ফল
তাল উৎপত্তিস্থান, পুষ্টিমান, ওষুধিগুণ, উৎপাদন পদ্ধতি, বীজতলা তৈরী ও চারা উৎপাদন – দা এগ্রো নিউজ
লেখক
নিজস্ব প্রতিনিধিউৎপত্তিস্থান :
তালের জন্মস্থান মধ্য আফ্রিকা বলে ধারণা হলেও অনেকে বলেন এটি আমাদের উপ-মহাদেশীয় বৃক্ষ।
পুষ্টিমান :
পাকা তালের খাদো্যপযোগী প্রতি ১০০ গ্রামে জলীয় অংশ ৭৭.২ গ্রাম খনিজ০.৭ গ্রাম, আঁশ ০.৫ গ্রাম, আমিষ ০.৭ গ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম শর্করা ২০.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৯ মিলিগ্রাম ও খাদ্য শাক্তি ৮৭ কিলোক্যালরী রয়েছে।
ওষুধিগুণ :
তালের রস শেৱষ্মানাশক।এটি মূত্র কর , প্রদাহ ও কোষ্ঠাঠিন্য নিবারণ করে। রস থেকে তৈরি তালমিসরি সর্দি কাশির মহৌষধ, যকৃতের দোষ নিবারক ও পিত্তনাশক।
জাত :
তালের কোন অনুমেদিত জাত নেই। তবে এদেশে বিভিন্ন আকার ও রংয়ের তাল দেখা যায়। আবার কোন কোন তাল গাছের বারমাসই কমবেশী তাল ধরে থাকে।
উৎপাদন পদ্ধতি :
জমি নির্বাচন ও তৈরী :
প্রায় সব ধরনের মাটিতেই তাল ফসলের আবাদ করা যায়। তবে উঁচুজমিতে এবং ভারী মাটি ইহা চাষের জন্য বেশী উপযোগী। এদেশে বাগান আকারে কোন তাল ফসলের আবাদ নেই। বাগান আকারে চাষ করতে হলে নির্বাচিত জমি ভাল করে চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল এবং আগাছা মুক্ত করে নিতে হবে।
বীজ সংগ্রহ ও নির্বাচন :
আগষ্ট মাস থেকে তাল পাকতে শুর্ব করে এবং অক্টোবর মাস পর্যন্ত পাকা তাল পাওয়া যায়। তাল বীজ সংগ্রহ করে নির্বাচন করা উত্তম। তবে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নির্বাচিত মাতৃবৃৰ হতে তালের বীজ সংগ্রহ করা উচিত।
বীজ বপনের সময় :
ভাদ্র হতে কার্তিক মাস বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
বীজ বপনের দূরত্ব :
সারি থেকে সারি ৭ মিটার এবং চাবা থেকে চারা ৭ মিটার
গর্ততৈরী ও প্রাথমিক সার প্রয়োগ:
গর্তের আকার হবে ১ মিটার চওড়া ও ১ মিটার গভীর। গর্ত করার ১০-১৫ দিন পর প্রতি গর্তে ১৫-২০ কেজি জৈব সার, ২৫০ গ্রাম টি এস পি এবং ২০০ গ্রাম এমপি মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে।
বংশ বিস্তার :
বীজের মাধ্যমে তালের বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। দুই ভাবে তাল গাছ লাগানো যায়। একটি পদ্বতি হলো সরাসরি বীজ বপন করে অথবা বীজতলায় চারা উৎপাদন করে চারা রোপনের মাধ্যমে এর আবাদ করা যায়।
বীজ বপন:
সমতল ভূমিতে তালের বীজ সাধারনত বর্গাকার বা ষড়ভূজী প্রণালীতে লাগানো যেতে পারে। তাবে উচু নিচু পাহাড়ী এলাকায় কন্টুর প্রনালী করা যেতে পারে। গর্ত ভর্তি করার ১০-১৫ দিন পর গর্তের মাঝখানে বীজ বপন করতে হবে।
বীজতলা তৈরী ও চারা উৎপাদন :
পাকা অথবা ইট হিছানো মেঝেতে বীজতলা তৈরী করতে হবে। মাটির উপরও বীজতলা তৈরী করা যেতে পারে। এৰেত্রে চারার শিকড় যাতে বীজতলার তৈরী মাটিতে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য প্রথমেই পলিথিন শীট বিছিয়ে দিতে হবে। এরপর ৩০-৪০ সে.মি: পুর্ব বেলে মাটি অথবা কম্পোষ্ট দিয়ে বীজতলা তৈরী করতে হবে। বীজতলার আকার হবে ১ মিটার প্রস্থ ও ১০ মিটার অথবা জমির সাইজ অনুযায়ী দৈর্ঘ্য হতে পারে । এ আকারের একটি বীজতলা প্রায়১০০০ টি বীজবপন করা যায়। সংগ্রহিত বীজ পাশাপাশি রেখে বীজতলার উপর সাজাতে হবে এবং বীজের উপর ২-৩ সে. মি: বালি অথবা কম্পোষ্ট দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে।
বীজতলা সবসময় ভিজিয়ে রাখতে হবে। ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যেই বীজ অংকুরিত হতে শুর্ব করবে। বীজ অংকুরোদগমের সময় বীজপত্রের যে আবরণী বের হয়ে আসে তা দেখতে শিকড়ের মত কিন্তু আসলে তা শিকড় নয়। এই বীজপত্রের আবরণীর মাঝে ফাঁপা থাকে, অগ্রভাগে ভ্রূণ অবস্থান করে এবং টিউবের আকৃতিতে বৃদ্ধি পায়। হলদে রং-এর জার্মটিউবের অগ্রভাগে ভ্রূণ আবৃত থাকে এবং তা সাধারণত মাটির নীচের দিকে বৃদ্ধি পায়।
জার্মটিউবলন্ব হবার পরেই ভ্রূণের Coleoptile (åƒY কান্ডের আবরণী) এবং Coleorhiza
(ভ্রূণ মূলের আবরণী)-এর বৃদ্ধি শুর্ব হয়। জার্মটিউবের মতো Coleoptile ১৫-৪০ সে. মি. লন্ব হয়ে থাকে । Coleorhiza ও শিকড় এমনভাবে বৃদ্ধি পায় যে এদের পৃথক করা কঠিন এবং বীজতলার নিচের মেঝেতে বাধা প্রাপ্ত হয়ে বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। জার্মটিউব লন্ব হবার ১০-১৫ সপ্তাহের মধ্যে Coleoptile এর উপরে একটি পাতলা আবরণীতে পরিণত হয়। এঅবস্থায় চারায় কেবল ১ টি Coleoptile ও ১টি শিকড় থাকে। চারার গোড়া ও শিকড়ের গা হতে ছোট ছোট অনু শিকড়ও গজাতে শুর্ব করে। Coleoptile এর বৃদ্ধি সম্পূর্ণ হলে বীজের সাথে জার্মটিউবের সংযোগ স্থানে পচতে/ শুকাতে আরম্ভ করলে চারা পলিব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে।
চারা পলিব্যাগে স্থানান্তর ও নার্সারীতে পরিচর্য্যা :
বীজতলার উৎপাদিত চারা গোরব মিশ্রিত মাটি দিয়ে ভরা 15×15 সে. মি. আকারের পলিব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে। ব্যাগের পূর্বত্ব হবে ০.০৬/০.০৭ মিমি। প্রতিটি পলিব্যাগের নীচের দিকে চার জোড়া ছিদ্র রাখতে হবে। ব্যাগে ভরার জন্য ১/৫ অংশ গোবর ও ৪/৫ অংশ মাটির মিশ্রিণ ব্যবহার করতে হবে। প্রথমে বীজতলা খনন করে বেলেমাটি / কম্পোস্ট সরিয়ে চারা উন্মুক্ত করতে হবে। বীজ থেকে চারা আলাদা করার জন্য জার্মটিউবের উপরে অর্থাৎ বীজ সংলগ্ন চিকন, পচা / শুকনো স্থানে কাটতে হবে। যদি চারার শিকড় বেশি লন্ব হয় তাহলে ১০-১৫ সে. মি. শিকড় রেখে বাকি অংশ ধারালো চাকু দিয়ে কেটে ফেলতে হবে।
প্রথমত :
পলিব্যাগের ১/৩ অংশ গোবর মিশ্রিত মাটি ভরতে হবে। এরপর চারাটি পলিব্যাগের মাঝামাঝি এমনভাবে রাখতে হবে যেন চারার গোড়া প্রায় ৫ সে.মি. ব্যাগের মধ্যে থাকে। অত:পর গোবর মিশ্রিত মাটি দিয়ে ব্যাগের বাকী অংশ ভরতে হবে (চিত্র-১)। পলিব্যাগে চারা স্থানান্তরের পরে অন্তত: ২-৩ সপ্তাহ আংশিক ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং নার্সারিতে সাজিয়ে রাখতে হবে। পানি দিয়ে পলিব্যাগের মাটি আর্দ্র রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। পলিব্যাগের চারা সবসময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে এবং রোগবালাই দমন করতে হবে।
মাঠে চারা রোপন:
মৌসুমী বৃষ্টিপাত আরম্ভ হওয়ার পরপরই পলিব্যাগে উত্তোলিত ৩০-৩৫ সে. মি. লন্ব পাতা বিশিষ্ট চারা মাঠে রোপন করা উচিত। তবে মাটিতে প্রচুর পরিমাণে আর্দ্রতা থাকলে অথবা পানি সেচের ব্যবস্থা থাকলে চারা এপ্রিল- মে মাস পর্যন্ত লাগানো যেতে পারে।সমতল ভূমিতে অন্যান্য বৃৰ প্রজাতির পলিব্যাগের চারার মতোইএ চারা লাগাতে হবে। চারা লাগানোর নির্দিষ্ট স্থানে পলিব্যাগের আকৃতি অনুসারে অগার দিয়ে গর্ত করে পলিথিন ছিড়ে পলিব্যাগের মাটিসহ চারা গর্তে বসাতে হবে। গুড়ো মাটি দিয়ে গর্তের ফাঁক ভরাটসহ ভালভাবে চারার গোড়ার মাটি চেপে দিতে হবে। চারাগুলো আগাছমুক্ত রাখা ও গবাদি পশুর উপদ্রব থেবে রৰার ব্যবস্থা দিতে হবে। চারা রোপণের পর অন্তত প্রথম তিন বছর রোগ- বালাই ও কীট -পতঙ্গের আক্রমণের হাত হতে চারা রৰা করা আবশ্যাক।
সার প্রয়োগ :
প্রতি বছরই বর্ষার আগে ও পরে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বাড়ার সাথে প্রতি বছর সারের মাত্রা ১০% হারে বাড়িয়ে দিতে হবে। পূর্ণবয়স্ক গাছে প্রতিবছর ১৫-২০ কেজি গোবর,ইউরিয়া ১ কেজি, টি এসপি ৫০০ গ্রাম, এমপি ৫০০ গ্রাম সার প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পর পরই পানি সেচ দিতে হবে।
পরিচর্য্যা :
সার প্রয়োগ ছাড়াও আগাছা পরিস্কার , সেচ ও নিস্কাশনের প্রতি গুর্বত্ব দিতে হবে। নিয়মিত যত্ন ও পরিচর্য্যা নিশ্চিত করা হলে ১০- ১২ বছরের মধ্যেই তাল খাওয়া যায়।
পোকা মাকড় ও রোগবালাই :
তাল গাছে কোন পোকামাকড়- ও রোগবালাই দেখা যায় না ।
ফল সংগ্রহ:
মধ্য পৌষ থেকে মধ্য চৈত্র (জানুয়ারি থেকে মার্চ) মাসে ফুল আসে এবং শ্রাবণ- ভাদ্র মাসে ফল পাকতে শুরু করে। প্রতি গাছে প্রায় ১৫০- ২৫০ টি ফল ধরে। তালের ব্যবহার তালের রস বিভিন্ন প্রকার পিঠা , মিছরি ও গুড় তৈরীতে ব্যবহার হয়। সদ্য আহরিত তালের রস পানীয়। তালগাছের পাতা ও আঁশ পাখা ও অন্যান্য কুটির শিল্পজাত দ্রব্য তৈরীর জন্য ব্যবহার করা যায়। বয়স্ক তালগাছ থেকে উৎকৃষ্ট মানের কাঠ পাওয়া যায় যা গৃহ নির্মান ও সৌখিন দ্রব্য প্রস্তুত করা জন্য ব্যবহার করা হয়। পাকা তালের রস কনফেকশনারীতে শুকনো খাবার প্রস্তুত করনের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
ছাদে আমের কলমের চারা বাগান
-
রাঙ্গুনিয়ায় ছাদে সাকিবের বাগানে থোকায় থোকায় পাকা আম
-
জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে লাভজনক চায়না তরমুজের চাষ
-
ফল বাগানে সঠিক স্প্রে যন্ত্রের ব্যবহার
-
বিদেশ থেকে খালি হাতে ফিরে ড্রাগন চাষে সাফল্য
-
আমের চারা তৈরি, চারা রোপণ,সার ব্যবস্থাপনা, সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা,রোগ ব্যবস্থাপনা, পোকা দমন ব্যবস্থাপনা – দা এগ্রো নিউজ
-
লিচুর চারা তৈরি, চারা রোপণ, সার ব্যবস্থাপনা,অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা ও পোকা মাকড় ব্যবস্থাপনা – দা এগ্রো নিউজ
-
লটকনের ওষুধিগুণ, চাষ পদ্ধতি, চারা রোপণ, পরিচর্যা ও সার প্রয়োগ- দা এগ্রো নিউজ
-
পরিবারের সদস্যদের জন্য ভেজালমুক্ত খাবার নিশ্চিত করতেই ছাদে বা বারান্দায় ফল,সবজি চাষ করতে আগ্রহী হচ্ছেন মানুষ
-
লেবু জাত পরিচিতি ও চাষ পদ্ধতি
আম বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয় একটি ফলের নাম । আমকে ফলের রাজা বলা হয় । সারা দেশেই এর চাষ হলেও বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল হল এই আম । বাংলাদেশে অনেক জাতের আমের চাষ হয়ে থাকে । তবে এর মধ্যে ভাল জাতের আমের চাষ রাজশাহী অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ । শহরের বাসিন্দারা ছাদে দুচারটা আম গাছ লাগিয়ে শখ মিটাতে পারেন ।
ছাদের উপযোগী জাতঃ সব জাতের আমই ছাদে চাষ করা সম্ভব ।
তবে ফলন বেশী হয় ছাদের জন্য এমন কিছু জাত নির্বাচন করা উচিৎ । এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল হয় বারি আম -৩ জাতটি । গাছ ছোট আকৃতি, ফল মাঝারি এবং খেতে বেশ সুস্বাদু । যার আরেক নাম আম্রপালি । মোটামুটি প্রতিবছরই ফল দেয় বিধায় ছাদে লাগানোর ক্ষেত্রে আম্রপালিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া উচিৎ । তাছাড়াও বাউ আম – ১, ২, ৩, ৬, ৭, লতা বোম্বাই ইত্যাদি বামন জাতের আম ছাদের জন্য বেশ উপযোগী । চাষ পদ্ধতিঃ ছাদে আমের কলমের চারা লাগানোর জন্য ২০ ইঞ্চি কালার ড্রাম বা টব সংগ্রহ করতে হবে । ড্রামের তলায় ৩-৫ টি ছিদ্র করে নিতে হবে । যাতে গাছের গোড়ায় পানি জমে না থাকে । টব বা ড্রামের তলার ছিদ্রগুলো ইটের ছোট ছোট টুকরা দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে । এবার ২ ভাগ দোআঁশ মাটি, ১ ভাগ গোবর, ৪০-৫০ গ্রাম টি,এস,পি সার, ৪০-৫০ গ্রাম পটাশ সার, ১ কেজি কাঠের ছাই, ১কেজি হাড়ের গোড়া ও হাফ কেজি সরিষার খৈল একত্রে মিশিয়ে ড্রাম বা টব ভরে পানিতে ভিজিয়ে রেখে দিতে হবে ১৫ দিন ।
অতঃপর মাটি কিছুটা খুচিয়ে দিয়ে আবার ৪-৫ দিন এভাবেই রেখে দিতে হবে । যখন মাটি কিছুটা ঝুরঝুরে হবে তখন একটি সুস্থ সবল কলমের চারা উক্ত টবে রোপন করতে হবে । চারা গাছটিকে সোজা করে লাগাতে হবে । সেই সাথে গাছের গোড়ায় মাটি কিছুটা উচু করে দিতে হবে এবং মাটি হাত দিয়ে চেপে চেপে দিতে হবে । যাতে গাছের গোড়া দিয়ে বেশী পানি না ঢুকতে পারে । একটি সোজা কাঠি দিয়ে গাছটিকে বেধে দিতে হবে । চারা লাগানোর পর প্রথমদিকে পানি কম দিতে হবে । আস্তে আস্তে পানি বাড়াতে হবে । টবের গাছটিকে এমন জায়গায় রাখতে হবে যাতে প্রায় সারাদিন রোদ লাগে ।
রাঙ্গুনিয়ায় সাকিবের ছাদে গড়ে তোলা আম বাগানে সুস্বাদু আমের ঘ্রানে চারদিক মৌ মৌ করছে। আম বাগানে উঁকি দিচ্ছে এলাকার লোকজন। পাকা আমে জানান দিচ্ছে মধুমাস সমাগত। উপজেলার রাঙ্গুনিয়া থানার পার্শ¦স্থ সৈয়দ বাড়ী এলাকায় কলেজ পড়–য়া মো. সাকিব ঘরের ছাদে টবে লাগিয়েছে সারি সারি আম গাছ। আমের মুকুল আসার পাশাপাশি কয়েকটি গাছে থোকায় থোকায় ধরেছে আম। পাকা আমের মৌ মৌ সুঘ্রানে ছুটে যাচ্ছে এলাকার মানুষ। সবার মাঝে কৌতুহল জাগছে মৌসুম ছাড়া আম গাছে আম ধরার বিষয়টি। সাকিবের আম বাগান দেখে এলাকার অধিকাংশ যুবক ছাদের টবে আম বাগান করার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছে। দীর্ঘদিন আগে থেকে সাকিব আম গাছের পরিচর্যা করে আসছিল। কয়েকটি গাছে আম পাকতেও শুরু করেছে। সে আম গাছের পাশাপাশি লেবু আনারসহ বিভিন্ন ফলজ গাছের চারা লাগিয়েছে ফলও ধরেছে আশানরুপ।
অপরদিকে মৌসুম বিহীন আম বাগানে আম আসার বিষয়ে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, নির্ধারিত সময়ের আগে উন্নত মানের চারা ও সঠিক পরিচর্যা হওয়ায় ছাদে আম ধরার বিষয়টি অস্বাভাবিক কিছু না। ছাদে কেউ বানিজ্যিকভাবে আম বাগান করার উদ্যোগ নিলে সাকিবের মতো আম বাগান করে সফলতা আসবে।
বিশেষ করে ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাতি, আশ্বিনা জাতের বেশি। সেই সঙ্গে গবেষণাকৃত বারি-৩, বারি-৪ জাতের বাগান তৈরির ক্ষেত্রেও আগ্রহী হয়ে উঠছেন অনেকে।
ছাদে আম বাগান করার বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজ ছাত্র সাকিব জানায়, ঘরের ছাদে অল্প জায়গায় উন্নত মানের আমের চারা লাগানো হয়। কৃষি কর্মকর্র্তার পরামর্শে আম বাগানের পরিচর্যা করি। আমের ফলনও ভাল হয়েছে। দুয়েকটি গাছে আম পাকতে শুরু করেছে। ঘরের ছাদে অল্প পরিসরে টবে আম বাগান করলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করা যাবে ও পরিবারের পুষ্টির যোগান দেওয়া যাবে। আগামী বছরে ব্যাপক ভাবে আম বাগান করার পরিকল্পনা গ্রহন করেছি। আমার দেখাদেখিতে অনেকেই ছাদের টবে আম বাগান করার উদ্যোগ নিচ্ছে।
এ বিষয়ে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম মজুমদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, ফরমালিনমুক্ত আম খাওয়ার জন্য ও পরিবারের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে ঘরের ছাদে যে কেউ আম বাগান অনায়সে করতে পারে।
জয়পুরহাটে পাঁচবিবি উপজেলার বিনধারার গ্রামে এবার হচ্ছে মাঠজুড়ে চায়না জাতের তরমুজের চাষ। উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের রফিকুল ইসলাম শাহিন এবং কয়েকজন প্রান্তিক কৃষক বিনধারা মাঠে প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে চায়না জাতের ব্লাকবেবী তরমুজের চাষ করছেন।
আকারে ছোট খেতে সুস্বাধু এ জাতের তরমুজের গায়ের রং কালো হওয়ায় ”ব্লাকবেবী” হিসাবেই পরিচিত। ব্লাকবেবী চাষ অন্য ফসলের তুলনায় বহুগুনে লাভজনক।
মাচা পদ্ধতিতে বারোমাসি তরমুজ চাষ বিবেচিত হচ্ছে সম্ভাবনাময় একটি কৃষি পণ্য হিসাবে। এই তরমুজের জীবনকাল মাত্র ৬০ দিনের। ১ বিঘা জমির জন্য প্রয়োজন ৫০ গ্রাম বীজ। যার দাম ৩ হাজার ৮’শ টাকা। বিঘাপ্রতি সেড তৈরীর মালসিং পেপার ৭ হাজার ৫’শ, মাচা পদ্ধতিতে শেড তৈরীর বাঁশ আর মজুরী খরচ ১০ হাজার, সার মাটি আর বালাই নাশক স্প্রে বাবদ ৭ হাজার ৫’শ, পরিচর্য্যা মজুরী ৬ হাজার, পরিবহন খরচ ২ হাজার সর্বমোট বিঘা প্রতি তরমুজ চাষে খরচ হয় ৩০-৩৫ হাজার টাকা।
এক বিঘা জমিতে ৬০ দিনে তরমুজ উৎপাদন হয় প্রায় ১২ ’শ থেকে ১৫’শ পিস তরমুজ যার ওজন প্রায় ৪ থেকে ৪.৫ মেট্রিক টন। প্রতিটি তরমুজ ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলে যার বিক্রি মূল্য হয় ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় নীট লাভ থাকে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। যা তুলনামূলক অন্যান্য ফসলের চাইতে অনেক লাভজনক। একটি সেড তৈরী হলে সেই শেডে নুন্যতম তিনটি তরমুজের আবাদ করা যায়। ফলে স্থায়ী এই খরচটি পরের দু’বার হয় না। ফলে পরের দু’বারে উৎপাদন খরচ কমে গিয়ে লাভের ভাগ আরো বেশী হয়।আবার বারোমাসই এই তরমুজ পাওয়া যায় বলে এর চাহিদা বেশী। তাইওয়ানের জেসমিন-১, জেসমিন-২ ও ব্লাক প্রিন্স জাতের তরমুজে পোকামাকড়ের আক্রমণ তুলনা মূলক বলে ফসলে মার খাওয়ার ঝুঁকিও কম। গাছের গোড়ায় জলাবদ্ধতা ছাড়া এই জাতের উৎপাদন ব্যাহত হবার আর কোন কারন নেই। এই তরমুজ অনেক সুস্বাদু, পুষ্টিকর। সবচেয়ে বড় আশা জাগানিয়া কথা হচ্ছে বোরো ধান কাটার পর প্রায় দু’ আড়াই মাস জমি পতিত থাকে। দু’টি ধান চাষের মাঝে অনায়াসে একার তরমুজের ফলন সম্ভব। ফলে জমির সঠিক ব্যবহার যেমন নিশ্চিত হচ্ছে তেমনি বাড়ছে আয়। এ সব কারনে তরমুজ চাষে বাড়ছে কৃষকের সংখ্যা।
সরেজমিনে দেখাযায়, পলিথিন দিয়ে তরমুজের বীজ বোপনের জন্য বরাবর বেড তৈরী করা হয়েছে। বাশ ও জিআই তারে তৈরী ঝাংলায় তরমুজ গাছের সবুজ পাতাগুলো শোভা বর্ধন করছে। কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, পরিচিত এক বন্ধুর এ জাতের তরমুজ চাষে লাভবান হয়েছে এবং তার কথা শুনেই তিনিও শুরু করেছেন। প্রায় ৪০ হাজার টাকা বিঘা প্রতি খরচ হলেও এক থেকে দেড় লক্ষ টাকার তরমুজ বিক্রয় হবে এমন আশা প্রকাশ করেন তিনি। চায়না তরমুজ ছাড়াও তিনি টমেটোসহ বিভিন্ন ধরনের মৌসুমী সবজিও চাষ করেছেন।
মিরাজুল ইসলাম (৩৩)। ১০ বছর সৌদি আরবে ছিলেন। আকামা জটিলতায় খালি হাতে দেশে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এক বছর বেকার থাকার পর ইউটিউবে পতিত জমিতে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখেন। বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে নেমে পড়েন ড্রাগন চাষে। দেড় বছরের ব্যবধানে এখন উপজেলার সবচেয়ে বড় ড্রাগন বাগান তাঁর। এ বছর খরচ বাদে আট থেকে নয় লাখ টাকা লাভের আশা করছেন তিনি।
পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার ইন্দুরকানি গ্রামের বাসিন্দা মিরাজুল। উপজেলার টগরা গ্রামে দেড় একর জমিতে তিনি ড্রাগনের বাগান তৈরি করেছেন। তাঁর বাগানে এখন সাড়ে তিন হাজার ড্রাগন ফলের গাছ আছে।
মিরাজুল ইসলাম বলেন, শ্রমিক হিসেবে ১০ বছর সৌদিতে কাজ করে ২০১৯ সালে দেশে ফেরেন তিনি। আকামা সমস্যার কারণে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কিছু একটা করবেন বলে ভাবছিলেন। একদিন ইউটিউবে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখতে পান। সেই থেকে ড্রাগন চাষে আগ্রহ জন্মে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দেড় একর পতিত জমি ড্রাগন চাষের উপযোগী করেন। গাজীপুর থেকে ৬০ টাকা দরে ৬০০ চারা নিয়ে আসেন। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে শুরু করেন চাষাবাদ। পরের বছর জুনে ফল পাওয়া শুরু করেন।
ড্রাগনের বাগান করতে মিরাজুলের খরচ হয়েছিল ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। ইতিমধ্যে ফল বিক্রি করে তাঁর খরচ উঠে গেছে। সাধারণত মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গাছে ফল আসে। বছরে ছয় থেকে সাতবার পাকা ড্রাগন সংগ্রহ করা যায়। এখন পরিপক্ব ও রোগমুক্ত গাছের শাখা কেটে নিজেই চারা তৈরি করেন। ড্রাগন চাষের পাশাপাশি বাগানে চুইঝাল, এলাচ, চায়না লেবুসহ মৌসুমি সবজি চাষ করেন। এ ছাড়া ড্রাগনের চারাও উৎপাদন করে বিক্রি করেন তিনি।
মিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাগানের বেশির ভাগ গাছে এ বছর ফল ধরেছে। গত মঙ্গলবার বাগান থেকে দেড় টন ফল সংগ্রহ করেছেন। ২৫০ টাকা কেজি দরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছেন। স্থানীয় বাজারে ৩০০ টাকা কেজি দরে ড্রাগন বিক্রি হয়। নভেম্বর পর্যন্ত আরও পাঁচ–ছয়বার বাগান থেকে ফল তোলা যাবে। আশা করছেন, খরচ বাদে এবার আট থেকে নয় লাখ টাকা লাভ থাকবে।
মিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমার বাগান থেকে চারা নিয়ে অনেকে বাড়িতে ও ছাদে ছোট পরিসরে ড্রাগনের বাগান করেছেন। আমি এ পর্যন্ত ৪০ টাকায় দেড় হাজার চারা বিক্রি করেছি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পূর্ণ বয়সের একটি ড্রাগনের চারা রোপণের পর ২৫ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। এর মৃত্যুঝুঁকি নেই বললেই চলে। তবে কয়েক দিন পরপর সেচ দিতে হয়। বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হয়। ড্রাগন ফল চাষে রাসায়নিক সার দিতে হয় না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইশরাতুন্নেছা বলেন, মিরাজুল ইসলামকে ড্রাগন চাষে নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে আসছে কৃষি বিভাগ। উপজেলায় তাঁর বাগানটি সবচেয়ে বড়। তিনি নিরলস পরিশ্রম করে ছোট থেকে বাগানটি বড় করেছেন।
পাবনার বেড়া উপজেলার বড়শিলা গ্রামের কৃষক সাইদুল ইসলাম তাঁর দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করে এবার প্রায় ৪০ হাজার টাকা লোকসান দিয়েছেন। অথচ পেঁয়াজের জমিতেই সাথি ফসল হিসেবে লাগানো বাঙ্গি থেকে তিনি ৫০ হাজার টাকার মতো লাভ করবেন বলে আশা করছেন। এই বাঙ্গি আবাদে তাঁর কোনো খরচ হয়নি। ফলে পেঁয়াজ আবাদের ক্ষতি পুষিয়ে যাচ্ছে।
সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘বাঙ্গি আবাদ কইর্যা যে টাকা পাইল্যাম তা হলো আমাগরে ঈদের বোনাস। পেঁয়াজের দাম না পাওয়ায় আমরা (কৃষকেরা) যে ক্ষতির মধ্যে পড়িছিল্যাম, বাঙ্গিতে তা পুষায়া গেছে। এই কয়েক দিনে ১২ হাজার টাকার বাঙ্গি বেচছি। সব মিলায়া ৫০ হাজার টাকার বাঙ্গি বেচার আশা করতেছি।’
সাইদুল ইসলামের মতো পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার অনেক কৃষক এবার পেঁয়াজের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে বাঙ্গির আবাদ করেন। কৃষকেরা পেঁয়াজ আবাদ করতে গিয়ে বিঘায় প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ করেছিলেন। সেই হিসাবে প্রতি মণ পেঁয়াজ উৎপাদনে তাঁদের খরচ হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকার বেশি। কিন্তু বাজারে সেই পেঁয়াজ কৃষকেরা বিক্রি করতে পেরেছেন প্রতি মণ ৬০০ থেকে ৮৫০ টাকায়। এতে প্রতি বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদে কৃষকদের এবার ২০ হাজার টাকার বেশি লোকসান হয়েছে।
কৃষকেরা বলেন, পেঁয়াজের জমিতে সাথি ফসল হিসেবে বাঙ্গি, মিষ্টিকুমড়া, কাঁচা মরিচসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। জমিতে পেঁয়াজ লাগানোর পর তা কিছুটা বড় হলে এর ফাঁকে ফাঁকে এসব সাথি ফসল লাগানো হয়। পেঁয়াজের জন্য যে সার, কীটনাশক, সেচ দেওয়া হয়, তা থেকেই সাথি ফসলের সব চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। ফলে সাথি ফসলের জন্য বাড়তি কোনো খরচ হয় না।
কৃষকেরা বলেন, বাঙ্গিতেই কৃষকের লাভ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। রমজান মাস হওয়ায় এখন বাঙ্গির চাহিদা ও দাম দুই-ই বেশি।
সাঁথিয়ার শহীদনগর গ্রামের কৃষক আজমত আলী জানান, তাঁর জমিসহ এই এলাকার জমি থেকে ৮ থেকে ১০ দিন হলো বাঙ্গি উঠতে শুরু করেছে। এবার বাঙ্গির ফলনও হয়েছে বেশ ভালো। বাজারে এসব বাঙ্গি আকারভেদে প্রতিটি ৬০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এমন দাম থাকলে এক বিঘা থেকে প্রায় ৩০ হাজার টাকার বাঙ্গি বিক্রি হবে।
সাঁথিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার গোস্বামী বলেন, পেঁয়াজের সঙ্গে সাথি ফসলের আবাদ কৃষকদের মধ্যে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ ব্যাপারে তাঁরাও কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন