কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে সবার দৃষ্টি কেড়েছে ৩২ মণ ওজনের ‘চাঁপাই সম্রাট’। চলন বলন এবং আয়েশি খাবার খাওয়ার জন্যই তার এমন নাম। ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির উচ্চতার গরুটি দেখতেও বেশ মোটাতাজা।
উপজেলার শাহবাজপুর ইউপি সদস্য জুলফিকার আলী এই বৃহদাকার গরুটির মালিক। জেলার সবচেয়ে সুদর্শন ও বড় হিসেবে আলোচিত গরুটি দেখতে প্রতিদিন তার বাড়িতে ভিড় করছেন উৎসুক জনতা। দূর-দূরান্ত থেকে আসছেন ক্রেতারাও। মালিক দাম হাঁকছেন ৩০ লাখ টাকা।
সম্রাটকে দেখতে আসা কয়েকজন বলেন, আমরা এত বড় কোরবানির গরু এর আগে কখনো দেখিনি। বৃহদাকার হওয়ায় গরুটি এলাকায় বেশ আলোচিত। আশপাশের সব গ্রাম থেকে মানুষ দেখতে আসছে।
ইউপি সদস্য জুলফিকার আলী বলেন, ‘১৫ বছর ধরে গরুর খামার করি। বর্তমানে আমার খামারে চারটি গরু আছে। সব গরুই বিক্রিযোগ্য। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় চাঁপাই সম্রাট। আমার খামারে একটি অস্ট্রেলিয়ান জাতের একটি গাভী ছিল। তার গর্ভে চার বছর আগে জন্ম হয় এই গরুটির। ছোট থেকেই বেশ ভালো খাবার আর প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হওয়ায় সে খুবই শান্ত স্বভাবের। এ ধরনের গরু জেলায় আর একটিও দেখিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘গরুটিকে মোটাতাজা করতে বিশেষ কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়নি। স্বাভাবিকভাবে খড়, ভুসি, গম, খৈল, কলা ও ঘাস খেয়ে থাকে। এছাড়া প্রতিদিন লালি ও খৈল দিয়ে ছানা তৈরি করে খেতে দেয়া হয় গরুটিকে। বাসি খাবার খায় না। সব সময় আরাম আয়েশে থাকতে পছন্দ করে। জুন মাসের শেষের দিক থেকেই গরুর পাইকাররা আসছেন চাঁপাই সম্রাটের খোঁজে। তারাও গরুটিকে দেখে বেশ আনন্দ পাচ্ছেন। কিন্তু আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় তাকে বিক্রি করছি না।’
জুলফিকার আলী বলেন, ‘তবে লকডাউনে একটু চিন্তায় আছি। যদি ঈদের আগে সব পশুর হাট খুলে দেয়া হয়, তবে ঢাকার কোনো এক হাটে গরুটিকে বিক্রি করব।’
শিবগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রণজিৎ চন্দ্র সিংহ বলেন, ‘শিবগঞ্জ উপজেলায় প্রতি বছরই ঈদকে সামনে রেখে খামারিরা পশু মোটাতাজা করে থাকেন। এছাড়া প্রতি বছরই অনেকেই বেশি ওজনের ষাঁড় গরু লালনপালন করে আলোচিত হয়ে আসছে। তবে চাঁপাই সম্রাটের তথ্য আমাকে এখন পর্যন্ত কেউ দেননি।’
ডাচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে দুই দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।
গতকাল সোমবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অনুষ্ঠিত কৃষি খাতের ব্যবসাবিষয়ক এক সম্মেলনে দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এগ্রি বিজনেস কনক্লেভে বাংলাদেশের প্রায় ৪০জন উদ্যোক্তা ডাচ কৃষি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি প্রযুক্তি সহযোগিতা ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছে ওয়েগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়।
আলোচনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তি কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি সহযোগিতা দিতে রাজি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে ডাচরা প্রস্তুত এবং বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও তাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া ডাচ সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বীজ, পশু খাদ্য, পোলট্রি, হর্টিকালচার ও এ্যাকুয়াকালচার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করেছে, যা ওই দেশের বেসরকারি খাতকে আরও উৎসাহিত করেছে।
আলোচনায় কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তৈরি আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্কয়ার, ইস্পাহানি এগ্রো, একে খান অ্যান্ড কোম্পানি, প্যারাগন গ্রুপ, এসিআই, জেমকন গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ডাচ প্রযুক্তির প্রয়োগ সরেজমিনে দেখতে যাবেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের পোল্ট্রিখাতে সহযোগিতার আলোচনা অনেকটা এগিয়েছে উল্লেখ করে মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দুই দেশের মধ্যে মৎস্য, পশুপালন ও হর্টিকালচারে সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা আছে।
কনক্লেভ আয়োজনে প্রথমবারের মতো দূতাবাসের সঙ্গে অংশীদার হয়েছে নেদারল্যান্ডসের কৃষি মন্ত্রণালয়, নেদারল্যান্ডস এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি, নেদারল্যান্ডস ফুড পার্টনারশিপ, ডাচ-গ্রিন-হাইজডেল্টা, লারিভ ইন্টারন্যাশনাল, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ।
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী নেদারল্যান্ডসের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কম। ২০২১-এ কৃষিপণ্য ও খাদ্য রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে।
রামের বাজারে প্লাস্টিকের টুলে বসে কচুর লতি বিক্রি করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবু বকর সিদ্দিক (প্রিন্স)। তাঁর এই ছবি একজন ফেসবুকে পোস্ট করলে তা ভাইরাল হয়েছিল। তাঁকে নিয়ে আলোচনা–সমালোচনায় যোগ দিয়েছিলেন বহু মানুষ। তবে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয় বলে জানালেন বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ কাউন্সিলের পরিচালনা পর্ষদের এই সদস্য।
নিজের বৌভাতের জন্য জমানো এক লাখ টাকা দিয়ে ২০০৬ সালে শ্বশুরবাড়ির এলাকা ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নে খামারের জন্য জমি কিনেছিলেন। পরে ধারদেনাসহ নানাভাবে অর্থ সংগ্রহ করে ২০১৪ সালে সেখানে ‘কৃষাণ সমন্বিত কৃষি উদ্যোগ’ নামে খামার চালু করেন তিনি। এই কাজ করতে গিয়ে বর্তমানে ব্যাংক এবং বিভিন্ন এনজিও থেকে নেওয়া তাঁর ঋণের পরিমাণ ২৫ লাখ টাকার মতো।
আবু বকরের কৃষিকাজের জন্য মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৮ একর। এর মধ্যে ৩ একর দীর্ঘ মেয়াদে ইজারা নেওয়া। বিভিন্ন জাতের ছয় হাজার ড্রাগনগাছ রয়েছে তাঁর খামারে। নয়জন স্থায়ী শ্রমিকের পাশাপাশি সেখানে কাজ করছেন অনেক অস্থায়ী শ্রমিক। আবু বকর সিদ্দিক তাঁর নামের আগে ডক্টরেট বা শিক্ষক এসবের চেয়ে ‘শিক্ষিত কৃষক’ বলতেই বেশি পছন্দ করেন। ড্রাগন চাষের জন্য এলাকাবাসীর পক্ষ থেকেই পেয়েছেন ‘ড্রাগন প্রিন্স’ উপাধি।
কৃষি–অন্তঃপ্রাণ আবু বকর সিদ্দিকের ফেসবুকের বেশির ভাগ পোস্টই কৃষিসংক্রান্ত। কালবৈশাখীর তাণ্ডবের পর গত শনিবার ভোরে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘কেমনে সম্ভব এইভাবে কৃষিকাজ করা?’
ওই ঝড়ের আগের দিন শুক্রবার মুঠোফোনে কথা হয় আবু বকরের সঙ্গে। ছবি ভাইরাল হওয়া প্রসঙ্গে হাসতে হাসতেই বলেন, ‘আমি তো আর আজ নতুন করে কাজ করছি না। এর আগেও বিভিন্ন সময় আমার কাজ ও ছবি নিয়ে ফেসবুকে আলোচনা হয়েছে। ২০১৬ সালেও একবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে ড্রাগন ফল বিক্রি করার সময় এমন আলোচনা হয়েছে।’
১৪ মে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নে বাবুলের বাজারে প্লাস্টিকের একটি টুলে বসে নিজের খামারে উৎপাদিত কচুর লতি বিক্রি করছিলেন আবু বকর সিদ্দিক। সেই ছবি তুলেছিলেন বেশ কয়েকজন। তাঁদেরই একজন ছবিটি ফেসবুকে দেন। এর দুই ঘণ্টা পর আবু বকর যখন ফেসবুকে ঢুকলেন, তখন দেখেন, তাঁকে ঘিরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
আবু বকর জানান, কচুর লতি বিক্রির ঘটনার দিন খামারের শ্রমিকদের খাবারের জন্য বাজার করার কথা ছিল। সেই সময় হাতে বাজার করার মতো টাকা ছিল না। যে লোকের কচুর লতি বিক্রি করতে যাওয়ার কথা ছিল, তখন তিনি উপস্থিত ছিলেন না। তাই আবু বকর নিজেই স্থানীয় বাজারে তা বিক্রি করার জন্য যান।
তিনি বলেন, ‘আমি বসে থাকলে তো আর কেউ লতি বিক্রি করে দিত না। আমার প্রয়োজনেই আমাকে আমার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে হয়েছে। ৫০ টাকা কেজি দরে ১৬ কেজি লতি বিক্রি করে বাজার করে ফিরেছি। কৃষকের জন্য যা স্বাভাবিক কাজ, শিক্ষিত বা নামের আগে ডক্টরেট থাকায় তা যখন আমি করতে গিয়েছি, তখন মানুষের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।’
আবু বকরের পৈতৃক বাড়ি ঝালকাঠি। বাবার চাকরি সূত্রে থেকেছেন ঢাকায়। বাবা মারা যাওয়ার আগে গাজীপুরে জমি কিনে বাড়ি করেছেন। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার হাতিলেইট গ্রামে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ির এলাকাতেই খামার গড়েছেন। আবু বকর ফুলবাড়িয়া ও ঢাকা—দুই জায়গায় যাতায়াতের মধ্যে থাকেন।
আবু বকরের বাবা ছিলেন সেনা কর্মকর্তা। তিনি বললেন, ‘চাচা–মামারাও কৃষির সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন, তাঁরা চাকরি, না হয় ব্যবসা করছেন। বলতে গেলে আমিই প্রথম কৃষিকাজ বেছে নিয়েছি। এ নিয়ে শুরুতে ঝামেলাও পোহাতে হয়েছে। তবে এখন পরিবারের সদস্যরা, বিশেষ করে ঢাকার উত্তরায় থাকা স্ত্রী মাকসুদা রুমি ও তিন ছেলেমেয়ে এখন আর কোনো আপত্তি করে না।’
এখন খামারের আয় থেকেই ঋণের কিস্তি পরিশোধের পাশাপাশি ঢাকায় ভালো স্কুলে ছেলেমেয়েদের পড়ানোসহ সংসারের অন্যান্য খরচ বেশ ভালোভাবেই মেটাতে পারছেন বলে জানান আবু বকর। গত বছর বরিশালের ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটিতে সহকারী অধ্যাপক ও মার্কেটিং বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। তবে এখানেও তাঁর কৃষি ও খামার প্রাধান্য পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির মালিকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার সুবাদে শুরুতেই বলে নিয়েছেন খামারে যে ছয় মাস কাজ বেশি থাকবে, সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে (দুই সেমিস্টার) তিনি ক্লাস নেবেন না। আবু বকর জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সম্মানী ভাতা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণ তহবিলে জমা দিয়ে দেন।
আবু বকর বললেন, কৃষিকাজ পুরোপুরি বিজ্ঞাননির্ভর। কৃষিতে সফল হতে হলে বুদ্ধি ও পরিশ্রম—এ দুটোকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
২০০২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ব্যবস্থাপনায় এমএ করেছেন আবু বকর। ২০০৮ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ থেকে কৃষি ব্যবসায় এমবিএ করেন। ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল, ২০১৮ সালে কৃষি সাপ্লাই চেইন এবং বাজারজাতকরণ বিষয়ে পিএইচডি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে। তাঁর মতে, কৃষক শিক্ষিত হলে অসুবিধার চেয়ে সুবিধাই বেশি।
তবে ওই শিক্ষিত কৃষককে লজ্জাটা ঝেড়ে ফেলতে হবে। কৃষিতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এগোতে হয়। তাঁর মতে, এই পরিকল্পনাই হলো আধুনিক টেকসই কৃষির মূলমন্ত্র।
আবু বকর জানালেন, গত বছর বিভিন্ন জাতের ধান, মাছ, গরুর মাংস, আম, ড্রাগন, মাল্টা, লটকন, লেবু, আনারসসহ প্রায় ২০০ টন কৃষিপণ্য বিক্রি করেছেন। আয় হয়েছিল ৫২ লাখ টাকা। এর বাইরে জৈব সার বিক্রি এবং খামারের মধ্যে ১২ শতাংশ জমিতে নিজস্ব নার্সারি থেকে ফলের গাছ বিক্রি হয়েছিল পাঁচ লাখ টাকার মতো। তবে আবহাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন জটিলতায় আগের তুলনায় কৃষির উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় বছরটিতে খামারের মোট খরচ ছিল ৪৭ লাখ টাকা। আস্তে আস্তে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা গেলে লাভের পরিমাণ বাড়বে বলেই আশাবাদী এ কৃষক।
পুরো খামারের কৃষি উৎপাদনে ৮০ শতাংশই জৈব সার ব্যবহার করছেন, আর এ সার নিজেই তৈরি করছেন। তাঁর সহজ স্বীকারোক্তি, ‘প্রথমে শতভাগ জৈব সার দিয়েই উৎপাদন শুরু করেছিলাম। কিন্তু এতে করে গাছগুলো ঠিকভাবে পুষ্টি পাচ্ছিল না। তাই সহনীয় মাত্রায় রাসায়নিক ও জৈব সারের সমন্বয়ে সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে। তবে সব পুষ্টিমান ঠিক রেখে কীভাবে শুধু জৈব সার দিয়ে উৎপাদন করা যায়, তার গবেষণা নিজেই করছি।’ তিনি জানালেন, তাঁর ছোট একটা গবেষণাগারে চারটি জৈব জীবাণু কালচার করছেন। ২০টির বেশি উপাদান দিয়ে উন্নত জৈব সার বানানোর নানা পরীক্ষা চালাচ্ছেন।
আবু বকরের আফসোস, কৃষিকাজে আগে থেকেই অভিজ্ঞতা থাকলে তাঁর সময় কম নষ্ট হতো। এখন তাঁকে ঠেকে ঠেকে শিখতে হচ্ছে। আর এই শিখতে আর বুঝতে গিয়েই তাঁর অতিরিক্ত সময় নষ্ট হচ্ছে, টাকা খরচ হচ্ছে। এমবিএ করার পর ভারতের পাঞ্জাবে ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম করার সুযোগ পেয়েছিলেন আবু বকর। তখন সেখানকার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশেষজ্ঞ-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপের সূত্রে কৃষির প্রতি আগ্রহটা বাড়ে। দেশের বিভিন্ন জেলায় ২০০টি বাণিজ্যিক বাগানের ২০০ জন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করেছেন আবু বকর। এই উদ্যোক্তারা আবু বকরের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন, তাঁর কাছ থেকে চারা নিচ্ছেন। আবু বকরের ভাষায়, এই বাগানমালিকদের অনেকেই তাঁর চেয়ে ভালো অবস্থানে পৌঁছে গেছেন। এই নতুন উদ্যোক্তা তৈরির বিষয়টিতেই তিনি বেশি তৃপ্তি পান।
নতুন কৃষি উদ্যোক্তার জন্য স্বল্প পুঁজির বিষয়টি অনেক বড় প্রতিবন্ধকতা বলে উল্লেখ করলেন আবু বকর।
তিনি জানান, শুরুতে কারও কাছে ২০০ টাকা চাইলেও পাওয়া যেত না। আর এখন ওই ব্যক্তিদের কাছে ১০ হাজার টাকা চাইলেও মুহূর্তের মধ্যে দিয়ে দিচ্ছেন। এ পর্যায়ে আসতে তাঁকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। নিজের আরাম–আয়েশ বাদ দিতে হয়েছে। পরিবারের জন্য বরাদ্দ করা সময়টুকু খামারের পেছনে দিতে হয়েছে।
উত্তরার বাসার বাজারের চেয়ে খামারের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে হয়েছে। ১৫ বছর বয়সী মেয়ে মুনিবা সিদ্দিক, ১১ বছর বয়সী ছেলে ইয়াফি আবদুল্লাহ সিদ্দিক আর ৫ বছরের ছেলে আদিব আবদুল্লাহকে সামলাচ্ছেন স্ত্রী মাকসুদা।
আবু বকর বললেন, তাঁর ইচ্ছা আছে, ভবিষ্যতে উৎপাদিত পণ্যের লাভের অংশ থেকে একটি তহবিল গঠন করবেন, যা থেকে নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা করা হবে।
তিনি বলেন, কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পান না বলেই অনিশ্চিত কাজে নিজের সন্তানদের তাঁরা কৃষি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চান।
আবু বকর জানালেন, গ্রাম্য রাজনীতি মোকাবিলা করেই তাঁকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হচ্ছে। গ্রামের অনেকেই চাননি বা চান না তিনি সেখানে খামার করেন। তবে অনেক নতুন কৃষক তাঁকে দেখে উৎসাহিত হচ্ছেন।
আবু বকর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনা মূল্যে গাছ দেন। নিজের ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসা বা যে পরিবারের প্রয়োজন, তাঁর পাশে দাঁড়াচ্ছেন। ভবিষ্যৎ খামারে মা ও শিশুদের জন্য একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু করতে চান। আবু বকরের মতে, এই ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলে ছেলেমেয়েরা বিপথে চলে যাবে, এ ভয় কম থাকে।
জীবনের এই পর্যন্ত আসার পেছনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক অধ্যক্ষ মরহুম চিকিৎসক কবির উদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী তাসলিমা কবিরের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানালেন। এই পরিবার তাঁকে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি মানসিকভাবে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সব সময় পাশে থেকেছে। এই দম্পতির ছেলের বিজ্ঞাপনী ফার্মে আবু বকর কাজ করেছেন। এই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া এক লাখ টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন বিয়ের পর বউভাতের খরচের জন্য। তবে বউভাতের অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে তখন ওই এক লাখ টাকা এবং শ্বশুরের সহায়তায় জমি কিনে কৃষি নিয়ে স্বপ্নের যাত্রা শুরু করেছিলেন। এক বছর পর স্বল্প পরিসরে বউভাতের আনুষ্ঠানিকতা পালন করেছিলেন। তখন স্ত্রী ছিলেন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
শাহজাদপুরের একটি গ্রামে প্রাণ কোম্পানির জন্য খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করেন রাকিবুল মাহমুদ।
তিনি বলেন, ” আমি যখন দুধ এখানে রিসিভ করি তখন অনেক সময় দেখা যায় দুধে মাই আসছে। মাই এক ধরণের রোগ। এটা গরুর ওলান দিয়ে বের হয়। কৃমির ট্যাবলেট দিলে দুধে মাই আসে। তখন আমি খামারিদের বলে দিই যে মাই আসা দুধ আমি রিসিভ করবো না। “
” তাৎক্ষনিক ওরা অ্যান্টিবায়োটিক ডোজ দিয়ে দেয়। স্বাভাবিকভাবে মাই সারতে ১০-১৫দিন সময় লাগে। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক দিলে দেখা যায় ওটা পরের দিন থেকে ক্লিয়ার হয়ে যায়। ঐ অ্যান্টিবায়োটিকটা যাবে কই? অ্যান্টিবায়োটিকটা এভাবেই আসে,” বলছিলেন মি: মাহমুদ।
খামারিদের অনেকই মনে করেন, দানাদার গবাদি পশুর খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক এবং সিসা থাকতে পারে। যদিও এটি শুধুই তাদের ধারণা।
শাহজাদপুর উপজেলায় পোতাজিয়া দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সভাপতি ওয়াজ আলী বলেন, অনেক কোম্পানি আছে যারা গবাদি পশুর খাদ্য বাজারজাত করার জন্য গরুর খামারিদের নানাভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে। তারা খামারিদের বোঝানোর চেষ্টা করে যে তাদের কোম্পানির খাবার গরুকে দিলে দুধের উৎপাদন বাড়বে।
তিনি জানান, বর্ষা মৌসুমে গবাদি পশুর চারণভূমি কমে যায়। ফলে গবাদি পশুর খাদ্যের জন্য প্যাকেট-জাত দানাদার খাদ্যের উপর নির্ভর করতে হয়।
” ক্যাটেল ফিডের কোম্পানি বিভিন্ন অবস্থায় হয়তো হরমোন জাতীয় দ্রব্য দিয়া বলে আমার মালটা খাওয়াও দুধ বেশি হবে। সেই ক্ষেত্রে সরকারিভাবে ক্যাটল ফিড পরীক্ষা করুক,” বলছিলেন ওয়াজ আলী।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেল, ক্যাটল ফিডের বিভিন্ন কোম্পানি ভেদে দুধের উৎপাদন এক থেকে দুই কেজি হেরফের হয়।
তবে শাহজাদপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, দানাদার পশুখাদ্য থেকে ক্ষতিকর উপাদান গরুর শরীরে প্রবেশ করার সুযোগ নেই। তিনি দাবি করেন, পশু খাদ্যের নমুনা বাজার থেকে সংগ্রহ করে প্রায়ই পরীক্ষা করা হয়।
গবাদি পশুর অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ” আমরা খামারিদের বা সংশ্লিষ্ট সবাইকে বলবো, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কখনো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাবহার করবেন না।”
তিনি বলেন, গরুর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হলে সেটির প্রভাব ক্ষেত্র বিশেষ সাত থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত থাকে। এ সময়টুকু দুধ খাওয়া যাবেনা।
মি: রহমান জানান, এমন কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ আছে যেগুলো গবাদি পশু এবং মানুষ – উভয়ের শরীরের জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে সেক্ষেত্রে শুধু প্রয়োগের মাত্রা হেরফের হতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বছর দেড়েক আগে ডেমরার আমুলিয়া মডেল টাউন এলাকায় ১২ থেকে ১৫টি গরু নিয়ে খামার শুরু করেছিলেন তাসনীম আহমেদ। বর্তমানে তার খামারে গরুর সংখ্যা ৪০টির মতো।
আগে তিনি অন্য ব্যবসা করতেন, এখনো করেন। তবে নতুন করে তিনি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন গরু পালনে।
ইদানীং কৃষি, বিশেষ করে পশুর খামারের ব্যবসাটি ‘বুমিং’ হওয়ার কারণেই এই খামারটি শুরু করেন তিনি, বিবিসি বাংলাকে জানালেন মিস্টার আহমেদ।
“গত বছর ৩৫টির মতো গরু কিনেছিলাম কোরবানির বাজারের জন্য। যার ২৯টি এরই মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। এখন বিক্রির জন্য আছে আর ৬টি।”
তাসনীম আহমেদের মতো এখন অনেকেই ঝুঁকছেন গরুর খামার করার দিকে। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণরা আসছেন এই ব্যবসায়। আর এর কারণ হলো বাজারে স্থানীয়ভাবে লালন-পালন করা পশুর বিপুল চাহিদা।
ঈদুল আযহার সময় বাংলাদেশে যত পশু কোরবানী হয়, এক সময় তার একটা বড় অংশ আসতো ভারত থেকে। কিন্তু ভারতে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে গরু চোরাচালান বন্ধ করতে ওই দেশের কর্তৃপক্ষ বেশ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
শুরুতে বাংলাদেশের ভোক্তারা খানিকটা সমস্যায় পড়লেও অনেকে একটি সুযোগ হিসেবেও চিহ্নিত করেন। নতুন অনেক উদ্যোক্তা শুরু করেন গরুর খামার।
ফলে খুব দ্রুতই পাল্টে যায় বাংলাদেশে পশু পালনের চিত্রটি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. এ বি এম খালেদুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে জানান, গত তিন চার বছর ধরে কোরবানির জন্য দেশীয়ভাবে উৎপাদিত পশু দিয়েই মূলত চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “ভারত থেকে একটা নির্দেশনা আছে যে, তাদের দেশ থেকে যাতে কোন পশু বাইরে না যায়। এটা আমাদের জন্যও খুবই ভালো। আমাদের ভেটেনারি মেডিকেল টিম রয়েছে যারা বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন। তারাও বলেছে যে, ভারতীয় গরু এখনো তেমন চোখে পড়েনি।”
কী পরিমাণ গরু আসছে ভারত থেকে?
বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি’র দেয়া তথ্য উল্লেখ করে মিস্টার খালেদুজ্জামান বলেন, ২০১৩ সালে গরুর করিডোরের মাধ্যমে গরু আসে ২৩ লাখ, ২০১৪ সালে এসেছে ২১ লাখ। আর ২০১৫ সালে আসে ১৬ লাখ এবং ২০১৬ সালে ১১ লাখ।
তিনি জানান, এর পরের বছর সংখ্যাটা দশ লক্ষের নিচে নেমে আসে। ওই বছর গরু আসে ৯ লাখ। গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল সাত লক্ষ।
চলতি বছরে এই সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে। মিস্টার খালেদুজ্জামান বলেন, এ বছর বৈধ পথে এসেছে মাত্র ৯২ হাজার গরু। “বছর শেষে আরো কিছু আসতে পারে, তবে আগের তুলনায় সংখ্যাটা বেশ কমে গেছে।”
তিনি বলেন, “এটা নির্দেশ করে যে, দেশীয় উৎস বাড়ছে, আমরা সরবরাহ করছি এবং বাইরে থেকে আসাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ জানাচ্ছে যে এবারে কোরবানীর জন্য গরু-মহিষ পাওয়া যাবে সংখ্যা ৪৫ লাখ ৮২ হাজারটি, আর ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭১ লাখ। অর্থাৎ সব মিলিয়ে কোরবানির জন্য প্রস্তুত এক কোটি ১৭ লক্ষ পশু।
দেশীয় বাজারে চাহিদা নির্ধারণ করা হয় গত বছর যত পশু জবাই করা হয় তার সঙ্গে ৫ শতাংশ যোগ করে। সে হিসেবে, গত বছর জবাই করা এক কোটি পাঁচ লক্ষের সঙ্গে ৫ শতাংশ যোগ করে এবারে চাহিদা ধরা হয়েছে এক কোটি ১১ লক্ষ।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মিস্টার খালেদুজ্জামান জানান, দেশীয় উৎপাদন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর পরই আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক করে বিজিবিকে অনুরোধ করে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
দাম কেমন হবে?
চাহিদার তুলনায় গরুর উৎপাদন বেশি থাকায় এটা দামের উপর কোন প্রভাব ফেলবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যেহেতু বাংলাদেশের বাইরে থেকে, বিশেষ করে ভারত থেকে পশু আসার তেমন কোন খবর পাওয়া যায়নি, আর উৎপাদন ও চাহিদায় যে পার্থক্য আছে সেটা তেমন বড় নয়, তাই আশা করা যায় যে এটা দামের উপর তেমন কোন প্রভাব ফেলবে না।
খামারিরা ভালো দাম পাবেন, মনে করছেন এই কর্মকর্তা।
মিস্টার খালেদুজ্জামান বলেন, বিদেশি গরু আসা ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের খামারিদের ব্যবসায় বড় ধরণের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তিনি বলেন, অনেক তরুণ-তরুণী এই খামারের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন।
ঈদুল আযহার সময়ে চামড়া শিল্প বাদে শুধু গবাদি পশু খাতেই টার্ন ওভারের পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।
মিস্টার খালেদুজ্জামান বলেন, এটা খুবই ইতিবাচক, কারণ একদিকে যেমন দেশীয় উৎস থেকে দেশের মানুষকে নিরাপদ মাংস সরবরাহ করা যাচ্ছে, তেমনি বাইরে থেকে গরুর সাথে আসা নানা ধরণের রোগব্যাধিও কমে গেছে।
ট্রান্স-বাউন্ডারি অ্যানিম্যাল ডিজিজ অর্থাৎ পশুর মাধ্যমে যেসব রোগ এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরিত হয় – যেমন গরুর খুরা রোগ, অ্যান্থ্রাক্স ইত্যাদি – সেগুলোও কম দেখা যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, নিরাপদ মাংস উৎপাদন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দেশীয় বাজার সৃষ্টিতে স্থানীয়ভাবে গরুর উৎপাদন ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, প্রতিবছরই খামার নিবন্ধনের আওতায় খামারিদের সংখ্যা হিসাব করা হয়। এই হিসাব অনুযায়ী, এবছর খামারির সংখ্যা ৫ লাখ ৭৭ হাজার। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৪২ হাজার।
মিস্টার খালেদুজ্জামান বলেন, “এক বছরেই খামারির সংখ্যা এক লাখের উপরে বেড়ে গেছে। তবে এই খামারিদের মধ্যে ডেইরি খামারও রয়েছে।”
পশু খামারিদের ভবিষ্যৎ কী?
২০১৭ সালের হিসাবে, প্রোটিনের চাহিদা পূরণে মাছের পাশাপাশি জনপ্রতি প্রতিদিন ১২০ গ্রাম হারে মাংস খেলে সেটাকে মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে ধরা হয়। সে হিসেবে গত বছর চাহিদার ৭২ লক্ষ মেট্রিক টন চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। এবার এই চাহিদা ধরা হয়েছে ৭৫ লক্ষ মেট্রিক টন।
“তবে এই চাহিদা ভবিষ্যতে বেড়ে ১৫০ গ্রাম বা ২০০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। এটা হলো দেশীয় বাজারে বৃদ্ধি,” বলছেন এই কর্মকর্তা।
আর বিদেশি বাজার ধরতে এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মাংস রপ্তানি শুরু করেছে বলে তিনি জানান। তবে এর জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাংসের উৎপাদন বাড়াতে হবে বলেও তিনি মনে করেন।
অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব পড়বে?
পশুপালনে এই পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এরই মধ্যে বেশ ইতিবাচক ভূমিকা রাখা শুরু করেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা বলেন, এই খাতটি অর্থনীতির জন্য একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে, তবে সেজন্য যথাযথ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, “প্রায় সব সময়ই মাংসের চাহিদা পূরণের জন্য আমরা ভারতের উপর নির্ভরশীল ছিলাম। এখন যদি এক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠা যায়, সেটা অবশ্যই ইতিবাচক।”
সায়মা হক বিদিশা আরও বলেন, সরকার যদি একে একটা শিল্প এবং একটা বড় খাত ধরে চিন্তা করে পদক্ষেপ নেয়, তাহলে পশুপালন একদিকে দেশীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
আর কী পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের?
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানায়, ডেইরি ও বিফ সেক্টরের উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাংলাদেশে চার হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প রয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে আধুনিক জবাবইখানা নির্মাণ, যা নিরাপদ মাংসের জন্য প্রয়োজন। এছাড়া, গবাদি পশুর সুষম খাদ্য নিশ্চিতে এগুলোর আমদানি শুল্কমুক্ত করা, আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ, কসাই প্রশিক্ষণ, গবাদি পশু বীমা, মাংসের গুণাগুণ নিশ্চিতে মান নিয়ন্ত্রণ, ল্যাবরেটরি নির্মাণ, খামারিদের পশুপালন ঋণ দেয়ার মতো পরিকল্পনা রয়েছে।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমাতে হলে মাংস খাওয়াও কমাতে হবে। এমন তথ্য দিয়েছেন জলবায়ু বিষয়ে কাজ করা জাতিসংঘের বিজ্ঞানীরা।
বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে এক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ- আইপিসিসি।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পৃথিবীর গ্রিন হাউস গ্যাসের এক চতুর্থাংশ আসে জমির ব্যবহার থেকে। যার বেশিরভাগই হয় মাংস উৎপাদনকারী গবাদি পশুর খামারের কারণে।
মাংস জাতীয় খাবারের চাহিদা বাড়ার ফলে জমি থেকে বেশি মাত্রায় কার্বন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে, যার ফলে বায়ুমণ্ডল আরও বেশি উষ্ণ হচ্ছে।
আর এ কারণেই গবাদি পশুর খামার কমাতে খাবার হিসেবে মাংস খাওয়া কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
জাতিসংঘের বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ বেশি করে উদ্ভিদজাত খাদ্য গ্রহণ শুরু করলে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকারক প্রভাব কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
তারা হুঁশিয়ার করেছেন, মাংস এবং দুগ্ধজাত খাদ্য তৈরির লক্ষ্যে নিবিড় চাষাবাদ বৈশ্বিক উষ্ণতাকে ক্রমশই বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এ বিষয়ে বিজ্ঞানী ও আইপিসিসির একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য সালিমুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যেখানি পারি আমাদের গ্রিন হাউস গ্যাসটাকে কমানো প্রয়োজন। তা না হলে যে পরিমাণে তাপমাত্রা বেড়ে যাবে তা সহ্য করা যাবে না।”
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন