বাংলায় একটি বাগধারা আছে ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’ – যা ব্যবহৃত হতো অসম্ভব বা অবাস্তব কোন বস্তু বোঝাতে।
তবে বহু পুরোনো এই প্রবচন হয়তো এখন অযৌক্তিক প্রমাণিত হবার সময় এসে গেছে – কারণ কাঁঠাল থেকে আমের মতই ‘সত্ত্ব’ তৈরি করা এখন আর অসম্ভব নয়।
বাংলাদেশের কৃষিবিদরা এরই মধ্যে তৈরি করে ফেলেছেন ‘কাঁঠালসত্ত্ব।’
প্রকৃতপক্ষে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ কাঁঠাল ব্যবহার করে এরকম পণ্য আগেই উৎপাদন করেছে। তবে বাংলাদেশে কাঁঠাল থেকে এ ধরণের খাদ্য তৈরি করা হচ্ছে এই প্রথম।
শুধু কাঁঠালসত্ত্ব নয়, কাঁঠাল ব্যবহার করে গবেষণাগারে ভেজিটেবল মিট, চিপস, আচার, জেলি, আইসক্রিম, কেকসহ বিভিন্ন ধরণের খাদ্যদ্রব্য তৈরি করছেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষিবিদরা।
কাঁঠালের অপচয় রোধে এবং এই ফলের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে কৃষি অধিদপ্তরের ‘কাঁঠাল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, পদ্ধতি ও বাজারজাতকরণ’ প্রকল্পের অধীনে তৈরি হচ্ছে এসব খাদ্য পণ্য।
এই প্রকল্পের প্রধান ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পোস্ট-হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী জানান, কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে গত দুই বছর ধরে এই গবেষণা হচ্ছে বাংলাদেশে।
“এই প্রকল্প সফল হলে কাঁঠালের অপচয় তো রোধ হবেই, পাশাপাশি এসব পণ্য রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং স্বল্প বিনিয়োগে কৃষি উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে” – আশা প্রকাশ করছেন মি. চৌধুরী।
কাঁঠাল নিয়ে কেন গবেষণা?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ১০ লাখ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপন্ন হয়।
“আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি, গত কয়েক বছর এই মোট উৎপাদনের প্রায় ৪৫%, অর্থাৎ প্রায় ৫ লক্ষ টন কাঁঠালই নষ্ট হয়েছে”, বলেন মি. ফেরদৌস চৌধুরী।
কাঁঠালের মৌসুমে একইসাথে আম, লিচু, জামের মত ফল বাজারে থাকা এবং এসব ফলের তুলনায় খাওয়ার জন্য কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত করা অপেক্ষাকৃত কষ্টকর বলে প্রতি বছরে উৎপাদিত কাঁঠালের একটা বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায় বলে মনে করেন তিনি।
তার মতে বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে কাঁচা কাঁঠাল খাওয়ার চল না থাকাও অপচয়ের অন্যতম প্রধান কারণ।
“বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ধারণা, কাঁঠাল শুধু পাকাই খাওয়া যায়। আবার আম খাওয়ার জন্য মানুষের যে ঝোঁকটা রয়েছে, কাঁঠাল পছন্দ করলেও সেটির জন্য ঐ ঝোঁক দেখা যায় না মানুষের মধ্যে।”
“আবার কাঁঠাল ভাঙ্গার ঝামেলা, খাওয়ার সময় হাতে-মুখে আঠা লেগে যাওয়ার বিড়ম্বনার জন্য নতুন প্রজন্মের অনেকে পাকা কাঁঠাল পছন্দ করলেও শখ করে খেতে চায় না। এসব বিষয় মাথায় রেখেই কাঁঠাল দিয়ে এমন খাদ্যদ্রব্য তৈরির চেষ্টা করছি আমরা, যেটা সহজে খাওয়া যায় এবং সুস্বাদুও”, বলেন ফেরদৌস চৌধুরী।
কাঁঠাল ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে যেসব পণ্য
কৃষিবিদ ফেরদৌস চৌধুরী জানান তাদের গবেষণাগারে যেসব পণ্য তৈরি হচ্ছে সেগুলোর একটা বড় অংশ তৈরি করা হয় কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে।
“কাঁচা কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত করে ভেজিটেবল মিট তৈরি করা হয়েছে, যেটিকে ‘ফ্রেশ কাট’ বলা হয়। এই পণ্য এরই মধ্যে ঢাকার কয়েকটি সুপার শপে বিক্রি হচ্ছে এবং ক্রেতাদের কাছ থেকে এটি সম্পর্কে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।”
কাঁঠাল দিয়ে তৈরি এ ধরণের ভেজিটেবল মিট কোনো প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়া সরাসরি রান্না করা যায় এবং দামে সাশ্রয়ী বলে এটি গ্রাহকের কাছে সাড়া ফেলছে বলে মনে করেন মি. চৌধুরী।
এছাড়া কাঁচা কাঠাল কেটে, মসলা দিয়ে, প্রক্রিয়াজাত করে, শুকিয়ে, প্যাকেটজাত করে কাঁঠালের ‘ড্রাইড’ প্রডাক্ট তৈরি করা সম্ভব, যা সারা বছর সংরক্ষণ করা যায়।
পাশাপাশি কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে চাটনি ও উৎকৃষ্ট মানের আচারও নারী উদ্যোক্তাদের অনেকে বাজারজাত করছেন বলে জানান মি. চৌধুরী।
“এছাড়া কাঁঠাল থেকে উৎকৃষ্ট মানের চিপস, জ্যাম, জেলি ছাড়াও অত্যন্ত সুস্বাদু কাঁঠালসত্ত্ব তৈরি হয়, যেটিকে আমরা জ্যাকফ্রুট লেদার বলে থাকি।”
এছাড়া কাঁচা কাঁঠালের ভেজিটেবল রোল, কাটলেট, সিঙ্গাড়া, সমুচা ছাড়াও পাকা কাঁঠালের রস দিয়ে আইসক্রিম বা কেকের মত খাবার তৈরি করা যায় বলে জানান মি. চৌধুরী।
অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
কাঁঠাল ব্যবহার করে তৈরি এসব পণ্য এরই মধ্যে দেশে কর্মসংস্থান তৈরি করছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারেও এসব পণ্যের চাহিদা রয়েছে।
মি. চৌধুরী জানান চলমান এই প্রকল্পের অধীনে ২৫০ থেকে ৩০০ জন কৃষি উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, যারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় কাঁঠাল দিয়ে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরি করে বাজারজাত করছেন।
“আমাদের উদ্দেশ্য তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি করা, যেন তারা এর মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে পারে। তাদের মাধ্যমে পরবর্তীতে ক্ষুদ্র পরিসরে আরো কর্মসংস্থান তৈরি হবে বলে আমরা মনে করি।”
ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম সহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু দেশে কাঁঠাল দিয়ে তৈরি নানা ধরণের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্যের জনপ্রিয়তা রয়েছে। সেসব দেশে কাঁঠালজাত পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হতে পারে বলে মনে করেন মি. চৌধুরী।
“আমাদের দেশের কাঁঠাল খুবই উৎকৃষ্ট মানের, কাজেই এই কাঁঠাল দিয়ে তৈরি করা খাদ্য আন্তর্জাতিক বাজারেও জনপ্রিয় হতে পারে বলে আমাদের ধারণা।”
'কাঁঠালসত্ত্ব', 'কাঁঠালের চিপস' যেভাবে তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে
মিরাজুল ইসলাম (৩৩)। ১০ বছর সৌদি আরবে ছিলেন। আকামা জটিলতায় খালি হাতে দেশে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এক বছর বেকার থাকার পর ইউটিউবে পতিত জমিতে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখেন। বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে নেমে পড়েন ড্রাগন চাষে। দেড় বছরের ব্যবধানে এখন উপজেলার সবচেয়ে বড় ড্রাগন বাগান তাঁর। এ বছর খরচ বাদে আট থেকে নয় লাখ টাকা লাভের আশা করছেন তিনি।
পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার ইন্দুরকানি গ্রামের বাসিন্দা মিরাজুল। উপজেলার টগরা গ্রামে দেড় একর জমিতে তিনি ড্রাগনের বাগান তৈরি করেছেন। তাঁর বাগানে এখন সাড়ে তিন হাজার ড্রাগন ফলের গাছ আছে।
মিরাজুল ইসলাম বলেন, শ্রমিক হিসেবে ১০ বছর সৌদিতে কাজ করে ২০১৯ সালে দেশে ফেরেন তিনি। আকামা সমস্যার কারণে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কিছু একটা করবেন বলে ভাবছিলেন। একদিন ইউটিউবে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখতে পান। সেই থেকে ড্রাগন চাষে আগ্রহ জন্মে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দেড় একর পতিত জমি ড্রাগন চাষের উপযোগী করেন। গাজীপুর থেকে ৬০ টাকা দরে ৬০০ চারা নিয়ে আসেন। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে শুরু করেন চাষাবাদ। পরের বছর জুনে ফল পাওয়া শুরু করেন।
ড্রাগনের বাগান করতে মিরাজুলের খরচ হয়েছিল ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। ইতিমধ্যে ফল বিক্রি করে তাঁর খরচ উঠে গেছে। সাধারণত মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গাছে ফল আসে। বছরে ছয় থেকে সাতবার পাকা ড্রাগন সংগ্রহ করা যায়। এখন পরিপক্ব ও রোগমুক্ত গাছের শাখা কেটে নিজেই চারা তৈরি করেন। ড্রাগন চাষের পাশাপাশি বাগানে চুইঝাল, এলাচ, চায়না লেবুসহ মৌসুমি সবজি চাষ করেন। এ ছাড়া ড্রাগনের চারাও উৎপাদন করে বিক্রি করেন তিনি।
মিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাগানের বেশির ভাগ গাছে এ বছর ফল ধরেছে। গত মঙ্গলবার বাগান থেকে দেড় টন ফল সংগ্রহ করেছেন। ২৫০ টাকা কেজি দরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছেন। স্থানীয় বাজারে ৩০০ টাকা কেজি দরে ড্রাগন বিক্রি হয়। নভেম্বর পর্যন্ত আরও পাঁচ–ছয়বার বাগান থেকে ফল তোলা যাবে। আশা করছেন, খরচ বাদে এবার আট থেকে নয় লাখ টাকা লাভ থাকবে।
মিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমার বাগান থেকে চারা নিয়ে অনেকে বাড়িতে ও ছাদে ছোট পরিসরে ড্রাগনের বাগান করেছেন। আমি এ পর্যন্ত ৪০ টাকায় দেড় হাজার চারা বিক্রি করেছি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পূর্ণ বয়সের একটি ড্রাগনের চারা রোপণের পর ২৫ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। এর মৃত্যুঝুঁকি নেই বললেই চলে। তবে কয়েক দিন পরপর সেচ দিতে হয়। বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হয়। ড্রাগন ফল চাষে রাসায়নিক সার দিতে হয় না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইশরাতুন্নেছা বলেন, মিরাজুল ইসলামকে ড্রাগন চাষে নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে আসছে কৃষি বিভাগ। উপজেলায় তাঁর বাগানটি সবচেয়ে বড়। তিনি নিরলস পরিশ্রম করে ছোট থেকে বাগানটি বড় করেছেন।
ডাচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে দুই দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।
গতকাল সোমবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অনুষ্ঠিত কৃষি খাতের ব্যবসাবিষয়ক এক সম্মেলনে দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এগ্রি বিজনেস কনক্লেভে বাংলাদেশের প্রায় ৪০জন উদ্যোক্তা ডাচ কৃষি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি প্রযুক্তি সহযোগিতা ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছে ওয়েগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়।
আলোচনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তি কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি সহযোগিতা দিতে রাজি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে ডাচরা প্রস্তুত এবং বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও তাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া ডাচ সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বীজ, পশু খাদ্য, পোলট্রি, হর্টিকালচার ও এ্যাকুয়াকালচার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করেছে, যা ওই দেশের বেসরকারি খাতকে আরও উৎসাহিত করেছে।
আলোচনায় কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তৈরি আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্কয়ার, ইস্পাহানি এগ্রো, একে খান অ্যান্ড কোম্পানি, প্যারাগন গ্রুপ, এসিআই, জেমকন গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ডাচ প্রযুক্তির প্রয়োগ সরেজমিনে দেখতে যাবেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের পোল্ট্রিখাতে সহযোগিতার আলোচনা অনেকটা এগিয়েছে উল্লেখ করে মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দুই দেশের মধ্যে মৎস্য, পশুপালন ও হর্টিকালচারে সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা আছে।
কনক্লেভ আয়োজনে প্রথমবারের মতো দূতাবাসের সঙ্গে অংশীদার হয়েছে নেদারল্যান্ডসের কৃষি মন্ত্রণালয়, নেদারল্যান্ডস এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি, নেদারল্যান্ডস ফুড পার্টনারশিপ, ডাচ-গ্রিন-হাইজডেল্টা, লারিভ ইন্টারন্যাশনাল, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ।
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী নেদারল্যান্ডসের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কম। ২০২১-এ কৃষিপণ্য ও খাদ্য রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে।
পাবনার বেড়া উপজেলার বড়শিলা গ্রামের কৃষক সাইদুল ইসলাম তাঁর দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করে এবার প্রায় ৪০ হাজার টাকা লোকসান দিয়েছেন। অথচ পেঁয়াজের জমিতেই সাথি ফসল হিসেবে লাগানো বাঙ্গি থেকে তিনি ৫০ হাজার টাকার মতো লাভ করবেন বলে আশা করছেন। এই বাঙ্গি আবাদে তাঁর কোনো খরচ হয়নি। ফলে পেঁয়াজ আবাদের ক্ষতি পুষিয়ে যাচ্ছে।
সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘বাঙ্গি আবাদ কইর্যা যে টাকা পাইল্যাম তা হলো আমাগরে ঈদের বোনাস। পেঁয়াজের দাম না পাওয়ায় আমরা (কৃষকেরা) যে ক্ষতির মধ্যে পড়িছিল্যাম, বাঙ্গিতে তা পুষায়া গেছে। এই কয়েক দিনে ১২ হাজার টাকার বাঙ্গি বেচছি। সব মিলায়া ৫০ হাজার টাকার বাঙ্গি বেচার আশা করতেছি।’
সাইদুল ইসলামের মতো পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার অনেক কৃষক এবার পেঁয়াজের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে বাঙ্গির আবাদ করেন। কৃষকেরা পেঁয়াজ আবাদ করতে গিয়ে বিঘায় প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ করেছিলেন। সেই হিসাবে প্রতি মণ পেঁয়াজ উৎপাদনে তাঁদের খরচ হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকার বেশি। কিন্তু বাজারে সেই পেঁয়াজ কৃষকেরা বিক্রি করতে পেরেছেন প্রতি মণ ৬০০ থেকে ৮৫০ টাকায়। এতে প্রতি বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদে কৃষকদের এবার ২০ হাজার টাকার বেশি লোকসান হয়েছে।
কৃষকেরা বলেন, পেঁয়াজের জমিতে সাথি ফসল হিসেবে বাঙ্গি, মিষ্টিকুমড়া, কাঁচা মরিচসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। জমিতে পেঁয়াজ লাগানোর পর তা কিছুটা বড় হলে এর ফাঁকে ফাঁকে এসব সাথি ফসল লাগানো হয়। পেঁয়াজের জন্য যে সার, কীটনাশক, সেচ দেওয়া হয়, তা থেকেই সাথি ফসলের সব চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। ফলে সাথি ফসলের জন্য বাড়তি কোনো খরচ হয় না।
কৃষকেরা বলেন, বাঙ্গিতেই কৃষকের লাভ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। রমজান মাস হওয়ায় এখন বাঙ্গির চাহিদা ও দাম দুই-ই বেশি।
সাঁথিয়ার শহীদনগর গ্রামের কৃষক আজমত আলী জানান, তাঁর জমিসহ এই এলাকার জমি থেকে ৮ থেকে ১০ দিন হলো বাঙ্গি উঠতে শুরু করেছে। এবার বাঙ্গির ফলনও হয়েছে বেশ ভালো। বাজারে এসব বাঙ্গি আকারভেদে প্রতিটি ৬০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এমন দাম থাকলে এক বিঘা থেকে প্রায় ৩০ হাজার টাকার বাঙ্গি বিক্রি হবে।
সাঁথিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার গোস্বামী বলেন, পেঁয়াজের সঙ্গে সাথি ফসলের আবাদ কৃষকদের মধ্যে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ ব্যাপারে তাঁরাও কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
জাতীয় ফল কাঁঠালের জ্যাম, চাটনি ও চিপস উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) শস্য সংগ্রহের প্রযুক্তি বিভাগের একদল গবেষক। তাঁরা কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত করে মোট ১২টি প্যাকেট ও বোতলজাত পণ্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
গত শনিবার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ক্যাম্পাসে অবস্থিত বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিনা) ‘কাঁঠালের সংগ্রহত্তোর ক্ষতি প্রশমন ও বাজারজাতকরণ কৌশল’ শীর্ষক কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এসব তথ্য জানান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) অর্থায়নে এবং নিউভিশন সলিউশন্স লিমিটেডের সহযোগিতায় গবেষণা প্রকল্পটি পরিচালিত হয়।
কর্মশালায় ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী বলেন, ‘এই প্রকল্পের আওতায় আমরা কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাত করে মুখরোচক ১২টি প্যাকেট ও বোতলজাত পণ্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এসব পণ্য উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। কাঁঠালের জ্যাম, আচার, চাটনি, চিপস, কাটলেট, আইসক্রিম, দই, ভর্তা, কাঁঠাল স্বত্ব, রেডি টু কুক কাঁঠাল, ফ্রেশ কাট পণ্যসহ আরও বিভিন্ন ধরনের প্যাকেটজাত পণ্য তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। প্রক্রিয়াজাত পণ্যগুলো ঘরে রেখে সারা বছর খাওয়া যাবে। কাঁঠাল থেকে এসব পণ্য উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা কমানো সম্ভব বলে মনে করছেন গবেষক।’
কর্মশালায় নিউভিশন সলিউশন্স লিমিটেডের মুখ্য পরিদর্শক তারেক রাফি ভূঁইয়া বলেন, উদ্ভাবিত পণ্যগুলো বাজারজাত করার জন্য নিউভিশন কোম্পানি বিএআরআইয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ময়মনসিংহসহ বাংলাদেশের কয়েকটি জেলা ও উপজেলা শহরে পণ্যগুলো বিপণনের কাজ চলছে।
কর্মশালায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিভাগের বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. হাফিজুল হক খানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম। সম্মানিত অতিথি ছিলেন কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের সিনিয়র স্পেশালিস্ট (ফিল্ড ক্রপস) ড. নরেশ চন্দ্র দেব বর্মা। বিশেষ অতিথি ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আবু হানিফ। উপস্থিত ছিলেন নিউভিশন সলিউশন্স লিমিটেডের প্রকল্প ম্যানেজার কায়সার আলম।
সার ব্যবস্থাপনা: প্রতি গর্তে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া সার, ১০০ গ্রাম টিএসপি সার ও এমওপি সার ১০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হয়।
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা: চারা গাছের গোড়ায় মাঝে মাঝে পানি সেচ দিতে হবে। বর্ষাকালে গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেজন্য পানি নিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া কমলা গাছের আগাছা দমন করতে হবে।
ফসল তোলা: মধ্য কার্তিক থেকে মধ্য পৌষ মাসে ফল সংগ্রহ করতে হয়।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন