আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন

পরিবেশ

হাওরের সুখ-দুঃখ যেমন দেখেছি-১

আমার সব সময় মনে হয়, হাওরের জীবন সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ঝড়ঝঞ্ঝা আর সংগ্রামে পরিপূর্ণ এক মহাকাব্যিক জীবন। তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া আমার মতো সাধারণ মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে অসম্ভব। তবু হাওরাঞ্চলের একজন মানুষ হিসেবে যতটুকু দেখেছি, তার কিছুটা সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করার চেষ্টা করিমাত্র।

একটা সময় ছিল, যখন হাওরাঞ্চলের মানুষ ছিল একেবারেই কৃষিনির্ভর। শুধু তা–ই নয়, কৃষি ব্যবস্থাটাও ছিল গতানুগতিক। ফসল ভালো না খারাপ হবে, সেটা নির্ভর করত প্রকৃতির খেয়ালখুশির ওপর। ভাটি এলাকায় বোরো ফসলটাই ছিল প্রধান। কৃষকেরা জমি তৈরি করে ধানের চারা রোপণ করতেন। বিল থেকে কোণ (কাঠের তক্তার তৈরি পানি সেচের একপ্রকার সেকেলে যন্ত্র) দিয়ে জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতেন।

একপর্যায়ে ফাল্গুন–চৈত্র মাসে বিলও শুকিয়ে যেত। তখন কৃষকদের অসহায়ের মতো বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তখন বর্তমান সময়ের মতো সেচের এমন আধুনিক মেশিন ছিল না। আমাদের এলাকায় দেখেছি, শুধু বিএডিসির পাওয়ার পাম্প ছিল, যেগুলো নদীতে বসিয়ে সেচের ব্যবস্থা করা হতো। এগুলোর সংখ্যাও ছিল একেবারেই অপ্রতুল। সারা গ্রামের জন্য একটা মেশিন ছিল, যা দিয়ে পুরো হাওরে জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হতো না। ফলে অনেক জমিই পতিত থাকত। আর চৈত্র মাসে খরা তো থাকতই। ফলে একটিমাত্র পাম্পের ওপর অত্যধিক চাপ থাকায় তা মাঝেমধ্যেই বিকল হয়ে যেত। তখন এখনকার মতো এত মেকানিক পাওয়া যেত না। আর নেত্রকোনার বিএডিসি অফিস ছাড়া পাম্পের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও পাওয়া যেত না। বিএডিসিও দ্রুতগতিতে যন্ত্রপাতি ও মেকানিক দিতে পারত না। ফলে হাওর এলাকায় ফসলহানি মোটামুটি নিয়মিতই ছিল। এতে প্রায় বছরেই এলাকার মানুষের কষ্টের কোনো সীমা থাকত না। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হতো তাদের। তখনকার সময়ে আমাদের এলাকা খাদ্যে উদ্বৃত্ত ছিল না। ফলে সারা বছর পর্যাপ্ত খাবার থাকত, এমন গৃহস্থ খুব কম ছিলেন। বিশেষ করে ফাল্গুন-চৈত্র মাস ছিল হাওরাঞ্চলের মানুষের ভয়ংকর সময়। তখন মানুষ কী যে কষ্ট করত, তা বলে বোঝানো যাবে না।বিজ্ঞাপন

আমাদের গ্রামের পাশেই ঝালিয়ার হাওর। এ হাওরের মধ্য দিয়ে পশ্চিম দিকের পায়ে হাঁটার মাটির যে রাস্তা, সেটি মামুদপুর, হারুলিয়া, সাজিউড়া ইত্যাদি গ্রাম হয়ে কেন্দুয়া উপজেলা (তখনকার থানা) শহরে গেছে। চৈত্র মাসে সকাল ৯টা–১০টায় তাকালেই দেখতাম, সারি সারি মানুষ আটার বস্তা নিয়ে আসত। তা–ও রিকশা বা এমন কোনো যানবাহন ছিল না। হাওরের মধ্য দিয়ে উঁচু–নিচু রাস্তা। বোঝা বহন ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না। তখন গম–আটার দাম ধান–চালের দামের চেয়ে অনেক কম ছিল। টাকা বাঁচানোর জন্য মানুষ ভাতের বদলে আটা খেত। এখন তো গরিব মানুষ আটা খায় না। আটা খায় ধনীরা—ডায়াবেটিস/ প্রেশারের রোগীরা। যাহোক, চৈত্র মাসটা খেয়ে না খেয়ে কষ্টের মধ্য দিয়েই পার হতো। চৈত্র মাসকে বলা হতো ‘দারুণ চৈত্র মাস’। এরপর বৈশাখ মাসে ধান হলে তো ভালো। আর না হলে মানুষের মাথায় হাত। সারা বছরের অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে পড়ে যেত আবার।

নেত্রকোনায় গত কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমির আমন তলিয়ে গেছে। নেত্রকোনা-সিধলী সড়কের রাজাপুর এলাকায়
নেত্রকোনায় গত কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমির আমন তলিয়ে গেছে। নেত্রকোনা-সিধলী সড়কের রাজাপুর এলাকায়

চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের কথা স্পষ্টই মনে আছে আমার। তখন আমি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। বয়স তো কমই ছিল। তবু ভুলিনি কিছুই। মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট তখন নিজের চোখেই দেখেছি। তবে তখনকার সরকারের আন্তরিকতা বা চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। আমাদের স্কুলে তখন ছাতু, বিস্কুট ইত্যাদি দেওয়া হতো, যাতে দুর্ভিক্ষের প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপর না পড়ে। কিন্তু এমনিতেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে দাঁড় করানো, তার ওপর বন্যা আর খরার ফলে দুর্ভিক্ষের কড়াল থাবা, তার চেয়ে বড় কথা, স্বার্থান্বেষী কিছু মোনাফাখোর মজুতদারের কর্মকাণ্ড আর দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারী—সব মিলিয়ে এমন একটা কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে তা সামাল দেওয়া সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর হাওরাঞ্চলের মানুষকে এ চক্রান্তের মূল্য চরমভাবেই দিতে হয়েছিল। তখন আমাদের এলাকায় দেখেছি, মোটামুটি ধনী মানুষকেও ভাতের কষ্টে পড়তে হয়েছিল। আর গরিব মানুষের তো কষ্টের কোনো সীমাই ছিল না। ভাতের অভাবে তারা শাপলা–শালুক, শাকসবজি—হাতের কাছে যা পেয়েছে, তা–ই খেয়ে ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করেছে। এমনকি তারা ভাতের ফেন, চালের কুঁড়া ইত্যাদি পর্যন্ত খেয়েছে। এগুলো পাওয়াও তখন বেশ কঠিন ছিল।বিজ্ঞাপন

এক দিনের একটা ঘটনা বলি। আমার মা ভাত খেতে বসেছিলেন। এমন সময় এক বৃদ্ধা ও খুব দুর্বল ভিক্ষুক এলেন। মাকে বললেন, ‘আমার পেটে আজ দানা–পানি কিছুই পড়েনি। আমি আর চলতে পারছি না। মনে হয় মরে যাব। আমাকে দুটো ভাত দেন বোন।’ মায়ের মনটা ছিল খুবই নরম। তাঁর খাবার বৃদ্ধাকে দিয়ে দিলেন। বৃদ্ধা খাবার পেয়ে গোগ্রাসে বেহুঁশের মতো খেতে লাগলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই ভাত তাঁর গলায় আটকে গেল। বৃদ্ধা পড়ে গেলেন। তাঁর মরে যাওয়ার অবস্থা। বাড়ির সবাই তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন। কেউ তাঁকে পানি খাওয়ালেন, কেউবা তাঁর মাথায় পানি দিলেন। অনেক্ষণ পর বৃদ্ধা চোখ খুললেন। আমাদের বাড়ির সবাই তখন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সবাই মাকে দুষতে লাগলেন এই বলে যে ‘বৃদ্ধা মারা গেলে নিশ্চিত আমরা মার্ডারের কেসে পড়তাম।’ মা অবশ্য এমন কাজ প্রায়ই করতেন।

হাওরে মাছ ধরা শেষে তীরে ফেরা
হাওরে মাছ ধরা শেষে তীরে ফেরা

যাহোক, হাওরের মানুষ শত অভাবের মধ্যেও ভেঙে পড়ে না। লড়াকু সৈনিকের মতো সংগ্রাম করে বছরের পর বছর তাদের কষ্টের দিনগুলো অতিক্রম করে আসছে।
ছোটবেলায় দেখেছি, কৃষকেরা মান্ধাতা আমলের চাষবাসে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রচণ্ড গরমে বা হিমশীতল ঠান্ডায় কাজ করে তাঁদের ফসল ফলাতে হতো। পৌষ মাসের একদম ভোরে গরু আর লাঙল নিয়ে তাঁরা বেরিয়ে যেতেন জমি চাষ করে ধানের চারা রোপণের জন্য জমি প্রস্তুত করতে। এ সময়ে এত ঠান্ডা যে লেপ–কাঁথার নিচে শুয়ে থেকেও ঠান্ডা থেকে বাঁচা কঠিন হতো। আর এই সময় তাঁরা হাঁটুপানিতে নেমে হালচাষ করতেন। ২০-৩০ মিনিট নয়, কয়েক ঘণ্টা ধরে তাঁরা হালচাষ করতেন। কী করে যে এত ঠান্ডা সহ্য করতেন, তা ভেবে পাই না। আমি তাঁদের জিজ্ঞেস করেছি, ‘এত সকালে পানিতে নেমে হালচাষ করতে কষ্ট লাগে না?’ তাঁরা বলতেন, ‘প্রথম কিছুক্ষণ লাগে, এরপর আর লাগে না। পাগুলো কেমন যেন অবশ হয়ে যায়।’ সত্যি, ঠান্ডায় কাজ করতে করতেই তাঁদের অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আমি নিজেও মাঝেমধ্যে এতটা সকালে না হলেও পৌষ মাসে পানিতে নেমে ধানের চারা রোপণ করেছি বা জমিতে আগাছা পরিষ্কার করেছি। ঠান্ডা লাগলেও এতটা অসহ্য মনে হতো না, যেমনটা এখন মনে হয়। এখন তো বৃষ্টিতে একটু ভিজলে বা একটু ঠান্ডা লাগলেই সর্দি, এমনকি জ্বর পর্যন্ত হয়ে যায়। তখন তো হতো না। আমাদের ছেলেমেয়েরা তো একটু ঠান্ডাতেই কাতর হয়ে যায়। গ্রামের ছেলেমেয়েরা এখনো আমাদের ছেলেমেয়েদের চেয়ে অনেক কষ্টসহিষ্ণু। তবে গ্রামের অবস্থাও অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। এখন জমি চাষ হয় ট্রাক্টর দিয়ে। গরু দিয়ে লাঙল টানার দিন এখন আর নেই।

শৈশবে আমাদের এলাকায় ভাতের অভাব দেখলেও মাছের অভাব দেখিনি কখনো। প্রচুর মাছ পাওয়া যেত প্রাকৃতিক উৎস থেকে। মাছ ধরা যেমন সহজ ছিল, তেমন আনন্দদায়কও। অনেকভাবে মাছ ধরার সুযোগ ছিল। বর্ষাকালে মাছ ধরার একটা সহজ উপায় ছিল লার দেওয়া (আমাদের এলাকায় এ নামে পরিচিত)। এ উপায়ে মাছ ধরার জন্য তিনজন মানুষ দরকার। একজন উচের (বাঁশের বেত আর চটি দিয়ে তৈরি ত্রিকোনাকার মাছ ধরার যন্ত্র) এক কোনায় ধরে রাখতেন। অন্য দুজন একটা লম্বা দড়ির দুই প্রান্তে ধরে অনেক দূরে যেতেন এবং দড়ি টেনে উচের দিকে আসতেন। এরপর উচের কাছে এসে দুজন উচের দুই কোনার ওপর পা রেখে দড়িটা পায়ের নিচ দিয়ে উচের দিকে টানতেন। এতে দড়ির তাড়া খেয়ে মাছগুলো উচের মধ্যে এসে জড়ো হতো। টানতে টানতে দড়িটা যখন উচের সঙ্গে লাগত, তখন তিনজন একসঙ্গে উচটা ওপরে তুলতেন। দেখা যেত, উচের মধ্যে অনেক মাছ জমা হয়ে আছে। এরপর উচটা নৌকায় উপুড় করে রাখা হতো। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ মাছ ধরার পর দেখা যেত, নৌকার তলাটা ভরে গেছে। ছোট–বড় এসব মাছের স্বাদই ছিল আলাদা। মুক্ত জলাশয়ের মাছ, রান্না করলে অন্য রকম একটা গন্ধ পাওয়া যেত, এখন যা সচরাচর পাওয়া মুশকিল।

মাছ ধরার মজার গল্প

এভাবে মাছ ধরার ক্ষেত্রে দারুণ মজার একটা গল্প বলব। গল্পটা আমার শোনা। আমাদের গ্রামের তিনজন একদিন লার দিয়ে মাছ ধরতে যান। উচ ধরে রাখেন একজন মুরব্বি। অন্য দুজন দড়িটা টেনে উচের কাছে নিয়ে আসার মুহূর্তে যখন উচটা তোলার সময়, তখনই মুরব্বি এটা ছেড়ে দেন। অন্য দুজন আশ্চর্য হয়ে এর কারণ জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু মুরব্বি কিছু না বলে উ-আ শব্দ করতে থাকেন। আর দুই হাত দিয়ে তাঁর লুঙ্গি সামালাতে ব্যস্ত থাকেন। এভাবে কিছুটা সময় কিসের সঙ্গে যেন যুদ্ধ করলেন। সঙ্গী দুজনকে কিছু বলেন না। তাঁরাও কিছু বুঝতে পারছেন না। অবশেষে তিনি দুই হাতে লুঙ্গি শক্ত করে ধরে দুজনকে বললেন তাঁকে টেনে নৌকায় তুলতে। তাঁরা তাঁকে নৌকায় টেনে তুললেন। এরপর তিনি হাত ছাড়লেন। তাঁর লুঙ্গির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বিশাল আকারের এক মৃগেল মাছ। আর মুরব্বি তখন হাঁপাতে লাগলেন। সঙ্গী দুজন তো তখন আশ্চর্য হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ডাঙায় অসহায় হলেও পানিতে মাছেরা অসম্ভব শক্তিশালী। আর বাঁচার জন্য মাছটা নিশ্চয়ই তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে। তাই মাছটাকে সামলাতে গিয়ে মুরব্বির ওপর দিয়ে কী ধকলটাই না গেছে! তবু তিনি হাল ছাড়েননি। মাছটা শেষ পর্যন্ত আটকিয়েই ফেলেছেন।

হাওরের সুখ-দুঃখ যেমন দেখেছি-১
প্রথম আলো ফাইল ছবি

মাছ ধরার সঙ্গে অনেক ভৌতিক বিষয়ের কথাও আমরা ছোটবেলায় শুনেছি। মাছ ধরার জন্য অনেক সময় খুব ভোরবেলায় যেতে হতো। তা–ও আবার বৃষ্টির দিনে। তখনকার দিনে বর্তমান সময়ের মতো এত ঘনবসতি ছিল না। বিদ্যুৎ তো ছিলই না। এ ছাড়া গ্রামে অনেক জঙ্গল ছিল। ফলে রাত ছাড়াও সকালেও বেশ অন্ধকার থাকত। যাহোক, রাতেই পরামর্শ করে রাখা হতো কত সকালে কে কাকে নিয়ে মাছ ধরতে যাবে। এমনভাবেই দুই বন্ধু রাতে পরামর্শ করে ঘুমালেন যে তাঁরা একদম ভোরবেলাতেই একেবারে অন্ধকার থাকতেই মাছ ধরতে বেরিয়ে যাবেন। ভোরে একজন শুনলেন, তাঁর বন্ধু তাঁকে ডাকছেন। তিনিও ঘুম থেকে তাড়াহুড়ো করে উঠলেন। হারিকেনটা হাতে নিয়েই দরজাটা খুললেন। বন্ধুকে বললেন ভেতরে আসতে, কিন্তু তিনি ভেতরে না এসে তাঁকে বের হওয়ার জন্য তাড়া দিতে লাগলেন। হঠাৎ করেই ঘরের ভেতরের বন্ধুর বাইরের বন্ধুর পায়ের দিকে নজর পড়ল। দেখলেন পায়ের আঙুলগুলো পেছনের দিকে। দেখামাত্রই বুঝে ফেললেন যে এটা ভূত, তাঁর বন্ধু নন। সঙ্গে সঙ্গেই দরজাটা বন্ধ করে দিলেন এক চিৎকার। ভূতও তখন চিৎকার দিয়ে এই বলে চলে গেল, ‘বেঁচে গেলি, আজ ঘর থেকে বের হলে তোর ঘাড় মটকে খেতাম।’ এসব গল্প শুনে আমরা বেশ ভয় পেতাম। আর রাতে কেউ ডাকতে এলে প্রথমেই তার পা দেখে নিশ্চিত হতাম সে ভূত না মানুষ।

মাছ ধরার এমন আরও অনেক মজার গল্প আমরা শুনতাম। আমাদের গ্রামের এক হাজি সাহেব মাছ শিকারে খুব ওস্তাদ ছিলেন। একদিন তিনি হাওরে মাছ ধরতে গেলেন। তখন বর্ষাকাল। হাওরে শোল মাছের এক ঝাঁক পোনামাছ (আমাদের এলাকায় একসঙ্গে থাকা পোনামাছকে পোনাবাইশ বলা হতো) পেলেন। পোনামাছের সঙ্গে মা শোল মাছটাও থাকে। এটাকে মারার জন্য তিনি কুচ (মাছ ধরার যন্ত্র) নিয়ে দাঁড়ালেন। বড় শোল মাছটা ভাসলেই ঘা মেরে এটাকে ধরবেন। হঠাৎ করেই তিনি দেখলেন, পোনামাছের ঝাঁকের মধ্যে থেকে শোল মাছের বদলে বিশাল আকারের এক মাউচ্ছা সাপ (আমাদের এলাকায় গোখরো সাপকে এ নামে ডাকা হতো) ফণা তোলে তাঁর দিকে ছোবল দিতে আসছে। তিনি আর কালবিলম্ব না করে কুচ দিয়ে সাপটাকে ঘা দিয়ে লাগিয়ে ফেললেন এবং কুচের বাঁশের হাতলে শক্ত করে ধরে সাপটাকে পানির নিচে একেবারে মাটির সঙ্গে চেপে ধরলেন। ওখানে তখন বেশ পানি। আর সাপটাও খুব শক্তিশালী। সাপটাও তার সব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল উঠে আসতে। আর হাজি সাহেবও প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন সাপটা না মরা পর্যন্ত ঠেসে ধরে রাখতে। উভয়ের মধ্যেই বাঁচা–মরার সংগ্রাম চলছে। পাশেই ছিলেন আরেকজন মাছশিকারি। তিনি ভাবলেন, হাজি সাহেব বিরাট বড় কোনো মাছ আটকাতে পেরেছেন। তিনি তাঁকে একটু সাহায্যের জন্য এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘কী মাছ এটা? মনে হচ্ছে বেশ বড়। আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’ হাজি সাহেব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, ‘পারেন, আমার কুচটায় একটু শক্ত করে ধরুন। আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।’ লোকটা খুব উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে গেলেন এবং কুচটায় ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গেই হাজি সাহেব কুচটা ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে চলে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘ভাইজান, একটু শক্ত করে ধরুন। এটা কিন্তু মাছ না, মাউচ্ছা সাপ।’ কথাটা শুনে ভদ্রলোক ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। বললেন, ‘বলেন কী, সাপের কথা তো আগে বলেননি।’ হাজি সাহেব বললেন, ‘আগে বললে কি আপনি কুচটা ধরতেন? আপনি ভয় পাবেন না। আমি আপনাকে ফেলে যাব না। একটু বিশ্রাম নিয়ে আসছি।’ ‘বলেন কি ভাই! তাড়াতাড়ি আসুন।’ হাজি সাহেব বসে বসে হাঁপাচ্ছেন। তাঁর পুরোটা শরীরই ঘেমে গেছে। অন্যদিকে সাহায্য করতে আসা লোকটার শরীরও ঘামে জবজবে। যাহোক, একটু বিশ্রাম নিয়ে হাজি সাহেব তাঁর কাছে গেলেন। ততক্ষণে সাপটাও কিছুটা দুর্বল হয়ে এসেছে। সাহায্যকারী লোকটা আস্তে আস্তে কুচটা ওপরে তোলার পর হাজি সাহেব অন্য একটা কুচ দিয়ে সাপটার মাথায় আরেকটা ঘা দেন। এরপর দুজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সাপটাকে মেরে নৌকায় তুলেন। সাপটা এতটা লম্বা ছিল যে এর মাথাটা নৌকার এক মাথায় আর লেজটা অন্য মাথায়। দুজনেই স্বীকার করলেন যে এত বড় সাপ তাঁরা জীবনে কেউই দেখেননি।

আলো দিয়ে মাছ ধরা

আসলে মাছ ধরা তখন সাধারণ মানুষের কোনো পেশা ছিল না। তারা মাছ বিক্রি করত না। শুধু জেলেরাই মাছ বিক্রি করতেন। তখন এখনকার মতো ফিশারি ছিল না। প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যেত। অনেকভাবে মাছ ধরার মধ্যে একটা উপায় ছিল আলো দিয়ে মাছ ধরা। হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে নৌকায় করে রাতে বের হতে হতো। লাইটটা থাকত নৌকার সামনে গলুইয়ে বাঁধা। একজন বা দুজন মাছশিকারি কুচ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। একজন নৌকা বাইতেন। লাইটের আলোয় পানির নিচে থাকা মাছ খুব ভালোভাবেই দেখা যেত। এভাবে রুই, কাতলা, বোয়ালসহ সব ধরনের মাছ ধরা যেত। এভাবে প্রায়ই প্রচুর পরিমাণে কাইক্যা (কাকি) মাছ ধরা যেত, যেগুলো রান্না করলে অন্য রকম একটা মজার গন্ধ বের হতো। মাছ ধরার নেশায় পেয়ে বসলে যতক্ষণ মাছ পাওয়া যেত, ততক্ষণই মাছ ধরা হতো। প্রয়োজন বা চাহিদার দিকে লক্ষ রাখা হতো না। দেখা যেত, রাতের দুটা–তিনটার দিকে নৌকা বোঝাই করে মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। এসে নারীদের কাঁচা ঘুম থেকে তুলতেন। তাঁরা মাছ দেখে একদিকে খুশি হতেন, অন্যদিকে মাছের আধিক্য দেখে কিছুটা বিরক্তও হতেন। রাতের বেলাতেই তাঁদের মাছ কাটতে হতো। তবে একান্নবর্তী পরিবার থাকায় একটা সুবিধাও ছিল। সবাই মিলেমিশে মাছ কেটে ফেলতেন। আর বেশি বড় মাছগুলো পুরুষেরাই কেটে দিতেন।

মাছের উইজ্জা

বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস মাছের ডিম পাড়ার সময়। বিশেষ করে বৃষ্টির দিনে মাছেরা ডিম ছাড়ার জন্য দল বেঁধে অল্প পানিতে চলে আসত। এটাকে বলা হতো মাছের উইজ্জা। মাছশিকারিরাও এমন দিনের অপেক্ষায়ই থাকতেন। বোয়াল, গনিয়া ইত্যাদি ডিমওয়ালা বড় বড় মাছ একেবারে পানির ওপরেই ভেসে উঠত। তখন ইচ্ছেমতো মাছ ধরার সুযোগ পেয়ে যেতেন সবাই। দশটা, বিশটা, ত্রিশটা—যে যেমন পারতেন মাছ নিয়ে বাড়ি আসতেন। আবার এমনও হতো যে মাছের পরিমাণ খুব বেশি হয়ে যাওয়ায় এগুলো নেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে খবর দিয়ে মাছ নেওয়ার জন্য মানুষ আনতে হতো।
বৈশাখ–জ্যৈষ্ঠ মাসে রাতেই মাছশিকারিরা হাওরে গিয়ে উইজ্জার জন্য অপেক্ষা করতেন। এমনই একটা সময়ের গল্প বলি। এক রাতে মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে একজন অপেক্ষা করছিলেন। তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি। নিকষ কালো অন্ধকার রাত। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য মাথায় একটা লম্বা মাতলা (ছাতার পরিবর্তে এগুলো ব্যবহৃত হতো) দিয়ে বসে আছেন। একপর্যায়ে তাঁর একটু ঘুমও এসে যায়। হঠাৎ করেই বেশ ঠান্ডা কী যেন একটা জিনিসের ছোঁয়ার তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। মনে হলো তাঁর মাতলার নিচে পিঠ ঘেঁষে খুব ঠান্ডা কিছু একটা কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু মাথা ঠান্ডা রাখলেন। একদম নড়াচড়া না করে তাঁর সঙ্গে থাকা ম্যাচ থেকে একটা দেশলাইয়ের কাঠি বের করে আস্তে করে জ্বালালেন। এরপর তাকিয়ে যা দেখলেন, তাতে তো তাঁর বারোটা বেজে যাওয়ার অবস্থা। একটা বিশাল বড় সাপ মাতলার নিচে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। এই মহাবিপদেও লোকটা বুদ্ধি হারালেন না। তাঁর মনে হলো, বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য সাপটা মাতলার নিচে আশ্রয় নিয়েছে। তিনি সাপটার ওপর মাতলাটা রেখেই ধীরে ধীরে দূরে সরে গেলেন। সাপটা কোনোরূপ নড়াচড়া না করে চুপটি করে শুয়েই রইল। আর এ সুযোগে তিনি সে রাতে আর মাছ ধরার অপেক্ষায় না থেকে বাড়ি চলে এলেন।

আমাদের এলাকায় দেখেছি, প্রতি গ্রামেই দুই–তিনজন মাছশিকারি ছিলেন। বর্ষাকালে হাওর যখন পানিতে টইটম্বুর, তখন মাছ শিকারের উপযুক্ত সময়। আমার মেজো ভাই ভালো মাছশিকারি। নৌকায় মাছ ধরার বিভিন্ন যন্ত্র নিয়ে হাওরের গভীরে যেতে হতো। শিকারির নৌকা বেয়ে দেওয়ার জন্য একজন সহকারীর প্রয়োজন হতো। ভাই আমাকে সহকারী হিসেবে নিতেন। রুই, কাতলা, মৃগেল ইত্যাদি মাছ গভীর পানিতে জন্মানো ঘাস তাদের খাবার হিসেবে ব্যবহার করত। পানির ওপরের অংশ নয়, তারা খেত ঘাসের বেশ নিচের অংশ। যখনই মাছেরা ঘাসের কোনো অংশ খেতে শুরু করত, তখনই সেই ঘাসের পানির ওপরের অংশটা নড়ে উঠত। কিন্তু ঘাসগুলো সোজাসুজি বা খাড়া থাকত না। স্রোতের কারণে ঘাসগুলো অনেক হেলে থাকত। একমাত্র ভালো শিকারিরাই মাছের অবস্থান বুঝতে পারতেন। শুধু অবস্থান নয়, মাছটা কতটা বড়, এটাও বুঝতে পারতেন। মাছের আকার বুঝেই অস্ত্রটা বাছাই করতেন এবং সেটা যথাযথভাবে প্রয়োগ করতেন। আমার মেজো ভাই এ বিষয়ে বেশ অভিজ্ঞ ছিলেন। আর আমার দায়িত্বটাও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। যেদিকে মাছটাকে ঘাস খেতে দেখা যেত, সেদিকে নৌকাটা এগিয়ে দিতে হতো কোনো শব্দ না করেই। একটু শব্দ হলেই মাছটা চলে যেত। তাই নৌকা বাইতে হতো অতি সাবধানে। যাহোক, আমরা প্রচুর মাছ মারতাম। ছোট ছোট রুই, গনিয়া ইত্যাদি তো ধরতামই, পাশাপাশি অনেক দিন বড় মাছও ধরতাম। তবে এর জন্য উপযোগী পরিবেশের প্রয়োজন হতো। যেদিন বাতাস থাকত না, সেদিনই মাছ ধরা যেত। তাই আমরা অপেক্ষায় থাকতাম কখন নীরব পরিবেশটা আসবে। বাতাস একটু কমলেই আমরা বেরিয়ে পড়তাম। এমনও হতো, আমরা মাছ ধরার নেশায় সারাটা দিন হাওরে কাটিয়ে দিতাম। কখন বেলা শেষ হয়ে সন্ধ্যা হয়ে যেত, টেরই পেতাম না। মাছও ধরতাম প্রচুর। ছোট–বড় রুই, কাতল, গনিয়া, চিতল—সব মাছ। অবশ্য চিতল ধরার কৌশলটা ছিল ভিন্ন। চিতল মাছ গভীর পানিতে থাকে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর শ্বাস নেওয়ার জন্য পানির ওপরে আসে। সাধারণত একই জায়গায় আসে। আমরা লক্ষ করে দেখতাম, ঠিক কোন জায়গায় মাছটা আসে। এরপর একদম কোনো শব্দ না করে নৌকাটা ওই জায়গায় নিয়ে যেতাম। মেজো ভাই মাছ ধরার যন্ত্রটা নিয়ে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। মাছটা হঠাৎ করেই শ্বাস নিয়ে আবার খুব দ্রুত চলে যেত। এর মধ্যেই যা করার করতে হতো। মেজো ভাইয়ের নিশানা সাধারণত মিস হতো না। এর মধ্যেই ঘা মেরে মাছটাকে আটকে দিতেন। মাছটাও ছুটে যাওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করত। কিছু কিছু মাছ চলেও যেত। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা মাছটাকে ধরে নৌকায় তুলতে পারতাম। বেশ বড় বড় মাছ। কী ভালো যে লাগত, তা বলে বোঝানো যাবে না। সারা দিনটা খাওয়াদাওয়া ছাড়া কীভাবে যে চলে যেত, টেরই পেতাম না। স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো।বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সাল। বেশ ছোটই তখন। কিন্তু তখনকার সবকিছুই মনে আছে আমার। আমার বেশ মনে পড়ে, একাত্তরের বর্ষাকালে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত হাওরে। আমার বড় ভাইয়েরা নৌকা নিয়ে হাওরে মাছ ধরতে যেতেন। আমি তখন মাছ ধরার কোনো কাজে অংশগ্রহণ করার মতো যোগ্যতা অর্জন করিনি। কিন্তু আমি রোজই তাঁদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য বায়না ধরতাম। মাছ ধরা দেখতে আমার খুব ভালো লাগত। আমাকে তাঁরা নিয়েও যেতেন। সারা দিন নৌকায় বসে বসে মাছ ধরা দেখাই ছিল আমার একমাত্র কাজ। তবে আমাকে কঠোরভাবে একটা শর্ত মানতে হতো। কোনো নড়াচড়া না করে বসে থাকতে হতো। শর্তটা বেশ কঠিনই ছিল। তবু মাছ ধরা দেখার নেশায় এটা মানতে আমার তেমন কোনো অসুবিধা হতো না। কিন্তু তখন একটা বিষয় লক্ষ করতাম, কিছুদূর যেতে না যেতেই একটা–দুটা লাশ ভেসে আসত। বেশ দুর্গন্ধযুক্ত লাশ। বড়দের কাছে শুনতাম, এগুলো হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধা বা সাধারণ নিরীহ মানুষের লাশ। লাশের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন মাছ আনাগোনা করছে। কী ভয়ংকর দৃশ্য। মনে হলে এখনো গা শিউরে ওঠে। আমার ভাইয়েরা বলতেন, ‘আহারে, কোন মায়ের কোল না জানি খালি হলো।’ এরপর নৌকা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিতেন। একাত্তরে এমন দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ত।

ছোটবেলায় আমাদের এলাকায় বিভিন্নভাবে এত মাছ ধরার সুযোগ ছিল যে এগুলোর বর্ণনা দিতে গেলে শেষ করা যাবে না। তা ছাড়া আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের বর্ণনা যত বড় হবে, পাঠকের বিরক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও তত বেশি থাকবে। তাই একাত্তরের আরেক দিনের একটা গল্প দিয়ে এই পর্বের লেখাটা শেষ করতে চাই। যত দূর মনে পড়ে, সময়টা কার্তিক মাস ছিল। মেজো ভাই আমাকে নিয়ে নদীর পাড়ে মাছ ধরতে গেলেন। তখন নদীর পাড়ের কাছ দিয়ে শোল, গজার বড় বড় টাকি ইত্যাদি মাছ যেত। আর ভাই কুচ দিয়ে ঘা দিয়ে এগুলো ধরে চোপড়ায় (বাঁশের বেত দিয়ে তৈরি মাছ রাখার পাত্র) রাখতেন। আমার কাজ ছিল তাঁর সঙ্গে থেকে মাছ ধরার মজাটা উপভোগ করা আর চোপড়াটা বহন করে নিয়ে যাওয়া। কিছুক্ষণ পরেই চোপড়াটা মাছে প্রায় ভরে গেল। আমার পক্ষে আর এটা বহন করা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন ভাই এটা একটু সামনে রেখে আসতেন আর আমি এটা পাহারা দিতাম। পাহারা দেওয়ার এক ফাঁকে আমার চোখে পড়ল বেশ বড় একটা ফুটকা মাছ। একটু আগে মাছ ধরতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় বলে হয়তো এটাকে কেউ ফেলে গেছে। আমার হাতে ছিল একটা লাঠি। লাঠি দিয়ে স্পর্শ করামাত্রই এটা ফুলে ছোট একটা ফুটবলের আকার ধারণ করল। আমি লাঠি দিয়ে এটাকে জোরে আঘাত করলাম (ছোটবেলায় ফুটকা মাছ পেলেই সব সময় এই কাজ আমরা সব সময় করতাম)। তখন বড় ধরনের একটা শব্দ করে এটা ফুটো হয়ে গেল।

অনেকটা বোমা ফুটার মতোই শব্দ। একটু আগেই তিনজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা যাচ্ছিলেন। তাঁরা ইতিমধ্যেই আমাদের পেছনে ফেলে একটু এগিয়ে গিয়েছিলেন। তখন তো প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল সময়টা। আর মুক্তিযোদ্ধাদের তো সর্বোচ্চ ঝুঁকি মাথায় নিয়ে চলতে হতো। আওয়াজটা শুনে তাঁরা তিনজনই একসঙ্গে আমার দিকে তাকালেন। আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। ভয়ে আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মাঝেমধ্যে আড়চোখে তাঁদের দিকে তাকাচ্ছিলাম। তাঁরা তিনজন নিজেদের মধ্যে কী যেন কথা বললেন। এরপর চলে গেলেন। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মেজো ভাই অবশ্য বিষয়টি একদমই খেয়াল করেননি। তিনি তাঁর মাছ ধরার নেশায় ব্যস্ত ছিলেন। তিনি বিষয়টা লক্ষ করলে আমি যে খুব বকুনি খেতাম, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিজ্ঞাপন
মন্তব্য করুন

অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন

Leave a Reply

পরিবেশ

ছাদ বাগানের জন্য কয়েকটি টিপস

ছাদ বাগানীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। টবে, ড্রামে গাছ লাগানো হয়। কেউ ফল, কেউবা সবজির গাছ লাগান। কেউ সফল হন। কেউ সফল হন না। ছোট ছোট কিছু ভুল বাগানীরা করে থাকেন। সে কারণে যত্ন নিলেও ফল আসে না। এখানে ছাদ বাগানীদের জন্য কিছু টিপস দেয়া হলো, যা মানলে সফলতা পাওয়া সহজ হতে পারে।

প্রথমেই মনে রাখতে হবে, টবে বা ড্রামে গাছ লাগালে তাকে খাবার দিতে হবে। প্রকৃতিতে বিদ্যমান গাছের মতো সে খাবার সংগ্রহ করতে পারে না। রোগ-বালাই হলো কিনা সেটাও বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে।

১. মাটির সাথে অবশ্যই কিছু কোকোপিট মেশাবেন। গাছের গোড়া স্যাতস্যাতে হতে দিবেন না। স্যাতস্যাতে হলে অসংখ্য রোগ হবে। মাটি ভেজা থাকবে তবে স্যাতস্যাতে না। কেকোপিট মেশালে পানি কম দিলেও হবে। কোকোপিট (নারকেলের ছোবলার গুড়া) পানি ধরে রাখে। অতি বৃষ্টি হলে গোড়ায় পানি জমতে দেয় না। হালকা হওয়ায় ছাদে ওজনের চাপ পড়ে না। এছাড়া কোকোপিটে কিছু পুষ্টি উপাদান আছে। যা গাছের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কোকোপিটে চারা দ্রুত গজায়, বড় হয়। মাটির চেয়ে কোকোপিটে চারা ভালো হয়।

২. গাছের জন্য বিরিয়ানি হলো সরিষার খৈল-পচা পানি। মাটির হাড়িতে খৈল পচাতে হবে। কমপক্ষে ৫ দিন। ৭ দিন কিংবা বা ১৫ দিন হলে উত্তম। অল্প পানিতে পচিয়ে তার সাথে আরো পানি মিশিয়ে দিতে হবে। এটি গাছের জন্য অত্যন্ত উপকারী। একটু গন্ধ হয়, তাই অল্প একটু গুড় দিতে পারেন। ছাদে হাড়িতে পচালে বাসায় গন্ধ আসবে না। বৃষ্টির সময় খৈল-পচা পানি দেবেন না। পুকুরের নিচে থাকা পাক কাদা গাছের জন্য খুব উপকারী।

৩. আমরা জানি, মাটিতে অসংখ্য ক্ষতিকর ছত্রাক থাকে। যা গাছকে মেরে ফেলার জন্য যথেস্ট। তাই মাটি রেডি করার সময় কিছুটা বায়োডামা সলিট দিবেন। এটি উপকারী ছত্রাক। মাটিতে ক্ষতিকারক উপাদানগুলো মেরে ফেলে। আবার জৈব সারের কাজও করে। গাছের জন্য মাটি হবে ঝুরঝুরে, হালকা।

৪. যাই লাগান না কেন, ভালো জাতের বীজ কিনা নিশ্চিত হয়ে নেবেন। ভালো বীজে ভালো ফসল হবে। নতুবা যতই যত্ন নেন না কেন, সব পরিশ্রম বেলাশেষে জলে যাবে। বীজ থেকে নিজে চারা করা উত্তম। কারণ বাজার থেকে যে চারা কিনবেন সেটার জাত ভালো হবে সে নিশ্চয়তা কোথায়? ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে নেয়া উত্তম। পদ্ধতি হলো- ছত্রাকনাশক দেয়া পানিতে কিছুটা সময় বীজ ভিজিয়ে রাখতে হবে। ম্যানসার, মেটারিল দুটি ছত্রাকনাশক।

৫. গাছ বেশি তো ফলন বেশি- এটি ভুল ধারণা। অল্প জায়গায় বেশি গাছ লাগানো যাবে না। গাছ পাতলা করে লাগাতে হবে। বেশি লাগালে গাছ প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাবে না। একটি ফলের ক্রেটে মাত্র দুটি গাছ। একটি টবে একটি গাছ। ক্রেট বা টবে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

৬. ছাদে মাচা দেয়া সমস্যা। কারণ ঘুঁটি থাকে না। এ জন্য ফলের ক্রেটের চারপাশে লাঠি বেঁধে সহজে মাচা দেয়া যায়। লতাপাতা জাতীয় গাছ লাগানোর পাত্র একটু গভীর হলে উত্তম। গাছের জন্য সবচেয়ে বেশি ভালো জৈব সার হলো পাতা-পচা সার, তারপর ভার্মি কম্পোস্ট, তারপর গোবর সার। পাতা-পচা সার সহজলভ্য নয়। দাম বেশি। কিন্তু ভার্মি কম্পোস্ট সহজলভ্য। মাটির সঙ্গে মিনিমাম ৪০% জৈব সার দেয়া উত্তম।
৭. নিম কীটনাশককে ক্ষতিকারক পোকা-মাকড় খুব অপছন্দ করে। এটি দিলে তারা বিরক্ত বোধ করে। গাছে বাসা বাঁধতে পারে না। প্রতি সাত দিনে একবার সব গাছের পাতায় নিম কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। মাসে একবার ইপসম সল্ট স্প্রে করে দেয়া উত্তম। একইভাবে মাসে একবার পানির সঙ্গে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড মিশিয়ে স্প্রে করা ভালো।

৮. ডাটা, পুইশাক, লালশাক, ধনেপাতা এসব লাগাতে পারেন। মাত্র ২৫ দিনে খেতে পারবেন। লালশাক লাগালে নেট দিয়ে ঘিরে দেবেন। শাকপাতা লাগালে দ্রুত আউটপুট পাবেন। যা আপনাকে প্রেরণা দেবে। পুইশাক গাছের পাতায় দাগ হলে পাতা কেটে দিন। অথবা ছত্রাকনাশক স্প্রে করেন। অথবা গাছ উঠিয়ে আবার লাগান। ইউরিয়া সার দিলে পুইশাক দ্রুত বাড়বে। শশা গাছের বৃদ্বির জন্য ডিএপি সার দিলে ভালো হবে। শশা গাছে ছাড়া ছাড়া ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়। খুব রোদ, গাছের গোড়ায় মালচিং করে দিয়ে উত্তম ফল মিলবে। মালচিং হলো গাছের গোড়ায় বিশেষ পলিথিন কিংবা শুকনো পাতা, খড় দিয়ে ঢেকে দেয়া।

৯. ফুল আসার পরে প্রানোফিক্স অথবা মিরাকুরান গাছের পাতায় শেষ বিকালে স্প্রে করবেন। বাসায় দুইটি গ্রুপের ছত্রাকনাশক রাখা ভালো। যেমন- ম্যানসার, মেটারিল। ১৫ দিনে একবার স্প্রে করবেন। এগরোমিন্ড গোল্ড অনুখাদ্য বা অন্য কোনো অনুখাদ্য বাসায় রাখতে হবে। মাসে কমপক্ষে একবার স্প্রে করবেন। অতিরিক্ত গরম, বৃষ্টি, খাদ্যের অভাব, গাছ রোগাক্রান্ত, আবহাওয়া দ্রুত আপডাউন করা ইত্যাদি কারণে ফুল ঝরে পড়তে পারে। আবার পরাগায়ন না হলে ঝরে পড়তে পারে। এ জন্য হাতের মাধ্যমে পরাগায়ন করতে হবে। পুরুষ ফুলের পরাগদণ্ড নারী ফুলে গর্ভে ঘষে দিতে হবে।

১০. ছাদ বাগানে গাছ মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ পানি বেশি বা কম দেয়া। যতটুকু লাগে ঠিক ততটুকু পানি দিতে হবে। কোন গাছের কি চাহিদা, রোগ একটু স্টাডি করলে সহজে সফল হতে পারবেন।

১১. গাছের পাতার নিচে খেয়াল করবেন। বেগুন গাছের পোকা মারার জন্য সেক্স ফোরেমান ফাঁদ লাগাবেন। ডগা ছিদ্র বা ফল ছিদ্র হলে সাইপারমেত্রিন গ্রুপের কীটনাশক দিতে হবে। একটি বেগুন গাছ অনেক দিন ফল দেয়। ঢেড়স গাছ বেশি রোদ পড়ে এমন জায়গায় লাগাবেন। বেগুন, ঢেড়স, লালশাক, পুইশাক, ধনেপাতা, ডাটা শাক- এসব গাছের খুব যত্ন করতে হয় না।

১২. রসুন আর লবঙ্গ বেটে সেই পানি গাছে স্প্রে করলে পোকা কম আসবে। মরিচ গাছে নেপথলিন বেঁধে দিন, পোকা কম আসবে। পাতা কোকড়ালে ভার্মিটেক কিংবা এবোম কীটনাশক দিন। কোকড়ানো পাতা ফেলে দিন। মরিচ গাছে দশ দিন পর পর ডায়মেথট গ্রুপের (যেমন টাফগর) কীটনাশক দিলে উপকার হবে। সবকিছু করছেন, তারপরও কাজ হচ্ছে না। এক্ষেত্রে গাছের জায়গা বদল করেন, উঠিয়ে অন্যত্র লাগান।

সম্পূর্ণ খবরটি পড়ুন

দৈনন্দিন

নিপাহ্‌ ভাইরাসঃ খেজুরের রস খাওয়ার আগে সতর্ক থাকতে যা করণীয়

নিপাহ্‌ ভাইরাস খেজুরের রস খাওয়ার আগে সতর্ক থাকতে যা করণীয়
নিপাহ্‌ ভাইরাস খেজুরের রস খাওয়ার আগে সতর্ক থাকতে যা করণীয়
খেজুরের রস সংগ্রহের প্রক্রিয়া।

শীতকাল এলেই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে খেজুরের রস খাওয়ার চল বেড়ে যায়। অনেকে গাছ থেকে খেজুরের কলসি নামিয়ে সরাসরি কাঁচা রস খেয়ে থাকেন।

আবার অনেকে এই রস চুলায় ফুটিয়ে সিরাপ, পায়েস বা ক্ষীর বানিয়ে খান। এছাড়া রসের তৈরি ঝোলা গুড়, পাটালি গুড়, নলেন গুড়, ভেলি গুড়, বালুয়া গুড়, মিছরি গুড়সহ নানা ধরণের পিঠার বেশ সুখ্যাতি রয়েছে।

নিপাহ্‌ ভাইরাস আতঙ্ক

খেজুর আরব দেশের প্রচলিত ফল হলেও ওইসব দেশে খেজুর, মূলত ফল উৎপাদননির্ভর, যেখানে কিনা বাংলাদেশের খেজুর গাছ রস উৎপাদননির্ভর।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের মতে, বাংলাদেশে সাধারণত কার্তিক থেকে মাঘ অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত খেজুরের রস সংগ্রহ হয়ে থাকে।

দেশটির সবচেয়ে বেশি রস সংগ্রহ হয় যশোর, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর অঞ্চল থেকে।

মূলত খেজুর গাছের ডালপালা পরিষ্কার করে, ডগার দিকের কাণ্ড চেঁছে তাতে একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি চোঙ বসিয়ে দেয়া হয়। চোঙের শেষ প্রান্তে ঝুলিয়ে দেয়া হয় একটি মাটির হাড়ি বা কলসি।

সেই চোঙ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রস এসে জমা হতে থাকে মাটির হাড়ি বা কলসিতে। এভাবে একটি গাছ থেকে দৈনিক গড়ে পাঁচ থেকে ছয় লিটার রস সংগ্রহ করা যায় বলে কৃষি তথ্য সার্ভিস সূত্রে জানা গিয়েছে।

কিন্তু গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই খেজুরের রস খাওয়ার ক্ষেত্রে নিপাহ্‌ ভাইরাস আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

সম্পূর্ণ খবরটি পড়ুন

পরিবেশ

জেনে নিন এই মরসুমে কোন কোন ঔষধি উদ্ভিদের চাষ আপনার জন্য সেরা

দেশের বিভিন্ন রাজ্যেই বর্ষার (Monsoon 2021) প্রভাবে চলছে বৃষ্টিপাত। এসময় কৃষকেরা খারিফ শস্য (Kharif Crops) বপনে তৎপর হয়ে ওঠেন। এই খরিফ মরসুমে কৃষকভাইরা সাধারণত অঞ্চলভেদে ধান, অড়হর, সোয়াবিন সহ বিভিন্ন চাষে মনযোগ দিয়ে থাকেন ৷ তবে এসব ছাড়াও, ঔষধি গুন সমৃদ্ধ (Medicinal Crops) গাছ চাষে বর্ষায় যে কতটা লাভ হতে পারে সে সম্পর্কে অনেকেই হয়তো জানেন না৷

বিশেষ করে বর্ষাকালেই এমন বহু ঔষধি গুন সম্পন্ন গাছ রয়েছে যাদের চাষ হতে পারে লাভজনক৷

বর্ষাকালে কোন কোন ঔষধি উদ্ভিদের চাষ করা যেতে পারে অথবা এই চাষ কীভাবেই বা করা যাবে সে বিষয়ে সঠিক তথ্য না পাওয়ার কারণেই অনেকের কাছে বিষয়টি অধরা৷ চলুন এই প্রতিবেদনে এমনই কিছু গাছ নিয়ে আলোচনা করা যাক যা কৃষকদের জন্য হতে পারে লাভদায়ক৷ তবে সঠিক সময়ে, সঠিক রোপন, সেচ, কীটনাশক দেওয়ার প্রয়োজন এগুলিতে, না হলে এর ওপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে৷

অশ্বগন্ধা –

বর্ষায় এর চাষ ভালো৷ জুন থেকে অগস্ট পর্যন্ত এর চাষ করতে পারেন৷ এর বিভিন্ন জাত রয়েছে৷ উন্নত মানের গাছের চাষে কৃষকের লাভের পরিমাণও বৃদ্ধি পেতে পারে৷ উল্লেখ্য, প্রতি হেক্টরে ৫ কিলোগ্রাম বীজ ব্যবস্থা করতে হবে৷ যদি কেউ ১ হেক্টর জমিতে অশ্বগন্ধার চাষ করতে চায় তাহলে তাকে প্রায় ৫০০ বর্গমিটারে নার্সারি তৈরি করতে হবে৷ প্রায় ১ সেন্টিমিটার গভীরে বীজ বপন করতে হবে৷

শতমূলী –

শীত বাদ দিয়ে বছরের যে কোনও সময়ে এই গাছের চাষ করতে পারেন৷ বর্ষাকালে এই চারা রোপন করলে সহজেই তা বেড়ে উঠতে থাকে৷ তবে বীজ বপনের আগে বীজ ১ দিন পর্যন্ত হালকা গরম জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়৷

যষ্টিমধু –

জুলাই থেকে অগস্ট পর্যন্ত এর চাষ করা হয়৷ আর তাই জুন থেকেই এর প্রস্তুতি শুরু করে দেন কৃষকেরা৷ জলনিকাশি ব্যবস্থা উচ্চমানের হওয়া প্রয়োজন এই গাছ চাষের জন্য৷ মনে রাখতে হবে এর চাষের আগে জমিতে কমপক্ষে ১৫ টন গোবর সার দেওয়া প্রয়োজন, এরপরেই এটি চাষ করা উচিত৷

ঘৃতকুমারী –

এর ভালো উৎপাদনের জন্য জলনিকাশি ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে৷ এই ধরনের ঔষধি গুনসম্পন্ন গাছ শীতকাল বাদ দিয়ে যে কোনও সময় চাষ করতে পারেন৷ বর্ষাকালে দূরত্ব রেখে বীজ বপন করতে হবে৷ কম সময়ের মধ্যেই ব্যবহারোপযোগী হয়ে ওঠে এগুলি৷

অগ্নিশিখা বা কলিহারি –

এটি চাষের জন্য কৃষকেরা জুন মাসেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন৷ জুলাইয়ে ভালো বৃষ্টিতে এর চাষ শুরু করা যেতে পারে৷ উল্লেখ্য, ১ হেক্টর জমির জন্য প্রায় ১০ ক্যুইন্টাল কন্দের প্রয়োজন৷ এটি চাষের আগেও জমিতে গোবর সার প্রয়োগ করে তা প্রস্তুত করে নিতে হবে৷

সম্পূর্ণ খবরটি পড়ুন

পরিবেশ

শিখে নিন টবে দারুচিনির চাষের কৌশল

পৃথিবীতে ভোজ্য মসলা যতরকম আছে তারমধ্যে দারুচিনি সবথেকে উল্লেখযোগ্য। এই প্রাচীনতম মসলা বহুদিন ধরে ওষধি হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে। এছাড়াও খাবারে স্বাদ বাড়ানো থেকে শুরু করে, পানীয় এবং তরল মশলাদার খাবারে স্বাদ বাড়ানোর জন্যও এই দারচিনির ব্যবহার হয়। এলাচ, গোলমরিচ, লবঙ্গের সাথে সাথে দারুচিনির নামও মসলা হিসেবে একই পংক্তিতে উচ্চারিত হয়। বহু কৃষক দারুচিনির চাষ করে ভীষণভাবে উপকৃত হয়েছেন। বাজারে এই দারুচিনির চাহিদা প্রচুর পরিমানে থাকায়, এই চাষে ভালো লাভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও সৌখিন মানুষেরাও ভালোবেসে দারুচিনির চাষ বাড়িতে করে থাকেন। দারুচিনি গাছের বাকল, ফুল, কুঁড়ি, পাতা, ফল, শেকড় সবকিছুই কাজে লেগে যায়। দারুচিনি গাছ বাড়িতে চাষ করতে গেলে ঘরে ছাদে দুই জায়গাতেই চাষ করা যায়।

মনে রাখতে হবে এই চাষ করতে গেলে উপযুক্ত পরিমানে রোদ দরকার। বাংলার জলবায়ুতে মূলত শীতকালে এই চাষ করা সবথেকে ভালো। জানুয়ারি মাসে দারুচিনি গাছে ফুল ফোটা আরম্ভ করে, এবং এই গাছের ফল পাকতে আরম্ভ করে জুলাইয়ে। সেইসময়ই ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে এসে বাগানে বা টবে রোপন করে দেওয়া উচিত।

প্রয়োজনীয় রোদ (Sunlight)

কড়া সূর্যালোক দারুচিনি জন্য প্রয়োজনীয়, তাই এটি পর্যাপ্ত রোদ পাওয়া যায় এমন জায়গায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দারুচিনি রোপন করতে গেলে রৌদ্রোজ্জ্বল স্থান যেমন জানালার ধারে, ব্যালকনি কিংবা ছাদের খালি স্থান ব্যবহার করতে হবে।

উপযুক্ত মাটি (Soil)

দারুচিনি চাষের জন্য ভাল মানের মাটি ব্যবহার করা আবশ্যক। বাগানের মাটি ব্যবহার না করাই ভালো, কেননা এতে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। অনে সময় আমরা আশেপাশ থেকে মাটি নিয়েই টব ভরে গাছ লাগানো হয়।  বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংবেদনশীল গাছগুলোতে এই উপায় কার্যকরী হয় না। নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভাল এমন মাটি ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উত্তম নিষ্কাশনযুক্ত বেলে দোআঁশ মাটি ব্যবহার করা সবথেকে উত্তম। জেনে রাখা ভালো দারুচিনি খরা একদমই সহ্য করতে পারে না। মাটির বিকল্প হিসেবে ১৫% ট্রাইকোকমপোস্টযুক্ত কোকোডাস্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।

বাইরে চাষ করার জন্য এক মিটার (৩০ সেন্টিমিটার গভীর) পর্যন্ত গর্ত করে মাটি দিয়ে পূরণ করে নিতে হবে। ঘরের ভিতরে বা ছাদবাগানের দারুচিনি চাষের জন্য একটি বড় পাত্র প্রয়োজন হবে।

রোপন (Planting)

দারুচিনির বীজ সংগ্রহও করা যায় অথবা নার্সারি থেকে দারুচিনির গাছ কিনেও আনা যায়।

বাইরে চাষের ক্ষেত্রে

দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ১ মিটার x ১ মিটার এবং ৩০ সেমি গভীরতায় খনন করে মাটি দিয়ে গর্তটি পূরণ করতে হবে।

ঘরের মধ্যে টবে রোপনের ক্ষেত্রে

নিচে গর্ত সহ বড় সিরামিক পাত্র (৬০ x ৫০ সেমি) ব্যবহার করতে হবে। পাত্রটি মাটি বা কোকোডাস্ট দিয়ে পূরণ করে নিতে হবে। ৩০ সেন্টিমিটার গভীরতা এবং ৩০ সেন্টিমিটার প্রস্থের একটি গর্ত তৈরি করতে একটি বাগান ট্রোয়েল ব্যবহার করে নেওয়া ভালো। বীজ ব্যবহার করলে  ১.৫ সেন্টিমিটার গভীর গর্ত তৈরি করে নেওয়া উচিত। এবার গাছটি গর্তের মধ্যে রেখে মাটি দিয়ে চাপা দিতে হবে। বীজ ব্যবহার করলে প্রতি ১.৫ সেমি গর্তে একটি করে বীজ পুঁততে হবে এবং মাটি দিয়ে বীজটি ঢেকে দিতে হবে।

মাটি সবসময় ভেজা রাখতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জল দিতে হবে। দারুচিনি গাছ পাত্রে রোপন করার পর, টবের নিচের গর্ত থেকে জল বের না হওয়া পর্যন্ত জল দিতে হবে। টবের উপরের ৫ সেন্টিমিটার শুকিয়ে গেলেই আবার গাছটিকে জল দিতে হবে।

গাছের পরিচর্যা (Caring)

দারুচিনি গাছে নিয়মিত সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম বছর ৫০ গ্রাম টিএসপি, ৭৫ গ্রাম এমওপি ও ৫০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিবছর ২-৩ কেজি ট্রাইকোকম্পোস্ট ও সার প্রয়োগ শেষে একই হারে টিএসপি, এমওপি ও ইউরিয়া দিতে হবে।

দারুচিনি প্রথম ধরতে দুই থেকে তিন বছর সময় নেয় এবং তার পরে প্রতি দুই বছর পরপরই ফসল দিতে থাকে। দারুচিনি গাছ কম করে ১০-১৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। তাই একে নিয়মিত করে ছোট রাখতে হবে। পাঁচ বছর বয়সী দারুচিনি গাছ থেকে নিয়মিত দারুচিনি সংগ্রহের ডাল পাওয়া সম্ভব। দারুচিনি ব্যবহার করার জন্য যে শাখাগুলি কাটা হবে সেগুলি থেকে বাকল তুলে নিতে হবে, বাকলগুলি ব্যবহার করার আগে জলে ভালোভাবে ভিজিয়ে নেওয়া উচিত।

সম্পূর্ণ খবরটি পড়ুন

আঙিনা কৃষি

টবে লাগান মিষ্টি তেঁতুল গাছ

পৃথিবীতে জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, হারিয়ে যাচ্ছে বহু প্রাণী ও উদ্ভিদ বৈচিত্র। চাষবাসের জমিরও সংকুলান ঘটছে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে। গগনচুম্বী বাড়ি ঘিরে ফেলছে সমস্ত ফাঁকা জমিন। শখ করে মানুষ খোলা জায়গায় যে গাছ লাগবে অথবা ফল-ফুলের চারা সেই উপায়ও আর নেই। গাছ লাগানোর জন্য সামান্য জায়গাও ফাঁকা থাকছে না আর। তবে আমাদের করণীয় কী? বৃক্ষরোপন কি তবে অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে। বেঁচে থাকার জন্য তো গাছ লাগাতে হবেই। বাড়ির একটুকরো বারান্দা অথবা ব্যালকনিতেও সুন্দর ভাবে ইচ্ছা করলে গাছ লাগানো যায়। বাড়ির ছাদেও বানানো যায় সুন্দর বাগিচা। শহরের মানুষদের জন্য ছাদ বাগানের কোনও বিকল্পও নেই। বাড়ির মধ্যেকার ব্যালকনি অথবা ছাদের একটুকরো জমিতেও, ইচ্ছা করলে টবে চাষ করা যায় বিভিন্ন ফুলের ও ফলের গাছ।

শাকসবজি, পেয়ারা, লেবু প্রভৃতি দেশীয় গাছ টবে বাড়তে দেওয়া থেকে শুরু করে বর্তমানে বহু বিদেশী গাছের চারাও মানুষ ব্যালকনি অথবা ছাদে চাষ করছেন। তার মধ্যে থাই মিষ্টি তেঁতুল টবের চাষ পদ্ধতি হিসাবে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। প্রথমত মিষ্টি তেঁতুলের চাষ করতে গেলে, নার্সারি থেকে এই বিশেষ তেঁতুলের সঠিক বীজ নিয়ে আনতে হবে। তবে থাই মিষ্টি তেঁতুলের কলম পাওয়া একটু দুষ্কর কাজ। বুঝে সঠিক চারা নিয়ে আসা বাগান মালিকের উপরেই বর্তায়।

থাই মিষ্টি তেঁতুলের ফুল থেকে ফল ধরতে প্রায় ৭ মাস সময় লাগে। বছরে দু’বার থাই মিষ্টি তেঁতুলের গাছে ফল ধরে। প্রথমবার বর্ষাকালে এবং দ্বিতীয়বার শীতকালে। এই গাছের পরিচর্যা আলাদা করে করার কোনও দরকার পড়ে না। গাছের যত্নআত্তি নিতে হয় ঠিকই, কিন্তু তা বলে, আলাদা করে কোনও বিশেষ যত্ন নিতে হয় না।

গাছ লাগানোর পদ্ধতি (Planting):

থাই মিষ্টি তেঁতুল চাষের জন্য আদর্শ মাটি হল, দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি। এই দু’টি মৃত্তিকার মধ্যে যে কোনও একটি বেছে নিন। তারপর বেছে নেওয়া মাটির দুই ভাগ অংশের সাথে গোবর, ১০০ গ্রাম, টিএসপি ১০০ গ্রাম, পটাশ, ২৫০ গ্রাম, হাড়ের গুঁড়ো এবং ৫০ গ্রাম সরিষার খোল একসঙ্গে মিশিয়ে ২০ ইঞ্চি মাপের বড় টবে জল মিশিয়ে রেখে দিতে হবে। ১০ থেকে ১২ দিন পর টবের মাটি ভালো করে খুঁচিয়ে দিয়ে আরও ৪-৫ দিন রেখে দিতে হবে। ৪ থেকে ৫ দিন বাদে মিষ্টি তেঁতুলের একটি ভালো চারা ওই টবে লাগান।

পরিচর্যা(Caring):

চারা লাগানোর প্রথম কয়েক মাস তেমন যত্নের দরকার পড়বে না। অবশ্যই গাছে এই সময়টুকু পর্যাপ্ত জলের যোগান, এবং আগাছা পরিষ্কারের কাজ করতে হবে।  ছয় মাস চারা লাগানোর সময়সীমা ফুরোলেই ১ মাস বাদে বাদে গাছে সরষের খোল মিশ্রিত পচা জল দিতে হবে। মনে রাখতে  হবে খোল দেওয়ার আগে গাছের মাটি খুঁচিয়ে নিতে হবে।

রোগ দমন (Disease management):

সাধারণত থাই মিষ্টি তেঁতুল গাছে পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা যায় না। কিন্তু বর্ষাকালে অনেক সময় তেঁতুল গাছে ছত্রাক হানা দেয়। এর ফলে তেঁতুল ফেটে যায়। এই অসুবিধার থেকে গাছকে বাঁচাতে হলে, বর্ষাকাল আসার আগেই ভালো ছত্রাকনাশক ওষুধ ১০ দিন অন্তর গাছে স্প্রে করে ছড়িয়ে দিতে হবে।

বাংলার বেজায় টক তেঁতুলের সঙ্গে থাই মিষ্টি তেঁতুলের কোনও তুলনাই চলে না। অত্যন্ত মিষ্টি খেতে এই তেঁতুল থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় চাষ প্রভূত পরিমাণে হলেও, আমাদের রাজ্য এই ফলের চাষ এখনও ততটা গতি পায়নি। কিন্তু আপনি আপনার ব্যালকনি অথবা ছাদে সহজেই এই থাই তেঁতুলের গাছ লাগাতে পারেন।

সম্পূর্ণ খবরটি পড়ুন
বিজ্ঞাপন

শীর্ষ সংবাদ

সম্পাদক ও প্রকাশক: শাইখ সিরাজ
© ২০২১ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। দা এগ্রো নিউজ, ফিশ এক্সপার্ট লিমিটেডের দ্বারা পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। ৫১/এ/৩ পশ্চিম রাজাবাজার, পান্থাপথ, ঢাকা -১২০৫
ফোন: ০১৭১২-৭৪২২১৭
ইমেইল: info@agronewstoday.com, theagronewsbd@gmail.com