অর্ধেক তার গড়িয়াছে কৃষাণী
লেখক
শাইখ সিরাজআপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
মাছ চাষে স্মার্ট প্রযুক্তির উদ্ভাবন বাংলাদেশি তরুণের
-
পঞ্চাশে বাংলাদেশ: এক টেলিভিশন তারকা আর দরিদ্র কৃষকের সন্তান এক বিজ্ঞানী যেভাবে পাল্টে দিয়েছেন বাংলাদেশের কৃষি
-
কৃষকের বন্ধু ও কৃষি উন্নয়ন এর পথিকৃৎ শাইখ সিরাজের ৭১তম জন্মদিন আজ
-
স্মার্ট ডিভাইসে মাছ চাষে বিপ্লব
-
চীনে পানিবিহীন হাঁসের খামার
-
পৌণে আট’শ বিঘা জমিতে তরুন উদ্যোক্তার কৃষি খামার
-
নতুন স্বপ্ন জাগাচ্ছে গোলাপী রঙের মহিষ
-
মাংস রান্নার স্বাস্থ্যকর উপায়
-
তামাক চাষীদের নিবন্ধনের আওতায় আনা হোক
-
টাঙ্গাইলে কলার আবাদ বাড়লেও সুবিধা নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী
ভুট্টা বিশ্বের অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য এবং বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। এটি শুধু পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও অত্যন্ত লাভজনক। ভুট্টার ব্যবহার খাদ্য, পশুখাদ্য এবং শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপক। আসুন, ভুট্টার পুষ্টিগুণ, উপকারিতা এবং চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।
ভুট্টার পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা
পুষ্টি মূল্যঃ ধান ও গমের তুলনায় ভুট্টার পুষ্টিমান বেশী। এতে প্রায় ১১% আমিষ জাতীয় উপাদান রয়েছে। আমিষে প্রয়োজনীয় এ্যামিনো এসিড, ট্রিপটোফ্যান ও লাইসিন অধিক পরিমানে আছে। এছাড়া হলদে রংয়ের ভুট্টা দানায় প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ৯০ মিলিগ্রাম ক্যারোটিন বা ভিটামিন “এ” থাকে।
ভুট্টা হলো একটি উচ্চ পুষ্টিসমৃদ্ধ শস্য, যা শরীরের বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করে। এতে রয়েছে:
- প্রোটিন: শরীরের গঠন ও পুনর্গঠনে সহায়ক।
- কার্বোহাইড্রেট: শক্তির প্রধান উৎস।
- ভিটামিন: ভিটামিন এ, বি, এবং ই-এর ভালো উৎস।
- মিনারেলস: ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, এবং আয়রন।
- ফাইবার: হজমশক্তি বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
উপকারিতা:
- শক্তি বৃদ্ধি: ভুট্টার কার্বোহাইড্রেট দ্রুত শক্তি সরবরাহ করে।
- হৃদরোগ প্রতিরোধ: এতে থাকা ফাইবার কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- চোখের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী: ভুট্টার ভিটামিন এ চোখের জ্যোতি বাড়ায়।
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: ভুট্টার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ায় এটি রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
- ত্বকের উজ্জ্বলতা: ভুট্টার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখে।
ভেষজ গুনঃ ভুট্টার দানা মানুষের খাদ্য হিসেবে এবং ভুট্টার গাছ ও সবুজ পাতা উন্নত মানের গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবেও এর যথেষ্ট গুরূত্ব রয়েছ। শুধু পশু, মুরগির খামার ও মাছের চাহিদা মিটানোর জন্যই বছরে প্রায় ২ লক্ষ ৭০ হাজার টন ভুট্টা দানা প্রয়োজন। বাংলাদেশে ভুট্টার জমি দ্রুত বাড়ছে।
ভুট্টার চাষ পদ্ধতি
ভুট্টার চাষ বাংলাদেশে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করলে উচ্চ ফলন নিশ্চিত করা যায়।
উপযুক্ত জমি ও মাটিঃ বেলে দোআশ ও দোআশ মাটি ভুট্টা চাষের জন্য উপযোগী। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন জমিতে পানি জমে না থাকে।
মাটি ও আবহাওয়া:
- মাটির ধরন:
- দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি ভুট্টার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।
- মাটির pH মান ৫.৮ থেকে ৭.০ এর মধ্যে থাকা উচিত।
- আবহাওয়া:
- ভুট্টার জন্য উষ্ণ ও রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া প্রয়োজন।
- ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটি ভালো জন্মে।
বীজ নির্বাচন ও রোপণ
- বীজ নির্বাচন:
- উচ্চ ফলনশীল এবং রোগ প্রতিরোধী জাতের বীজ বেছে নিন।
- প্রত্যেক হেক্টরে ২০-২৫ কেজি বীজ প্রয়োজন।
- রোপণের সময়:
- ভুট্টা সাধারণত রবি মৌসুমে (অক্টোবর-নভেম্বর) রোপণ করা হয়।
- রোপণ পদ্ধতি:
- সারি পদ্ধতিতে রোপণ করুন।
- গাছের মধ্যে ২০-২৫ সেন্টিমিটার এবং সারির মধ্যে ৬০ সেন্টিমিটার দূরত্ব রাখুন।
জাত পরিচিতি
ভুট্টার জাত সংগ্রহ ও বাছাই করনের মাধ্যমে বিএআরআই আজ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মিটাতে বহুমুখী ব্যবহারের উপযোগী ভুট্টা জাতের চাষের সম্ভবনা খুবই উজ্জ্বল।
ভুট্টার জাত
বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫: আমিষ সমৃদ্ধ উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড জাত যা ২০০৪ সালে অনুমোদন করা হয়। এ জাতটির জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪০-১৪৫ দিন ও খরিপ মৌসুমে ৯৫-১০৫ দিন। জাতটির দানা উজ্জ্বল আকর্ষণীয় কমলা রঙের, ফ্লিন্ট প্রকৃতির এবং হাজার দানার ওজন ২৯০-৩১০ গ্রাম। হেক্টরপ্রতি ফলন রবি মৌসুমে ৯-১০ টন এবং খরিফ মৌসুমে ৭-৭.৫ টন।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৭: আন্তর্জাতিক গম ও ভুট্টা উন্নয়ন কেন্দ্র হতে সংগ্রহীত ও বাছাইকৃত পিতৃ-মাতৃ লাইন হতে একমুখী সংকরায়ণ করে এ জাতটি উদ্ভাবিত হয়েছে এবং ২০০৬ সালে অবমুক্ত করা হয়। এ জাতটির জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৩৫-১৪১ দিন ও খরিপ মৌসুমে ৯৫-১০০ দিন। জাতটির দানা আকর্ষণীয় হলুদ রঙের, ফ্লিন্ট প্রকৃতির এবং হাজার দানার ওজন ৩৭০-৩৯০ গ্রাম। হেক্টরপ্রতি ফলন রবি মৌসুমে ১০.৫-১১.৫ টন।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯: আন্তর্জাতিক গম ও ভুট্টা উন্নয়ন কেন্দ্র হতে সংগ্রহীত ও বাছাইকৃত পিতৃ-মাতৃ লাইন হতে একমুখী সংকরায়ণ করে এ জাতটি উদ্ভাবিত হয়েছে এবং ২০০৭ সালে অবমুক্ত করা হয়। এ জাতটির জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪৫-১৫০ দিন ও খরিপ মৌসুমে ১০৫-১১০ দিন। জাতটির দানা আকর্ষণীয় হলুদ রঙের, ডেন্ট প্রকৃতির এবং হাজার দানার ওজন ৩৭০-৩৭৫ গ্রাম। হেক্টরপ্রতি ফলন রবি মৌসুমে ১১.৫-১২.৫ টন।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১০: আন্তর্জাতিক গম ও ভুট্টা উন্নয়ন কেন্দ্র হতে সংগ্রহীত ও বারির নিজস্ব উদ্ভাবিত ইনব্রিড লাইনের সংকরায়ণ করে এ জাতটি উদ্ভাবিত হয়েছে এবং ২০০৯ সালে অবমুক্ত করা হয়। এ জাতটির জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪৫-১৫০ দিন ও খরিপ মৌসুমে ১০০-১১০ দিন। জাতটির দানা আকর্ষণীয় হলুদ রঙের, ফ্লিন্ট প্রকৃতির। হেক্টরপ্রতি ফলন রবি মৌসুমে ১০-১১.৫ টন।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১১: আন্তর্জাতিক গম ও ভুট্টা উন্নয়ন কেন্দ্র হতে সংগ্রহীত ও বাছাইকৃত পিতৃ-মাতৃ লাইন হতে একমুখী সংকরায়ণ করে এ জাতটি উদ্ভাবিত হয়েছে এবং ২০০৯ সালে অবমুক্ত করা হয়। এ জাতটির জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৫০-১৫৫ দিন। জাতটির দানা হলুদ রঙের, ফ্লিন্ট প্রকৃতির। হেক্টরপ্রতি ফলন রবি মৌসুমে ১০.৫-১১.৫ টন।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১২: স্বল্প সেচে উৎপাদনক্ষম এবং মধ্যমাত্রার খরা সহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল সাদা দানা বিশিষ্ট ফ্লিন্ট প্রকৃতির জাত। এটি ২০১৬ সালে অবমুক্ত করা হয়। এ জাতটির জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪০-১৪৫ দিন। খরা অবস্থায় একটি মাত্র সেচ প্রয়োগে (ফল আসার আগে) জাতটির ফলন হেক্টরপ্রতি ৮.১-৮.৫ টন এবং স্বাভাবিক সেচ প্রয়োগে ফলন হেক্টরপ্রতি ১০-১১.১ টন।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৩: স্বল্প সেচে উৎপাদনক্ষম এবং মধ্যমাত্রার খরা সহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল সাদা দানা বিশিষ্ট ফ্লিন্ট প্রকৃতির জাত। এটি ২০১৬ সালে অবমুক্ত করা হয়। এ জাতটির জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪৫-১৫২ দিন। খরা অবস্থায় একটি মাত্র সেচ প্রয়োগে (ফল আসার আগে) জাতটির ফলন হেক্টরপ্রতি ৮.২-৮.৯ টন এবং স্বাভাবিক সেচ প্রয়োগে ফলন হেক্টরপ্রতি ১০.১-১১.২ টন। মোচা পরিপক্ক হওয়ার পরও জাতটির গাছ ও পাতা সবুজ থাকে যা গো-খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের উপযোগী।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪: জাতটি খরিফ মৌসুমে ফুল আসার পর্যায়ে অধিক তাপ সহিষ্ণু এবং মধ্যম ফলন ক্ষমতা সম্পন্ন। এটি ২০১৭ সালে অবমুক্ত করা হয়। এ জাতটির জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪০ দিন এবং খরিফ মৌসুমে ১১৫ দিন। জাতটি দানা সাদা বর্ণের এবং সেমি ডেন্ট প্রকৃতির। জাতটি পাতা ঝলসানো রোগ সহনশীল। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন রবি মৌসুমে ১০.৮৪ টন এবং খরিফ মৌসুমে ১০.৫২ টন।
বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫: জাতটি খরিফ মৌসুমে ফুল আসার পর্যায়ে অধিক তাপ সহিষ্ণু এবং উচ্চ ফলন ক্ষমতা সম্পন্ন। এটি ২০১৭ সালে অবমুক্ত করা হয়। এ জাতটির জীবনকাল রবি মৌসুমে ১৪৮ দিন এবং খরিফ মৌসুমে ১২১ দিন। জাতটির দানা হলুদ বর্ণের এবং সেমি ডেন্ট প্রকৃতির। জাতটি পাতা ঝলসানো রোগ সহনশীল। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন রবি মৌসুমে ১২.৭৫ টন এবং খরিফ মৌসুমে ১২.০৭ টন। পরিপক্ক অবস্থায় জাতটির বেশির ভাগ পাতা সবুজ থাকে বিধায় গো-খাদ্য হিসাবে ব্যবহার উপযোগী।
বারি মিষ্টি ভুট্টা-১: থাইল্যান্ড থেকে সংগৃহীত জার্মপ্লাজম হতে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ জাতটি নির্বাচন করা হয় এবং ২০০২ সালে অনুমোদিত হয়। মিষ্টি ভুট্টা কাঁচা অবস্থায় খাওয়া হয়। তাই দানা যখন নরম থাকে তখনই মোচা সংগ্রহ করতে হয়। সিল্ক বের হবার ২০-২৫ দিনের মধ্যে অর্থাৎ বপনের মাত্র ১১৫-১২০ দিনে খাওয়ার উপযোগী মোচা সংগ্রহ করা যায়। এর হলুদ দানা প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ। জাতটির ফলন রবি মৌসুমে হেক্টরপ্রতি ১০-১০.৫ টন (খোসা ছাড়ানো কচি মোচা) এবং প্রায় ২৫টন/হেক্টর সবুজ গো-খাদ্য পাওয়া যায়।
বপনের সময়ঃ বাংলাদেশে রবি মৌসুমে মধ্য-আশ্বিন থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ (অক্টোবর-নভেম্বর) এবং খরিফ মৌসুমে ফাল্গুন থেকে মধ্য-চৈত্র (মধ্য ফেব্রুয়ারী-মার্চ) পর্যন্ত সময় বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা
- সার:
- জৈব সার এবং রাসায়নিক সার সমানভাবে প্রয়োগ করুন।
- বীজ বপনের সময় এবং রোপণের ৩০ দিন পর সার দিন।
- সেচ:
- মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে ২-৩ বার সেচ দিন।
- ফুল ফোটার সময় এবং দানা আসার সময় পর্যাপ্ত সেচ নিশ্চিত করুন।
সার ব্যবস্থাপনাঃ ভুট্টা চাষে বিভিন্ন প্রকার সারের পরিমান নিচে দেওয়া হলোঃ পরিমান/হেক্টর/ কেজি
সারের নাম | কম্পোজিট রবি | কম্পোজিট খরিফ | হাইব্রিড রবি |
ইউরিয়া | ১৭২-৩১২ | ২১৬-২৬৪ | ৫০০-৫৫০ |
টিএসপি | ১৬৮-২১৬ | ১৩২-২১৬ | ২৪০-২৬০ |
এমপি | ৯৬-১৪৪ | ৭২-১২০ | ১৮০-২২০ |
জিপসাম | ১৪৪-১৬৮ | ৯৬-১৪৪ | ২৪০-২৬০ |
জিংকসালফেট | ১০-১৫ | ৭-১২ | ১০-১৫ |
বোরিকএসিড | ৫-৭ | ৫-৭ | ৫-৭ |
গোবর | ৪-৬টন | ৪-৬টন | ৪-৬টন |
সার প্রয়োগ পদ্ধতিঃ জমি তৈরীর শেষ পর্যায়ে অনুমোদিত ইউরিয়ার এক তৃতীয়াংশ এবং অন্যান্য সারের সবটুকু ছিটিয়ে জমি চাষ দিতে হবে। বাকি ইউরয়া সমান ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তি বীজ গজানোর ২৫-৩০ দিন পর এবং দ্বিতীয় কিস্তি বীজ গজানোর ৪০-৫০ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে। চারা গজানোর ৩০ দিনের মধ্যে জমি থেকে অতিরিক্ত চারা তুলে ফেলতে হবে। চারার বয়স এক মাস না হওয়া পর্যন্ত জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনাঃ উচ্চ ফলনশীল জাতের ভুট্টার আশানুরূপ ফলন পেতে হলে রবি মৌসুমে সেচ প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। উদ্ভাবিত জাতে নিম্নরূপ ৩-৪টি সেচ দেওয়া যায়।
- প্রথম সেচ: বীজ বপনের ১৫-২০ দিনের মধ্যে (৪-৬ পাতা পর্যায়)
- দ্বিতীয় সেচ:বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিনের মধ্যে (৮-১২ পাতা পর্যায়)
- তৃতীয় সেচ:বীজ বপনের ৬০-৭০ দিনের মধ্যে (মোচা বের হওয়া পর্যায়)
- চতুর্থ সেচ:বীজ বপনের ৮৫-৯৫ দিনের মধ্যে (দানা বাঁধার পূর্ব পর্যায়)
ভুট্টার ফুল ফোটা ও দানা বাঁধার সময় কোন ক্রমেই জমিতে যাতে জলবদ্ধতা সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জমিতে আগাছা দেখা দিলে নিড়ানী দিয়ে দমন করতে হবে।
রোগবালাই ও প্রতিকার
ভুট্টার চাষে রোগবালাই একটি সাধারণ সমস্যা। কিছু সাধারণ রোগ হলো:
- লিফ ব্লাইট: এই রোগে পাতা ঝলসে যায়। দমন করতে তামার ফাংশাইড ব্যবহার করুন।
- স্টেম বোরার: এই পোকার আক্রমণে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। কীটনাশক স্প্রে করুন।
পোকা মাকড় ব্যবস্থাপনাঃ ভুট্টার চারা অবস্থায় কাটুই পোকার আক্রমণ হলে হাত দিয়ে তা মেরে ফেলতে হবে।
রোগ ব্যবস্থাপনাঃ ভুট্টার বীজ পচা এবং চারা গাছের রোগ দমনঃ বীজ পচা এবং চারা নষ্ট হওয়ার কারণে সাধারণত ক্ষেতে ভুট্টা গাছের সংখ্যা কমে যায়। নানা প্রকার বীজ ও মাটি বাহিত ছত্রাক যেমন পিথিয়াম, রাইজোকটনিয়া, ফিউজেরিয়াম, পেনিসিলিয়াম ইত্যাদি বীজ বপন, চারা ঝলসানো, রোগ ও শিকড় পচা রোগ ঘটিয়ে থাকে। জমিতে রসের পরিমান বেশী হলে এবং মাটির তাপমাত্রা কম থাকলে বপনকৃত বীজের চারা বড় হতে অনেক সময় লাগে। ফলে এ সময়ে ছত্রকের আক্রমনের মাত্রা বেড়ে যায়।
প্রতিকার
- সুস্থ্য, সবল ও ক্ষতমুক্ত বীজ এবং ভুট্টার বীজ পচা রোগ প্রতিরোধী বর্ণালী ও মোহর জাত ব্যবহার করতে হবে।
- উত্তমরূপে জমি তৈরী করে পরিমিত রস ও তাপমাত্রায় (১৩সে. এর বেশী) বপন করতে হবে।
- থিরাম বা ভিটাভেক্স (০.২৫%) প্রতি কেজি বীজে ২.৫-৩.০ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করলে ভুট্টার বীজ পচা রোগের আক্রমণ অনেক কমে যায়।
ভুট্টার পাতা ঝলসানো রোগ দমনঃ হেলমিনথোসপরিয়াম টারসিকাম ও হেলমিনথোসপরিয়াম মেইডিস নামক ছত্রাকদ্বয় এ রোগ সৃষ্টি করে। প্রথম ছত্রাকটি দ্বারা আমাদের দেশে ভুট্টার পাতা ঝলসানো রোগ বেশী হতে দেখা যায়। হেলমিনথোসপরিয়াম টারসকাম দ্বারা আক্রান্ত গাছের নিচের দিকের পাতায় লম্বাটে ধূসর বর্ণের দাগ দেখা যায়। পরবর্তীতে গাছের উপরের অংশে তা বিস্তার লাভ করে। রোগের প্রকোপ বেশী হলে পাতা আগাম শুকিয়ে যায় এবং গাছ মরে যায়। এ রোগের জীবানু গাছের আক্রান্ত অংশে অনেক দিন বেঁচে থাকে জীবাণুর বীজকণা বা কনিডিয়া বাতাসের সাহায্যে অনেক দূর পর্যন্ত সুস্থ্য গাছে ছড়াতে পারে। বাতাসের আদ্রতা বেশী হলে এবং ১৮-২৭ ডিগ্রী সে. তাপমাত্রায় এ রোগের আক্রমণ বেড়ে যায়।
প্রতিকারঃ
- রোগ প্রতিরোধী জাতের (মোহর) চাষ করতে হবে।
- আক্রান্ত ফসলে টিল্ট ২৫০ ইসি (০.০৪%) ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
- ভুট্টা উঠানোর পর জমি থেকে আক্রান্ত গাছ সরিয়ে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
ভুট্টার মোচা ও দানা পচা রোগ দমনঃ মোচা ও দানা পচা রোগ ভুট্টার ফলন, বীজের গুনাগুন ও খাদ্যমান কমিয়ে দেয়। বিভিন্ন প্রকার ছত্রাক যথা ডিপ্লোডিয়া মেডিস, ফিউজেরিয়াম মনিলিফরমি প্রভৃতি এ রোগ ঘটায়। আক্রান্ত মোচার খোসা ও দানা বিবর্ণ হয়ে যায়। দানা পুষ্ট হয় না, কুঁচকে অথবা ফেটে যায়। অনেক সময় মোচাতে বিভিন্ন দানার মাঝে বা উপরে ছত্রাকের উপস্থিতি খালি চোখেই দেখা যায়। ভুট্টা গাছে মোচা আসা থেকে পাকা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত বেশী থাকলে এ রোগের আক্রমণ বাড়ে। পোকা বা পাখির আক্রমনে বা কান্ড পচা রোগে গাছ মাটিতে পড়ে গেলে এ রোগ ব্যাপকতা লাভ করে। এ রোগের জীবাণু বীজ অথবা আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশে বেঁচে থাকে। একই জমিতে বার বার ভুট্টার চাষ করলে এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
প্রতিকার
- এ রোগের প্রাদুর্ভাব এড়াতে একই জমিতে বার বার ভুট্টা চাষ করা ঠিক নয়।
- জমিতে পোকা ও পাখির আক্রমন রোধ করতে হবে।
- ভুট্টা পেকে গেলে তাড়াতাড়ি কেটে ফেলতে হবে।
- কাটার পর ভুট্টার পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
ভুট্টার কান্ড পচা রোগ দমনঃ বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাক যথা ডিপ্লোডিয়া মেডিস, ফিউজেরিয়াম মনিলিফরমি-এর কারণে এ রোগ ঘটে থাকে। প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে গাছের কান্ড পচে যায় এবং গাছ মাটিতে ভেঙ্গে পড়ে। আমাদের দেশে খরিফ মৌসুমে এ রোগ বেশী হয়ে থাকে। জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশী এবং পটাশের পরিমাণ কম হলে ছত্রাক জনিত কান্ড পচা রোগ বেশী হয়।
প্রতিকারঃ
- ছত্রাকনাশক ভিটাভেক্স-২০০ দিয়ে বীজ শোধন করে লাগাতে হবে।
- সুষম হারে সার ব্যবহার করতে হবে, বিশেষ করে নাইট্রোজেন ও পটাশ পরিমিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
- ভুট্টা কাটার পর পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- শিকড় ও কান্ড আক্রমকারী পোকা-মাকড় দমন করতে হবে।
- আক্রান্ত জমিতে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
ফসল সংগ্রহঃ দানার জন্য ভুট্টা সংগ্রহের ক্ষেত্রে মোচা চক্চক্ খড়ের রং ধারণ করলে এবং পাতা কিছুটা হলদে হলে সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। এ অবস্থায় মোচা থেকে ছড়ানো বীজের গোড়ায় কালো দাগ দেখা যাবে। ভুট্টা গাছের মোচা ৭৫-৮০% পরিপক্ক হলে ভুট্টা সংগ্রহ করা যাবে। বীজ হিসেবে মোচার মাঝামাঝি অংশ থেকে বড় ও পুষ্ট দানা সংগ্রহ করতে হবে।
- ভুট্টার দানা পুরোপুরি পরিপক্ক হলে সংগ্রহ করুন।
- সংগ্রহের পর ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করুন।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব
- বাজার চাহিদা:
- ভুট্টার চাহিদা সারা বছর থাকে।
- এটি খাদ্যশস্য, পশুখাদ্য এবং শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
- উচ্চ লাভ:
- সঠিক চাষ পদ্ধতিতে প্রতি হেক্টরে ৭-১০ টন ফলন পাওয়া যায়।
- রপ্তানি সম্ভাবনা:
- বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ভুট্টা আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি হয়।
ভুট্টা একটি পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং লাভজনক ফসল, যা সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করলে কৃষকের জন্য আয়ের বড় উৎস হতে পারে। স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা থাকায় ভুট্টা চাষ আপনার জন্য হতে পারে একটি সাফল্যময় উদ্যোগ। স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য আজই ভুট্টা চাষ শুরু করুন।
বাগেরহাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক নারীর চাষ করা ধান ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। একটি শীষে ধান পাওয়া গেছে এক হাজার এক শর বেশি। দেশে বর্তমান যেসব জাতের ধান চাষ হয় সেসবের চেয়ে এই ধানের ফলন দ্বিগুণ। ফাতেমা বেগমের জমিতে এই ধানের চাষ হওয়ায় এরই মধ্যে তা ‘ফাতেমা ধান’ নামে পরিচিতি পেয়েছে এলাকায়।
ফাতেমা ধানের গাছ, ফলন, পাতা, শীষ সবকিছু অন্য যে কোনো জাতের ধানের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতি গোছে একটি চারা রোপণ করা হয়, যা বেড়ে ৮-১২টি হয়। প্রতিটি ধান গাছ ১১৫ থেকে ১৩০ সেন্টিমিটার লম্বা। একেকটি ছড়ার দৈর্ঘ্য ৩৬-৪০ সেন্টিমিটার। প্রতি ছড়ায় দানার সংখ্যা এক হাজার থেকে ১২০০টি। যার ওজন ৩০-৩৫ গ্রাম। ধানগাছের পাতা লম্বা ৮৮ সেন্টিমিটার, ফ্লাগলিপ (ছড়ার সঙ্গের পাতা) ৪৪ সেন্টিমিটার। ধানগাছের পাতা চওড়ায় দেড় ইঞ্চি। এই জাতের গাছের কাণ্ড ও পাতা দেখতে অনেকটা আখ গাছের মতো এবং অনেক বেশি শক্ত। তাই এই ধান ঝড়-বৃষ্টিতে হেলে পড়ার কোন আশঙ্কা নেই। ফাতেমা ধান একরপ্রতি ফলন হয় প্রায় ১৩০ মণ। তাই অন্য যে কোনো জাতের তুলনায় এই জাতের ধান অনেক ব্যতিক্রম।
গতকাল শুক্রবার চাকুলিয়া গ্রামে ফাতেমা বেগমের বাড়িতে গিয়ে বেশ কিছু মানুষের ভিড় দেখা যায়। দূর-দূরান্ত থেকে তারা ফাতেমার ধানের বীজ কিনতে এসেছে। কেউ কেউ যে জমিতে ওই ধান ফলেছে, তা ঘুরে দেখে। তবে কয়েক দিন আগেই ওই ধানের বীজ শেষ হয়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে।
ফাতেমা বেগম জানান, ২০১৬ সালে বোরো মৌসুমে তাঁর বাড়ির পাশে জমিতে হাইব্রিড আফতাব-৫ জাতের ধান কাটার সময় তিনটি ভিন্ন জাতের ধানের শীষ দেখতে পান তিনি। ওই তিনটি শীষ অন্যগুলোর চেয়ে অনেক বড় এবং শীষে ধানের দানার পরিমাণও অনেক বেশি ছিল। এরপর ওই ধানের শীষ তিনটি বাড়িতে এনে শুকিয়ে প্রক্রিয়া করে বীজ হিসেবে রেখে দেন। পরের বছর ছেলে লেবুয়াতকে ধান চাষ চাষ করতে বলেন। সে বছর আড়াই কেজি ধান পাওয়া যায়। এবার আরো বেশি জমিতে চাষ করার পর ধানে ধানে সয়লাব হয়ে গেছে। সাড়া ফেলেছে তা এলাকার বাইরেও। ওই ধান দেখতে ব্রি-২৮ ধানের মতো। লেবুয়াত শেখ জানান, বাড়ির পাশে দেড় বিঘার মৎস্যঘেরের মধ্যে প্রায় ৪২ শতক জমিতে আলাদাভাবে এ বছর ওই ধানের চাষ করেন তাঁরা। অন্য ধানের মতোই সাধারণ পরিচর্চা করেন। জমিতে দুই দফায় ২০ কেজি ইউরিয়া এবং ৩০ কেজি পটাশ সার ব্যবহার করা হয়েছে। পোকামাকড় তাড়াতে দুই দফায় কীটনাশক ছিটানো হয়েছে। অন্য জাতের ধানগাছের চেয়ে এই ধানগাছ অনেক লম্বা। ধানের শীষও অনেক বড়। প্রতিটি শীষে এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ দানা হয়। ওই জমিতে প্রায় দুই হাজার ৬০০ কেজি ধান ফলেছে। নিজেদের জন্য কিছু পরিমাণ বীজ ধান রাখার পর ৪০০ টাকা কেজিদরে ওই ধান বিক্রি করে দিয়েছেন। তাতে আয় হয়েছে সাত লাখ ২০ হাজার টাকা। সিলেট, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, খুলনাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এসে ওই ধান ক্রয় করেছে। ফকিরহাটের মাসকাটা ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. সোলায়মান আলী জানান, ওই ধান রোপণ করার পর তাঁরা তত্ত্বাবধান করেন। চাষি তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী ধান চাষ করেছেন।
কৃষক রিয়াজুল ইসলাম জানান, ইউটিউবের মাধ্যমে ফাতেমা ধানের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রায় ৬ মাস অপেক্ষা করার পর বাগেরহাটের কৃষক লেবুয়াতের মায়ের নিকট থেকে বীজ সংগ্রহ করি। এরপর প্রাথমিকভাবে আমার ৭৫ শতাংশ জমিতে এ ধানের চাষ করি। এতে সবকিছু মিলে মাত্র ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আমি আশাবাদী এ জমিতে প্রায় ৯৫-১০০ মণ ধান হবে। এই ধান উপজেলাব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার বলেও তিনি মনে করেন। তিনি আরও জানান, এই ধান চাষ করে লাভবান হতে পারব বলে আশা করছি। নিজেও স্বাবলম্বী হতে পারব। এ বছর আরও জমিতে আবাদ করব এই ধান।
আলফাডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রিপন প্রসাদ সাহা জানান, বাগেরহাটের কৃষক কর্তৃক উদ্ভাবিত ফাতেমা জাতের ধানের রয়েছে নানা বৈশিষ্ট্য। এ ধানের ফলন শুধু দেশ নয়, গোটা বিশ্বকে তাক লাগাতে পারে। যা দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা যেতে পারে। তিনি আরও জানান, উপজেলাতে এ ধানের আবাদ বৃদ্ধিতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
গোল মরিচ, যা “মসালার রাজা” নামে পরিচিত, শুধু একটি মসলা নয় বরং এটি পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত লাভজনক একটি ফসল। এর চাহিদা শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও অত্যধিক। আসুন, গোল মরিচের উপকারিতা, পুষ্টিগুণ এবং চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।
গোল মরিচের উপকারিতা:
গোল মরিচে রয়েছে অসংখ্য পুষ্টিগুণ এবং ঔষধি গুণাবলী।
স্বাস্থ্যগত উপকারিতা:
- হজম শক্তি বাড়ায়: গোল মরিচে থাকা পাইপারিন হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে।
- ওজন কমাতে সহায়ক: এটি বিপাকক্রিয়া বাড়িয়ে শরীরের চর্বি দ্রুত কমায়।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়: এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- ত্বকের উজ্জ্বলতা: গোল মরিচ ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নত করতে এবং ব্রণ দূর করতে কার্যকর।
- শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা কমায়: ঠাণ্ডা, কাশি এবং সাইনাসের সমস্যায় এটি অত্যন্ত কার্যকর।
পুষ্টিগুণ:
- ভিটামিন সি, ভিটামিন কে এবং ভিটামিন এ সমৃদ্ধ।
- ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, এবং আয়রনের ভালো উৎস।
- অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
পুষ্টিমূল্যঃ গোল মরিচে আমিষ, চর্বি এবং প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম ও লৌহ থাকে।
ভেষজগুণঃ
১. হজমে সহায়তা করে
২. স্নায়ু শক্তি বাড়ায়
৩. দাঁতের ব্যাথা কমানোতে সহায়তা করে
৪. মাংসপেশী ও হাড়ের জোড়ার ব্যাথা উপশম করে
৫. কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
ব্যবহারঃ মসলা হিসেবে গোল মরিচের ব্যবহার রয়েছে।
গোল মরিচ চাষের পদ্ধতি:
গোল মরিচের চাষ একটি লাভজনক উদ্যোগ, যা সঠিক পদ্ধতিতে পরিচালনা করলে ভালো ফলন দেয়।
জমি ও আবহাওয়া:
- মাটির ধরন:
- দোআঁশ মাটি এবং জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটি উপযুক্ত।
- মাটির pH মান ৫.৫ থেকে ৬.৫ এর মধ্যে থাকা উচিত।
- আবহাওয়া:
- উষ্ণ এবং আর্দ্র জলবায়ুতে গোল মরিচ ভালো জন্মায়।
- ১০০-২০০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাতপূর্ণ অঞ্চলে এটি ভালো ফলন দেয়।
বীজ এবং রোপণ পদ্ধতি:
- বীজ সংগ্রহ:
- উন্নত জাতের গোল মরিচের বীজ সংগ্রহ করুন।
- রোপণ:
- গোল মরিচ গাছ লতানো প্রকৃতির, তাই পায়ার বা খুঁটির সাহায্যে লতা ওঠানোর ব্যবস্থা করুন।
- গাছের মধ্যে ২-৩ মিটার দূরত্ব রাখুন।
- সময়:
- বর্ষাকালের শুরুতে চারা রোপণ উত্তম।
সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা:
- সার:
- জৈব সার (কম্পোস্ট) এবং পটাশিয়াম, ফসফরাসযুক্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগ করুন।
- সেচ:
- নিয়মিত সেচ প্রয়োজন, তবে পানি জমে থাকা এড়িয়ে চলুন।
উপযুক্ত মাটি ও জমিঃ পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয় ও আর্দ্রতা বেশি এমন এলাকায় গোল মরিচ ভাল জন্মে। এ ফসল 100C-400C পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। পিএইচ ৪.৫-৬.০ পর্যন্ত এ ফসল ফলানো যায়। পাহাড়ি এলাকার মাটি এ ফসল চাষের জন্য খুব উপযোগী।
জাত পরিচিতিঃ স্থানীয় জাত
সার ব্যবস্থাপনাঃ প্রতি গর্তে ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১১০ গ্রাম টিএসপি ও ৪৫০ গ্রাম পটাশ দিতে হয়। তবে এ পরিমাণ সার তৃতীয় বছর হতে দিতে হবে। এ পরিমাণের ১/৩ ভাগ ১ম বছর এবং ২/৩ ভাগ দ্বিতীয় বছরে দিতে হবে। সার সাধারণতঃ বছরে দু’বারে দিতে হয়। একবার মে-জুন মাসে ও পরের বার আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে দিতে হয়। এছাড়া প্রতি বছর প্রতি গর্তে মে-জুন মাসে ১০ কেজি পঁচা গোবর ও প্রতি ১ বছর অন্তর-অন্তর প্রতি গর্তে ৬০০ গ্রাম চুন দিতে হবে।
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনাঃ আগাছা দেখা দিলে পরিষ্কার করতে হবে ও মাটিতে রসের অভাব হলে পানি সেচ দিতে হবে। ডগা বাড়তে থাকলে ঠেস গাছের সাথে বেঁধে দিতে হবে।
রোগবালাই ও প্রতিকার:
গোল মরিচ গাছে পাতা পুড়ে যাওয়া, গোড়া পচা এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে পারে। প্রতিরোধের জন্য:
- সময়মতো কীটনাশক ব্যবহার করুন।
- পচন রোধে সঠিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখুন।
পোকা
পোকার নাম : ফ্লি বিটল
ভূমিকা : এ পোকার আক্রমণে শতকরা ৩০ -৪০ ভাগ ক্ষতি হতে পারে। সে কারনে এ পোকা দেখা মাত্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
পোকা চেনার উপায় : পূর্নাঙ্গ বিটল কালো পাখা যুক্ত, মাথা ও ঘাড় হলদে বাদামী বর্ণের।
ক্ষতির নমুনা : পূর্ণাঙ্গ ও কীড়া উভয় গাছের কচি অংশ খেয়ে নষ্ট করে ।
– পূর্ণাঙ্গ বিটল ফল ছিদ্র করে ফলের মধ্যে ঢুকে ভেতরের অংশ খায়।
– আক্রান্ত ফল প্রথমে হলুদ ও পরে কালো হয়।
– কীড়া ফলের বীজ ছিদ্র করে ভেতরের অংশ খায় ।
অনুকুল পরিবেশ : ছায়াযুক্ত স্থান।
জীবন চক্র : স্ত্রী বিটল জুলাই মাসে কচি ফলে ১-২ টি ডিম পাড়ে। প্রতিটি পোকা ১০০ টি করে ডিম পাড়ে। ৫-৮ দিনে ডিম থেকে কীড়া বের হয়। কীড়া ২০-৩২ দিন পরে পুত্তলিতে পরিণত হয়। ৬-৭ দিন পর পুত্তলি হতে পূর্ণাঙ্গ বিটল বের হয়। পূর্ণাঙ্গ বিটল ৩৯-৫০ দিন বাঁচে।
ব্যবস্থাপনা : নিয়মিত গাছ ছাঁটাই করে বৃদ্ধি কমাতে হবে।
– অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ।
রোগ ব্যবস্থাপনাঃ
নার্সারী
নার্সারীতে পাতা পচা ও ঢলে পড়া রোগ দেখা যায়। পাতা পচা রোগে পাতায় কাল দাগ পড়ে এবং ঢলে পড়া রোগ হলে কাটিং নেতিয়ে পড়ে।
দমন: ব্যাভিস্টিন বা কপার অক্সি ক্লোরাইড নামক ছত্রাক নাশক প্রতি দশ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম হারে ১০-১২ দিন অন্তর অন্তর ৩ বার প্রয়োগ করলে এ রোগ দমন করা যায়।
মাঠে হটাৎ ঢলে পড়া রোগ
লক্ষণঃ
১. পাতার উপর কালো দাগ পড়ে এবং পরে দাগ বড় হয়।
২. কচি পাতা ও ডগা আক্রমণে কালো হয়ে যায়। অধিক আক্রমণে গাছ মরে যায়।
৩. গোড়া সহ সকল স্থানে আক্রমণ ছড়াতে পারে।
৪. বর্ষা মৌসুমের শেষে আক্রমণ হলে গাছ হলুদ হয়ে ঢলে পড়তে পারে।
দমনঃ
১. মাটিসহ গাছ তুলে ধ্বংস করা
২. রোগমুক্ত কাটিং ব্যবহার
৩. পরিচর্যার সময় শিকড়ে ক্ষত করা যাবেনা
৪. সাকার (ডগা) মাটিতে বাড়তে দেয়া যাবেনা
৫. ০.২% হারে কপার অক্সিক্লোরাইড প্রয়োগ
ফসল তোলাঃ মে-জুন মাসে ফুল আসে এবং ৬-৮ মাস পর ফল তোলা যায়। থোকায় ২/১টি ফল উজ্জ্বল কমলা বা বেগুণী হলে সংগ্রহ করে ৭-১০ দিন রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়।
- রোপণের ২-৩ বছরের মধ্যে গোল মরিচ ফল উৎপাদন শুরু করে।
- পাকা মরিচ সংগ্রহের পর রোদে শুকিয়ে প্যাকেজিং করুন।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব:
- বাজার চাহিদা:
- স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে গোল মরিচের চাহিদা অত্যধিক।
- রপ্তানি সম্ভাবনা:
- বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বড় পরিমাণে গোল মরিচ রপ্তানি করা হয়।
- লাভজনক ফসল:
- একবার চাষ করে দীর্ঘমেয়াদে ফলন পাওয়া যায়, যা কৃষকদের জন্য লাভজনক।
গোল মরিচ শুধুমাত্র একটি সুগন্ধি মসলা নয়, এটি একটি পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ফসল। সঠিক চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করলে এটি আপনাকে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে পারে। তাই, গোল মরিচ চাষে আগ্রহী হলে আজই শুরু করুন এবং এর মাধ্যমে আপনার কৃষি আয় বৃদ্ধি করুন।
ছোলা বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় একটি ডালশস্য। এটি শুধু স্বাদে নয়, বরং পুষ্টিগুণেও অনন্য। গ্রামীণ ও শহুরে উভয় অঞ্চলে ছোলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ছোলার চাষ কৃষকদের জন্য লাভজনক হওয়ার পাশাপাশি এটি স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের কাছেও অত্যন্ত প্রিয়। আসুন, ছোলার পুষ্টিগুণ, উপকারিতা, এবং এর চাষাবাদের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।
ছোলার পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা
ছোলা প্রোটিন, ফাইবার, এবং মিনারেলের চমৎকার উৎস। এটি মানবদেহে বিভিন্নভাবে উপকার করে।
ছোলার পুষ্টিগুণ
- প্রোটিন সমৃদ্ধ: ছোলা শরীরের পেশি গঠনে সহায়তা করে।
- ফাইবার: হজমশক্তি বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
- ভিটামিন ও মিনারেলস: এতে আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, এবং ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স থাকে।
- লো ক্যালরি: ছোলা কম ক্যালরিযুক্ত, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ছোলার ব্যবহার: ডাল হিসেবে এবং পবিত্র রমজান মাস সহ অন্যান্য সময়ে মুখরোচক খাদ্য হিসেবে।
ছোলার উপকারিতা
- হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক: ছোলায় থাকা ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হার্ট সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: ছোলার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ায় এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর।
- হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি: ছোলার ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম হাড়কে শক্তিশালী করে।
- ওজন কমাতে সহায়ক: ছোলার ফাইবার দীর্ঘ সময় পেট ভরা রাখে, যা অতিরিক্ত খাওয়া কমায়।
- ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি: ছোলার ভিটামিন ই ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে।
ছোলার উপযুক্ত জমি ও মাটি
দো-আঁশ ও এটেল দো-আঁশ মাটিতে ছোলা ভালো জন্মে।
ছোলার চাষাবাদ পদ্ধতি
ছোলার চাষ তুলনামূলক সহজ এবং এটি কম খরচে ভালো উৎপাদন দেয়।
মাটির ধরন ও আবহাওয়া:
- ছোলার জন্য দোআঁশ বা বেলে-দোআঁশ মাটি উপযুক্ত।
- এটি শীতকালীন ফসল, সাধারণত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে চাষ শুরু হয়।
বীজ নির্বাচন:
- উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহার করুন।
- বীজ রোপণের আগে ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করুন।
মাটি প্রস্তুত:
- জমি ভালোভাবে চাষ করে ঝরঝরে করতে হবে।
- জৈব সার এবং প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করুন।
বীজ রোপণ:
- ৪০-৪৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারি করে বীজ বপন করুন।
- প্রতি হেক্টরে ৫০-৬০ কেজি বীজ ব্যবহার করা হয়।
সেচ ব্যবস্থা:
- ছোলার চাষে সেচ খুব বেশি প্রয়োজন হয় না। তবে খরার সময় হালকা সেচ দিন।
আগাছা দমন:
- নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
পোকামাকড় ও রোগ প্রতিরোধ:
- ছোলার ফসলে ব্লাইট, উইল্ট এবং কাটওয়ার্মের আক্রমণ হয়। সময়মতো কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
জাত পরিচিতি
বারি ছোলা-২ (বড়াল)
গাছের রং সবুজ। বীজ স্থানীয় জাতের চেয়ে বড়। হাজার বীজের ওজন ১৪০-১৫০ গ্রাম। বীজের রং হালকা বাদামি। বীজের আকার বড় হওয়ায় এ জাতের ছোলা কৃষক ও ক্রেতার কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য। ডাল রান্না হওয়ার সময়কাল ৩০-৩৫ মিনিট। আমিষের পরিমাণ ২৩-২৭%। বারি ছোলা-২ এর জীবনকাল ১২০-১৩০ দিন। হেক্টরপ্রতি ফলন ১.৩-১.৬ টন। এ জাত নুয়ে পড়া বা উইল্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন।
বারি ছোলা-৩ (বরেন্দ্র)
এ জাতের গাছ খাড়া প্রকৃতির। রং হালকা সবুজ, পত্রফলক বেশ বড় এবং ডগা সতেজ। বীজের আকার বেশ বড়। হাজার বীজের ওজন ১৮৫-১৯৫ গ্রাম। ডাল রান্না হওয়ার সময়কাল ৪০-৪৪ মিনিট। আমিষের পরিমাণ ২৩-২৬%। সঠিক সময়ে বুনলে পাকতে সময় লাগে ১১৫-১২৫ দিন। এ জাতটি রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে আবাদের জন্য বেশি উপযোগী। ফলন হেক্টরপ্রতি ১.৮-২.০ টন পাওয়া যায়।
বারি ছোলা-৪ (জোড়াফুল)
গাছ মাঝারি খাড়া এবং পাতা গাঢ় সবুজ। কান্ডে খয়েরি রংয়ের ছাপ দেখা যায়। বীজের পার্শ্ব দিক সামান্য চেপ্টা, ত্বক মসৃণ। বীজের রং হালকা বাদামি। হাজার বীজের ওজন ১৩২-১৩৮ গ্রাম। গাছের উচ্চতা ৫০-৬০ সেমি। ডাল রান্না হওয়ার সময়কাল ৩২-৩৮ মিনিট। আমিষের পরিমাণ ১৮-২১%। জীবনকাল ১২০-১২৫ দিন। ফলন হেক্টরপ্রতি ১.৯-২.০ টন। এ জাতটি ফিউজেরিয়াম উইল্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
সম্পন্ন।
বারি ছোলা-৫ (পাবনাই)
বীজ আকারে ছোট, রং ধূসর বাদামি এবং হিলাম খুব স্পষ্ট। বীজের পার্শ্ব কিছুটা চেপ্টা এবং ত্বক মসৃণ। হাজার বীজের ওজন ১১০-১২০ গ্রাম। ডাল রান্না হওয়ার সময়কাল ৩৫-৪০ মিনিট। আমিষের পরিমাণ ২০-২২%। এ জাত ১২৫-১৩০ দিনে পাকে। ফলন হেক্টরপ্রতি ১.৮-২.০ টন।
বারি ছোলা-৬ (নাভারুন)
বীজের আকার কিছুটা গোলাকৃতি, ত্বক মসৃণ এবং রং উজ্জ্বল বাদামি হলদে। বীজ আকারে দেশী জাতের চেয়ে বড়। হাজার বীজের ওজন ১৫৫-১৬৫ গ্রাম। এ জাতের ডাল রান্নার সময়কাল ৩২-৩৭ মিনিট। আমিষের পরিমাণ ১৯-২১%। জীবনকাল ১২৫-১৩০ দিন। ফলন হেক্টরপ্রতি ১.৮-২.০ টন। জাতটি নাবীতে বপন করেও অন্যান্য জাতের চেয়ে অধিক ফলন পাওয়া যায়।
বীজ বপন
ছিটিয়ে ও লাইন করে বীজ বপন করা যায়। লাইনে বপনের ক্ষেত্রে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৪০ সেমি রাখতে হবে। বীজের হার ৪৫-৫০ কেজি/হেক্টর, ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে বীজের পরিমাণ কিছু বেশি অর্থাৎ ৫০-৬০ কেজি/হেক্টর দিতে হবে। অগ্রহায়ণ মাসের ৫ থেকে ২৫ (২০ নভেম্বর-১০ ডিসেম্বর)। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য কার্তিক মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তৃতীয় সপ্তাহ (অক্টোবর শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ) সময়ে বীজ বপন করতে হবে।
সারের পরিমাণ
জমিতে শেষ চাষের সময় হেক্টরপ্রতি নিম্নরুপ সার প্রয়োগ করতে হবে।
সারের নাম | সারের পরিমাণ (কেজি/হেক্টর) |
ইউরিয়া | ৪০-৫০ |
টিএসপি | ৮০-৯০ |
এমওপি | ৩০-৪০ |
বোরিক এসিড (বোরাক্স) | ১০-১২ |
অণুজীব সার | ৫-৬ |
চাষের সময় সমুদয় সার প্রয়োগ করতে হয়। অপ্রচলিত এলাকায় আবাদের জন্য সুপারিশ মত নির্দিষ্ট অণুজীব সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। প্রতি কেজি বীজের জন্য ৮০ গ্রাম হারে অণুজীব সার প্রয়োগ করতে হয়। ইনোকুলাম সার ব্যবহার করলে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয় না।
সেচ ও আগাছা ব্যবষপনা
বপনের ৩০-৩৫ দিনের মধ্যে একবার আগাছা দমন করা প্রয়োজন। অতি বৃষ্টির ফলে যাতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয় সেজন্য অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে বপনের পর হালকা সেচ দিতে হবে।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
পোকার নাম: পড বোরার
ক্ষতির নমুনা: পোকার কীড়া (শুককীট) কটি পাতা, ফুল ও ডগা খায়। ফল বড় হওয়ার সময় ছিদ্র করে ভিতরের নরম অংশ খায়। একটি কীড়া পূর্ণাঙ্গ হওয়ার পূর্বে ৩০-৪০ টি ফল খেয়ে ফেলতে পারে। এ রোগে ছোলার উৎপাদন অনেক হ্রাস পায়।
ব্যবস্থাপনা: কীড়া ছোট অবস্থায় দাত দিয়ে সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে ডেসিস ২.৫ ইসি বা রিপকর্ড ১০ ইসি বা সিমবুস ১০ ইসি বা ফেসম ১০ ইসি ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর ১-২ বার সেপ্র করতে হবে।
রোগ ব্যবস্থাপনা
রোগের নাম: ছোলার উইল্ট বা নুইয়ে পড়া রোগ
ক্ষতির নমুনা: চারা অবস্থায় এ রোগে আক্রান্ত গাছ মারা যায় এবং পাতায় রংয়ের কোন পরিবর্তন হয় না। পরিপূর্ণ বয়সে গাছ আক্রান্ত হলে পাতা ক্রমান্বয়ে হলদে রং ধারণ করে। আক্রান্ত গাছ ঢলে পড়ে ও শুকিয়ে যায়। লম্বালম্বিভাবে কাটলে কান্ডের মাঝখানের অংশ কালো দেখা যায়।
ব্যবস্থাপনা: জাত যেমন বারি ছোলা- এবং বারি ছোলা-৪ এর চাষ করতে হবে। ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব সার ব্যবহার করতে হবে।
রোগের নাম: ছোলার গোড়া পচা রোগ
ক্ষতির নমুনা: চারা গাছে এ রোগ বেশি দেখা যায়। আক্রান্ত গাছ হলদে হয়ে যায় এবং শিকড় ও কান্ডের সংযোগ স্থলে কালো দাগ পড়ে। গাছ টান দিলে সহজেই উঠে আসে। আক্রান্ত স্থানে গাছের গোড়ায় ছত্রাকের জালিকা ও সরিষার দানার মত স্কেলেরোসিয়া গুটি দেখা যায়।
ব্যবস্থাপনা: ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। সুষম হারে সার প্রয়োগ করতে হবে। ভিটাভেক্স-২০০ প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫-৩.০ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।
রোগের নাম: ছোলার বট্রাইটিস গ্রে মোল্ড রোগ
ক্ষতির নমুনা: ছোলার বৃদ্ধি ব্যবস্থাপনা কিংবা ফল আসার শুরুতেই এর রোগের আক্রমণ লক্ষ করা যায়। এ রোগের লক্ষণ কান্ড, পাতা, ফুল ও ফলে প্রকাশ পায়। আক্রান্ত স্থানে ধূসর রংয়ের ছত্রাকের উপস্থিতি দেখা যায়।
অনুকুল পরিবেশ: জমিতে গাছ বেশি ঘন থাকলে এবং বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকলে এ রোগ ব্যাপকতা লাভ করে।
ব্যবস্থাপনা: ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। বাভিস্টিন অথবা থিরাম প্রতি কেজি বীজে ২.৫-৩.০ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। বাভিস্টিন ০.২% হারে ১০-১২ দিন পরপর ২-৩ বার সেপ্র করতে হবে।
গুদামজাত ডালের পোকা ব্যবস্থাপনা
ভূমিকা: পূর্ণবয়স্ক পোকা ও কীড়া উভয়ই গুদামজাত ডালের ক্ষতি করে থাকে।
ক্ষতির নমুনা: এ পোকা ডালের খোসা ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে শাঁস খেতে থাকে। ফলে দানা হাল্কা হয়ে যায়। এর ফলে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় এবং খাওয়ার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে।
ব্যবস্থাপনা: গুদামজাত করার আগে দানা ভালভাবে পরিষ্কার করতে হয়। ডালের দানা শুকিয়ে পানির পরিমান ১২% এর নিচে আনতে হবে। বীজের জন্য টন প্রতি ৩০০ গ্রাম ম্যালাথিয়ন বা সেভিন ১০% গুড়া মিশিয়ে পোকার আক্রমণ প্রতিরোদ করা যায়। ফসটক্সিন ট্যাবলেট ২টি বড়ি প্রতি ১০০ কেজি গুদামজাত ডালে ব্যবহার করতে হয়। এ বড়ি আবদ্ধ পরিবেশে ব্রবহার করতে হয়।
ফসল তোলা
চৈত্রের প্রথম সপ্তাহ থেকে মধ্য-চৈত্র (মধ্য-মার্চের শেষ) সময়ে ফসল সংগ্রহ করতে হবে।
- বপনের ৯০-১২০ দিনের মধ্যে ছোলা সংগ্রহ করা যায়।
- ফসল শুকিয়ে সংরক্ষণ করুন।
ছোলার অর্থনৈতিক গুরুত্ব
- বাজার চাহিদা: ছোলা সারা বছর বাজারে চাহিদা রয়েছে।
- রপ্তানি: বাংলাদেশের ছোলা আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানি হয়।
- কৃষকদের আয় বৃদ্ধি: সঠিক পরিচর্যায় ছোলার উৎপাদন খরচ কম এবং লাভ বেশি।
ছোলা শুধুমাত্র একটি পুষ্টিকর খাদ্য নয়, এটি কৃষকদের জন্য একটি অর্থকরী ফসল। সঠিক চাষ পদ্ধতি এবং যত্নে ছোলা চাষ করে আপনি ভালো আয় করতে পারেন। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের জন্য ছোলা একটি উৎকৃষ্ট খাবার। তাই, ছোলা চাষে আগ্রহী হলে আজই শুরু করুন এবং এই পুষ্টিগুণে ভরপুর ফসল থেকে আয় ও স্বাস্থ্য লাভ করুন।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের কানিহাটি গ্রাম। কৃষিনির্ভর এ গ্রামের দিগন্তজোড়া মাঠে এখন ধানক্ষেত। শিশির ভেজা বাতাসে দুলছে সোনালি ফসল। এই গ্রামেরই দুই বিঘা জমি ঘিরে টান টান উত্তেজনা। কারণ এই জমির ধান সাধারণ নয়, এই ধান ভিন্ন প্রকৃতির। বিস্ময়জাগানো পাকা এ ফসল কাটা হবে আর কয়েকদিন পর। তখন নিভৃত কানিহাটি গ্রাম থেকে সৃষ্টি হবে নতুন এক ইতিহাস। একবার রোপণে এ ধানের গাছে বছরজুড়ে পাঁচবার ফলন এসেছে।
ধানের এ নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ধান গবেষক ও জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী। তিনি সমকালকে জানান, বোরো হিসেবে বছরের প্রথমে লাগানো এ ধান ১১০ দিন পর পেকেছে। ওই গাছেই পর্যায়ক্রমে ৪৫ দিন পরপর একবার বোরো, দু’বার আউশ এবং দু’বার আমন ধান পেকেছে।
এক গাছে পাঁচ ফলনের এমন ঘটনা পৃথিবীতে বিরল বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে আবেদ চৌধুরী আছেন তার উদ্ভাবন আরও এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টায়। তিনি ওই গাছেই ছয়বার ফসল তোলার গবেষণা চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি নতুন জাতের ধানটি সারাদেশেই চাষাবাদ সম্ভব কিনা তা যাচাই করবেন। এজন্য বিভিন্ন জেলায় এ ধানের পরীক্ষামূলক চাষ করবেন।
আবেদ চৌধুরীর ভাষ্য, কম সময়ে পাকা এই ধানের উৎপাদন বেশি, খরচও কম। তবে প্রথম ফলনের চেয়ে পরের ফলনগুলোতে উৎপাদন কিছুটা কম। কিন্তু পাঁচবারের ফলন মিলিয়ে উৎপাদন প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।
কুলাউড়ার কানিহাটি গ্রামের সন্তান আবেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরি নিয়ে চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানকার জাতীয় গবেষণা সংস্থার প্রধান ধানবিজ্ঞানী হিসেবে ধানের জিন নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়ে দিয়েছেন ২০ বছর। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩০০ রকমের নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন। পেশাগত কারণে বিদেশের মাটিতে গবেষণা করলেও দেশে তার গ্রাম কানিহাটিতে গড়ে তুলেছেন খামার।
আবেদ চৌধুরী বলেন, ‘আম-কাঁঠালের মতো বছরের পর বছর টিকে থাকার সৌভাগ্য ধান গাছের হয় না- এটা কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না। তাই নেমে পড়ি গবেষণায়।’
ধান গাছের দ্বিতীয় জন্ম নিয়ে ১৪ বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান আবেদ চৌধুরী। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে কানিহাটি গ্রামে ২৫ বর্গমিটারের একটি ক্ষেতে ২০টি ধানের জাত নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি। এর মধ্যে চীন, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশের ও স্থানীয় ধানের জাত ছিল। যে জাতগুলোর ধান পাকার পর কেটে নিয়ে গেলে আবার ধানের শীষ বের হয়, সেগুলো তিনি আলাদা করেন। এভাবে ১২টি জাত বের করেন। তিন বছর ধরে জাতগুলো চাষ করে দেখলেন, নিয়মিতভাবে এগুলো দ্বিতীয়বার ফলন দিচ্ছে। তারপর তিনি শুরু করেন একই গাছে তৃতীয়বার ফলনের গবেষণা। তাতেও সফল হলেন। কিন্তু এর মধ্যে চারটি জাত ছাড়া বাকিগুলো চতুর্থবার ফলন দিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়।
আবেদ চৌধুরী জানান, চারটি জাত একই গাছ থেকে পাঁচবার ফলন দিচ্ছে। এই চারটি জাতের ওপর ১০ বছর ধরে চলছে গবেষণা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বোরো ধানের এই চারটি জাত দুই বিঘা জমিতে রোপণ করা হয়। পরিমাণমতো ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা হয়। সঠিকভাবে সেচ ও পরিচর্যা করার পর ১১০ দিনের মধ্যে ৮৫ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার উচ্চতার গাছে ফসল আসে। পরে মাটি থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার উচ্চতায় পরিকল্পিতভাবে ওই ধান কেটে ফেলা হয়।
মে মাসে প্রথম দিকে প্রথমবার কাটা ধানে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হয়েছে চার টন। তারপর থেকে ৪৫ দিন অন্তর প্রতিটি মৌসুমে হেক্টরপ্রতি কখনও দুই টন, কখনও তিন টন ফলন এসেছে। সবগুলো জাত হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৬ টন ফলন দিয়েছে।
বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী বলেন, দুটি পদ্ধতির মাধ্যমে জাতগুলো করা হয়েছে। স্থানীয় জাতের সঙ্গে বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল জাত এবং স্থানীয় জাতের সঙ্গে স্থানীয় হাইব্রিড জাতের সংকরায়ন ঘটানো হয়েছে। ১০-১২ বছর আগে এগুলো থেকে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বার ফলন দেওয়ার জন্য উপযোগী করে চিহ্নিত করা হয়।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদন হয়ে থাকে তিন থেকে চার টন। গতকাল শুক্রবার টেলিফোনে আবেদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সারা পৃথিবীর জন্য ঐতিহাসিক। আমার নিজ গ্রাম কানিহাটির কৃষকদের সমন্বয়ে আমি এটি করতে পেরেছি। সারা বছর যেহেতু ধান দিচ্ছে, সেহেতু বর্ষজীবী বলা যেতে পারে। কারণ একটি ঋতুর পরই সাধারণত ধানের জীবনের অবসান ঘটে। কিন্তু আমার উদ্ভাবিত ধান বোরা, আউশ ও আমন তিন মৌসুম বা পুরো বছর ধরে ফসল দিয়েছে।’
তিনি বলেন, সাধারণত ধান একবার লাগানো হয় এবং ১২০ দিন পর কাটা হয়। এভাবে আমাদের বোরো, আউশ ও আমন ধান আছে। আমার উদ্ভাবিত ধানগুলো লাগানো হয়েছে বছরের প্রথমে বোরো হিসেবে। তারপর একটি বোরো, দুটি আউশ এবং দুটি আমন দিয়েছে। যতবার ফসল কেটে ঘরে নেওয়া হয়েছে, ততবারই গাছটি আরও বেশি বড় হয়ে উঠেছে। এটি একটি যুগান্তকারী ফলাফল। এবার আর কয়েকদিন পর পঞ্চমবারের মতো ধান কেটে গাছগুলো রেখে দেওয়া হবে। এই গাছ থেকে আরও ফলন আনতে গবেষণা চলবে।
নতুন ধানের নামকরণ বিষয়ে আবেদ চৌধুরী বলেন, একই গাছের শরীর থেকে পাঁচবার ধান বেরিয়ে আসে। ফলে এই ধানের তিনি নাম দিতে চান ‘পঞ্চব্রীহি’। নামকরণের ব্যাখ্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, ধানকে ব্রীহি বলা হয়। এটা যেহেতু পাঁচবার ফলন দিয়েছে, সেহেতু ‘পঞ্চব্রীহি’ নাম দিতে চাই। পরবর্তী ষষ্ঠবার ফল দিলে ষষ্ঠব্রীহি নামে নামকরণ করা যেতে পারে। তবে এই ধানের নাম এখনও তিনি চূড়ান্ত করেননি।
তিনি বলেন, বছরের যে কোনো সময়ে এ ধান রোপণ করা যায়। এখন পরের ধাপগুলোতে কিছুটা কম উৎপাদন হচ্ছে। আমার চেষ্টা থাকবে, আরও বেশি ফলন বের করার।
পঞ্চমবার ফলন দেওয়া ধান উদ্ভাবন সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে আবেদ চৌধুরী বলেন, এর আগে আমি অন্য ধানের জাত উদ্ভাবন করেছি। দু’বার ফসল হয়, এমন ধানও উদ্ভাবন করেছিলাম; যাকে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ‘রাইস টুআইস’ বলেছে। আবার অনেকে ‘জীবন বর্ধিত ধান’ বলেছে। এই প্রথম সারা বছর ধরে আমার অন্য আরেকটি ধানের জাত মাঠে থাকল। এ ধানের চারা ৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ করতে হয়। ফলে গাছটি মাটি থেকে ভালোভাবে শক্তি নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে এবং একটি ধান গাছ থেকে আরও বেশ কয়েকটি ধান গাছ গজাতে থাকে।
এই ধান পরিবেশবান্ধব উল্লেখ তিনি বলেন, কোনো একটি জমি যতবার চাষ দেওয়া হবে, ততবার মিথেন গ্যাস ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে। একবার চাষ দিয়ে দু’বার ফসল উৎপাদন করলে উৎপাদন খরচ কমে যাওয়ার পাশাপাশি তা কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমিয়ে এনে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে।
ধানের এই জাতগুলোকে দেশের কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে আবেদ চৌধুরী জানান, এ ধানের বীজ সংগ্রহ সহজ। কৃষকরা নিজেরাই তা করতে পারবেন। অন্য ধানের মতো বীজতলায় রোপণের পর চারা তুলে চাষ করতে হয়।
তিনি বলেন, ‘আপাতত আমি নিজের খরচে কানিহাটিতে পরীক্ষামূলক চাষ করব। তারপর সারাদেশে চাষ করে দেখব। সারাদেশের ফলাফল বিশ্নেষণ করে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ধানের বীজ কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে ভাবব।’
আবেদ চৌধুরী অস্ট্রেলিয়ায় থাকলেও সবকিছু দেখার জন্য রাসেল মিয়া নামে একজনকে দায়িত্ব দিয়ে যান। রাসেল মিয়া বলেন, এ ধানে চিটা নেই। খরচ কম এবং ফলন বেশি। জমিতে রেড়ি করে বোরো রোপণের পর আর জমি রেড়ি করতে হয় না। নির্দিষ্ট একটা মাপে ধান কেটে নেওয়ার পর মোড়া অংশে লতাপাতা ও ঘাস বাছাই করে সার দিই। এটুকু করলেই আবার ধানের গাছ বাড়তে থাকে।
রাসেল জানান, যদি পোকামাকড়ে ধরে তাহলে সামান্য কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। এই ধান মেঘবৃষ্টি নষ্ট করতে পারে না। খুব শক্ত ধানের গাছ। এলাকার কৃষকরা এ ধানের ফলন দেখে চাষাবাদ করতে আগ্রহী হয়েছেন।
কুলাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল মোমিন বলেন, এক গাছে পাঁচবার ধান উৎপাদন নতুন দেখেছি। এটি দেশের জন্য সুখবর। এই উদ্ভাবনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া উচিত।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) নবনিযুক্ত মহাপরিচালক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ও বিশিষ্ট কৃষিবিদ ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, পুনর্জন্ম পদ্ধতিতে একটি ধান গাছে চারবার ফলন আসা সম্ভব। তবে পাঁচবার ফলন বের করা একটু কঠিন।
ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলামের ভাষ্য, প্রথমবার ফলন আসার পর পরের বার ফলন কমতে থাকে। এ জন্য এটি এতটা লাভজনক নয়। ততদিনে এই ধান কেটে আরেকটি ফসল লাগালে লাভজনক হবে। এক গাছে সর্বোচ্চ দু’বার ফলন হলে ভালো। এ পদ্ধতিতে এখন ফল বাড়াতে আরও গবেষণা করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, এটি জীনবিজ্ঞানীর কাজ নয়। ফলন বাড়ানোর বিষয়ে কৃষিতত্ত্ববিদ ও মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে পারেন। মাটি, গাছ, প্রজনন, বায়োকেমেস্ট্রি ও জিনসহ সব ব্যবস্থাপনা দেখতে হবে। আবেদ চৌধুরী শুধু জিনের অবস্থা দেখছেন। লাভক্ষতি হিসাব করতে হবে। শুধু উদ্ভাবন করলে হবে না, ফলন আশাব্যঞ্জক না হলে কৃষক তা নেবেন না।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক কৃষিবিজ্ঞানী ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, একটি ধানের গাছ থেকে একাধিকবার ফসল সম্ভব, কিন্তু ফলন কম হবে। এটি টেকসই কোনো উদ্ভাবন নয়। যেখানে আমরা জমিতে আরও বেশি উৎপাদনের চেষ্টা করছি, সেখানে তিনি খরচ বাঁচানোর জন্য উৎপাদন কমনোর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে তো লাভ নেই। এসব বিষয় নিয়ে আবেদ চৌধুরীর সঙ্গে আমরা একাধিকবার কথা বলেছি। তাকে আমরা দাওয়াত দিয়েছি, কিন্তু তিনি আসেন না। আমরা তো বিজ্ঞান নিয়েই ৫০ বছর ধরে চর্চা করছি। ধানের ফলন বাড়ানোসহ নানা বিষয় নিয়ে কাজ করছি।
ড. আবেদ চৌধুরী বংশগতিবিষয়ক গবেষক। একদল অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানীর সঙ্গে তিনি ফিস (ইন্ডিপেনডেন্ট সিড) জিন আবিস্কার করেন। তিনি লাল রঙের চাল ও রঙিন ভুট্টাও উদ্ভাবন করেছেন। তার ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার প্রতিরোধক রঙিন ভুট্টা বিশ্বব্যাপী আলোচিত। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদন ও ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণা করছেন।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন