বাংলাদেশ
মুজিব জন্মশতবার্ষিকী: মুসলিম লীগ দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও মুজিবের রাজনৈতিক দর্শনে পরিবর্তন হয়েছে কীভাবে
লেখক
বিবিসি বাংলাশেখ মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতির সূচনা হয়েছিল মুসলিম লীগের রাজনীতির মধ্য দিয়ে, পরে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধ এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রবক্তা।
তাঁর রাজনৈতিক দর্শন বা চিন্তায় কীভাবে এই পরিবর্তন হয়েছিল? এই প্রশ্ন নিয়েই কথা হয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং গবেষক কয়েকজনের সাথে।
শেখ মুজিবের জন্ম ১৯২০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। উনিশ বছর বয়সেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
যাত্রা শুরু মুসলিম লীগে
মুসলিম লীগের উদারপন্থী অংশের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরে শেখ মুজিব কোলকাতায় গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করেছিলেন ১৯৩৯ সালে।
সেই সাক্ষাতের পর ফিরে এসে সে বছরই তিনি গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ এবং মুসলিম লীগ গঠন করেছিলেন। তিনি নিজে মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক হয়েছিলেন।
শেখ মুজিব ১৯৪১ সালে মেট্রিক পাশ করে কোলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়তে গিয়েও সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন রাজনীতি নিয়ে।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময় সারা দেশ ঘুরে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন।
সোহরাওয়ার্দীর সাথে পরিচয়
সরাসরি রাজনীতিতে জড়ানোর আগের বছর ১৯৩৮ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে তাঁর পরিচয় হওয়ার প্রেক্ষাপটও ছিল ভিন্নরকম।
সেই প্রেক্ষাপট নিয়ে শেখ মুজিব লিখেছেন তার অসমাপ্ত আত্নজীবনীতে – পরে যা বই হয়ে বেরিয়েছে।
“শেরে বাংলা তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। বাংলার এই দুই নেতা একসাথে গোপালগঞ্জে আসবেন। মুসলামানদের মধ্যে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হল। তখন স্কুলে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার ভার পড়ল আমার ওপর। আমি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে।”
সেই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার বিষয়ও তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন।
“পরে দেখা গেল, হিন্দু ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে সরে পড়তে লাগল। এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে বলল কংগ্রেস থেকে তাদের যোগদান করতে নিষেধ করেছে। আমি এ খবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোন জিনিস ছিল না” লিখেছেন শেখ মুজিব তাঁর অসমাপ্ত আত্নজীবনীতে।
হিন্দু–মুসলিম ভেদাভেদের মুখোমুখি মুজিব
গোপালগঞ্জে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সেই সফরের সময়ই তাঁর সাথে শেখ মুজিবের পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে কিছুদিন পত্রবিনিময়ও ঘটে।
সে সময়ই গোপালগঞ্জে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবের এক সহপাঠীকে স্থানীয় একটি হিন্দু পরিবারে আটকিয়ে রাখার ঘটনা নিয়ে মারামারি হলে তাঁকে জীবনের প্রথম জেলে যেতে হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ নেতা নূহ আলম লেনিন বলেছেন, হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদের জেরে কিছু নেতিবাচক ঘটনার মুখোমুখি হলেও সেই কিশোর বয়সেও শেখ মুজিবের ওপর সাম্প্রদায়িক চিন্তা প্রভাব ফেলতে পারেনি।
“তাঁর যে মানস গঠন, সেটা কোনো সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হয়নি। সেই কিশোর বয়সেই মাদারীপুরের পূর্ণ দাসের স্বদেশী আন্দোলনের গ্রুপের সাথেও তাঁর সংশ্লিষ্টতা ছিল। আর তিনি ব্রিটিশ শাসন এবং জমিদারী প্রথার প্রতিও তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন।”
নূহ আলম লেনিন মনে করেন, সেই সময়ের বাস্তবতায় শেখ মুজিব মুসলিম লীগকে একটি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের চিন্তা থেকে ঐ দলে যোগ দিয়েছিলেন।
“হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে পরিচয়ের পর ঐ সময়ের বাস্তবতায় তারা মুসলিম লীগকে একটা প্ল্যাটফর্ম মনে করেছিলেন। সেই প্ল্যাটফর্ম মাধ্যমে জমিদারী প্রথার অবসান ঘটিয়ে একটা উদার রাষ্ট্রের স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন” – মন্তব্য করেন মি: লেনিন।
সুভাষ বসুর ভক্ত মুজিব
শেখ মুজিব যে কিশোর বয়সেই ১৯৩৬ সালে স্বদেশী আন্দোলন বা ভারতের বিপ্লবী নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর অনুরাগী ছিলেন, সে কথা তিনি নিজেই তাঁর অসমাপ্ত আত্নজীবনীতে লিখেছেন।
“ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নেই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। এই সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর যাওয়া আসা করতাম। স্বদেশী আন্দোলনের লোকের সাথে মেলা মেশা করতাম” – লিখেছেন শেখ মুজিব।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যুবক শেখ মুজিবুর রহমান।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুজিব
‘বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সময়’-এই শিরোনামে এক প্রবন্ধে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, মুসলিম লীগের রাজনীতিতেও উদার অংশের নেতা সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিমের সাথে থেকে শেখ মুজিব রাজনৈতিক শিক্ষা নিয়েছেন।
সেকারণে শুরু থেকেই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চিন্তা নিয়ে তার রাজনৈতিক মানস তৈরি হয়েছিল।
শেখ মুজিব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন।
তাঁর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন অর রশিদ। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অল্প সময়ের মধ্যেই শেখ মুজিব অসাম্প্রদায়িক চিন্তা নিয়ে গণতন্ত্রের আন্দোলন শুরু করেন।
“বঙ্গবন্ধু কখনোই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। মুসলিম লীগে থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তিনি করেছেন, কিন্তু তাঁর রাষ্ট্র ভাবনায় ছিল ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের ভূখণ্ডের সাথে আরও কিছু এলাকা নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।”
তিনি আরও বলেছেন, “৪৭ সালে যখন সেই আন্দোলন ব্যর্থ হলো, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো – সেই ৪৭ সাল থেকেই নতুন করে তিনি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এবং দেখুন মাত্র সাড়ে চার মাসের মধ্যেই ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করলেন। আর ২২ মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলেন মুসলিম আওয়ামী লীগের।”
শেখ মুজিব তার ‘অসমাপ্ত আত্নজীবনী’তেও পাকিস্তানের প্রতি মোহভঙ্গ হওয়ার বিষয়ে কয়েকবার উদাহরণ দিয়েছেন।
শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বিবিসি বাংলাকে সাক্ষাৎকার দেবার সময় তোলা ছবি।
মুজিবের রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগের বছরই ১৯৪৬ সালের কোলকাতায় সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের জেরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল নোয়াখালি এবং বিহারে। সাম্প্রদায়িক সেই দাঙ্গার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন শেখ মুজিব।
পরে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধকেই তিনি তাঁর রাজনৈতিক দর্শন হিসাবে নির্দিষ্ট করে আওয়ামী মুসলিম লীগের মাধ্যমে এগিয়েছেন বলে গবেষকরা বলেছেন। সেই আন্দোলনের একপর্যায়ে দলটির নাম থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ করা হয়েছিল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খুরশিদা বেগম শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে গবেষণা করেছেন।
তিনি বলছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন শেখ মুজিব।
“পাকিস্তান আন্দোলনের সময় ১৯৪৬ সালে ডাইরেক্ট অ্যাকশন একটি কর্মসূচি হয়েছিল। সেই কর্মসূচিতে ভয়ঙ্কর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা তিনি দেখেছেন। যা তিনি তার অসমাপ্ত আত্নজীবনীতেও লিখেছেন। ফলে তিনি সাম্প্রদায়িক মঞ্চে দাঁড়িয়েও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা করছেন।”
অধ্যাপক খুরশিদা বেগম মনে করেন, শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক দর্শন স্থির করে এগিয়েছেন এবং সেজন্য তিনি হয়ে ওঠেন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রবক্তা।
“পরে তিনি (শেখ মুজিব) ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানে নিজেকে দেখেছেন এবং ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনকে নিজের রাজনৈতিক দর্শন হিসাবে নির্দিষ্ট করছেন।”
“অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র- এই দর্শনগুলো নির্দিষ্ট করার পাশাপাশি এগুলোর বাস্তবায়ন বা প্রায়োগিক রূপ দেয়ার জন্য তিনি যে অভিপ্রায়কে লালন করেছেন, সেটি স্বাধীনতা।”
‘বাঙালী জাতীয়তাবাদের শক্তিকে ব্যবহার করেছেন মুজিব’
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার আন্দোলনও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি বা ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছিল বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম ধাপেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল শেখ মুজিবকে। তিনি জেলে থেকেই আন্দোলনের নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন।
খুরশিদা বেগম বলেছেন, শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক দর্শন বাস্তবায়নের আন্দোলনে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন।
“জাতীয়তাবোধ বাঙালীর ছিল ১৯০৫ সাল থেকেই সেটা দেখা যায়। এই জাতীয়তাবোধকে তিনি (শেখ মুজিব) জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত করলেন। এই বাঙালী জাতীয়তাবাদ হলো চেতনার শক্তি। জনগণ নিজ পরিচয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বার্থ রক্ষার জন্য এটা চরম শক্তি। এই জাতীয়তাবাদকে সর্বজনীনতায় নিয়ে গিয়ে তিনি চরম শক্তিটিকে ব্যবহার করেছিলেন। যে শক্তিতেই শেষপর্যন্ত আমাদের বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল” বলেন খুরশিদা বেগম।
ছয়দফা প্রস্তাব শেখ মুজিবের রাজনৈতিক চিন্তা বাস্তবায়নের বড় টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে কাজ করে।
ছয়দফা টার্নিংপয়েন্ট: অবিসংবাদিত নেতা হন মুজিব
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হয় ১৯৬২ সালে।
এরপর অল্প সময়ের মধ্যে ১৯৬৬ সালের ছয়দফা প্রস্তাব শেখ মুজিবের রাজনৈতিক চিন্তা বাস্তবায়নের বড় টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে কাজ করে।
ছয়দফা প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে গণঅভ্যূত্থান এবং এরপরে ৭০এর নির্বাচন – এসব রাজনৈতিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে শেখ মুজিব ধাপে ধাপে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে বছরের পর বছর মানুষের কাছে গেছেন, সেকারণে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছিল।
“বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা একদিনে বা একটি ভাষণে বা একটি ঘোষণায় তৈরি হয়নি। পাকিস্তানের ব্যাপারে মোহভঙ্গ হতে ২৪ বছর সময় লেগেছিল। এই সময়ে রাজনীতির সবচেয়ে বড় অনুঘটক ছিলেন শেখ মুজিব। এবং ৬৬ সালে তাঁর দেয়া ছয় দফা ছিল ঐ সময়ের রাজনীতির এবং জনমানুষের আকাঙ্খার সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট এবং ধারালো আটিকুলেশন। যার পথ বেয়ে এসেছে স্বাধীনতা” – বলেন মি: আহমেদ।
মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, শেখ মুজিব মাঠের মানুষের ভাষা বুঝে তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক চিন্তা ঠিক করে এগিয়েছেন।
“রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মাতামাতি আছে। এরা অনেকেই কাগজে বাঘ। শেখ মুজিব ছিলেন মাঠের রাজা। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন কী – এটা এককথায় বলতে গেলে বলতে হয়-একটা বিষয় নিয়ে লেগে থাকা এবং মানুষের চোখ ও মনের ভাষা পড়ে তাকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া, এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়।”
বিশ্লেষকরা মনে করেন, শেখ মুজিবকে তাঁর জীবনের চৌদ্দ বছরই কারাগারে কাটাতে হয়েছে। এরপরও রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে দৃঢ় অবস্থানে থেকে তিনি গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন।
সেজন্যই সেই সময়ের অন্য সব নেতাকে ছাপিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা হয়েছিলেন তিনি, এবং প্রতিষ্ঠা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের।
-
-
-
-
-
মুজিব জন্মশতবার্ষিকী: মুসলিম লীগ দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও মুজিবের রাজনৈতিক দর্শনে পরিবর্তন হয়েছে কীভাবে
-
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
লাভজনক সবজি চাষ পদ্ধতি
-
কৃষকের বন্ধু ও কৃষি উন্নয়ন এর পথিকৃৎ শাইখ সিরাজের ৭০তম জন্মদিন আজ
-
যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে হতে পারে সারের সংকট
-
বিদেশ থেকে খালি হাতে ফিরে ড্রাগন চাষে সাফল্য
-
নাসিরনগরে বন্যায় তলিয়ে গেল কৃষকের বাদামখেত
-
পানি দিতে অতিরিক্ত টাকা
-
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
-
‘শিক্ষিত কৃষক’ বলেই তাঁকে নিয়ে মানুষের আগ্রহটা বেশি
-
ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বীজ কিনে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত
-
বোরো কাটতে বাড়তি খরচ ঃ হাসি নেই কৃষকের মুখে
সবজি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। কৃষি বিজ্ঞানের ভাষায় সবজিকে উদ্যানতাত্বিক ফসল (Horticultural crops) বলা হয়ে থাকে। পুষ্টিমানের দিক থেকে সবজি ফসল যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বাণিজ্যিকভাবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। সেজন্য সবজি চাষের আধুনিক কলাকৌশল জানা জরুরি।
আর আধুনিক কলাকৌশল বলতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদকেই বোঝানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু সবজি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তবে সারাদেশে যেমন সব ধরনের সবজি উৎপাদিত হয়না ঠিক তেমনি সকল সবজিই আবার সারাবছর উৎপাদিত হয়না। একেক অঞ্চলে একেক ধরনের শাকসবজি উৎপাদিত হয়ে থাকে। আবার বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ বিশেষ সবজির জাত উৎপাদন করা যায়।
সারাদেশে সারাবছরই যেসকল সবজি সহজে উৎপাদিত হয়ে থাকে তাদের কিছু শাকসবজির কথা এখানে তুলে ধরছি। লালশাক, ডাটাশাক, পুইশাক, কলমিশাক, মিষ্টিআলু শাক, ঢেড়শ, গাজর, বরবটি, টমেটো, লাউ ও লাউশাক, পাটশাক, শশা, কাঁচকলা, বেগুন, পেপে, করলা, কচুশাক, কচুর লতি, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা ইত্যাদি পরিচিত শাকসবজি। তাছাড়া অপরিচিত বিশেষ কিছু সবজি বিশেষ বিশেষ এলাকার বিশেষত্ব হিসেবে উৎপাদিত হয়ে থাকে। উপরোক্ত ফসলগুলোর মধ্যে কিছু শুধু শাক আর বাকীগুলো শাক এবং সবজি উভয় হিসেবেই প্রচলিত রয়েছে।
কৃষিতাত্বিকভাবে রবি (শীতকাল) ও খরিপ (গ্রীষ্মকাল)- এ দুধরনের মৌসুম রয়েছে। খরিপের আবার দুটি ভাগ, যথা- খরিপ-১ (আগাম গ্রীষ্ম) এবং খরিপ-২ (বর্ষাকাল)। তবে শীতকালীন শাকসবজির মধ্যে বাহারি ও রকমারি বৈচিত্র একটু বেশি। শুধুমাত্র শীতকালে উৎপাদিত হয় এমন ফসলগুলোর মধ্যে রয়েছে- টমেটো, শীতলাউ, ফুলকপি, বাধাকপি, গাজর, সীম, মূলা, ব্রকলি, বাটিশাক, ওলকপি, শালগম, বেগুন, গোল আলু ইত্যাদিই প্রধান। অপরদিকে শুধুমাত্র গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে উৎপাদিত হয় এমন ফসলের মধ্যে রয়েছে- বিভিন্ন ধরনের কচু, ওলকচু, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, কাকরোল, পটোল, করলা, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া ইত্যাদিই প্রধান।
সবজি ফসল উৎপাদন অন্যান্য ফসলের মতো নয়। সবজি ফসল উৎপাদনের জন্য বিশেষ ধরনের যত্নের প্রয়োজন হয়। আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবাদ করতে গেলে অল্প পরিমাণ জায়গায় অধিক পরিমাণ ফসল ফলিয়ে লাভবান হওয়া সম্ভব। সবজি আবাদেও জন্য বাড়ির আঙ্গিনায় অথবা অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গা বেছে নিতে হবে। সেখানে ভালোভাবে চাষ-মই দিয়ে জমির মাটি জো অবস্থায় ঝুরঝুরে করে সেখানে এক মিটার প্রশস্ত এবং প্রয়োজনমত জমির আকার-আকৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে লম্বা বেড তৈরী করে নিতে হবে। প্রতিটি বেডের মাঝখানে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি পরিমাণ গর্ত করে নালা সৃষ্টি করতে হবে। অর্থাৎ নালার মাটি তুলেই দুইপাশে বেড প্রয়োজনমত উঁচু করতে হবে।
এভাবে বেড তৈরীর একটি বিশেষত্ব হলো শাকসবজি চাষাবাদ অন্য সাধারণ ফসল আবাদের চেয়ে একটু ভিন্ন। এর জন্য প্রয়োজন হয় বাড়তি সতর্কতা ও যত্নের। শাকসবজির চাষাবাদে যেমন শুষ্ক মৌসুমে সেচের চাহিদা থাকে অপরদিকে বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি বের করে দেওয়ার প্রয়োজন হয়। সেজন্যই বেড তৈরী করে মাটি কিছুটা উঁচু করা হয় সেখানে আবার নালা তৈরী করে নিষ্কাষনের ব্যবস্থাও রাখা হয়। কিন্তু বেড এবং নালা তৈরী না করলে সেটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবাদ হয়না। সেঠা হয় সাধারণ শাকসবজি চাষ। এতে ফলন অনেক কমে যায়।
পেপে, কাঁচকলা- এ জাতীয় সবজি বসতবাড়ির আঙ্গিনায়, রাস্তা বা পুকুরের ধারে সহজেই আবাদ করা যায়। লালশাক, ডাটা শাক, পাটশাক, মূলাশাক, গাজর, শালগম ইত্যাদি সবজি তৈরীকৃত বেডে ছিটিয়ে বীজ বুনে দিলেই ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাছাড়া টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, বাধাকপি, ঢেড়শ, কচু, ওলকচু ইত্যাদি সবজি এক মিটারের বেডে দুই সারি করে নির্ধারিত দূরত্বে চারা লাগিয়ে আবাদ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। সেজন্য এসব সবজি উৎপাদনের জন্য আলাদাভাবে নার্সারিতে চারা তৈরী করে নিতে হয়। অপরদিকে লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শশা, চাল কুমড়া, পটোল, কাকরোল, করলা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, সীম, বরবটি ইত্যাদি লতাজাতীয় সবজি চাষের জন্য উক্ত বেডে দুইটি সারি করে সেখানে জাংলা দিয়ে দিতে হয়। সাধারণত বেডের দুইপাশে খুটি দিয়ে পরে তা ইংরেজি অক্ষর ‘এক্স’ আকৃতিতে বা ‘ভি’ আকৃতিতে বাঁকিয়ে বেঁধে দিতে হয়।
বেড ছাড়াও লতাজাতীয় এসব সবজি অতি সহজেই ক্ষেতের আইলে, রাস্তার ধারে, পুকুরের পাড়ে বিশেষ ব্যবস্থায় আবাদ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে অন্যান্য যেকোন ফসলের তুলনায় এসব সবজি ফসলের একটু বেশি যত্নের প্রয়োজন হয়। বিনা আবাদেই এসব সবজি চাষ করা যেতে পারে। সেজন্য বন্যা পরবর্তীতে পুনর্বাসনের সময় বিনাচাষে এসব আবাদের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ জৈবভাবেই এসব সবজি ফসল উৎপাদন সম্ভব। আবাদের পূর্বে সামান্য পরিমাণ প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার ব্যবহার করে বাকীটা মেটাতে হবে বাড়িতে উৎপাদিত জৈব সারের মাধ্যমে। তারপর আন্তপরিচর্যা এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতেও জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। তখন এসব উৎপাদিত ফসল সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
কাজেই এভাবেই সারাবছর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বষ্পপরিসরে শাকসবজি উৎপাদন করে নিজের চাহিদা মিটিয়ে তা বাণিজ্যিকভাবেও লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমাদের শারীরিক পুষ্টি চাহিদার একটি বিরাট অংশ শাকসবজি থেকে আসা দরকার। দৈনিক একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের গড়ে কমপক্ষে আড়াইশ গ্রাম শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। আর সেটা নিবিড়ভাবে এবং নিরাপদভাবে খেতে হলে নিজের উৎপাদিত শাকসবজি খাওয়াই সবচেয়ে উত্তম। কাজেই আমাদের সারাবছর অলস সময়টাকে কাজে লাগিয়ে আসুন নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় সবজির বাগান গড়ে তুলি।
একজন টেলিভিশন তারকা, কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের জন্মদিন আজ। তিনি ১৯৫৪ সালের এদিনে জন্মগ্রহণ করেন চাঁদপুরে (সার্টিফিকেট অনুযায়ী তার জন্মতারিখ ২৮শে জুন ১৯৫৬)। শাইখ সিরাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ভূগোলে। ছাত্রজীবনেই সম্পৃক্ত হন বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতার ও সংবাদপত্রের সঙ্গে।
শাইখ সিরাজ ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড, চ্যানেল আই-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও বার্তা প্রধান। টানা সাড়ে চার দশক ধরে তিনি গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে দেশের কৃষি ও কৃষক তথা উৎপাদন-অর্থনৈতিক খাতে অপরিসীম ভূমিকা রেখে চলেছেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সকল শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে বিপুল গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেন তিনি। পরে তার নিজস্ব পরিচালনাধীন টেলিভিশন ‘চ্যানেল আই’তে শুরু করেন কৃষি কার্যক্রম হৃদয়ে মাটি ও মানুষ। উন্নয়ন সাংবাদিকতার জন্য তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দু’টি রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৮) ও একুশে পদক (১৯৯৫) লাভ করেন।
টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রায় চার দশকের একনিষ্ঠ পথচলার মধ্য দিয়ে শাইখ সিরাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন উন্নয়ন সাংবাদিকতার এক অগ্রপথিক হিসাবে। গণমাধ্যমে তার উদ্বুদ্ধকরণ প্রচারণায় আমূল পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশের কৃষিতে। বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে বৈপ্লবিক সাফল্য।
গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। একইসঙ্গে শহর-নগরের মানুষকে করেছেন কৃষিমুখি। ফলে দেশের অর্থনীতিতে কৃষির বহুমুখি অবদান সূচিত হয়েছে।
‘মাটি ও মানুষ’
বাংলাদেশের কৃষিতে গত কয়েক দশকে যে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে, শাইখ সিরাজকে বর্ণনা করা হয় সেই পরিবর্তনের পেছনে অন্যতম প্রধান এক চরিত্র হিসেবে।
বাংলাদেশে যখন বিজ্ঞানীরা একের পর এক নতুন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করে চলেছেন, কৃষিতে নতুন ধ্যান ধারণা এবং কৌশল চালুর জন্য সরকারের নানা পর্যায় থেকে চেষ্টা চলছে, সেগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে বিরাট ভূমিকা রাখে তার কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান, ‘মাটি ও মানুষ।’
“শুরুতে এই অনুষ্ঠানটা হতো আমার দেশ নামে। তখন এটি ৫০ মিনিটের পাক্ষিক অনুষ্ঠান। পরে এটিকেই ‘মাটি ও মানুষ’ নামে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করি। আমার মনে হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের চেয়ে বেশি দরকার শিক্ষামূলক মোটিভেশনাল অনুষ্ঠান। কৃষকদের যদি নতুন বীজ, নতুন প্রযুক্তি, নতুন কৌশল, এসব ঠিকমত বোঝানো যায়, তাহলে কৃষিতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব।”
গত চার দশক ধরে শাইখ সিরাজ হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে কৃষি বিষয়ক তথ্যের প্রধান উৎস। উনিশ’শ আশির দশকে, যখনো টেলিভিশন ঘরে ঘরে পৌঁছায়নি, তখনো গ্রামের হাটেবাজারে, কমিউনিটি সেন্টারে প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় ‘মাটি ও মানুষ’ দেখার জন্য ভিড় করতো মানুষ।
তবে কৃষকদের নতুন ধরণের কৃষিতে উৎসাহিত করার কাজটা সহজ ছিল না।
“আজকের কৃষক এবং তিরিশ বছর আগের কৃষকের মধ্যে তফাৎ আকাশ আর পাতাল। তখন কৃষকের কাছে একজন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা যে কথা বলতেন, একজন টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে আমি যেকথা বলতাম, সেটা তারা মানতে চাইতো না। তারা ভাবতো, আমরা যেধরণের কৃষির কথা বলছি, যদি সেটাতে ভালো ফসল না হয়? এ কারণে সে সহজে মোটিভেট হতে চাইতো না। সহজে নতুন প্রযুক্তি নিতে চাইতো না।”
“আমি যখন আশির দশকে উচ্চফলনশীল নতুন জাতের ধানের কথা বলছি, গমের কথা বলছি, তখন পরিস্কার তারা আমাকে বলতো এই রাবার ভাত খাবো না। তখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধানের মান তেমন ভালো ছিল না। ভাতটা ছিল রাবারের মতো, ভাতের দানা উপর থেকে থালার উপর ফেললে সেটি রাবারের মতো ড্রপ করতো।”
কিন্তু বিজ্ঞানীরা যখন তাদের গবেষণায় নতুন নতুন সাফল্য পাচ্ছিলেন, আর সেই সঙ্গে শাইখ সিরাজও তার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকদের মন জয় করার জন্য নতুন কৌশল নিচ্ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অশোকা ফেলো শাইখ সিরাজ খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র বিমোচন বিষয়ে সাংবাদিকতায় অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসাবে তিনি ২০০৯ সালে অর্জন করেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এ এইচ বুর্মা এ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া তিনি পেয়েছেন এশিয়ার মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার গুসি পিস প্রাইজ, বৃটেনের বিসিএ গোল্ডেন জুবিলি অনার এ্যাওয়ার্ডস। বৃটিশ হাউজ অব কমন্স তাকে প্রদান করেছে বিশেষ সম্মাননা, বৃটিশ-বাংলাদেশ ব্যবসায়ী সংগঠন তাকে দিয়েছে গ্রীন এ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া পেয়েছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির স্বর্ণপদক, ডা. ইব্রাহিম মেমোরিয়াল স্বর্ণপদক, রণদা প্রসাদ সাহা স্বর্ণপদকসহ অর্ধশত দেশি-বিদেশি পুরস্কার ও সম্মাননা।
চ্যানেল আই ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখে থাকেন। তিনি এদেশে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে নিরস বিষয় হিসাবে উপেক্ষিত কৃষিতে জাতীয় সংবাদের প্রধান খবরের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শাইখ সিরাজের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- মৎস্য ম্যানুয়েল, মাটি ও মানুষের চাষবাস, ফার্মার্স ফাইল, মাটির কাছে মানুষের কাছে, বাংলাদেশের কৃষি: প্রেক্ষাপট ২০০৮, কৃষি ও গণমাধ্যম, কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট (সম্পাদিত), আমার স্বপ্নের কৃষি, কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট (২০১১), সমকালীন কৃষি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (২০১১), কৃষি ও উন্নয়ন চিন্তা (২০১৩) ইত্যাদি।
মেহেরপুর: পতিত ও অনুর্বর বেলে মাটির জমিতে চিনাবাদাম চাষ করে লাভবান হচ্ছেন মেহেরপুরের চাষিরা। ফলন ও বাজার দর ভালো এবং কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় দিন দিন এই এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাদামের চাষ।
সদর উপজেলার মদনাডাঙ্গা, শ্যামপুর, টেংগারমাঠ ও গোপালপুর গ্রামের অধিকাংশ জমির মাটি বেলে। ফলে এই এলাকার চাষিরা ধান, গম, পাটসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করে খুব একটা লাভবান হতে পারেন না।
ধান কাটার পর এ সব জমি সাধারণত পতিত থাকে। এজন্য ৯০ দিনের ফসল হিসেবে অল্প খরচে বাদাম চাষ করছেন এলাকার চাষিরা।
মেহেরপুর জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলায় এবার বাদাম চাষ হয়েছে ১৫ হেক্টর জমিতে। এবার এক বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করতে চাষিদের খরচ হয়েছে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা সেক্ষেত্রে বাদামের ফলন হয়েছে ৬ থেকে ৭ মণ। আর এ ফলনে প্রায় ২০ হাজার টাকা ঘরে তুলছেন তারা। বাজারে প্রতিমণ বাদাম বিক্রি হচ্ছে ২৭শ’ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। সদর উপজেলার মদনাডাঙ্গা গ্রামের বাদাম চাষি খাঁজা আহমেদ, কাওছার আলী ও ফিরোজ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, এলাকার মাটি বেলে হওয়ায় সাধারণত সবজি, আলু ও অন্যান্য ফসল চাষ করার পর জমি পতিত থাকে। সে সময়ে চিনা বাদামের চাষ করা হয়। বাদাম চাষে খরচ কম এবং উৎপাদন ও বাজার দর ভাল। তাই দিন দিন চাষিরা তাদের পতিত জমিতে চিনা বাদামের চাষ শুরু করছেন।
এছাড়া বাদাম ছাড়ানো, শুকানোসহ যাবতীয় কাজ করে থাকেন এখানকার নারীরা। বাদামের গাছ আবার শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করছেন গৃহিণীরা।
নারী শ্রমিক সাহানা খাতুন ও জরিমন নেছা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বাদাম ছাড়ানো ও শুকানোর কাজ করে থাকি। এলাকার ২৫/৩০ জন নারী শ্রমিক এ কাজ করে আসছেন।
গৃহিণী সাজেদা খাতুন ও জামেলা খাতুন জানান, বাদামের লতা জালানি হিসেবে বেশ ভাল। তাই লতাও বিক্রি হচ্ছে।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আক্তারুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, চিনা বাদামের চাষ সাধারণত পতিত জমিতে হয়ে থাকে। এলাকার চাষিরা এই জমিতে বাদামের চাষ করে বাড়তি আয় করছেন। তাই বাদাম চাষ যাতে আরও সম্প্রসারিত হয় সেজন্য কৃষি বিভাগ চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছে।
সিলেট বিভাগের উচ্চমাত্রার অ্যাসিডিক জমিতে গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধাসহ বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কৃষি বিজ্ঞানিরা মৌলভীবাজারের আকবরপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে ফুল চাষ করে সফল হয়েছেন। এ ফুল চাষ মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে ১০০ চাষিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে কৃষি গবেষণা কেন্দ্র।
কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যমতে, যশোরে বাণিজ্যিকভাবে গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল চাষ হয়। যার বাজার দর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। যশোরের ফুল সারাদেশের পাশাপাশি সিলেটেও আসে প্রচুর। সিলেটে ফুলের বাজার শত কোটি টাকার উপরে। কিন্তু সিলেটে ফুলের চাষ বাণিজ্যিকভাবে হয় না।
সিলেট বিভাগের মাটি অ্যাসিডিক হওয়ায় ফুল চাষ করা যাবে না, সেটাই ছিল প্রচলিক ধারণা। কিন্তু এ ধারণাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যদিয়ে ভুল প্রমাণ করেছেন মৌলভীবাজার আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের একদল গবেষক। মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এস এম শরিফুজ্জামানের নেতৃত্বে উচ্চমাত্রার অ্যাসিডিটিক জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে ফুল চাষ করে সফল হয়েছেন তারা। এ পরীক্ষামূলক চাষে ফলনও হয়েছে ভালো। তাই সিলেট অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট অঞ্চলে অনেক জায়গা অনাবাদি ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। প্রবাসীরা দেশের বাইরে অবস্থান করায় তাদের অনেক জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। এ জমিকে আবাদের আওতায় আনতে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষের উদ্যোগ নিয়ে আগ্রহী ১০০ চাষিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে আমন ধান কাটার পর এ অঞ্চলের অনেক জমি পতিত থাকে। ফলে ফুল চাষ করে অনাবাদি জমি থেকে কোটি টাকা উপার্জন সম্ভব।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মিরানা আক্তার সুমি জানান, চাষিরা প্রশিক্ষণ শেষে অনেক কিছু শিখেছেন। কী পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে হয়, তা জেনেছেন। ধানের চেয়ে যেহেতু ফুলের দাম বেশি, তাই ফুল চাষে তাদের আগ্রহ বাড়ছে।
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সরফ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভালোভাবে জমি চাষ করে নির্দেশিত মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হয়। অন্য ফসলের মতোই এর চাষ পদ্ধতি সহজ। বেড তৈরি করে ফুল চাষ করতে হয়। প্রতিটি বেডের দৈর্ঘ যে কোন মাপের হতে পারে। তবে প্রস্থে ১.২-১.৫ মিটার হলে ভালো।’
তিনি বলেন, ‘কলম (বীজ) লাগানো থেকে তিন মাস পর স্টিক সংগ্রহ শুরু হয়। সংগ্রহ করা যাবে পরবর্তী ২৫ দিন। গ্লাডিওলাস ৫টি জাতসহ মোট ১২টি প্রজাতির ফুলের পরীক্ষা করে আমরা সফল হয়েছি।
সবুজ বিপ্লবের সময়ে পেস্টিসাইড ব্যবহারকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জীব বৈচিত্র্য, মাটির স্বাস্থ্য ও ফসলের গুণমানতা। এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে, এত রাসায়নিক পেস্টিসাইড ব্যবহার করা কি ঠিক হচ্ছে? এ প্রশ্ন শুধু ভারতে নয়, সারাবিশ্বের কৃষকসমাজ ও শস্যবিজ্ঞানীদের কাছে। তাই মনে হয় জৈব নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্ব দিয়ে সুসংহত রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণ আগামী দিনে একমাত্র সমাধানের রাস্তা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
চলমান খরিফ মরসুমে আমাদের রাজ্যে প্রধানত ধান, খরিফ পেঁয়াজ, জুট, ইক্ষু, তিল ইত্যাদি ফসলের চাষ হয়ে থাকে। এ রাজ্যে ধানে ঝলসা রোগের আক্রমণ একটি গুরুতর বিষয়।
জৈব পদ্ধতিতে এই রোগ দমন করার একটি সহজ উপায় রয়েছে। ৫০ মিলিলিটার কেরোসিন তেলে ৮৫ গ্রাম থেঁতলানো রসুন মিশিয়ে ২৪ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এরপর ৯৫০ মিলি. জল ও ১০ মিলি. তরল সাবান মিশিয়ে ভালোভাবে নেড়ে নিয়ে বোতলে রেখে দিতে হবে। ১৯ লিটার জলের সাথে ১ ভাগ মিশ্রণ মিশিয়ে সকালে/বিকেলে স্প্রেয়ার দিয়ে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করতে হবে।
এই মিশ্রণটি আমেরিকান বোল ওয়ার্ম, আর্মি ওয়ার্ম, পেঁয়াজ-এর চিরুনি পোকা, আলুর টিউবার মথ, রুট নট নিমাটোড (কৃমি), আখের কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা, ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ, ডাউনি মিলডিউ ও ধানের ঝলসা রোগ প্রতিরোধে খুবই কার্যকরী।
এছাড়া বিভিন্ন ধরণের পাতা খেকো পোকা ও জাব পোকা নিয়ন্ত্রণে ১ কেজি পেঁয়াজ থেঁতো করে ১ লিটার জলের সাথে মিশিয়ে ২৪ ঘণ্টা রেখে দেবার পর কচলিয়ে রস নিংড়ে নিতে হবে। প্রাপ্ত নির্যাসের সাথে ১০ লিটার জল মিশিয়ে আক্রান্ত ফসলে স্প্রে করতে হবে।
জৈব সার প্রয়োগ ও জৈব কীটনাশক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন খরচ শতকরা ২৫-৩০ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব। উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন প্রযুক্তিতে উৎপাদিত জৈব সার, শাকসব্জী ও অন্যান্য ফসলের প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম-এর সাথে অণুখাদ্যের যোগান দেয়।
জৈব পদ্ধতিতে উৎপন্ন কীটনাশক ও ছত্রাকনাশকগুলি ফসলে কোনওরকম দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ব্যতিরেকে, পোকা ও রোগ দমনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এতে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও উর্বরতা দীর্ঘমেয়াদী হয়। উৎপাদিত ফসল হয় স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ।
বন্ধুপোকা মাকড়ের (পরজীবি ও পরভোজী) সংরক্ষণের জন্য জমির পাশে অব্যবহৃত জায়গায় ত্রিধারা, উঁচুটি, শালিঞ্চে ইত্যাদি আগাছা জাতীয় গাছের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
দূরদর্শী পদক্ষেপের মাধ্যমে রাসায়নিক কৃষি বর্জন করে প্রাণ বৈচিত্র্য নির্ভর জৈব কৃষির মাধ্যমে খাদ্যে সার্বভৌমত্ব আনা সম্ভব। তাই জৈব কৃষির পথে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে কৃষিবিষমুক্ত, স্বাস্থ্যসম্মত সমাজ গড়ে তোলাই বাঞ্ছনীয়।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন