বাংলাদেশ
মাছ বিক্রিও করতে পারছেন না, খাবারও দিতে পারছেন না চাষীরা
লেখক
শাইখ সিরাজময়মনসিংহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সাহার তথ্যমতে, সারাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪২ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রতি বছর উৎপাদন হয় প্রায় পাঁচ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ দেশের প্রায় ১০ ভাগের একভাগ মাছ উৎপাদন হয় ময়মনসিংহে।
করোনা সংক্রমণের পর থেকে ময়মনসিংহ অঞ্চলের মাছ চাষীরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বিশেষ করে হাইব্রিড উপায়ে পাঙ্গাশ, কৈ, তেলাপিয়া, শিং, মাগুর, টেংড়াসহ নানা জাতের মাছ উৎপাদনকারীরা। সেই সঙ্গে মাছের হ্যাচারির মালিকরাও পড়েছেন সঙ্কটে। দেশি জাতের মাছ উৎপাদনকারীরাও এর বাইরে নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাঙ্গাশ, কৈ, তেলাপিয়া, শিং, মাগুরসহ নানা জাতের হাইব্রিড মাছ চাষীরা অর্থের অভাবে মাছের খাবার দিতে পারছেন না। স্বাভাবিক সময়ে ১০-২০ শতাংশ নগদ অর্থ দিলে মাছের সব খাবার দিতেন ডিলাররা। এখন নগদ অর্থ ছাড়া মাছের খাদ্য দিচ্ছেন না তারা। অন্যদিকে ব্যাংক কিংবা অন্য কারও কাছ থেকে ঋণও পাচ্ছেন। ফলে অনেক চাষী মাছের খাদ্য দিতে পারছেন না।
সাধারণ সময়ে ময়মনসিংহ থেকে কৈ, পাঙ্গাশসহ অন্যান্য মাছ ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ সারাদেশে বিক্রি হতো। লকডাউনের পর থেকে কোনো পাইকার কিংবা চাষী ময়মনসিংহের বাইরে মাছ বিক্রির জন্য নিয়ে যেতে পারছেন না। ফলে মাছের দামও পাচ্ছেন না তারা। পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, কৈ মাছের দাম মণ প্রতি প্রায় ১ হাজার টাকা কমে গেছে। তবে এ অবস্থা চলতে থাকলে মাছের দাম আরও কমতে পারে। দাম না পাওয়ায় ইতোমধ্যে অনেকে মাছ বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার মধ্যস্বত্বভোগীরা চাষীদের কাছ থেকে একেবারে কম দামে মাছ কেনার চেষ্টা করছেন। এছাড়া এসব হাইব্রিড মাছ খেলে করোনা হতে পারে– এমন গুজবও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে ফেলেছে চাষীদের।
সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে মাছ চাষীরাও রয়েছেন। তাদের প্রণোদনা দেয়া হবে। তবে কী উপায়ে দেয়া হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। অন্যদিকে মাছ পরিবহন লকডাউনের আওতামুক্ত রয়েছে। কোথাও মাছের গাড়ি সমস্যায় পড়লে তারা সেটার সমাধান করে দিচ্ছেন। তবে মাছ চাষীরা কীভাবে খাদ্য কিনবেন, সেটার কোনো সমাধান দেখছেন না।
সোমবার (২০ এপ্রিল) ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ জেলা এবং ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাসমূহের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছি, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। কৃষি খাতে আরও বেশি। মাত্র ৪ শতাংশ সুদে আমরা কৃষি ঋণ দিচ্ছি। কৃষি মানে শুধু ধান ফলানো নয়। মৎস্য পোল্ট্রি, ডেইরি থেকে শুরু করে ফলমূল, ফুল যা যা আছে – সবকিছু মিলেই এই প্যাকেজ।’
এই করোনা সঙ্কটে মাছ চাষী, খাদ্যের ডিলার ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কী ভাবছেন, কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন, বিস্তারিত তুলে ধরা হলো –
যা বলছেন মাছ চাষীরা
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ১১০ শতাংশ জমির পুকুরে প্রায় তিন লাখ কৈ মাছের পোনা ছাড়েন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার শিবরামপুর গ্রামের মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, তার মাছের এই চালান তুলতে প্রায় ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা লাগবে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এক মাসের মধ্যে মাছগুলো বিক্রির উপযোগী হবে। এই সময় প্রায় ৮-৯ লাখ টাকার খাদ্যের প্রয়োজন হবে। কিন্তু গত ১৩ দিনে কোনো খাদ্য দিতে পারেননি। কারণ, ডিলার এখন আর নগদ টাকা ছাড়া মাছের খাদ্য দিচ্ছেন না।
রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে ১০-২০ শতাংশ টাকা দিলে মাছের খাদ্য দিত ডিলাররা। কিন্তু করোনার কারণে নগদ টাকা ছাড়া কোনো খাদ্য দিচ্ছে না। টাকার জোগাড় করতে না পারায় ১৩ দিন ধরে মাছকে খাবার দিতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘কৈ মাছকে খাবার না দিতে পারার আরেকটা সমস্যা আছে। বড় কৈ ছোট কৈ খেয়ে ফেলে। ফলে মাছ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অন্যদিকে খাবার দিতে না পারায় মাছের বৃদ্ধিও কমে গেছে। ’
একই উপজেলার রাজাবাড়ী গ্রামের শ্রীবাস চন্দ্র দাস চাষ করেছেন তেলাপিয়া মাছ। তার প্রায় ৭০-৮০ মণ তেলাপিয়া করোনা সংক্রমণের শুরু সময়ই বিক্রির উপযোগী হয়েছে। কিন্তু তেলাপিয়াসহ কৈ, শিং, মাগুর– হাইব্রিড জাতের এসব মাছ খেলে করোনা হয়, এমন গুজবের কারণে এতদিন মাছ কেনেননি পাইকাররা (মধ্যস্বত্বভোগী)। আড়তে নিলেও ফিরিয়ে আনতে হয়েছে তাকে। তবে পাইকাররা তেলাপিয়া মাছ বাজারে তুলতে বললে রোববার (১৯ এপ্রিল) বিক্রির জন্য মাছ তোলেন তিনি।
শ্রীবাস চন্দ্র দাস বলেন, ‘হাইব্রিড পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, কৈ, শিং– এ জাতীয় মাছ খেলে করোনা হয়, এটা ছড়িয়ে গেছে। কয়েক দিন বাজারে তেলাপিয়া বিক্রি করতে গেছিলাম। কিন্তু পাইকাররা নেয়নি। তিন সপ্তাহ পর আজকে বাজার থেকে খবর দিছে, এখন পাঠালাম।’
তিনি বলেন, ‘প্রায় ৭০-৮০ মণ তেলাপিয়া হবে আমাদের। যে বাজার ছিল ১৩০ টাকা কেজি, সেটা এখন ১০০-১০২ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। যেটা ৪৮০০-৫০০০ টাকা মণ বিক্রি হতো, এখন সেটা ৩৫০০-৩৭০০ টাকা মণে হচ্ছে। পাঙ্গাশের আগে বাজার ছিল ৩৭০০-৩৯০০ টাকা মণ। এখন ২৫০০-২৭০০ টাকা মণ। অর্থাৎ তেলাপিয়া, পাঙ্গাশে মণপ্রতি প্রায় ১২০০-১৫০০ টাকা কমে গেছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দিন দিন মাছের দাম আরও কমতে থাকবে।’
‘আগে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মাছ যেত, এখন সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। এক থেকে দেড় লাখ টাকার মাছ নিয়ে কেউ রিস্কে যেতে চায় না। তাই ময়মনসিংহের ভেতরেই কম দামে মাছ বিক্রি করতে হচ্ছে’, যোগ করেন শ্রীবাস।
আলমগীর হোসেন নামের আরেক মাছ চাষী বলেন, ‘মাছ বিক্রির সময় করোনার প্রভাব পড়বেই। দূরে কোথাও মাছ নিয়ে বিক্রি করা যায় না। দূরে না নিয়ে গেলে দাম পাওয়া যায় না। তবে কী হয় বলা যাচ্ছে না। এ জন্যই বাকি খাদ্য দিচ্ছে না ডিলার। করোনায় কেউ মারা গেলে টাকা পাবে না। নানা কারণ।’
তিনি বলেন, ‘যত টাকার খাদ্য লাগে, তত টাকা তো একজন চাষীর পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। নতুন করে তো ঋণ পাওয়ারও সুযোগ নেই। এটা একটা বড় সমস্যা।’
কেন নগদ ছাড়া খাদ্য দিচ্ছেন না ডিলার?
মুক্তগাছা উপজেলার কালীবাড়ি বাজারের মাছের খাদ্যের ডিলার জয়নাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘চাষীদের কাছে যে টাকা-পয়সা ছাড়ছি, তারা তো মাছ বিক্রি করতে পারতেছে না। পার্টি মাছ নেয় না, বাজার খুব খারাপ, বাজারে মাছ খাচ্ছে না। বিক্রি না করতে পারার জন্য আমার কাছে ক্যাশ আসছে না। আমার কাছে যা ক্যাশ ছিল, সব শেষ করে ফেলছি। চাষীরাও কিছু কিছু দিছে, ওইটাও শেষ করছি। এখন আর টাকা নাই। অন্যদিকে কোম্পানি ক্যাশ ছাড়া খাদ্য দিচ্ছে না। তাই এখন আমিও চাষীদের নগদ টাকা ছাড়া খাদ্য দিতে পারতেছি না।’
বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত কথা হয় ময়মনসিংহের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সাহার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সরকার একটা প্রণোদনা দিচ্ছে মাছ চাষীদের। ছোট, মাঝারি চাষী। তবে এটার ক্রাইটেরিয়াগুলো কী হবে, মন্ত্রণালয় থেকে এখনও সেই ধরনের কোনো নির্দেশনা পাইনি। কত একর পর্যন্ত মাছ চাষ করলে সে ছোট চাষী, কত একর হলে মাঝারি চাষী হবে ইত্যাদি। তাছাড়া আমাদের তো বিভিন্ন সমস্যা আছে। কেউ একটা পুকুর নিয়ে মাছ চাষ করছে, তার একটা ক্ষতিই বড় ক্ষতি। আবার দেখা যাচ্ছে, কারও ৩০টা পুকুর আছে, তার ক্ষতিটাও অনেক বড়। মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের একটা নীতিমালা করে দেবে, আমরা ছোট ও মাঝারি ক্যাটাগরির কথা বলেছি। হ্যাচারির নাম্বারগুলো আমরা ঠিক করে দিচ্ছি, নার্সারিগুলোর কাছ থেকে নিচ্ছি। পরে কৃষকদের কাছ থেকে নেব। গ্রাম পর্যায় থেকে তাদের তথ্য সংগ্রহ ও যাচাইয়ের পর প্রণোদনা দেয়া হবে।’
লকডাউন থাকলেও সারাদেশে মাছ সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা নেই। এক জেলা থেকে আরেক জেলায় মাছ নিয়ে যাওয়ার সময় কোনো সমস্যায় পড়লে তা তারা সমাধান করেন বলেও জানিয়েছেন ময়মনসিংহের এই মৎস্য কর্মকর্তা।
দিলীপ কুমার সাহা বলেন, ‘লকডাউনের মধ্যে আমরা সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় মাছ পাঠিয়েছি। ঢাকা অফিসের একটা হটলাইন নম্বর আছে। সমস্যা হলে আমাদের জানালে ময়মনসিংহের ভেতরে হলে আমরা নিজেরাই তা সমাধান করছি। কিন্তু যখন জেলার বাইরে যাচ্ছে হ্যাচারি বা মাছের চালান, তখন আমাদের কিছু নম্বর আছে, তা উপজেলা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই তারা দিয়ে দেবে। কোথাও আটকা পড়লে আমাদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই ওই উপজেলার সঙ্গে কথা বলে বিষয়টার সমাধান করতে পারব।’
তবে কৈ, পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া চাষীরা যে টাকার অভাবে মাছের খাদ্য দিতে পারছেন না, এ বিষয়ে কোনো সমাধান দিতে পারেননি ময়মনসিংহ জেলার মৎস্য কর্মকর্তা।
-
মাছ বিক্রিও করতে পারছেন না, খাবারও দিতে পারছেন না চাষীরা
-
মাছ বিক্রিও করতে পারছেন না, খাবারও দিতে পারছেন না চাষীরা
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
মাছ চাষে স্মার্ট প্রযুক্তির উদ্ভাবন বাংলাদেশি তরুণের
-
মাছের খাবার সংরক্ষণের সঠিক উপায় জেনে নিন
-
মাছ চাষে স্মার্ট প্রযুক্তির উদ্ভাবন: বাংলাদেশি তরুণের সাফল্যের গল্প
-
স্মার্ট এরিয়েটর এর সাথে অটো ফিডিং সিস্টেম – লাভজনক মাছ চাষ করার প্রযুক্তি
-
বাংলাদেশে বাড়ছে ইলিশ, মিয়ানমারে কেন কমছে – দা এগ্রো নিউজ
-
ইলিশ কি মিঠা পানির মাছ হয়ে যাচ্ছে? – দা এগ্রো নিউজ
-
কই মাছে বাঁধাকপির ছেঁচকি – দা এগ্রো নিউজ
-
বাংলাদেশে ‘প্রায় বিলুপ্তি’র পথে ১০০-এর বেশি দেশীয় মাছ – দা এগ্রো নিউজ
-
ধনেপাতা ও টমেটোয় শোল মাছ – দা এগ্রো নিউজ
-
লাউ টাকি – দা এগ্রো নিউজ
বাগেরহাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক নারীর চাষ করা ধান ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। একটি শীষে ধান পাওয়া গেছে এক হাজার এক শর বেশি। দেশে বর্তমান যেসব জাতের ধান চাষ হয় সেসবের চেয়ে এই ধানের ফলন দ্বিগুণ। ফাতেমা বেগমের জমিতে এই ধানের চাষ হওয়ায় এরই মধ্যে তা ‘ফাতেমা ধান’ নামে পরিচিতি পেয়েছে এলাকায়।
ফাতেমা ধানের গাছ, ফলন, পাতা, শীষ সবকিছু অন্য যে কোনো জাতের ধানের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতি গোছে একটি চারা রোপণ করা হয়, যা বেড়ে ৮-১২টি হয়। প্রতিটি ধান গাছ ১১৫ থেকে ১৩০ সেন্টিমিটার লম্বা। একেকটি ছড়ার দৈর্ঘ্য ৩৬-৪০ সেন্টিমিটার। প্রতি ছড়ায় দানার সংখ্যা এক হাজার থেকে ১২০০টি। যার ওজন ৩০-৩৫ গ্রাম। ধানগাছের পাতা লম্বা ৮৮ সেন্টিমিটার, ফ্লাগলিপ (ছড়ার সঙ্গের পাতা) ৪৪ সেন্টিমিটার। ধানগাছের পাতা চওড়ায় দেড় ইঞ্চি। এই জাতের গাছের কাণ্ড ও পাতা দেখতে অনেকটা আখ গাছের মতো এবং অনেক বেশি শক্ত। তাই এই ধান ঝড়-বৃষ্টিতে হেলে পড়ার কোন আশঙ্কা নেই। ফাতেমা ধান একরপ্রতি ফলন হয় প্রায় ১৩০ মণ। তাই অন্য যে কোনো জাতের তুলনায় এই জাতের ধান অনেক ব্যতিক্রম।
গতকাল শুক্রবার চাকুলিয়া গ্রামে ফাতেমা বেগমের বাড়িতে গিয়ে বেশ কিছু মানুষের ভিড় দেখা যায়। দূর-দূরান্ত থেকে তারা ফাতেমার ধানের বীজ কিনতে এসেছে। কেউ কেউ যে জমিতে ওই ধান ফলেছে, তা ঘুরে দেখে। তবে কয়েক দিন আগেই ওই ধানের বীজ শেষ হয়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে।
ফাতেমা বেগম জানান, ২০১৬ সালে বোরো মৌসুমে তাঁর বাড়ির পাশে জমিতে হাইব্রিড আফতাব-৫ জাতের ধান কাটার সময় তিনটি ভিন্ন জাতের ধানের শীষ দেখতে পান তিনি। ওই তিনটি শীষ অন্যগুলোর চেয়ে অনেক বড় এবং শীষে ধানের দানার পরিমাণও অনেক বেশি ছিল। এরপর ওই ধানের শীষ তিনটি বাড়িতে এনে শুকিয়ে প্রক্রিয়া করে বীজ হিসেবে রেখে দেন। পরের বছর ছেলে লেবুয়াতকে ধান চাষ চাষ করতে বলেন। সে বছর আড়াই কেজি ধান পাওয়া যায়। এবার আরো বেশি জমিতে চাষ করার পর ধানে ধানে সয়লাব হয়ে গেছে। সাড়া ফেলেছে তা এলাকার বাইরেও। ওই ধান দেখতে ব্রি-২৮ ধানের মতো। লেবুয়াত শেখ জানান, বাড়ির পাশে দেড় বিঘার মৎস্যঘেরের মধ্যে প্রায় ৪২ শতক জমিতে আলাদাভাবে এ বছর ওই ধানের চাষ করেন তাঁরা। অন্য ধানের মতোই সাধারণ পরিচর্চা করেন। জমিতে দুই দফায় ২০ কেজি ইউরিয়া এবং ৩০ কেজি পটাশ সার ব্যবহার করা হয়েছে। পোকামাকড় তাড়াতে দুই দফায় কীটনাশক ছিটানো হয়েছে। অন্য জাতের ধানগাছের চেয়ে এই ধানগাছ অনেক লম্বা। ধানের শীষও অনেক বড়। প্রতিটি শীষে এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ দানা হয়। ওই জমিতে প্রায় দুই হাজার ৬০০ কেজি ধান ফলেছে। নিজেদের জন্য কিছু পরিমাণ বীজ ধান রাখার পর ৪০০ টাকা কেজিদরে ওই ধান বিক্রি করে দিয়েছেন। তাতে আয় হয়েছে সাত লাখ ২০ হাজার টাকা। সিলেট, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, খুলনাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এসে ওই ধান ক্রয় করেছে। ফকিরহাটের মাসকাটা ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. সোলায়মান আলী জানান, ওই ধান রোপণ করার পর তাঁরা তত্ত্বাবধান করেন। চাষি তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী ধান চাষ করেছেন।
কৃষক রিয়াজুল ইসলাম জানান, ইউটিউবের মাধ্যমে ফাতেমা ধানের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রায় ৬ মাস অপেক্ষা করার পর বাগেরহাটের কৃষক লেবুয়াতের মায়ের নিকট থেকে বীজ সংগ্রহ করি। এরপর প্রাথমিকভাবে আমার ৭৫ শতাংশ জমিতে এ ধানের চাষ করি। এতে সবকিছু মিলে মাত্র ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আমি আশাবাদী এ জমিতে প্রায় ৯৫-১০০ মণ ধান হবে। এই ধান উপজেলাব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার বলেও তিনি মনে করেন। তিনি আরও জানান, এই ধান চাষ করে লাভবান হতে পারব বলে আশা করছি। নিজেও স্বাবলম্বী হতে পারব। এ বছর আরও জমিতে আবাদ করব এই ধান।
আলফাডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রিপন প্রসাদ সাহা জানান, বাগেরহাটের কৃষক কর্তৃক উদ্ভাবিত ফাতেমা জাতের ধানের রয়েছে নানা বৈশিষ্ট্য। এ ধানের ফলন শুধু দেশ নয়, গোটা বিশ্বকে তাক লাগাতে পারে। যা দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা যেতে পারে। তিনি আরও জানান, উপজেলাতে এ ধানের আবাদ বৃদ্ধিতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ
পঞ্চাশে বাংলাদেশ: এক টেলিভিশন তারকা আর দরিদ্র কৃষকের সন্তান এক বিজ্ঞানী যেভাবে পাল্টে দিয়েছেন বাংলাদেশের কৃষি
লেখক
বিবিসি বাংলাশাইখ সিরাজ
বাংলাদেশে আধুনিক কৃষি প্রচলনের প্রথম চেষ্টা হয়েছিল কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে, ষাটের দশকে। এটির প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খানের উদ্যোগে জাপান থেকে আনা উন্নত জাতের একটি ধানের পরীক্ষামূলক চাষের উদ্যোগ নেয়া হলো। কিন্তু এই ধানের চাষের জন্য কৃত্রিম সেচের দরকার হবে। গ্রামে সেজন্য গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছিল।
“নলকূপ দিয়ে যখন মাটির নীচ থেকে পানি তোলা হচ্ছিল, তখন গ্রামের কিছু মানুষ ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তারা এটিকে দেখেছিল আল্লাহর ওপর খবরদারি হিসেবে। বুঝতেই পারছেন কৃষিতে নতুন প্রযুক্তি বা ধ্যানধারণার ব্যাপারে শুরুতে বাংলাদেশের কৃষকের মনোভাব কেমন ছিল”, বলছিলেন শাইখ সিরাজ, বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় এক টেলিভিশন উপস্থাপক।
হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে, জলপাই সবুজ রঙের ট্রেডমার্ক শার্ট পরে ক্যামেরা হাতে শাইখ সিরাজ এখন বাংলাদেশের যেখানেই যান, সেখানেই তাকে কৃষকরা সাদরে বরণ করে নেন।
কিন্তু যখন তিনি প্রথম রাষ্ট্রায়ত্ব বাংলাদেশ টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন, তখন পরিস্থিতি ছিল একেবারেই প্রতিকূল।
“তখন আমরা যেসব বিশাল ক্যামেরা নিয়ে গ্রামে যেতাম, সেগুলো দেখে লোকে ভয় পেত। তারা ভাবতো এটা বুঝি কামান। মাইক্রোফোনকে ভাবতো বন্দুকের নল। গ্রামগুলো আর্থ সামাজিক দিক দিয়ে তখন এতটাই পিছিয়ে। ক্যামেরার সামনে লোকজনকে কথা বলানো কঠিন ছিল, এতটাই লাজুক তখন গ্রামের মানুষ,” তিনি বলেন।
‘মাটি ও মানুষ’
বাংলাদেশের কৃষিতে গত কয়েক দশকে যে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে, শাইখ সিরাজকে বর্ণনা করা হয় সেই পরিবর্তনের পেছনে অন্যতম প্রধান এক চরিত্র হিসেবে।
বাংলাদেশে যখন বিজ্ঞানীরা একের পর এক নতুন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করে চলেছেন, কৃষিতে নতুন ধ্যান ধারণা এবং কৌশল চালুর জন্য সরকারের নানা পর্যায় থেকে চেষ্টা চলছে, সেগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে বিরাট ভূমিকা রাখে তার কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান, ‘মাটি ও মানুষ।’
“শুরুতে এই অনুষ্ঠানটা হতো আমার দেশ নামে। তখন এটি ৫০ মিনিটের পাক্ষিক অনুষ্ঠান। পরে এটিকেই ‘মাটি ও মানুষ’ নামে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করি। আমার মনে হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের চেয়ে বেশি দরকার শিক্ষামূলক মোটিভেশনাল অনুষ্ঠান। কৃষকদের যদি নতুন বীজ, নতুন প্রযুক্তি, নতুন কৌশল, এসব ঠিকমত বোঝানো যায়, তাহলে কৃষিতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব।”
গত চার দশক ধরে শাইখ সিরাজ হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে কৃষি বিষয়ক তথ্যের প্রধান উৎস। উনিশ’শ আশির দশকে, যখনো টেলিভিশন ঘরে ঘরে পৌঁছায়নি, তখনো গ্রামের হাটেবাজারে, কমিউনিটি সেন্টারে প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় ‘মাটি ও মানুষ’ দেখার জন্য ভিড় করতো মানুষ।
তবে কৃষকদের নতুন ধরণের কৃষিতে উৎসাহিত করার কাজটা সহজ ছিল না।
“আজকের কৃষক এবং তিরিশ বছর আগের কৃষকের মধ্যে তফাৎ আকাশ আর পাতাল। তখন কৃষকের কাছে একজন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা যে কথা বলতেন, একজন টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে আমি যেকথা বলতাম, সেটা তারা মানতে চাইতো না। তারা ভাবতো, আমরা যেধরণের কৃষির কথা বলছি, যদি সেটাতে ভালো ফসল না হয়? এ কারণে সে সহজে মোটিভেট হতে চাইতো না। সহজে নতুন প্রযুক্তি নিতে চাইতো না।”
“আমি যখন আশির দশকে উচ্চফলনশীল নতুন জাতের ধানের কথা বলছি, গমের কথা বলছি, তখন পরিস্কার তারা আমাকে বলতো এই রাবার ভাত খাবো না। তখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধানের মান তেমন ভালো ছিল না। ভাতটা ছিল রাবারের মতো, ভাতের দানা উপর থেকে থালার উপর ফেললে সেটি রাবারের মতো ড্রপ করতো।”
কিন্তু বিজ্ঞানীরা যখন তাদের গবেষণায় নতুন নতুন সাফল্য পাচ্ছিলেন, আর সেই সঙ্গে শাইখ সিরাজও তার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকদের মন জয় করার জন্য নতুন কৌশল নিচ্ছিলেন।
ভাষার পরিবর্তন
“তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে প্রমিত উচ্চারণে কথা বলতে হতো। আমি বুঝতে পারছিলাম গ্রামের মানুষের সঙ্গে আমার একটা দূরত্ব থেকে যাচ্ছিল। কৃষক আমার কথা কিছু বুঝতে পারছে, কিছু বুঝতে পারছে না। অন্যদিকে আমি যখন কৃষকের সঙ্গে কথা বলছি, সেও নিজেকে প্রকাশ করতে পারছে না,” তিনি বলেন।
টেলিভিশন অনুষ্ঠানে শাইখ সিরাজ তার মুখের ভাষায় পরিবর্তন আনলেন, গ্রামের মানুষের সঙ্গে তাদের কথ্য ভাষার ব্যবহার শুরু করলেন। পরিবর্তন এলো তার পোষাকেও। কেতাদুরস্থ শহুরে পোষাকের জায়গা নিল তার এখনকার ট্রেডমার্ক জলপাই রঙা শার্ট।
টাঙ্গাইলের এক গ্রামে ঝকঝকে নতুন টিনের চালার এক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে শহর থেকে আসা কজন মানুষ। ফসলের মাঠ ঘুরে দেখে এসে ক্লান্ত হয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন। স্থানীয় জাতের চামারা ধানের জায়গায় উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান-চাষ শুরু হওয়ার পর এলাকাটির অবস্থা কী, সেটা দেখতে গেছেন তারা।
শহুরে মানুষ দেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলেন গৃহস্থ। জানতে চাইলেন, আপনারা কারা।
“আমরা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের লোক,” জানালেন তারা।
“এরপর যা ঘটলো তার জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না”, বলছিলেন ডঃ এম এ সালাম, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক বিজ্ঞানী।
“লোকটি খুশিতে চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বললো, আল্লাহ আপনাদের ফেরেশতা হিসেবে পাঠিয়েছেন। আমরা হতচকিত। কী ঘটছে বুঝতে পারছি না।”
ঘটনাটি ১৯৯৬ সালের। যমুনা সেতু নির্মাণের জন্য যে নদী শাসন করা হয়েছে, তার ফলে এলাকাটি তখন বন্যামুক্ত। আগে সেখানে চাষ হতো কেবল স্থানীয় জাতের চামারা ধান, যেটি বন্যার পানির সঙ্গে বাড়ে, তিন-চার ফুট পানিতেও চাষ করা যায়। কিন্তু ফলন হতো খুব কম। বন্যামুক্ত এলাকায় সেই প্রথম কৃষকরা উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ শুরু করেছেন।
সেই কৃষক এরপর ডঃ সালাম এবং তার সহকর্মীদের হাত ধরে টানতে টানতে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলেন। বললেন, “এই যে টিনের চালার বাড়ি দেখছেন, এটা আমি ধান বিক্রির টাকায় করেছি। আমার চৌদ্দ পুরুষ কুঁড়েঘরে থাকতো। চামারা ধান চাষ করে আমাদের দিন চলতো খেয়ে-না খেয়ে। এখন দেখেন আমার কত ধান। আপনারা আমাদের জীবন বদলে দিয়েছেন।”
একজন সফল ধান বিজ্ঞানী হিসেবে কয়েক দশকের দীর্ঘ কর্মজীবনে এটি ডঃ সালামের সবচেয়ে মধুর স্মৃতিগুলোর একটি।
“আউশ, আমন এবং বোরো- এই তিন মৌসুম মিলে এখন আমাদের দেশে মোট ১১ হতে সাড়ে ১১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে চাষ হয়। এখন গড়ে আমরা প্রতি হেক্টরে চার টন ফলন পাই। যার ফলে এখন আমরা ধান উৎপাদনে উদ্বৃত্তে এসেছি। তা না হলে, আমরা যদি প্রতি হেক্টরে দেড় হতে দুই টন ফলনে থেকে যেতাম, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষকে খাওয়ানো-পরানো অসম্ভব ছিল,” বলছিলেন তিনি।
দুর্ভিক্ষের স্মৃতি
ময়মনসিংহ শহর থেকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী পেরিয়ে চর ইশ্বরদিয়া গ্রাম। উনিশ’শ চুয়াত্তর সালের শরৎকালে বাংলাদেশ যখন তার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর এক খাদ্য সংকটের মোকাবেলা করছে, তখন সেই গ্রামেও হানা দিয়েছে তীব্র অভাব।
চর ইশ্বরদিয়ার রশিদা তখন কিশোরী। প্রতিদিন খাবারের জন্য তাকে লাইনে দাঁড়াতে হতো বাড়ির কাছের এক লঙ্গরখানায়।
“লাইনে দাঁড়াইলে কোনদিন রুটি দিত, কোনদিন গোলা আটা দিত। অভাব চলছে মনে করেন প্রায় বছরখানিক। চাউল থাকলেও আমরা কিন্যা আইনা খাওনের মতো সামর্থ্য আছিল না। ফরে আটা আইন্যা খাই, আলু আইন্যা খাই। কোনদিন না খাইয়া থাকি। কোনদিন মনে করেন কচুর শাক তুইল্যা খাই। এইরকম কইরা দিন কাটাইছি।”
এম এ সালাম তখন চর ঈশ্বরদিয়া থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। লজিং থাকেন যে পরিবারের সঙ্গে, তাদের আর্থিক অবস্থাও খুবই খারাপ।
“ওরা তখন যা করছিল, সেটা আমি কোনদিন ভুলিনি। প্রতিদিন তারা কষ্ট করে হলেও আমাকে ভাত খেতে দিত, কিন্তু তারা নিজেরা জাউ খেয়ে থাকতো। এত ভালোবাসতো ওরা আমাকে।”
এম এ সালাম স্বপ্ন দেখছিলেন একজন কৃষি বিজ্ঞানী হওয়ার। অল্প বয়সে তার মধ্যে এই স্বপ্ন উস্কে দেন দরিদ্র কৃষক পিতা।
“আমি যখন ক্লাশ থ্রীতে পড়ি, তখন একদিন ধান কাটার মওসুমে আমার বাবার সঙ্গে আমি গরুর গাড়িতে করে মাঠে গেছি ধান তুলতে। কিছুক্ষণ পর আমার গাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। তখন আমার বাবা বলছে, দ্যাখো বাবা, কৃষিকাজ কত কঠিন। কত পরিশ্রমের। তুমি যদি লেখাপড়া শিখতে পারো, তাহলে তোমার এই পরিশ্রম করা লাগবে না। তুমি ভালো থাকবে, আমরাও ভালো থাকবো,” শৈশবের কথা বলতে গিয়ে ডঃ সালামের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে।
ডঃ এম এ সালাম এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে কৃতি ধানবিজ্ঞানীদের একজন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে যত রকমের উন্নত জাতের ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে, তার অন্তত ২০টির গবেষণায় সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি।
তাদের উদ্ভাবন পাল্টে দিয়েছে বাংলাদেশের কৃষি। ঢাকার গুলশানে যে প্রতিষ্ঠানে তিনি এখন নতুন গবেষণায় নিয়োজিত সেখানে বসে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে।
উনিশ’শ সাতাত্তর সালে যখন তিনি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে যোগ দিলেন, তখন দুর্ভিক্ষ পরবর্তী বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, কীভাবে এই দেশটির বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যের সংস্থান করা যায়।
“তখন বাংলাদেশে একজন মানুষ হয়তো সারাদিনে একবারই খায় এবং সেটা হয়তো এক সের চালের ভাত। ভাতই তার প্রোটিন, ভাতই তার ভিটামিন, এটাই তার সবকিছু। বাংলাদেশ ধানের দেশ। অথচ কী দুর্ভিক্ষ আমাদের, কী করুণ অবস্থা।”
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের সামনে তখন বড় চ্যালেঞ্জ কীভাবে ধানের উৎপাদন বাড়ানো যায়।
“আমি যখন কাজে যোগ দিলাম, তখন আমাদের সিনিয়র বিজ্ঞানীরা বললেন, আমাদেরকে এটা করতেই হবে। আমাদেরও প্রতিজ্ঞা, এই দেশকে আমরা বদলে দেব।”
বিআর-৩ বিপ্লব
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর শুরুর দিকে একটি মাত্র উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ হচ্ছিল পরীক্ষামূলক ভাবে, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত ইরি-৮।
কিন্তু বাংলাদেশে এই জাতটির চাষের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা ছিল এটির জীবনকাল ছিল বেশ দীর্ঘ। তা ছাড়া বোরো মওসুমে চাষ করতে হলে জমিতে সেচের দরকার ছিল, তখনো বাংলাদেশে আধুনিক সেচের পদ্ধতি গড়ে উঠেনি।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা তখন ইরি-৮ এর সঙ্গে বাংলাদেশের একটি স্থানীয় জাতের লতিশাইল ধানের সংকর ঘটিয়ে উদ্ভাবন করলেন নতুন জাত বিআর-৩, যেটির আরেক নাম ছিল বিপ্লব।
কিন্তু এটিও ধান চাষে প্রত্যাশিত সাফল্য আনতে ব্যর্থ হলো।
“মূল সমস্যা হলো ফটো পিরিয়ড সেনসিটিভিটি, অর্থাৎ আলোক সংবেদনশীলতা। বাংলাদেশে রোাপা আমন মওসুমে যত স্থানীয় জাতের ধান লাগানো হতো, তার সবগুলোই ছিল আলোক সংবেদনশীল। যার ফলে এগুলো মাঠে লাগানোর পর হতে ধান কাটার আগে পর্যন্ত সময়টা ছিল অনেক দীর্ঘ। আমাদের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ হলো, কীভাবে স্থানীয় জাতের ধানগুলো থেকে আমরা আলোক সংবেদনশীলতা তুলে নিতে পারি।”
উনিশ’শ পঁচাশি সালে এম এ সালাম ঠিক এই ফটো পিরিয়ড সেনসিটিভিটি বা আলোক সংবেদনশীলতা নিয়ে পিএইচডি করতে গেলেন ফিলিপিন্সে। ফিরে এলেন ১৯৮৮ সালে।
“এবার আমাদের চেষ্টা শুরু হলো কীভাবে স্থানীয় জাতের ধান থেকে আমরা ফটো পিরিয়ড সেনসিটিভিটি আলাদা করতে পারি। এটা যদি করা যায়, এই ধানের চাষ তিন মাসেই করা সম্ভব। এটার বিজ্ঞান আমাদের জানা। এটা পিউর জেনেটিক্স।”
ব্রি-২৯ ঘটালো বিপ্লব
ধান গবেষণায় বাংলাদেশে ধীরে ধীরে সাফল্য আসতে শুরু করলো। একের পর এক উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের প্রচলনের ফলে বাড়তে শুরু করলো খাদ্য উৎপাদন। সবচেয়ে বড় সাফল্য আসলো নব্বুই এর দশকের মাঝামাঝি। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন ব্রি-২৮ এবং ব্রি-২৯ অবশেষে বিপ্লব ঘটিয়ে দিল।
“বাংলাদেশে এখন বছরে যত ধান উৎপাদন হয়, তার অর্ধেক আসে কেবল এই দুটি উফশী জাতের ধান থেকে। ব্রি-২৮ থেকে প্রতি হেক্টরে পাঁচ টন পর্যন্ত ফলন হয়। আর ব্রি-২৯ থেকে প্রতি হেক্টরে ফলন পাওয়া যায় ছয় টন পর্যন্ত। এটা প্রমানিত।”
ডঃ সালাম এ পর্যন্ত যত জাতের ধান গবেষণায় জড়িত ছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম সফল একটি উদ্ভাবন হচ্ছে ব্রি-৫০। ২০০৮ সালে উদ্ভাবিত এই জাতটির জনপ্রিয় নাম বাংলামতি। এই সুগন্ধি জাতের চালের মান অনেকটা বাসমতির মতো।
ধান গবেষণায় তার অবদানের জন্য ডঃ এম এ সালাম ২০০৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রাইস কংগ্রেসে সেরা বিজ্ঞানীর পুরস্কার পান।
বাংলাদেশ, একটি নদীমাতৃক দেশ, যেখানে মাছ চাষ দেশের অর্থনীতি ও খাদ্য সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ চাষে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়, যেমন পানি দূষণ, সঠিক পরিচর্যার অভাব, এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি।
এ সমস্যাগুলো সমাধানে এক বাংলাদেশি তরুণ উদ্ভাবন করেছেন স্মার্ট প্রযুক্তি-নির্ভর মাছ চাষ ব্যবস্থা, যা মৎস্যখাতকে আরও আধুনিক, পরিবেশবান্ধব, এবং লাভজনক করে তুলছে।
মাছ চাষে স্মার্ট প্রযুক্তির বৈপ্লবিক উদ্ভাবন: কীভাবে কাজ করে? 🌟
এই উদ্ভাবনী প্রযুক্তি মাছ চাষে স্বয়ংক্রিয়তা, সঠিক তথ্য বিশ্লেষণ এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চাষের কার্যকারিতা বাড়ায়। নিচে এর কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো:
১। স্মার্ট পুকুর ব্যবস্থাপনা (IoT-Based System)
- সেন্সর প্রযুক্তিঃ পুকুরের পানির গুণমান (পিএইচ লেভেল, অক্সিজেন মাত্রা, তাপমাত্রা) নিরীক্ষণ।
- ডাটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণঃ স্মার্টফোন অ্যাপ ব্যবহার করে ডাটা রিয়েল-টাইমে সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ।
- স্বয়ংক্রিয় সতর্কতাঃ সমস্যা দেখা দিলে চাষীকে সঙ্গে সঙ্গে নোটিফিকেশন পাঠানো।
২। অটোমেটেড ফিডিং সিস্টেম
- মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়, যা নির্ধারিত সময়ে সঠিক পরিমাণে খাদ্য সরবরাহ করে।
- খাদ্যের অপচয় কমিয়ে উৎপাদন খরচ সাশ্রয় করা হয়।
৩। ফিশিং অ্যাপস এবং ডেটা অ্যানালিটিক্স
- অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে চাষীরা তাদের মাছের বৃদ্ধি, বাজারের চাহিদা এবং লাভজনকতা বিশ্লেষণ করতে পারেন।
- এটি বাজার পরিকল্পনা এবং ব্যবসায়িক সাফল্য আনতে সাহায্য করে।
৪। দূরবর্তী পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ
- স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের মাধ্যমে চাষীরা দূর থেকে পুকুর বা মাছের ট্যাংকের অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
৫। ড্রোন প্রযুক্তি
- ড্রোন ব্যবহার করে পুকুরের পানির মান এবং মাছের আচরণ পর্যবেক্ষণ।
- পুকুরে ক্ষতি বা রোগ দেখা দিলে তা দ্রুত শনাক্ত করা।
৬। এআই এবং মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মাছের উৎপাদন পূর্বাভাস এবং বাজার চাহিদার পূর্বানুমান।
- চাষের জন্য সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা।
স্মার্ট প্রযুক্তির সুবিধা মাছ চাষে
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিঃ স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছের বৃদ্ধি আরও দ্রুত এবং স্বাস্থ্যকর হয়। এটি চাষীদের উৎপাদনশীলতা ২৫-৩০% পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে সক্ষম।
খরচ কমানোঃ অটোমেটেড প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্য ও শ্রমের খরচ কমানো সম্ভব। পানির অপচয় কমানো, খাদ্য ব্যবস্থাপনা অটোমেশন এবং দূরবর্তী পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে চাষীরা খরচ কমাতে সক্ষম হন।
পরিবেশবান্ধব চাষ পদ্ধতিঃ স্মার্ট প্রযুক্তি মাছ চাষকে পরিবেশবান্ধব করে তোলে। এটি পানির দূষণ কমায় এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে।
চাষীদের জীবনযাত্রার উন্নতিঃ স্মার্ট প্রযুক্তি মাছ চাষকে আরও সহজ এবং লাভজনক করে তোলে, যা চাষীদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটায়।
সমস্যার দ্রুত সমাধানঃ স্মার্টফোন বা অ্যাপের মাধ্যমে মৎস্যচাষী যে কোনো সমস্যার দ্রুত সমাধান পেতে পারেন।
আন্তর্জাতিক বাজারের সুযোগঃ উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদিত মাছ আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করার সহজতর হয়।
মাছ চাষে স্মার্ট প্রযুক্তির বাজারজাতকরণ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাজার চাহিদা বৃদ্ধিঃ স্মার্ট প্রযুক্তি মাছের গুণমান উন্নত করে, যা স্থানীয় এবং বৈশ্বিক বাজারে উচ্চ চাহিদা তৈরি করবে।
উদ্ভাবনমূলক উদ্যোগঃ এই প্রযুক্তি শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারেও মডেল হিসেবে কাজ করবে। এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।
স্মার্ট পুকুরের ব্যাপক ব্যবহারঃ আগামীতে দেশের প্রতিটি মাছ চাষ প্রকল্পে স্মার্ট পুকুর ব্যবস্থাপনা সিস্টেম চালু করা সম্ভব হবে।
উন্নত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধিঃ মৎস্যচাষীদের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আরও কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাবে।
রপ্তানি বৃদ্ধিতে অবদানঃ এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছের গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের মাছের চাহিদা বাড়াবে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
তার উদ্ভাবন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে এবং তিনি বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
স্মার্ট অ্যাকুয়া সেন্টার: চাষীদের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তি সরবরাহ।
রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট: নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে আরও উন্নত সমাধান।
ডিজিটাল ইন্টিগ্রেশন: পুরো প্রক্রিয়াকে ক্লাউড সিস্টেমের মাধ্যমে সহজতর এবং দক্ষ করা।
স্বল্প খরচে প্রযুক্তি সরবরাহ: সাশ্রয়ী মূল্যে প্রযুক্তি সরবরাহ করে তিনি ছোট চাষিদের মাঝে এটি ছড়িয়ে দিতে চান।
চাষিদের প্রশিক্ষণ: প্রযুক্তি ব্যবহারে চাষিদের জন্য বিনামূল্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
আপনার মাছ চাষকে স্মার্ট করুন!
মাছ চাষে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করে উৎপাদন বাড়ান, খরচ কমান, এবং আপনার আয় বৃদ্ধি করুন। এখনই স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করে মাছ চাষে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করুন।
স্মার্ট প্রযুক্তি, স্মার্ট চাষাবাদ! 🌟
যোগাযোগ করুন এবং আপনার চাষাবাদকে আরও কার্যকরী করে তুলুন!
একজন টেলিভিশন তারকা, কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের জন্মদিন আজ। তিনি ১৯৫৪ সালের এদিনে জন্মগ্রহণ করেন চাঁদপুরে (সার্টিফিকেট অনুযায়ী তার জন্মতারিখ ২৮শে জুন ১৯৫৬)। শাইখ সিরাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ভূগোলে। ছাত্রজীবনেই সম্পৃক্ত হন বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতার ও সংবাদপত্রের সঙ্গে।
শাইখ সিরাজ ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড, চ্যানেল আই-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও বার্তা প্রধান। টানা সাড়ে চার দশক ধরে তিনি গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে দেশের কৃষি ও কৃষক তথা উৎপাদন-অর্থনৈতিক খাতে অপরিসীম ভূমিকা রেখে চলেছেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সকল শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে বিপুল গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেন তিনি। পরে তার নিজস্ব পরিচালনাধীন টেলিভিশন ‘চ্যানেল আই’তে শুরু করেন কৃষি কার্যক্রম হৃদয়ে মাটি ও মানুষ। উন্নয়ন সাংবাদিকতার জন্য তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দু’টি রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৮) ও একুশে পদক (১৯৯৫) লাভ করেন।
টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রায় চার দশকের একনিষ্ঠ পথচলার মধ্য দিয়ে শাইখ সিরাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন উন্নয়ন সাংবাদিকতার এক অগ্রপথিক হিসাবে। গণমাধ্যমে তার উদ্বুদ্ধকরণ প্রচারণায় আমূল পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশের কৃষিতে। বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে বৈপ্লবিক সাফল্য।
গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। একইসঙ্গে শহর-নগরের মানুষকে করেছেন কৃষিমুখি। ফলে দেশের অর্থনীতিতে কৃষির বহুমুখি অবদান সূচিত হয়েছে।
‘মাটি ও মানুষ’
বাংলাদেশের কৃষিতে গত কয়েক দশকে যে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে, শাইখ সিরাজকে বর্ণনা করা হয় সেই পরিবর্তনের পেছনে অন্যতম প্রধান এক চরিত্র হিসেবে।
বাংলাদেশে যখন বিজ্ঞানীরা একের পর এক নতুন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করে চলেছেন, কৃষিতে নতুন ধ্যান ধারণা এবং কৌশল চালুর জন্য সরকারের নানা পর্যায় থেকে চেষ্টা চলছে, সেগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে বিরাট ভূমিকা রাখে তার কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান, ‘মাটি ও মানুষ।’
“শুরুতে এই অনুষ্ঠানটা হতো আমার দেশ নামে। তখন এটি ৫০ মিনিটের পাক্ষিক অনুষ্ঠান। পরে এটিকেই ‘মাটি ও মানুষ’ নামে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করি। আমার মনে হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের চেয়ে বেশি দরকার শিক্ষামূলক মোটিভেশনাল অনুষ্ঠান। কৃষকদের যদি নতুন বীজ, নতুন প্রযুক্তি, নতুন কৌশল, এসব ঠিকমত বোঝানো যায়, তাহলে কৃষিতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব।”
গত চার দশক ধরে শাইখ সিরাজ হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে কৃষি বিষয়ক তথ্যের প্রধান উৎস। উনিশ’শ আশির দশকে, যখনো টেলিভিশন ঘরে ঘরে পৌঁছায়নি, তখনো গ্রামের হাটেবাজারে, কমিউনিটি সেন্টারে প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় ‘মাটি ও মানুষ’ দেখার জন্য ভিড় করতো মানুষ।
তবে কৃষকদের নতুন ধরণের কৃষিতে উৎসাহিত করার কাজটা সহজ ছিল না।
“আজকের কৃষক এবং তিরিশ বছর আগের কৃষকের মধ্যে তফাৎ আকাশ আর পাতাল। তখন কৃষকের কাছে একজন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা যে কথা বলতেন, একজন টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে আমি যেকথা বলতাম, সেটা তারা মানতে চাইতো না। তারা ভাবতো, আমরা যেধরণের কৃষির কথা বলছি, যদি সেটাতে ভালো ফসল না হয়? এ কারণে সে সহজে মোটিভেট হতে চাইতো না। সহজে নতুন প্রযুক্তি নিতে চাইতো না।”
“আমি যখন আশির দশকে উচ্চফলনশীল নতুন জাতের ধানের কথা বলছি, গমের কথা বলছি, তখন পরিস্কার তারা আমাকে বলতো এই রাবার ভাত খাবো না। তখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধানের মান তেমন ভালো ছিল না। ভাতটা ছিল রাবারের মতো, ভাতের দানা উপর থেকে থালার উপর ফেললে সেটি রাবারের মতো ড্রপ করতো।”
কিন্তু বিজ্ঞানীরা যখন তাদের গবেষণায় নতুন নতুন সাফল্য পাচ্ছিলেন, আর সেই সঙ্গে শাইখ সিরাজও তার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকদের মন জয় করার জন্য নতুন কৌশল নিচ্ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অশোকা ফেলো শাইখ সিরাজ খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র বিমোচন বিষয়ে সাংবাদিকতায় অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসাবে তিনি ২০০৯ সালে অর্জন করেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এ এইচ বুর্মা এ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া তিনি পেয়েছেন এশিয়ার মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার গুসি পিস প্রাইজ, বৃটেনের বিসিএ গোল্ডেন জুবিলি অনার এ্যাওয়ার্ডস। বৃটিশ হাউজ অব কমন্স তাকে প্রদান করেছে বিশেষ সম্মাননা, বৃটিশ-বাংলাদেশ ব্যবসায়ী সংগঠন তাকে দিয়েছে গ্রীন এ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া পেয়েছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির স্বর্ণপদক, ডা. ইব্রাহিম মেমোরিয়াল স্বর্ণপদক, রণদা প্রসাদ সাহা স্বর্ণপদকসহ অর্ধশত দেশি-বিদেশি পুরস্কার ও সম্মাননা।
চ্যানেল আই ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখে থাকেন। তিনি এদেশে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে নিরস বিষয় হিসাবে উপেক্ষিত কৃষিতে জাতীয় সংবাদের প্রধান খবরের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শাইখ সিরাজের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- মৎস্য ম্যানুয়েল, মাটি ও মানুষের চাষবাস, ফার্মার্স ফাইল, মাটির কাছে মানুষের কাছে, বাংলাদেশের কৃষি: প্রেক্ষাপট ২০০৮, কৃষি ও গণমাধ্যম, কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট (সম্পাদিত), আমার স্বপ্নের কৃষি, কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট (২০১১), সমকালীন কৃষি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (২০১১), কৃষি ও উন্নয়ন চিন্তা (২০১৩) ইত্যাদি।
মেহেরপুর: পতিত ও অনুর্বর বেলে মাটির জমিতে চিনাবাদাম চাষ করে লাভবান হচ্ছেন মেহেরপুরের চাষিরা। ফলন ও বাজার দর ভালো এবং কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় দিন দিন এই এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাদামের চাষ।
সদর উপজেলার মদনাডাঙ্গা, শ্যামপুর, টেংগারমাঠ ও গোপালপুর গ্রামের অধিকাংশ জমির মাটি বেলে। ফলে এই এলাকার চাষিরা ধান, গম, পাটসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করে খুব একটা লাভবান হতে পারেন না।
ধান কাটার পর এ সব জমি সাধারণত পতিত থাকে। এজন্য ৯০ দিনের ফসল হিসেবে অল্প খরচে বাদাম চাষ করছেন এলাকার চাষিরা।
মেহেরপুর জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলায় এবার বাদাম চাষ হয়েছে ১৫ হেক্টর জমিতে। এবার এক বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করতে চাষিদের খরচ হয়েছে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা সেক্ষেত্রে বাদামের ফলন হয়েছে ৬ থেকে ৭ মণ। আর এ ফলনে প্রায় ২০ হাজার টাকা ঘরে তুলছেন তারা। বাজারে প্রতিমণ বাদাম বিক্রি হচ্ছে ২৭শ’ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। সদর উপজেলার মদনাডাঙ্গা গ্রামের বাদাম চাষি খাঁজা আহমেদ, কাওছার আলী ও ফিরোজ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, এলাকার মাটি বেলে হওয়ায় সাধারণত সবজি, আলু ও অন্যান্য ফসল চাষ করার পর জমি পতিত থাকে। সে সময়ে চিনা বাদামের চাষ করা হয়। বাদাম চাষে খরচ কম এবং উৎপাদন ও বাজার দর ভাল। তাই দিন দিন চাষিরা তাদের পতিত জমিতে চিনা বাদামের চাষ শুরু করছেন।
এছাড়া বাদাম ছাড়ানো, শুকানোসহ যাবতীয় কাজ করে থাকেন এখানকার নারীরা। বাদামের গাছ আবার শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করছেন গৃহিণীরা।
নারী শ্রমিক সাহানা খাতুন ও জরিমন নেছা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বাদাম ছাড়ানো ও শুকানোর কাজ করে থাকি। এলাকার ২৫/৩০ জন নারী শ্রমিক এ কাজ করে আসছেন।
গৃহিণী সাজেদা খাতুন ও জামেলা খাতুন জানান, বাদামের লতা জালানি হিসেবে বেশ ভাল। তাই লতাও বিক্রি হচ্ছে।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আক্তারুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, চিনা বাদামের চাষ সাধারণত পতিত জমিতে হয়ে থাকে। এলাকার চাষিরা এই জমিতে বাদামের চাষ করে বাড়তি আয় করছেন। তাই বাদাম চাষ যাতে আরও সম্প্রসারিত হয় সেজন্য কৃষি বিভাগ চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছে।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন