ইসলাম
মহানবী (সা.)–এর জীবনী রচনার হাজার বছর
লেখক
প্রথম আলোএকক ব্যক্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি জীবনীগ্রন্থ লেখা হয়েছে কার, এ–বিষয়ক কোনো জরিপ কখনো হয়েছে কি? হলে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর নাম ওপরেই থাকবে। গত দেড় হাজার বছরে দেশ–বর্ণ–ধর্মনির্বিশেষে অজস্র সাহিত্যিক, সমাজনেতা, শিক্ষাবিদ, সমরবিদ, গবেষক, রাষ্ট্রনায়ক, এমনকি তাঁর বিরুদ্ধবাদীরাও তাঁকে নিয়ে বিপুল প্রশস্তি বর্ণনা করেছেন। তাঁর প্রচারিত ধর্ম গ্রহণ না করেও তাঁকে মহামানবের স্বীকৃতি দিয়েছেন। বিশ্বের ঘোর দুর্দিনে তাঁর মতো নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। একেবারে আটপৌরে জীবনীগ্রন্থ থেকে বিশেষায়িত গবেষণাগ্রন্থ লিখেছেন তাঁরা অসংখ্য। একটিই মানুষ, একটিই তাঁর জীবন, একটিই কাহিনি—সেই মক্কার কুরাইশ পরিবারে জন্ম, আল-আমিন উপাধি, সিরিয়ায় বাণিজ্য, হেরা পর্বতের ধ্যানমগ্নতা, মক্কার দাওয়াত, তায়েফের ক্ষত, মদিনায় হিজরত, বদরের যুদ্ধ, বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে ঊর্ধ্বগমন, আবার মক্কায় ফেরা, বিদায় হজ। একই কথা বহুমুখে বহুজনে বহুশতাব্দী ধরে বাতাসে বাতাসে ফিরছে, তবু যেন অফুরান, যেন কিছু লেখা হলো আর অলিখিত রয়ে গেল ঢের, কিছু বলা হলো আর অনেক কিছুই হয়নি বলা।
জীবনী রচনার সূচনাপূর্ব: মহানবী (সা.)–কে জানার প্রথম উৎস হলো কোরআন। যেমন তাঁর সম্পর্কে তাঁর জীবনসঙ্গী আয়েশা (রা.)–এর কাছে জানতে চাওয়ার পর তিনি বলেছেন, কোরআনই তাঁর চরিত্র। (ইমাম বুখারি, আল আদাব আল মুফরাদ, হাদিস: ৩০৮)। কোরআনজুড়ে প্রসঙ্গক্রমে নবীজীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতির ছায়া পড়েছে। মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন, যুদ্ধের নানান অনুষঙ্গ, অথবা নবীর স্ত্রীর নির্দোষিতা ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে তখনকার ঘটনার আলোকে। কোরআনের প্রাচীন তাফসির ও কোরআন নাজিলের প্রেক্ষাপট–সংক্রান্ত বিভিন্ন হাদিস এবং হাদিসের বিচ্ছিন্ন সংকলনগুলোতে তাঁর জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনা বিধৃত হয়েছে। সেকালে রচিত ইতিহাসের আধার ও উপাদানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নবীজীবনের খণ্ড খণ্ড চিত্র। কিন্তু তাঁকে নিয়ে ধারাবাহিক জীবনী রচনার উন্মেষ ঘটেছে তাঁর ইন্তেকালের অন্তত ৫০ বছর পরে। কেননা নবীজি তখন নিজেই তাঁদের সামনে ছিলেন। এমনকি দূরে বা কাছের যাঁরা তখনো দেখেননি তাঁকে, তাঁদেরও সবার যেন একবার অন্তত দেখার সুযোগ হয়ে যায়, তাই তিনি বহু আগেই বিদায় হজের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর তিরোধানের পর পরবর্তী প্রজন্মও সাহাবিদের এমন একটি বিরাট দলের সান্নিধ্য পেয়েছেন, যাঁদের প্রাত্যহিক জীবনের সব ইবাদত ও কাজকর্ম মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর আদর্শ মেনে বাস্তবায়িত হতো। তারপর সময়ের দূরত্ব যত বাড়তে থাকে, নবীজি সম্পর্কে জানার কৌতূহল বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি কেমন ছিলেন—এই প্রশ্নের আধিক্য মহানবীর জীবনকাহিনি রচনার পথ উন্মুক্ত করে দেয়। প্রজন্মান্তরে মহানবীকে দেখা ও তাঁকে জানার প্রবল ইচ্ছার কথা কি তিনিও জানতেন? যেমন তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের পরে উম্মতের মধ্যে আমার প্রতি এতটা ভালোবাসাসম্পন্ন লোক আসবে, যারা তাদের সম্পদ-পরিজনের বিনিময়ে হলেও আমাকে দেখতে চাইবে।’ (মুসলিম, সহিহ, হাদিস: ২৮৩২)। তো জীবিত সাহাবিগণ নবীজির বিবরণ তুলে ধরা শুরু করলেন, কখনো সংক্ষেপে, কখনো সবিস্তারে, আবার কখনোবা আংশিক। এভাবেই একসময় ধারাবাহিক জীবনী সামনে চলে এল।বিজ্ঞাপন
জীবনীগ্রন্থের দুটি বাহু: মহানবী (সা.)–এর জীবনী আলোচনার প্রধানতম দুটি বাহু রয়েছে। একটি হলো ‘সিরাত’; যাকে ‘সিয়ার’ ও ‘মাগাজি’ও বলা হয়। সিরাত মানে জীবনী। আমরা মহানবী (সা.)–এর জীবনীর যে সাধারণ ধরনটি দেখি, অর্থাৎ জন্ম থেকে তাঁর জীবনের ধারাবাহিক ঘটনাবলির বিবরণ সেটিই ‘সিরাত’ নামে পরিচিত এবং এ-জাতীয় গ্রন্থকে সাধারণত সিরাতগ্রন্থ বলা হয়। তবে আরেকটা দিক আছে—নবীজির দৈহিক গঠন, আচরণ ও কার্যক্রমের বর্ণনা। একে বলে ‘শামায়েল’। শামায়েল রচনার ধারাটা শুরু হয় একটু পরে। শামায়েল গ্রন্থকারকগণ প্রথম দিকে কেবল নবীজির দৈহিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করার মধ্য দিয়ে তাঁর অবয়ব-প্রকৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করতেন। পরবর্তী সময়ে আরও বিস্তৃতি আকারে নবীজির আচার-আচরণ, ইবাদত-বন্দেগি, বিনয়-কোমলতা—এভাবে তাঁর ব্যক্তিজীবনের সব দিক উল্লেখ করা হতে থাকে। শামায়েলবিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হলো ইমাম তিরমিজির (মৃ. ২৭৯ হি.) ‘শামায়েল তিরিমিজি’, ইমাম বাগাবির (মৃ. ৫১৬ হি.) ‘আল আনওয়ার ফিশ শামায়েল’, ইবনে কাসিরের (মৃ. ৭৭৪ হি.) ‘আল-ফুসুল ফি সিরাতির রসুল’ ও জালালুদ্দিন সুয়ুতির (মৃ. ৭৭৪ হি.) ‘শামায়িলুশ শারিফা’ এবং বর্তমান সময়ে সিরিয়ান লেখক সালেহ আহমাদ শামির (জন্ম ১৯৩৪) ‘মিন মায়িনিশ শামায়েল’, যা ইতিমধ্যে আকিক পাবলিকেশনস, ঢাকা থেকে ‘মুহাম্মাদ স.: ব্যক্তি ও নবী’ নামে অনুবাদিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে।
প্রথম যুগের রচনাবলি: প্রথম মহানবী (সা.)–এর জীবনী রচনা করেন কে—এই সময়ে এসে তাঁর নিশ্চিত সন্ধান পাওয়া দুরূহ। ১০৯২ সালে সৌদি আরবের কিং সাউদ ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত ‘আসসিরাতুন নাবাবিয়াহ ফি যাওইল মাসাদিরিল আসলিয়া’ এ-বিষয়ক একটি প্রামাণ্যগ্রন্থ। ড. মাহদি রিজকুল্লাহ আহমাদ তাতে চোদ্দ শতকের মিসরীয় স্কলার ইবনে হাজার আসকালানির অভিমতকে প্রাধান্য দিয়ে প্রথম তিনজন রচয়িতার নাম ও রচনার উল্লেখ করেছেন।
এক. সাহল ইবনে হাসমা (রা.)। তাঁর জন্ম তৃতীয় হিজরিতে। কৈশরে তিনি মহানবী (সা.)–কে দেখেছেন এবং উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়ার আমলে (৪১-৬০ হি.) মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সেই জীবনীর বিভিন্ন অংশ মৌলিক সূত্র আকারে নবম শতকের ঐতিহাসিক বালাজুরি রচিত ‘আনসাব’, ইবনে সাদ রচিত ‘তাবাকাত’, তাবারি রচিত ‘তারিখে তাবারি’ এবং ওয়াকিদির বিভিন্ন রচনায় পাওয়া যায়।
গত শতকের প্রথম দিকে জার্মান প্রাচ্যবিদ এডওয়ার্ড সাচাউ (মৃ. ১৯৩০ খ্রি.) বার্লিনে সরকারি প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকের হাদিসবেত্তা ইউসুফ ইবনে কাজি শাহবাহ (মৃ. ১৩৮৭ খ্রি.) সংকলিত মুসা ইবনে উকবা বর্ণিত হাদিসগুলো ও ‘মাগাজি’র ২০টি অধ্যায়–সংবলিত একটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন এবং কিছু নির্বাচিত অংশ ইংরেজিতে প্রকাশ করেন। এর মধ্য দিয়ে আধুনিক সময়ে প্রথমবারের মতো গ্রন্থটি আলোর মুখ দেখে।
দুই. সাইদ ইবনে সাদ ইবনে উবাদা খাজরাজি। তাঁর রচনা ইবনে হাম্বল ও আবি-ইওয়ানার ‘মুসনাদ’ এবং তাবারির ‘তারিখে তাবারি’তে রয়েছে।
তিন. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (মৃ. ৭৮ হিজরি)। খ্যাতিমান তাফসিরবিশারদ সাহাবি। হাদিস ও সিরাতের বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর রচনা পাওয়া যায়। তাঁদের তিনজনের রচিত নবীজীবনী পুস্তকাকারে পাওয়া যায় না এবং পরবর্তী সময়েও সেই রচনাবলি কোথাও একত্রে সংকলিত হয়নি।
তাঁদের পরে রচনাকর্মে হাত দেন উরওয়া ইবনে জুবাইর (রা.) (মৃ. ৯২ হি.), সাদ ইবনে মুসাইয়িব মাখজুমি (মৃ. ৯৪ হি.), আবদুল্লাহ ইবনে কাব ইবনে মালেক (মৃ. ৯৭ হি.) ও খলিফা উসমানের (রা.) ছেলে আবান ইবনে উসমান (মৃ.১০৫ হি.), ওয়াহাব ইবনে মুনাববিহ (মৃ. ১১০ হি.), ইবনে শিহাব জুহরি (মৃ. ১২০ হি.), শুরাহবিল ইবনে সাদ (মৃ. ১২৩ হি.) ও আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর ইবনে হাজাম (মৃ. ১৩৫ হি.)। কিন্তু উরওয়া, ওহাব ও জুহরির রচনা ছাড়া সব কটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কিছু কিছু অংশমাত্র বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থে টিকে আছে।
উরওয়া ইবনে জুবাইর (রা.) ছিলেন সাহাবি আবু বকরের (রা.) বড় মেয়ে আসমার ছেলে। তিনি উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান ও আল ওয়ালিদের সময়ে নবীযুগে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে জানতে চাওয়া চিঠির জবাব লিখতেন। তাঁকে বহু ঐতিহাসিক গ্রন্থে মুহাম্মদ (সা.)–এর ‘প্রথম জীবনীকার’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতের খ্যাতিমান স্কলার ড. মুহাম্মাদ মুস্তফা আজমি (মৃ. ২০১৭ খ্রি.) তাঁর রচিত পুস্তিকাটির কেবল শেষভাগটি উদ্ধার করতে সক্ষম হন—যা আবুল আসওয়াদ মিসরির বর্ণনায় পাওয়া যায় এবং ‘মাগাজি রসুলিল্লাহ স. লি-উরওয়াহ ইবনি জুবাইর বি-রিওয়াতি আবিল আসওয়াদ’ শিরোনামে রিয়াদ (সৌদি আরব) থেকে ১৯৮১ সালে প্রকাশ করেন। ওয়াহাব ইবনে মুনাববিহর রচনার একটি অংশ বর্তমানে জার্মানির হাইডেলবার্গে সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়। আর ইবনে শিহাব জুহরির রচনা বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ থেকে কুড়িয়ে এনে ২ হাজার পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আওয়াজি এবং তা দুই খণ্ডে ‘মারাউইয়্যাত আল ইমাম জুহরি ফিল মাগাজি’ শিরোনামে ২০০৪ সালে মদিনা থেকে প্রকাশিত হয়।
সর্বপ্রাচীন পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ: প্রাচীন সিরাত গ্রন্থের কথা উঠলেই সবাই একনামে ইবনে ইসহাক (মৃ. ১৫১ হি.) রচিত ‘সিরাতে ইবনে ইসহাক’কে চেনেন; যার ভিত্তিতে আবদুল মালিক ইবনে হিশাম (মৃ. ২১৮ হি.) জনপ্রিয় সিরাতগ্রন্থ ‘সিরাতে ইবনে হিশাম’ রচনা করেছেন। অথচ এর অন্তত এক যুগ আগে রচিত হয়েছে মুসা ইবনে উকবার (মৃ. ১৪১ হি.) সুবিশাল সিরাতগ্রন্থ ‘আল-মাগাজি’ এবং তা এখনো অক্ষত আছে। একটি বর্ণনা অনুযায়ী ‘মুআম্মার ইবনে রাশেদ’র (মৃ. ১৫১ হি.) সিরাতগ্রন্থ ‘আল-মাগাজি’ও সিরাতে ইবনে ইসহাকের পূর্বে রচিত এবং তার কপিও দুর্লভ নয়। লেখকদের জীবনকালের তারতম্য থেকেও প্রাচীনত্বের বিষয়টি পরিষ্কার হয়। ইবনে ইসহাকের জন্ম ৮৫ হিজরি এবং মৃত্যু ১৫১ হিজরি। আর মুসা ইবনে উকবার জন্ম ৬৮ হিজরি এবং মৃত্যু ১৪১ হিজরি। সুতরাং অস্তিত্বের বিচারে ইবনে ইসহাক রচিত ‘সিরাত’ নয়—মুসা ইবনে উকবার ‘আল-মাগাজি’ সর্বপ্রাচীন পূর্ণাঙ্গ সিরাতগ্রন্থ।
গত শতকের প্রথম দিকে জার্মান প্রাচ্যবিদ এডওয়ার্ড সাচাউ (মৃ. ১৯৩০ খ্রি.) বার্লিনে সরকারি প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকের হাদিসবেত্তা ইউসুফ ইবনে কাজি শাহবাহ (মৃ. ১৩৮৭ খ্রি.) সংকলিত মুসা ইবনে উকবা বর্ণিত হাদিসগুলো ও ‘মাগাজি’র ২০টি অধ্যায়–সংবলিত একটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন এবং কিছু নির্বাচিত অংশ ইংরেজিতে প্রকাশ করেন। এর মধ্য দিয়ে আধুনিক সময়ে প্রথমবারের মতো গ্রন্থটি আলোর মুখ দেখে। এরপর মরক্কোর ইবনে জুহর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবু মালিক মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন বাকিশিশ দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে বিভিন্ন প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে আরবি মূলপাঠ উদ্ধারে সক্ষম হন, এরপর প্রয়োজনীয় টিকা-ভাষ্য যুক্ত করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক অনুষদ থেকে ১৯৯৪ সালে মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন।
আধুনিক যুগে আরবি ভাষার অন্যতম সিরাতগ্রন্থ হলো নাসিরুদ্দিন আলবানি (মৃ. ১৯৯৯ ইং) রচিত ‘সহিহ আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা’, ভারতের বিখ্যাত দায়ি আবুল হাসান আলী নদভি (মৃ. ২০০০ ইং) রচিত ‘আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা’; যা বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বাংলা ভাষায় এর অনুবাদ ‘নবীয়ে রহমত’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।
পরবর্তী যুগের শ্রেষ্ঠ রচনা: হিজরি প্রথম ও দ্বিতীয় শতক ছিল নবীজীবনী রচনার প্রথম যুগ। তৃতীয় শতক থেকে দ্বিতীয় যুগের সূচনা হয়। এই যুগই হলো নবীজীবনী রচনার স্বর্ণযুগ এবং ইতিহাসের ধুলোর আস্তর কঠিন হওয়ার আগেই ইসলামের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতগণ বিরাট বিরাট কলেবরের জীবনী ও ইতিহাসগ্রন্থ রচনা করেছেন। তৃতীয় শতকের শ্রেষ্ঠ রচনা হলো ‘সিরাতে ইবনে হিশাম’, যার কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ আলফ্রেড গিলিয়াম অনূদিত ইংরেজি সংস্করণ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হলে তা আধুনিক সময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষায়ও এর বেশ কয়েকটি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এরপরই রয়েছে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবনে ওমর আল-ওয়াকিদির (মৃ. ৩৪৬ হি.) ‘আত-তারিখ ওয়াল মাগাজি’ গ্রন্থটি। লেখক ‘ওয়াকিদি’ নামেই সমধিক পরিচিত, তিনি মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর এই গ্রন্থটির বিভিন্ন বর্ণনার ব্যাপারে ইসলামবেত্তা পণ্ডিতগণ বেশ ‘আপত্তি’ তুলেছেন। চতুর্থ হিজরি শতকে রচিত হয় ঐতিহাসিক জারির ইবনে তাবারির ( মৃ. ৩১০ হি.) ‘আত-তারিখ ওয়াল উমাম’ এবং আলী ইবনে হুসাইন মাসউদির (মৃ. ৩৪৬ হি.) ‘মুরুজু আজ-জাহাব’, পঞ্চম হিজরি শতকে ইবনে হাজমের (মৃ. ৪৫৬ হি.) ‘জাওয়ামিউস সিরাহ’, ষষ্ঠ শতকে আবদুর রহমান সুহাইলি আন্দালুসির (মৃ. ৫৮১ হি.) ‘রওজুল উনফ’, সপ্তম শতকে প্রকাশিত হয় ইমাম নববির (মৃ. ৬৭৬ হি.) ‘তাহজিবুস সিরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ’, অষ্টম শতকে তিনটি গ্রন্থ বিখ্যাত হয়—ইমাম জাহাবির (মৃ. ৭৪৮ হি.) ‘আল-মাগাজি’, ইবনুল কাইয়্যিম জাওজির (মৃ. ৭৫১ হি.) ‘জাদুল মাআদ’ ও ইবনে কাসিরের (মৃ. ৭৭৪ হি.) ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’। এর মধ্যে ‘জাদুল মাআদ’ গ্রন্থটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে ৬ খণ্ডে বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। নবম হিজরি শতকের দুটি বিখ্যাত সিরাতগ্রন্থ হলো ঐতিহাসিক আহমদ ইবনে আলী মাকরিজির (মৃ. ৮৪৫ হি.) ‘ইমতাউল আসমা বিমা লিররসুলি মিনার আবনা’ ও প্রখ্যাত হাদিসবেত্তা ইবনে হাজার আসকালানির (মৃ. ৮৫২ হি.) ‘মুখতাসারুস সিয়ার’; দশম শতকে শিহাবুদ্দিন কাসতালানি (মৃ. ৯২৩ হি.) লেখেন ‘আল-মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যা’, এগারো শতকে রচিত হয় আল্লামা বুরহানুদ্দিন হালাবির (মৃ. ১০৪৪ হি.) বিখ্যাত সিরাতগ্রন্থ ‘ইনসানুল উয়ুন ফি সিরাতিল আমিনিল মামুন’, যা ‘সিরাতে হালাবিয়া’ নামে সমধিক পরিচিত।
এ যুগের রচনার সিংহভাগ রচিত হয়েছে আরবি ভাষায়, যদিও লেখকদের সবাই আরব ছিলেন, তা নয়। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের লেখা ও শেখার মাধ্যম আরবি হওয়ায় রচয়িতাগণ আরবি ভাষাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।বিজ্ঞাপন
আধুনিক যুগের বিচিত্র রচনা: ইসলামের ইতিহাসের এমন কোনো পণ্ডিত খুঁজে পাওয়া ভার, যিনি নবীজীবনের ওপরে কলম ধরেননি। কারও কারও রচনা কলেবরে এতটাই বিরাট আকার ধারণ করেছে যে তা কয়েক হাজার পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে ‘সিরাত বিশ্বকোষ’ রচিত হয়েছে। আবার কেউ কেউ নবীজীবনের ওপর আরবি ভাষায় বিরাট কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। মহানবী (সা.)–এর জীবদ্দশাতেও তাঁকে নিয়ে অনেক প্রশস্তিমূলক কাব্য রচিত হয়েছে বটে, তবে তা জীবনী আকারে ছিল না। ১২ হিজরি শতকে মাসউদ ইবনে মুহাম্মাহ আল-ফাসি (মৃ. ১১১৯ হি.) প্রথম কাব্যজীবনী রচনা করেন। গ্রন্থের নাম দেন ‘নাফাইসুদ দুরার ফি আখবারি সাইয়িদিল বাশার’। এরপর একইভাবে আহমদ বুখারি দিময়াতি (মৃ. ১৮৯২ ইং) রচিত ‘সাআদাতুত দারাইন’ এবং ইউসুফ ইসমাইল নাবহানি (মৃ. ১৯৩২ ইং) লেখেন ‘আন-নাজমুল বাদি ফি মাওলিদিশি শাফি’। বাংলা ভাষায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘মরুভাস্কর’ লিখেছেন। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে। মহানবী (সা.)–এর জীবনী নিয়ে চারটি পর্বে ১৮টি খণ্ড-কবিতা নিয়ে রচিত হয়েছে এই কাব্যগ্রন্থ।
আধুনিক যুগে আরবি ভাষার অন্যতম সিরাতগ্রন্থ হলো নাসিরুদ্দিন আলবানি (মৃ. ১৯৯৯ ইং) রচিত ‘সহিহ আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা’, ভারতের বিখ্যাত দায়ি আবুল হাসান আলী নদভি (মৃ. ২০০০ ইং) রচিত ‘আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা’; যা বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বাংলা ভাষায় এর অনুবাদ ‘নবীয়ে রহমত’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। সফিউর রহমান মোবারকপুরির (মৃ. ২০০৬ ইং) ‘আর রাহীকুল মাখতুম’ আরবি বইটি ১৯৭৯ সালে রাবেতায়ে আলাম আল ইসলামি আয়োজিত প্রথম উন্মুক্ত সিরাত গ্রন্থ প্রতিযোগিতায় ১১৮৭টি পাণ্ডুলিপির মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। এটিকে সিরাতসংক্রান্ত বিশাল সংগ্রহশালার একটি নির্যাসগ্রন্থ বলা যায়। মিসরীয় চিন্তাবিদ মুহাম্মাদ আল গাজালি (মৃ. ১৯৯৬ ইং) রচনা করেন সিরাতবিষয়ক একটি বিশ্লেষণগ্রন্থ ‘ফিকহুস সিরাহ’। একই নামে সিরিয়ান শায়খ রামাদান আল-বুতিরও (মৃ. ১৯৯৬ ইং) একটি রচনা রয়েছে। এ ছাড়া আরবি ভাষায় লিখিত সিরাতের মধ্যে সাইয়েদ সোলাইমান নদভির ‘আস-সিরাতুন নাবাবিয়া’, শায়খ সালেহ আল মুনাজ্জিদ ‘খুলুকুন আজিম’ ও আলী সাল্লাবির ‘আসসিরাতুন নাবাবিয়া আরজু ওয়াকায়ি ওয়া তাহলিলিল আহদাস’ উল্লেখযোগ্য।
উর্দু ভাষায় অমুসলিমদের রচনাবলির মধ্যে বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ হলো ইন্ডিয়া পত্রিকার সম্পাদক গুরু দত্ত সিং দারা (G S Dara) লিখিত ‘রসুলে আরাবি’, যা আবু তাহের মেছবাহ কর্তৃক ‘তোমাকে ভালোবাসি হে নবী’ শিরোনামে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
উর্দু ভাষায় রয়েছে ভারতের শিক্ষাবিদ মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ‘রসুলে রহমত’ ও শিবলী নুমানির ‘সিরাতুন নাবী’। ইংরেজি ভাষার আলোচিত সিরাতগ্রন্থগুলো মধ্যে মার্টিন লিংগসের ‘Muhammad: His Life Based on the Earliest Sources’, জামাল বাদাবির ‘Muhammad A Blessing For Mankind’, ওয়াহিদুদ্দিন খানের ‘Prophet of Revolution’, হোসাইন হায়কলের ‘Muhammad Rasulallah’, মোহাম্মদ হামিদুল্লাহর ‘Muhammad Rasulullah: A concise survey of the life and work of the founder of Islam’, সাইয়েদ হোসাইন নাসেরের ‘Muhammad, Man of God’, আদিল সালাহির ‘Muhammad: man and prophet, a complete study of the life of the Prophet of Islam’, ফেতুল্লাহ গুলেনের ‘The Messenger of God: Muhammad’ ও তারিক রামাদানের ‘The Messenger: the Meanings of the Life of Muhammad’ উল্লেখযোগ্য।
অমুসলিমদের রচনাবলি: ঊনবিংশ শতকের শুরুতে প্রাচ্যবিদদের রচনায় বেশ কিছু জীবনীগ্রন্থের নাম উঠে আসে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাতে মহানবী (সা.)–কে উপস্থাপন করার চেয়ে তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছে বেশি। ফিলিপ কে হিট্টি আরবি ভাষা ও সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত। তাঁর রচিত ‘ইসলাম অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট’ গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন ‘ইসলাম ইন ওয়েস্টার্ন লিটারেচার’। তিনি দেখিয়েছেন, ১৬৪৯ সালে সিউর ডিউ রায়ার কোরআনের ফারসি তরজমা প্রকাশ করেন। তার সঙ্গে মহানবী (সা.)–এর সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য যুক্ত করে Alcoran of Mahomet নামে প্রকাশ করেন। এই Mahomet হলো মুহাম্মদ (সা.)–এর বিকৃত রূপ। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে একই নামের ৪১টি রূপের সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর ১৭৩৬ সালে ভলতেয়ার ‘মাহোমেত’ নামে একটি পাঁচ অঙ্কের প্রহসন রচনা করেন; যার পুরো শিরোনাম: Le fanatisme, ou Mahomet le Prophete (ধর্মান্ধতা বা মাহোমেত নবী)। নাটকের মাহোমেত [মুহাম্মদ (সা.)] চরিত্রটি ধর্মান্ধ, যে তাঁর সমালোচকদের হত্যার আদেশ দেয় এবং ‘পালমিরা’ নামে এক মেয়ের প্রেমে মত্ত হয়। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সেন্ট হেলেনাতে বন্দী থাকাকালে এই নাটকের কঠোর সমালোচনা করেন। ভলতেয়ার তাঁর বক্তব্য পরিবর্তন করেন এবং বলেন, ‘তিনি [মুহাম্মদ (সা.)] অবশ্যই খুব মহান ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি মহান মানুষদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ছিলেন বিজয়ী বিধানদাতা, প্রজ্ঞাবান ও নেতা। সাধারণ মানুষের চোখে তিনি পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন।’
১৮৩০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের একজন পূর্বপুরুষ রেভারেন্ড জর্জ বুশ এ এম (১৭৯৬-১৮৫৯) লেখেন ‘The Life of Mohammed : Founder of the Religion of Islam and of the Empire of the Saracens’। কিসিঞ্জার লিগেছি রিপ্রিন্ট ১৮৩৩ সালে তা পুনঃপ্রকাশ করে এবং নতুন করে ২০০২ সালে লন্ডনে আবার ছাপা হয়। ১৮৪৩ সালে জার্মান প্রাচ্যবিদ গুস্তাফ ওয়েইল লেখেন ‘Mohammed der Prophet, sein Leben und seine Lehre’, ১৮৫১ সালে অস্ট্রিয়ান প্রাচ্যবিদ স্প্রেঙ্গার লেখেন ‘Aloys Sprenger, The Life of Mohammad, from Original Sources’, ১৮৫৮ সালে স্কটিশ লেখক উইলিয়াম মুর ৪ খণ্ডে লিখেছেন ‘The Life of Muhammad and History of Islam to the Era of the Hegira’। তবে ১৯৪৭ সালে আর ভি সি বোদলে লিখিত বিখ্যাত ‘The Messenger: the Life of Mohammed’ গ্রন্থটি বেশ প্রশংসা অর্জন করে, খ্যাতিমান স্কলার আলী নদভিসহ পরবর্তীকালের সিরাত গ্রন্থকারগণ এই গ্রন্থের রেফারেন্স ব্যবহার করেন। এমন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হলো উইলিয়াম মন্টোগোমেরি ওয়াট রচিত Muhammad at Mecca ও Muhammad at Medina.
উর্দু ভাষায় অমুসলিমদের রচনাবলির মধ্যে বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ হলো ইন্ডিয়া পত্রিকার সম্পাদক গুরু দত্ত সিং দারা (G S Dara) লিখিত ‘রসুলে আরাবি’, যা আবু তাহের মেছবাহ কর্তৃক ‘তোমাকে ভালোবাসি হে নবী’ শিরোনামে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আরেকটি হলো স্বামী লক্ষ্মণ প্রসাদ লিখিত ‘আরব কা চান্দ’। গ্রন্থটির ভূমিকায় লেখকের পরিচয়ে বলা হয়েছে, লেখক একজন হিন্দু সাহিত্যানুরাগী যুবক; সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বাইরে এসে সত্যপ্রিয়তায় প্রাণিত হয়ে শেষ নবীর জীবনী লিখেছেন। ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের ফতেহাবাদ জেলার তোহানায় থাকতেন তিনি। ১৯৩৯ সালে ২৬ বছর বয়সে মারা যান। গ্রন্থটি পরে পাকিস্তানের লাহোর থেকে প্রকাশিত হয়।
বাংলা ভাষায় লেখা নবীজীবনী: বাংলা ভাষায় যাঁরা মহানবী (সা.)–এর জীবনীগ্রন্থ লেখেন, তাঁদের বেশ কয়েকজনই ইসলামের অনুসারী নন, তবু ভক্তি ও ভালোবাসার অর্ঘ্য নিবেদনে তাঁরা মুসলিমদের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন না। যদিও ১৮০২ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে জনৈক লেখকের ‘মহম্মদের বিবরণ’ শিরোনামের একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, কিন্তু তা ছিল কুৎসায় ভরপুর। তবে বাংলায় প্রথম যাঁর পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ সামনে আসে, তিনি হলেন রেভারেন্ড জেমস লং। তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন একজন খ্রিষ্টান, পরে মুসলিম হন। ১৮৮৫ সালে তা কলকাতার সত্যার্ণব প্রকাশনী থেকে ‘মুহাম্মদের জীবনচরিত্র’ নামে প্রকাশিত হয়। একই বছর অতুল কৃষ্ণমিত্র লেখেন ‘ধর্মবীর মুহাম্মদ’ নামে একটি নাট্যজীবনী। ১৮৮৬ সালে কৃষ্ণ কুমার মিত্রের ‘মুহাম্মদ চরিত্র ও মুসলমান ধর্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ প্রকাশিত হয় শ্যামা প্রেস, কলকাতা থেকে এবং গিরিশ চন্দ্র সেন লেখেন ৩ খণ্ডে ‘মহাপুরুষ মুহাম্মদের জীবনচরিত’। এরপর ১৯০৪ সালে রামপ্রাণ গুপ্ত লিখেছেন ‘হজরত মুহাম্মদ ও হজরত আবু বকর’।
১৯৪২ সালে দ্য শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় ‘Aishah: the beloved of Mohammed’। এই গ্রন্থের লেখক নাবিয়া অ্যাবট ছিলেন আমেরিকার একজন প্যাপিওরোলজিস্ট ও পুস্তিকাবিদ। তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটে প্রথম মহিলা অধ্যাপক নির্বাচিত হন। আরবি লিপি ও ইসলামের প্রাচীনতম লিখিত দলিলগুলোর উত্থানের বিষয়ে তাঁর গবেষণার জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন।
বাংলা সাহিত্যে নবীজিকে নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন শেখ আবদুর রহীম (১৮৫৯-১৯৩১)। গ্রন্থটির নাম ‘হযরত মুহম্মদের স. জীবনচরিত ও ধর্মনীতি’, ১৮৮৭ সালে ৪০৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ সিরাতগ্রন্থ হলো কলকাতা থেকে ১৯০৮ সালে ডা. সৈয়দ আবুল হোসেন রচিত ‘মোসলেম পতাকা’, ১৯১৫ সালে কলকাতা থেকে শেখ মোহাম্মদ জমীর উদ্দীন রচিত ‘মাসুম মোস্তফা (সা.)’, ১৯২২ সালে কলকাতা থেকে এয়াকুব আলী চৌধুরী রচিত ‘মানব মুকুট’, ১৯২৫ সালে মোবিনুদ্দীন আহমদ জাহাঙ্গীর নগরী রচিত ‘নবীশ্রেষ্ঠ’, ১৯২৫ সালে কলকাতা থেকে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী রচিত ‘মরু ভাস্কর’, ১৯৪২ সালে চুঁচুড়া থেকে কবি গোলাম মোস্তফা রচিত ‘বিশ্বনবী’, ১৯৪৯ সালে ঢাকা থেকে খান বাহাদুর আবদুর রহমান খাঁ রচিত ‘শেষ নবী’, ১৯৫১ সালে ঢাকা থেকে মাওলানা আবদুল খালেক রচিত দুই খণ্ডের ‘ছাইয়েদুল মুরছালীন’, ঢাকা থেকে ১৯৬০ সালে মুহাম্মদ বরকতুল্লাহ রচিত ‘নবী গৃহ সংবাদ’, ১৯৬৮ সালে শায়খুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মদ তফাজ্জল হোসাইন রচিত ‘হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) সমকালীন পরিবেশ ও জীবন’। এ ছাড়া কবি আল মাহমুদ রচিত ‘মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’, কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা রচিত ‘মহানবী’ ও ২০০২ সালে প্রকাশিত কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ রচিত ‘বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’ অনন্য জীবনীগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষক নাসির হেলাল তাঁর গবেষণায় মধ্যযুগ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলায় রচিত মোট ১০২৮টি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন।
নারীদের সিরাত রচনা: মহানবী (সা.)–এর জীবনীগ্রন্থ রচনার কাজটি ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে পুরুষদের হাতেই পরিপুষ্ট হয়েছে। তবে আধুনিক সময়ে বেশ কয়েকজন নারীর লিখিত গ্রন্থ বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবার ওপরে থাকবেন ক্যারেন আর্মস্ট্রং। তিনি ইংল্যান্ডের ওয়ারসেস্টারশায়ারের উইল্ডমুরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬২ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ছিলেন গির্জার নান। ১৯৯১ সালে তাঁর ‘Muhammad: A Biography of the Prophet’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং বাংলা ভাষাসহ বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়। এই গ্রন্থে তিনি মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনের যেসব ঘটনা নিয়ে পশ্চিমাদের সমালোচনা ছিল, সেগুলোর যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে তাদের সমাজের উপমা উল্লেখ করেন। ২০০৬ সালে ‘Muhammad: A Prophet For Our Time’ নামে আরও একটি ননফিকশন গ্রন্থ প্রকাশ করেন।
তবে এর আগে ১৯৪২ সালে দ্য শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় ‘Aishah: the beloved of Mohammed’। এই গ্রন্থের লেখক নাবিয়া অ্যাবট ছিলেন আমেরিকার একজন প্যাপিওরোলজিস্ট ও পুস্তিকাবিদ। তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটে প্রথম মহিলা অধ্যাপক নির্বাচিত হন। আরবি লিপি ও ইসলামের প্রাচীনতম লিখিত দলিলগুলোর উত্থানের বিষয়ে তাঁর গবেষণার জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন। মুহাম্মদ (সা.)–এর সহধর্মিণী আয়েশা (রা.)–কে কেন্দ্র করে লেখা হলেও এটি মূলত একটি সিরাতগ্রন্থ, যাতে হিজরতের পূর্ব থেকে আয়েশা (রা.)–এর মৃত্যু পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসও সুনিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে। ১৯৮৫ সালে ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনা প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় প্রভাবশালী জার্মান প্রাচ্যবিদ অ্যানেমারি শিমেলের ৩৬৭ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ। শিরোনাম ‘And Muhammad Is His Messenger: The Veneration of the Prophet in Islamic Piety’। লেখক দীর্ঘদিন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। ২০১৩ সালে ব্রিটিশ লেখক লেসলি হাজলেটন (জন্ম ১৯৪৫) রচিত ‘The First Muslim: The Story of Muhammad’ নিউইয়র্ক টাইমস এডিটর্স বাছাইয়ে নির্বাচিত হয় এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০১৬ সালে ফরাসি লেখক হেলা ওয়ার্দি মহানবী (সা.)–এর জীবনের শেষের দিনগুলো নিয়ে রচনা করেন ‘Les Derniers Jours De Muhammad’ গ্রন্থটি, যা ইতিমধ্যে ‘মুহাম্মাদ ফি আইয়্যামিল আখিরাহ’ শিরোনামে আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
বাংলা ভাষায় নারী সিরাতগ্রন্থকারদের মধ্যে প্রথমে জায়গা করে নিয়েছেন সারা তাইফুর (জ. ১৮৯৩)। তাঁর লিখিত ‘স্বর্গের জ্যোতি’ গ্রন্থটি ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়। অবশ্য ১৩৭১ বাংলা সনে বাংলা একাডেমি এর একটি সংস্করণ প্রকাশ করে। তাঁর পুরো নাম হুরায়ুন্নিসা সারা খাতুন। কাব্যিক গদ্যে রচিত এ গ্রন্থের ভাষা সাবলীল।
বাংলা ভাষায় নারী সিরাতগ্রন্থকারদের মধ্যে প্রথমে জায়গা করে নিয়েছেন সারা তাইফুর (জ. ১৮৯৩)। তাঁর লিখিত ‘স্বর্গের জ্যোতি’ গ্রন্থটি ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়। অবশ্য ১৩৭১ বাংলা সনে বাংলা একাডেমি এর একটি সংস্করণ প্রকাশ করে। তাঁর পুরো নাম হুরায়ুন্নিসা সারা খাতুন। কাব্যিক গদ্যে রচিত এ গ্রন্থের ভাষা সাবলীল। লেখিকা অত্যন্ত দরদ দিয়ে গ্রন্থটি রচনা করেছেন। উল্লেখ্য, এ গ্রন্থ প্রকাশের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠি দিয়ে লেখিকাকে অভিনন্দিত করেছিলেন। এরপর খাদিজা আক্তার রেজায়ি লেখেন ‘তিনি চাঁদের চেয়েও সুন্দর’। তিনি ‘আর-রাহিকুল মাখতুম’র মতো কয়েকটি প্রাচীন ও মৌলিক সিরাতগ্রন্থ অনুবাদের জন্য বিখ্যাত হয়েছেন। ২০০৯ সালে মাসুদা সুলতানা রুমির সিরাতগ্রন্থ ‘আমি বারোমাস তোমায় ভালোবাসি’ প্রকাশিত হয় ঢাকার রিমঝিম প্রকাশনী থেকে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে প্রবাসী লেখিকা মাজিদা রিফার ‘মহানবী’ প্রকাশিত হয় রাহবার প্রকাশনী, ঢাকা থেকে। অসাধারণ গদ্যে রচিত তাঁর গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
সবিশেষ—হাজার বছর ধরে মহানবীর জীবনী রচনার যে অবিরল ধারা চলেছে, তা নিশ্চয় মহাকাল পর্যন্ত রুদ্ধ হওয়ার নয়। কবি যথার্থ বলেছেন, শব্দশিল্পী সকলকালের সকল দেশের সব ভাষার, আহরণ করে সকল মুক্তা মনের মাধুরী করে উজাড়, অনন্তকাল রচে যায় যদি বাণীর হার, তোমার স্তুতি তবুও হে নবী হবে না শেষ।
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে হতে পারে সারের সংকট
-
বিদেশ থেকে খালি হাতে ফিরে ড্রাগন চাষে সাফল্য
-
নাসিরনগরে বন্যায় তলিয়ে গেল কৃষকের বাদামখেত
-
পানি দিতে অতিরিক্ত টাকা
-
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
-
‘শিক্ষিত কৃষক’ বলেই তাঁকে নিয়ে মানুষের আগ্রহটা বেশি
-
ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বীজ কিনে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত
-
বোরো কাটতে বাড়তি খরচ ঃ হাসি নেই কৃষকের মুখে
-
পেঁয়াজের ক্ষতি পুষিয়ে দিচ্ছে সাথি ফসল বাঙ্গি
-
দেশের কৃষিতে নতুন সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে
দেশের আকাশে ১৪৪৩ হিজরি সালের পবিত্র রবিউস সানি মাসের চাঁদ দেখা গিয়েছে। ফলে রবিবার থেকে পবিত্র রবিউস সানি মাস গণনা করা হবে।
সেই হিসেবে দেশে আগামী ১১ রবিউস সানি ১৪৪৩ হিজরি (১৭ নভেম্বর, বুধবার) পবিত্র ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম পালিত হবে।
শনিবার ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এদিন সন্ধ্যায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পূর্ব সাহানে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী এনামুল হাসান।
সভায় সব জেলা প্রশাসন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়, বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে পবিত্র রবিউস সানি মাসের চাঁদ দেখার ব্যাপারে নিশ্চিত হয় চাঁদ দেখা কমিটি।
নামাজে থাকাকালীন কারও মনে সংশয় জাগে কত রাকাত হলো, রাকাত ভুলে ছুটে যায়নি তো? কিংবা নামাজের পরেও সন্দেহ জাগতে পারে রাকাত পূর্ণ হয়েছে নাকি হয়নি। নামাজের রাকাতসংখ্যায় সন্দেহ হলে কী করবেন- সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা:
নামাজ পড়ার সময়ে রাকাতসংখ্যা নিয়ে সন্দেহ হলে এবং এই সন্দেহ প্রথমবারের মতো হলে ওই নামাজ বাতিল হয়ে যাবে। নামাজ পুনরায় পড়া আবশ্যক। (ইবনে আবি শায়বা, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২৮)
নামাজের সালাম ফেরানোর পর যদি রাকাতসংখ্যা নিয়ে সন্দেহ হয়, তবে তার নামাজ বাতিল হয়ে যাবে। (ইবনে আবি শায়বা, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২৮)
কারও যদি নামাজের পর দৃঢ়বিশ্বাস হয় যে কিছু রাকাত পড়া হয়নি এবং যদি নামাজ পরিপন্থী কোনো কাজ না হয়ে থাকে, তাহলে ছুটে যাওয়া রাকাত পড়ে নেবে। যদি নামাজ পরিপন্থী কোনো কাজ হয়ে যায়, তাহলে ওই নামাজ পুনরায় পড়বে। (ইবনে আবি শায়বা, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২৪)
যে ব্যক্তির প্রায় সময় সন্দেহ হয় এবং সন্দেহ তার অভ্যাসে পরিণত হয়, তবে যেদিকে তার মন বেশি যায়, সেটার ওপর আমল করবে। যদি সব বিষয়ে ধারণা সমান হয়, তবে কমটির ওপর আমল করবে এবং প্রতি রাকাতকে নামাজের শেষ মনে করে বসবে এবং শেষে সিজদায়ে সাহু করবে। (মুসলিম, হাদিস: ৮৮৮)
তিন রাকাত পড়া হয়েছে নাকি চার রাকাত- সে ব্যাপারে সন্দেহ হলে তিন রাকাত মনে করে চতুর্থ রাকাত পড়বে। এরপর শেষে সিজদায়ে সাহু করবে। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৬৭৭)
প্রিয় নবির ঘর সুমহান আদর্শের কেন্দ্রবিন্দু। এ ঘর থেকে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তম আদর্শ, পরিপূর্ণ আদব, অতুলনীয় শিষ্টাচার ও স্বাধীন সমাজ ব্যবস্থা। নবিজীর যুগে এমন সমাজ ব্যবস্থা প্রবতির্তত হয়েছিল যে, পরিবারের সবাই সমভাবে কাজ করতেন। পুরুষরা স্ত্রীদের কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন। আর একটি সময় হলেই সবাই একত্রিত হতেন। তা ছিল নামাজের আজান। আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুহূর্তের মধ্যে সবাই কাজ রেখে নামাজ পড়তে মসজিদে একত্রিত হতেন।
স্বয়ং বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিবারিক কাজে সময় দিতেন। স্ত্রীদের কাজে সহযোগিতা করতেন। নামাজের আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ ছেড়ে দিতেন। হাদিসে পাকের একাধিক বর্ণনা থেকে প্রমাণিত যে-
১. হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ঘরে কী কী কাজ করতেন? তিনি উত্তর দেন-
كان بشرًا من البشر: يفلي ثوبه ويحلب شاته، ويخدم نفسه
‘তিনি একজন মানুষ ছিলেন, তিনি তাঁর কাপড় সেলাই করতেন, ছাগলের দুধ দহন করতেন এবং নিজের কাজ নিজেই করতেন।’ (মুসনাদে আহমাদ)
তিনি কি শুধু সাধারণ মানুষের মতো মানুষ ছিলেন? না তিনি ছিলেন চারিত্রিক মাদুর্য ও বিনয়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কোনো গুণেই কেউ তার সমকক্ষ ছিল না। তিনি যেমন বিনয়ী ছিলেন, তেমনি ছিলেন অহংকারমুক্ত মানুষ।
প্রিয় নবি কেমন মানুষ ছিলেন? তিনি কোনো দিন কাউকে কষ্ট দেননি। তিনি ছিলেন প্রতিটি কাজে অংশগ্রহণকারী সেরা মানুষ। অন্যকে সেরা সাহায্যকারী ও শ্রেষ্ঠ মানুষ। ইবাদত-বন্দেগি ও আল্লাহর হুকুম পালনে তিনি ছিলেন অনুকরণীয় আদর্শ। তাঁর প্রতি নাজিল হয়েছে এ আয়াত-
لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰهِ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰهَ وَ الۡیَوۡمَ الۡاٰخِرَ وَ ذَکَرَ اللّٰهَ کَثِیۡرًا
‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর (চরিত্রের) মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ২১)
আজান শোনার পর প্রিয় নবির সুন্নাত
কোরআনের ঘোষণার পরও তিনি আল্লাহর ইবাদাত ও তার অনুসরণ থেকে কখনো বিরত হতেন না। বরং মসজিদে আজান হওয়ার ধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তাতে সাড়া দিয়ে সব কাজ রেখে মসজিদে ছুটে যেতেন। হাদিসের বর্ণনায় এসেছে-
হজরত আসওয়াদ বিন ইয়াজিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাড়ীতে কি কি ধরনের কাজ করতেন? উত্তরে তিনি বললেন-
كان يكون في مهن أهله، فإذا سمع بالأذان خرج
‘তিনি তার পরিবারের সব কাজে নিয়োজিত থাকতেন, তবে আজান শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতেন।’ (বুখারি)
ফরজ নামাজ মসজিদে পড়ার গুরুত্ব
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে, তিনি বাড়িতে ফরজ নামাজ পড়েছেন। তবে তিনি মৃত্যুর আগ মুহূর্তে যখন প্রচণ্ড রোগাক্রান্ত; শোয়া থেকে উঠতে পারছিলেন না; যখন মসজিদে যেতে অপরাগ ছিলেন তখন বাড়িতে নামাজ আদায় করেছেন। কিন্তু তিনি দরজা দিয়ে মসজিদে নামাজ পড়ার দৃশ্য অস্রুসিক্ত নয়নে অবলোকন করতেন।
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের প্রতি খুবই দয়াশীল ছিলেন। কিন্তু নামাজের জামাতের অংশগ্রহণের ব্যাপারে তাঁর মতো এতো কঠোর দ্বিতীয় আর কেউ ছিল না। তিনি জামাতে অনুপস্থিত ব্যক্তিদের ব্যাপারে এভাবে কঠোর শাস্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে-
لقد هممت أن آمر بالصلاة فتقام ثم آمر رجلاً أن يصلي بالناس ثم أنطلق معي برجال معهم حزم من حطب إلى قوم لا يشهدون الصلاة فأحرق عليهم بيوتهم
‘আমার ইচ্ছা হয় যে, আমি কাউকে নামাজের ইমামতি করার আদেশ দেই আর আমি কাঠসহ কিছু লোককে সঙ্গে নিয়ে ঐ সব লোকদের বাড়িতে যাই; যারা জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়ার জন্য উপস্থিত হয়নি। এরপর তারাসহ তাদের বাড়ি-ঘরকে জালিয়ে দেই।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মসজিদে না গেলে নামাজ কবুল হবে না!
মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ পড়ার প্রতি ছিল নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ গুরুত্ব। শরিয়তের ওজর ছাড়া আজান শোনার পর মসজিদে না গেলে নামাজ কবুল হবে মর্মেও প্রিয় নবি ঘোষণা করেছেন-
من سمع النداء فلم يجب فلا صلاة له إلا من عذر، والعذر خوف أو مرض
‘শরিয়তের ওজর ব্যতিত যে ব্যক্তি আজান শোনার পর জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করলো না, তার নামাজ কবুল হবে না।’ (তিরমিজি) আর ওজর বলতে: শত্রুর ভয় অথবা রোগকে বুঝানো হয়েছে।
প্রিয় নবির যুগের সে দৃশ্য আজ কোথায়? কোথায় সেই নামাজি? মসজিদে আজান হয় ঠিকই কিন্তু মসজিদের কাতারপূর্ণ হয় না। অথচ বর্তমান সময়ে মসজিদে নামাজ পড়তে না যাওয়ার পেছনে নেই কোনো শরিয়তের ওজর। না কোনো শত্রুর ভয় কিংবা বিপদের ভয়।
মুমিন মুসলমান মাত্রই উচিত, আজান হলে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সোনালী যুগের মতো কাজ রেখে মসজিদে উপস্থিত হওয়া। একত্রে নামাজ আদায় করা। প্রিয় নবির প্রিয় সুন্নাতকে জাগ্রত করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের উপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মানসিক চাপ, বিষন্নতা ও জীবনের নানা কষ্ট থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর সাহায্যের বিকল্প নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের ঝুঁকির মুহূর্তে আল্লাহর নির্দেশে মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সময় চরম বিপদের মুহূর্তে প্রশান্তি স্বরূপ এ আয়াতটি নাজিল হয়। যা সত্যিই প্রশান্তির। এ আয়াতটি পড়লে এমনিতেই কঠিন বিপদে মিলে প্রশান্তি ও নিরাপত্তা। তাহলো-
رَّبِّ اَدۡخِلۡنِیۡ مُدۡخَلَ صِدۡقٍ وَّ اَخۡرِجۡنِیۡ مُخۡرَجَ صِدۡقٍ وَّ اجۡعَلۡ لِّیۡ مِنۡ لَّدُنۡکَ سُلۡطٰنًا نَّصِیۡرًا
উচ্চারণ : রাব্বি আদ্খিলনি মুদ্খালা সিদ্ক্বিও ওয়া আখরিঝ্নি মুখরাঝা সিদ্ক্বিও ওয়াঝ্আললি মিল্লাদুংকা সুলত্বানান নাছিরা।’
অর্থ : ‘হে আমার প্রভু! তুমি আমাকে কল্যাণসহ প্রবেশ করাও এবং কল্যাণসহ বের কর। আর তোমার কাছ থেকে আমাকে দান কর সাহায্যকারী শক্তি।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ৮০)
উল্লেখ্য, এ আয়াতটি প্রিয় নবির হিজরতের সময় নাজিল হয়েছিল। যখন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে বের হওয়ার এবং মদিনাতে প্রবেশ করার সময় উপস্থিত হয়েছিল।
কেউ কেউ বলেন, এ প্রার্থনামূলক আয়াতের মর্মার্থ হলো- সত্যের উপর আমার মৃত্যু দিও এবং সত্যের উপর আমাকে কেয়ামতের দিন উত্থিত করো।
আবার কেউ কেউ বলেন, সত্যতার সঙ্গে আমাকে কবরে প্রবিষ্ট করো এবং কেয়ামতের দিন সত্যতার সঙ্গে আমাকে কবর থেকে বের করো ইত্যাদি।
ইমাম শাওকানি বলেন, এ আয়াতটি যেহেতু দোয়া; বিধায় এর ব্যাপকতায় উল্লিখিত সব কথাই এসে যায়।
কেউ কেউ বলেন, যারা বিভিন্ন কষ্ট ভোগ করেন, তারাও এ দোয়াটি প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজের পর পড়তে পারেন। আশা করা যায়, এতে তার উল্লেখিত রোগ ও সমস্যাগুলো সমাধান হয়ে যাবে।
আবার কেউ কেউ বলেছেন, যদি কারো ডায়বেটিস রোগ হয়; তবে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম ও শৃঙ্ক্ষলাবদ্ধ জীবনের পাশাপাশি এ দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। এ রোগ থেকে মুক্ত থাকতে এটিকে কোরআনি আমল মনে করা হয়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বিভিন্ন রোগ মুক্তিতে কোরআনের এ আয়াতের আমলটি বেশি বেশি করার তাওফিক দান করুন। দুনিয়ার ও পরকালের সব বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
শিরকমুক্ত ঈমান এবং নেক আমল ছাড়া কেয়ামতের দিন মুক্তির বিকল্প নেই। কেয়ামতের ময়দানে সব মানুষ আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকবে। এমনকি নবি-রাসুলগণও আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকবেন। কারণ কেউ জানেন না আল্লাহ তাআলা সে দিন কার সঙ্গে কীরূপ ব্যবহার করবেন।
হাদিসের বর্ণনায় যদিও কেয়ামতের দিনের ভয়বাহতার বর্ণনা দিয়েছেন প্রিয়নবি। তিনি সেদিন সেজদায় থাকবেন। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাকে সেজদা থেকে উঠতে বলবেন। তিনি সেজদা থেকে মাথা উঠিয়ে বিচার কাজ শুরু করার জন্য সুপারিশ করবেন। তারপরই শুরু হবে পরকালের বিচারকার্য।
সেদিন যার আমলনামা ভালো হবে সে সফল হবে। শুধু মানুষ নয়, সেদিন নবি-রাসুলরা কতটা ভয়াবহ সময় কাটাবেন তা হাদিসের একটি বর্ণনা থেকেই সুস্পষ্ট-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যখন এ আয়াত নাজিল হয়-
وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ
(হে রাসুল!) আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন।’ (সুরা শুআরা : আয়াত ২১৪)
তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন-
> হে কুরাইশ দল! (তোমরা আল্লাহর একত্ববাদ ও ইবাদতের ধারায়) নিজেদের আত্মাকে প্রস্তুত কর। আমি আল্লাহর কাছে তোমাদের কোনো কাজে আসতে পারব না।
> হে বনি আবদে মানাফ! আমি আল্লাহর কাছে তোমাদের কোনো উপকার করতে পারব না।
> হে আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র আব্বাস! আমি আল্লাহর কাছে তোমার কোনো উপকার করতে পারব না।
> হে রাসুলের ফুফু সাফিয়্যাহ! আমি আল্লাহর কাছে আপনার কোনো কাজে আসব না।
> হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যা ফাতেমা! তুমি আমার সম্পদ থেকে যা ইচ্ছা চেয়ে নাও। আমি আল্লাহর কাছে তোমার কোনো কাজে আসব না।’ (বুখারি)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের করণীয়-
এ সতর্কবার্তা ঘোষণার পরপরই মহান আল্লাহ তাআলা পরবর্তী আয়াতে প্রিয়নবিকে অনুসরণ ও অনুকরণ করার যে ঘোষণাগুলো দিয়েছেন, সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা। আর তাহলো-
‘আর মুমিনদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করে, তাদের প্রতি তোমার বাহুকে অবনত কর। তারপর যদি তারা তোমার অবাধ্য হয়, তাহলে বল, তোমরা যা কর, নিশ্চয় আমি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আর তুমি মহাপরাক্রমশালী পরম দয়ালু (আল্লাহর) উপর তাওয়াক্কুল কর। যিনি তোমাকে দেখেন যখন তুমি (নামাজে) দণ্ডায়মান হও এবং সেজদাকারীদের মধ্যে তোমার ওঠা-বসা। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা মহাজ্ঞানী।’ (সুরা শুআরা : আয়াত ২১৫-২২০)
আল্লাহর একত্ববাদ ও ইবাদতে যদি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নিজ বংশধর, চাচা, ফুফু ও কন্যার ব্যাপারে এমন ঘোষণা দেন তবে অন্যান্য মুসলমান কিভাবে আল্লাহর নাফরমানি করে প্রিয়নবির শাফায়াত লাভের আশা করতে পারে!
কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা থেকে এ কথা প্রমাণিত যে, শিরক মুক্ত ঈমান ও নেক আমল ছাড়া কোনো আদম সন্তানই পরকালে মুক্তি পাবে না। যারাই প্রিয় নবির অনুসরণ ও অনুকরণ করবে তাদের মুক্তি হবে নিরাপদ ও সহজ।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, শিরকমুক্ত ঈমান ও নেক আমলে নিজেদের জীবন সাজানো। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবন পরিচালনা করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে শিরকমুক্ত ঈমান লাভ ও তার ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেদের নিয়োজিত করার তাওফিক দান করুন। হাশরের ময়দানে হাদিসে ঘোষিত সব ধরনের শাফায়াত লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন