পরিবেশ
হারানো গৌরব ফিরে আসছে চা শিল্পে
লেখক
বণিক বার্তাটলটলে লিকার। উগ্র সুবাস যেন প্রাণশক্তি ও উৎসাহের উৎস। সত্যিই চা জাগ্রত জীবনীশক্তির ভাণ্ডার। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে চা শিল্পকে ভারতীয়রা মনে করত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তার পিতামহের চা ব্যবসাসংক্রান্ত সব দস্তাবেজ পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু যে পণ্যটিকে ভারতীয়রা, বিশেষ করে বাঙালিরা দীর্ঘদিন যুক্তির মোড়কে দূরে সরিয়ে রেখেছে, ব্রিটিশ বিদায়ের পর তা এখন সংস্কৃতির অংশ।
পাড়ার দোকান থেকে শুরু করে শহরের মোড়ে মোড়ে। শুধু শিক্ষিত সমাজ নয়; কৃষক, কুলি, মজুর, শ্রমিক, ব্যবসায়ী—সব মানুষই চায়ের অনুরাগী। দেশের গ্রামীণ আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনে চায়ের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। গত এক দশকে বাংলাদেশে চায়ের মাথাপিছু ভোগ বেড়েছে ঈর্ষণীয় হারে। চায়ের বাড়তি চাহিদার পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাড়তি ভোগের কারণে আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধি পেলেও কয়েক বছরের মধ্যেই রফতানিমুখী হতে পারে বাংলাদেশ। সেক্ষেত্রে চা শিল্পের উন্নয়নে গ্রীহিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
বাংলাদেশ চা বোর্ড (বিটিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে দেশে চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার কেজি। এ সময়ে ভোগের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৬৯ লাখ ৫০ হাজার কেজি। ফলে ওই বছরে ১ কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজার কেজি চা রফতানি করা সম্ভব হয়েছিল। আর রফতানির মাধ্যমে আয় হয়েছিল প্রায় ৮৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু ২০১৯ সালে দেশে এ-যাবৎকালের সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার কেজি। এ সময়ে দেশের ভোগ ছিল ৯ কোটি ৫২ লাখ কেজি। ফলে রফতানি হয় মাত্র ছয় লাখ কেজি, যার মাধ্যমে রফতানি আয় হয় ১৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ফলে প্রায় দুই দশকের ব্যবধানে উৎপাদন ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে ১৬০ শতাংশ। ভোগের এই বাড়তি বৃদ্ধির কারণে চা রফতানিকারক দেশ থেকে অনেকটাই আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে।
গ্রামীন অর্থনীতি: প্রাণশক্তি ও উদ্দীপনার অন্যতম জোগানদাতা হিসেবে বাসাবাড়ি, অফিস, মোড়ের দোকান সর্বত্রই জনপ্রিয় চা। এজন্যই দেশে চায়ের ভোগ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি প্রয়োজনের তাগিদেই বেড়েছে চায়ের দোকান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে দেশে চায়ের দোকান প্রায় ৪ লাখ ৯১ হাজার ২৭৯টি, যা ২০১৩ সালে ছিল ৪ লাখ ১১ হাজার ৩৩০টি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে চায়ের দোকান বেড়েছে ৭৯ হাজার ৯৪৯টি বা প্রায় ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ। আর এসব চায়ের দোকানে কাজ করছে প্রায় ১০ লাখ ৭৮ হাজার জন। যদিও ২০১৩ সালে ছিল ৮ লাখ ৮২ হাজার টনের। পাঁচ বছরের ব্যবধানে কর্মসংস্থান বেড়েছে ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৩ সালে প্রতিটি চায়ের দোকানে গড়ে ২ দশমিক ১২ জনের কর্মসংস্থান ছিল, যা ২০১৮ সালে চায়ের দোকানে কর্মসংস্থান হয়েছে ২ দশমিক ১৯ জনের।
চা ভোগের ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে গত এক দশকে গ্রামীণ অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনের পাশাপাশি খাদ্যগুণের উপকারিতাও বিবেচনায় নিচ্ছে সাধারণ মানুষ। ভোগের পরিমাণ এ হারে বাড়তে থাকলে সামনের দিনগুলোয় চাহিদা মেটাতে এখনই এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। কার্যকরভাবে বাগানের ব্যবহার করতে হবে। বাড়াতে হবে উৎপাদনশীলতা। সেজন্য বাগানগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক আরো জোরদার করতে হবে। কেননা উৎপাদনশীলতায় বিশ্ব গড়ের নিচে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বিশ্বের শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশগুলোতে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন আড়াই হাজার কেজির কাছাকাছি হলেও বাংলাদেশের আবহাওয়া অনুকূল থাকলেও হেক্টরপ্রতি বাংলাদেশের উৎপাদন মাত্র এক-দেড় হাজার কেজির কাছাকাছি। দেশে গত কয়েক দশকে এ শিল্পের উন্নয়নে বিনিয়োগ তুলনামূলকভাবে কম।
প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বিবিধ প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ চা শিল্পের পর্যায়ে চা রোপণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, কারখানা উন্নয়ন, উৎপাদন প্রক্রিয়া সুসংহতকরণ, শ্রমকল্যাণ, অবকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে এরই মধ্যে বেশকিছু সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ১৯৭০ সালের ৩ কোটি ১৩ লাখ ৮০ হাজার কেজি থেকে ২০১৯ সালে উৎপাদন ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজিতে উন্নীত হয়েছে। চা চাষাধীন জমি ১৯৭০ সালে ৪৩ হাজার হেক্টর থেকে প্রায় ৬০ হাজার হেক্টরে উন্নীত হয়েছে। চা বাগানের সংখ্যা ১৯৭০ সালে ১৫০ থেকে বর্তমানে ১৬৬তে উন্নীত হয়েছে।
দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ এবং রফতানি বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা ভিশন-২০২৫ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের সাতটি জেলায় প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে চা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। দেশে আরো ৪ হাজার ৬৯৮ হেক্টর অনাবাদি জমিতে ১২ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করা সম্ভব। সম্প্রতি এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন, যার সিংহভাগই ঋণভিত্তিক পেলেও কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে। বাকি কিছু অর্থ অনুদান বা প্রকল্প সহায়তার মাধ্যমে নেয়া যেতে পারে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিপুল পরিমাণ উন্নত মানের চা রফতানি করা সম্ভব হবে।
চায়ের হারানোর গৌরব ফিরিয়ে এনে রফতানিযোগ্য করার লক্ষ্যে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ চা বোর্ড। বিদেশী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে চায়ের শ্রেণীবিন্যাস করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। যে চা আমাদের দেশে ব্ল্যাক টি নামে পরিচিত এটির উৎপাদন বৃদ্ধিসহ ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঠাণ্ডা চা, সুগন্ধি চা, মসলাযুক্ত চা, ওষুধি চায়ের মতো বিশেষ ক্যাটাগরির চা রফতানি করা হবে। রফতানিযোগ্য চা বস্তায় নয়, উন্নত মোড়কে প্যাকেটজাত এবং চা উৎপাদন ও গুণাগুণ সম্পর্কিত পর্যাপ্ত তথ্যাবলিসহ রফতানি করা হবে। এর মাধ্যমে বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশের চায়ের গৌরব পুনরুদ্ধার হবে। সাধারণ চাকেই বিশেষ চায়ে রূপান্তর করে রফতানি বাজারে বিদেশী ক্রেতাকে আকৃষ্ট করা যেতে পারে। বিশেষ চা তৈরি করতে কোনো সুগন্ধ বা হারবাল কেমিক্যল মিশ্রণের প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে কী পরিমাণ কেমিক্যাল দেয়া হলে চায়ের গুণগত মান বজায় থাকবে এবং স্বাস্থ্যকর হবে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে বলা যাবে না। সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে মানসম্মত চা উৎপাদন বৃদ্ধি। দেশের অভ্যন্তরে যে পরিমাণ চাহিদা বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাইব্রিড প্রজাতির চা প্লান্টেশন করা না হলে রফতানিযোগ্য চা উৎপাদন করা কঠিন হবে। বিটিআরআই নতুন ক্লোন টি (বিটি-১৮) উদ্ভাবন করেছে। চারা বিভিন্ন বাগান মালিকরা নিচ্ছেন, এসব চা গাছ পরিপক্ব হলে উৎপাদন বাড়বে নিঃসন্দেহে এবং এর গুণগত মানও ভালো থাকবে।
প্রয়োজন কার্যকর উদ্যোগ: বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলের মাটি উন্নত মানের চা উৎপাদনের জন্য বেশ উপযোগী। সেখানে চা উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। বাড়তি চাহিদা মেটাতে দেশের উত্তরাঞ্চলে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট জেলায় উন্নত মানের চা উৎপাদন বেগবান করতে হবে। সরকার চা উৎপাদনকারীদের প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করে যাচ্ছে। সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগালে চা উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করে বিপুল পরিমাণ চা বিদেশে রফতানি করা সম্ভব। তাছাড়া চা আমদানি নিরুৎসাহিত করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে চা উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তাই জাত উদ্ভাবনে উষ্ণতাকে বিবেচনায় নিতে হবে। চায়ের বাজার ধরে রাখতে হলে আমাদের উচ্চফলনশীল জাতের চা চাষ বাড়াতে হবে। এ খাতের উন্নয়নে ব্যাংক সুদের হার কমানো, আমদানিকে নিরুৎসাহিত, নিরবিচ্ছন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, শ্রম অসন্তুষ্টি কমাতে আরো সুবিধা বাড়ানো, জমি ইজারা নিয়ে বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। পাশাপাশি চা আবাদ অঞ্চল বৃদ্ধির জন্য সরকার জমি ইজারার হার এখনো ন্যূনতম পর্যায়ে রেখেছে, সেটি বাড়ানোর মাধ্যমে যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। চা শিল্প শ্রমিকদের উন্নয়নেও নানা কর্মসূচি নিতে হবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে রয়েছে প্রণোদনা। এছাড়া গবেষণাকাজে সরকারি বরাদ্দ আগের তুলনায় অনেক বাড়াতে হবে।
চা শিল্পের উন্নয়নে বাংলাদেশ চা বোর্ড: অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ এবং রফতানির জন্য চা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ চা বোর্ড। বেশকিছু লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সংবিধিবদ্ধ এ প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো চা বাগানের জন্য চায়ের আবাদযোগ্য জমি চিহ্নিতকরণ, এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত, ক্ষুদ্রায়তনের চা চাষে উৎসাহ প্রদান, উৎপাদন ও মান বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ এবং পণ্যটি রফতানিতে হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার। বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে চা শিল্পের উন্নয়ন তথা চা উৎপাদন, বিপণন ও রফতানি বৃদ্ধির জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, নতুন চা বাগান প্রতিষ্ঠা ও পরিত্যক্ত বাগানের পুনর্বাসন, বাংলাদেশে উৎপাদিত চায়ের ওপর উপকর আরোপ এবং সহায়ক অন্যান্য বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ ও সামগ্রিকভাবে দেশে চা শিল্পের কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ।
পাকিস্তান টি অ্যাক্ট-১৯৫০-এর অধীনে ১৯৫১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গঠন করা হয়েছিল সে সময়কার পাকিস্তান টি বোর্ড। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালের ৪ জুন থেকে ১৯৫৮ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত তৎকালীন টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বঙ্গবন্ধুই ছিলেন প্রথম বাঙালি, যিনি চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। চেয়ারম্যান হওয়ার পর চা-সংক্রান্ত গবেষণা কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি এবং এ পদে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায়ই শ্রীমঙ্গলে চা গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেন তিনি, যার সুফল এ দেশের জনগণ এখন ভোগ করছে। তার সরাসরি নির্দেশনাতেই চায়ের ওপর ব্যাপক হারে গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয় এবং এ ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত ২০টি অত্যন্ত উন্নত মানের ফলন ও গুণসম্পন্ন চায়ের ক্লোন উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। এসব ক্লোন বা জাত রোপণের মাধ্যমে দেশের চা উৎপাদনকারী ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছেন। ১৯৫৯ সালের ৮ আগস্ট পাকিস্তান টি অ্যাক্ট-১৯৫০ বাতিল করে টি বোর্ড পরিচালনার লক্ষ্যে জারি করা হয় চা অধ্যাদেশ ১৯৫৯। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে এটিকেও বাতিল করে ঘোষণা করা হয় চা অধ্যাদেশ-১৯৭৭। এ অধ্যাদেশের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ চা বোর্ড। অধ্যাদেশ বলবৎ থাকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। ওই বছরের ১ আগস্ট জারি করা এক গেজেটের মাধ্যমে চা অধ্যাদেশ-১৯৭৭ রহিত করে জারি করা হয় চা আইন-২০১৬।
দেশে চা শিল্পের বিকাশ: ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চা বাগানগুলো প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ শিল্পকে টেকসই খাতের ওপর দাঁড় করানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। চা বাগান মালিকদের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহ করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটি (বিটিআইএমসি) গঠন করে যুদ্ধোত্তর মালিকানাবিহীন/পরিত্যাক্ত চা বাগান পুনর্বাসন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এছাড়া যুদ্ধে বিধ্বস্ত পরিত্যক্ত বাগানগুলোকে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাগান মালিকদের কাছে পুনরায় হস্তান্তর করেন। চা কারখানাগুলোর পুনর্বাসনের জন্য তৎকালীন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া থেকে ৩০ লাখ রুপি ঋণ নিয়ে চা শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি করেন। বাগান মালিকদের ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা সংরক্ষণের অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি। একই সঙ্গে চা শ্রমিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকারও দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। চা শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর সরকার চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুকি প্রদান করার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এ প্রতিষ্ঠানকে প্রথমে বাংলাদেশ চা গবেষণা স্টেশন (বিটিআরএস) নাম দেয়া হয়। এরপর ১৯৭৩ সালে এটিকে পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করে নাম দেয়া হয় বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই)। এসব উদ্যোগের কারণেই দেশের চা শিল্প আজ বিশেষ অবস্থান নিতে সমর্থ হয়েছে। নতুন নতুন বিনিয়োগ আসছে এ শিল্পে। তেমনি দেশের মানুষের চাহিদা মেটাতে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়েছে। ২০০ বছরের চা পণ্য দেশের মানুষের সংস্কৃতির অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে।
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
লাভজনক সবজি চাষ পদ্ধতি
-
ছাদ বাগানের জন্য কয়েকটি টিপস
-
কৃষকের বন্ধু ও কৃষি উন্নয়ন এর পথিকৃৎ শাইখ সিরাজের ৭০তম জন্মদিন আজ
-
যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে হতে পারে সারের সংকট
-
বিদেশ থেকে খালি হাতে ফিরে ড্রাগন চাষে সাফল্য
-
নাসিরনগরে বন্যায় তলিয়ে গেল কৃষকের বাদামখেত
-
পানি দিতে অতিরিক্ত টাকা
-
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
-
‘শিক্ষিত কৃষক’ বলেই তাঁকে নিয়ে মানুষের আগ্রহটা বেশি
-
ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বীজ কিনে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত
ছাদ বাগানীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। টবে, ড্রামে গাছ লাগানো হয়। কেউ ফল, কেউবা সবজির গাছ লাগান। কেউ সফল হন। কেউ সফল হন না। ছোট ছোট কিছু ভুল বাগানীরা করে থাকেন। সে কারণে যত্ন নিলেও ফল আসে না। এখানে ছাদ বাগানীদের জন্য কিছু টিপস দেয়া হলো, যা মানলে সফলতা পাওয়া সহজ হতে পারে।
প্রথমেই মনে রাখতে হবে, টবে বা ড্রামে গাছ লাগালে তাকে খাবার দিতে হবে। প্রকৃতিতে বিদ্যমান গাছের মতো সে খাবার সংগ্রহ করতে পারে না। রোগ-বালাই হলো কিনা সেটাও বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে।
১. মাটির সাথে অবশ্যই কিছু কোকোপিট মেশাবেন। গাছের গোড়া স্যাতস্যাতে হতে দিবেন না। স্যাতস্যাতে হলে অসংখ্য রোগ হবে। মাটি ভেজা থাকবে তবে স্যাতস্যাতে না। কেকোপিট মেশালে পানি কম দিলেও হবে। কোকোপিট (নারকেলের ছোবলার গুড়া) পানি ধরে রাখে। অতি বৃষ্টি হলে গোড়ায় পানি জমতে দেয় না। হালকা হওয়ায় ছাদে ওজনের চাপ পড়ে না। এছাড়া কোকোপিটে কিছু পুষ্টি উপাদান আছে। যা গাছের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কোকোপিটে চারা দ্রুত গজায়, বড় হয়। মাটির চেয়ে কোকোপিটে চারা ভালো হয়।
২. গাছের জন্য বিরিয়ানি হলো সরিষার খৈল-পচা পানি। মাটির হাড়িতে খৈল পচাতে হবে। কমপক্ষে ৫ দিন। ৭ দিন কিংবা বা ১৫ দিন হলে উত্তম। অল্প পানিতে পচিয়ে তার সাথে আরো পানি মিশিয়ে দিতে হবে। এটি গাছের জন্য অত্যন্ত উপকারী। একটু গন্ধ হয়, তাই অল্প একটু গুড় দিতে পারেন। ছাদে হাড়িতে পচালে বাসায় গন্ধ আসবে না। বৃষ্টির সময় খৈল-পচা পানি দেবেন না। পুকুরের নিচে থাকা পাক কাদা গাছের জন্য খুব উপকারী।
৩. আমরা জানি, মাটিতে অসংখ্য ক্ষতিকর ছত্রাক থাকে। যা গাছকে মেরে ফেলার জন্য যথেস্ট। তাই মাটি রেডি করার সময় কিছুটা বায়োডামা সলিট দিবেন। এটি উপকারী ছত্রাক। মাটিতে ক্ষতিকারক উপাদানগুলো মেরে ফেলে। আবার জৈব সারের কাজও করে। গাছের জন্য মাটি হবে ঝুরঝুরে, হালকা।
৪. যাই লাগান না কেন, ভালো জাতের বীজ কিনা নিশ্চিত হয়ে নেবেন। ভালো বীজে ভালো ফসল হবে। নতুবা যতই যত্ন নেন না কেন, সব পরিশ্রম বেলাশেষে জলে যাবে। বীজ থেকে নিজে চারা করা উত্তম। কারণ বাজার থেকে যে চারা কিনবেন সেটার জাত ভালো হবে সে নিশ্চয়তা কোথায়? ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে নেয়া উত্তম। পদ্ধতি হলো- ছত্রাকনাশক দেয়া পানিতে কিছুটা সময় বীজ ভিজিয়ে রাখতে হবে। ম্যানসার, মেটারিল দুটি ছত্রাকনাশক।
৫. গাছ বেশি তো ফলন বেশি- এটি ভুল ধারণা। অল্প জায়গায় বেশি গাছ লাগানো যাবে না। গাছ পাতলা করে লাগাতে হবে। বেশি লাগালে গাছ প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাবে না। একটি ফলের ক্রেটে মাত্র দুটি গাছ। একটি টবে একটি গাছ। ক্রেট বা টবে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৬. ছাদে মাচা দেয়া সমস্যা। কারণ ঘুঁটি থাকে না। এ জন্য ফলের ক্রেটের চারপাশে লাঠি বেঁধে সহজে মাচা দেয়া যায়। লতাপাতা জাতীয় গাছ লাগানোর পাত্র একটু গভীর হলে উত্তম। গাছের জন্য সবচেয়ে বেশি ভালো জৈব সার হলো পাতা-পচা সার, তারপর ভার্মি কম্পোস্ট, তারপর গোবর সার। পাতা-পচা সার সহজলভ্য নয়। দাম বেশি। কিন্তু ভার্মি কম্পোস্ট সহজলভ্য। মাটির সঙ্গে মিনিমাম ৪০% জৈব সার দেয়া উত্তম।
৭. নিম কীটনাশককে ক্ষতিকারক পোকা-মাকড় খুব অপছন্দ করে। এটি দিলে তারা বিরক্ত বোধ করে। গাছে বাসা বাঁধতে পারে না। প্রতি সাত দিনে একবার সব গাছের পাতায় নিম কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। মাসে একবার ইপসম সল্ট স্প্রে করে দেয়া উত্তম। একইভাবে মাসে একবার পানির সঙ্গে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড মিশিয়ে স্প্রে করা ভালো।
৮. ডাটা, পুইশাক, লালশাক, ধনেপাতা এসব লাগাতে পারেন। মাত্র ২৫ দিনে খেতে পারবেন। লালশাক লাগালে নেট দিয়ে ঘিরে দেবেন। শাকপাতা লাগালে দ্রুত আউটপুট পাবেন। যা আপনাকে প্রেরণা দেবে। পুইশাক গাছের পাতায় দাগ হলে পাতা কেটে দিন। অথবা ছত্রাকনাশক স্প্রে করেন। অথবা গাছ উঠিয়ে আবার লাগান। ইউরিয়া সার দিলে পুইশাক দ্রুত বাড়বে। শশা গাছের বৃদ্বির জন্য ডিএপি সার দিলে ভালো হবে। শশা গাছে ছাড়া ছাড়া ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়। খুব রোদ, গাছের গোড়ায় মালচিং করে দিয়ে উত্তম ফল মিলবে। মালচিং হলো গাছের গোড়ায় বিশেষ পলিথিন কিংবা শুকনো পাতা, খড় দিয়ে ঢেকে দেয়া।
৯. ফুল আসার পরে প্রানোফিক্স অথবা মিরাকুরান গাছের পাতায় শেষ বিকালে স্প্রে করবেন। বাসায় দুইটি গ্রুপের ছত্রাকনাশক রাখা ভালো। যেমন- ম্যানসার, মেটারিল। ১৫ দিনে একবার স্প্রে করবেন। এগরোমিন্ড গোল্ড অনুখাদ্য বা অন্য কোনো অনুখাদ্য বাসায় রাখতে হবে। মাসে কমপক্ষে একবার স্প্রে করবেন। অতিরিক্ত গরম, বৃষ্টি, খাদ্যের অভাব, গাছ রোগাক্রান্ত, আবহাওয়া দ্রুত আপডাউন করা ইত্যাদি কারণে ফুল ঝরে পড়তে পারে। আবার পরাগায়ন না হলে ঝরে পড়তে পারে। এ জন্য হাতের মাধ্যমে পরাগায়ন করতে হবে। পুরুষ ফুলের পরাগদণ্ড নারী ফুলে গর্ভে ঘষে দিতে হবে।
১০. ছাদ বাগানে গাছ মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ পানি বেশি বা কম দেয়া। যতটুকু লাগে ঠিক ততটুকু পানি দিতে হবে। কোন গাছের কি চাহিদা, রোগ একটু স্টাডি করলে সহজে সফল হতে পারবেন।
১১. গাছের পাতার নিচে খেয়াল করবেন। বেগুন গাছের পোকা মারার জন্য সেক্স ফোরেমান ফাঁদ লাগাবেন। ডগা ছিদ্র বা ফল ছিদ্র হলে সাইপারমেত্রিন গ্রুপের কীটনাশক দিতে হবে। একটি বেগুন গাছ অনেক দিন ফল দেয়। ঢেড়স গাছ বেশি রোদ পড়ে এমন জায়গায় লাগাবেন। বেগুন, ঢেড়স, লালশাক, পুইশাক, ধনেপাতা, ডাটা শাক- এসব গাছের খুব যত্ন করতে হয় না।
১২. রসুন আর লবঙ্গ বেটে সেই পানি গাছে স্প্রে করলে পোকা কম আসবে। মরিচ গাছে নেপথলিন বেঁধে দিন, পোকা কম আসবে। পাতা কোকড়ালে ভার্মিটেক কিংবা এবোম কীটনাশক দিন। কোকড়ানো পাতা ফেলে দিন। মরিচ গাছে দশ দিন পর পর ডায়মেথট গ্রুপের (যেমন টাফগর) কীটনাশক দিলে উপকার হবে। সবকিছু করছেন, তারপরও কাজ হচ্ছে না। এক্ষেত্রে গাছের জায়গা বদল করেন, উঠিয়ে অন্যত্র লাগান।
শীতকাল এলেই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে খেজুরের রস খাওয়ার চল বেড়ে যায়। অনেকে গাছ থেকে খেজুরের কলসি নামিয়ে সরাসরি কাঁচা রস খেয়ে থাকেন।
আবার অনেকে এই রস চুলায় ফুটিয়ে সিরাপ, পায়েস বা ক্ষীর বানিয়ে খান। এছাড়া রসের তৈরি ঝোলা গুড়, পাটালি গুড়, নলেন গুড়, ভেলি গুড়, বালুয়া গুড়, মিছরি গুড়সহ নানা ধরণের পিঠার বেশ সুখ্যাতি রয়েছে।
নিপাহ্ ভাইরাস আতঙ্ক
খেজুর আরব দেশের প্রচলিত ফল হলেও ওইসব দেশে খেজুর, মূলত ফল উৎপাদননির্ভর, যেখানে কিনা বাংলাদেশের খেজুর গাছ রস উৎপাদননির্ভর।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের মতে, বাংলাদেশে সাধারণত কার্তিক থেকে মাঘ অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত খেজুরের রস সংগ্রহ হয়ে থাকে।
দেশটির সবচেয়ে বেশি রস সংগ্রহ হয় যশোর, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর অঞ্চল থেকে।
মূলত খেজুর গাছের ডালপালা পরিষ্কার করে, ডগার দিকের কাণ্ড চেঁছে তাতে একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি চোঙ বসিয়ে দেয়া হয়। চোঙের শেষ প্রান্তে ঝুলিয়ে দেয়া হয় একটি মাটির হাড়ি বা কলসি।
সেই চোঙ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রস এসে জমা হতে থাকে মাটির হাড়ি বা কলসিতে। এভাবে একটি গাছ থেকে দৈনিক গড়ে পাঁচ থেকে ছয় লিটার রস সংগ্রহ করা যায় বলে কৃষি তথ্য সার্ভিস সূত্রে জানা গিয়েছে।
কিন্তু গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই খেজুরের রস খাওয়ার ক্ষেত্রে নিপাহ্ ভাইরাস আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
দেশের বিভিন্ন রাজ্যেই বর্ষার (Monsoon 2021) প্রভাবে চলছে বৃষ্টিপাত। এসময় কৃষকেরা খারিফ শস্য (Kharif Crops) বপনে তৎপর হয়ে ওঠেন। এই খরিফ মরসুমে কৃষকভাইরা সাধারণত অঞ্চলভেদে ধান, অড়হর, সোয়াবিন সহ বিভিন্ন চাষে মনযোগ দিয়ে থাকেন ৷ তবে এসব ছাড়াও, ঔষধি গুন সমৃদ্ধ (Medicinal Crops) গাছ চাষে বর্ষায় যে কতটা লাভ হতে পারে সে সম্পর্কে অনেকেই হয়তো জানেন না৷
বিশেষ করে বর্ষাকালেই এমন বহু ঔষধি গুন সম্পন্ন গাছ রয়েছে যাদের চাষ হতে পারে লাভজনক৷
বর্ষাকালে কোন কোন ঔষধি উদ্ভিদের চাষ করা যেতে পারে অথবা এই চাষ কীভাবেই বা করা যাবে সে বিষয়ে সঠিক তথ্য না পাওয়ার কারণেই অনেকের কাছে বিষয়টি অধরা৷ চলুন এই প্রতিবেদনে এমনই কিছু গাছ নিয়ে আলোচনা করা যাক যা কৃষকদের জন্য হতে পারে লাভদায়ক৷ তবে সঠিক সময়ে, সঠিক রোপন, সেচ, কীটনাশক দেওয়ার প্রয়োজন এগুলিতে, না হলে এর ওপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে৷
অশ্বগন্ধা –
বর্ষায় এর চাষ ভালো৷ জুন থেকে অগস্ট পর্যন্ত এর চাষ করতে পারেন৷ এর বিভিন্ন জাত রয়েছে৷ উন্নত মানের গাছের চাষে কৃষকের লাভের পরিমাণও বৃদ্ধি পেতে পারে৷ উল্লেখ্য, প্রতি হেক্টরে ৫ কিলোগ্রাম বীজ ব্যবস্থা করতে হবে৷ যদি কেউ ১ হেক্টর জমিতে অশ্বগন্ধার চাষ করতে চায় তাহলে তাকে প্রায় ৫০০ বর্গমিটারে নার্সারি তৈরি করতে হবে৷ প্রায় ১ সেন্টিমিটার গভীরে বীজ বপন করতে হবে৷
শতমূলী –
শীত বাদ দিয়ে বছরের যে কোনও সময়ে এই গাছের চাষ করতে পারেন৷ বর্ষাকালে এই চারা রোপন করলে সহজেই তা বেড়ে উঠতে থাকে৷ তবে বীজ বপনের আগে বীজ ১ দিন পর্যন্ত হালকা গরম জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়৷
যষ্টিমধু –
জুলাই থেকে অগস্ট পর্যন্ত এর চাষ করা হয়৷ আর তাই জুন থেকেই এর প্রস্তুতি শুরু করে দেন কৃষকেরা৷ জলনিকাশি ব্যবস্থা উচ্চমানের হওয়া প্রয়োজন এই গাছ চাষের জন্য৷ মনে রাখতে হবে এর চাষের আগে জমিতে কমপক্ষে ১৫ টন গোবর সার দেওয়া প্রয়োজন, এরপরেই এটি চাষ করা উচিত৷
ঘৃতকুমারী –
এর ভালো উৎপাদনের জন্য জলনিকাশি ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে৷ এই ধরনের ঔষধি গুনসম্পন্ন গাছ শীতকাল বাদ দিয়ে যে কোনও সময় চাষ করতে পারেন৷ বর্ষাকালে দূরত্ব রেখে বীজ বপন করতে হবে৷ কম সময়ের মধ্যেই ব্যবহারোপযোগী হয়ে ওঠে এগুলি৷
অগ্নিশিখা বা কলিহারি –
এটি চাষের জন্য কৃষকেরা জুন মাসেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন৷ জুলাইয়ে ভালো বৃষ্টিতে এর চাষ শুরু করা যেতে পারে৷ উল্লেখ্য, ১ হেক্টর জমির জন্য প্রায় ১০ ক্যুইন্টাল কন্দের প্রয়োজন৷ এটি চাষের আগেও জমিতে গোবর সার প্রয়োগ করে তা প্রস্তুত করে নিতে হবে৷
পৃথিবীতে ভোজ্য মসলা যতরকম আছে তারমধ্যে দারুচিনি সবথেকে উল্লেখযোগ্য। এই প্রাচীনতম মসলা বহুদিন ধরে ওষধি হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে। এছাড়াও খাবারে স্বাদ বাড়ানো থেকে শুরু করে, পানীয় এবং তরল মশলাদার খাবারে স্বাদ বাড়ানোর জন্যও এই দারচিনির ব্যবহার হয়। এলাচ, গোলমরিচ, লবঙ্গের সাথে সাথে দারুচিনির নামও মসলা হিসেবে একই পংক্তিতে উচ্চারিত হয়। বহু কৃষক দারুচিনির চাষ করে ভীষণভাবে উপকৃত হয়েছেন। বাজারে এই দারুচিনির চাহিদা প্রচুর পরিমানে থাকায়, এই চাষে ভালো লাভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও সৌখিন মানুষেরাও ভালোবেসে দারুচিনির চাষ বাড়িতে করে থাকেন। দারুচিনি গাছের বাকল, ফুল, কুঁড়ি, পাতা, ফল, শেকড় সবকিছুই কাজে লেগে যায়। দারুচিনি গাছ বাড়িতে চাষ করতে গেলে ঘরে ছাদে দুই জায়গাতেই চাষ করা যায়।
মনে রাখতে হবে এই চাষ করতে গেলে উপযুক্ত পরিমানে রোদ দরকার। বাংলার জলবায়ুতে মূলত শীতকালে এই চাষ করা সবথেকে ভালো। জানুয়ারি মাসে দারুচিনি গাছে ফুল ফোটা আরম্ভ করে, এবং এই গাছের ফল পাকতে আরম্ভ করে জুলাইয়ে। সেইসময়ই ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে এসে বাগানে বা টবে রোপন করে দেওয়া উচিত।
প্রয়োজনীয় রোদ (Sunlight)
কড়া সূর্যালোক দারুচিনি জন্য প্রয়োজনীয়, তাই এটি পর্যাপ্ত রোদ পাওয়া যায় এমন জায়গায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দারুচিনি রোপন করতে গেলে রৌদ্রোজ্জ্বল স্থান যেমন জানালার ধারে, ব্যালকনি কিংবা ছাদের খালি স্থান ব্যবহার করতে হবে।
উপযুক্ত মাটি (Soil)
দারুচিনি চাষের জন্য ভাল মানের মাটি ব্যবহার করা আবশ্যক। বাগানের মাটি ব্যবহার না করাই ভালো, কেননা এতে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। অনে সময় আমরা আশেপাশ থেকে মাটি নিয়েই টব ভরে গাছ লাগানো হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংবেদনশীল গাছগুলোতে এই উপায় কার্যকরী হয় না। নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভাল এমন মাটি ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উত্তম নিষ্কাশনযুক্ত বেলে দোআঁশ মাটি ব্যবহার করা সবথেকে উত্তম। জেনে রাখা ভালো দারুচিনি খরা একদমই সহ্য করতে পারে না। মাটির বিকল্প হিসেবে ১৫% ট্রাইকোকমপোস্টযুক্ত কোকোডাস্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
বাইরে চাষ করার জন্য এক মিটার (৩০ সেন্টিমিটার গভীর) পর্যন্ত গর্ত করে মাটি দিয়ে পূরণ করে নিতে হবে। ঘরের ভিতরে বা ছাদবাগানের দারুচিনি চাষের জন্য একটি বড় পাত্র প্রয়োজন হবে।
রোপন (Planting)
দারুচিনির বীজ সংগ্রহও করা যায় অথবা নার্সারি থেকে দারুচিনির গাছ কিনেও আনা যায়।
বাইরে চাষের ক্ষেত্রে
দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ১ মিটার x ১ মিটার এবং ৩০ সেমি গভীরতায় খনন করে মাটি দিয়ে গর্তটি পূরণ করতে হবে।
ঘরের মধ্যে টবে রোপনের ক্ষেত্রে
নিচে গর্ত সহ বড় সিরামিক পাত্র (৬০ x ৫০ সেমি) ব্যবহার করতে হবে। পাত্রটি মাটি বা কোকোডাস্ট দিয়ে পূরণ করে নিতে হবে। ৩০ সেন্টিমিটার গভীরতা এবং ৩০ সেন্টিমিটার প্রস্থের একটি গর্ত তৈরি করতে একটি বাগান ট্রোয়েল ব্যবহার করে নেওয়া ভালো। বীজ ব্যবহার করলে ১.৫ সেন্টিমিটার গভীর গর্ত তৈরি করে নেওয়া উচিত। এবার গাছটি গর্তের মধ্যে রেখে মাটি দিয়ে চাপা দিতে হবে। বীজ ব্যবহার করলে প্রতি ১.৫ সেমি গর্তে একটি করে বীজ পুঁততে হবে এবং মাটি দিয়ে বীজটি ঢেকে দিতে হবে।
মাটি সবসময় ভেজা রাখতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জল দিতে হবে। দারুচিনি গাছ পাত্রে রোপন করার পর, টবের নিচের গর্ত থেকে জল বের না হওয়া পর্যন্ত জল দিতে হবে। টবের উপরের ৫ সেন্টিমিটার শুকিয়ে গেলেই আবার গাছটিকে জল দিতে হবে।
গাছের পরিচর্যা (Caring)
দারুচিনি গাছে নিয়মিত সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম বছর ৫০ গ্রাম টিএসপি, ৭৫ গ্রাম এমওপি ও ৫০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিবছর ২-৩ কেজি ট্রাইকোকম্পোস্ট ও সার প্রয়োগ শেষে একই হারে টিএসপি, এমওপি ও ইউরিয়া দিতে হবে।
দারুচিনি প্রথম ধরতে দুই থেকে তিন বছর সময় নেয় এবং তার পরে প্রতি দুই বছর পরপরই ফসল দিতে থাকে। দারুচিনি গাছ কম করে ১০-১৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। তাই একে নিয়মিত করে ছোট রাখতে হবে। পাঁচ বছর বয়সী দারুচিনি গাছ থেকে নিয়মিত দারুচিনি সংগ্রহের ডাল পাওয়া সম্ভব। দারুচিনি ব্যবহার করার জন্য যে শাখাগুলি কাটা হবে সেগুলি থেকে বাকল তুলে নিতে হবে, বাকলগুলি ব্যবহার করার আগে জলে ভালোভাবে ভিজিয়ে নেওয়া উচিত।
পৃথিবীতে জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, হারিয়ে যাচ্ছে বহু প্রাণী ও উদ্ভিদ বৈচিত্র। চাষবাসের জমিরও সংকুলান ঘটছে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে। গগনচুম্বী বাড়ি ঘিরে ফেলছে সমস্ত ফাঁকা জমিন। শখ করে মানুষ খোলা জায়গায় যে গাছ লাগবে অথবা ফল-ফুলের চারা সেই উপায়ও আর নেই। গাছ লাগানোর জন্য সামান্য জায়গাও ফাঁকা থাকছে না আর। তবে আমাদের করণীয় কী? বৃক্ষরোপন কি তবে অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে। বেঁচে থাকার জন্য তো গাছ লাগাতে হবেই। বাড়ির একটুকরো বারান্দা অথবা ব্যালকনিতেও সুন্দর ভাবে ইচ্ছা করলে গাছ লাগানো যায়। বাড়ির ছাদেও বানানো যায় সুন্দর বাগিচা। শহরের মানুষদের জন্য ছাদ বাগানের কোনও বিকল্পও নেই। বাড়ির মধ্যেকার ব্যালকনি অথবা ছাদের একটুকরো জমিতেও, ইচ্ছা করলে টবে চাষ করা যায় বিভিন্ন ফুলের ও ফলের গাছ।
শাকসবজি, পেয়ারা, লেবু প্রভৃতি দেশীয় গাছ টবে বাড়তে দেওয়া থেকে শুরু করে বর্তমানে বহু বিদেশী গাছের চারাও মানুষ ব্যালকনি অথবা ছাদে চাষ করছেন। তার মধ্যে থাই মিষ্টি তেঁতুল টবের চাষ পদ্ধতি হিসাবে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। প্রথমত মিষ্টি তেঁতুলের চাষ করতে গেলে, নার্সারি থেকে এই বিশেষ তেঁতুলের সঠিক বীজ নিয়ে আনতে হবে। তবে থাই মিষ্টি তেঁতুলের কলম পাওয়া একটু দুষ্কর কাজ। বুঝে সঠিক চারা নিয়ে আসা বাগান মালিকের উপরেই বর্তায়।
থাই মিষ্টি তেঁতুলের ফুল থেকে ফল ধরতে প্রায় ৭ মাস সময় লাগে। বছরে দু’বার থাই মিষ্টি তেঁতুলের গাছে ফল ধরে। প্রথমবার বর্ষাকালে এবং দ্বিতীয়বার শীতকালে। এই গাছের পরিচর্যা আলাদা করে করার কোনও দরকার পড়ে না। গাছের যত্নআত্তি নিতে হয় ঠিকই, কিন্তু তা বলে, আলাদা করে কোনও বিশেষ যত্ন নিতে হয় না।
গাছ লাগানোর পদ্ধতি (Planting):
থাই মিষ্টি তেঁতুল চাষের জন্য আদর্শ মাটি হল, দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি। এই দু’টি মৃত্তিকার মধ্যে যে কোনও একটি বেছে নিন। তারপর বেছে নেওয়া মাটির দুই ভাগ অংশের সাথে গোবর, ১০০ গ্রাম, টিএসপি ১০০ গ্রাম, পটাশ, ২৫০ গ্রাম, হাড়ের গুঁড়ো এবং ৫০ গ্রাম সরিষার খোল একসঙ্গে মিশিয়ে ২০ ইঞ্চি মাপের বড় টবে জল মিশিয়ে রেখে দিতে হবে। ১০ থেকে ১২ দিন পর টবের মাটি ভালো করে খুঁচিয়ে দিয়ে আরও ৪-৫ দিন রেখে দিতে হবে। ৪ থেকে ৫ দিন বাদে মিষ্টি তেঁতুলের একটি ভালো চারা ওই টবে লাগান।
পরিচর্যা(Caring):
চারা লাগানোর প্রথম কয়েক মাস তেমন যত্নের দরকার পড়বে না। অবশ্যই গাছে এই সময়টুকু পর্যাপ্ত জলের যোগান, এবং আগাছা পরিষ্কারের কাজ করতে হবে। ছয় মাস চারা লাগানোর সময়সীমা ফুরোলেই ১ মাস বাদে বাদে গাছে সরষের খোল মিশ্রিত পচা জল দিতে হবে। মনে রাখতে হবে খোল দেওয়ার আগে গাছের মাটি খুঁচিয়ে নিতে হবে।
রোগ দমন (Disease management):
সাধারণত থাই মিষ্টি তেঁতুল গাছে পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা যায় না। কিন্তু বর্ষাকালে অনেক সময় তেঁতুল গাছে ছত্রাক হানা দেয়। এর ফলে তেঁতুল ফেটে যায়। এই অসুবিধার থেকে গাছকে বাঁচাতে হলে, বর্ষাকাল আসার আগেই ভালো ছত্রাকনাশক ওষুধ ১০ দিন অন্তর গাছে স্প্রে করে ছড়িয়ে দিতে হবে।
বাংলার বেজায় টক তেঁতুলের সঙ্গে থাই মিষ্টি তেঁতুলের কোনও তুলনাই চলে না। অত্যন্ত মিষ্টি খেতে এই তেঁতুল থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় চাষ প্রভূত পরিমাণে হলেও, আমাদের রাজ্য এই ফলের চাষ এখনও ততটা গতি পায়নি। কিন্তু আপনি আপনার ব্যালকনি অথবা ছাদে সহজেই এই থাই তেঁতুলের গাছ লাগাতে পারেন।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন