মৎস্য
কৃত্রিম প্রজননে কোরালের পোনা
সুস্বাদু কোরাল কিংবা ভেটকি মাছের কদর দেশব্যাপী। বঙ্গোপসাগরের গভীর জলের মাছ কোরাল সব সময় হাটবাজারে পাওয়া যায় না। চিংড়ির মতো চাষের মাধ্যমে কোরাল মাছ উৎপাদনের তেমন সুযোগও নেই। কিন্তু এখন যে কেউ চাইলে কোরাল মাছের চাষে হাত বাড়াতে পারেন। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে কক্সবাজারে উৎপাদিত হচ্ছে কোরাল মাছের পোনা।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে কোরাল মাছের পোনা উৎপাদনে সফল হয়েছেন দেশের মৎস্য বিজ্ঞানীরা। সেই সঙ্গে তাঁরা বঙ্গোপসাগরের ‘কক্সবাজার-সোনাদিয়া’ উপকূলের ২৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোরাল মাছের প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করেছেন। গত এক বছর বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের চালানো এক গবেষণায় এ সাফল্য এসেছে।
তবে এটি প্রাথমিক সাফল্য মনে করেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ও দেশের বিশিষ্ট মৎস্য বিজ্ঞানী ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস থেকে শুরু হওয়া এক গবেষণায় প্রথমবারের মতো হ্যাচারিতে কৃত্রিম উপায়ে কোরাল মাছের পোনা উৎপাদনে সাফল্য এসেছে। তবে এ জন্য আরও গবেষণা দরকার। কোরালের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হলে দেশের অর্থনীতি তথা সামুদ্রিক মৎস্য ক্ষেত্রে এক বিপ্লবের সূচনা হবে।
মৎস্য বিজ্ঞানীরা বলেন, এর আগে গবেষণার মাধ্যমেই কক্সবাজারে প্রথমবারের মতো কাঁকড়া পোনা উৎপাদনে সাফল্য পান মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এখন আর দেশে কাঁকড়া পোনার সংকট নেই। এখন কোরালের পাশাপাশি অন্যান্য মূল্যবান ও অর্থকরী মাছেরও কৃত্রিম পোনা উৎপাদনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সূত্রমতে, ‘সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণা জোরদারকরণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে ‘ভেটকির মা মাছ তৈরি ও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন গবেষণা’ শীর্ষক একটি প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হকের নেতৃত্বে এ গবেষণা কাজ পরিচালিত হচ্ছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে গবেষণা চালানোর পর গত মে মাসে সর্বপ্রথম ভেটকি মাছের কৃত্রিম প্রজননে সাফল্য পাওয়া যায়। আর গবেষণা চালাতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো বঙ্গোপসাগরে চিহ্নিত করতে সক্ষম হন কক্সবাজারের কলাতলী থেকে সোনাদিয়া পর্যন্ত ২৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোরাল মাছের প্রজনন ক্ষেত্র।
মৎস্য কর্মকর্তা বলছেন, উপকূলীয় এলাকার অতিপরিচিত সুস্বাদু মাছ কোরাল। এ মাছ কম কাটাযুক্ত, দ্রুত বর্ধনশীল ও খেতে সুস্বাদু বলে এর বাজারমূল্য বেশি। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এ মাছের ব্যাপক চাহিদা ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ প্রতিবেশী দেশগুলো আগেই হ্যাচারিতে কৃত্রিম উপায়ে কোরাল পোনা উৎপাদনে সক্ষম হলেও বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা এত দিন ছিলেন পিছিয়ে।
তবে দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটসহ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘেরের মধ্যে চিংড়ির সঙ্গে কোরাল মাছেরও কিছুটা চাষ হচ্ছে। কোরাল মাছ লবণাক্ত, আধা-লবণাক্ত, এমনকি স্বাদু পানিতেও চাষ করা যায়। এ মাছের রোগবালাই কম বলে সাম্প্রতিককালে অনেকেই চিংড়ি চাষ বাদ দিয়ে কোরাল চাষে নেমেছেন। তবে পোনার সংকটের কারণে অনেকে লাভজনক কোরাল চাষে নামতে পারছেন না। প্রজননের মাধ্যমে কোরাল মাছের পোনা বাজারে সরবরাহ হলে এই মাছ চাষে বিপ্লব শুরু হবে।
কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক বলেন, একটি পরিপক্ব স্ত্রী কোরাল মাছ ৬০ লাখ থেকে ২ কোটি পর্যন্ত ডিম দিতে সক্ষম। ফলে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনের জন্য স্বল্পসংখ্যক মা কোরালই যথেষ্ট। তবে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মা কোরাল তৈরি হওয়ার জন্য যে ৪-৫ বছর সময়টুকু দরকার, তা রক্ষা করতে হবে।
মোহাম্মদ আশরাফুল হক বলেন, কোরাল মাছ প্রথমে পুরুষ হয়ে জন্মায় এবং ৪-৫ বছর পর কিছু স্ত্রীতে রূপান্তরিত হয়। রূপান্তরিত হওয়ার পরই প্রজননের জন্য উপকূলের নদী মোহনার কাছে চলে আসে। কোরাল মাছের প্রজননকাল এপ্রিল থেকে শুরু হলেও সবচেয়ে বেশি ডিম দেয় মে মাসে। গত ২৩ মে সোনাদিয়া উপকূলে গবেষণা চালানোর সময় বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক কোরাল মাছের ডিম পাড়ার দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেন এবং ওখান থেকে সংগৃহীত মা মাছটি হ্যাচারিতে এনে কৃত্রিম উপায়ে তিনি পোনা উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন।
মৎস্য
থাই সরপুঁটি যেভাবে চাষ করবেন

থাই সরপুঁটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক বিশেষ প্রজাতির মাছ। ১৯৭৭ সালে থাইল্যান্ড থেকে মাছটি বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। মাছটি দেখতে দেশি সরপুঁটির মতো। তবে এর বর্ণ দেশি সরপুঁটির চেয়ে আরো উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয়।
বৈশিষ্ট্য
থাই সরপুঁটি খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। এটি বেশ শক্ত প্রকৃতির অধিক ফলনশীল মাছ। প্রতিকূল পরিবেশে কম অক্সিজেনযুক্ত বেশি তাপমাত্রার পানিতেও এ মাছ বেঁচে থাকতে পারে।
চাষের স্থান
এ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পুকুর-ডোবা-জলাশয়। বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত চাষির বাড়ির আশপাশেই রয়েছে একটি বা দুটি মাঝারি আকারের পুকুর কিংবা ডোবা। এসব পুকুর-ডোবায় বছরের অধিকাংশ সময়ই পানি থাকে না। গ্রামাঞ্চলের পতিত এ পুকুর-ডোবাগুলো সামান্য সংস্কার করে অতি সহজেই চাষোপযোগী করা যায়।

উৎপাদন
থাই সরপুঁটি রুই জাতীয় মাছের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম খরচে, কম সময়েও সহজতর ব্যবস্থাপনায় বেশি উৎপাদন পাওয়া সম্ভব। মিশ্র চাষ পদ্ধতিতে উন্নত প্রজাতির মাছের সঙ্গেও অত্যন্ত সফলভাবে এ মাছ চাষ করা যায়। ছয় মাসে একটি থাই সরপুঁটির পোনা গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম ওজনে উন্নীত হয়ে থাকে। একই পুকুরে বছরে দুইবার এ মাছের চাষ করা যায়।
চাষ পদ্ধতি
এ মাছ চাষের জন্য পুকুরের আয়তন ৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ হতে পারে। এর চেয়ে বেশি হলেও ক্ষতি নেই। তবে এক একরের ঊর্ধ্বে না হলেই ভালো। পুকুরের গভীরতা হবে ১.৫ মিটার থেকে ২ মিটার অর্থাৎ তিন থেকে চার হাত।
পুকুর প্রস্তুত
পোনা ছাড়ার আগে পুকুর ভালোভাবে প্রস্তুত করে নিতে হবে। শুকনো মৌসুমে পুকুরের সম্পূর্ণ পানি নিষ্কাশন করে তলার মাটি ১০-১৫ দিন ধরে রোদে শুকাতে হয়। এরপর লাঙল দিয়ে চাষ করে নিতে হবে। পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে রাক্ষুসে মাছ ও অন্যান্য ক্ষতিকর প্রাণি মেরে ফেলার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
চুন ও সার প্রয়োগ
পুকুর প্রস্তুতির জন্য প্রতি শতাংশে এক কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করা দরকার। চুন প্রয়োগের সাত দিন পর প্রতি শতাংশে ৪ কেজি গোবর, ১৫০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা জরুরি। সার পুকুরের তলার মাটির ওপর ছড়িয়ে দিয়ে কোদালের সাহায্যে ভালোভাবে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পর পুকুর পানি দিয়ে ভরে দেওয়া জরুরি।
পোনা
পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য প্লাঙ্কটনের পর্যাপ্ত মজুদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে প্রতি শতাংশে ১.৫ ইঞ্চি থেকে ২ ইঞ্চি সাইজের ৬০-৬৫টি থাই সরপুঁটির পোনা ছাড়া যেতে পারে।
খাবার
পুকুরে যে পরিমাণ মাছ আছে, সে মাছের মোট ওজনের শতকরা চার থেকে ছয় ভাগ হারে চালের কুড়া বা গমের ভুসি সম্পুরক খাদ্য হিসেবে প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে পুকুরের সর্বত্র ছিঁটিয়ে দিতে হবে। খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতি শতাংশে ১৫০ থেকে ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে। থাই সরপুঁটি সাধারণত নরম ঘাস পছন্দ করে। তাই এ মাছের জন্য ক্ষুদে পানা, টোপা পানা, নেপিয়ার ঘাস, কলাপাতা ইত্যাদি প্রতিদিন সামান্য পরিমাণে হলেও সরবরাহ করা যায়।

জাল টানা
প্রতি মাসে একবার জাল টেনে মাছের গড় ওজন নির্ধারণ করে খাবার পরিমাণ ক্রমশ বাড়াতে হবে।
ওজন
পাঁচ-ছয় মাস পালনের পর এক একটি মাছের ওজন দাঁড়াবে গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম। এ সময় মাছ বাজারজাত করার পুরোপুরি উপযোগী হয় এবং সর্বনিম্নে ৮০ টাকা কেজি হিসেবে বিক্রি করা যায়।
মৎস্য
জেনে নিন গলদা চিংড়ি ঘেরের বৈশিষ্ট্য

গলদা চিংড়ি চাষে সফলতা পেতে উপযুক্ত ঘের অবশ্যই জরুরি। একটি ঘেরের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য থাকলে তা গলদা চিংড়ি চাষের জন্য উপযুক্ত। আসুন জেনে নেই ঘেরের বৈশিষ্ট্যসমূহ-
বৈশিষ্ট্য
• গলদা চিংড়ি চাষের জন্য নির্বাচিত ঘেরে ৪-৬ মাস ৩.০-৪.০ ফুট উচ্চতার পানি ধরে রাখার সুবিধা থাকতে হবে।
• ঘেরের মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বেশি থাকতে হবে; যাতে ঘের তাড়াতাড়ি শুকিয়ে না যায়।
• সাধারণত দো-আঁশ বা বেলে ও দো-আঁশ মাটির ঘের গলদা চিংড়ি চাষের জন্য উপযুক্ত।
• ঘের একটু নিচু জায়গায় হলে পানি ধরে রাখতে সুবিধা হয়।

- ঘেরে বন্যার পানি যেন প্রবেশ না করতে পারে এবং বন্যা বা বৃষ্টির পানিতে বাঁধ যেন প্লাবিত না হয়।
- নিচু ঘেরের বাঁধ উঁচু করে বেঁধে বন্যামুক্ত করে চিংড়ি চাষের উপযুক্ত করা যায়।
- ঘেরের আকার ৩০-১০০ শতাংশ হলে ব্যবস্থাপনার জন্য সুবিধা হয়।
- ঘেরে যথেষ্ট সূর্যালোক পড়তে হবে।
- ঘেরে উৎপাদিত চিংড়ি বাজারজাত করার সুবিধা থাকতে হবে।
ছাদকৃষি
ছাদে যেভাবে মাছ চাষ করবেন

এখন অনেকেই ছাদে মাছ করছেন। কেউ কেউ পরিবারের চাহিদা পূরণ করে বিক্রি করেও বাড়তি আয় করেন। মাছ চাষে আপনার যেমন প্রতিদিনের প্রয়োজন মিটবে তেমনি অর্থনৈতিক ভাবেও আপনি হতে পারেন সাবলম্বী। অবশ্য এ জন্য আপনার মাছের ঘের বা পুকুরের দরকার হবে না। সাধারণ পদ্ধতির চেয়ে ঘরের ভেতর বা আঙিনায় অথবা বাড়ির ছাদে ড্রামে বা ট্যাঙ্কিতে মাছ চাষ করে তিনগুণেরও বেশি লাভবান হতে পারেন। এমন পদ্ধতি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা।
আধুনিক এ প্রযুক্তির নাম ‘বায়োফ্লক’। এ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একোয়াকালচার বিভাগের একদল গবেষক। গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ছাদে স্থাপন করা হয়েছে বায়োফ্লক ল্যাব। গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন একোয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান ড. এ এম সাহাবউদ্দিন।
বায়োফ্লক সম্পর্কে গবেষক দলের প্রধান ড. এ এম সাহাবউদ্দিন বলেন, ‘বায়োফ্লক হলো প্রোটিনসমৃদ্ধ জৈব পদার্থ এবং বিভিন্ন অণুজীবের সমষ্টি। এখানে অণুজীব মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মূলত উপকারী ব্যাকটেরিয়া দিয়ে পানিতে উচ্চ কার্বন নাইট্রোজেন অনুপাত নিশ্চিত করে ক্ষতিকর অ্যামোনিয়াকে রূপান্তর করা হয় অণুজীব আমিষে।’
বায়োফ্লক প্রযুক্তিতে মাছ চাষের প্রক্রিয়া সম্পর্কে গবেষকরা জানান, প্রথমে ট্যাঙ্কে পানি দিয়ে এক সপ্তাহ অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে। এতে আয়রন বা অন্য ভারী পদার্থ থাকলে উপরে জমা হবে। এরপর প্রতি ১ হাজার লিটারে এক কেজি হারে আয়োডিনমুক্ত সাধারণ লবণ প্রয়োগ করতে হবে। এরপর টিডিএস ১২০০ এর ওপরে হলে প্রতি ১ হাজার লিটারে ১০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করতে হবে। কার্বনের উৎস হিসেবে চিটাগুড় ৫০-১০০ গ্রাম দিতে হবে। সবসময় অক্সিজেনের সরবরাহ রাখতে হবে। দুই সপ্তাহ পর এতে বায়োফ্লক (ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া, শৈবাল, ডায়াটম) তৈরি হবে। পানিতে ৩০-৪০ সেন্টিমিটার বায়োফ্লক তৈরি হলে মাছ ছাড়া যাবে। এ জন্য দরকার উপকারী ব্যাকটেরিয়ার উৎস, নিয়মিত পানির গুণাগুণ পরীক্ষা, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বদা বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা।

ড. এ এম সাহাবউদ্দিন আরো বলেন, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে শিং, মাগুর, পাবদা, গুলশা, কৈ, তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা যেতে পারে। যেখানে উৎপাদন বাড়বে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে তিনগুণ। রোগের প্রাদুর্ভাব কম হওয়ায় স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দশগুণ বেশি ঘনত্বে মাছ চাষ করা যায়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য মাছ চাষের এ প্রযুক্তি হতে পারে নতুন দিগন্ত।
মাঠ পর্যায়ে এ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের বিষয়ে তিনি বলেন, দেশব্যাপী এ প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে পারলে মাছের উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব।
আপনিও বাড়ির ছাদে মাছ চাষের চেষ্ট করতে পারেন।
মৎস্য
অ্যাকুরিয়ামে মাছ চাষ করবেন যেভাবে

অ্যাকুরিয়ামে মাছ চাষ করলে দেখতে অনেক সুন্দর লাগে। পরিবেশের সৌন্দর্য বাড়ায়। ইচ্ছা করলে এই মাছ অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা বাসায় চাষ করতে পারেন। আসুন তবে জেনে নেই নিয়ম-কানুন।
অ্যাকুরিয়াম বাছাই
অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা
বাসায় মাছ চাষ করার জন্য মাঝারি অথবা বড় সাইজের অ্যাকুরিয়ামের ব্যবস্থা
করতে পারেন। তবে খেয়াল রাখবেন সেটি যেন গভীর হয়।
মৌসুম
সাধারণত তিন ধাপে এ মাছ চাষ করা যায়।
গ্রীষ্মকালে টাইগার বার্ব, রোজিবার্ব, উইডো টেট্রা, শার্পে টেট্রা,
সোর্ডটেল, মলি, প্লাটি ইত্যাদি। বর্ষাকালে পার্ল গোরামি, কিসিং গোরামি,
ডোয়ার্ফ গোরামি, ব্লু চিকলিড, জেব্রা চিকলিড, টেট্রা, টাইগার ইত্যাদি।
শীতকালে গোল্ড ফিস, কই কার্প, ম্যানিলা কার্প, ক্যাট ফিস ইত্যাদি।

পোনা সংগ্রহ
যেকোন নার্সারি থেকে পোনা সংগ্রহ করতে পারেন। পোনা সংগ্রহ করার সময় সুস্থ-সবল পোনা দেখে নিবেন।
চাষাবাদ পদ্ধতি
অ্যাকুরিয়ামে মাছ চাষের জন্য সঠিক তাপমাত্রা প্রয়োজন। এছাড়া অ্যাকুরিয়ামের ভেতরে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে হবে।

খাবার
মাছের পোনাকে সঠিক নিয়মে খাবার দিতে হবে।
পোনার প্রিয় খাবার ব্রাইন শ্রিম্প, ইনফুসুরিয়ান্স, ওয়াটার ফ্লি, স্লাডজ
ওয়ার্মস, ব্লাড ওয়ার্ম ইত্যাদি।
রোগ-বালাই
মাছের যত্ন নিতে হবে। যদি কখনো মাছের রোগ দেখা দেয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে অথবা উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

মাছের যত্ন
নিয়মিত অ্যাকুরিয়ামের যত্ন নিতে হবে। সময়মতো পানি পরিষ্কার বা পরিবর্তন করতে হবে। অবশিষ্ট খাবার তুলে ফেলতে হবে। এছাড়া মাছের বর্জ্য ও মরা মাছ তুলে ফেলতে হবে।
মৎস্য
বাঙালির পাতে ফিরছে আরও তিন দেশি মাছ

দেশে মিঠা পানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ছোট মাছ ১৪৩ প্রজাতির। এরমধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ ছিল বিলুপ্তপ্রায়। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যম বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) বিলুপ্তপ্রায় এসব মাছ ফিরিয়ে আনছে। এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে ৩১ প্রজাতির মাছের সফল প্রজনন। বাঙালির পাতে ফিরছে কুর্শা, লইট্যা ট্যাংরা ও বটিয়া পুইয়া নামে আরও তিন প্রজাতির দেশি ছোট মাছ।
এছাড়াও নতুন করে কাজুলি, হিরালু, দেশি শোল, বাছা মাছ নিয়ে চলছে গবেষণা। আগামী বছরের জুন-জুলাইয়ে এসব মাছের চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন সম্ভব হবে বলে আশা। পাবদা, গুলশা টেংরা, গুজি আইড়, চিতল, ফলি, মহাশোল, বৈরালী, বালাচাটা, গুতুম, কুচিয়া, ভাগনা, খলিশা, গজার, রানি, বাতাসি, পিয়ালিসহ ৩১ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছ চাষের পদ্ধতি উদ্ভাবন করে মৎস্যচাষিদের হাতে তুলে দিয়েছেন বিএফআরআই’র গবেষকরা।
উদ্ভাবিত এসব মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ। এসব উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করে তোলে। পাশাপাশি রক্তশূন্যতা, গলগণ্ড, অন্ধত্ব প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলাশয় সংকোচন, অতি আহরণসহ নানাবিধ কারণে মাছের প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র বিনষ্ট হওয়ায় প্রাকৃতিক জলাশয়ে ছোট মাছের প্রাপ্যতা ক্রমে কমছে।

বিএফআরআই সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০৯ সালে পুকুরে দেশি ছোট মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার ৩৪০ মেট্রিক টন, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আড়াই লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়। অর্থাৎ গত ১০ বছরে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৪ গুণ। দেশের মৎস্য উৎপাদনে দেশি ছোট মাছের অবদান ৩০-৩৫ শতাংশ। চাষাবাদ বাড়ায় বর্তমানে হ্যাচারিতে দেশি মাছের পোনা ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। পোনা প্রাপ্তি সহজতর হওয়ায় মাঠ পর্যায়ে পাবদা, গুলশা, শিং, টেংরা, মাগুর ও কৈ মাছ চাষ হচ্ছে ব্যাপক পরিসরে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী চাষের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার ধীরগতি হলেও গত এক দশকে বাংলাদেশে এর প্রবৃদ্ধির ধারা ৯.১ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালে দেশে মাছের মোট উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৪৫ লাখ তিন হাজার টন, যা আগের বছরের চেয়ে এক লাখ ১৯ হাজার টন বেশি।
আগে শুধু বিএফআরআই ময়মনসিংহের স্বাদুপানি গবেষণা কেন্দ্র থেকে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে গবেষণা পরিচালনা করা হতো। বর্তমানে বগুড়ার সান্তাহার, নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর ও যশোর উপকেন্দ্রেও বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণে গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে।

নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা গত জুন-জুলাই মাসে বিলুপ্তপ্রায় তিনটি মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করেছেন। এতে নেতৃত্ব দেওয়া স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খোন্দকার রশীদুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, সম্প্রতি আমরা কুর্শা, লইট্যা ট্যাংরা, বটিয়া মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছি। কিছু মাছ তো হারিয়ে যাওয়ার পথে। এখন তাদের বাসস্থান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব মাছ তাদের নতুন প্রজন্ম তৈরি করার মতো জায়গা পাচ্ছে না, সেজন্য এসব মাছ ভবিষ্যতে হারিয়ে যেতে পারে।
‘এখন আমাদের ফিশারিজ পরিবারের দায়িত্ব এগুলো ধরে রাখা। ইতোমধ্যে ৩১ প্রজাতির মাছ আমরা ফিরিয়ে এনেছি। এরমধ্যে সৈয়দপুরে উপকেন্দ্রই ফিরিয়ে আনতে পেরেছি নয়টি প্রজাতি। তিস্তা নদী থেকে এসব মাছ সংগ্রহ করা হয়। আমাদের পোনা উৎপাদন কলাকৌশল উদ্ভাবন হওয়ায় ভবিষ্যতে এসব মাছ হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেলো।’
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, বিলুপ্তপ্রায় ৬৪টি মাছের মধ্যে অনেকগুলোই আমরা ফিরিয়ে এনেছি। গত জুন-জুলাই মাসে আরো তিনটি মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন আমাদের গবেষকরা। আগামী জুন-জুলাইয়ে বর্ষা মৌসুমে আরও কয়েকটি জাত ফিরবে। আমরা আরও চারটি জাত নিয়ে কাজ করছি।

‘মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা কার্যক্রম সম্প্রতি জোরদার করা হয়েছে এবং দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে গবেষণার। পর্যায়ক্রমে সব দেশি মাছ পুনরুদ্ধারের জন্য স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় সব দেশি মাছ পর্যায়ক্রমে খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনাই এসব গবেষণার মূল উদ্দেশ্য।’
জানা যায়, গত বছর সেপ্টেম্বরে দেশে প্রথমবারের মতো বিএফআরআইয়ে দেশি মাছের লাইভ জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেশি প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে এ লাইভ জিন ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। প্রতিষ্ঠিত এ লাইভ জিন ব্যাংকে দেশের বিলুপ্তপ্রায় ভাগনা, দেশি কই, নাপিত কই, গুলশা, খলিশা, লালখলিশা, মাগুর, বোয়ালিপাবদা, সরপুঁটি, পুঁটি, শিং, মহাশোল, রুই, বুজুরি টেংরা, ভিটা টেংরা, বাটা, রিটা, মলা, পুইয়াগুতুম, পাহাড়ি গুতুম, ঠোঁটপুইয়া, শালবাইম, টাকি, ফলি, ঢেলা, চেলা, লম্বা চান্দা, রাঙাচান্দা, লালচান্দা, পিয়ালি, বৈরালি, দারকিনা, ইংলা, কেপ চেলা, রানি, কাকিলা, কাজলি, ভাচা, বাতাসি, আঙ্গুস, কানপোনা, ঘাউরা, ভেদা, কাকিলা, বাঁশপাতাসহ মোট ৮৮ প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব দেশি মাছ এ ব্যাংকে সংরক্ষণ করা হবে। দেশব্যাপী এ সংরক্ষণ কার্যক্রম এখনো অব্যাহত।
মাছের জার্মপ্লাজম সংরক্ষণের জন্য লাইভ জিন ব্যাংক একটি আধুনিক ধারণা। জিন ব্যাংক মূলত কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের জেনেটিক উপাদানের সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা। কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ যখন হুমকির সম্মুখীন হয় তখন জিন ব্যাংকের প্রয়োজন হয়। প্রাকৃতিক উৎসে কোনো দেশি মাছ হারিয়ে গেলে সেসব মাছ পুনরুদ্ধারের জন্য লাইভ জিন ব্যাংক থেকে ব্যবহার করা যাবে।

এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, বিলুপ্তপ্রায় দেশি প্রজাতির মাছের চাষপ্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে সরকার কাজ করছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে ৩১ প্রজাতির দেশি বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজনন কৌশল ও চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। আরও বেশ কিছু প্রজাতির দেশি মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন নিয়ে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা চলমান।
‘দেশি মাছ সংরক্ষণে প্রথমবারের মতো ময়মনসিংহে ‘লাইভ জিন’ ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। ময়মনসিংহে অবস্থিত এই জিন ব্যাংকে ইতোমধ্যে ৮৮ প্রজাতির মাছের জিন সংরক্ষণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশি সব মাছ এ ব্যাংকে সংরক্ষণ করা হবে। সরকারের উদ্যোগের ফলে বাজারে এখন বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে। আবার বাঙালির পাতে ফিরে আসছে নানা স্বাদের দেশি মাছ।’



















অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন