বিষমুক্ত আম পেতে আম জনতা এই বছর সরাসরি বাগান থেকে, বাগান মালিক থেকে আম ক্রয় করছেন! কিন্তু আদৌ কি সেই আম জনতার আম কেনার খাওয়ার শখ সঠিক ভাবে হচ্ছে? কাড়ি কাড়ি সারি সারি অনেক গাড়ি দিয়ে আম যাচ্ছে বাড়ি বাড়ি! ঝাঁকি ভরে আম নিচ্ছে সবাই। কেজি কিংবা সের ওজনে নয় সবাই আম ক্রয় করছেন মন আর টন এ! আমার চারপাশের সকলেই আম কিনলেন এভাবেই। কেউ কেউ কুরিয়ার সার্ভিসের সাহায্যে আবার কেউ কেউ পাইকারি এনে বিক্রি করলেন পাইকারি দামে। কারো ভাইয়ের, কারো শালার, কিংবা কারো নিজের বাগানের আম দাবি করছেন বিক্রেতারা! আমার বেলায়ও এমন ঘটেছে! কিন্তু আসলেই কি আম জনতা বিষমুক্ত আম পাচ্ছেন? পাচ্ছি আর খাচ্ছি?
আমে বিষ কখন কোথায় কিভাবে গাছে মুকুল আসার পর থেকে পাকা পর্যন্ত বাগানে, আড়তে দফায় দফায় আমে দেয়া হচ্ছে সায়ানাইড, ফরমালিনসহ নানা ধরনের কেমিক্যাল। আমের রাজধানী বলে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়াও মেহেরপুর, রাজশাহী, নাটোর ও অন্যান্য জেলায় এই অসাধু কার্যক্রম চালাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট বাগান মালিক, চাষী থেকে শুরু করে স্থানীয় ফল ব্যবসায়ীরা। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা উচ্চ মূল্যে বিক্রি করার জন্য অপরিপক্ক আম কেমিক্যাল দিয়ে আগেই পাকিয়ে ফেলে। আর পচন রোধে অর্থাত্ দীর্ঘদিন তরতাজা রেখে বিক্রির জন্য সেই আমে মেশানো হয় ফরমালিন। এই আম পাকা ও তরতাজা দেখে এক শ্রেণীর ক্রেতা কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন।
মুকুল আসার আগে গাছের গোড়ায় সার প্রয়োগ ও প্রয়োজনে সেচ দেয়া হয় এবং পাতায় ম্যালথান গ্রুপের কীটনাশক কট, টিডো, ফাইটার ইত্যাদি স্প্রে করা হয়। গাছে মুকুল দেখা দিলে সামান্য কীটনাশকের সাথে ম্যানকোজের গ্রুপের ডায়াথেন অথবা কার্বন্ডাজিন গ্রুপের নইন পাওডার পানিতে গুলিয়ে স্প্রে করা হয়। তারপর আমের গুটি বড় হওয়া পর্যন্ত এনটাকল, নইন, ডায়াথেন, ব্যাপিস্টিন, ফ্লোরা, ফাইটার, টিডো ইত্যাদি ছত্রাক নাশক ও কীটনাশক স্প্রে করা হয়। আমের উপরের ময়লা পরিষ্কারের জন্য শ্যাম্পু, বোরন, ফলিকুর, রোব্রাল নামের তরল ওষুধ এবং গাছ থেকে আম পাড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে নইন, টিডো, প্রিমিয়ার, এন্টাকল নামের বিষ।
গোপালপুর বাজারের একজন কীটনাশক ব্যবসায়ী জানান, আম ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ গাছ থেকে আম পাড়ার পর দ্রুত পাকানোর কাজে ফ্লোরা নামের এক ধরনের ওষুধ ব্যবহার করছেন। আম ব্যবসায়ী জানান, আমের রং ভাল না হলে দাম পাওয়া যায় না তাই গাছ থেকে আম পাড়ার আগে এন্টাকল ও নইন নামের ওষুধ ব্যবহার করতে হয়। তবে তারা এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানেন না বলে দাবি করেন। ‘সায়ানাইড’ দিয়ে আম পাকানো হয়। দীর্ঘদিন রেখে বিক্রির জন্য সে আমে মেশানো হয় ফরমালিন। এই দুটি কেমিক্যালেই মানবদেহে মরণব্যাধি ক্যান্সার হওয়ার আশংকা শতভাগ। দেশে ক্যান্সার রোগ আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে বিষাক্ত আমসহ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী দায়ী। ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক রোগী চিকিত্সার জন্য আসেন। তা সামাল দেয়া চিকিত্সকদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে বলে তিনি জানান।
মধ্যস্বত্বভোগী, অতি মুনাফালোভী, ফড়িয়া, ব্যবসায়ী ও বাগান মালিক এবং আড়তদাররা আমে বিষাক্ত কেমিক্যাল ও ফরমালিন মিশিয়ে বছরের পর বছর বাজারজাত করছে। মূলত তাদের হাতেই দেশের ফল ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হয়। বাজারে ৯৫ ভাগ আমের মধ্যেই বিষাক্ত কেমিক্যাল রয়েছে। তার বাস্তব প্রমাণও মিলছে। প্রায় প্রতিদিনই মোবাইল কোর্ট অভিযানে নেমে টনে টনে কেমিক্যাল যুক্ত আম ধ্বংস করে সংশ্লিষ্টদের জরিমানা করছেন। কিন্তু অজানা কারণে আমে বিষ মেশানো বন্ধ হচ্ছে না। সম্প্রতি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাজিপুর গ্রামে প্রাণ কোম্পানির আঞ্চলিক আম সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় বিপুল পরিমান ফরমালিনের বিষ পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার দুপুরে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ৮৮৭টি প্লাস্টিক ড্রামে মাত্রারিক্ত ফরমালিন মেশানো ৯০ টন আম জব্দ করেন। যার মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। নগরীতে কেমিক্যালমুক্ত আম বিক্রির প্রতিযোগিতা চলছে। রাস্তার ধারে অস্থায়ী সেলস সেন্টার খুলে বিক্রি করা হচ্ছে নানা জাতের আম। বিক্রেতারা বলেছেন, কোন ধরণের কেমিক্যাল মিশ্রিণ ছাড়াই নিজেদের বাগান থেকে সরাসরি আম এনে বিক্রি করা হচ্ছে। ভোক্তাদের মধ্যে এ আমের চাহিদা অনেক বেশি। নগরীর কয়েকটি এলাকা দেখা গেছে, রাস্তার ধারে অস্থায়ী সেলস সেন্টার খুলে আকর্ষণীয় ডিজিটাল ব্যানার টানিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে নানা জাতের সুস্বাদু আম। এসব সেলস সেন্টারে চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের আম বিক্রি করা হচ্ছে। ‘কেমিক্যালমুক্ত আম বিক্রি একটি ভাল উদ্যোগ। উদ্যোক্তাদের ঘোষণা অনুযায়ী এর সত্যতা যাচাই করতে কোন উদ্যোগ তেমন চোখে পরেনি । অপরদিকে উদ্যোক্তারা বলছেন, আমরা গ্যারান্টি সহকারে কেমিক্যালমুক্ত আম বিক্রি করছি। আমে কেমিক্যাল প্রমাণ করতে পারলে পুরস্কৃত করবো। সেলস সেন্টারের সামনে ব্যানার টানায়ে এ ঘোষণাও দেন উদ্যোক্তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই বিষাক্ত আম খেলে সাধারণ আম জনতার কি কি হতে পারে?
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাঃ সৈয়দ আকরাম হোসাইন বলেন, বিষাক্ত কেমিক্যালযুক্ত আম খাওয়ার পর শরীরের বিভিন্ন স্থানে সেই কেমিক্যাল জমা হয়ে থাকে। পরবর্তীতে তা ক্যান্সার সৃষ্টি করে। গর্ভবতী মায়েদের চিকিত্সকরাই ফল খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সেই কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো ফল খাওয়ার পর গর্ভবতী মা ও তার পেটের সন্তান উভয়ের মরণব্যাধি ক্যান্সার হওয়ার আশংকা বেশি বলে তিনি জানান। কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক অধ্যাপক ডাঃ হারুনুর রশিদ বলেন, মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল মেশানো আম খেলে কিডনি নষ্ট হওয়ার আশংকা বেশি। গর্ভবতী মা ও শিশুদের জন্য এই ফল খাওয়া সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে তিনি জানান।
রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ বদরুল আলম বলেন, কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো আম খেলে নার্ভ দুর্বল হয়ে নিউরোপ্যাথি রোগ হওয়ার আশংকা বেশি। ওই সকল কেমিক্যালের টক্সিনের প্রভাব পড়ে নার্ভে। এর ফলে ব্রেইনে ও নার্ভের মারাত্মক ক্ষতি হয়। গর্ভবতী মা ওই ফল খেলে তার পেটের সন্তান বিকলাঙ্গ ও হাবাগোবা হওয়ার আশংকা থাকে। দেশে বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার এটি অন্যতম কারণ বলে তিনি জানান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং প্ল্যান্ট স্থাপন করা গেলে ২-৩ সপ্তাহ আম রাখা যাবে। সেক্ষেত্রে ফরমালিন ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না। এ কাজে বেসরকারি উদ্যোক্তা বা সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। উন্নত মানের প্যাকেট করে আম বাজারজাত করা গেলে নির্দিষ্ট সময় পর আম পাকবে। আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি দিয়ে আম জীবাণু মুক্ত করে প্যাকেটবদ্ধ করা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা আমের চাষ পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনতে বলছেন। বলা হচ্ছে, মুকুল আসার আগে ছত্রাক প্রতিরোধে একবার রাসায়নিক ব্যবহার করা যেতে পারে। মুকুল পড়া বন্ধে এবং আম পরিপুষ্ট করতে ভিটামিন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার এবং পোকা দমন করতে সীমিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। প্রতিটি বাগানে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি তৈরি করতে হবে। রাজশাহী ফল গবেষণাকেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, মুকুল আসার পরে এবং ফোঁটার আগে একবার স্প্রে এবং আরেকবার আম মটরদানার সমান হলে কীটনাশক দেয়া যেতে পারে।
কিন্তু কি করে চিনবেন রাসায়নিক মুক্ত আম? কেনার সময় ক্রেতা যদি একটু সচেতন থাকেন, তাহলেই কিন্তু চিনে নেয়া সম্ভব রাসায়নিক মুক্ত আম। আসুন জেনে নেই: ক) প্রথমেই লক্ষ্য করুন যে আমের গায়ে মাছি বসছে কিনা। কেননা ফরমালিন যুক্ত আমে মাছি বসবে না। খ) আম গাছে থাকা অবস্থায়, বা গাছ পাকা আম হলে লক্ষ্য করে দেখবেন যে আমের শরীরে এক রকম সাদাটে ভাব থাকে। কিন্তু ফরমালিন বা অন্য রাসায়নিকে চুবানো আম হবে ঝকঝকে সুন্দর। গ) কারবাইড বা অন্য কিছু দিয়ে পাকানো আমের শরীর হয় মোলায়েম ও দাগহীন। কেননা আম গুলো কাঁচা অবস্থাতেই পেড়ে ফেলে ওষুধ দিয়ে পাকানো হয়। গাছ পাকা আমের ত্বকে দাগ পড়বেই।
ঘ) গাছপাকা আমের ত্বকের রঙে ভিন্নতা থাকবে। গোঁড়ার দিকে গাঢ় রঙ হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কারবাইড দেয়া আমের আগাগোড়া হলদেটে হয়ে যায়, কখনো কখনো বেশি দেয়া হলে সাদাটেও হয়ে যায়। ঙ) হিমসাগর ছাড়াও আরও নানান জাতের আম আছে যারা পাকলেও সবুজ থাকে, কিন্তু অত্যন্ত মিষ্টি হয়। গাছপাকা হলে এইসব আমের ত্বকে বিচ্ছিরি দাগ পড়ে। ওষুধ দিয়ে পাকানো হলে আমের শরীর হয় মসৃণ ও সুন্দর। চ) আম নাকের কাছে নিয়ে ভালো করে শুঁকে কিনুন। গাছ পাকা আম হলে অবশ্যই বোটার কাছে ঘ্রাণ থাকবে। ওষুধ দেয়া আম হলে কোনও গন্ধ থাকবে না, কিংবা বিচ্ছিরি বাজে গন্ধ থাকবে। ছ) আম মুখে দেয়ার পর যদি দেখেন যে কোনও সৌরভ নেই, কিংবা আমে টক/ মিষ্টি কোনও স্বাদই নেই, বুঝবেন যে আমে ওষুধ দেয়া। জ) আম কেনা হলে কিছুক্ষণ রেখে দিন। এমন কোথাও রাখুন যেখানে বাতাস চলাচল করে না। গাছ পাকা আম হলে গন্ধে মৌ মৌ করে চারপাশ। ওষুধ দেয়া আমে এই মিষ্টি গন্ধ হবেই না।
মিরাজুল ইসলাম (৩৩)। ১০ বছর সৌদি আরবে ছিলেন। আকামা জটিলতায় খালি হাতে দেশে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এক বছর বেকার থাকার পর ইউটিউবে পতিত জমিতে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখেন। বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে নেমে পড়েন ড্রাগন চাষে। দেড় বছরের ব্যবধানে এখন উপজেলার সবচেয়ে বড় ড্রাগন বাগান তাঁর। এ বছর খরচ বাদে আট থেকে নয় লাখ টাকা লাভের আশা করছেন তিনি।
পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার ইন্দুরকানি গ্রামের বাসিন্দা মিরাজুল। উপজেলার টগরা গ্রামে দেড় একর জমিতে তিনি ড্রাগনের বাগান তৈরি করেছেন। তাঁর বাগানে এখন সাড়ে তিন হাজার ড্রাগন ফলের গাছ আছে।
মিরাজুল ইসলাম বলেন, শ্রমিক হিসেবে ১০ বছর সৌদিতে কাজ করে ২০১৯ সালে দেশে ফেরেন তিনি। আকামা সমস্যার কারণে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কিছু একটা করবেন বলে ভাবছিলেন। একদিন ইউটিউবে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখতে পান। সেই থেকে ড্রাগন চাষে আগ্রহ জন্মে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দেড় একর পতিত জমি ড্রাগন চাষের উপযোগী করেন। গাজীপুর থেকে ৬০ টাকা দরে ৬০০ চারা নিয়ে আসেন। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে শুরু করেন চাষাবাদ। পরের বছর জুনে ফল পাওয়া শুরু করেন।
ড্রাগনের বাগান করতে মিরাজুলের খরচ হয়েছিল ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। ইতিমধ্যে ফল বিক্রি করে তাঁর খরচ উঠে গেছে। সাধারণত মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গাছে ফল আসে। বছরে ছয় থেকে সাতবার পাকা ড্রাগন সংগ্রহ করা যায়। এখন পরিপক্ব ও রোগমুক্ত গাছের শাখা কেটে নিজেই চারা তৈরি করেন। ড্রাগন চাষের পাশাপাশি বাগানে চুইঝাল, এলাচ, চায়না লেবুসহ মৌসুমি সবজি চাষ করেন। এ ছাড়া ড্রাগনের চারাও উৎপাদন করে বিক্রি করেন তিনি।
মিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাগানের বেশির ভাগ গাছে এ বছর ফল ধরেছে। গত মঙ্গলবার বাগান থেকে দেড় টন ফল সংগ্রহ করেছেন। ২৫০ টাকা কেজি দরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছেন। স্থানীয় বাজারে ৩০০ টাকা কেজি দরে ড্রাগন বিক্রি হয়। নভেম্বর পর্যন্ত আরও পাঁচ–ছয়বার বাগান থেকে ফল তোলা যাবে। আশা করছেন, খরচ বাদে এবার আট থেকে নয় লাখ টাকা লাভ থাকবে।
মিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমার বাগান থেকে চারা নিয়ে অনেকে বাড়িতে ও ছাদে ছোট পরিসরে ড্রাগনের বাগান করেছেন। আমি এ পর্যন্ত ৪০ টাকায় দেড় হাজার চারা বিক্রি করেছি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পূর্ণ বয়সের একটি ড্রাগনের চারা রোপণের পর ২৫ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। এর মৃত্যুঝুঁকি নেই বললেই চলে। তবে কয়েক দিন পরপর সেচ দিতে হয়। বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হয়। ড্রাগন ফল চাষে রাসায়নিক সার দিতে হয় না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইশরাতুন্নেছা বলেন, মিরাজুল ইসলামকে ড্রাগন চাষে নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে আসছে কৃষি বিভাগ। উপজেলায় তাঁর বাগানটি সবচেয়ে বড়। তিনি নিরলস পরিশ্রম করে ছোট থেকে বাগানটি বড় করেছেন।
ডাচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে দুই দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।
গতকাল সোমবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অনুষ্ঠিত কৃষি খাতের ব্যবসাবিষয়ক এক সম্মেলনে দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এগ্রি বিজনেস কনক্লেভে বাংলাদেশের প্রায় ৪০জন উদ্যোক্তা ডাচ কৃষি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি প্রযুক্তি সহযোগিতা ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছে ওয়েগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়।
আলোচনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তি কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি সহযোগিতা দিতে রাজি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে ডাচরা প্রস্তুত এবং বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও তাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া ডাচ সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বীজ, পশু খাদ্য, পোলট্রি, হর্টিকালচার ও এ্যাকুয়াকালচার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করেছে, যা ওই দেশের বেসরকারি খাতকে আরও উৎসাহিত করেছে।
আলোচনায় কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তৈরি আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্কয়ার, ইস্পাহানি এগ্রো, একে খান অ্যান্ড কোম্পানি, প্যারাগন গ্রুপ, এসিআই, জেমকন গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ডাচ প্রযুক্তির প্রয়োগ সরেজমিনে দেখতে যাবেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের পোল্ট্রিখাতে সহযোগিতার আলোচনা অনেকটা এগিয়েছে উল্লেখ করে মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দুই দেশের মধ্যে মৎস্য, পশুপালন ও হর্টিকালচারে সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা আছে।
কনক্লেভ আয়োজনে প্রথমবারের মতো দূতাবাসের সঙ্গে অংশীদার হয়েছে নেদারল্যান্ডসের কৃষি মন্ত্রণালয়, নেদারল্যান্ডস এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি, নেদারল্যান্ডস ফুড পার্টনারশিপ, ডাচ-গ্রিন-হাইজডেল্টা, লারিভ ইন্টারন্যাশনাল, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ।
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী নেদারল্যান্ডসের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কম। ২০২১-এ কৃষিপণ্য ও খাদ্য রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে।
পাবনার বেড়া উপজেলার বড়শিলা গ্রামের কৃষক সাইদুল ইসলাম তাঁর দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করে এবার প্রায় ৪০ হাজার টাকা লোকসান দিয়েছেন। অথচ পেঁয়াজের জমিতেই সাথি ফসল হিসেবে লাগানো বাঙ্গি থেকে তিনি ৫০ হাজার টাকার মতো লাভ করবেন বলে আশা করছেন। এই বাঙ্গি আবাদে তাঁর কোনো খরচ হয়নি। ফলে পেঁয়াজ আবাদের ক্ষতি পুষিয়ে যাচ্ছে।
সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘বাঙ্গি আবাদ কইর্যা যে টাকা পাইল্যাম তা হলো আমাগরে ঈদের বোনাস। পেঁয়াজের দাম না পাওয়ায় আমরা (কৃষকেরা) যে ক্ষতির মধ্যে পড়িছিল্যাম, বাঙ্গিতে তা পুষায়া গেছে। এই কয়েক দিনে ১২ হাজার টাকার বাঙ্গি বেচছি। সব মিলায়া ৫০ হাজার টাকার বাঙ্গি বেচার আশা করতেছি।’
সাইদুল ইসলামের মতো পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার অনেক কৃষক এবার পেঁয়াজের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে বাঙ্গির আবাদ করেন। কৃষকেরা পেঁয়াজ আবাদ করতে গিয়ে বিঘায় প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ করেছিলেন। সেই হিসাবে প্রতি মণ পেঁয়াজ উৎপাদনে তাঁদের খরচ হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকার বেশি। কিন্তু বাজারে সেই পেঁয়াজ কৃষকেরা বিক্রি করতে পেরেছেন প্রতি মণ ৬০০ থেকে ৮৫০ টাকায়। এতে প্রতি বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদে কৃষকদের এবার ২০ হাজার টাকার বেশি লোকসান হয়েছে।
কৃষকেরা বলেন, পেঁয়াজের জমিতে সাথি ফসল হিসেবে বাঙ্গি, মিষ্টিকুমড়া, কাঁচা মরিচসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। জমিতে পেঁয়াজ লাগানোর পর তা কিছুটা বড় হলে এর ফাঁকে ফাঁকে এসব সাথি ফসল লাগানো হয়। পেঁয়াজের জন্য যে সার, কীটনাশক, সেচ দেওয়া হয়, তা থেকেই সাথি ফসলের সব চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। ফলে সাথি ফসলের জন্য বাড়তি কোনো খরচ হয় না।
কৃষকেরা বলেন, বাঙ্গিতেই কৃষকের লাভ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। রমজান মাস হওয়ায় এখন বাঙ্গির চাহিদা ও দাম দুই-ই বেশি।
সাঁথিয়ার শহীদনগর গ্রামের কৃষক আজমত আলী জানান, তাঁর জমিসহ এই এলাকার জমি থেকে ৮ থেকে ১০ দিন হলো বাঙ্গি উঠতে শুরু করেছে। এবার বাঙ্গির ফলনও হয়েছে বেশ ভালো। বাজারে এসব বাঙ্গি আকারভেদে প্রতিটি ৬০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এমন দাম থাকলে এক বিঘা থেকে প্রায় ৩০ হাজার টাকার বাঙ্গি বিক্রি হবে।
সাঁথিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার গোস্বামী বলেন, পেঁয়াজের সঙ্গে সাথি ফসলের আবাদ কৃষকদের মধ্যে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ ব্যাপারে তাঁরাও কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
জাতীয় ফল কাঁঠালের জ্যাম, চাটনি ও চিপস উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) শস্য সংগ্রহের প্রযুক্তি বিভাগের একদল গবেষক। তাঁরা কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত করে মোট ১২টি প্যাকেট ও বোতলজাত পণ্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
গত শনিবার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ক্যাম্পাসে অবস্থিত বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিনা) ‘কাঁঠালের সংগ্রহত্তোর ক্ষতি প্রশমন ও বাজারজাতকরণ কৌশল’ শীর্ষক কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এসব তথ্য জানান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) অর্থায়নে এবং নিউভিশন সলিউশন্স লিমিটেডের সহযোগিতায় গবেষণা প্রকল্পটি পরিচালিত হয়।
কর্মশালায় ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী বলেন, ‘এই প্রকল্পের আওতায় আমরা কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাত করে মুখরোচক ১২টি প্যাকেট ও বোতলজাত পণ্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এসব পণ্য উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। কাঁঠালের জ্যাম, আচার, চাটনি, চিপস, কাটলেট, আইসক্রিম, দই, ভর্তা, কাঁঠাল স্বত্ব, রেডি টু কুক কাঁঠাল, ফ্রেশ কাট পণ্যসহ আরও বিভিন্ন ধরনের প্যাকেটজাত পণ্য তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। প্রক্রিয়াজাত পণ্যগুলো ঘরে রেখে সারা বছর খাওয়া যাবে। কাঁঠাল থেকে এসব পণ্য উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা কমানো সম্ভব বলে মনে করছেন গবেষক।’
কর্মশালায় নিউভিশন সলিউশন্স লিমিটেডের মুখ্য পরিদর্শক তারেক রাফি ভূঁইয়া বলেন, উদ্ভাবিত পণ্যগুলো বাজারজাত করার জন্য নিউভিশন কোম্পানি বিএআরআইয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ময়মনসিংহসহ বাংলাদেশের কয়েকটি জেলা ও উপজেলা শহরে পণ্যগুলো বিপণনের কাজ চলছে।
কর্মশালায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিভাগের বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. হাফিজুল হক খানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম। সম্মানিত অতিথি ছিলেন কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের সিনিয়র স্পেশালিস্ট (ফিল্ড ক্রপস) ড. নরেশ চন্দ্র দেব বর্মা। বিশেষ অতিথি ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আবু হানিফ। উপস্থিত ছিলেন নিউভিশন সলিউশন্স লিমিটেডের প্রকল্প ম্যানেজার কায়সার আলম।
সার ব্যবস্থাপনা: প্রতি গর্তে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া সার, ১০০ গ্রাম টিএসপি সার ও এমওপি সার ১০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হয়।
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা: চারা গাছের গোড়ায় মাঝে মাঝে পানি সেচ দিতে হবে। বর্ষাকালে গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেজন্য পানি নিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া কমলা গাছের আগাছা দমন করতে হবে।
ফসল তোলা: মধ্য কার্তিক থেকে মধ্য পৌষ মাসে ফল সংগ্রহ করতে হয়।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন