মৎস্য
মাছের আঁশে স্বপ্ন দেখেন কুমিল্লার মাহবুব
মাছের আঁশে জীবন বাঁচে, এই ধারণাটার সাথে আগে থেকে অনেকেই পরিচিতি না হলেও এখন বাস্তবে তাই হচ্ছে। বাতিল জিনিষ মানেই যে ফেলনা নয়, এটা এখন প্রমাণিত। মাছের আঁশে তৈরি হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। শুধু তাই নয় বিভিন্ন প্রসাধনসামগ্রী, ফুড সাপ্লিমেন্ট তৈরিতে ব্যবহৃত হয় মাছের আঁশ। এছাড়াও কোলাজেন নামক একটি পণ্য বিক্রি হয় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের দোকানে দোকানে। তাও তৈরি হয় মাছের আঁশ দিয়ে এসব কথাও জানান কুমিল্লার মাহবুব।
মাহবুবব বাসসকে বলেন, জীবনে কখনও ভাবেননি মাছের আঁশের ব্যবসা করবেন। আর এখন পুরো ধ্যানজ্ঞানই তার এই ফেলনা জিনিসটি। প্রায় ১২ বছর আগে মাহবুবের সাথে এক আঁশ ক্রেতার পরিচয় হয় ঢাকায়। সেই যে হাঁটা শুরু করলাম, আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
মাহবুব কুমিল্লা নগরীর ১৬নং ওয়ার্ডের সংরাইশ এলাকার ইয়াকুব আলীর ছেলে। বাবা-মার চার ছেলে মেয়ের মধ্যে মাহবুব সবার বড়। গত ১৪ বছর ধরে তিনি কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারে মাছ কাটেন আর ১২ বছর ধরে মাছের আঁশের ব্যবসা করেন। এখন তার দেখাদেখি আরো কয়েক যুবক এই মাছের আঁশের ব্যবসা শুরু করেছেন।
মাহবুব বাসসকে জানান, একদিন ঢাকায় দেবদূতের ন্যায় দেখা হলো এক ব্যবসায়ীর সাথে। তিনি জানালেন, মাছের আঁশগুলো বাসা বাড়ি কিংবা বাজার থেকে সংগ্রহ করে শুকিয়ে আমাকে দিলে আমি কেজি প্রতি তোমাকে ৪০ টাকা দেব। এ কথায় কুমিল্লা এসে একটি পাত্র নিয়ে সকালেই চলে গেলাম রাজগঞ্জ বাজারে। বাজারে দুপুর পর্যন্ত থেকে মাছের আঁশ সংগ্রহ করে ঝাকুনীপাড়া সংলগ্ন এই গোমতী নদীর পাড়ে শুকিয়ে ঐ ব্যবসায়ীকে দিলাম ৬ কেজি মাছের আঁশ। তিনি আমাকে ৪০ টাকা ধরে ২৪০ টাকা দিলেন নগদ। এতে আমার আস্থা এবং উৎসাহ বেড়ে গেল। শুরু করলাম পেশা হিসেবেই মাছের আঁশ সংগ্রহ করাকে। এরপর থেকে কুমিল্লা নগরীর রাজগঞ্জ, চকবাজার, রানীর বাজার, টমছমব্রিজ, বাদশা মিয়ার বাজার, পদুয়া বাজার চৌয়ারা বাজার, ক্যান্টনমেন্ট বাজারসহ নানা বাজারে লোক নিয়োগ করি। আমার এ কাজে আমাকে ছয়জন সহযোগিতা করেন। যারা প্রত্যেকেই মাসিক বেতনভুক্ত। আমার এই সহযোগীরা বিভিন্ন বাজার থেকে মাছের আঁশ সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন আর আমি তা শুকিয়ে প্রস্তুত করি। ঢাকার পাইকাররা আমার বাড়ি এসে প্রতি মাসে এই মাছের আঁশ নিয়ে যান। মাসে গড়ে আমি ৬০০ কেজি মাছের আঁশ শুকিয়ে বিক্রির উপযোগী করতে পারি।
মাহবুবের দেখাদেখি কুমিল্লার বাদশা মিয়া বাজারের বাদশা আর চান্দিনার খলিলও এখন এই ব্যবসা শুরু করেন।
মাহবুব বলেন, প্রথম প্রথম এলাকার মানুষ আমাকে অন্য চোখে দেখত। ঘৃণা করত। বলত যেই মাছের আঁশ আমরা ডাস্টবিনে ফেলে দেই আর সেগুলো সে বাড়ি এনে শুকায়। এখন স্বল্প পুঁজিতে ব্যবসা বেশি এখন অনেকেই এই পেশায় আগ্রহী হতে শুরু করেছে।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন বাসসকে বলেন, মাছের আঁশ শুকিয়ে বিদেশে রপ্তানি করার হচ্ছে। মাহবুবকে জেলা মৎস্য অফিস থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। সে যেন সঠিক ভাবে এই কাজটি করতে পারে।
মৎস্য
মাছ রোগাক্রান্ত হলে প্রতিকার করবেন যেভাবে

মাছেরও বিভিন্ন রকম রোগ বালাই আছে। এসব রোগ মাছ চাষের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা। বছরে অনেক সময় মাছ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। বিভিন্ন কারণে উন্মুক্ত জলাশয়ের চেয়ে বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করা মাছে রোগের প্রকোপ বেশি দেখা দেয়। তাই পুকুর-দীঘির মাছ প্রায়ই নানা রোগের কবলে পড়ে।
আমাদের দেশে প্রায় ৩২ প্রজাতির মাছ ক্ষত রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মাছের গায়ে ক্ষতের সৃষ্টি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এ রোগে মাছের গায়ে ছোট ছোট লাল দাগ দেখা যায়। লাল দাগের স্থানে গভীর ক্ষত হয়। মাছ দ্রুত মারা যায়। চোখ নষ্ট হতে পারে। ক্ষত স্থান থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। মাছ খাদ্য গ্রহণ করে না।
ক্ষতে চাপ দিলে দুর্গন্ধ ও পুঁজ বের হয়। মাছ দুর্বল হয় এবং ভারসাম্যহীনভাবে চলাফেরা করে। আক্রান্ত বেশি হলে লেজ ও পাখনা পচে খসে পড়ে।
দেশে সাধারণত শোল, গজার, টাকি, পুঁটি, বাইন, কৈ, মৃগেল, কার্পিও এবং পুকুরের তলায় বসবাসকারী অন্যান্য প্রজাতির মাছ ক্ষত রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।

মাছের ক্ষত রোগ সম্পর্কে মৎস্য চাষিরা কম-বেশি সবাই জানেন। এ রোগ সম্পর্কে ভালোভাবে জানার উপায় আক্রান্ত মাছের গায়ে ক্ষত বা ঘাজনিত লাল দাগ দেখা যায়। এই দাগের আকৃতি ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঘা মাছের লেজের গোড়া, পিঠ ও মুখের দিকেই বেশি হয়ে থাকে। এ রোগ দেখা মাত্র মাছ পুকুর থেকে দ্রুত তুলে ফেলতে হবে। ১০ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম লবণ গুলে লবণমিশ্রিত পানিতে রোগাক্রান্ত মাছ পাঁচ থেকে ১০ মিনিট ডুবিয়ে রেখে আবার পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে।
ক্ষত রোগে আক্রমণের আগেই প্রতি বছর আশ্বিন মাসের শেষে কিংবা কার্তিক মাসের প্রথম দিকে পুকুরে শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে পাথুরে চুন ও এক কেজি হারে লবণ দিতে হবে। তাহলে সাধারণত আসন্ন শীত মৌসুমে ক্ষত রোগের কবল থেকে মাছ মুক্ত থাকবে।
মাছের পেট ফোলা রোগে সাধারণত রুই জাতীয় মাছ, শিং-মাগুর ও পাঙাশ মাছ বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। পেট ফোলা রোগাক্রান্ত মাছের দেহের রং ফ্যাকাশে হয়ে যায়। পেটে পানি জমার কারণে পেট ফুলে থাকে। মাছ ভারসাম্যহীনভাবে চলাফেরা করে।
বেশির ভাগ সময়ই পানির ওপর ভেসে ওঠে এবং খাবি খায়। আক্রান্ত মাছ খুব দ্রুত মারা যেতে পারে। প্রতিকার হিসেবে প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে মাছের খাদ্যের সঙ্গে ফিশমিল ব্যবহার করা জরুরি। এছাড়া পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনসহ মাছকে নিয়মিত সুষম খাদ্য প্রদান করতে হবে।
মাছের মধ্যে পাখনা ও লেজ পচা রোগে সাধারণত রুইজাতীয় মাছ, শিং-মাগুর ও পাঙাশ মাছ আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ রোগে আক্রান্ত হলে প্রাথমিকভাবে পিঠের পাখনা এবং ক্রমান্বয়ে অন্যান্য পাখনাও আক্রান্ত হয়। কোনো কোনো মৎস্যবিজ্ঞানীর বলছেন, অ্যারোমোনাডস ও মিক্সোব্যাকটার গ্রুপের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এ রোগের সংক্রমণ ঘটে। পানির ক্ষার স্বল্পতা ও পিএইচ ঘাটতি দেখা দিলেও এ রোগের উৎপত্তি হতে পারে। এরোগ আক্রান্ত মাছ পুকুর থেকে তুলে ০.৫ পিপিএম পটাশযুক্ত পানিতে আক্রান্ত মাছকে ৩ থেকে ৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। পুকুরে সাময়িকভাবে সার দেয়া বন্ধ করতে হবে।

এছাড়া রোগজীবাণু ধ্বংসের পর মজুতকৃত মাছের সংখ্যা কমিয়ে ফেলতে হবে। এ অবস্থায় প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় মাছেরই উকুন রোগ দেখা দেয়। এরমধ্যে রুই মাছ, কখনো কখনো কাতল মাছও আক্রান্ত হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এ রোগে মাছের সারা দেহে উকুন ছড়িয়ে দেহের রস শোষণ করে মাছকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়।
এতে মাছ ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে মারা যেতে পারে। মাছের উকুন রোগের প্রতিকার করার জন্য শতকরা আড়াই ভাগ লবণ দ্রবণে কিছু সময় আক্রান্ত মাছ ডুবিয়ে রাখতে হবে। এতে করে উকুনগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়বে। এ অস্থায় হাত কিংবা চিমটা দিয়ে উকুনগুলো মাছের শরীর থেকে তুলে ফেলতে হবে। অনেক সময় মাছের পুষ্টির অভাবজনিত রোগ দেখা দেয়।
এ রোগে পুকুরে চাষযোগ্য যে কোনো মাছই আক্রান্ত হতে পারে। ভিটামিন ‘এ ডি এবং কে’-এর অভাবে মাছ অন্ধত্ব এবং হাড় বাঁকা রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। মাছের খাবারে আমিষের ঘাটতি দেখা দিলেও মাছের স্বাভাবিক বর্ধন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত হয়। অচিরেই মাছ নানা রোগের কবলে পড়ে।
মাছ এসব রোগে আক্রান্ত মাছকে খাবারের সঙ্গে প্রয়োজনীয় মাত্রায় সুনির্দিষ্ট ভিটামিন ও খনিজ লবণ মিশিয়ে খাওয়ানো হলে যথা শিগগিরই মাছের শারীরিক অবস্থার উন্নতি সম্ভব। মাছের রোগ প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মাছ চাষ করে চাষকৃত পুকুরে মাছের রোগ প্রতিরোধ করা অনেকাংশেই সম্ভব।
মৎস্য
খাঁচায় বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির মাছ চাষ

মৎস্য উৎপাদনের বিবেচনায় বাংলাদেশের জলজ সম্পদ একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় উৎস হলেও এখনও পর্যন্ত এই জলজ সম্পদকে যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে সুষম উৎপাদনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভবপর হয়নি। উন্মুক্ত জলাশয় প্রধানত ব্যবস্থাপনা নির্ভর সম্পদ হওয়ায় বদ্ধ জলাশয়ের চেয়ে এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত চাষাবাদের বিষয়টিকে পূর্বে সেরূপ গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
ইতোমধ্যে দেশের বদ্ধ জলাশয়সমূহ থেকে চাষাবাদের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও তা দ্রুত বর্ধনশীল জনগোষ্ঠীর মৎস্য চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত নয় । এরূপ অবস্থায় সম্ভবনাময় আরও ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করে ব্যবহারের আওতায় সহনশীল উৎপাদন প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত না করা হলে চাহিদা ও সরবরাহের এই ব্যবধান দিন দিন বেড়েই চলবে ।
মুক্ত জলাশয় ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি তাই উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মৎস্য উৎপাদনে গুরুত্বারোপ করা হলে খাদ্য সরবরাহন ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে । এরূপ বিবেচনায় নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ একটি উৎসাহজনক প্রযুক্তি।
অতি সনাতন কাল থেকে বাঁশ বা জালের তৈরি খাঁচায় মাছ লালন পালনের ইতিহাস থাকলেও সে সময়ে এময়ে এসবের লাভ লোকসানের হিসাব এতটা বিবেচ্য ছিল না । তবে চীন সাগরে ও ভারতে মহাসাগরে প্রায় ৩ যুগ পূর্ব থেকেই বাণিজ্যিক বিবেচনায় খাঁচায় মাছ চাষের প্রচলন শুরু হয়েছিল ।
বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশেও বিভিন্ন নদ নদীতে খাঁচায় তেলাপিয়া চাষ হচ্ছে । কিন্তু দেশীয় প্রজাতির মাছ যেমন-পাবদা, গুলশা, মাগুর, শিং, ইত্যাদি খাঁচায় চাষের সম্ভাবত্য যাচাইয়েই লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউট, স্বাদুপানি কেন্দ্র , ময়মনসিংহ গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করে ।
বিগত কয়েক বছর ধারাবাহিক গবেষণার পর খাঁচায় বিলুপ্তপ্রায় গুলশা মাছ চাষের লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছে । সহনশীল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভাসমান খাঁচায় সুস্বাদু উচ্চমূল্যের বিলুপ্তপ্রায় গুলশা মাছ চাষ করা হলে তা মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও পুষ্টির অভাব পূরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলে আশা করা যায় ।
মৎস্য
নিজেই চাষ করুন পাবদা মাছ

পাবদা মাছ বাংলাদেশের ছোট মাছের মধ্যে অন্যতম। মিঠাপানির এ মাছ নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়ে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। পাবদা অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সুস্বাদু মাছ। বর্তমানে পাবদা মাছ আমাদের দেশে প্রায় বিলুপ্তির পথে। তাই কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পাবদা মাছ রক্ষা করা সম্ভব। তাই নিজেই চাষ করুন পাবদা মাছ।
পুকুর নির্বাচন
এ মাছ চাষের জন্য ৭-৮ মাস পানি থাকে এমন ১৫-২০ শতাংশের পুকুর বা জলাশয় নির্বাচন করুন। তবে পুকুরটি বন্যামুক্ত হতে হবে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
মাছ বাছাই
পাবদা মাছের পুরুষ ব্রুড বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পুরুষ মাছটি আকারে তুলনামূলকভাবে স্ত্রী মাছের চেয়ে ছোট। পুরুষ মাছের প্রজনন ঋতুতে পেট চাপা থাকে এবং পুরুষ মাছের বুকপাখনা খাঁজকাটা থাকে। স্ত্রী ব্রুড বাছাইয়ের ক্ষেত্রে স্ত্রী মাছটি আকারে তুলনামূলকভাবে পুরুষ মাছ থেকে বড় হয়। স্ত্রী মাছের প্রজনন ঋতুতে পেট ফোলা ও নরম থাকে এবং স্ত্রী মাছের বুকপাখনা তেমন খাঁজকাটা থাকে না।
পুকুর প্রস্তুত
শুকনো মৌসুমে পুকুর থেকে জলজ আগাছা পরিষ্কার ও পাড় মেরামত করুন। তবে ছোট মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুর শুকানো উচিত নয়। তাই বারবার ঘন ফাঁসের জাল টেনে রাক্ষুসে মাছ ও ক্ষতিকর প্রাণী অপসারণ করে নিন। এরপর প্রতিশতকে ১-২ কেজি পাথুরে চুন প্রয়োগ করুন। মাটির গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে চুনের মাত্রা কম-বেশি হতে পারে। পোনা ছাড়ার আগে সার প্রয়োগ করুন, যাতে পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মাতে পারে। এছাড়া প্রতিশতকে ৪-৬ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে পারলে ভালো হয়। মনে রাখবেন, পানির রং সবুজ বা বাদামি-সবুজ হলে পোনা ছাড়ার উপযুক্ত সময়।
পোনা মজুদ
ভালো জাতের সুস্থ, সবল ও সঠিক পোনা সঠিক সংখ্যায় মজুদ করতে হবে। পুকুরে পোনা ছাড়ার আগে পরিবহনকৃত পোনা পুকুরের পানির তাপমাত্রার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এর জন্য ১০ লিটার পানি ও ১ চামচ পটাসিয়াম পারম্যাংগানেট অথবা ১০০ গ্রাম লবণ মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করতে হবে। এরপর তাতে ১-২ মিনিট গোসল করিয়ে পোনা জীবাণুমুক্ত করতে হবে। শতাংশ প্রতি ৩-৪ গ্রাম ওজনের সুস্থ্য-সবল ২০০-২৫০টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে।
খাদ্য ও সার
চুন প্রয়োগের ৩ দিন পর প্রতিশতাংশে ৭-৮ কেজি গোবর প্রয়োগ করতে হবে। সম্পূরক খাদ্য হিসেবে দেহ ওজনের ৫-১০ ভাগ হারে ২৫-৩০% আমিষ সমৃদ্ধ খাবার প্রতিদিন ২ বার প্রয়োগ করতে হবে। প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদনের জন্য ১৫ দিন অন্তর ৪ কেজি গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে।
মাছ আহরণ
পুকুরের মাছ ৭-৮ মাসের মধ্যে ৩০-৩৫ গ্রাম ওজনের হলে আহরণ করা যাবে।
মৎস্য
শোল মাছ চাষ করবেন যেভাবে

শোল মাছকে আমরা ‘রাক্ষুসে মাছ’ বলে থাকি। শোল মাছ বাজারের দামি মাছ। এই মাছ দামি হলেও চাষে খরচ খুবই কম। শোল মাছ সব ধরনের দুর্যোগ বা প্রতিকূল পরিস্থিতি সহ্য করতে পারে। মা শোল মাছই নিজেদের মতো করে ডিম নার্সিং ও পোনা লালন করে।
পোনা মজুত
বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে শোল মাছ চাষ না হওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে সংগ্রহের ওপর জোর দিতে হবে। বৈশাখ মাস শোল মাছের প্রজনন মৌসুম। বৈশাখ মাসের প্রথম থেকে শোল মাছ বাচ্চা দিতে শুরু করে। বাচ্চাগুলো এক ঝাঁকে থাকে। সেই সময় হাওর-বাঁওড়, পুকুর থেকে সপ্তাহখানেক বয়সের বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে। পোনা পাওয়া না গেলে বড় শোল মাছ সংগ্রহ করে পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। এককভাবে প্রতি শতাংশে ১০টি দেয়া যেতে পারে। মিশ্র পদ্ধতিতে চাষের জন্য প্রতি শতাংশে ৪টি। একটি প্রাপ্তবয়স্ক শোল মাছ লম্বায় ২.৫-৩ ফুট হতে পারে।

পুকুর প্রস্তুতি
যেকোনো পুকুরেই শোল মাছ চাষ করা যায়। তবে তাকে উপযুক্ত পরিবেশ দিতে হবে। যে পুকুরে শোল চাষ হবে সে পুকুরে কচুরিপানা অথবা কলমিলতা থাকলে ভালো হয়। কারণ শোল মাছ আড়ালে থাকতে পছন্দ করে। তবে কচুরিপানায় যেন পুকুর ভরে না যায়। পুকুরের চারদিকে কমপক্ষে ৫ ফুট উচ্চতায় জাল দিয়ে বেড়া দিতে হবে। তা না হলে বর্ষাকালে শোল মাছ লাফিয়ে চলে যাবে।

খাদ্য
শোল মাছ সাধারণত খৈল বা কুড়া দিয়ে বানানো খাবার খায় না। ছোট মাছই এর প্রধান খাদ্য। পোনা মাছের প্রিয় খাদ্য শুঁটকির গুঁড়া। সেজন্য পোনা মাছকে খাবার হিসেবে চিংড়ি শুঁটকির গুঁড়া ভালোভাবে পিষে দিতে হবে। এভাবে ১৫ দিন খাওয়ানোর পর পোনাগুলো প্রায় ২/৩ ইঞ্চি হবে। ২/৩ ইঞ্চি পোনা মজুদের পর খাদ্য হিসেবে কার্পজাতীয় মাছের ধানীপোনা দেয়া যেতে পারে; সঙ্গে ছোট ছোট ব্যাঙ বা ব্যাঙাচি দেয়া যেতে পারে। আর বড় মাছের জন্য ছোট ছোট মাছ, তবে মরা টাটকা মাছ খেতে দিলে এরা খুব খায়।
মিশ্র চাষ
আমাদের দেশে শোল মাছের একক চাষের সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ এত কাঁচা মাছ, শুঁটকি, ব্যাঙ বা ব্যাঙাচি জোগান দেয়া সম্ভব নয়। তাই মিশ্র মাছের সঙ্গে শোল মাছের চাষ করা যেতে পারে। ৬ মাসে একেকটি শোল মাছের ওজন ৭০০-১০০০ গ্রাম হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

রোগ
শীতকালে শোল মাছে ক্ষত রোগ দেখা দেয়। তাই ওই সময় মৎস্য কর্মকর্তার পরামর্শ নিতে পারেন।
মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি বা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। না হলে আগামী কয়েক বছর দেশীয় মাছের চিহ্ন খুঁজে পাবে না জনগণ।
মৎস্য
আমাদের হার্টকে সারিয়ে তোলার জাদু জানে ছোট্ট এই মাছটি

যেন জাদুমন্ত্র জানে আমাদের ধানখেতের আলে, খালেবিলে, পুকুরে, নদীতে থাকা ম্যাজিশিয়ান এই মাছটি। অনেকে চিনেন আবার অনেকে নামও জানেন না মাছটির। এই মাছটির নাম জেব্রা ফিশ। এর শক্তি সম্পর্কে জানলে আপনি রীতিমতো অবাক হবেন। মূলত গ্রাম বাংলা আর উত্তর-পূর্ব ভারতের নদী, পুকুর, খালবিলে এই জেব্রা ফিশটি পাওয়া যায়।
হাতের আঙুলের আকারের ও গায়ে ডোরাকাটা দাগের এই মাছটি ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পরেও মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র, যকৃত, অগ্ন্যাশয়, মেরুদণ্ডসহ তার শরীরের প্রায় সবকটি অঙ্গকে নতুন করে গড়ে তুলতে পারে। যা মানুষ কিংবা কোনও স্তন্যপায়ী প্রাণীও পারে না।
ভারতের পুনের আগরকর রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজি বিভাগের বিজ্ঞানী চিন্ময় পাত্রের তত্ত্বাবধানে আমাদের দুর্বল হয়ে পড়া হৃদযন্ত্রকে ফের জাগিয়ে তোলার এই সঞ্জীবনী মন্ত্রটি খুঁজে বের করেছেন দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও তার সহযোগীরা। দেবাঞ্জন এখন ফ্রাঙ্কফুর্টে গোথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট ফর কার্ডিওভাসকুলার রিজেনারেশনের গবেষক।
চিন্ময় ও দেবাঞ্জনসহ ১০ জনের গবেষকদল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্বে এই প্রথম দেখালেন, একটি বিশেষ জিন কীভাবে জেব্রা ফিশের ক্ষতবিক্ষত হৃদযন্ত্রকে (‘মায়োকার্ডিয়াল ইনজুরি’) পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠতে সাহায্য করে। জিনটির নাম- ‘কানেকটিভ টিস্যু গ্রোথ ফ্যাক্টর (সিটিজিএফ)’। আরও একটি নাম রয়েছে জিনটির, তাহলো ‘সেলুলার কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ফ্যাক্টর ২-এ’।
এই গবেষণাতেই প্রথম বোঝা গেল কেন হার্ট অ্যাটাকের পর আমরা আর হৃদযন্ত্রকে আগের অবস্থায় ফিরে পাই না এবং তৃতীয়বার হার্ট অ্যাটাকের পর অনিবার্যই হয়ে ওঠে আমাদের মৃত্যু। আর কেনই বা জেব্রা ফিশের হৃদযন্ত্র বার বার ক্ষতবিক্ষত হয়েও পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠতে পারে প্রায় নতুন হৃদযন্ত্রের মতোই?
গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘ডেভেলপমেন্ট’-এ। মূল গবেষক দেবাঞ্জন কাজ করেছেন পুনের ‘আগরকর রিসার্চ ইন্সটিটিউট (এআরআই)’-এর ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক চিন্ময় পাত্রের তত্ত্বাবধানে। সহযোগিতা করেছে জার্মানির ‘ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর হার্ট অ্যান্ড লাং রিসার্চ’ এবং আমেরিকার ডারহ্যামের ‘ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়’-এর মেডিক্যাল সেন্টারও।

গবেষণায় কেন বেছে নেওয়া হলো জেব্রা ফিশ?
সাধারণত ২ থেকে ৩ বছর জেব্রা ফিশ বেঁচে থাকে। তাই ৩ মাস বয়স হয়ে গেলেই এই মাছ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে। গবেষকরা কাজটা করেছেন অন্তত ৬ মাস বয়সি জেব্রা ফিশ নিয়ে। সেগুলো ছিল প্রাপ্তবয়স্ক জেব্রা ফিশ। হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা ও আশঙ্কা যেহেতু শিশুদের চেয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বেশি, প্রবীণদের ক্ষেত্রে আরও বেশি, গবেষকরা তাই কাজটা করেছেন প্রাপ্তবয়স্ক জেব্রা ফিশ নিয়ে।
জেব্রা ফিশ নিয়ে কাজ করার একটা সুবিধা হলো, জন্মের পর ১০-১৫ দিন পর্যন্ত বাইরে থেকেই তাদের হৃদযন্ত্র, যকৃত, অগ্ন্যাশয়সহ শরীরের সবকটি অঙ্গের বিকশিত হয়ে ওঠা আর তাদের কাজকর্ম চাক্ষুষ করা যায়। কীভাবে হৃদযন্ত্রের ভাল্ব তৈরি হচ্ছে, তা-ও দেখা যায়, একেবারে কোষের স্তরে গিয়েও। আর একটা সুবিধা হলো জেব্রা ফিশের বেশির ভাগ কার্যকরী জিনের (প্রাণী বা উদ্ভিদের অনেক জিনই কার্যকরী থাকে না) সঙ্গেই মানুষ ও ইঁদুরের কার্যকরী জিনগুলোর খুব সাদৃশ্য রয়েছে। গত শতাব্দীর ৬-এর দশক থেকেই গ্রাম বাংলার এই ‘ম্যাজিশিয়ান’ মাছটি নিয়ে বিদেশে শুরু হয় গবেষণা। এখন বিশ্বের প্রায় ১ হাজারটি গবেষণাগারে জেব্রা ফিশ নিয়ে গবেষণা চলছে।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন