহে একবার করে পাঁচ সপ্তাহ অথবা সুমিথিয়ন ০.৮ পিপিএস হারে একই মেয়াদে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

ট্রাইকোডিনিয়াসিস : এটি একটি এককোষী পরজীবী দ্বারা সংঘটিত রোগ। ধানী পোনা ও আঙ্গুলে পোনার ক্ষেত্রে এ রোগের প্রয়োগ অত্যধিক। অপেক্ষাকৃত ছোট ও অগভীর জলাশয়ে এবং দূষিত পানিবাহিত পুকুরে এ রোগের দ্রুত সংক্রমণ ঘটে। নার্সারি পুকুরে অধিক সংখ্যক পোনার মজুদ এ রোগের একটি অন্যতম সহায়ক কারণ। এ রোগ প্রতিরোধে পানির গুণাগুণ সমুন্নত রাখার পাশাপাশি পোনার ঘনত্ব হ্রাস করা অত্যাবশ্যক। এছাড়া আক্রান্ত মাছকে ২৫০ পিপিএম ফরমালিনে ৩-৫ মিনিট গোসল দেয়া অথবা পুকুরে ৪ পিপিএম হারে পটাশ প্রয়োগ করে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। উপরন্ত মাছকে শতকরা ২-৩ ভাগ লবণ পানিতে কয়েক মিনিটের জন্য গোসল করালে এ রোগে প্রতিকার আশা করা যায়।
কৃমিজাতীয় রোগ : এই পরজীবীগুলো মূলত মাছের পাখনা, ফুলকা ও ত্বকে আক্রমণ করে। নার্সারি পুকুরে এ রোগ অতিদ্রুত বৃদ্ধি পায়।
অপরপক্ষে কৃমির আক্রমণে ত্বক ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে। ত্বকে বিন্দু বিন্দু রক্তক্ষরণ হয়। কার্পজাতীয় মাছের ৪-৫ গ্রাম ওজনের পোনায় এ রোগের আক্রমণ বেশি লক্ষ করা যায়।
কৃমিজাতীয় পরজীবী ঘটিত রোগের চিকিৎসার জন্য আক্রান্ত গাছকে ২৫০ পিপিএম ফরমালিন দ্রবণে গোসল করালে সন্তোষজনক ফল পাওয়া যায়। এছাড়া আক্রান্ত পুকুরে ১০-২০ পিপিএম হারে পটাশ প্রয়োগ করা যেতে পারে।
মাছের হ্যাচারি ও নার্সারিতে মাছের পোনার রোগ প্রতিরোধে করণীয়
(১) উৎপাদনের শুরুতে এবং চলমান সময়ে সব হ্যাচারি ইউনিট এবং সরঞ্জামাদি ব্লিচিং পাউডার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করণ।
(২) নার্সারি পুকুর ও ব্রুড রাখার পুকুর নিয়মিত জীবাণূ মুক্ত করণ।
(৩) নিষিক্ত ডিম ও পোনাগুলোকে জীবাণুমুক্ত করণ।
(৪) গুণগতমান সম্পন্ন, দূষণ ও রোগজীবাণুমুক্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ।
(৫) সুষম ও জীবাণুমুক্ত খাদ্য সরবরাহ করা।
(৬) রোগের চিকিৎসার জন্য যথেচ্ছ-ড্রাগ ব্যবহার না করা।
(৭) মৃত ও অসুস্থ মাছ যথাশিগগিরর সরিয়ে ফেলা।
(৮) মাছ খাদক রাক্ষুসে প্রাণী নিয়ন্ত্রণ করা।
উল্লেখ্য যে, রেণু উৎপাদনের প্রায় ৯৯% আসে হ্যাচারি থেকে, পাশাপাশি নার্সারিতে উৎপাদিত হচ্ছে ৮২ হাজার লাখেরও অধিক পোণা। এরই প্রেক্ষাপটে নির্দ্বিধায় আশা করা যায়, হ্যাচারি ও নার্সারিতে উৎপাদিত রেণুও পোণা রোগমুক্ত রাখা সম্ভব হলে মাছের সার্বিক উৎপাদনও বেড়ে যাবে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে।
পরিশেষে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মাছ ও পোনার রোগ-ব্যাধি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়, সমাজে বহুল প্রচলিত এ প্রবাদ সর্বদাই চাষিদের মন মানসিকতায় লালন করতে হবে।
মৎস্য
মাগুর মাছ চাষ করে বিপুল অর্থ উপার্জন করুন

দেশি মাগুর মাছ সুস্বাদু ও উপাদেয়। দেশের প্রায় সব শ্রেণির মানুষের পছন্দের মাছ। এছাড়া পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবেও সর্বত্র দেশি মাগুরের চাহিদা রয়েছে। সর্বোপরি, মাগুর একটি জিওল মাছ | অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্রের উপস্থিতির ফলে এই মাছ জলের বাইরে অনেকক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে এবং বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে। তাই এই ধরণের মাছগুলিকে জিওল মাছ বলা হয়। এই মাছগুলির বাজারে মূল্য এবং চাহিদাও বেশি | তাই, মাগুর চাষ করে কৃষকরা আর্থিক দিক থেকে লাভবান হয়ে থাকেন |

পুকুর নির্মাণ(Pond preparation)
মাছ চাষের প্রথমেই সঠিকভাবে পুকুর নির্বাচন করতে হবে | পুকুরের আয়তন ১০ শতাংশ থেকে ৩৩ শতাংশ এবং গভীরতা ৮০ থেকে ১২০ সেন্টিমিটার (৩ ইঞ্চি থেকে ৪ ফুট) হতে হবে। অধিক গভীরতা উৎপাদনের জন্য অসুবিধাজনক। কারণ মাগুর মাছকে শ্বাস নেওয়ার জন্য সবসময় উপরে আসতে হয়। এতে অতিরিক্ত শক্তিক্ষয়ের কারণে মাছের বৃদ্ধি প্রতিক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে।
তবে, অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে পাড়ের ঊর্ধ্বসীমা অবশ্যই সর্বোচ্চ বন্যার লেভেল থেকে ৩০ সেন্টিমিটার (১ ফুট) উপরে রাখতে হবে। এতে বৃষ্টির সময় মাছ বুকে হেঁটে বাইরে যেতে পারে না। আবার বাইরে থেকে সাপ-ব্যাঙ ইত্যাদি মৎস্যভুক প্রাণিও পুকুরে প্রবেশের সুযোগ পায় না। এছাড়া পুকুরের চারদিকের পাড়ের ওপর ৩০ সেন্টিমিটার উঁচু নেটের বেড়া দেওয়া বাঞ্ছনীয়।

চুন প্রয়োগ
পুকুরের তলদেশ শুকিয়ে হাল্কাভাবে চাষ দিয়ে তলার মাটির পিএইচ পরীক্ষা করে প্রতি শতাংশে ১ থেকে দেড় কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন প্রয়োগের পর পুকুরে ১৫ সেন্টিমিটার (৬ ইঞ্চি) পরিমাণ জল ঢুকিয়ে সপ্তাহ খানিক ধরে রাখা প্রয়োজন।

সার প্রয়োগ(Fertilizer)
জৈব সার প্রয়োগের ৭ দিন পর জলের উচ্চতা ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বজায় থাকা অবস্থায় প্রতি শতাংশ ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ১০০ গ্রাম টিএসপি ও ২০ গ্রাম এমপিও সার ব্যবহার করতে হবে। জলের রং বাদামি সবুজ, লালচে বাদামি, হাল্কা সবুজ, লালচে সবুজ অথবা সবুজ থাকাকালীন অজৈব সার প্রয়োগের কোনো প্রয়োজন নেই।

পোনা মজুদ
পুকুরে ৫-৮ সেন্টিমিটার দৈর্ঘের সুস্থ-সবল পোনা প্রতি বর্গমিটারে ৫০ থেকে ৮০টি ছাড়া যেতে পারে। মে-জুন মাসে মাগুরের পোনা ছাড়ার যথার্থ সময়।
খাদ্য ব্যবস্থাপনা(Food)
মাগুর মূলত জলাশয়ের তলদেশের খাদ্য খেয়ে জীবন ধারণ করে। প্রাকৃতিক এই খাদ্যগুলো হচ্ছে জলাশয়ের তলায় আমিষ জাতীয় পচনশীল দ্রব্যাদি। প্রাণি প্লাঙ্কটন ও কেঁচো জাতীয় ক্ষুদ্রাকার প্রাণি ইত্যাদি।

খাদ্য সরবরাহ
অধিক ঘনত্বে চাষের ক্ষেত্রে পুকুরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। সহজলভ্য দেশীয় উপকরণের মাধ্যমে সম্পূরক খাদ্য প্রস্তুত করা যায়। এ ক্ষেত্রে চালের কুড়া ৪০ শতাংশ, তৈলবীজের খোল ৩০ শতাংশ ও শুঁটকি ৩০ শতাংশ মিশিয়ে গোলাকার বল তৈরি করে মাছকে সরবরাহ করা যেতে পারে। তাছাড়া শামুক ও ঝিনুকের মাংস মাগুরের অত্যন্ত প্রিয় খাবার। পুকুরে মজুদকৃত মাছের মোট ওজনের ৫-১০ শতাংশ হারে দৈনিক খাদ্যের এক-চতুর্থাংশ সকালে এবং বাকি তিন-চতুর্থাংশ সন্ধ্যায় প্রয়োগ করতে হয়।
মৎস্য
জেনে নিন পাবদা চাষে করণীয় কী

পাবদা অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সুস্বাদু মাছ। বর্তমানে পাবদা মাছ আমাদের দেশে প্রায় বিলুপ্তির পথে। তাই কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পাবদা মাছ রক্ষা করা সম্ভব। জেনে নিন পাবদা চাষে করণীয় কী?
প্রশ্ন : পাবদা মাছ ইদানিং বাজারে কম পাওয়া যায়। এর কারণ কী? এই মাছ কোথায় থাকে?
উত্তর : মাছটি হারিয়ে যাওয়া মাছের মধ্যে পড়ে। পাবদা আসলে নদীর মাছ। কিন্তু বর্ষার সময় যে সমস্ত নদীর সঙ্গে বড় বড় জলাশয়ের যোগাযোগ রয়েছে সেখানে এসেও পাবদা মাছ ঠাঁই নেয়। আমাদের দেশে কোনও কোনও বিলে ও বড় বড় জলাশয়ে এই মাছ পাওয়া যায়।
প্রশ্ন : পাবদা মাছ কোন ধরনের পুকুরে চাষ করা যায়?
উত্তর : সাইপ্রিনাস ও মৃগেল মাছ বাদ দিয়ে অন্য পোনা মাছের সঙ্গে পাবদা মাছও পুকুরে চাষ করা হয়।
প্রশ্ন : পাবদা মাছের খাদ্য কী?
উত্তর : পাবদা মাছ হচ্ছে মত্স্যভুক মাছ। এরা খায় ছোট চিংড়ি, শামুক, বিভিন্ন জলজ পোকা।
প্রশ্ন : পাবদা মাছের প্রজনন প্রক্রিয়া কেমন?
উত্তর : পাবদা মাছের স্বাভাবিকভাবেই প্রজনন হয়। এই মাছ ২০ গ্রাম থেকে ৪০ গ্রাম হলেই এরা প্রজননক্ষম হয়ে পড়ে, তখন এরা বিল থেকে পাশের নদীতে জড়ো হয় এবং ডিম পাড়ে।
প্রশ্ন : একটি প্রজননক্ষম পাবদা মাছে কী পরিমাণ ডিম পাওয়া যায়?
উত্তর : প্রতি ১০০ গ্রাম দেহের ওজনে এদের ৩৫,০০০-৪০,০০০ ডিম পাওয়া যেতে পারে।
প্রশ্ন : চারা তৈরি করার জন্য ধানি পোনার লালন কীভাবে করতে হবে?
উত্তর : প্রথমে অন্যান্য মাছের ডিম পোনা থেকে ধানি করার জন্য যে পদ্ধতিতে আঁতুড় পুকুর তৈরি করা হয়, এখানেও সেই পদ্ধতিতে করা হয়। দেখা গেছে, ১৫-১৮ দিনের মধ্যে ডিম পোনা থেকে ধানি পোনায় রূপান্তরিত হয়।
প্রশ্ন : লালনের সময় পাবদার ধানি পোনা কী খায়?
উত্তর : লালনের সময় পাবদার ধানি পোনা আঁতুড় পুকুরে উত্পাদিত জলজ প্রাণিকণা খেয়ে বড় হয়। ৩৫ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে ধানি চারা পোনায় রূপান্তরিত হয়। এই সময়ই মজুত পুকুরে স্থানান্তরিত করা হয়।
প্রশ্ন : পাবদা মাছের চাষের পদ্ধতি কী রকম হবে?
উত্তর : পাবদা চাষের জন্য প্রথমেই পোনা মাছ চাষের পদ্ধতি অনুযায়ী পুকুর তৈরি করতে হবে। প্রতি বিঘা পুকুরে ২২৫-২৫০ কিলোগ্রাম গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে। ৩-৪ দিনের মধ্যেই খাদ্যকণা উৎপন্ন হলে পাবদার চারাপোনা পুকুরে ছাড়তে হয়।
প্রশ্ন : এ চাষে খরচ এবং লাভ কত হতে পারে?
উত্তর : পোনা মাছের সঙ্গে মিশ্র চাষে খরচ হয় প্রায় ৩,৫০০ টাকা। পাবদা মাছ থেকে আয় হয় ৪,২০০ টাকা। পোনা মাছ থেকে আয় হয় ৬,০০০ টাকা। মোট আয় হয় ১০ হাজার ২০০ টাকা। মোট লাভ ৬,৭০০ টাকা।
মৎস্য
মাছ রোগাক্রান্ত হলে প্রতিকার করবেন যেভাবে

মাছেরও বিভিন্ন রকম রোগ বালাই আছে। এসব রোগ মাছ চাষের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা। বছরে অনেক সময় মাছ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। বিভিন্ন কারণে উন্মুক্ত জলাশয়ের চেয়ে বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করা মাছে রোগের প্রকোপ বেশি দেখা দেয়। তাই পুকুর-দীঘির মাছ প্রায়ই নানা রোগের কবলে পড়ে।
আমাদের দেশে প্রায় ৩২ প্রজাতির মাছ ক্ষত রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মাছের গায়ে ক্ষতের সৃষ্টি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এ রোগে মাছের গায়ে ছোট ছোট লাল দাগ দেখা যায়। লাল দাগের স্থানে গভীর ক্ষত হয়। মাছ দ্রুত মারা যায়। চোখ নষ্ট হতে পারে। ক্ষত স্থান থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। মাছ খাদ্য গ্রহণ করে না।
ক্ষতে চাপ দিলে দুর্গন্ধ ও পুঁজ বের হয়। মাছ দুর্বল হয় এবং ভারসাম্যহীনভাবে চলাফেরা করে। আক্রান্ত বেশি হলে লেজ ও পাখনা পচে খসে পড়ে।
দেশে সাধারণত শোল, গজার, টাকি, পুঁটি, বাইন, কৈ, মৃগেল, কার্পিও এবং পুকুরের তলায় বসবাসকারী অন্যান্য প্রজাতির মাছ ক্ষত রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।

মাছের ক্ষত রোগ সম্পর্কে মৎস্য চাষিরা কম-বেশি সবাই জানেন। এ রোগ সম্পর্কে ভালোভাবে জানার উপায় আক্রান্ত মাছের গায়ে ক্ষত বা ঘাজনিত লাল দাগ দেখা যায়। এই দাগের আকৃতি ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঘা মাছের লেজের গোড়া, পিঠ ও মুখের দিকেই বেশি হয়ে থাকে। এ রোগ দেখা মাত্র মাছ পুকুর থেকে দ্রুত তুলে ফেলতে হবে। ১০ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম লবণ গুলে লবণমিশ্রিত পানিতে রোগাক্রান্ত মাছ পাঁচ থেকে ১০ মিনিট ডুবিয়ে রেখে আবার পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে।
ক্ষত রোগে আক্রমণের আগেই প্রতি বছর আশ্বিন মাসের শেষে কিংবা কার্তিক মাসের প্রথম দিকে পুকুরে শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে পাথুরে চুন ও এক কেজি হারে লবণ দিতে হবে। তাহলে সাধারণত আসন্ন শীত মৌসুমে ক্ষত রোগের কবল থেকে মাছ মুক্ত থাকবে।
মাছের পেট ফোলা রোগে সাধারণত রুই জাতীয় মাছ, শিং-মাগুর ও পাঙাশ মাছ বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। পেট ফোলা রোগাক্রান্ত মাছের দেহের রং ফ্যাকাশে হয়ে যায়। পেটে পানি জমার কারণে পেট ফুলে থাকে। মাছ ভারসাম্যহীনভাবে চলাফেরা করে।
বেশির ভাগ সময়ই পানির ওপর ভেসে ওঠে এবং খাবি খায়। আক্রান্ত মাছ খুব দ্রুত মারা যেতে পারে। প্রতিকার হিসেবে প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে মাছের খাদ্যের সঙ্গে ফিশমিল ব্যবহার করা জরুরি। এছাড়া পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনসহ মাছকে নিয়মিত সুষম খাদ্য প্রদান করতে হবে।
মাছের মধ্যে পাখনা ও লেজ পচা রোগে সাধারণত রুইজাতীয় মাছ, শিং-মাগুর ও পাঙাশ মাছ আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ রোগে আক্রান্ত হলে প্রাথমিকভাবে পিঠের পাখনা এবং ক্রমান্বয়ে অন্যান্য পাখনাও আক্রান্ত হয়। কোনো কোনো মৎস্যবিজ্ঞানীর বলছেন, অ্যারোমোনাডস ও মিক্সোব্যাকটার গ্রুপের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এ রোগের সংক্রমণ ঘটে। পানির ক্ষার স্বল্পতা ও পিএইচ ঘাটতি দেখা দিলেও এ রোগের উৎপত্তি হতে পারে। এরোগ আক্রান্ত মাছ পুকুর থেকে তুলে ০.৫ পিপিএম পটাশযুক্ত পানিতে আক্রান্ত মাছকে ৩ থেকে ৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। পুকুরে সাময়িকভাবে সার দেয়া বন্ধ করতে হবে।

এছাড়া রোগজীবাণু ধ্বংসের পর মজুতকৃত মাছের সংখ্যা কমিয়ে ফেলতে হবে। এ অবস্থায় প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় মাছেরই উকুন রোগ দেখা দেয়। এরমধ্যে রুই মাছ, কখনো কখনো কাতল মাছও আক্রান্ত হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এ রোগে মাছের সারা দেহে উকুন ছড়িয়ে দেহের রস শোষণ করে মাছকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়।
এতে মাছ ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে মারা যেতে পারে। মাছের উকুন রোগের প্রতিকার করার জন্য শতকরা আড়াই ভাগ লবণ দ্রবণে কিছু সময় আক্রান্ত মাছ ডুবিয়ে রাখতে হবে। এতে করে উকুনগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়বে। এ অস্থায় হাত কিংবা চিমটা দিয়ে উকুনগুলো মাছের শরীর থেকে তুলে ফেলতে হবে। অনেক সময় মাছের পুষ্টির অভাবজনিত রোগ দেখা দেয়।
এ রোগে পুকুরে চাষযোগ্য যে কোনো মাছই আক্রান্ত হতে পারে। ভিটামিন ‘এ ডি এবং কে’-এর অভাবে মাছ অন্ধত্ব এবং হাড় বাঁকা রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। মাছের খাবারে আমিষের ঘাটতি দেখা দিলেও মাছের স্বাভাবিক বর্ধন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত হয়। অচিরেই মাছ নানা রোগের কবলে পড়ে।
মাছ এসব রোগে আক্রান্ত মাছকে খাবারের সঙ্গে প্রয়োজনীয় মাত্রায় সুনির্দিষ্ট ভিটামিন ও খনিজ লবণ মিশিয়ে খাওয়ানো হলে যথা শিগগিরই মাছের শারীরিক অবস্থার উন্নতি সম্ভব। মাছের রোগ প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মাছ চাষ করে চাষকৃত পুকুরে মাছের রোগ প্রতিরোধ করা অনেকাংশেই সম্ভব।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন