ভোজ্যতেলের নতুন নির্ধারিত বাড়তি দর এখনো বাজারে কার্যকর হয়নি। তবে বাজারে যে দামে সয়াবিন ও পামঅয়েল বিক্রি হচ্ছে তা গত সপ্তাহের তুলনায় লিটারে তিন থেকে পাঁচ...
নিষিদ্ধ মাদক মরফিন, আফিম ও হেরোইনের ব্যবহার কমাতে বিশ্বব্যাপী অনেক দেশেই পপি সিড বা পোস্তদানার উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বাংলাদেশেও কয়েক দশক ধরে পোস্তদানার আমদানি, ক্রয় ও বিক্রয় নিষিদ্ধ। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের বীজ ঘোষণা দিয়ে প্রায় সময়েই দেশের কাস্টমস পার হয়ে আমদানি হচ্ছে পোস্তদানা। তাছাড়া মসলাজাতীয় পণ্য হিসেবে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা পার্বত্য অঞ্চলেও পোস্তদানার চাষ হয় প্রকাশ্যে। নানামুখী বিধিনিষেধ সত্ত্বেও শীত মৌসুমের উৎসব-অনুষ্ঠান সামনে রেখে অনেকটা প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে পোস্তদানা। বাংলাদেশে পোস্তদানা ব্যবহার মসলা হিসেবে। মাংস রান্না কিংবা নিরামিষ সবজি রান্নায় পোস্তদানার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এ কারণে রোজার মাস কিংবা শীত মৌসুমে বিয়ে ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদির সময় পোস্তদানার চাহিদা বেড়ে যায়। কয়েক মাস আগেও পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি পোস্তদানা ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল। সর্বশেষ এক মাসে পোস্তদানার দাম বেড়ে ৪ হাজার টাকায় ঠেকেছে, যা বর্তমান সময়ে জাফরানের পর সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হওয়া মসলা পণ্য। মূলত আমদানি নিষিদ্ধ থাকায় চোরাই পথে আমদানি ও মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে আমদানি হওয়ায় পোস্তদানা ব্যবসায় অস্বাভাবিক লাভ করছেন ব্যবসায়ীরা। দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্তত দুই দশক ধরে দেশে পপি সিড বা পোস্তদানা আমদানি নিষিদ্ধ। এর পরও সরিষা, তিসি কিংবা অন্যান্য শস্যবীজের ঘোষণায় দেশে পোস্তদানা আমদানি হয়। আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ায় পণ্যটি লুকিয়ে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। অনেক ক্ষেত্রে তিল কিংবা তিসির মতো বীজের সঙ্গে মিল থাকায় এটি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের আড়ালে থেকে যায়। আবার চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় দেখতে একই রকম বীজ মিশিয়ে পোস্তদানা বিক্রি হচ্ছে দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলোয়। মসলা ব্যবসায়ী ও খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মরফিনের উপস্থিতি থাকায় সিঙ্গাপুরে আফিম গাছ থেকে প্রাপ্ত পোস্তদানা বিক্রি নিষিদ্ধ রয়েছে। পোস্তদানা দিয়ে সরাসরি মরফিন, আফিম কিংবা হেরোইন উৎপাদন না হলেও বীজ রোপণের মাধ্যমে আফিম তৈরির সুযোগ না দিতে পপি সিডের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া আছে। চীন, সৌদি আরব, তাইওয়ান, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বে অনেক দেশেই এটি নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে। খাতুনগঞ্জের মেসার্স সাতকানিয়া ট্রেডার্েসর স্বত্বাধিকারী সিদ্দিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, মসলাজাতীয় পণ্য হিসেবেই ব্যবসায়ীরা পোস্তদানা বিক্রি করেন। আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ায় পোস্তদানার দাম সবসময়ই বেশি থাকে। তবে শীত মৌসুমে বিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠান বেশি থাকায় চাহিদা ও দাম দুটোই অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের অভিযানের সময় কিছু প্রতিষ্ঠানে পোস্তদানা উদ্ধার হলেও অনেকটা প্রকাশ্যেই পোস্তদানার ব্যবসা চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি। চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, গত বেশ কয়েকটি ত্রিবার্ষিক আমদানি নীতি আদেশে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য হিসেবে পোস্তদানার নাম রয়েছে। ২০১৯ সালের জুনে ২১টি ক্যাটাগরির পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে ‘আমদানি নীতি ২০১৮-২১’ অনুমোদন করে সরকার। সরকারের অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমদানি নীতি ২০১৮-২১ তিন বছর মেয়াদি এ আমদানি নীতি উপস্থাপন করা হলে তা পর্যালোচনা শেষে অনুমোদন দেয়া হয়। আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে মিথ্যা ঘোষণা ও সীমান্তপথ দিয়ে চোরাই পথে আসা ছাড়া দেশে পোস্তদানা প্রবেশের সুযোগ নেই। গত এক দশকে চট্টগ্রাম কাস্টমস ও মোংলা পোর্ট দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় পোস্তদানা আমদানি হলে সেটি কর্তৃপক্ষ বাজেয়াপ্ত করে। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ সময় কাস্টমসের হেফাজতে রাখার পর সেগুলো ধ্বংস করা হয়। ২০০৮ সালে মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে ২৪০ টন পোস্তদানা আমদানির সময় কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়ে। প্রায় চার বছর ধরে সেগুলো আটক থাকার পর ২০১২ সালে প্রায় ৫০ কোটি টাকার ওই পোস্তদানা ধ্বংস করে পোর্ট কর্তৃপক্ষ। এর আগে ২০১১ সালে এপ্রিলে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১৬ টন পোস্তদানা সরিষা ঘোষণা দিয়ে আমদানির সময় চট্টগ্রাম কাস্টমসের হাতে ধরা পড়ে। ৪০০ টন সরিষার সঙ্গে ১৬ হাজার কেজি পোস্তদানা আমদানি হলে আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ায় সেগুলো আটকে দেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। ঢাকার সোয়ারি ঘাটের মেসার্স তাজ ট্রেডার্স ও ইসলামপুরের মেসার্স আয়সা ট্রেডার্স নামের দুটি প্রতিষ্ঠান টেনিসবল ও ফোম স্প্রে ঘোষণা দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে আমদানি নিষিদ্ধ ৭২ টন নিয়ে পোস্তদানা আসার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। বিভিন্ন সময়ে ধরা পড়লেও অধিকাংশ সময়ই ফাঁকি দিয়ে পোস্তদানা আমদানি হচ্ছে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে আমদানির পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরেও মসলা পণ্য হিসেবে পপি চাষ হচ্ছে। দেশের পার্বত্য তিন জেলার দুর্গম এলাকায় পপি চাষ হচ্ছে পোস্তদানা হিসেবে বিক্রির জন্য। অধিক মুনাফার লোভে চাষীরাও পপি চাষ করছেন। বিভিন্ন সময়ে সেনাবাহিনী এসব পপি চাষ ধ্বংস করছে। সম্প্রতি জয়পুরহাটে পপি চাষের অভিযোগে পাঁচ কৃষককে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। ৭ মার্চ সদর উপজেলার চারটি গ্রামে অবৈধভাবে চাষ করা পাঁচ একর জমিতে পপি চাষ করার অভিযোগ পাঁচ কৃষককে আটক করা হয়। আটকের পর অভিযুক্ত মসলা হিসেবে লাভজনক হওয়ায় পপি চাষ করেছে বলে দাবি করেছেন। এ সময় চাষকৃত জমির পপি গাছ ধ্বংস করে দেয়া হয়। ওই পাঁচ একর জমিতে ৪ লাখ ২৩ হাজার ৫০০ পপি গাছ ধ্বংস এবং ১৬ লাখ ৯৪ হাজার আফিমবীজ জব্দ করে র্যাব। খাতুনগঞ্জে অনেকটা প্রকাশ্যে পোস্তদানা বিক্রি হলেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি আমদানিকারক একাধিক মসলা ব্যবসায়ী। তাদের দাবি, কিছু মুনাফালোভী প্রতিষ্ঠান মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পোস্তদানা আমদানি ও বিক্রি করে। অন্যদিকে কিছু ব্যবসায়ী পোস্তদানার সঙ্গে অন্যান্য দেশীয় বীজ মিশ্রিত করে চড়া দামে বিক্রি করে অস্বাভাবিক মুনাফা করেন। কাস্টমস ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানই পোস্তদানা আমদানি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন তারা।
সর্বশেষ মন্তব্য