বাংলাদেশ
উন্নয়ন সাংবাদিকতা ও টেলিভিশন (পর্ব: ২)
লেখক
শাইখ সিরাজটেলিভিশনের মাধ্যমে তখন আমি কৃষকদের নতুন নতুন কথা শোনাচ্ছি। আমি তাদের বোঝাতাম, বাপ-দাদার আমলের প্র্যাকটিস ছেড়ে বেরিয়ে এসো। যে ধান চাষ করছো তা দিয়ে তোমার পরিবারের খাদ্যের চাহিদা মেটে না। সন্তান বাড়ছে, আর অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে কৃষি জমির পরিমাণ কমছে। জমির আইল বাড়ছে, বাড়ছে ফ্র্যাগমেন্টেশন অব ল্যান্ড। দেশিয় যে বীজ তুমি জমিতে লাগাচ্ছো এতে ধান কম হচ্ছে, তোমার চাহিদা মিটছে না। তাই তোমার উচিত সরকারি বীজ লাগানো। সরকারের কর্মকর্তারা এসে যে বীজের কথা বলেছে ওই বীজ লাগাও।
জবাবে তারা বলতো ওই বীজের ধান আমরা খাই না, ওটা রাবার ভাত। বলতাম, চালের পাশাপাশি গমের আবাদ করতে হবে। বলতো, না না গম কেন আমরা খাব? আমরা কি পাকিস্তানি! তখন দরিদ্র মানুষের খাবার ছিল গমের রুটি। বলতাম ভুট্টা লাগাতে, বলতো পাকিস্তানি জুলফিকার আলী ভুট্টোর নামের এই জিনিস আমরা কেন লাগাবো? এই ছিল তখনকার কৃষকদের সামগ্রিক অবস্থা। বাড়ির সামনে সবজি লাগানোর কথাও বলেছিলাম তাদের।
সেই সময় ঈশ্বরদীর কালিকাপুর নামে একটা জায়গা ছিল, সেখানে কৃষি কর্মকর্তারা বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় সবজির বাগান করার একটি মডেল তৈরি করেছিলেন। বাড়ির সামনে বিশ ফুট বাই বিশ ফুট যদি কোনো জায়গা থাকে, তাহলে বেড করে সবজি লাগিয়ে সারা বছর বিভিন্ন ধরনের সবজি পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে বিদেশি একটি সংস্থা এসে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে এই মডেল ছড়িয়ে দেয় টেলিভিশনের মাধ্যমে। ঘরের পাশের যে লাউয়ের মাচা তা চলে এলো ধানখেতের আইল কিংবা পুকুরের ঢালে। মাইলের পর মাইল তখন সবজি চাষ হচ্ছে।
তবুও দীর্ঘদিনের অভ্যাস কৃষকরা ছাড়তে চাইতো না। ৫০০ জনকে বললে ৫ জন প্রয়োগ করতো। যেই ৫ জন শুনতো তারা যেদিন লাউ বা ধানের বীজ বপন করতো, তখন বাকি কৃষকদের এনে দেখানো হতো।
কুমিল্লা বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খানই সর্বপ্রথম বাংলাদেশে একটা গ্রামে কৃত্রিম সেচের ব্যবস্থা করেন এইচওয়াইভি ধান লাগানোর জন্য। ওই যন্ত্র স্থাপনের পর পানি যখন উঠলো, তখন গ্রামের মানুষ ভয়ে পালিয়ে গেলো।
একজন টেলিভিশন ব্রডকাস্টার
শুরুর দিক আমি খুবই কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে কাজ করেছি? এতগুলো যন্ত্রপাতি দেখে মানুষ ভয় পেত আবার নতুন জ্ঞানের কথা বলতে গেলে তারা তেড়ে আসতো। প্রতিনিয়ত তাদের অনেক ধরনের মোটিভেশন দিতে হতো। তখন আমি দেখলাম টেলিভিশন এমন একটা ক্ষেত্র, যেখানে মানুষকে শিক্ষিত করা যায়। গান, নাটক কিংবা উন্নয়ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষিত করা যায়। কিন্তু টেলিভিশনে মাতৃভাষা বাংলার প্রমিত রূপের বাইরে কোনো ভাষায় কথা বলা যেত না। তখনকার টেলিভিশনে কোনো বিশেষ জেলার ক্যারেক্টার থাকলেও সেই জেলার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারতো না। এরকম কোনো ক্যারেক্টার রাখতে হলে পাণ্ডুলিপি প্রথমে মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হতো। তারা যদি অনুমোদন দিতো, তাহলেই কেবল ঐ চরিত্রে আঞ্চলিক সংলাপ ব্যবহার করা যেত। আর এখন শত শত পর্বের নাটকও আঞ্চলিক ভাষায় প্রচারিত হচ্ছে।
১৯৮০ সালের দিকে প্রমিত বাংলার বাইরে কথা বলা ছিলো বিশাল অপরাধ। অনুষ্ঠান শুরু করার পর এক-দুই বছর কেটে গেলো। আমি লক্ষ করলাম, আমার কথা গ্রামের সাধারণ কৃষক বুঝতে পারছে না। কারণ আমি তো তার সাথে প্রমিত বাংলায় কথা বলছি। ফলে সেই কৃষক কতগুলো জায়গায় শংকিত হয়ে আছে। এক হচ্ছে, শহর থেকে যাওয়া বেশ কিছু মানুষ। তাদের পরনে আবার শার্ট-প্যান্ট। গ্রামের মানুষ তখন কালে ভদ্রে শার্ট-প্যান্ট পরতো। ছেঁড়া গেঞ্জি আর লুঙ্গিই ছিল তাদের সম্বল। তার উপর আবার আমাদের হাতে থাকতো অনেক যন্ত্রপাতি।
কেউ যদি কথা বলতেও চাইতো, তাহলেও আমার কথা ঠিকমতো বুঝতে পারতো না। আমাকে বলতে হতো, আপনি কেন এই চাষটি করবেন? এই চাষটি করলে আপনার ভাগ্যের এই উন্নতি হবে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো, মাঝে মাঝে বলতো, আমি তো এই চাষ করি না।
বছর দুয়েক যাওয়ার পর আমার জার্নালিস্টিক অ্যাপ্রোচে পরিবর্তন আনলাম। উন্নয়ন সাংবাদিকতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করলাম। আমি চিন্তা করলাম বাংলা ভাষাতেই কথা বলবো কিন্তু পরিবর্তন করতে হবে। কীরকম পরিবর্তন? এমন একটি কথ্য ভাষা তৈরি করবো, যেটা সবজায়গার মানুষই বুঝবে। সেটা বরিশাল, চট্টগ্রাম কিংবা নোয়াখালীই হোক। তো ঐ চাষের কথাই এরপর আমি তাকে এভাবে বললাম: ‘গতবার আপনি যেটা করসিলেন, আর এইবার এটা করসেন। এই দুইটার মধ্যে তফাৎটা কি পাইসেন? গতবারের তে এবার বেশি হইসে না কম হইসে?’
যখন এই ভাষায় কথা বলা শুরু করলাম, কৃষকের ভেতর থেকে সব গড়গড় করে বের হওয়া শুরু করলো। কারণ এটা তার ভাষা। সে বলতে থাকলো, ‘গতবার করসিলাম, গতবারের তে এবার একটু ভালোই মনে হইসে। ওই সাব ভালোই কইসে, আমারটা ভালো হইসে। আমারটা দেইখা আশেপাশের জনও লাগাইসে। তাদেরটাও ভালো হইসে।’
টেলিভিশন প্রমিত বাংলা ব্যবহারের পক্ষে। কিন্তু টেলিভিশনের কিছু কিছু অনুষ্ঠান থাকে টার্গেট অরিয়েন্টেড। এগ্রিকালচার সেরকম একটা অনুষ্ঠান। যারা দেখে তারা বেশিরভাগ গ্রামের মানুষ। সেখানে ফোকাস গ্রামের মানুষ। আর যদি শহুরে দর্শক দেখে তাহলে সেটা অনুষ্ঠানের ক্রেডিবিলিটি, এটাই প্লাস পয়েন্ট। যাদের জন্য অনুষ্ঠান তারা যদি আমার অনুষ্ঠান না-ই বোঝে তাহলেতো অনুষ্ঠান ব্যর্থ। অডিয়েন্স ঠিক রাখার জন্য তাই প্রমিত বাংলার ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এইসব অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে।
কাউকে জিজ্ঞাসা না করে এরকম একটা ভাষার অনুষ্ঠান আমরা প্রচার করে দিলাম, পুরো টেলিভিশনে শোরগোল বেঁধে গেল। একজন উপস্থাপক কীভাবে এই ভাষায় কথা বলে? সে সময়কার কর্তাব্যক্তি যারা ছিলেন তারা বেশ চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন। তাদের সাপোর্টেই এই জিনিস প্রচার করা গেছে।
ভাষার মাধ্যমে তাদের দুঃখ-বেদনা-আনন্দ বের করে নিয়ে আসা গেল। দেখা গেল তারা ক্রমশ আন্তরিক হচ্ছে। নিজের মতো করে কথা বলছে। প্রথম দিকে আমাকে অনেক বেশি কথা বলতে হতো। ২৫ মিনিটের অনুষ্ঠানে ১০ মিনিটই হয়তো আমাকে দেখা যাচ্ছে। কারণ আমি তাকে কনভিন্স করে নতুন প্রযুক্তির কথা বোঝাচ্ছি। জীবনমানের উন্নয়নের কথা বোঝাচ্ছি। এ কারণে আমাকে বেশি দেখানো হচ্ছে।
কৃষকের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখলাম কৃষক মাঠে কাদার মধ্যে আর আমি মাঠের আইলের উপরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। টেলিভিশনে যখন দেখছি, তখন তার আর আমার মধ্যে পার্থক্য অনেক। এটা ঠিক হচ্ছে না। আমার কাছে মনে হচ্ছিল এই দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে। পরের সপ্তাহে আইলের উপর ডেকে পাশাপাশি বসে দুজন কথা বলছি। দূরত্ব কমেছে, সম্পর্ক আন্তরিক হয়েছে। কিন্তু এতে আরেক কৃষক মনে করতে পারে আমার কৃষক ভাইয়ের সময় নষ্ট হচ্ছে। পরের অনুষ্ঠানে আমি কাদার উপর দিয়ে তার কাছে চলে গেছি। কাদা, শব্দের খেলা এগুলোর মাধ্যমে নস্টালজিক করে তুলেছি। ক্যামেরা জুম ইন করে নির্দিষ্ট বস্তুর কাছে যাওয়া। ক্যামেরা আর আমি দুজন যাচ্ছি, এর মানে দর্শককে আমি তার কাছে নিয়ে যাচ্ছি। উপস্থাপক বিষয়ের কাছে চলে যাচ্ছে, আভিজাত্য ভেঙে যাচ্ছে। কৃষক নিজেকে মর্যাদার জায়গায় প্রতিষ্ঠা করছে, তার সময় নষ্ট হচ্ছে না।
মানুষের সাথে একাত্মতা প্রকাশের জন্য এবার পোশাকের দিকে গেলাম। যদিও টেলিভিশন গ্ল্যামার কিংবা জৌলুসের জায়গা। তারপরও টার্গেট অডিয়েন্সের সাথে একাত্ম হওয়ার জন্য টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে আমার এই জায়গা ভাঙতে হবে। যাদের সাথে কথা বলছি তারা ছেঁড়া কাপড় পরা, আর আমি যদি একেক সপ্তাহে একেক পোশাক পরে যাই তাহলে আমি তাদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারবো না। তারা আমাকে আপন ভাববে না। আমার টার্গেট টেলিভিশনকে এডুকেশন আর ডেভেলপমেন্টের টুলস হিসেবে ব্যবহার করা। আমাকে তাহলে একটাই কাপড় ব্যবহার করতে হবে যেটা তার মনে গেঁথে থাকবে। আমাকে গ্ল্যামারাস হওয়ার লোভ সংবরণ করতে হবে। একটি কাপড় পরবো, সেটা হবে পাইলট শার্ট। ১৯৮০’র দশকে সেই শার্ট অনেক জনপ্রিয় ছিল। হাতের উপরে, আস্তিনের উপরে ফ্ল্যাপ থাকে, পকেটে ঢাকনা থাকে। এই শার্ট দারোয়ানরাও পরতো, কিংবা পুলিশরা। এই ধরনের শার্টে একটা আউটডোর ভাব থাকে। এই শার্টটি বিশেষ দর্জি দিয়ে বানানো হলো। প্রথমে ছিল বিস্কুট রঙের, পরে কালারে পরিবর্তন আনা হলো। পকেটে কলম নিলাম, স্কুলের শিক্ষকের মতো। চোখে চশমা পরা হলো কারণ তখনকার গ্রামীণ পরিবেশ কলম আর চশমাকে বিশেষভাবে মূল্য দেওয়া হতো। এই বেশ নিতো শিক্ষক কিংবা মসজিদের ইমামরা। কৃষকরা যেন আমাকে শিক্ষিত মনে করে। আমার কথা যদি তারা আমলে না নেয়, তাহলে কি সম্প্রসারণের কাজ হবে? এরপর সবুজ শার্ট পরার সিদ্ধান্ত নিলাম, সবুজ ধানক্ষেতের কথা ভেবে। কৃষকের সঙ্গে আরো একাত্ম হওয়ার জন্য।
প্রথম দিকে ক্যামেরায় আমি ফোকাসড। ৫ বছর পর যখন আমি ফিডব্যাক নিয়ে অনুষ্ঠান করতে গেলাম, ফোকাস করা হলো কৃষককে, তার ফেসে ক্যামেরা ঘুরে যেত। ফ্ল্যাপের মধ্য দিয়ে ওভার দ্য শোল্ডার শটে কৃষকের মুখ। তারা তাদের উন্নয়নের কথা বলছে। বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বীজে তাদের ফলন বেশি হচ্ছে। তারা মাছ চাষ করছে। সবজির ভালো ফলন পাচ্ছে। সর্বোপরি তাদের আয় বেড়েছে। এ কারণে তাদের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। এভাবেই চলেছে উন্নয়ন সাংবাদিকতা। ৩০ বছর পর এখন ওই সবুজ শার্ট পরে যখন গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই, তখন দূরের কৃষক আমাকে দেখলেই ডাক দেয়, জানায় তাদের উন্নয়ন কিংবা সমস্যার কথা।
সাধারণ মানুষ কিছু পেশার মানুষকে ভয় পায়; যেমন চোর, ডাকাত, পুলিশ। আর ভয় পায় সাংবাদিককে। সাংবাদিককে তার ভয় পাওয়ার কথা ছিল না। বরং সাংবাদিকের কাছে তার সবকিছু প্রাণ খুলে বলার কথা। কিন্তু আমরা আমাদের কারণে এই প্লাটফর্মটা হারিয়ে ফেলছি। প্লাটফর্ম হারাচ্ছি এই কারণে, আমরা আমাদের কলমকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছি, আমাদের ক্যামেরা বা মাইক্রোফোনকেও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছি। এ কারণে মানুষ স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারে না। তাদের সামনে মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে এভাবে একটু একটু করে এই পর্যায়ে আসতে হয়েছে।
আসলে এটাই উন্নয়ন সাংবাদিকতা। যে দেশে খাদ্যের নিরাপত্তা ছিল না, সে দেশে টেলিভিশন আর পত্রপত্রিকার মাধ্যমে খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেছে। হাজার মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন ঘটেছে। পোলট্রি শিল্প এখন বিশাল এক শিল্প। বছর জুড়ে নানা ধরনের শাক-সবজি খেতে পারছে মানুষ। এগুলো সম্ভব হয়েছে কৃষিবিদ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সরকার সর্বোপরি কৃষকের আন্তরিক ও কঠোর পরিশ্রমের কারণে। মিডিয়ার একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি তাদের একটু সাহায্য করছি। তাহলে এই সাংবাদিকতাই কি শুধু উন্নয়ন সাংবাদিকতা? তা কি শুধুই কৃষিকেন্দ্রিক?
আসলে এমনটি নয়। আমাদের সবকিছুর মধ্যেই উন্নয়ন সাংবাদিকতা নিহিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিশৃঙ্খল রাজনীতি সবকিছুর মধ্যেই উন্নয়ন সাংবাদিকতা হতে পারে। আমাদের মেধা কিংবা সাংবাদিকতার দক্ষতা দিয়ে এগুলোর মধ্যে থেকে উন্নয়ন সাংবাদিকতাকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। গোটা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটালেই কেবল সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব। ১৯৮০ সাল থেকে মানুষকে বলে এসেছি, কৃষি মানেই কেবল ধান আর পাট চাষ নয় কিংবা কৃষক মানেই গ্রামের সাধারণ মানুষ নয়। কৃষি হবে ইন্টিগ্রেটেড। যেটা দিয়ে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে, স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে।(চলবে…)
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
কৃষকের বন্ধু ও কৃষি উন্নয়ন এর পথিকৃৎ শাইখ সিরাজের ৭০তম জন্মদিন আজ
-
পঞ্চাশে বাংলাদেশ: এক টেলিভিশন তারকা আর দরিদ্র কৃষকের সন্তান এক বিজ্ঞানী যেভাবে পাল্টে দিয়েছেন বাংলাদেশের কৃষি
-
মাছ চাষে স্মার্ট প্রযুক্তির উদ্ভাবন বাংলাদেশি তরুণের
-
স্মার্ট ডিভাইসে মাছ চাষে বিপ্লব
-
চীনে পানিবিহীন হাঁসের খামার
-
পৌণে আট’শ বিঘা জমিতে তরুন উদ্যোক্তার কৃষি খামার
-
নতুন স্বপ্ন জাগাচ্ছে গোলাপী রঙের মহিষ
-
মাংস রান্নার স্বাস্থ্যকর উপায়
-
তামাক চাষীদের নিবন্ধনের আওতায় আনা হোক
-
টাঙ্গাইলে কলার আবাদ বাড়লেও সুবিধা নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী
সবজি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। কৃষি বিজ্ঞানের ভাষায় সবজিকে উদ্যানতাত্বিক ফসল (Horticultural crops) বলা হয়ে থাকে। পুষ্টিমানের দিক থেকে সবজি ফসল যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বাণিজ্যিকভাবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। সেজন্য সবজি চাষের আধুনিক কলাকৌশল জানা জরুরি।
আর আধুনিক কলাকৌশল বলতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদকেই বোঝানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু সবজি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তবে সারাদেশে যেমন সব ধরনের সবজি উৎপাদিত হয়না ঠিক তেমনি সকল সবজিই আবার সারাবছর উৎপাদিত হয়না। একেক অঞ্চলে একেক ধরনের শাকসবজি উৎপাদিত হয়ে থাকে। আবার বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ বিশেষ সবজির জাত উৎপাদন করা যায়।
সারাদেশে সারাবছরই যেসকল সবজি সহজে উৎপাদিত হয়ে থাকে তাদের কিছু শাকসবজির কথা এখানে তুলে ধরছি। লালশাক, ডাটাশাক, পুইশাক, কলমিশাক, মিষ্টিআলু শাক, ঢেড়শ, গাজর, বরবটি, টমেটো, লাউ ও লাউশাক, পাটশাক, শশা, কাঁচকলা, বেগুন, পেপে, করলা, কচুশাক, কচুর লতি, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা ইত্যাদি পরিচিত শাকসবজি। তাছাড়া অপরিচিত বিশেষ কিছু সবজি বিশেষ বিশেষ এলাকার বিশেষত্ব হিসেবে উৎপাদিত হয়ে থাকে। উপরোক্ত ফসলগুলোর মধ্যে কিছু শুধু শাক আর বাকীগুলো শাক এবং সবজি উভয় হিসেবেই প্রচলিত রয়েছে।
কৃষিতাত্বিকভাবে রবি (শীতকাল) ও খরিপ (গ্রীষ্মকাল)- এ দুধরনের মৌসুম রয়েছে। খরিপের আবার দুটি ভাগ, যথা- খরিপ-১ (আগাম গ্রীষ্ম) এবং খরিপ-২ (বর্ষাকাল)। তবে শীতকালীন শাকসবজির মধ্যে বাহারি ও রকমারি বৈচিত্র একটু বেশি। শুধুমাত্র শীতকালে উৎপাদিত হয় এমন ফসলগুলোর মধ্যে রয়েছে- টমেটো, শীতলাউ, ফুলকপি, বাধাকপি, গাজর, সীম, মূলা, ব্রকলি, বাটিশাক, ওলকপি, শালগম, বেগুন, গোল আলু ইত্যাদিই প্রধান। অপরদিকে শুধুমাত্র গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে উৎপাদিত হয় এমন ফসলের মধ্যে রয়েছে- বিভিন্ন ধরনের কচু, ওলকচু, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, কাকরোল, পটোল, করলা, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া ইত্যাদিই প্রধান।
সবজি ফসল উৎপাদন অন্যান্য ফসলের মতো নয়। সবজি ফসল উৎপাদনের জন্য বিশেষ ধরনের যত্নের প্রয়োজন হয়। আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবাদ করতে গেলে অল্প পরিমাণ জায়গায় অধিক পরিমাণ ফসল ফলিয়ে লাভবান হওয়া সম্ভব। সবজি আবাদেও জন্য বাড়ির আঙ্গিনায় অথবা অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গা বেছে নিতে হবে। সেখানে ভালোভাবে চাষ-মই দিয়ে জমির মাটি জো অবস্থায় ঝুরঝুরে করে সেখানে এক মিটার প্রশস্ত এবং প্রয়োজনমত জমির আকার-আকৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে লম্বা বেড তৈরী করে নিতে হবে। প্রতিটি বেডের মাঝখানে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি পরিমাণ গর্ত করে নালা সৃষ্টি করতে হবে। অর্থাৎ নালার মাটি তুলেই দুইপাশে বেড প্রয়োজনমত উঁচু করতে হবে।
এভাবে বেড তৈরীর একটি বিশেষত্ব হলো শাকসবজি চাষাবাদ অন্য সাধারণ ফসল আবাদের চেয়ে একটু ভিন্ন। এর জন্য প্রয়োজন হয় বাড়তি সতর্কতা ও যত্নের। শাকসবজির চাষাবাদে যেমন শুষ্ক মৌসুমে সেচের চাহিদা থাকে অপরদিকে বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি বের করে দেওয়ার প্রয়োজন হয়। সেজন্যই বেড তৈরী করে মাটি কিছুটা উঁচু করা হয় সেখানে আবার নালা তৈরী করে নিষ্কাষনের ব্যবস্থাও রাখা হয়। কিন্তু বেড এবং নালা তৈরী না করলে সেটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবাদ হয়না। সেঠা হয় সাধারণ শাকসবজি চাষ। এতে ফলন অনেক কমে যায়।
পেপে, কাঁচকলা- এ জাতীয় সবজি বসতবাড়ির আঙ্গিনায়, রাস্তা বা পুকুরের ধারে সহজেই আবাদ করা যায়। লালশাক, ডাটা শাক, পাটশাক, মূলাশাক, গাজর, শালগম ইত্যাদি সবজি তৈরীকৃত বেডে ছিটিয়ে বীজ বুনে দিলেই ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাছাড়া টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, বাধাকপি, ঢেড়শ, কচু, ওলকচু ইত্যাদি সবজি এক মিটারের বেডে দুই সারি করে নির্ধারিত দূরত্বে চারা লাগিয়ে আবাদ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। সেজন্য এসব সবজি উৎপাদনের জন্য আলাদাভাবে নার্সারিতে চারা তৈরী করে নিতে হয়। অপরদিকে লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শশা, চাল কুমড়া, পটোল, কাকরোল, করলা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, সীম, বরবটি ইত্যাদি লতাজাতীয় সবজি চাষের জন্য উক্ত বেডে দুইটি সারি করে সেখানে জাংলা দিয়ে দিতে হয়। সাধারণত বেডের দুইপাশে খুটি দিয়ে পরে তা ইংরেজি অক্ষর ‘এক্স’ আকৃতিতে বা ‘ভি’ আকৃতিতে বাঁকিয়ে বেঁধে দিতে হয়।
বেড ছাড়াও লতাজাতীয় এসব সবজি অতি সহজেই ক্ষেতের আইলে, রাস্তার ধারে, পুকুরের পাড়ে বিশেষ ব্যবস্থায় আবাদ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে অন্যান্য যেকোন ফসলের তুলনায় এসব সবজি ফসলের একটু বেশি যত্নের প্রয়োজন হয়। বিনা আবাদেই এসব সবজি চাষ করা যেতে পারে। সেজন্য বন্যা পরবর্তীতে পুনর্বাসনের সময় বিনাচাষে এসব আবাদের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ জৈবভাবেই এসব সবজি ফসল উৎপাদন সম্ভব। আবাদের পূর্বে সামান্য পরিমাণ প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার ব্যবহার করে বাকীটা মেটাতে হবে বাড়িতে উৎপাদিত জৈব সারের মাধ্যমে। তারপর আন্তপরিচর্যা এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতেও জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। তখন এসব উৎপাদিত ফসল সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
কাজেই এভাবেই সারাবছর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বষ্পপরিসরে শাকসবজি উৎপাদন করে নিজের চাহিদা মিটিয়ে তা বাণিজ্যিকভাবেও লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমাদের শারীরিক পুষ্টি চাহিদার একটি বিরাট অংশ শাকসবজি থেকে আসা দরকার। দৈনিক একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের গড়ে কমপক্ষে আড়াইশ গ্রাম শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। আর সেটা নিবিড়ভাবে এবং নিরাপদভাবে খেতে হলে নিজের উৎপাদিত শাকসবজি খাওয়াই সবচেয়ে উত্তম। কাজেই আমাদের সারাবছর অলস সময়টাকে কাজে লাগিয়ে আসুন নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় সবজির বাগান গড়ে তুলি।
একজন টেলিভিশন তারকা, কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের জন্মদিন আজ। তিনি ১৯৫৪ সালের এদিনে জন্মগ্রহণ করেন চাঁদপুরে (সার্টিফিকেট অনুযায়ী তার জন্মতারিখ ২৮শে জুন ১৯৫৬)। শাইখ সিরাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ভূগোলে। ছাত্রজীবনেই সম্পৃক্ত হন বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতার ও সংবাদপত্রের সঙ্গে।
শাইখ সিরাজ ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড, চ্যানেল আই-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও বার্তা প্রধান। টানা সাড়ে চার দশক ধরে তিনি গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে দেশের কৃষি ও কৃষক তথা উৎপাদন-অর্থনৈতিক খাতে অপরিসীম ভূমিকা রেখে চলেছেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সকল শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে বিপুল গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেন তিনি। পরে তার নিজস্ব পরিচালনাধীন টেলিভিশন ‘চ্যানেল আই’তে শুরু করেন কৃষি কার্যক্রম হৃদয়ে মাটি ও মানুষ। উন্নয়ন সাংবাদিকতার জন্য তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দু’টি রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৮) ও একুশে পদক (১৯৯৫) লাভ করেন।
টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রায় চার দশকের একনিষ্ঠ পথচলার মধ্য দিয়ে শাইখ সিরাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন উন্নয়ন সাংবাদিকতার এক অগ্রপথিক হিসাবে। গণমাধ্যমে তার উদ্বুদ্ধকরণ প্রচারণায় আমূল পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশের কৃষিতে। বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে বৈপ্লবিক সাফল্য।
গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। একইসঙ্গে শহর-নগরের মানুষকে করেছেন কৃষিমুখি। ফলে দেশের অর্থনীতিতে কৃষির বহুমুখি অবদান সূচিত হয়েছে।
‘মাটি ও মানুষ’
বাংলাদেশের কৃষিতে গত কয়েক দশকে যে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে, শাইখ সিরাজকে বর্ণনা করা হয় সেই পরিবর্তনের পেছনে অন্যতম প্রধান এক চরিত্র হিসেবে।
বাংলাদেশে যখন বিজ্ঞানীরা একের পর এক নতুন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করে চলেছেন, কৃষিতে নতুন ধ্যান ধারণা এবং কৌশল চালুর জন্য সরকারের নানা পর্যায় থেকে চেষ্টা চলছে, সেগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে বিরাট ভূমিকা রাখে তার কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান, ‘মাটি ও মানুষ।’
“শুরুতে এই অনুষ্ঠানটা হতো আমার দেশ নামে। তখন এটি ৫০ মিনিটের পাক্ষিক অনুষ্ঠান। পরে এটিকেই ‘মাটি ও মানুষ’ নামে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করি। আমার মনে হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের চেয়ে বেশি দরকার শিক্ষামূলক মোটিভেশনাল অনুষ্ঠান। কৃষকদের যদি নতুন বীজ, নতুন প্রযুক্তি, নতুন কৌশল, এসব ঠিকমত বোঝানো যায়, তাহলে কৃষিতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব।”
গত চার দশক ধরে শাইখ সিরাজ হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে কৃষি বিষয়ক তথ্যের প্রধান উৎস। উনিশ’শ আশির দশকে, যখনো টেলিভিশন ঘরে ঘরে পৌঁছায়নি, তখনো গ্রামের হাটেবাজারে, কমিউনিটি সেন্টারে প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় ‘মাটি ও মানুষ’ দেখার জন্য ভিড় করতো মানুষ।
তবে কৃষকদের নতুন ধরণের কৃষিতে উৎসাহিত করার কাজটা সহজ ছিল না।
“আজকের কৃষক এবং তিরিশ বছর আগের কৃষকের মধ্যে তফাৎ আকাশ আর পাতাল। তখন কৃষকের কাছে একজন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা যে কথা বলতেন, একজন টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে আমি যেকথা বলতাম, সেটা তারা মানতে চাইতো না। তারা ভাবতো, আমরা যেধরণের কৃষির কথা বলছি, যদি সেটাতে ভালো ফসল না হয়? এ কারণে সে সহজে মোটিভেট হতে চাইতো না। সহজে নতুন প্রযুক্তি নিতে চাইতো না।”
“আমি যখন আশির দশকে উচ্চফলনশীল নতুন জাতের ধানের কথা বলছি, গমের কথা বলছি, তখন পরিস্কার তারা আমাকে বলতো এই রাবার ভাত খাবো না। তখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধানের মান তেমন ভালো ছিল না। ভাতটা ছিল রাবারের মতো, ভাতের দানা উপর থেকে থালার উপর ফেললে সেটি রাবারের মতো ড্রপ করতো।”
কিন্তু বিজ্ঞানীরা যখন তাদের গবেষণায় নতুন নতুন সাফল্য পাচ্ছিলেন, আর সেই সঙ্গে শাইখ সিরাজও তার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকদের মন জয় করার জন্য নতুন কৌশল নিচ্ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অশোকা ফেলো শাইখ সিরাজ খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র বিমোচন বিষয়ে সাংবাদিকতায় অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসাবে তিনি ২০০৯ সালে অর্জন করেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এ এইচ বুর্মা এ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া তিনি পেয়েছেন এশিয়ার মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার গুসি পিস প্রাইজ, বৃটেনের বিসিএ গোল্ডেন জুবিলি অনার এ্যাওয়ার্ডস। বৃটিশ হাউজ অব কমন্স তাকে প্রদান করেছে বিশেষ সম্মাননা, বৃটিশ-বাংলাদেশ ব্যবসায়ী সংগঠন তাকে দিয়েছে গ্রীন এ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া পেয়েছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির স্বর্ণপদক, ডা. ইব্রাহিম মেমোরিয়াল স্বর্ণপদক, রণদা প্রসাদ সাহা স্বর্ণপদকসহ অর্ধশত দেশি-বিদেশি পুরস্কার ও সম্মাননা।
চ্যানেল আই ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখে থাকেন। তিনি এদেশে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে নিরস বিষয় হিসাবে উপেক্ষিত কৃষিতে জাতীয় সংবাদের প্রধান খবরের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শাইখ সিরাজের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- মৎস্য ম্যানুয়েল, মাটি ও মানুষের চাষবাস, ফার্মার্স ফাইল, মাটির কাছে মানুষের কাছে, বাংলাদেশের কৃষি: প্রেক্ষাপট ২০০৮, কৃষি ও গণমাধ্যম, কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট (সম্পাদিত), আমার স্বপ্নের কৃষি, কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট (২০১১), সমকালীন কৃষি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (২০১১), কৃষি ও উন্নয়ন চিন্তা (২০১৩) ইত্যাদি।
মেহেরপুর: পতিত ও অনুর্বর বেলে মাটির জমিতে চিনাবাদাম চাষ করে লাভবান হচ্ছেন মেহেরপুরের চাষিরা। ফলন ও বাজার দর ভালো এবং কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় দিন দিন এই এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাদামের চাষ।
সদর উপজেলার মদনাডাঙ্গা, শ্যামপুর, টেংগারমাঠ ও গোপালপুর গ্রামের অধিকাংশ জমির মাটি বেলে। ফলে এই এলাকার চাষিরা ধান, গম, পাটসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করে খুব একটা লাভবান হতে পারেন না।
ধান কাটার পর এ সব জমি সাধারণত পতিত থাকে। এজন্য ৯০ দিনের ফসল হিসেবে অল্প খরচে বাদাম চাষ করছেন এলাকার চাষিরা।
মেহেরপুর জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলায় এবার বাদাম চাষ হয়েছে ১৫ হেক্টর জমিতে। এবার এক বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করতে চাষিদের খরচ হয়েছে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা সেক্ষেত্রে বাদামের ফলন হয়েছে ৬ থেকে ৭ মণ। আর এ ফলনে প্রায় ২০ হাজার টাকা ঘরে তুলছেন তারা। বাজারে প্রতিমণ বাদাম বিক্রি হচ্ছে ২৭শ’ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। সদর উপজেলার মদনাডাঙ্গা গ্রামের বাদাম চাষি খাঁজা আহমেদ, কাওছার আলী ও ফিরোজ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, এলাকার মাটি বেলে হওয়ায় সাধারণত সবজি, আলু ও অন্যান্য ফসল চাষ করার পর জমি পতিত থাকে। সে সময়ে চিনা বাদামের চাষ করা হয়। বাদাম চাষে খরচ কম এবং উৎপাদন ও বাজার দর ভাল। তাই দিন দিন চাষিরা তাদের পতিত জমিতে চিনা বাদামের চাষ শুরু করছেন।
এছাড়া বাদাম ছাড়ানো, শুকানোসহ যাবতীয় কাজ করে থাকেন এখানকার নারীরা। বাদামের গাছ আবার শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করছেন গৃহিণীরা।
নারী শ্রমিক সাহানা খাতুন ও জরিমন নেছা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বাদাম ছাড়ানো ও শুকানোর কাজ করে থাকি। এলাকার ২৫/৩০ জন নারী শ্রমিক এ কাজ করে আসছেন।
গৃহিণী সাজেদা খাতুন ও জামেলা খাতুন জানান, বাদামের লতা জালানি হিসেবে বেশ ভাল। তাই লতাও বিক্রি হচ্ছে।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আক্তারুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, চিনা বাদামের চাষ সাধারণত পতিত জমিতে হয়ে থাকে। এলাকার চাষিরা এই জমিতে বাদামের চাষ করে বাড়তি আয় করছেন। তাই বাদাম চাষ যাতে আরও সম্প্রসারিত হয় সেজন্য কৃষি বিভাগ চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছে।
সিলেট বিভাগের উচ্চমাত্রার অ্যাসিডিক জমিতে গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধাসহ বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কৃষি বিজ্ঞানিরা মৌলভীবাজারের আকবরপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে ফুল চাষ করে সফল হয়েছেন। এ ফুল চাষ মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে ১০০ চাষিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে কৃষি গবেষণা কেন্দ্র।
কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যমতে, যশোরে বাণিজ্যিকভাবে গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল চাষ হয়। যার বাজার দর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। যশোরের ফুল সারাদেশের পাশাপাশি সিলেটেও আসে প্রচুর। সিলেটে ফুলের বাজার শত কোটি টাকার উপরে। কিন্তু সিলেটে ফুলের চাষ বাণিজ্যিকভাবে হয় না।
সিলেট বিভাগের মাটি অ্যাসিডিক হওয়ায় ফুল চাষ করা যাবে না, সেটাই ছিল প্রচলিক ধারণা। কিন্তু এ ধারণাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যদিয়ে ভুল প্রমাণ করেছেন মৌলভীবাজার আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের একদল গবেষক। মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এস এম শরিফুজ্জামানের নেতৃত্বে উচ্চমাত্রার অ্যাসিডিটিক জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে ফুল চাষ করে সফল হয়েছেন তারা। এ পরীক্ষামূলক চাষে ফলনও হয়েছে ভালো। তাই সিলেট অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট অঞ্চলে অনেক জায়গা অনাবাদি ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। প্রবাসীরা দেশের বাইরে অবস্থান করায় তাদের অনেক জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। এ জমিকে আবাদের আওতায় আনতে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষের উদ্যোগ নিয়ে আগ্রহী ১০০ চাষিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে আমন ধান কাটার পর এ অঞ্চলের অনেক জমি পতিত থাকে। ফলে ফুল চাষ করে অনাবাদি জমি থেকে কোটি টাকা উপার্জন সম্ভব।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মিরানা আক্তার সুমি জানান, চাষিরা প্রশিক্ষণ শেষে অনেক কিছু শিখেছেন। কী পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে হয়, তা জেনেছেন। ধানের চেয়ে যেহেতু ফুলের দাম বেশি, তাই ফুল চাষে তাদের আগ্রহ বাড়ছে।
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সরফ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভালোভাবে জমি চাষ করে নির্দেশিত মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হয়। অন্য ফসলের মতোই এর চাষ পদ্ধতি সহজ। বেড তৈরি করে ফুল চাষ করতে হয়। প্রতিটি বেডের দৈর্ঘ যে কোন মাপের হতে পারে। তবে প্রস্থে ১.২-১.৫ মিটার হলে ভালো।’
তিনি বলেন, ‘কলম (বীজ) লাগানো থেকে তিন মাস পর স্টিক সংগ্রহ শুরু হয়। সংগ্রহ করা যাবে পরবর্তী ২৫ দিন। গ্লাডিওলাস ৫টি জাতসহ মোট ১২টি প্রজাতির ফুলের পরীক্ষা করে আমরা সফল হয়েছি।
সবুজ বিপ্লবের সময়ে পেস্টিসাইড ব্যবহারকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জীব বৈচিত্র্য, মাটির স্বাস্থ্য ও ফসলের গুণমানতা। এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে, এত রাসায়নিক পেস্টিসাইড ব্যবহার করা কি ঠিক হচ্ছে? এ প্রশ্ন শুধু ভারতে নয়, সারাবিশ্বের কৃষকসমাজ ও শস্যবিজ্ঞানীদের কাছে। তাই মনে হয় জৈব নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্ব দিয়ে সুসংহত রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণ আগামী দিনে একমাত্র সমাধানের রাস্তা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
চলমান খরিফ মরসুমে আমাদের রাজ্যে প্রধানত ধান, খরিফ পেঁয়াজ, জুট, ইক্ষু, তিল ইত্যাদি ফসলের চাষ হয়ে থাকে। এ রাজ্যে ধানে ঝলসা রোগের আক্রমণ একটি গুরুতর বিষয়।
জৈব পদ্ধতিতে এই রোগ দমন করার একটি সহজ উপায় রয়েছে। ৫০ মিলিলিটার কেরোসিন তেলে ৮৫ গ্রাম থেঁতলানো রসুন মিশিয়ে ২৪ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এরপর ৯৫০ মিলি. জল ও ১০ মিলি. তরল সাবান মিশিয়ে ভালোভাবে নেড়ে নিয়ে বোতলে রেখে দিতে হবে। ১৯ লিটার জলের সাথে ১ ভাগ মিশ্রণ মিশিয়ে সকালে/বিকেলে স্প্রেয়ার দিয়ে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করতে হবে।
এই মিশ্রণটি আমেরিকান বোল ওয়ার্ম, আর্মি ওয়ার্ম, পেঁয়াজ-এর চিরুনি পোকা, আলুর টিউবার মথ, রুট নট নিমাটোড (কৃমি), আখের কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা, ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ, ডাউনি মিলডিউ ও ধানের ঝলসা রোগ প্রতিরোধে খুবই কার্যকরী।
এছাড়া বিভিন্ন ধরণের পাতা খেকো পোকা ও জাব পোকা নিয়ন্ত্রণে ১ কেজি পেঁয়াজ থেঁতো করে ১ লিটার জলের সাথে মিশিয়ে ২৪ ঘণ্টা রেখে দেবার পর কচলিয়ে রস নিংড়ে নিতে হবে। প্রাপ্ত নির্যাসের সাথে ১০ লিটার জল মিশিয়ে আক্রান্ত ফসলে স্প্রে করতে হবে।
জৈব সার প্রয়োগ ও জৈব কীটনাশক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন খরচ শতকরা ২৫-৩০ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব। উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন প্রযুক্তিতে উৎপাদিত জৈব সার, শাকসব্জী ও অন্যান্য ফসলের প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম-এর সাথে অণুখাদ্যের যোগান দেয়।
জৈব পদ্ধতিতে উৎপন্ন কীটনাশক ও ছত্রাকনাশকগুলি ফসলে কোনওরকম দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ব্যতিরেকে, পোকা ও রোগ দমনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এতে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও উর্বরতা দীর্ঘমেয়াদী হয়। উৎপাদিত ফসল হয় স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ।
বন্ধুপোকা মাকড়ের (পরজীবি ও পরভোজী) সংরক্ষণের জন্য জমির পাশে অব্যবহৃত জায়গায় ত্রিধারা, উঁচুটি, শালিঞ্চে ইত্যাদি আগাছা জাতীয় গাছের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
দূরদর্শী পদক্ষেপের মাধ্যমে রাসায়নিক কৃষি বর্জন করে প্রাণ বৈচিত্র্য নির্ভর জৈব কৃষির মাধ্যমে খাদ্যে সার্বভৌমত্ব আনা সম্ভব। তাই জৈব কৃষির পথে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে কৃষিবিষমুক্ত, স্বাস্থ্যসম্মত সমাজ গড়ে তোলাই বাঞ্ছনীয়।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন