ইসলাম
অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ার কুরআনি আমল ও দোয়া
লেখক
জাগোনিউজ২৪.কমযে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব বা সদ্ভাব বজায় রাখার আমল শেখায় কুরআন। কুরআনের উপদেশ ও নীতিবাক্য মানুষের জন্য অমূল্য আমল। এ আমলে যে কোনো লিঙ্গ, বর্ণ, গোত্র ও জাতি-গোষ্ঠীর মানুষকে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বে পরিণত করে দেয়; তা এক আরব সাহিত্যিকের নিজের বাস্তব জীবনের ঘটনা ও আমলে ফুটে উঠেছে।
অন্তরঙ্গ মুহূর্ত, সুসম্পর্ক ও সুন্দর জীবন লাভে কুরআনের ছোট্ট একটি উপদেশই মানুষের সব শত্রুতা ও মনের অমিল পাল্টে দিতে পারে। ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক নজির রয়েছে। ইসলাম ও মুসলমানদের জীবনে যুগে যুগে এ নজির চলমান।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে-
এ আমল করতেন স্বয়ং বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এ আমল ছিল সাহাবায়ে কেরামের জীবনে। তাবেয়িন, তাবে তাবেয়িন ও আউলিয়ায়ে কেরামের জীবনেও রয়েছে হাজারো প্রমাণ। আরব সাহিত্যিক শায়খ সুলাইমান জিলানির একটি ঘটনাও তার নজিরবিহীন প্রমাণ।
কুরআনুল কারিমের একাধিক আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা অন্তরঙ্গ ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার সে উপদেশ তুলে ধরেছেন। যে উপদেশ মেনে চলায় বা আমল করায় শত্রুও বন্ধুতে পরিণত হয়। থাকে মনের কোনো অমিল। আল্লাহ তাআলা বলেন-
– ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَصِفُونَ
‘মন্দ কথার প্রতি উত্তরে তাই বলুন; যা উত্তম। আমি সেই বিষয়েও সবিশেষ অবগত; তারা যা বলে।’ (সুরা মুমিনুন : আয়াত ৯৬)
– وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ
‘সব ভালো ও মন্দ পরস্পর সমান নয়। আপনি মন্দের জবাবে ওই কথা বলুন; যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবেন আপনার সঙ্গে যে ব্যক্তির শুত্রুতা রয়েছে, সেও যেন আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু।’ (সুরা হামিম : আয়াত ৩৪)
সুসম্পর্ক গঠনে প্ররোচনামুক্ত থাকার দোয়া
মানুষ যত মন্দ কথা বলে; এর উদ্ভাবক হচ্ছে বিতাড়িত শয়তান। এ কারণেই মহান আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে মানুষের মন্দ কথা জবাবে উত্তম কথা বলার নসিহত পেশ করেছেন। আর আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তানের প্ররোচনায় মন্দ কথা, কাজ ও আচরণ থেকে বিরত থাকতে তিনি বিশ্বনবিকে এ মর্মে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা দোয়া শিখিয়েছেন-
رَّبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ
উচ্চারণ : ‘রাব্বি আউজুবিকা মিন হামাযাতিশ শায়াত্বিন।’
অর্থ : ‘হে আমার প্রভু! আমি শয়তানের প্ররোচনা (মন্দ কথা) থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ (সুরা মুমিনুন : আয়াত ৯৭)
মন্দের জবাবে ভালো আচরণ
মন্দ কথা, কাজ ও আচরণের জবাবে ভালো কথা, কাজ ও আচরণ দেখানো নিঃসন্দেহে পরস্পর অন্তরঙ্গ সুসম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম উপায়। ফলে কারও মাঝে শত্রুতা, ভুল বোঝাবুঝি থাকে না। যে কোনো ব্যক্তির সঙ্গেই গড়ে ওঠে সুসম্পর্ক অন্তরের মিল।
ভারতের একটি ইসলামিক ম্যাগাজিন ‘মাসিক আরমোগান‘। এ ম্যাগাজিনে ইসলামিক স্কলার ও দাঈ মাওলানা মুহাম্মাদ কালিম সিদ্দিকী বিখ্যাত আরবি সাহিত্যিক শায়খ সুলাইমান আল-জিলানির এমনই একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন-
একবার বিখ্যাত আরবি সাহিত্যিক শায়খ সুলাইমান আল জিলানি তার নিজের একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি একবার তার দুই সঙ্গীসহ নিজ গাড়িতে চড়ে এক সফরে বের হন। সফরের রাস্তার ওপর কতগুলো উট পথ বন্ধ করে রাখে। তিনি দেখলেন, দলবদ্ধ উটের সঙ্গে রাস্তার অপর পাশে একটি গাড়িতে বৃদ্ধ একজন লোক বসে আছে।
শায়খ জিলানি বলেন, আমি গাড়ি সামনে নিতে পারছিলাম না উটগুলোর কারণে। উটের রাখালরা উটগুলোকে হাঁকাচ্ছে ঠিকই কিন্তু সেগুলো রাস্তা থেকে সরছে না।
আমি ভাবলাম- হর্ন বাজালে হয়তো উটগুলো রাস্তা ছেড়ে দেবে। তাই আমি আমার গাড়ির হর্ন বাজালাম।
হর্ন বাজানোর কারণে রাস্তার অপর পাশে গাড়িতে বসা বৃদ্ধ (উটের মালিক) আমাকে গালাগাল শুরু করে। আমার বাবাকেও অভিশাপ দিতে থাকে। সে বলছে-
অভিশাপ পড়ুক এমন বাবার উপর, যে তোমার মতো ছেলেকে জন্ম দিয়েছে। আমার উট সরাতে হর্ন বাজানোর তুই কে! তোকে যে জন্ম দিয়েছে তার উপরও অভিশাপ, যা তা বলে ওই বৃদ্ধ আমাকে গালি দিতে থাকে। ফলে বৃদ্ধের উপর আমার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো।
সাধারণ একটি হর্নের জন্য আমাকে এভাবে গালাগালের বিষয়টি আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। আর আমি তো ভালোর জন্যই হর্ন বাজিয়েছিলাম; হয়ত আমার হর্ন শুনে উট চলতে শুরু করবে। অথচ হর্নের বদলায় এমন গালি শুনতে হলো?
শায়খ আল-জিলানি বলেন, আমি গাড়ি থেকে বের হয়ে সজোরে গাড়ি দরজা বন্ধ করে জামার হাতা গুটাতে গুটাতে উটের মালিকের গাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম।
গাড়িতে থাকা আমার দুই সঙ্গীর একজন বলছিল- আপনি কী করতে (ঘটনা ঘটাতে) যাচ্ছেন! আর গাড়ির বৃদ্ধ লোকটি আমরা অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলে।
আমি আমার সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বললাম, আজ নতুন কিছু দেখবেন বলে আমি বৃদ্ধের গাড়ির কাছে গিয়ে উচ্চ শব্দে তার গাড়ির দরজা খুলেই তার কপালে চুম্বন করলাম। আর বললাম-
‘আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন, আমি আপনার উটকে হরণ দিয়ে ভুল করে ফেলেছি। উটকে কষ্ট দিয়েছি। আপনার উটকে কষ্ট দেয়া মানে আপনাকে কষ্ট দেয়ার শামিল। আসলেই আপনার প্রতি বড় অন্যায় করে ফেলেছি। সতুরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন।
বৃদ্ধ আশ্চর্য হয়ে আমাকে বলল-
বেটা! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমি তো অন্যায় করনি; বরং আমি তোমার বাবা-মাকে গালি দিয়েছি, অভিশাপ দিয়েছি। অথচ তুমি আমার কপালে চুমু খেয়েছ। বরং তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।
তখন আমি বললাম-
যেহেতু আপনি আমার বাবা-মা এমনকি আমাকে অভিশাপ দিয়েছেন, গালাগাল করেছন। আল্লাহর কসম! আমি কেয়ামত পর্যন্ত আপনাকে ক্ষমা করব না। তবে একটি শর্তে আপনাকে ক্ষমা করতে পারি। যদি আপনি তা মানতে রাজি হন।
বৃদ্ধ লোকটি শর্ত মানতে রাজি হলেন এবং শর্ত জানতে চাইলেন।
আমি বললাম, আমাদের উটেরদুধ পান করাতে হবে। এ কথা শুনে বৃদ্ধ মালিক খুশি হলো এবং রাখালদের দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলো। মেহমানদারির আদেশ দিলো। অতপর আমরা পেটভরে উটের দুধ পান করি।
শায়খ আল-জিলানি বলেন, আমি বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলাম- আপনি শের পারেন? তিনি আমাদের শের শুনাতে শুরু করে। অনেক কবিতা শুনায় আমাদের। এভাবে আধাঘণ্টা অতিবাহিত হলো। অতপর আমরা ওঠার অনুমতি চাইলাম। বৃদ্ধ আমাদের ছাড়বে না বলে জড়িয়ে ধরলেন।
বৃদ্ধ বললেন, আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের ভালোবেসে ফেলেছি। তোমাদের এভাবে যেতে দেবো না।
আমি বৃদ্ধকে বললাম, এমনিতেই আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাদের তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আল্লাহর ইচ্ছায় পরে এক সময় আপনার মেহমান হবো। এখন যাওয়ার অনুমতি দিন
বৃদ্ধ আবদার জানালেন- হে তিন যুবক! উটের পেছনে পর্দার ভেতরে আমার তিন কন্যা রয়েছে; আর তোমরা তিন জনও আলেম এবং বুদ্ধিমান। তোমরা তাদের বিয়ে করে আমাকে সম্মানিত কর।
কুরআনি নসিহতের উপহার
এ ছিল কুরআনের ছোট্ট নসিহতের উপর আমল করার উপহার। মন্দ কথা ও আচরণের জবাবে শায়খ জিলানির উত্তম আচরণ এ বৃদ্ধকে একান্ত আপন ও অন্তরঙ্গ করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে। এ কথাই এসেছে কুরআনে-
‘সব ভাল ও মন্দ পরস্পর সমান নয়। তাই আপনি মন্দের জবাবে ওই কথা বলুন; যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবেন আপনার সঙ্গে যে ব্যক্তির শুত্রুতা রয়েছে, সেও যেন আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু।’ (সুরা হামিম : আয়াত ৩৪)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, যে কারও কটু কথা, খারাপ আচরণ ও গালাগাল শুনে ক্ষেপে না যাওয়া। বরং সুন্দর ও উত্তম ভাষায় মন্দ কথার জবাব দেয়ার মাধ্যমে শত্রু কিংবা মনের অমিল ব্যক্তিকেও আপন করে নেয়া। শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্ত থাকতে কুরআনে শেখানো ভাষায় আল্লাহর সাহায্য চাওয়াও জরুরি।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে শত্রু কিংবা মিত্রদের মন্দ কথা ও আচরণের জবাবে উত্তম ভাষায় কথা বলার তাওফিক দান করুন। কুরআনের উত্তম নসিহতের আমলে শত্রুকে আন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
লাভজনক সবজি চাষ পদ্ধতি
-
কৃষকের বন্ধু ও কৃষি উন্নয়ন এর পথিকৃৎ শাইখ সিরাজের ৭০তম জন্মদিন আজ
-
যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে হতে পারে সারের সংকট
-
বিদেশ থেকে খালি হাতে ফিরে ড্রাগন চাষে সাফল্য
-
নাসিরনগরে বন্যায় তলিয়ে গেল কৃষকের বাদামখেত
-
পানি দিতে অতিরিক্ত টাকা
-
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
-
‘শিক্ষিত কৃষক’ বলেই তাঁকে নিয়ে মানুষের আগ্রহটা বেশি
-
ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বীজ কিনে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত
-
বোরো কাটতে বাড়তি খরচ ঃ হাসি নেই কৃষকের মুখে
দেশের আকাশে ১৪৪৩ হিজরি সালের পবিত্র রবিউস সানি মাসের চাঁদ দেখা গিয়েছে। ফলে রবিবার থেকে পবিত্র রবিউস সানি মাস গণনা করা হবে।
সেই হিসেবে দেশে আগামী ১১ রবিউস সানি ১৪৪৩ হিজরি (১৭ নভেম্বর, বুধবার) পবিত্র ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম পালিত হবে।
শনিবার ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এদিন সন্ধ্যায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পূর্ব সাহানে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী এনামুল হাসান।
সভায় সব জেলা প্রশাসন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়, বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে পবিত্র রবিউস সানি মাসের চাঁদ দেখার ব্যাপারে নিশ্চিত হয় চাঁদ দেখা কমিটি।
নামাজে থাকাকালীন কারও মনে সংশয় জাগে কত রাকাত হলো, রাকাত ভুলে ছুটে যায়নি তো? কিংবা নামাজের পরেও সন্দেহ জাগতে পারে রাকাত পূর্ণ হয়েছে নাকি হয়নি। নামাজের রাকাতসংখ্যায় সন্দেহ হলে কী করবেন- সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা:
নামাজ পড়ার সময়ে রাকাতসংখ্যা নিয়ে সন্দেহ হলে এবং এই সন্দেহ প্রথমবারের মতো হলে ওই নামাজ বাতিল হয়ে যাবে। নামাজ পুনরায় পড়া আবশ্যক। (ইবনে আবি শায়বা, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২৮)
নামাজের সালাম ফেরানোর পর যদি রাকাতসংখ্যা নিয়ে সন্দেহ হয়, তবে তার নামাজ বাতিল হয়ে যাবে। (ইবনে আবি শায়বা, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২৮)
কারও যদি নামাজের পর দৃঢ়বিশ্বাস হয় যে কিছু রাকাত পড়া হয়নি এবং যদি নামাজ পরিপন্থী কোনো কাজ না হয়ে থাকে, তাহলে ছুটে যাওয়া রাকাত পড়ে নেবে। যদি নামাজ পরিপন্থী কোনো কাজ হয়ে যায়, তাহলে ওই নামাজ পুনরায় পড়বে। (ইবনে আবি শায়বা, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২৪)
যে ব্যক্তির প্রায় সময় সন্দেহ হয় এবং সন্দেহ তার অভ্যাসে পরিণত হয়, তবে যেদিকে তার মন বেশি যায়, সেটার ওপর আমল করবে। যদি সব বিষয়ে ধারণা সমান হয়, তবে কমটির ওপর আমল করবে এবং প্রতি রাকাতকে নামাজের শেষ মনে করে বসবে এবং শেষে সিজদায়ে সাহু করবে। (মুসলিম, হাদিস: ৮৮৮)
তিন রাকাত পড়া হয়েছে নাকি চার রাকাত- সে ব্যাপারে সন্দেহ হলে তিন রাকাত মনে করে চতুর্থ রাকাত পড়বে। এরপর শেষে সিজদায়ে সাহু করবে। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৬৭৭)
প্রিয় নবির ঘর সুমহান আদর্শের কেন্দ্রবিন্দু। এ ঘর থেকে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তম আদর্শ, পরিপূর্ণ আদব, অতুলনীয় শিষ্টাচার ও স্বাধীন সমাজ ব্যবস্থা। নবিজীর যুগে এমন সমাজ ব্যবস্থা প্রবতির্তত হয়েছিল যে, পরিবারের সবাই সমভাবে কাজ করতেন। পুরুষরা স্ত্রীদের কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন। আর একটি সময় হলেই সবাই একত্রিত হতেন। তা ছিল নামাজের আজান। আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুহূর্তের মধ্যে সবাই কাজ রেখে নামাজ পড়তে মসজিদে একত্রিত হতেন।
স্বয়ং বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিবারিক কাজে সময় দিতেন। স্ত্রীদের কাজে সহযোগিতা করতেন। নামাজের আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ ছেড়ে দিতেন। হাদিসে পাকের একাধিক বর্ণনা থেকে প্রমাণিত যে-
১. হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ঘরে কী কী কাজ করতেন? তিনি উত্তর দেন-
كان بشرًا من البشر: يفلي ثوبه ويحلب شاته، ويخدم نفسه
‘তিনি একজন মানুষ ছিলেন, তিনি তাঁর কাপড় সেলাই করতেন, ছাগলের দুধ দহন করতেন এবং নিজের কাজ নিজেই করতেন।’ (মুসনাদে আহমাদ)
তিনি কি শুধু সাধারণ মানুষের মতো মানুষ ছিলেন? না তিনি ছিলেন চারিত্রিক মাদুর্য ও বিনয়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কোনো গুণেই কেউ তার সমকক্ষ ছিল না। তিনি যেমন বিনয়ী ছিলেন, তেমনি ছিলেন অহংকারমুক্ত মানুষ।
প্রিয় নবি কেমন মানুষ ছিলেন? তিনি কোনো দিন কাউকে কষ্ট দেননি। তিনি ছিলেন প্রতিটি কাজে অংশগ্রহণকারী সেরা মানুষ। অন্যকে সেরা সাহায্যকারী ও শ্রেষ্ঠ মানুষ। ইবাদত-বন্দেগি ও আল্লাহর হুকুম পালনে তিনি ছিলেন অনুকরণীয় আদর্শ। তাঁর প্রতি নাজিল হয়েছে এ আয়াত-
لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰهِ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰهَ وَ الۡیَوۡمَ الۡاٰخِرَ وَ ذَکَرَ اللّٰهَ کَثِیۡرًا
‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর (চরিত্রের) মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ২১)
আজান শোনার পর প্রিয় নবির সুন্নাত
কোরআনের ঘোষণার পরও তিনি আল্লাহর ইবাদাত ও তার অনুসরণ থেকে কখনো বিরত হতেন না। বরং মসজিদে আজান হওয়ার ধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তাতে সাড়া দিয়ে সব কাজ রেখে মসজিদে ছুটে যেতেন। হাদিসের বর্ণনায় এসেছে-
হজরত আসওয়াদ বিন ইয়াজিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাড়ীতে কি কি ধরনের কাজ করতেন? উত্তরে তিনি বললেন-
كان يكون في مهن أهله، فإذا سمع بالأذان خرج
‘তিনি তার পরিবারের সব কাজে নিয়োজিত থাকতেন, তবে আজান শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতেন।’ (বুখারি)
ফরজ নামাজ মসজিদে পড়ার গুরুত্ব
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে, তিনি বাড়িতে ফরজ নামাজ পড়েছেন। তবে তিনি মৃত্যুর আগ মুহূর্তে যখন প্রচণ্ড রোগাক্রান্ত; শোয়া থেকে উঠতে পারছিলেন না; যখন মসজিদে যেতে অপরাগ ছিলেন তখন বাড়িতে নামাজ আদায় করেছেন। কিন্তু তিনি দরজা দিয়ে মসজিদে নামাজ পড়ার দৃশ্য অস্রুসিক্ত নয়নে অবলোকন করতেন।
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের প্রতি খুবই দয়াশীল ছিলেন। কিন্তু নামাজের জামাতের অংশগ্রহণের ব্যাপারে তাঁর মতো এতো কঠোর দ্বিতীয় আর কেউ ছিল না। তিনি জামাতে অনুপস্থিত ব্যক্তিদের ব্যাপারে এভাবে কঠোর শাস্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে-
لقد هممت أن آمر بالصلاة فتقام ثم آمر رجلاً أن يصلي بالناس ثم أنطلق معي برجال معهم حزم من حطب إلى قوم لا يشهدون الصلاة فأحرق عليهم بيوتهم
‘আমার ইচ্ছা হয় যে, আমি কাউকে নামাজের ইমামতি করার আদেশ দেই আর আমি কাঠসহ কিছু লোককে সঙ্গে নিয়ে ঐ সব লোকদের বাড়িতে যাই; যারা জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়ার জন্য উপস্থিত হয়নি। এরপর তারাসহ তাদের বাড়ি-ঘরকে জালিয়ে দেই।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মসজিদে না গেলে নামাজ কবুল হবে না!
মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ পড়ার প্রতি ছিল নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ গুরুত্ব। শরিয়তের ওজর ছাড়া আজান শোনার পর মসজিদে না গেলে নামাজ কবুল হবে মর্মেও প্রিয় নবি ঘোষণা করেছেন-
من سمع النداء فلم يجب فلا صلاة له إلا من عذر، والعذر خوف أو مرض
‘শরিয়তের ওজর ব্যতিত যে ব্যক্তি আজান শোনার পর জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করলো না, তার নামাজ কবুল হবে না।’ (তিরমিজি) আর ওজর বলতে: শত্রুর ভয় অথবা রোগকে বুঝানো হয়েছে।
প্রিয় নবির যুগের সে দৃশ্য আজ কোথায়? কোথায় সেই নামাজি? মসজিদে আজান হয় ঠিকই কিন্তু মসজিদের কাতারপূর্ণ হয় না। অথচ বর্তমান সময়ে মসজিদে নামাজ পড়তে না যাওয়ার পেছনে নেই কোনো শরিয়তের ওজর। না কোনো শত্রুর ভয় কিংবা বিপদের ভয়।
মুমিন মুসলমান মাত্রই উচিত, আজান হলে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সোনালী যুগের মতো কাজ রেখে মসজিদে উপস্থিত হওয়া। একত্রে নামাজ আদায় করা। প্রিয় নবির প্রিয় সুন্নাতকে জাগ্রত করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের উপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মানসিক চাপ, বিষন্নতা ও জীবনের নানা কষ্ট থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর সাহায্যের বিকল্প নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের ঝুঁকির মুহূর্তে আল্লাহর নির্দেশে মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সময় চরম বিপদের মুহূর্তে প্রশান্তি স্বরূপ এ আয়াতটি নাজিল হয়। যা সত্যিই প্রশান্তির। এ আয়াতটি পড়লে এমনিতেই কঠিন বিপদে মিলে প্রশান্তি ও নিরাপত্তা। তাহলো-
رَّبِّ اَدۡخِلۡنِیۡ مُدۡخَلَ صِدۡقٍ وَّ اَخۡرِجۡنِیۡ مُخۡرَجَ صِدۡقٍ وَّ اجۡعَلۡ لِّیۡ مِنۡ لَّدُنۡکَ سُلۡطٰنًا نَّصِیۡرًا
উচ্চারণ : রাব্বি আদ্খিলনি মুদ্খালা সিদ্ক্বিও ওয়া আখরিঝ্নি মুখরাঝা সিদ্ক্বিও ওয়াঝ্আললি মিল্লাদুংকা সুলত্বানান নাছিরা।’
অর্থ : ‘হে আমার প্রভু! তুমি আমাকে কল্যাণসহ প্রবেশ করাও এবং কল্যাণসহ বের কর। আর তোমার কাছ থেকে আমাকে দান কর সাহায্যকারী শক্তি।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ৮০)
উল্লেখ্য, এ আয়াতটি প্রিয় নবির হিজরতের সময় নাজিল হয়েছিল। যখন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে বের হওয়ার এবং মদিনাতে প্রবেশ করার সময় উপস্থিত হয়েছিল।
কেউ কেউ বলেন, এ প্রার্থনামূলক আয়াতের মর্মার্থ হলো- সত্যের উপর আমার মৃত্যু দিও এবং সত্যের উপর আমাকে কেয়ামতের দিন উত্থিত করো।
আবার কেউ কেউ বলেন, সত্যতার সঙ্গে আমাকে কবরে প্রবিষ্ট করো এবং কেয়ামতের দিন সত্যতার সঙ্গে আমাকে কবর থেকে বের করো ইত্যাদি।
ইমাম শাওকানি বলেন, এ আয়াতটি যেহেতু দোয়া; বিধায় এর ব্যাপকতায় উল্লিখিত সব কথাই এসে যায়।
কেউ কেউ বলেন, যারা বিভিন্ন কষ্ট ভোগ করেন, তারাও এ দোয়াটি প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজের পর পড়তে পারেন। আশা করা যায়, এতে তার উল্লেখিত রোগ ও সমস্যাগুলো সমাধান হয়ে যাবে।
আবার কেউ কেউ বলেছেন, যদি কারো ডায়বেটিস রোগ হয়; তবে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম ও শৃঙ্ক্ষলাবদ্ধ জীবনের পাশাপাশি এ দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। এ রোগ থেকে মুক্ত থাকতে এটিকে কোরআনি আমল মনে করা হয়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বিভিন্ন রোগ মুক্তিতে কোরআনের এ আয়াতের আমলটি বেশি বেশি করার তাওফিক দান করুন। দুনিয়ার ও পরকালের সব বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
শিরকমুক্ত ঈমান এবং নেক আমল ছাড়া কেয়ামতের দিন মুক্তির বিকল্প নেই। কেয়ামতের ময়দানে সব মানুষ আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকবে। এমনকি নবি-রাসুলগণও আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকবেন। কারণ কেউ জানেন না আল্লাহ তাআলা সে দিন কার সঙ্গে কীরূপ ব্যবহার করবেন।
হাদিসের বর্ণনায় যদিও কেয়ামতের দিনের ভয়বাহতার বর্ণনা দিয়েছেন প্রিয়নবি। তিনি সেদিন সেজদায় থাকবেন। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাকে সেজদা থেকে উঠতে বলবেন। তিনি সেজদা থেকে মাথা উঠিয়ে বিচার কাজ শুরু করার জন্য সুপারিশ করবেন। তারপরই শুরু হবে পরকালের বিচারকার্য।
সেদিন যার আমলনামা ভালো হবে সে সফল হবে। শুধু মানুষ নয়, সেদিন নবি-রাসুলরা কতটা ভয়াবহ সময় কাটাবেন তা হাদিসের একটি বর্ণনা থেকেই সুস্পষ্ট-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যখন এ আয়াত নাজিল হয়-
وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ
(হে রাসুল!) আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন।’ (সুরা শুআরা : আয়াত ২১৪)
তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন-
> হে কুরাইশ দল! (তোমরা আল্লাহর একত্ববাদ ও ইবাদতের ধারায়) নিজেদের আত্মাকে প্রস্তুত কর। আমি আল্লাহর কাছে তোমাদের কোনো কাজে আসতে পারব না।
> হে বনি আবদে মানাফ! আমি আল্লাহর কাছে তোমাদের কোনো উপকার করতে পারব না।
> হে আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র আব্বাস! আমি আল্লাহর কাছে তোমার কোনো উপকার করতে পারব না।
> হে রাসুলের ফুফু সাফিয়্যাহ! আমি আল্লাহর কাছে আপনার কোনো কাজে আসব না।
> হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যা ফাতেমা! তুমি আমার সম্পদ থেকে যা ইচ্ছা চেয়ে নাও। আমি আল্লাহর কাছে তোমার কোনো কাজে আসব না।’ (বুখারি)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের করণীয়-
এ সতর্কবার্তা ঘোষণার পরপরই মহান আল্লাহ তাআলা পরবর্তী আয়াতে প্রিয়নবিকে অনুসরণ ও অনুকরণ করার যে ঘোষণাগুলো দিয়েছেন, সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা। আর তাহলো-
‘আর মুমিনদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করে, তাদের প্রতি তোমার বাহুকে অবনত কর। তারপর যদি তারা তোমার অবাধ্য হয়, তাহলে বল, তোমরা যা কর, নিশ্চয় আমি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আর তুমি মহাপরাক্রমশালী পরম দয়ালু (আল্লাহর) উপর তাওয়াক্কুল কর। যিনি তোমাকে দেখেন যখন তুমি (নামাজে) দণ্ডায়মান হও এবং সেজদাকারীদের মধ্যে তোমার ওঠা-বসা। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা মহাজ্ঞানী।’ (সুরা শুআরা : আয়াত ২১৫-২২০)
আল্লাহর একত্ববাদ ও ইবাদতে যদি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নিজ বংশধর, চাচা, ফুফু ও কন্যার ব্যাপারে এমন ঘোষণা দেন তবে অন্যান্য মুসলমান কিভাবে আল্লাহর নাফরমানি করে প্রিয়নবির শাফায়াত লাভের আশা করতে পারে!
কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা থেকে এ কথা প্রমাণিত যে, শিরক মুক্ত ঈমান ও নেক আমল ছাড়া কোনো আদম সন্তানই পরকালে মুক্তি পাবে না। যারাই প্রিয় নবির অনুসরণ ও অনুকরণ করবে তাদের মুক্তি হবে নিরাপদ ও সহজ।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, শিরকমুক্ত ঈমান ও নেক আমলে নিজেদের জীবন সাজানো। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবন পরিচালনা করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে শিরকমুক্ত ঈমান লাভ ও তার ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেদের নিয়োজিত করার তাওফিক দান করুন। হাশরের ময়দানে হাদিসে ঘোষিত সব ধরনের শাফায়াত লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন