বাংলাদেশ
শেষ মুহূর্তের আশায় খামারি-ব্যাপারীরা
কোরবানি উপলক্ষে একটু বেশি লাভের আশায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজধানীর হাটগুলোতে পশু নিয়ে আসেন খামারি, ব্যাপারী ও গৃহস্থরা। গত কয়েকদিন তেমন বেচাবিক্রি না হলেও এখন শেষ মুহূর্তের আশায় আছেন তারা।
এতদিন কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পাওয়ায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোকসানে পশু বিক্রি করলেও আজকের দিন কিংবা রাতে আশার আলো দেখবেন— এমনটি মনে করছেন বিক্রেতারা। তারা বলছেন, হাটগুলোতে পশুর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যারা পশু নিয়ে বাজারে থাকবেন তারা দুটো পয়সা লাভের মুখ দেখতে পাবেন।
রাজধানীর সবচেয়ে বড় স্থায়ী পশুর হাট গাবতলীতে গত সাতদিন ধরে অবস্থান করছেন কুষ্টিয়া থেকে আশা আল আমীন। তিনি ২২টি গরু নিয়ে হাটে এসেছেন। সাতদিনে ১০টি গরু বিক্রি করেছেন। ১০টি গরুতে লাভ-লোকসান মিলে সমান সমান আছে— বলেন জাগো নিউজকে। ফোনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ১২টি গরু নিয়ে শেষপর্যন্ত অবস্থান করব। গাবতলীতে এখন গরুর সংখ্যা কম। গত দুদিনে প্রচুর বিক্রি হয়েছে। আজ (শুক্রবার) সারাদিন এবং রাত ছাড়াও ঈদের দিনও (শনিবার) সারাদিন অপেক্ষা করব।
রাজধানীর হাজারীবাগের রাস্তায় বসানো অস্থায়ী গরুর হাটে চুয়াডাঙ্গা থেকে ১৩টি ষাঁড় এনেছেন ইসলাম নামের এক ব্যাপারী। তিনি বলেন, পাঁচদিন হলো হাটে আসা। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পাঁচটি বিক্রি হয়েছে। সামান্য কিছু লাভ হয়েছে। বাকি আটটি ষাঁড়ের ওপর এখন ভরসা।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্রামেও গরুর মাংস সাড়ে পাঁচশ টাকা কেজি। এখানে গরু বিক্রি করতে না পারলে বাড়িতে নিয়ে যাব। পানিতে পড়ার মতো অবস্থা তো হয়নি। তবে এখনও আশায় আছি। সারাদিন ও একটি রাত তো সামনে আছে।
পাবনার ঈশ্বরদী থেকে রমজান ব্যাপারী এসেছেন রাজধানীর আফতাব নগর হাটে। তিনি ১৮টি ষাঁড় নিয়ে এসেছেন। প্রত্যেকটির দাম হাকাচ্ছেন দুই লাখের ওপরে। শুক্রবার ভোরে কথা হয় তার সঙ্গে। বলেন, এখনও আশাবাদী, ষাঁড়গুলো কাঙ্ক্ষিত মূল্যে বিক্রি হবে।
জাগো নিউজকে তিনি আরও বলেন, ব্যবসার সঙ্গে লাভ-লোকসানের একটা সম্পর্ক আছে। বর্তমানে আমরা একটা কঠিন সময় পার করছি। এর মধ্যেও পাবনা থেকে ট্রাক ভাড়া করে হাটে এসেছি। লাভে বিক্রি করতে পারলে করব, না হলে ষাঁড়গুলো ফিরিয়ে নিয়ে যাব। আরেকটা বছর পালন করে পরের বছর বিক্রি করব।
‘অনেকে আসছেন, পছন্দ করছেন, ভালো দামও বলছেন। কিন্তু কেউ কেউ এসে এমন দাম বলছেন যেন আমরা ঠেকায় পড়েছি। কসাইকে দিলেও এর চেয়ে বেশি দাম পাব। সামনের বছর পর্যন্ত এগুলোকে লালন-পালন করার সামর্থ্য তো আছে, ভয় কী?’
সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর থেকে কমলাপুর গরুর হাটে এসেছেন রহমান ব্যাপারী। বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পশুগুলো কিনেছি। নয়টি ষাঁড় এনেছি। চারটি বিক্রি হয়েছে। আছে আর পাঁচটি। হাটে এখন পশুর সংখ্যা কম, তেমন আসছেও না। তাই এখনও ভরসা আছে, শেষপর্যন্ত ভাগ্য খুলতে পারে। ঈদের দিন পর্যন্ত আশায় থাকতে তিনিও রাজি।
অন্যান্য
খাদ্য নিরাপত্তা ও বাংলাদেশের কৃষি
খাদ্য নিরাপত্তা হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে একটি দেশের সকল মানুষ, সকল সময়ে, পর্যাপ্ত, পুষ্টিকর এবং নিরাপদ খাদ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে সক্ষম। এটি মানুষের সুস্থ জীবনযাপন এবং দেশের টেকসই উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
খাদ্য নিরাপত্তার উপাদানসমূহ
খাদ্যের সহজলভ্যতা (Availability)
- পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য উৎপাদন বা আমদানি নিশ্চিত করা।
- ধান, গম, শাকসবজি, মাছ, এবং মাংসের মতো প্রধান খাদ্য উপাদানের উৎপাদন বৃদ্ধি।
খাদ্যে প্রবেশাধিকার (Accessibility)
- সকল শ্রেণির মানুষের জন্য খাদ্যের অর্থনৈতিক ও ভৌতপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
- দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য সহজলভ্য করা।
খাদ্যের মান (Utilization)
- খাদ্যের পুষ্টিমান বজায় রাখা এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণ নিশ্চিত করা।
- জৈব এবং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন।
স্থিতিশীলতা (Stability)
- খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক সংকট বা অন্যান্য সমস্যার সময়ও খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ হলেও, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জের কারণে খাদ্য নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে দেশটি উল্লেখযোগ্য উন্নতি করলেও কিছু নির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এই নিবন্ধে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ এবং সমাধানের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার বর্তমান চিত্র
খাদ্য উৎপাদনের উন্নতি
- বাংলাদেশ ধান, গম এবং শাকসবজির মতো প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে।
- ২০২২-২৩ অর্থবছরে ধানের উৎপাদন ৩.৮৬ কোটি মেট্রিক টনে পৌঁছেছে, যা দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে সহায়ক।
পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব
- যদিও চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবে পুষ্টিকর খাদ্য যেমন ফল, দুধ, ডিম এবং প্রোটিনের প্রাপ্যতায় এখনও ঘাটতি রয়েছে।
- FAO এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩০% শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
খাদ্য প্রাপ্যতা ও বিতরণ
- খাদ্য প্রাপ্যতা শহরাঞ্চলে তুলনামূলকভাবে সহজ হলেও, প্রত্যন্ত অঞ্চলে খাদ্যের অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
- পরিবহন ব্যবস্থা এবং সরবরাহ চেইনের উন্নয়ন প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
- জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রায়ই বন্যা, খরা এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে, যা খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
- উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার কারণে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে।
খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ
জনসংখ্যা বৃদ্ধি
- ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে।
- সীমিত কৃষি জমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ।
জলবায়ু পরিবর্তন
- বন্যা, খরা, এবং ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ফসলের ক্ষতি।
- শস্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব।
জমির সংকট
- কৃষি জমি কমে যাওয়া এবং নগরায়ণের ফলে খাদ্য উৎপাদনে বাধা।
অপুষ্টি এবং খাদ্যের বৈষম্য
- দরিদ্র জনগোষ্ঠী পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য পায় না।
- পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে শিশুদের বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য ব্যাহত হয়।
খাদ্য সংরক্ষণ ও বিতরণ সমস্যা
- উৎপাদিত খাদ্যের সঠিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় অনেক খাদ্য নষ্ট হয়ে যায়।
- সুষ্ঠু বিতরণ ব্যবস্থার অভাব।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপায়
কৃষি উন্নয়ন
- উন্নত প্রযুক্তি এবং উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহার।
- কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
খাদ্য সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থা
- আধুনিক গুদাম এবং হিমাগার স্থাপন।
- খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার উন্নতি।
পুষ্টি শিক্ষার প্রসার
- পুষ্টিকর খাদ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা।
- অপুষ্টি দূরীকরণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ।
সরকারি সহায়তা
- দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ভর্তুকি এবং খাদ্য সহায়তা।
- খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখা।
খাদ্য নিরাপত্তা একটি দেশের উন্নয়নের মৌলিক চাহিদা। বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, সুষ্ঠু বিতরণ ব্যবস্থা, এবং জনগণের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে একটি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী জাতি গড়ে তোলা সম্ভব।
ইথিওপিয়া
কফি চাষের প্রক্রিয়া এবং বাংলাদেশে কফি চাষের সম্ভাবনা
কফি চাষ একটি সময়সাপেক্ষ এবং যত্নশীল প্রক্রিয়া যা নির্দিষ্ট আবহাওয়া ও মাটির গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে কফি চাষ সম্প্রতি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। নিচে কফি চাষের ধাপসমূহ বিশদভাবে আলোচনা করা হলো।
কফি চাষের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ
আবহাওয়া: ১৮-২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কফি চাষের জন্য আদর্শ। ঠাণ্ডা ও ছায়াযুক্ত স্থান উপযুক্ত।
মাটি: উর্বর, দোআঁশ বা বেলে-দোআঁশ মাটি যেখানে পানি জমে না। মাটির পিএইচ মান ৫.৫-৬.৫ হওয়া উচিত।
উচ্চতা: সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০০-১২০০ মিটার উচ্চতা।
কফি চাষের ধাপসমূহ
বীজ সংগ্রহ ও প্রস্তুতি
- উন্নত মানের কফি বীজ নির্বাচন করুন। সাধারণত অ্যারাবিকা (Arabica) এবং রোবাস্টা (Robusta) জাতের কফি বীজ চাষ করা হয়।
- বীজ বপনের আগে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখুন।
চারা তৈরির পদ্ধতি
- নার্সারি প্রস্তুতি: দোআঁশ মাটি, জৈব সার, এবং বালি মিশিয়ে নার্সারিতে চারা তৈরি করুন।
- বপন: বীজগুলো ২ সেন্টিমিটার গভীরে বপন করুন।
- পরিচর্যা: পর্যাপ্ত পানি এবং ছায়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করুন।
জমি প্রস্তুতি
- আগাছা পরিষ্কার করে মাটি চাষ করুন।
- জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করুন।
- গাছ লাগানোর জন্য ২ মিটার দূরত্বে গর্ত তৈরি করুন।
গাছ রোপণ
- চারাগুলো ৮-১২ মাসের পর জমিতে রোপণ করুন।
- প্রতি গর্তে একটি চারা রোপণ করুন এবং মাটির সঙ্গে ভালোভাবে চেপে দিন।
পরিচর্যা
- সেচ: নিয়মিত পানি দিন, বিশেষত শুকনো মৌসুমে।
- ছাঁটাই: বেশি ডালপালা ছেঁটে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন নিশ্চিত করুন।
- ছায়ার ব্যবস্থা: কফি গাছের জন্য কিছুটা ছায়া প্রয়োজন, তাই অন্যান্য গাছের ছায়া নিশ্চিত করুন।
- সার প্রয়োগ: বছরে দুইবার জৈব সার ও প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করুন।
পোকামাকড় ও রোগ দমন
- রোগ: কফি রস্ট (Coffee Rust) এবং ব্লাইট (Blight) রোগ দমনে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করুন।
- পোকা: পাতার পোকা এবং ফলের পোকা দমনের জন্য কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
ফসল সংগ্রহ
- কফি গাছ সাধারণত রোপণের ৩-৪ বছর পর ফল দেওয়া শুরু করে।
- লাল রঙের পাকা কফি ফল হাতে তুলে বা মেশিনের সাহায্যে সংগ্রহ করুন।
- সংগ্রহের পর কফি ফল থেকে বীজ পৃথক করুন এবং শুকানোর জন্য রোদে দিন।
বিশ্বের কফি চাষের দেশসমূহ: বিস্তারিত আলোচনা
কফি, বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পানীয়, যা প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ। কফি চাষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত। এই নিবন্ধে আমরা কফি চাষের শীর্ষ দেশসমূহ, তাদের বৈশিষ্ট্য, এবং বাংলাদেশে কফি চাষের সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
বিশ্বের শীর্ষ কফি উৎপাদক দেশসমূহ
ব্রাজিল
বিশ্বে অবস্থান: শীর্ষ কফি উৎপাদনকারী দেশ।
বৈশিষ্ট্য:
- বিশ্বব্যাপী মোট কফি উৎপাদনের প্রায় ৩০-৪০% ব্রাজিলে চাষ হয়।
- অ্যারাবিকা এবং রোবাস্টা জাতের কফি চাষে তারা দক্ষ।
- বিখ্যাত উৎপাদন অঞ্চল: মিনা জেরাইস, সাও পাওলো, এবং পারানা।
বিশেষত্ব: ব্রাজিলিয়ান কফি তাদের মৃদু স্বাদ এবং ভারসাম্যপূর্ণ সুগন্ধির জন্য বিশ্বখ্যাত।
ভিয়েতনাম
বিশ্বে অবস্থান: দ্বিতীয় বৃহত্তম কফি উৎপাদক।
বৈশিষ্ট্য:
- ভিয়েতনাম রোবাস্টা কফি উৎপাদনে শীর্ষে।
- দক্ষিণ মধ্যভাগ অঞ্চলে প্রচুর কফি চাষ হয়।
বিশেষত্ব: সাশ্রয়ী মূল্যের এবং উচ্চ উৎপাদনশীলতার কারণে রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কলম্বিয়া
বিশ্বে অবস্থান: তৃতীয় বৃহত্তম উৎপাদক।
বৈশিষ্ট্য:
- অ্যারাবিকা কফির জন্য বিখ্যাত।
- আন্দিজ পর্বতের ঢালে চাষ হওয়া কফি স্বাদের জন্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
বিশেষত্ব: সুগন্ধি ও মসৃণ স্বাদের জন্য জনপ্রিয়।
ইন্দোনেশিয়া
বিশ্বে অবস্থান: চতুর্থ বৃহত্তম।
বৈশিষ্ট্য:
- সুমাত্রা, জাভা, এবং বালির কফি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
- বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি “কোপি লুয়াক” কফি তাদের পরিচিতি বাড়িয়েছে।
বিশেষত্ব: রোবাস্টা জাতের কফি উৎপাদনে দক্ষ।
ইথিওপিয়া
বিশেষত্ব: কফির জন্মভূমি।
বৈশিষ্ট্য:
- অ্যারাবিকা কফির জন্য বিশ্বখ্যাত।
- হারার, সিদামো, এবং ইয়ারগেচেফ অঞ্চলের কফি সুগন্ধি এবং প্রাকৃতিক স্বাদের জন্য বিশেষভাবে সমাদৃত।
গুয়াতেমালা
বৈশিষ্ট্য:
- উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে অ্যারাবিকা কফি চাষ হয়।
- আগ্নেয়গিরির মাটি কফির মান উন্নত করে।
বিশেষত্ব: অনন্য স্বাদ এবং গভীর সুগন্ধির জন্য বিখ্যাত।
ভারত
বৈশিষ্ট্য:
- দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক, কেরালা এবং তামিলনাড়ু রাজ্যে কফি চাষ হয়।
- “মনসুনড মালাবার” নামে পরিচিত বিশেষ প্রক্রিয়াজাত কফি।
বিশেষত্ব: রোবাস্টা এবং অ্যারাবিকা উভয় কফি উৎপাদনে পারদর্শী।
কেনিয়া
বৈশিষ্ট্য:
- উজ্জ্বল অম্লীয়তা এবং ফলমূলের স্বাদযুক্ত কফি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত।
বিশেষত্ব: আফ্রিকার অন্যতম স্বাদযুক্ত কফি।
কোস্টা রিকা
বৈশিষ্ট্য:
- পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের জন্য সুপরিচিত।
বিশেষত্ব: উচ্চমানের অ্যারাবিকা কফি।
মেক্সিকো
বৈশিষ্ট্য:
- অ্যারাবিকা কফি উৎপাদনে বিশেষজ্ঞ।
- যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে কফি চাষের সম্ভাবনা
বাংলাদেশে কফি চাষ এখনও নবযাত্রায় থাকলেও এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত। পাহাড়ি অঞ্চল যেমন বান্দরবান, রাঙামাটি, এবং খাগড়াছড়িতে কফি চাষ শুরু হয়েছে। দেশের উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু এবং পাহাড়ি মাটির গুণগত মান কফি চাষের জন্য আদর্শ।
উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর উপায়:
- উন্নত জাতের বীজ ব্যবহার।
- আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ।
- স্থানীয় কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা:
- স্থানীয় চাহিদা পূরণ।
- আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির সুযোগ।
বিশ্বজুড়ে কফি চাষের বৈচিত্র্য এবং এর গুণগত মান নির্ভর করে স্থানীয় আবহাওয়া, মাটি এবং চাষ পদ্ধতির ওপর। বাংলাদেশে কফি চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি এবং দেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা উন্মোচিত হতে পারে।
কফি চাষের উপকারিতা
- কফি একটি উচ্চমূল্যের অর্থকরী ফসল।
- দেশে-বিদেশে এর চাহিদা অনেক বেশি।
- পাহাড়ি এলাকায় কফি চাষ মাটির ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে।
- অন্যান্য ফসলের তুলনায় কফি চাষে দীর্ঘমেয়াদি আয় হয়।
কফি চাষ একটি লাভজনক কৃষি উদ্যোগ, বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলে। সঠিক পরিকল্পনা, যত্ন, এবং আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে কৃষকরা সহজেই ভালো ফলন ও আয় নিশ্চিত করতে পারেন।
কফি চাষে আগ্রহী? এখনই উদ্যোগ নিন এবং এই লাভজনক খাতের অংশ হয়ে যান!
বাংলাদেশ
ঐতিহ্যবাহী দেশীয় মাছ – দা এগ্রো নিউজ
আমাদের দেশের অধিকাংশ ঐতিহ্যবাহী দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কিছু টিকে আছে আমাদের মাছ চাষিদের কল্যাণে। আসুন ছবির মাধ্যমে আজ আমরা কিছু ঐতিহ্যবাহী দেশীয় মাছ দেখে নেই।
ফসল
ফাতেমা ধান’ চাষে বাম্পার ফলন – দা এগ্রো নিউজ
বাগেরহাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক নারীর চাষ করা ধান ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। একটি শীষে ধান পাওয়া গেছে এক হাজার এক শর বেশি। দেশে বর্তমান যেসব জাতের ধান চাষ হয় সেসবের চেয়ে এই ধানের ফলন দ্বিগুণ। ফাতেমা বেগমের জমিতে এই ধানের চাষ হওয়ায় এরই মধ্যে তা ‘ফাতেমা ধান’ নামে পরিচিতি পেয়েছে এলাকায়।
ফাতেমা ধানের গাছ, ফলন, পাতা, শীষ সবকিছু অন্য যে কোনো জাতের ধানের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতি গোছে একটি চারা রোপণ করা হয়, যা বেড়ে ৮-১২টি হয়। প্রতিটি ধান গাছ ১১৫ থেকে ১৩০ সেন্টিমিটার লম্বা। একেকটি ছড়ার দৈর্ঘ্য ৩৬-৪০ সেন্টিমিটার। প্রতি ছড়ায় দানার সংখ্যা এক হাজার থেকে ১২০০টি। যার ওজন ৩০-৩৫ গ্রাম। ধানগাছের পাতা লম্বা ৮৮ সেন্টিমিটার, ফ্লাগলিপ (ছড়ার সঙ্গের পাতা) ৪৪ সেন্টিমিটার। ধানগাছের পাতা চওড়ায় দেড় ইঞ্চি। এই জাতের গাছের কাণ্ড ও পাতা দেখতে অনেকটা আখ গাছের মতো এবং অনেক বেশি শক্ত। তাই এই ধান ঝড়-বৃষ্টিতে হেলে পড়ার কোন আশঙ্কা নেই। ফাতেমা ধান একরপ্রতি ফলন হয় প্রায় ১৩০ মণ। তাই অন্য যে কোনো জাতের তুলনায় এই জাতের ধান অনেক ব্যতিক্রম।
গতকাল শুক্রবার চাকুলিয়া গ্রামে ফাতেমা বেগমের বাড়িতে গিয়ে বেশ কিছু মানুষের ভিড় দেখা যায়। দূর-দূরান্ত থেকে তারা ফাতেমার ধানের বীজ কিনতে এসেছে। কেউ কেউ যে জমিতে ওই ধান ফলেছে, তা ঘুরে দেখে। তবে কয়েক দিন আগেই ওই ধানের বীজ শেষ হয়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে।
ফাতেমা বেগম জানান, ২০১৬ সালে বোরো মৌসুমে তাঁর বাড়ির পাশে জমিতে হাইব্রিড আফতাব-৫ জাতের ধান কাটার সময় তিনটি ভিন্ন জাতের ধানের শীষ দেখতে পান তিনি। ওই তিনটি শীষ অন্যগুলোর চেয়ে অনেক বড় এবং শীষে ধানের দানার পরিমাণও অনেক বেশি ছিল। এরপর ওই ধানের শীষ তিনটি বাড়িতে এনে শুকিয়ে প্রক্রিয়া করে বীজ হিসেবে রেখে দেন। পরের বছর ছেলে লেবুয়াতকে ধান চাষ চাষ করতে বলেন। সে বছর আড়াই কেজি ধান পাওয়া যায়। এবার আরো বেশি জমিতে চাষ করার পর ধানে ধানে সয়লাব হয়ে গেছে। সাড়া ফেলেছে তা এলাকার বাইরেও। ওই ধান দেখতে ব্রি-২৮ ধানের মতো। লেবুয়াত শেখ জানান, বাড়ির পাশে দেড় বিঘার মৎস্যঘেরের মধ্যে প্রায় ৪২ শতক জমিতে আলাদাভাবে এ বছর ওই ধানের চাষ করেন তাঁরা। অন্য ধানের মতোই সাধারণ পরিচর্চা করেন। জমিতে দুই দফায় ২০ কেজি ইউরিয়া এবং ৩০ কেজি পটাশ সার ব্যবহার করা হয়েছে। পোকামাকড় তাড়াতে দুই দফায় কীটনাশক ছিটানো হয়েছে। অন্য জাতের ধানগাছের চেয়ে এই ধানগাছ অনেক লম্বা। ধানের শীষও অনেক বড়। প্রতিটি শীষে এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ দানা হয়। ওই জমিতে প্রায় দুই হাজার ৬০০ কেজি ধান ফলেছে। নিজেদের জন্য কিছু পরিমাণ বীজ ধান রাখার পর ৪০০ টাকা কেজিদরে ওই ধান বিক্রি করে দিয়েছেন। তাতে আয় হয়েছে সাত লাখ ২০ হাজার টাকা। সিলেট, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, খুলনাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এসে ওই ধান ক্রয় করেছে। ফকিরহাটের মাসকাটা ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. সোলায়মান আলী জানান, ওই ধান রোপণ করার পর তাঁরা তত্ত্বাবধান করেন। চাষি তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী ধান চাষ করেছেন।
কৃষক রিয়াজুল ইসলাম জানান, ইউটিউবের মাধ্যমে ফাতেমা ধানের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রায় ৬ মাস অপেক্ষা করার পর বাগেরহাটের কৃষক লেবুয়াতের মায়ের নিকট থেকে বীজ সংগ্রহ করি। এরপর প্রাথমিকভাবে আমার ৭৫ শতাংশ জমিতে এ ধানের চাষ করি। এতে সবকিছু মিলে মাত্র ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আমি আশাবাদী এ জমিতে প্রায় ৯৫-১০০ মণ ধান হবে। এই ধান উপজেলাব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার বলেও তিনি মনে করেন। তিনি আরও জানান, এই ধান চাষ করে লাভবান হতে পারব বলে আশা করছি। নিজেও স্বাবলম্বী হতে পারব। এ বছর আরও জমিতে আবাদ করব এই ধান।
আলফাডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রিপন প্রসাদ সাহা জানান, বাগেরহাটের কৃষক কর্তৃক উদ্ভাবিত ফাতেমা জাতের ধানের রয়েছে নানা বৈশিষ্ট্য। এ ধানের ফলন শুধু দেশ নয়, গোটা বিশ্বকে তাক লাগাতে পারে। যা দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা যেতে পারে। তিনি আরও জানান, উপজেলাতে এ ধানের আবাদ বৃদ্ধিতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ
পঞ্চাশে বাংলাদেশ: এক টেলিভিশন তারকা আর দরিদ্র কৃষকের সন্তান এক বিজ্ঞানী যেভাবে পাল্টে দিয়েছেন বাংলাদেশের কৃষি – দা এগ্রো নিউজ
শাইখ সিরাজ
বাংলাদেশে আধুনিক কৃষি প্রচলনের প্রথম চেষ্টা হয়েছিল কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে, ষাটের দশকে। এটির প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খানের উদ্যোগে জাপান থেকে আনা উন্নত জাতের একটি ধানের পরীক্ষামূলক চাষের উদ্যোগ নেয়া হলো। কিন্তু এই ধানের চাষের জন্য কৃত্রিম সেচের দরকার হবে। গ্রামে সেজন্য গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছিল।
“নলকূপ দিয়ে যখন মাটির নীচ থেকে পানি তোলা হচ্ছিল, তখন গ্রামের কিছু মানুষ ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তারা এটিকে দেখেছিল আল্লাহর ওপর খবরদারি হিসেবে। বুঝতেই পারছেন কৃষিতে নতুন প্রযুক্তি বা ধ্যানধারণার ব্যাপারে শুরুতে বাংলাদেশের কৃষকের মনোভাব কেমন ছিল”, বলছিলেন শাইখ সিরাজ, বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় এক টেলিভিশন উপস্থাপক।
হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে, জলপাই সবুজ রঙের ট্রেডমার্ক শার্ট পরে ক্যামেরা হাতে শাইখ সিরাজ এখন বাংলাদেশের যেখানেই যান, সেখানেই তাকে কৃষকরা সাদরে বরণ করে নেন।
কিন্তু যখন তিনি প্রথম রাষ্ট্রায়ত্ব বাংলাদেশ টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন, তখন পরিস্থিতি ছিল একেবারেই প্রতিকূল।
“তখন আমরা যেসব বিশাল ক্যামেরা নিয়ে গ্রামে যেতাম, সেগুলো দেখে লোকে ভয় পেত। তারা ভাবতো এটা বুঝি কামান। মাইক্রোফোনকে ভাবতো বন্দুকের নল। গ্রামগুলো আর্থ সামাজিক দিক দিয়ে তখন এতটাই পিছিয়ে। ক্যামেরার সামনে লোকজনকে কথা বলানো কঠিন ছিল, এতটাই লাজুক তখন গ্রামের মানুষ,” তিনি বলেন।
‘মাটি ও মানুষ’
বাংলাদেশের কৃষিতে গত কয়েক দশকে যে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে, শাইখ সিরাজকে বর্ণনা করা হয় সেই পরিবর্তনের পেছনে অন্যতম প্রধান এক চরিত্র হিসেবে।
বাংলাদেশে যখন বিজ্ঞানীরা একের পর এক নতুন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করে চলেছেন, কৃষিতে নতুন ধ্যান ধারণা এবং কৌশল চালুর জন্য সরকারের নানা পর্যায় থেকে চেষ্টা চলছে, সেগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে বিরাট ভূমিকা রাখে তার কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান, ‘মাটি ও মানুষ।’
“শুরুতে এই অনুষ্ঠানটা হতো আমার দেশ নামে। তখন এটি ৫০ মিনিটের পাক্ষিক অনুষ্ঠান। পরে এটিকেই ‘মাটি ও মানুষ’ নামে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করি। আমার মনে হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের চেয়ে বেশি দরকার শিক্ষামূলক মোটিভেশনাল অনুষ্ঠান। কৃষকদের যদি নতুন বীজ, নতুন প্রযুক্তি, নতুন কৌশল, এসব ঠিকমত বোঝানো যায়, তাহলে কৃষিতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব।”
গত চার দশক ধরে শাইখ সিরাজ হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে কৃষি বিষয়ক তথ্যের প্রধান উৎস। উনিশ’শ আশির দশকে, যখনো টেলিভিশন ঘরে ঘরে পৌঁছায়নি, তখনো গ্রামের হাটেবাজারে, কমিউনিটি সেন্টারে প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় ‘মাটি ও মানুষ’ দেখার জন্য ভিড় করতো মানুষ।
তবে কৃষকদের নতুন ধরণের কৃষিতে উৎসাহিত করার কাজটা সহজ ছিল না।
“আজকের কৃষক এবং তিরিশ বছর আগের কৃষকের মধ্যে তফাৎ আকাশ আর পাতাল। তখন কৃষকের কাছে একজন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা যে কথা বলতেন, একজন টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে আমি যেকথা বলতাম, সেটা তারা মানতে চাইতো না। তারা ভাবতো, আমরা যেধরণের কৃষির কথা বলছি, যদি সেটাতে ভালো ফসল না হয়? এ কারণে সে সহজে মোটিভেট হতে চাইতো না। সহজে নতুন প্রযুক্তি নিতে চাইতো না।”
“আমি যখন আশির দশকে উচ্চফলনশীল নতুন জাতের ধানের কথা বলছি, গমের কথা বলছি, তখন পরিস্কার তারা আমাকে বলতো এই রাবার ভাত খাবো না। তখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধানের মান তেমন ভালো ছিল না। ভাতটা ছিল রাবারের মতো, ভাতের দানা উপর থেকে থালার উপর ফেললে সেটি রাবারের মতো ড্রপ করতো।”
কিন্তু বিজ্ঞানীরা যখন তাদের গবেষণায় নতুন নতুন সাফল্য পাচ্ছিলেন, আর সেই সঙ্গে শাইখ সিরাজও তার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকদের মন জয় করার জন্য নতুন কৌশল নিচ্ছিলেন।
ভাষার পরিবর্তন
“তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে প্রমিত উচ্চারণে কথা বলতে হতো। আমি বুঝতে পারছিলাম গ্রামের মানুষের সঙ্গে আমার একটা দূরত্ব থেকে যাচ্ছিল। কৃষক আমার কথা কিছু বুঝতে পারছে, কিছু বুঝতে পারছে না। অন্যদিকে আমি যখন কৃষকের সঙ্গে কথা বলছি, সেও নিজেকে প্রকাশ করতে পারছে না,” তিনি বলেন।
টেলিভিশন অনুষ্ঠানে শাইখ সিরাজ তার মুখের ভাষায় পরিবর্তন আনলেন, গ্রামের মানুষের সঙ্গে তাদের কথ্য ভাষার ব্যবহার শুরু করলেন। পরিবর্তন এলো তার পোষাকেও। কেতাদুরস্থ শহুরে পোষাকের জায়গা নিল তার এখনকার ট্রেডমার্ক জলপাই রঙা শার্ট।
টাঙ্গাইলের এক গ্রামে ঝকঝকে নতুন টিনের চালার এক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে শহর থেকে আসা কজন মানুষ। ফসলের মাঠ ঘুরে দেখে এসে ক্লান্ত হয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন। স্থানীয় জাতের চামারা ধানের জায়গায় উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান-চাষ শুরু হওয়ার পর এলাকাটির অবস্থা কী, সেটা দেখতে গেছেন তারা।
শহুরে মানুষ দেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলেন গৃহস্থ। জানতে চাইলেন, আপনারা কারা।
“আমরা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের লোক,” জানালেন তারা।
“এরপর যা ঘটলো তার জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না”, বলছিলেন ডঃ এম এ সালাম, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক বিজ্ঞানী।
“লোকটি খুশিতে চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বললো, আল্লাহ আপনাদের ফেরেশতা হিসেবে পাঠিয়েছেন। আমরা হতচকিত। কী ঘটছে বুঝতে পারছি না।”
ঘটনাটি ১৯৯৬ সালের। যমুনা সেতু নির্মাণের জন্য যে নদী শাসন করা হয়েছে, তার ফলে এলাকাটি তখন বন্যামুক্ত। আগে সেখানে চাষ হতো কেবল স্থানীয় জাতের চামারা ধান, যেটি বন্যার পানির সঙ্গে বাড়ে, তিন-চার ফুট পানিতেও চাষ করা যায়। কিন্তু ফলন হতো খুব কম। বন্যামুক্ত এলাকায় সেই প্রথম কৃষকরা উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ শুরু করেছেন।
সেই কৃষক এরপর ডঃ সালাম এবং তার সহকর্মীদের হাত ধরে টানতে টানতে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলেন। বললেন, “এই যে টিনের চালার বাড়ি দেখছেন, এটা আমি ধান বিক্রির টাকায় করেছি। আমার চৌদ্দ পুরুষ কুঁড়েঘরে থাকতো। চামারা ধান চাষ করে আমাদের দিন চলতো খেয়ে-না খেয়ে। এখন দেখেন আমার কত ধান। আপনারা আমাদের জীবন বদলে দিয়েছেন।”
একজন সফল ধান বিজ্ঞানী হিসেবে কয়েক দশকের দীর্ঘ কর্মজীবনে এটি ডঃ সালামের সবচেয়ে মধুর স্মৃতিগুলোর একটি।
“আউশ, আমন এবং বোরো- এই তিন মৌসুম মিলে এখন আমাদের দেশে মোট ১১ হতে সাড়ে ১১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে চাষ হয়। এখন গড়ে আমরা প্রতি হেক্টরে চার টন ফলন পাই। যার ফলে এখন আমরা ধান উৎপাদনে উদ্বৃত্তে এসেছি। তা না হলে, আমরা যদি প্রতি হেক্টরে দেড় হতে দুই টন ফলনে থেকে যেতাম, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষকে খাওয়ানো-পরানো অসম্ভব ছিল,” বলছিলেন তিনি।
দুর্ভিক্ষের স্মৃতি
ময়মনসিংহ শহর থেকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী পেরিয়ে চর ইশ্বরদিয়া গ্রাম। উনিশ’শ চুয়াত্তর সালের শরৎকালে বাংলাদেশ যখন তার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর এক খাদ্য সংকটের মোকাবেলা করছে, তখন সেই গ্রামেও হানা দিয়েছে তীব্র অভাব।
চর ইশ্বরদিয়ার রশিদা তখন কিশোরী। প্রতিদিন খাবারের জন্য তাকে লাইনে দাঁড়াতে হতো বাড়ির কাছের এক লঙ্গরখানায়।
“লাইনে দাঁড়াইলে কোনদিন রুটি দিত, কোনদিন গোলা আটা দিত। অভাব চলছে মনে করেন প্রায় বছরখানিক। চাউল থাকলেও আমরা কিন্যা আইনা খাওনের মতো সামর্থ্য আছিল না। ফরে আটা আইন্যা খাই, আলু আইন্যা খাই। কোনদিন না খাইয়া থাকি। কোনদিন মনে করেন কচুর শাক তুইল্যা খাই। এইরকম কইরা দিন কাটাইছি।”
এম এ সালাম তখন চর ঈশ্বরদিয়া থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। লজিং থাকেন যে পরিবারের সঙ্গে, তাদের আর্থিক অবস্থাও খুবই খারাপ।
“ওরা তখন যা করছিল, সেটা আমি কোনদিন ভুলিনি। প্রতিদিন তারা কষ্ট করে হলেও আমাকে ভাত খেতে দিত, কিন্তু তারা নিজেরা জাউ খেয়ে থাকতো। এত ভালোবাসতো ওরা আমাকে।”
এম এ সালাম স্বপ্ন দেখছিলেন একজন কৃষি বিজ্ঞানী হওয়ার। অল্প বয়সে তার মধ্যে এই স্বপ্ন উস্কে দেন দরিদ্র কৃষক পিতা।
“আমি যখন ক্লাশ থ্রীতে পড়ি, তখন একদিন ধান কাটার মওসুমে আমার বাবার সঙ্গে আমি গরুর গাড়িতে করে মাঠে গেছি ধান তুলতে। কিছুক্ষণ পর আমার গাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। তখন আমার বাবা বলছে, দ্যাখো বাবা, কৃষিকাজ কত কঠিন। কত পরিশ্রমের। তুমি যদি লেখাপড়া শিখতে পারো, তাহলে তোমার এই পরিশ্রম করা লাগবে না। তুমি ভালো থাকবে, আমরাও ভালো থাকবো,” শৈশবের কথা বলতে গিয়ে ডঃ সালামের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে।
ডঃ এম এ সালাম এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে কৃতি ধানবিজ্ঞানীদের একজন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে যত রকমের উন্নত জাতের ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে, তার অন্তত ২০টির গবেষণায় সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি।
তাদের উদ্ভাবন পাল্টে দিয়েছে বাংলাদেশের কৃষি। ঢাকার গুলশানে যে প্রতিষ্ঠানে তিনি এখন নতুন গবেষণায় নিয়োজিত সেখানে বসে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে।
উনিশ’শ সাতাত্তর সালে যখন তিনি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে যোগ দিলেন, তখন দুর্ভিক্ষ পরবর্তী বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, কীভাবে এই দেশটির বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যের সংস্থান করা যায়।
“তখন বাংলাদেশে একজন মানুষ হয়তো সারাদিনে একবারই খায় এবং সেটা হয়তো এক সের চালের ভাত। ভাতই তার প্রোটিন, ভাতই তার ভিটামিন, এটাই তার সবকিছু। বাংলাদেশ ধানের দেশ। অথচ কী দুর্ভিক্ষ আমাদের, কী করুণ অবস্থা।”
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের সামনে তখন বড় চ্যালেঞ্জ কীভাবে ধানের উৎপাদন বাড়ানো যায়।
“আমি যখন কাজে যোগ দিলাম, তখন আমাদের সিনিয়র বিজ্ঞানীরা বললেন, আমাদেরকে এটা করতেই হবে। আমাদেরও প্রতিজ্ঞা, এই দেশকে আমরা বদলে দেব।”
বিআর-৩ বিপ্লব
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর শুরুর দিকে একটি মাত্র উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ হচ্ছিল পরীক্ষামূলক ভাবে, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত ইরি-৮।
কিন্তু বাংলাদেশে এই জাতটির চাষের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা ছিল এটির জীবনকাল ছিল বেশ দীর্ঘ। তা ছাড়া বোরো মওসুমে চাষ করতে হলে জমিতে সেচের দরকার ছিল, তখনো বাংলাদেশে আধুনিক সেচের পদ্ধতি গড়ে উঠেনি।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা তখন ইরি-৮ এর সঙ্গে বাংলাদেশের একটি স্থানীয় জাতের লতিশাইল ধানের সংকর ঘটিয়ে উদ্ভাবন করলেন নতুন জাত বিআর-৩, যেটির আরেক নাম ছিল বিপ্লব।
কিন্তু এটিও ধান চাষে প্রত্যাশিত সাফল্য আনতে ব্যর্থ হলো।
“মূল সমস্যা হলো ফটো পিরিয়ড সেনসিটিভিটি, অর্থাৎ আলোক সংবেদনশীলতা। বাংলাদেশে রোাপা আমন মওসুমে যত স্থানীয় জাতের ধান লাগানো হতো, তার সবগুলোই ছিল আলোক সংবেদনশীল। যার ফলে এগুলো মাঠে লাগানোর পর হতে ধান কাটার আগে পর্যন্ত সময়টা ছিল অনেক দীর্ঘ। আমাদের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ হলো, কীভাবে স্থানীয় জাতের ধানগুলো থেকে আমরা আলোক সংবেদনশীলতা তুলে নিতে পারি।”
উনিশ’শ পঁচাশি সালে এম এ সালাম ঠিক এই ফটো পিরিয়ড সেনসিটিভিটি বা আলোক সংবেদনশীলতা নিয়ে পিএইচডি করতে গেলেন ফিলিপিন্সে। ফিরে এলেন ১৯৮৮ সালে।
“এবার আমাদের চেষ্টা শুরু হলো কীভাবে স্থানীয় জাতের ধান থেকে আমরা ফটো পিরিয়ড সেনসিটিভিটি আলাদা করতে পারি। এটা যদি করা যায়, এই ধানের চাষ তিন মাসেই করা সম্ভব। এটার বিজ্ঞান আমাদের জানা। এটা পিউর জেনেটিক্স।”
ব্রি-২৯ ঘটালো বিপ্লব
ধান গবেষণায় বাংলাদেশে ধীরে ধীরে সাফল্য আসতে শুরু করলো। একের পর এক উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের প্রচলনের ফলে বাড়তে শুরু করলো খাদ্য উৎপাদন। সবচেয়ে বড় সাফল্য আসলো নব্বুই এর দশকের মাঝামাঝি। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন ব্রি-২৮ এবং ব্রি-২৯ অবশেষে বিপ্লব ঘটিয়ে দিল।
“বাংলাদেশে এখন বছরে যত ধান উৎপাদন হয়, তার অর্ধেক আসে কেবল এই দুটি উফশী জাতের ধান থেকে। ব্রি-২৮ থেকে প্রতি হেক্টরে পাঁচ টন পর্যন্ত ফলন হয়। আর ব্রি-২৯ থেকে প্রতি হেক্টরে ফলন পাওয়া যায় ছয় টন পর্যন্ত। এটা প্রমানিত।”
ডঃ সালাম এ পর্যন্ত যত জাতের ধান গবেষণায় জড়িত ছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম সফল একটি উদ্ভাবন হচ্ছে ব্রি-৫০। ২০০৮ সালে উদ্ভাবিত এই জাতটির জনপ্রিয় নাম বাংলামতি। এই সুগন্ধি জাতের চালের মান অনেকটা বাসমতির মতো।
ধান গবেষণায় তার অবদানের জন্য ডঃ এম এ সালাম ২০০৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রাইস কংগ্রেসে সেরা বিজ্ঞানীর পুরস্কার পান।
বীজ পরিচর্যা করবেন কিভাবে: বীজ পরিচর্যার গুরুত্ব ও উন্নত ফলনের জন্য সঠিক পদ্ধতি – দা এগ্রো নিউজ
মাছ চাষে স্মার্ট প্রযুক্তির উদ্ভাবন বাংলাদেশি তরুণের – দা এগ্রো নিউজ
ফাতেমা ধান’ চাষে বাম্পার ফলন – দা এগ্রো নিউজ
কৃত্রিম মাংসের বার্গার, যা থেকে ‘রক্ত’ও ঝরে – আর বেশি দূরে নয় – দা এগ্রো নিউজ
জমি এবং কৃষক ছাড়াই যেভাবে কৃষিকাজে বিপ্লব আনছে জাপান – দা এগ্রো নিউজ
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন