পরিবেশ
গাছপালা, কেঁচো, মৌমাছি, মাছ থেকেও কি মহামারি, অতিমারির দিন এসে গেল
লেখক
আনন্দবাজারসেই ভয়ঙ্কর দিন আর খুব বেশি দূরে নেই। শুধুই শিম্পাঞ্জি, শুয়োর, বাদুড় বা প্যাঙ্গোলিন নয়। এমন দিনও আসছে, যখন আশপাশের গাছপালা আর অসংখ্য অমেরুদণ্ডী প্রাণীর থেকেও লক্ষ কোটি ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক ঝাঁপিয়ে পড়বে আমাদের উপর। তাদের সংক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে যাবে মানুষের জীবন, যাপন। হবে একের পর এক মহামারি। উপর্যুপরি অতিমারিও। ঠিক যেমনটা বর্তমানে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।
যাদের থেকে মহামারি, অতিমারির কথা কল্পনাও করতে পারেন না সাধারণ মানুষ সেই কেঁচো, মৌমাছি বা নানা ধরনের মাছের থেকেও একের পর এক ছড়িয়ে পড়বে বহু অজানা-অচেনা ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ও ছত্রাক।
বিজ্ঞানীদের অনুমান, আর কয়েক দশকের মধ্যেই ১০ লক্ষ বা তারও বেশি সংখ্যায় বিভিন্ন প্রজাতির জীব পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পৃথিবী থেকে একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষ তো দূর অস্ত, এটা বেশি দিন আগে বিজ্ঞানীদেরও জানা ছিল না। কয়েক বছর আগে এই উদ্বেগজনক তথ্যের হদিশ মিলেছে।
এই ছোট ছোট জীবগুলি বহু কোটি ভাইরাসের আধার। যে মুহূর্তে এই আধারগুলি ধ্বংস হয়ে যাবে, তখনই সেই সব ভাইরাস বেরিয়ে পড়বে নতুন আধারের সন্ধানে। সেই নতুন আধার হতেই পারে মানবদেহ। যথেচ্ছ বন কেটে বসত বানানোর উৎসাহের জন্য তো মানুষকেই বেশি কাছে পাচ্ছে নতুন নতুন আধার খোঁজা অসংখ্য ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া আর ছত্রাক।
উদ্ভিদের ভাইরাস মানুষের অন্ত্রে!
কয়েক বছর আগে সিঙ্গাপুরের জিনোম ইনস্টিটিউট আর আমেরিকার সান ডিয়েগোর স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল বিজ্ঞানী মানুষের অন্ত্রে কী কী ভাইরাস থাকে, তার পরীক্ষা করতে গিয়ে চমকে যান। তাঁরা দেখেন, মানুষের অন্ত্রে রয়েছে অন্তত ৩৫ রকমের এমন সব ভাইরাস, যাদের আদত ‘ঠিকানা’ বিভিন্ন উদ্ভিদের দেহ! বিজ্ঞানীরা দেখেন, উদ্ভিদের দেহের চেনা মুলুক ছেড়ে এসেও ওই সব ভাইরাস মানুষের দেহে বেঁচেবর্তে আছে। নিজেদের বংশবৃদ্ধি করে যাচ্ছে।
গবেষণায় দেখা যায়, বিভিন্ন উদ্ভিদের দেহ থেকে এসে মানুষের অন্ত্রে ঘাঁটি গাড়া ভাইরাসগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আছে ‘পিপার মাইল্ড মট্ল ভাইরাস’। এই ভাইরাস ক্যাপসিকাম গাছের নানা রোগের কারণ হয়। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মানুষের এক গ্রাম ওজনের মলে এই ভাইরাসের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি! দেখা যায়, যে মানুষের দেহে এই ভাইরাসের সংখ্যা বেশি তাঁদের মধ্যে জ্বর, পেটব্যথা, চুলকানির প্রাদুর্ভাবও বেশি।
অমেরুদণ্ডী থেকেও ভাইরাস আসছে মেরুদণ্ডী প্রাণীতে
বহু দিন ধরে আমাদের ধারণা ছিল উদ্ভিদ থেকে প্রাণীতে বা কোনও অমেরুদণ্ডী প্রাণী থেকে মেরুদণ্ডী প্রাণীতে ভাইরাস ‘উপচে পড়তে’ পারে না। কিন্তু গত কয়েক বছরের গবেষণায় আমাদের এই ধারণা ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে। মানুষের দেহে যেমন উদ্ভিদ ভাইরাসের দেখা মিলেছে, তেমনই বাদুড়ের রক্তে ৫ রকমের পতঙ্গ ভাইরাসের হদিশ মিলেছে।
আবার টম্যাটো গাছের ‘ইয়েলো লিফ কার্ল ভাইরাস’-কে দেখা গিয়েছে ‘টোব্যাকো হোয়াট ফ্লাই’ নামে একটি পতঙ্গের দেহে বংশবিস্তার করতে। খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটাতে।
দুই লেখক। অধ্যাপক অরুণাভ গোস্বামী (বাঁ দিকে) এবং অধ্যাপক সংগ্রাম বাগ।
গ্রাফিক- নিরূপম পাল।
বহু যুগ আগে গ্রিসের নগররাষ্ট্র আথেন্স এক অজানা মহামারির কবলে পড়ে। তাতে বহু লোকের মৃত্যু হয়। এর বর্ণনা রয়েছে তৎকালীন আথেন্সের বাসিন্দা গ্রিক ইতিহাসবিদ থুকিডিটিসের লেখায়। যিনি নিজেও ওই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। থুকিডিটিসের লেখায় বর্ণিত রোগের লক্ষণগুলি বিশ্লেষণ করে এখনকার বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করেন, গ্রিসের সেই সময়ের মহামারির কারণ ছিল ইবোলা ভাইরাস। সে দিনের আথেন্স থেকে বহু শতাব্দী আর বহু যোজন দূরে ১৯৯৬ সালে আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর গাবনে ইভিন্ডো নদীর পাশে গভীর জঙ্গলে একটা গ্রামের কয়েক জন মানুষ একটা শিম্পাঞ্জি শিকার করে খান। তার কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁদের প্রায় ৯০ শতাংশ এক অজানা রোগে মারা যান। আমরা এখন নিশ্চিত ভাবে জানি ওই অজানা রোগের কারণ ছিল ইবোলা ভাইরাস।
গ্রিকসভ্যতার সময় থেকে শুরু করে এখনকার সময় পর্যন্ত মানবসভ্যতা বহু মহামারির কবলে পড়েছে। কিন্তু গত কয়েক দশকে সভ্যতার উপর মহামারির আঘাত অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছে।
দায়ী মানুষের লোভ, আগ্রাসী মনোভাব
মানুষই এর এক ও একমাত্র কারণ। যথেচ্ছ বন্যপ্রাণী মেরে কেটে খাওয়া, তাদের দেহাবশেষের অবাধ ব্যবহার ও ব্যবসা আর নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলকে নির্মূল করে দেওয়া। এর ফলে, বন্যজীবন আর মানুষের মধ্যে যে অদৃশ্য দেওয়াল আছে, তা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। আর বন্যপ্রাণীদের মধ্যে থাকা বিভিন্ন ভাইরাস মানবশরীরকে নিজেদের আশ্রয় হিসাবে পরখ করে দেখার সুযোগ পাচ্ছে।
এইচআইভি, ইবোলা, জিকা, নীপা, সার্স, এভিয়ান ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু-র মতো যে মারণ ভাইরাসগুলি গত ৫০ বছরে এসেছে বা ‘উপচে পড়েছে’, তার সবক’টিই এসেছে বাদুড়, শিম্পাঞ্জি, প্যাঙ্গোলিন, বন্য শুয়োর, বন্য পাখির মতো বিভিন্ন বন্যপ্রাণী থেকে।
বাদুড়, শিম্পাঞ্জি, প্যাঙ্গোলিন, বা শুয়োর— এরা সকলেই স্তন্যপায়ী। আর পাখি স্তন্যপায়ী না হলেও বিবর্তনে মানুষের কাছাকাছি থাকা একটি প্রাণী। তাই এদের কোষের সঙ্গে মানবদেহের কোষের জৈব রসায়নের মিল অনেকটাই। ফলে এই বন্যপ্রাণীদের থেকে মানুষের মধ্যে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়াটা তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই সহজ। খুব সম্ভবত এই ভাবেই ‘সার্স-কভ-২’-ও এসেছে বাদুড় বা প্যাঙ্গোলিন, অথবা দু’টো থেকেই।
খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে ভাইরাস।
ছবি- লেখকদের সৌজন্যে।
কিন্তু এর বাইরেও একটা সত্য আছে। হয়তো বা সেটা ভয়ঙ্কর সত্য। আমাদের বন্যপ্রাণী রক্ষার স্লোগানে স্তন্যপায়ী এবং বড় প্রাণীদের (যেমন-বাঘ, বাদুড়, কুমির, পাখি, মাছ) উপস্থিতিই বেশি চোখে পড়ে। এই ধরনের প্রাণী আমাদের জীববৈচিত্রের মাত্র ০.৪ শতাংশ। এর বাইরে লক্ষ লক্ষ ছোট ছোট প্রাণী কীটপতঙ্গ, কেঁচোজাতীয় প্রাণী রয়েছে, যারা বন-জঙ্গল নির্মূল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এরা আমাদের জীববৈচিত্রের ৮০ শতাংশ।
মথ, ফড়িং, মৌমাছি থেকেও হতে পারে মহামারি!
তবে এটাই আতঙ্কের একমাত্র কারণ নয়। বাস্তুচ্যুত, নতুন নতুন আধার খোঁজা কোটি কোটি ভাইরাস বাস্তুতন্ত্র এবং অর্থনীতিতে প্রভাবশালী ছোট ছোট প্রাণীদের ( যেমন, মৌমাছি, মথ, ফড়িং) মধ্যেও মহামারি সৃষ্টি করতে পারে।
আমাদের চাষবাসের অনেকটাই নির্ভর করে পতঙ্গদের দ্বারা পরাগ মিলনের উপর। বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের প্রতি ৩ গ্রাস খাবারের ১ গ্রাস এই পতঙ্গদের দান। একটি গণনা দেখিয়েছে, আমেরিকার কৃষিকাজে প্রতি বছর মৌমাছির অবদান ১০০ থেকে ২০০ কোটি টাকা। এখন মৌমাছির সংখ্যা কমে যাওয়ায় আমেরিকায় কাঠবাদাম চাষের খরচ ৩ গুণ বেড়ে গিয়েছে।
আমরা যখন কোভিড অতিমারির মোকাবিলা করছি, ঠিক সেই সময়েই মৌমাছিরা আক্রান্ত অন্য এক মহামারিতে। ইউরোপ, কানাডা আর কেনিয়ায় পালিত মৌমাছিদের মধ্যে ‘নোসমা’ নামে এক পরজীবী ছত্রাক ছড়িয়ে পড়েছে। যার জন্য এই পালিত মৌমাছিরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এমনকি, তাদের শুক্রাণুর সংখ্যাও দ্রুত কমে যাচ্ছে। এই পালিত মৌমাছিরা ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহ করে বেড়ায়। সেই ফুলেই বন্য মৌমাছি বসলে বন্য মৌমাছির দেহেও ‘নোসমা’ উপচে পড়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। বন্যজীবন আর মানুষের ভিতরের দেওয়াল কী ভাবে ভেঙে পড়ে, এটা তার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
‘নোসমা’ যদি ধীরে ধীরে ২০ হাজার প্রজাতির বন্য মৌমাছির দেহে উপচে পড়ে, তা হলে বাস্তুতন্ত্র আর মানুষের উপর তার কী ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়তে পারে সেটা ভেবে বিজ্ঞানীরা সন্ত্রস্ত।
বন্যজীবন আর মানুষের ভিতরের অদৃশ্য দেওয়ালগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হলে শুধু ভাইরাসই উপচে পড়ে তা নয়; নতুন নতুন ব্যাক্টেরিয়া ও ছত্রাকও উপচে পড়বে। আর তার ফলে অজানা সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যাবে কয়েক গুণ।
মানব দেহের কোষকে আক্রমণ করছে ব্যাক্টেরিয়া।
ছবি- লেখকদের সৌজন্যে।
বিবর্তনেরও নির্দিষ্ট দিক থাকে
বহু দশক ধরেই এটা আমাদের জানা ছিল, জীবজগতে বিবর্তনের কোনও নির্দিষ্ট অভিমুখ নেই। ১৯৮৮ সালে বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী দেখান, বিবর্তনের নির্দিষ্ট দিক থাকতে পারে। কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়লে সেই প্রতিকূলতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ব্যাক্টেরিয়া জিনোমের কোষ বিভাজন বা মিউটেশন ঘটায়। তার মধ্যে কোনও কোনও মিউটেশন ব্যাক্টেরিয়াকে সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। একে বলা হয়, ‘অ্যাডাপ্টিভ মিউটেশন’।
উন্নত জীবে ‘অ্যাডাপ্টিভ মিউটেশন’-এর কোনও প্রমাণ এখনও পর্যন্ত আমাদের হাতে নেই। কিন্তু ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষেত্রে এটা প্রমাণিত সত্য।
ভয়টা এখানেই। বন্যজীবন থেকে উপচে পড়া, নতুন নতুন আধার খোঁজা ব্যাক্টেরিয়ায় ‘অ্যাডাপ্টিভ মিউটেশন’ মানুষের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
নাসার ক্লিন রুম-এও ব্যাক্টেরিয়ার দাপাদাপি!
বিবর্তনের এই শক্তি মানুষের পক্ষে যে কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, তার একটা সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত মিলেছে নাসার একটি কাজে। যে কোনও মহাকাশ সংস্থায় মহাকাশযান, কৃত্রিম উপগ্রহ আর তাদের বিভিন্ন অংশকে জোড়া দেওয়ার কাজটা করা হয় বিশেষ ভাবে তৈরি ‘ক্লিন রুম’-এ। এই ক্লিন রুম এমন ভাবে তৈরি আর পরিচালনা করা হয়, যাতে কোনও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধুলিকণা, ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়াও সেখানে না থাকতে পারে। যে সব বিজ্ঞানী আর ইঞ্জিনিয়ার ক্লিন রুমে কাজ করেন, তাঁরা সব সময় কোভিড যোদ্ধাদের ‘পিপিই’র মতো পোশাক পরে থাকেন। যাতে মানুষের দেহের ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া এবং বিভিন্ন কোষ-কণা ক্লিন রুমকে ‘সংক্রমিত’ করতে না পারে। এত কিছু করার পরেও এই ক্লিন রুমকে খুব শক্তিশালী জীবাণুনাশক দিয়ে বার বার পরিষ্কার করা হয়।
অথচ কী আশ্চর্য, নাসার ক্লিন রুম পরিষ্কার করার জীবাণুনাশকের মধ্যেই বেশ কয়েক ধরনের ব্যাক্টেরিয়া পাওয়া গিয়েছে। যাদের মধ্যে ‘অ্যাসিনেটোব্যাক্টেরিয়া’ নামে এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। এই অ্যাসিনেটোব্যাক্টেরিয়া সাধারণ ভাবে জলে বা মাটিতে থাকে। যেটা আরও অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা তা হল; এই ব্যাক্টেরিয়া শুধু ওই জীবাণুনাশকের মধ্যে বেঁচেই থাকে না, ওই জীবাণুনাশক খেয়েই বেঁচে থাকে!
শেষের সে দিন বড়ই ভয়ঙ্কর
প্রকৃতির নিয়মগুলিকে একটু একটু করে ভাঙতে গিয়ে আমরা এখন জীবন আর বিবর্তনের শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে ফেলেছি। যা খুব সহজেই আমাদের বেঁচে থাকাকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে। তার প্রমাণ আমরা শেষ ক’বছরে পর পর পেয়েছি- ইবোলা, নীপা, কোভিড…।
তাই যত দিন না এই অদৃশ্য দেওয়ালগুলি আবার গড়ে উঠবে, নতুন নতুন রোগ বা একই রোগের ভিন্ন মারণ রূপ শুধু মানুষকেই আক্রমণ করবে না, মানুষের অস্তিত্ব ও অর্থনীতি যে সব প্রাণীদের উপর নির্ভরশীল, তাদেরও আক্রমণ করতে পারে। সেটা যাতে না হয়, তার জন্য এখন দরকার প্রকৃতি, জীবন আর বিবর্তনের শক্তিকে নতমস্তকে স্বীকার করে, বন্যজীবন আর মানবজীবনের অদৃশ্য দেওয়ালের ক্ষতগুলিকে সারিয়ে তোলা। না হলে, শেষের সে দিন খুবই ভয়ঙ্কর। হয়তো বা সেই দিন এসেও পড়বে খুব তাড়াতাড়ি।
-
গাছপালা, কেঁচো, মৌমাছি, মাছ থেকেও কি মহামারি, অতিমারির দিন এসে গেল
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
ছাদ বাগানের জন্য কয়েকটি টিপস
-
নিরাপদ খাদ্য: দেশি মাছ কাকিলাকে যেভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা
-
বাংলাদেশে বাড়ছে ইলিশ, মিয়ানমারে কেন কমছে – দা এগ্রো নিউজ
-
নিপাহ্ ভাইরাসঃ খেজুরের রস খাওয়ার আগে সতর্ক থাকতে যা করণীয়
-
ইলিশ কি মিঠা পানির মাছ হয়ে যাচ্ছে? – দা এগ্রো নিউজ
-
কই মাছে বাঁধাকপির ছেঁচকি – দা এগ্রো নিউজ
-
বাংলাদেশে ‘প্রায় বিলুপ্তি’র পথে ১০০-এর বেশি দেশীয় মাছ – দা এগ্রো নিউজ
-
ধনেপাতা ও টমেটোয় শোল মাছ – দা এগ্রো নিউজ
-
লাউ টাকি – দা এগ্রো নিউজ
-
বাঁধাকপির পাতায় চিংড়ি – দা এগ্রো নিউজ
ছাদ বাগানীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। টবে, ড্রামে গাছ লাগানো হয়। কেউ ফল, কেউবা সবজির গাছ লাগান। কেউ সফল হন। কেউ সফল হন না। ছোট ছোট কিছু ভুল বাগানীরা করে থাকেন। সে কারণে যত্ন নিলেও ফল আসে না। এখানে ছাদ বাগানীদের জন্য কিছু টিপস দেয়া হলো, যা মানলে সফলতা পাওয়া সহজ হতে পারে।
প্রথমেই মনে রাখতে হবে, টবে বা ড্রামে গাছ লাগালে তাকে খাবার দিতে হবে। প্রকৃতিতে বিদ্যমান গাছের মতো সে খাবার সংগ্রহ করতে পারে না। রোগ-বালাই হলো কিনা সেটাও বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে।
১. মাটির সাথে অবশ্যই কিছু কোকোপিট মেশাবেন। গাছের গোড়া স্যাতস্যাতে হতে দিবেন না। স্যাতস্যাতে হলে অসংখ্য রোগ হবে। মাটি ভেজা থাকবে তবে স্যাতস্যাতে না। কেকোপিট মেশালে পানি কম দিলেও হবে। কোকোপিট (নারকেলের ছোবলার গুড়া) পানি ধরে রাখে। অতি বৃষ্টি হলে গোড়ায় পানি জমতে দেয় না। হালকা হওয়ায় ছাদে ওজনের চাপ পড়ে না। এছাড়া কোকোপিটে কিছু পুষ্টি উপাদান আছে। যা গাছের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কোকোপিটে চারা দ্রুত গজায়, বড় হয়। মাটির চেয়ে কোকোপিটে চারা ভালো হয়।
২. গাছের জন্য বিরিয়ানি হলো সরিষার খৈল-পচা পানি। মাটির হাড়িতে খৈল পচাতে হবে। কমপক্ষে ৫ দিন। ৭ দিন কিংবা বা ১৫ দিন হলে উত্তম। অল্প পানিতে পচিয়ে তার সাথে আরো পানি মিশিয়ে দিতে হবে। এটি গাছের জন্য অত্যন্ত উপকারী। একটু গন্ধ হয়, তাই অল্প একটু গুড় দিতে পারেন। ছাদে হাড়িতে পচালে বাসায় গন্ধ আসবে না। বৃষ্টির সময় খৈল-পচা পানি দেবেন না। পুকুরের নিচে থাকা পাক কাদা গাছের জন্য খুব উপকারী।
৩. আমরা জানি, মাটিতে অসংখ্য ক্ষতিকর ছত্রাক থাকে। যা গাছকে মেরে ফেলার জন্য যথেস্ট। তাই মাটি রেডি করার সময় কিছুটা বায়োডামা সলিট দিবেন। এটি উপকারী ছত্রাক। মাটিতে ক্ষতিকারক উপাদানগুলো মেরে ফেলে। আবার জৈব সারের কাজও করে। গাছের জন্য মাটি হবে ঝুরঝুরে, হালকা।
৪. যাই লাগান না কেন, ভালো জাতের বীজ কিনা নিশ্চিত হয়ে নেবেন। ভালো বীজে ভালো ফসল হবে। নতুবা যতই যত্ন নেন না কেন, সব পরিশ্রম বেলাশেষে জলে যাবে। বীজ থেকে নিজে চারা করা উত্তম। কারণ বাজার থেকে যে চারা কিনবেন সেটার জাত ভালো হবে সে নিশ্চয়তা কোথায়? ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে নেয়া উত্তম। পদ্ধতি হলো- ছত্রাকনাশক দেয়া পানিতে কিছুটা সময় বীজ ভিজিয়ে রাখতে হবে। ম্যানসার, মেটারিল দুটি ছত্রাকনাশক।
৫. গাছ বেশি তো ফলন বেশি- এটি ভুল ধারণা। অল্প জায়গায় বেশি গাছ লাগানো যাবে না। গাছ পাতলা করে লাগাতে হবে। বেশি লাগালে গাছ প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাবে না। একটি ফলের ক্রেটে মাত্র দুটি গাছ। একটি টবে একটি গাছ। ক্রেট বা টবে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৬. ছাদে মাচা দেয়া সমস্যা। কারণ ঘুঁটি থাকে না। এ জন্য ফলের ক্রেটের চারপাশে লাঠি বেঁধে সহজে মাচা দেয়া যায়। লতাপাতা জাতীয় গাছ লাগানোর পাত্র একটু গভীর হলে উত্তম। গাছের জন্য সবচেয়ে বেশি ভালো জৈব সার হলো পাতা-পচা সার, তারপর ভার্মি কম্পোস্ট, তারপর গোবর সার। পাতা-পচা সার সহজলভ্য নয়। দাম বেশি। কিন্তু ভার্মি কম্পোস্ট সহজলভ্য। মাটির সঙ্গে মিনিমাম ৪০% জৈব সার দেয়া উত্তম।
৭. নিম কীটনাশককে ক্ষতিকারক পোকা-মাকড় খুব অপছন্দ করে। এটি দিলে তারা বিরক্ত বোধ করে। গাছে বাসা বাঁধতে পারে না। প্রতি সাত দিনে একবার সব গাছের পাতায় নিম কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। মাসে একবার ইপসম সল্ট স্প্রে করে দেয়া উত্তম। একইভাবে মাসে একবার পানির সঙ্গে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড মিশিয়ে স্প্রে করা ভালো।
৮. ডাটা, পুইশাক, লালশাক, ধনেপাতা এসব লাগাতে পারেন। মাত্র ২৫ দিনে খেতে পারবেন। লালশাক লাগালে নেট দিয়ে ঘিরে দেবেন। শাকপাতা লাগালে দ্রুত আউটপুট পাবেন। যা আপনাকে প্রেরণা দেবে। পুইশাক গাছের পাতায় দাগ হলে পাতা কেটে দিন। অথবা ছত্রাকনাশক স্প্রে করেন। অথবা গাছ উঠিয়ে আবার লাগান। ইউরিয়া সার দিলে পুইশাক দ্রুত বাড়বে। শশা গাছের বৃদ্বির জন্য ডিএপি সার দিলে ভালো হবে। শশা গাছে ছাড়া ছাড়া ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়। খুব রোদ, গাছের গোড়ায় মালচিং করে দিয়ে উত্তম ফল মিলবে। মালচিং হলো গাছের গোড়ায় বিশেষ পলিথিন কিংবা শুকনো পাতা, খড় দিয়ে ঢেকে দেয়া।
৯. ফুল আসার পরে প্রানোফিক্স অথবা মিরাকুরান গাছের পাতায় শেষ বিকালে স্প্রে করবেন। বাসায় দুইটি গ্রুপের ছত্রাকনাশক রাখা ভালো। যেমন- ম্যানসার, মেটারিল। ১৫ দিনে একবার স্প্রে করবেন। এগরোমিন্ড গোল্ড অনুখাদ্য বা অন্য কোনো অনুখাদ্য বাসায় রাখতে হবে। মাসে কমপক্ষে একবার স্প্রে করবেন। অতিরিক্ত গরম, বৃষ্টি, খাদ্যের অভাব, গাছ রোগাক্রান্ত, আবহাওয়া দ্রুত আপডাউন করা ইত্যাদি কারণে ফুল ঝরে পড়তে পারে। আবার পরাগায়ন না হলে ঝরে পড়তে পারে। এ জন্য হাতের মাধ্যমে পরাগায়ন করতে হবে। পুরুষ ফুলের পরাগদণ্ড নারী ফুলে গর্ভে ঘষে দিতে হবে।
১০. ছাদ বাগানে গাছ মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ পানি বেশি বা কম দেয়া। যতটুকু লাগে ঠিক ততটুকু পানি দিতে হবে। কোন গাছের কি চাহিদা, রোগ একটু স্টাডি করলে সহজে সফল হতে পারবেন।
১১. গাছের পাতার নিচে খেয়াল করবেন। বেগুন গাছের পোকা মারার জন্য সেক্স ফোরেমান ফাঁদ লাগাবেন। ডগা ছিদ্র বা ফল ছিদ্র হলে সাইপারমেত্রিন গ্রুপের কীটনাশক দিতে হবে। একটি বেগুন গাছ অনেক দিন ফল দেয়। ঢেড়স গাছ বেশি রোদ পড়ে এমন জায়গায় লাগাবেন। বেগুন, ঢেড়স, লালশাক, পুইশাক, ধনেপাতা, ডাটা শাক- এসব গাছের খুব যত্ন করতে হয় না।
১২. রসুন আর লবঙ্গ বেটে সেই পানি গাছে স্প্রে করলে পোকা কম আসবে। মরিচ গাছে নেপথলিন বেঁধে দিন, পোকা কম আসবে। পাতা কোকড়ালে ভার্মিটেক কিংবা এবোম কীটনাশক দিন। কোকড়ানো পাতা ফেলে দিন। মরিচ গাছে দশ দিন পর পর ডায়মেথট গ্রুপের (যেমন টাফগর) কীটনাশক দিলে উপকার হবে। সবকিছু করছেন, তারপরও কাজ হচ্ছে না। এক্ষেত্রে গাছের জায়গা বদল করেন, উঠিয়ে অন্যত্র লাগান।
শীতকাল এলেই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে খেজুরের রস খাওয়ার চল বেড়ে যায়। অনেকে গাছ থেকে খেজুরের কলসি নামিয়ে সরাসরি কাঁচা রস খেয়ে থাকেন।
আবার অনেকে এই রস চুলায় ফুটিয়ে সিরাপ, পায়েস বা ক্ষীর বানিয়ে খান। এছাড়া রসের তৈরি ঝোলা গুড়, পাটালি গুড়, নলেন গুড়, ভেলি গুড়, বালুয়া গুড়, মিছরি গুড়সহ নানা ধরণের পিঠার বেশ সুখ্যাতি রয়েছে।
নিপাহ্ ভাইরাস আতঙ্ক
খেজুর আরব দেশের প্রচলিত ফল হলেও ওইসব দেশে খেজুর, মূলত ফল উৎপাদননির্ভর, যেখানে কিনা বাংলাদেশের খেজুর গাছ রস উৎপাদননির্ভর।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের মতে, বাংলাদেশে সাধারণত কার্তিক থেকে মাঘ অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত খেজুরের রস সংগ্রহ হয়ে থাকে।
দেশটির সবচেয়ে বেশি রস সংগ্রহ হয় যশোর, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর অঞ্চল থেকে।
মূলত খেজুর গাছের ডালপালা পরিষ্কার করে, ডগার দিকের কাণ্ড চেঁছে তাতে একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি চোঙ বসিয়ে দেয়া হয়। চোঙের শেষ প্রান্তে ঝুলিয়ে দেয়া হয় একটি মাটির হাড়ি বা কলসি।
সেই চোঙ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রস এসে জমা হতে থাকে মাটির হাড়ি বা কলসিতে। এভাবে একটি গাছ থেকে দৈনিক গড়ে পাঁচ থেকে ছয় লিটার রস সংগ্রহ করা যায় বলে কৃষি তথ্য সার্ভিস সূত্রে জানা গিয়েছে।
কিন্তু গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই খেজুরের রস খাওয়ার ক্ষেত্রে নিপাহ্ ভাইরাস আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
দেশের বিভিন্ন রাজ্যেই বর্ষার (Monsoon 2021) প্রভাবে চলছে বৃষ্টিপাত। এসময় কৃষকেরা খারিফ শস্য (Kharif Crops) বপনে তৎপর হয়ে ওঠেন। এই খরিফ মরসুমে কৃষকভাইরা সাধারণত অঞ্চলভেদে ধান, অড়হর, সোয়াবিন সহ বিভিন্ন চাষে মনযোগ দিয়ে থাকেন ৷ তবে এসব ছাড়াও, ঔষধি গুন সমৃদ্ধ (Medicinal Crops) গাছ চাষে বর্ষায় যে কতটা লাভ হতে পারে সে সম্পর্কে অনেকেই হয়তো জানেন না৷
বিশেষ করে বর্ষাকালেই এমন বহু ঔষধি গুন সম্পন্ন গাছ রয়েছে যাদের চাষ হতে পারে লাভজনক৷
বর্ষাকালে কোন কোন ঔষধি উদ্ভিদের চাষ করা যেতে পারে অথবা এই চাষ কীভাবেই বা করা যাবে সে বিষয়ে সঠিক তথ্য না পাওয়ার কারণেই অনেকের কাছে বিষয়টি অধরা৷ চলুন এই প্রতিবেদনে এমনই কিছু গাছ নিয়ে আলোচনা করা যাক যা কৃষকদের জন্য হতে পারে লাভদায়ক৷ তবে সঠিক সময়ে, সঠিক রোপন, সেচ, কীটনাশক দেওয়ার প্রয়োজন এগুলিতে, না হলে এর ওপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে৷
অশ্বগন্ধা –
বর্ষায় এর চাষ ভালো৷ জুন থেকে অগস্ট পর্যন্ত এর চাষ করতে পারেন৷ এর বিভিন্ন জাত রয়েছে৷ উন্নত মানের গাছের চাষে কৃষকের লাভের পরিমাণও বৃদ্ধি পেতে পারে৷ উল্লেখ্য, প্রতি হেক্টরে ৫ কিলোগ্রাম বীজ ব্যবস্থা করতে হবে৷ যদি কেউ ১ হেক্টর জমিতে অশ্বগন্ধার চাষ করতে চায় তাহলে তাকে প্রায় ৫০০ বর্গমিটারে নার্সারি তৈরি করতে হবে৷ প্রায় ১ সেন্টিমিটার গভীরে বীজ বপন করতে হবে৷
শতমূলী –
শীত বাদ দিয়ে বছরের যে কোনও সময়ে এই গাছের চাষ করতে পারেন৷ বর্ষাকালে এই চারা রোপন করলে সহজেই তা বেড়ে উঠতে থাকে৷ তবে বীজ বপনের আগে বীজ ১ দিন পর্যন্ত হালকা গরম জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়৷
যষ্টিমধু –
জুলাই থেকে অগস্ট পর্যন্ত এর চাষ করা হয়৷ আর তাই জুন থেকেই এর প্রস্তুতি শুরু করে দেন কৃষকেরা৷ জলনিকাশি ব্যবস্থা উচ্চমানের হওয়া প্রয়োজন এই গাছ চাষের জন্য৷ মনে রাখতে হবে এর চাষের আগে জমিতে কমপক্ষে ১৫ টন গোবর সার দেওয়া প্রয়োজন, এরপরেই এটি চাষ করা উচিত৷
ঘৃতকুমারী –
এর ভালো উৎপাদনের জন্য জলনিকাশি ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে৷ এই ধরনের ঔষধি গুনসম্পন্ন গাছ শীতকাল বাদ দিয়ে যে কোনও সময় চাষ করতে পারেন৷ বর্ষাকালে দূরত্ব রেখে বীজ বপন করতে হবে৷ কম সময়ের মধ্যেই ব্যবহারোপযোগী হয়ে ওঠে এগুলি৷
অগ্নিশিখা বা কলিহারি –
এটি চাষের জন্য কৃষকেরা জুন মাসেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন৷ জুলাইয়ে ভালো বৃষ্টিতে এর চাষ শুরু করা যেতে পারে৷ উল্লেখ্য, ১ হেক্টর জমির জন্য প্রায় ১০ ক্যুইন্টাল কন্দের প্রয়োজন৷ এটি চাষের আগেও জমিতে গোবর সার প্রয়োগ করে তা প্রস্তুত করে নিতে হবে৷
পৃথিবীতে ভোজ্য মসলা যতরকম আছে তারমধ্যে দারুচিনি সবথেকে উল্লেখযোগ্য। এই প্রাচীনতম মসলা বহুদিন ধরে ওষধি হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে। এছাড়াও খাবারে স্বাদ বাড়ানো থেকে শুরু করে, পানীয় এবং তরল মশলাদার খাবারে স্বাদ বাড়ানোর জন্যও এই দারচিনির ব্যবহার হয়। এলাচ, গোলমরিচ, লবঙ্গের সাথে সাথে দারুচিনির নামও মসলা হিসেবে একই পংক্তিতে উচ্চারিত হয়। বহু কৃষক দারুচিনির চাষ করে ভীষণভাবে উপকৃত হয়েছেন। বাজারে এই দারুচিনির চাহিদা প্রচুর পরিমানে থাকায়, এই চাষে ভালো লাভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও সৌখিন মানুষেরাও ভালোবেসে দারুচিনির চাষ বাড়িতে করে থাকেন। দারুচিনি গাছের বাকল, ফুল, কুঁড়ি, পাতা, ফল, শেকড় সবকিছুই কাজে লেগে যায়। দারুচিনি গাছ বাড়িতে চাষ করতে গেলে ঘরে ছাদে দুই জায়গাতেই চাষ করা যায়।
মনে রাখতে হবে এই চাষ করতে গেলে উপযুক্ত পরিমানে রোদ দরকার। বাংলার জলবায়ুতে মূলত শীতকালে এই চাষ করা সবথেকে ভালো। জানুয়ারি মাসে দারুচিনি গাছে ফুল ফোটা আরম্ভ করে, এবং এই গাছের ফল পাকতে আরম্ভ করে জুলাইয়ে। সেইসময়ই ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে এসে বাগানে বা টবে রোপন করে দেওয়া উচিত।
প্রয়োজনীয় রোদ (Sunlight)
কড়া সূর্যালোক দারুচিনি জন্য প্রয়োজনীয়, তাই এটি পর্যাপ্ত রোদ পাওয়া যায় এমন জায়গায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দারুচিনি রোপন করতে গেলে রৌদ্রোজ্জ্বল স্থান যেমন জানালার ধারে, ব্যালকনি কিংবা ছাদের খালি স্থান ব্যবহার করতে হবে।
উপযুক্ত মাটি (Soil)
দারুচিনি চাষের জন্য ভাল মানের মাটি ব্যবহার করা আবশ্যক। বাগানের মাটি ব্যবহার না করাই ভালো, কেননা এতে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। অনে সময় আমরা আশেপাশ থেকে মাটি নিয়েই টব ভরে গাছ লাগানো হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংবেদনশীল গাছগুলোতে এই উপায় কার্যকরী হয় না। নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভাল এমন মাটি ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উত্তম নিষ্কাশনযুক্ত বেলে দোআঁশ মাটি ব্যবহার করা সবথেকে উত্তম। জেনে রাখা ভালো দারুচিনি খরা একদমই সহ্য করতে পারে না। মাটির বিকল্প হিসেবে ১৫% ট্রাইকোকমপোস্টযুক্ত কোকোডাস্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
বাইরে চাষ করার জন্য এক মিটার (৩০ সেন্টিমিটার গভীর) পর্যন্ত গর্ত করে মাটি দিয়ে পূরণ করে নিতে হবে। ঘরের ভিতরে বা ছাদবাগানের দারুচিনি চাষের জন্য একটি বড় পাত্র প্রয়োজন হবে।
রোপন (Planting)
দারুচিনির বীজ সংগ্রহও করা যায় অথবা নার্সারি থেকে দারুচিনির গাছ কিনেও আনা যায়।
বাইরে চাষের ক্ষেত্রে
দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ১ মিটার x ১ মিটার এবং ৩০ সেমি গভীরতায় খনন করে মাটি দিয়ে গর্তটি পূরণ করতে হবে।
ঘরের মধ্যে টবে রোপনের ক্ষেত্রে
নিচে গর্ত সহ বড় সিরামিক পাত্র (৬০ x ৫০ সেমি) ব্যবহার করতে হবে। পাত্রটি মাটি বা কোকোডাস্ট দিয়ে পূরণ করে নিতে হবে। ৩০ সেন্টিমিটার গভীরতা এবং ৩০ সেন্টিমিটার প্রস্থের একটি গর্ত তৈরি করতে একটি বাগান ট্রোয়েল ব্যবহার করে নেওয়া ভালো। বীজ ব্যবহার করলে ১.৫ সেন্টিমিটার গভীর গর্ত তৈরি করে নেওয়া উচিত। এবার গাছটি গর্তের মধ্যে রেখে মাটি দিয়ে চাপা দিতে হবে। বীজ ব্যবহার করলে প্রতি ১.৫ সেমি গর্তে একটি করে বীজ পুঁততে হবে এবং মাটি দিয়ে বীজটি ঢেকে দিতে হবে।
মাটি সবসময় ভেজা রাখতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জল দিতে হবে। দারুচিনি গাছ পাত্রে রোপন করার পর, টবের নিচের গর্ত থেকে জল বের না হওয়া পর্যন্ত জল দিতে হবে। টবের উপরের ৫ সেন্টিমিটার শুকিয়ে গেলেই আবার গাছটিকে জল দিতে হবে।
গাছের পরিচর্যা (Caring)
দারুচিনি গাছে নিয়মিত সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম বছর ৫০ গ্রাম টিএসপি, ৭৫ গ্রাম এমওপি ও ৫০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিবছর ২-৩ কেজি ট্রাইকোকম্পোস্ট ও সার প্রয়োগ শেষে একই হারে টিএসপি, এমওপি ও ইউরিয়া দিতে হবে।
দারুচিনি প্রথম ধরতে দুই থেকে তিন বছর সময় নেয় এবং তার পরে প্রতি দুই বছর পরপরই ফসল দিতে থাকে। দারুচিনি গাছ কম করে ১০-১৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। তাই একে নিয়মিত করে ছোট রাখতে হবে। পাঁচ বছর বয়সী দারুচিনি গাছ থেকে নিয়মিত দারুচিনি সংগ্রহের ডাল পাওয়া সম্ভব। দারুচিনি ব্যবহার করার জন্য যে শাখাগুলি কাটা হবে সেগুলি থেকে বাকল তুলে নিতে হবে, বাকলগুলি ব্যবহার করার আগে জলে ভালোভাবে ভিজিয়ে নেওয়া উচিত।
পৃথিবীতে জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, হারিয়ে যাচ্ছে বহু প্রাণী ও উদ্ভিদ বৈচিত্র। চাষবাসের জমিরও সংকুলান ঘটছে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে। গগনচুম্বী বাড়ি ঘিরে ফেলছে সমস্ত ফাঁকা জমিন। শখ করে মানুষ খোলা জায়গায় যে গাছ লাগবে অথবা ফল-ফুলের চারা সেই উপায়ও আর নেই। গাছ লাগানোর জন্য সামান্য জায়গাও ফাঁকা থাকছে না আর। তবে আমাদের করণীয় কী? বৃক্ষরোপন কি তবে অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে। বেঁচে থাকার জন্য তো গাছ লাগাতে হবেই। বাড়ির একটুকরো বারান্দা অথবা ব্যালকনিতেও সুন্দর ভাবে ইচ্ছা করলে গাছ লাগানো যায়। বাড়ির ছাদেও বানানো যায় সুন্দর বাগিচা। শহরের মানুষদের জন্য ছাদ বাগানের কোনও বিকল্পও নেই। বাড়ির মধ্যেকার ব্যালকনি অথবা ছাদের একটুকরো জমিতেও, ইচ্ছা করলে টবে চাষ করা যায় বিভিন্ন ফুলের ও ফলের গাছ।
শাকসবজি, পেয়ারা, লেবু প্রভৃতি দেশীয় গাছ টবে বাড়তে দেওয়া থেকে শুরু করে বর্তমানে বহু বিদেশী গাছের চারাও মানুষ ব্যালকনি অথবা ছাদে চাষ করছেন। তার মধ্যে থাই মিষ্টি তেঁতুল টবের চাষ পদ্ধতি হিসাবে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। প্রথমত মিষ্টি তেঁতুলের চাষ করতে গেলে, নার্সারি থেকে এই বিশেষ তেঁতুলের সঠিক বীজ নিয়ে আনতে হবে। তবে থাই মিষ্টি তেঁতুলের কলম পাওয়া একটু দুষ্কর কাজ। বুঝে সঠিক চারা নিয়ে আসা বাগান মালিকের উপরেই বর্তায়।
থাই মিষ্টি তেঁতুলের ফুল থেকে ফল ধরতে প্রায় ৭ মাস সময় লাগে। বছরে দু’বার থাই মিষ্টি তেঁতুলের গাছে ফল ধরে। প্রথমবার বর্ষাকালে এবং দ্বিতীয়বার শীতকালে। এই গাছের পরিচর্যা আলাদা করে করার কোনও দরকার পড়ে না। গাছের যত্নআত্তি নিতে হয় ঠিকই, কিন্তু তা বলে, আলাদা করে কোনও বিশেষ যত্ন নিতে হয় না।
গাছ লাগানোর পদ্ধতি (Planting):
থাই মিষ্টি তেঁতুল চাষের জন্য আদর্শ মাটি হল, দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি। এই দু’টি মৃত্তিকার মধ্যে যে কোনও একটি বেছে নিন। তারপর বেছে নেওয়া মাটির দুই ভাগ অংশের সাথে গোবর, ১০০ গ্রাম, টিএসপি ১০০ গ্রাম, পটাশ, ২৫০ গ্রাম, হাড়ের গুঁড়ো এবং ৫০ গ্রাম সরিষার খোল একসঙ্গে মিশিয়ে ২০ ইঞ্চি মাপের বড় টবে জল মিশিয়ে রেখে দিতে হবে। ১০ থেকে ১২ দিন পর টবের মাটি ভালো করে খুঁচিয়ে দিয়ে আরও ৪-৫ দিন রেখে দিতে হবে। ৪ থেকে ৫ দিন বাদে মিষ্টি তেঁতুলের একটি ভালো চারা ওই টবে লাগান।
পরিচর্যা(Caring):
চারা লাগানোর প্রথম কয়েক মাস তেমন যত্নের দরকার পড়বে না। অবশ্যই গাছে এই সময়টুকু পর্যাপ্ত জলের যোগান, এবং আগাছা পরিষ্কারের কাজ করতে হবে। ছয় মাস চারা লাগানোর সময়সীমা ফুরোলেই ১ মাস বাদে বাদে গাছে সরষের খোল মিশ্রিত পচা জল দিতে হবে। মনে রাখতে হবে খোল দেওয়ার আগে গাছের মাটি খুঁচিয়ে নিতে হবে।
রোগ দমন (Disease management):
সাধারণত থাই মিষ্টি তেঁতুল গাছে পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা যায় না। কিন্তু বর্ষাকালে অনেক সময় তেঁতুল গাছে ছত্রাক হানা দেয়। এর ফলে তেঁতুল ফেটে যায়। এই অসুবিধার থেকে গাছকে বাঁচাতে হলে, বর্ষাকাল আসার আগেই ভালো ছত্রাকনাশক ওষুধ ১০ দিন অন্তর গাছে স্প্রে করে ছড়িয়ে দিতে হবে।
বাংলার বেজায় টক তেঁতুলের সঙ্গে থাই মিষ্টি তেঁতুলের কোনও তুলনাই চলে না। অত্যন্ত মিষ্টি খেতে এই তেঁতুল থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় চাষ প্রভূত পরিমাণে হলেও, আমাদের রাজ্য এই ফলের চাষ এখনও ততটা গতি পায়নি। কিন্তু আপনি আপনার ব্যালকনি অথবা ছাদে সহজেই এই থাই তেঁতুলের গাছ লাগাতে পারেন।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন