দেশে সাধারণত জুলাইয়ের মাঝামাঝি আমের মৌসুম শেষ হয়। আশ্বিনাসহ কয়েকটি জাতের আম মধ্য আগস্ট পর্যন্ত বাজারে পাওয়া যায়। বেশির ভাগ জাতের আমের জোগান যখন শেষ হয়,...
দেশে সাধারণত জুলাইয়ের মাঝামাঝি আমের মৌসুম শেষ হয়। আশ্বিনাসহ কয়েকটি জাতের আম মধ্য আগস্ট পর্যন্ত বাজারে পাওয়া যায়। বেশির ভাগ জাতের আমের জোগান যখন শেষ হয়, তখনই পাকতে শুরু করে গৌড়মতি। আমটি যেমন রসাল, তেমনি সুস্বাদু। নাবি জাতের আম গৌড়মতি চাষে আগ্রহ বেড়েছে রংপুরের চাষীদের। অর্থনৈতিকভাবেও দেখা দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা। কারণ মৌসুম শেষে বাজারে আসায় দামও বেশি পাওয়া যায়। রংপুরের দুটি উপজেলায় বিক্ষিপ্তভাবে গৌড়মতি আম চাষ শুরু হলেও মিঠাপুকুর উপজেলার রানীপুকুর ইউনিয়নের নাসিরাবাদ এলাকার কৃষক মো. আজাহার আলী গড়ে তুলেছেন ৪৩০টি গাছের দুটি আমবাগান। এরই মধ্যে একটি বাগানের কয়েকটি গাছে আম পাকা শুরু হয়েছে। তা দেখে এলাকার অনেকে গৌড়মতি চাষে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। রংপুরে উৎপাদিত হাড়িভাঙ্গা আমের খ্যাতি কয়েক বছর আগেই স্থানীয় গণ্ডি পার হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতি বছর শুধু হাড়িভাঙ্গা আম ১০০ কোটিরও বেশি টাকার কেনাবেচা হচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় বেশকিছু জাতের আমও ভালো বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু মৌসুমে (জুলাইয়ের মাঝামাঝি) এ সুস্বাদু আম পাওয়া গেলেও পরে আর তেমন পাওয়া যায় না। কিন্তু নাবি (বিলম্ব) জাত হিসেবে দীর্ঘদিন থেকে যে আমগুলো বাজারে পাওয়া যায়, এর অধিকাংশই সুস্বাদু ও রসাল নয়। তবে গৌড়মতি আমটির স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। মিঠাপুকুর উপজেলার নাসিরাবাদ এলাকায় ২০১৯ সালের মাঝামাঝি কৃষক মো. আজাহার আলী ৬৩ শতক জমিতে গড়ে তোলেন গৌড়মতি আমের বাগান। এখানে গাছ আছে ১৮০টি। কিছুদিন পর গড়ে তোলেন ২৫০টি গাছের আরেকটি বাগান। এ বছর প্রথম বাগানের ৪০টি গাছে আম ধরেছে। চলতি আগস্টে পাকা শুরু হয়েছে এ আম। আজাহার আলী বলেন, তার এলাকায় অধিকাংশই হাড়িভাঙ্গা আমের বাগান। বর্তমানে বাগানগুলোয় আম নেই। তার বাগানের গৌড়মতি আম মিষ্টি, রসাল ও সুস্বাদু হওয়ায় ব্যবসায়ীসহ উত্সুক মানুষ ভিড় করছে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা ৮০ হাজার টাকায় গাছের আম কিনতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি রাজি হননি। বর্তমানে ১৫০ টাকা কেজি দরে আম বিক্রি করছেন। গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার একটি নার্সারি থেকে তিনি গৌড়মতির কলম কিনেছেন প্রতিটি ২৫০-৩০০ টাকায়। তবে তিনি রোগবালাই থেকে গাছগুলোকে রক্ষায় নিয়মিত মিঠাপুকুর উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শ নিচ্ছেন। এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, এলাকায় দিন দিন ফল বিশেষ করে আমের আবাদ বাড়ছে। কিন্তু অধিকাংশ বাগানে মৌসুমি আম ধরে। আগস্টে বাগানগুলোয় আম থাকে না। তাই সুস্বাদু নাবি জাতের আম গৌড়মতি আবাদ করে কৃষক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারেন। এরই মধ্যে আজাহার আলীর সাফল্য দেখে অনেকে এ আম চাষে উৎসাহী হচ্ছেন। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ল্যাংড়া ও আশ্বিনার প্রাকৃতিক পরাগায়ণের ফলে আমের নতুন জাতটির উদ্ভাবন হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। অর্থাৎ আশ্বিনা থেকে নাবি জাতের বৈশিষ্ট্য এবং ল্যাংড়ার রঙ, আকৃতি ও স্বাদসহ অন্যান্য বৈশিষ্ট্য আমটিতে বিদ্যমান। আমটি নাবি জাতের হলেও অন্যান্য জাতের মতো মুকুল একই সময়ে আসে। আমটি সহজে পচনশীল নয়। পাকা আম গাছ থেকে পাড়ার ৭-১০ দিন পরও ভালো থাকে। এ আম আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত পাকে। প্রতিটি আমের ওজন প্রায় ৩৫০-৬০০ গ্রাম অর্থাৎ গড়ে তিনটি আমের ওজন এক কেজি। এ জাতের আমগাছের ফল ধারণক্ষমতাও অনেক বেশি। চার বছর বয়সী একটি গাছে গড়ে ৬০-৭০টি আম ধরে। ২০১২ সালে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মঞ্জুরুল হক আমের জাতটির সর্বপ্রথম সন্ধান পান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার শিয়ালমারী গ্রামের স্কুলশিক্ষক মো. এরফান আলীর বাগানে। পরে আমটির স্বাদ, গড়ন ও পরিপক্বতার মৌসুম হিসাব করে গাছটির কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ শুরু করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টার। ২০১৩ সালে হর্টিকালচার সেন্টার মানসম্পন্ন উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এ মাতৃগাছ থেকে বেশকিছু কলম তৈরি করে। ওই বছরই নতুন জাতের এ আমের ‘গৌড়মতি’ নামকরণ করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারে মানসম্পন্ন উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক কৃষিবিদ এসএম কামরুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্টরা। বাংলার প্রাচীন জনপদের ‘গৌড়’ থেকে ‘গৌড়’ আর মূল্য বিবেচনায় রত্নের সঙ্গে তুলনা করে ‘মতি’ শব্দের সমন্বয়ে নতুন জাতের আমটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘গৌড়মতি’। আমটি ল্যাংড়া বা ক্ষীরশাপাতি অর্থাৎ হিমসাগরের চেয়ে ১৭-২০ শতাংশ বেশি মিষ্টি। এ আমের খোসা ও আঁটি দুটোই পাতলা এবং আঁটি ছোট হওয়ায় এ আমের ভক্ষণযোগ্য অংশ বেশি। রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, নিঃসন্দেহে নাবি জাতের আম গৌড়মতি চাষ করলে কৃষক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন। কারণ যে সময়ে এ আম বাজারে আসবে, তখন বাজারে ব্যাপক আমের চাহিদা। তবে এটি গণহারে চাষ করার আগে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে মাইক্রো ক্লাইমেট বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সর্বশেষ মন্তব্য