দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের সর্ববৃহৎ উপাদান হলো দেশের কৃষি ব্যবস্থা। আর এ ক্ষেত্রে কৃষি ব্যবস্থাকে একের পর এক নতুন উদ্যমে গড়ে তুলতে কাজ করছেন দেশের অসংখ্য বিজ্ঞ কৃষিবিদ ও কৃষি বিজ্ঞানীগণ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, পাট গবেষণা কেন্দ্র, ধান গবেষণা কেন্দ্র, বিএডিসিসহ দেশের বেশ ক’টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এ সেক্টরের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও নতুন নতুন কলাকৌশল আবিষ্কার ও বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা অনেকটাই সেচ নির্ভরশীল। শুধুই ধানের আবাদ নয়; সব ফল-ফসলেই ক্ষেত্রমতে পানি সেচের প্রয়োজন হয়। সেচ সংকটের কারণে স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা তথা ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভয়াবহ সংকট দেখা দিলে দেশে চরম খাদ্য ঘাটতি সৃষ্টি হয়। এসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বিএডিসি (সেচ) স্থাপনের মাধ্যমে বিদেশ থেকে গভীর নলকূপ আমদানি করে সারাদেশের কৃষির মাঠে স্থাপন করেন। এরই মাধ্যমে বাংলাদেশের ফসলের মাঠে সেচ ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটে। পর্যায়ক্রমে সেচ ব্যবস্থার দেশে বিদ্যমান বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে।
ধান ও ফল-ফসল উৎপাদনের জন্য যেমন পরিমিত সেচ ব্যবস্থা প্রয়োজন, তেমনি জমির উর্বরতা বজায় রাখতেও পরিমিত সেচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেচের মাধ্যমে গভীর নলকূপ দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন অথবা খাল, বিল, নদী-নালার পানি উত্তোলন যেটাই করা হোক না কেন, এজন্য জ্বালানি হিসেবে তেল, মবিল, গ্যাস বা বিদ্যুতের প্রয়োজন। প্রয়োজনের বেশি পানি উঠাতে গেলে জ্বালানি ও বিদ্যুতেরও ব্যাপক অপচয় ঘটে। বাংলাদেশে আউশ, আমন, ইরি ও বোরো ধান আবাদের ক্ষেত্রে সেচ ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে বোরো ধান আবাদেই এখন দেশের খাদ্য চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করে। এজন্য দেশে ইরি-বোরো আবাদের মাত্রা ব্যাপক বেড়েছে। ইরি-বোরো আবাদের ক্ষেত্রে সেচ ব্যবস্থার জন্য ভূগর্ভস্থ বা নদী-খাল থেকে সেচের মাধ্যমে প্রয়োজনের বেশি পানি উঠালে ফসলের উৎপাদন কম হয় ও জমির উর্বরতাও হ্রাস পায়। তাছাড়া বিপুল পরিমাণ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খরচ করতে হয়। এজন্য বোরো আবাদের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের চরম ঘাটতির খবর পাওয়া যায়।
এসব কথা বিবেচনায় রেখে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট অলটারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ডায়িং পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। যাতে বোরো ধান চাষে ৪০ ভাগ পানি সাশ্রয় হবে এবং ২০ শতাংশ উৎপাদন বাড়বে। পরিমিত পরিমাণ সেচ ব্যবস্থার পদ্ধতি পূর্ব থেকেই কৃষক পর্যায়ে প্রচলিত ছিল। ধান ক্ষেতে পানি সাশ্রয়ের জন্য কৃষকদের উদ্ভাবিত একটি সনাতন পদ্ধতির নাম ‘পিঠ দেওয়া’ বা ফসলের মাঠ পর্যায়ক্রমে শুকানো ও সেচ দেওয়ার মাধ্যমে পানি সাশ্রয় করা। এতে ফসলের ফলন বাড়ে আর এ পদ্ধতির আধুনিক রূপায়ন বর্তমান উদ্ভাবিত পদ্ধতিটি। যা ন্যাশনাল এগ্রিকালচার টেকনোলজি প্রোগ্রাম ফেজ (এনএটিপি-২) প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এডব্লিউডি পানি সাশ্রয়ী সেচ প্রযুক্তি হচ্ছে, সেচে পানির অপচয় রোধে এটি একটি পরীক্ষিত ও কার্যকরী কৃষি প্রযুক্তি। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের লক্ষ্য হলো ধানচাষের জমিতে সব সময় পানি না রেখে পর্যায়ক্রমে জমি ভেজা ও শুষ্কপদ্ধতি অনুসরণ করা। আর এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশেষ কৌশল অবলম্বন করাই এ প্রযুক্তির কাজ। এটি একটি সহজ ও স্বল্প খরচে ব্যবহার উপযোগী প্রযুক্তি। যা ব্যবহারে পিভিসি পাইপ অথবা বাঁশের চোঙ্গা দ্বারা ছিদ্রযুক্ত পর্যবেক্ষণ নল তৈরি করতে হয়। নলের ব্যাস ৭-১০ সেন্টিমিটার এবং নলটি ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা হতে হয়। নলের নিচের দিকের ২০ সেন্টিমিটার ছিদ্রযুক্ত এবং উপরের দিকের ১০ সেন্টিমিটার ছিদ্রবিহীন থাকে। নলের গায়ে ১০ মিলিমিটার দূরে ৫ মিলিমিটার ব্যাসের ছিদ্র থাকে। এক সারি ছিদ্র থেকে আরেক সারি ছিদ্রের দূরত্ব হবে ১০ মিলিমিটার।
জমিতে নলটি এমনভাবে স্থাপন করতে হয়, যেন ছিদ্রযুক্ত ২০ সেন্টিমিটার অংশটুকু মাটিতে এবং ছিদ্রবিহীন ১০ সেন্টিমিটার অংশ মাটির উপরে থাকে। স্থাপনের সময় পাইপ বা নলটি দু’হাতে চাপ দিয়ে মাটিতে ঢোকাতে হয়, যাতে মাটির চাপ থাকে। তারপর পাইপের ভেতরের মাটি ভালোভাবে সরিয়ে ফেলতে হয়।
ধানের জমিতে চারা রোপণের ১৫ দিন পর্যন্ত ২-৪ সেন্টিমিটার দাঁড়ানো পানি রাখতে হয়, যাতে আগাছা কম জন্মে। চারা রোপণের ১৫ দিন পর জমিতে এডব্লিউডি পদ্ধতি অনুসরণ করে সেচ দিলে পানি অপচয় রোধ হয়। জমিতে সেচ দিয়ে নলের ভেতরে পানির মাত্রা পরিমাপ লক্ষ্য রাখতে হয়। ক্ষেতের দাঁড়ানো পানি শুকিয়ে পাইপের তলায় নেমে গেলে আবার সেচ দিতে হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতিতে সেচ দিতে হয়।
দেশে বোরো ধানের জমিতে পানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিস্তার ঘটানোর লক্ষ্যে কৃষকদের আগ্রহী করতে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিশীর্ষক প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্প পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি প্রদর্শনীর মাধ্যমে এডব্লিউডি প্রযুক্তিটি দেশের সব কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা চালাচ্ছে। কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় এবং কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে যেসব কৃষক তাদের বোরো আবাদে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ দিচ্ছেন, তাদের প্রায় ৩০% সেচ সাশ্রয় হচ্ছে বলে কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা মনে করছেন। বোরো আবাদে সেচ কম লাগায় কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
কৃষিবিদদের মতে, বিনা প্রয়োজনে জমিতে সেচ দেওয়ার কোনো দরকার নেই। বোরো ধানের জমিতে পানি ১৫ সেন্টিমিটারের নিচে চলে গেলে তবেই সেচ দেওয়ার প্রয়োজন হয়। এতে কয়েকদিন পরপর জমিতে অতিরিক্ত সেচ দিতে হয় না। এতে সেচ ব্যয় কমে এবং পানির সদ্ব্যবহার হয়। তাই এ প্রযুক্তি কৃষি উন্নয়নে আরও অগ্রগতি হবে বলে কৃষিবিদরা আশা করেন। এতে কৃষক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ধান চাষের জন্য অনবরত দাঁড়ানো পানি রাখার প্রয়োজন নেই; বরং সেচ দেওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শুকিয়ে আবার সেচ দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। এ পদ্ধতিতে ক্ষেতে আগাছাও কম হয়। আশা করা যায়, প্রযুক্তিটির ব্যবহার প্রচলন বৃদ্ধি পেলে দেশের কৃষকরা কৃষিতে তথা ফসল উৎপাদনে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবেন।
মিরাজুল ইসলাম (৩৩)। ১০ বছর সৌদি আরবে ছিলেন। আকামা জটিলতায় খালি হাতে দেশে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এক বছর বেকার থাকার পর ইউটিউবে পতিত জমিতে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখেন। বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে নেমে পড়েন ড্রাগন চাষে। দেড় বছরের ব্যবধানে এখন উপজেলার সবচেয়ে বড় ড্রাগন বাগান তাঁর। এ বছর খরচ বাদে আট থেকে নয় লাখ টাকা লাভের আশা করছেন তিনি।
পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার ইন্দুরকানি গ্রামের বাসিন্দা মিরাজুল। উপজেলার টগরা গ্রামে দেড় একর জমিতে তিনি ড্রাগনের বাগান তৈরি করেছেন। তাঁর বাগানে এখন সাড়ে তিন হাজার ড্রাগন ফলের গাছ আছে।
মিরাজুল ইসলাম বলেন, শ্রমিক হিসেবে ১০ বছর সৌদিতে কাজ করে ২০১৯ সালে দেশে ফেরেন তিনি। আকামা সমস্যার কারণে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কিছু একটা করবেন বলে ভাবছিলেন। একদিন ইউটিউবে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখতে পান। সেই থেকে ড্রাগন চাষে আগ্রহ জন্মে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দেড় একর পতিত জমি ড্রাগন চাষের উপযোগী করেন। গাজীপুর থেকে ৬০ টাকা দরে ৬০০ চারা নিয়ে আসেন। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে শুরু করেন চাষাবাদ। পরের বছর জুনে ফল পাওয়া শুরু করেন।
ড্রাগনের বাগান করতে মিরাজুলের খরচ হয়েছিল ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। ইতিমধ্যে ফল বিক্রি করে তাঁর খরচ উঠে গেছে। সাধারণত মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গাছে ফল আসে। বছরে ছয় থেকে সাতবার পাকা ড্রাগন সংগ্রহ করা যায়। এখন পরিপক্ব ও রোগমুক্ত গাছের শাখা কেটে নিজেই চারা তৈরি করেন। ড্রাগন চাষের পাশাপাশি বাগানে চুইঝাল, এলাচ, চায়না লেবুসহ মৌসুমি সবজি চাষ করেন। এ ছাড়া ড্রাগনের চারাও উৎপাদন করে বিক্রি করেন তিনি।
মিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাগানের বেশির ভাগ গাছে এ বছর ফল ধরেছে। গত মঙ্গলবার বাগান থেকে দেড় টন ফল সংগ্রহ করেছেন। ২৫০ টাকা কেজি দরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছেন। স্থানীয় বাজারে ৩০০ টাকা কেজি দরে ড্রাগন বিক্রি হয়। নভেম্বর পর্যন্ত আরও পাঁচ–ছয়বার বাগান থেকে ফল তোলা যাবে। আশা করছেন, খরচ বাদে এবার আট থেকে নয় লাখ টাকা লাভ থাকবে।
মিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমার বাগান থেকে চারা নিয়ে অনেকে বাড়িতে ও ছাদে ছোট পরিসরে ড্রাগনের বাগান করেছেন। আমি এ পর্যন্ত ৪০ টাকায় দেড় হাজার চারা বিক্রি করেছি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পূর্ণ বয়সের একটি ড্রাগনের চারা রোপণের পর ২৫ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। এর মৃত্যুঝুঁকি নেই বললেই চলে। তবে কয়েক দিন পরপর সেচ দিতে হয়। বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হয়। ড্রাগন ফল চাষে রাসায়নিক সার দিতে হয় না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইশরাতুন্নেছা বলেন, মিরাজুল ইসলামকে ড্রাগন চাষে নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে আসছে কৃষি বিভাগ। উপজেলায় তাঁর বাগানটি সবচেয়ে বড়। তিনি নিরলস পরিশ্রম করে ছোট থেকে বাগানটি বড় করেছেন।
ডাচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে দুই দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।
গতকাল সোমবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অনুষ্ঠিত কৃষি খাতের ব্যবসাবিষয়ক এক সম্মেলনে দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এগ্রি বিজনেস কনক্লেভে বাংলাদেশের প্রায় ৪০জন উদ্যোক্তা ডাচ কৃষি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি প্রযুক্তি সহযোগিতা ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছে ওয়েগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়।
আলোচনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তি কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি সহযোগিতা দিতে রাজি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে ডাচরা প্রস্তুত এবং বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও তাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া ডাচ সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বীজ, পশু খাদ্য, পোলট্রি, হর্টিকালচার ও এ্যাকুয়াকালচার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করেছে, যা ওই দেশের বেসরকারি খাতকে আরও উৎসাহিত করেছে।
আলোচনায় কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তৈরি আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্কয়ার, ইস্পাহানি এগ্রো, একে খান অ্যান্ড কোম্পানি, প্যারাগন গ্রুপ, এসিআই, জেমকন গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ডাচ প্রযুক্তির প্রয়োগ সরেজমিনে দেখতে যাবেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের পোল্ট্রিখাতে সহযোগিতার আলোচনা অনেকটা এগিয়েছে উল্লেখ করে মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দুই দেশের মধ্যে মৎস্য, পশুপালন ও হর্টিকালচারে সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা আছে।
কনক্লেভ আয়োজনে প্রথমবারের মতো দূতাবাসের সঙ্গে অংশীদার হয়েছে নেদারল্যান্ডসের কৃষি মন্ত্রণালয়, নেদারল্যান্ডস এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি, নেদারল্যান্ডস ফুড পার্টনারশিপ, ডাচ-গ্রিন-হাইজডেল্টা, লারিভ ইন্টারন্যাশনাল, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ।
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী নেদারল্যান্ডসের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কম। ২০২১-এ কৃষিপণ্য ও খাদ্য রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে।
পাবনার বেড়া উপজেলার বড়শিলা গ্রামের কৃষক সাইদুল ইসলাম তাঁর দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করে এবার প্রায় ৪০ হাজার টাকা লোকসান দিয়েছেন। অথচ পেঁয়াজের জমিতেই সাথি ফসল হিসেবে লাগানো বাঙ্গি থেকে তিনি ৫০ হাজার টাকার মতো লাভ করবেন বলে আশা করছেন। এই বাঙ্গি আবাদে তাঁর কোনো খরচ হয়নি। ফলে পেঁয়াজ আবাদের ক্ষতি পুষিয়ে যাচ্ছে।
সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘বাঙ্গি আবাদ কইর্যা যে টাকা পাইল্যাম তা হলো আমাগরে ঈদের বোনাস। পেঁয়াজের দাম না পাওয়ায় আমরা (কৃষকেরা) যে ক্ষতির মধ্যে পড়িছিল্যাম, বাঙ্গিতে তা পুষায়া গেছে। এই কয়েক দিনে ১২ হাজার টাকার বাঙ্গি বেচছি। সব মিলায়া ৫০ হাজার টাকার বাঙ্গি বেচার আশা করতেছি।’
সাইদুল ইসলামের মতো পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার অনেক কৃষক এবার পেঁয়াজের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে বাঙ্গির আবাদ করেন। কৃষকেরা পেঁয়াজ আবাদ করতে গিয়ে বিঘায় প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ করেছিলেন। সেই হিসাবে প্রতি মণ পেঁয়াজ উৎপাদনে তাঁদের খরচ হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকার বেশি। কিন্তু বাজারে সেই পেঁয়াজ কৃষকেরা বিক্রি করতে পেরেছেন প্রতি মণ ৬০০ থেকে ৮৫০ টাকায়। এতে প্রতি বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদে কৃষকদের এবার ২০ হাজার টাকার বেশি লোকসান হয়েছে।
কৃষকেরা বলেন, পেঁয়াজের জমিতে সাথি ফসল হিসেবে বাঙ্গি, মিষ্টিকুমড়া, কাঁচা মরিচসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। জমিতে পেঁয়াজ লাগানোর পর তা কিছুটা বড় হলে এর ফাঁকে ফাঁকে এসব সাথি ফসল লাগানো হয়। পেঁয়াজের জন্য যে সার, কীটনাশক, সেচ দেওয়া হয়, তা থেকেই সাথি ফসলের সব চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। ফলে সাথি ফসলের জন্য বাড়তি কোনো খরচ হয় না।
কৃষকেরা বলেন, বাঙ্গিতেই কৃষকের লাভ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। রমজান মাস হওয়ায় এখন বাঙ্গির চাহিদা ও দাম দুই-ই বেশি।
সাঁথিয়ার শহীদনগর গ্রামের কৃষক আজমত আলী জানান, তাঁর জমিসহ এই এলাকার জমি থেকে ৮ থেকে ১০ দিন হলো বাঙ্গি উঠতে শুরু করেছে। এবার বাঙ্গির ফলনও হয়েছে বেশ ভালো। বাজারে এসব বাঙ্গি আকারভেদে প্রতিটি ৬০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এমন দাম থাকলে এক বিঘা থেকে প্রায় ৩০ হাজার টাকার বাঙ্গি বিক্রি হবে।
সাঁথিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার গোস্বামী বলেন, পেঁয়াজের সঙ্গে সাথি ফসলের আবাদ কৃষকদের মধ্যে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ ব্যাপারে তাঁরাও কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
জাতীয় ফল কাঁঠালের জ্যাম, চাটনি ও চিপস উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) শস্য সংগ্রহের প্রযুক্তি বিভাগের একদল গবেষক। তাঁরা কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত করে মোট ১২টি প্যাকেট ও বোতলজাত পণ্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
গত শনিবার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ক্যাম্পাসে অবস্থিত বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিনা) ‘কাঁঠালের সংগ্রহত্তোর ক্ষতি প্রশমন ও বাজারজাতকরণ কৌশল’ শীর্ষক কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এসব তথ্য জানান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) অর্থায়নে এবং নিউভিশন সলিউশন্স লিমিটেডের সহযোগিতায় গবেষণা প্রকল্পটি পরিচালিত হয়।
কর্মশালায় ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী বলেন, ‘এই প্রকল্পের আওতায় আমরা কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাত করে মুখরোচক ১২টি প্যাকেট ও বোতলজাত পণ্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এসব পণ্য উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। কাঁঠালের জ্যাম, আচার, চাটনি, চিপস, কাটলেট, আইসক্রিম, দই, ভর্তা, কাঁঠাল স্বত্ব, রেডি টু কুক কাঁঠাল, ফ্রেশ কাট পণ্যসহ আরও বিভিন্ন ধরনের প্যাকেটজাত পণ্য তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। প্রক্রিয়াজাত পণ্যগুলো ঘরে রেখে সারা বছর খাওয়া যাবে। কাঁঠাল থেকে এসব পণ্য উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা কমানো সম্ভব বলে মনে করছেন গবেষক।’
কর্মশালায় নিউভিশন সলিউশন্স লিমিটেডের মুখ্য পরিদর্শক তারেক রাফি ভূঁইয়া বলেন, উদ্ভাবিত পণ্যগুলো বাজারজাত করার জন্য নিউভিশন কোম্পানি বিএআরআইয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ময়মনসিংহসহ বাংলাদেশের কয়েকটি জেলা ও উপজেলা শহরে পণ্যগুলো বিপণনের কাজ চলছে।
কর্মশালায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিভাগের বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. হাফিজুল হক খানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম। সম্মানিত অতিথি ছিলেন কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের সিনিয়র স্পেশালিস্ট (ফিল্ড ক্রপস) ড. নরেশ চন্দ্র দেব বর্মা। বিশেষ অতিথি ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আবু হানিফ। উপস্থিত ছিলেন নিউভিশন সলিউশন্স লিমিটেডের প্রকল্প ম্যানেজার কায়সার আলম।
সার ব্যবস্থাপনা: প্রতি গর্তে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া সার, ১০০ গ্রাম টিএসপি সার ও এমওপি সার ১০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হয়।
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা: চারা গাছের গোড়ায় মাঝে মাঝে পানি সেচ দিতে হবে। বর্ষাকালে গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেজন্য পানি নিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া কমলা গাছের আগাছা দমন করতে হবে।
ফসল তোলা: মধ্য কার্তিক থেকে মধ্য পৌষ মাসে ফল সংগ্রহ করতে হয়।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন