দই, দধি বা দৈপ্রীতি কমবেশি আমাদের সবার মধ্যেই আছে। তবে এ প্রসঙ্গে একটি গল্প আছে, গল্পটি এ রকম: একটি গ্রামে একজন বেজায় পেটুক এবং অতিমাত্রায় ভোজনরসিক লোক ছিল। তার নাম কাসেম আলী (কারও নামের সঙ্গে মিলে গেলে, জানতে হবে তা কাকতালীয়)। খুব বেশি খেতে পারে বলে আশপাশের দশ গ্রামে তাঁর যেমন পরিচিতি ছিল, তেমনি গ্রামের সব উৎসবে, বিয়ে, পালা–পার্বণে অনাহূত এই ব্যক্তিকে দেখলেই সবার চোখ কপাল ছাড়িয়ে মাথায় উঠত। কারণ, ১০ জনের খাবার সে একাই অবলীলায় সাবাড় করে দিত।
একদিন একটি গ্রামে বিয়ের অনুষ্ঠান। সেদিন সেই গ্রামের বিয়েবাড়ির কিছু লোক আগে থেকে কাসেম আলীকে ভুলিয়ে–ভালিয়ে নির্জন স্থানে নিয়ে একটি খুঁটির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখল, যাতে সে বিয়ের অনুষ্ঠানে হাজির হতে না পারে। কাসেম আলীর জীবনে এর আগে এমন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কোনো প্রতিবাদ না করে বিষণ্ন বদনে হাতে দড়ি বাঁধা অবস্থায় চুপচাপ রইল। কল্পনায় বিয়েবাড়ির নানা পদের খাবার, স্বাদ-ঘ্রাণ অনুভব করতে করতে একসময় অনেকটা ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়ল।বিজ্ঞাপন
পড়ন্ত দুপুরে বিয়েবাড়িতে খাবারদাবারের মহাযজ্ঞ প্রায় শেষের দিকে, সে সময়ে কাসেম আলী কল্পনায় দেখতে পেল, খাবার শেষে আমন্ত্রিত অতিথিদেরকে দই পরিবেশন করা হচ্ছে। মুহূর্তে শান্ত স্বভাবের কাসেম হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠল—‘এখন দেয় দই, আরকি আমি রই’ এবং শরীরের সব শক্তি দিয়ে একঝটকায় হাতের দড়ি ছিড়ে পড়িমরি করে দৌড়ে বিয়েবাড়ি হাজির হয়ে গেল।
সে যা–ই হোক, এ গল্পে সব খাবার ছাপিয়ে কাসেম আলীর দইপ্রীতির সঙ্গে আমাদের বাঙালি সমাজেও খাবারদাবার শেষে দই পরিবেশনের রেওয়াজ আছে, তা মনে করিয়ে দেয়।
ইতিহাস
দই কত দিন থেকে মানুষের খাবারের অংশ হলো, তা নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারে না। ইতিহাসবিদেরা বলেন, খ্রিষ্টজন্মের পাঁচ হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়ায় দই আবিষ্কৃত হয়। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন নথিপত্র, নিদর্শন ঘেঁটে যা জানা যায়, তা হলো দই ও মধুর মিশ্রণে তৈরি হয় ‘ঈশ্বরের খাদ্য’। প্রাচীন গ্রিকরা রান্নায় দইজাতীয় ‘অক্সিগালা’ নামের একধরনের দুগ্ধজাত দ্রব্য ব্যবহার করত। তারাও এর সঙ্গে মধু মিশিয়ে খুব মজা করে এর স্বাদ আস্বাদন করত। এবং কিছু স্নায়বিক নল জন্মগত ত্রুটি থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে। এদিকে খাদ্যরসিক তৎকালীন অখণ্ড ভারতের মোগল সম্রাট আকবরের প্রিয় খাবারের তালিকায় দই ছিল উল্লেখ্যযোগ্য।বিজ্ঞাপন
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দই, ‘জীবিত খাদ্য’
ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রসোয়াঁ (১৫১৫-১৫৪৭) প্রায়ই গুরুতর ডায়রিয়া রোগে ভুগতেন। ফ্রান্সের সব নামকরা হেকিম তাঁর এমন বিশ্রী রোগটির কোনো কার্যকর চিকিৎসা দিতে পারলেন না। তখন ফরাসি রাজা তাঁর বন্ধু স্বর্ণযুগের অটোমান সুলতান সুলাইমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের শরণাপন্ন হন। সুলতান তখন ফরাসি রাজার চিকিৎসার জন্য একজন চিকিৎসক পাঠান। চিকিৎসক ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রসোয়াঁকে নিয়মিত দই খাইয়ে তাঁকে এমন বিরক্তিকর রোগের হাত থেকে মুক্তি দেন। রোগমুক্তির আনন্দে উৎফুল্ল ফরাসি নৃপতি এমন বিস্ময়কর খাবারের খুব গুণকীর্তন করেন।
আসলে রোগ প্রতিরোধের জন্য দইয়ের বিকল্প খুব কম আছে। সে সময়ের চিকিৎসক দইয়ের গুণাগুণ ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। চমৎকার প্রোটিনের উৎস দই হচ্ছে লক্ষকোটি জীবিত ব্যাকটেরিয়ার সমাহার। এগুলো আমাদের জন্য খুবই উপকারী ব্যাকটেরিয়া, আমাদের শরীরে প্রোবায়োটিক জোগান দেয়। তাই দইকে ‘জীবিত খাদ্য’ বলা হয়। দইয়ের সঙ্গে প্রচুর জীবিত ব্যাকটেরিয়া আমরা খেয়ে ফেলি। ফলে এসব উপকারী ব্যাকটেরিয়া আমাদের পাকযন্ত্রে ঘাঁটি গেড়ে থাকা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া হটিয়ে সে জায়গা দখল করে আমাদের শরীরের বিপাকীয় কাজে বন্ধুর মতো সাহায্য করে এবং আমাদের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে উন্নত করে।বিজ্ঞাপন
আমাদের দাঁত ও হাড়ের যত্নে খনিজসমৃদ্ধ এক কাপ দই থেকে প্রতিদিনের চাহিদার ৪৯ শতাংশ ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। এক কাপ দই থেকে আমারা নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় ফসফরাসের ৩৮ শতাংশ, ম্যাগনেশিয়ামের ১২ শতাংশ ও পটাশিয়ামের ১৮ শতাংশ পেতে পারি। এই খনিজগুলো বেশ কয়েকটি জৈবিকপ্রক্রিয়া, যেমন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, বিপাক ও হাড়ের ক্ষয় রোধের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।
দইয়ে আরও আছে ভিটামিন বি, বিশেষত ভিটামিন বি-১২ ও রিবোফ্লাভিন—উভয়ই হৃদরোগ ও কিছু স্নায়বিক নল জন্মগত ত্রুটি থেকে আমাদের করতে পারে। তাই যেমন বাংলাদেশের এক অখ্যাত গ্রামের একজন কাসেম আলী ও ফরাসি রাজা প্রথম ফ্রসোয়াঁ দইয়ের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন, তেমনি সুযোগ থাকলে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় এমন মজার খাবারটি যোগ করা উচিত হবে। তবে যাঁরা দুগ্ধজাত খাবার খেতে পারেন না, তাঁরা অবশই দই পরিহার করে চলবেন এবং এ ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।বিজ্ঞাপন
অণুজীববিজ্ঞানী স্টামেন গ্রিগোরভ (১৮৭৮-১৯৪৫)
মানুষ বহু প্রাচীন এই জনপ্রিয় খাবারের সঙ্গে পরিচিত থাকলেও তাদের মোটেই জানা ছিল না যে কীভাবে দুধকে দইয়ে রূপান্তর করা যায়। ব্যাপারটি প্রথম উদঘাটন করেন বুলগেরিয়ার এক চিকিৎসক ও অণুজীববিজ্ঞানী স্টামেন গ্রিগোরভ। তিনি ব্যাসিলাস প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া গাঁজন বা ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ায় দুধ থেকে দই হওয়ার বিষয়টি আবিষ্কার করেন। অর্থাৎ এমন মজাদার খাবারের আসল কারিগর হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া।
দুধের চিনি ল্যাকটোজেন থেকে ল্যাকটিক অ্যাসিড হয়, সেখান থেকে প্রোটিনে রূপান্তরিত হয়ে দুধ পরিণত হয় দইয়ে। আর এমন আবিষ্কারের জন্য তাঁকে সম্মান জানিয়ে দই তৈরির জন্য যে প্রজাতির ব্যাকটেরিয়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেটির নামকরণ করা হয়েছে ‘ল্যাকটোব্যাসিলাস বুলগেরিকুশ’।
২৭ অক্টোবর ছিল, স্টামেন গ্রিগোরভের জন্মদিন এবং একই সঙ্গে মৃত্যুদিন। তিনি দই তৈরির আসল কারিগর উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে শনাক্ত করেছিলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
শীতকাল এলেই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে খেজুরের রস খাওয়ার চল বেড়ে যায়। অনেকে গাছ থেকে খেজুরের কলসি নামিয়ে সরাসরি কাঁচা রস খেয়ে থাকেন।
আবার অনেকে এই রস চুলায় ফুটিয়ে সিরাপ, পায়েস বা ক্ষীর বানিয়ে খান। এছাড়া রসের তৈরি ঝোলা গুড়, পাটালি গুড়, নলেন গুড়, ভেলি গুড়, বালুয়া গুড়, মিছরি গুড়সহ নানা ধরণের পিঠার বেশ সুখ্যাতি রয়েছে।
নিপাহ্ ভাইরাস আতঙ্ক
খেজুর আরব দেশের প্রচলিত ফল হলেও ওইসব দেশে খেজুর, মূলত ফল উৎপাদননির্ভর, যেখানে কিনা বাংলাদেশের খেজুর গাছ রস উৎপাদননির্ভর।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের মতে, বাংলাদেশে সাধারণত কার্তিক থেকে মাঘ অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত খেজুরের রস সংগ্রহ হয়ে থাকে।
দেশটির সবচেয়ে বেশি রস সংগ্রহ হয় যশোর, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর অঞ্চল থেকে।
মূলত খেজুর গাছের ডালপালা পরিষ্কার করে, ডগার দিকের কাণ্ড চেঁছে তাতে একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি চোঙ বসিয়ে দেয়া হয়। চোঙের শেষ প্রান্তে ঝুলিয়ে দেয়া হয় একটি মাটির হাড়ি বা কলসি।
সেই চোঙ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রস এসে জমা হতে থাকে মাটির হাড়ি বা কলসিতে। এভাবে একটি গাছ থেকে দৈনিক গড়ে পাঁচ থেকে ছয় লিটার রস সংগ্রহ করা যায় বলে কৃষি তথ্য সার্ভিস সূত্রে জানা গিয়েছে।
কিন্তু গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই খেজুরের রস খাওয়ার ক্ষেত্রে নিপাহ্ ভাইরাস আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
উপকরণ: বাঁধাকপির কুচি ৪ কাপ, কই মাছের টুকরো ৬টি, তেজপাতা ১টি, শুকনো মরিচ ২টি, মেথি অল্প পরিমাণ, মরিচবাটা ১ চা-চামচ, পেঁয়াজ কুচি ১ কাপ, লবণ পরিমাণমতো, নারকেল কোরানো স্বল্প পরিমাণে, হলুদ পরিমাণমতো ও সরিষার তেল পরিমাণমতো।
প্রণালি: তেলে শুকনো মরিচ ও মেথি ফোড়ন দিতে হবে। ফোড়ন হয়ে এলে হালকা করে ভেজে উঠিয়ে রাখতে হবে। ওই তেলেই বাঁধাকপির কুচি ও পেঁয়াজ কুচি দিয়ে ভালো করে কষে নিতে হবে। তারপর লবণ, মরিচ ও হলুদবাটা দিয়ে আরও কিছুক্ষণ বসাতে হবে। সেদ্ধ হয়ে এলে অল্প পরিমাণে পানি দিতে হবে। পানি ফুটে উঠলে ভাজা মাছগুলো দিয়ে ঢাকা দিতে হবে। পানি শুকিয়ে গেলে এবং মাছ সেদ্ধ হয়ে এলে অল্প পরিমাণ নারকেল কোরানো দিয়ে নামিয়ে ফেলতে হবে।
উপকরণ: বড় শোল মাছ ৫০০ গ্রাম, টমেটো টুকরো আধা কাপ, সরিষার তেল ৩ টেবিল চামচ, টমেটোবাটা আধা কাপ, পেঁয়াজ কুচি ১ কাপ, আদাবাটা ১ চা-চামচ, রসুনবাটা ১ চা-চামচ, হলুদ গুঁড়া ১ চা-চামচ, ধনেপাতা আধা কাপ, শুকনো মরিচের গুঁড়া ১ চা-চামচ, লবণ স্বাদ অনুসারে ও কাঁচা মরিচ ৭-৮টি (চেরা)।
প্রণালি: শোল মাছ লবণ, হলুদ ও সরিষার তেল মাখিয়ে ভেজে তুলে রাখতে হবে। আর ওই তেলেই পেঁয়াজ কুচি দিতে হবে। পেঁয়াজ বাদামি রং হলে রসুন, আদা, মরিচের গুঁড়া, হলুদ ও লবণ দিয়ে ভালোভাবে কষাতে হবে। টমেটোবাটা দিতে হবে, কিছুক্ষণ কষানোর পর প্রয়োজনমতো গরম পানি দিতে হবে। পানি ফুটে উঠলে ভেজে রাখা মাছগুলো দিতে হবে। ঝোল মাখা-মাখা হলে টমেটোর টুকরো আর ধনেপাতা দিয়ে কিছুক্ষণ পর নামিয়ে ফেলতে হবে। নামানোর আগে কাঁচা মরিচ দিতে হবে।
উপকরণ: ছোট টুকরো করে কাটা টাকি মাছ ২ কাপ, ডুমো ডুমো করে কাটা লাউ ৪ কাপ, হলুদ সিকি চা-চামচ, লবণ পরিমাণমতো, পেঁয়াজ ১ কাপ, ধনেপাতা কুচি পরিমাণমতো, রসুনবাটা ১ চা-চামচ, কাঁচা মরিচ ১০-১২টি, আদাবাটা আধা চা-চামচ ও রাঁধুনি বাটা সিকি চা-চামচ।
প্রণালি: তেলে পেঁয়াজ দিয়ে হালকা করে ভেজে নিতে হবে। তারপর একে একে রসুনবাটা, আদাবাটা ও রাধুনি (গুঁড়া সজ) বাটা ও হলুদের গুঁড়া দিয়ে ভালো করে কষাতে হবে। কষানো হলে লাউ দিতে হবে। লাউ দিয়ে কিছুক্ষণ কষিয়ে অল্প পরিমাণে পানি দিতে হবে। পানি ফুটে উঠলে আগে থেকে হালকা করে ভেজে রাখা টাকি মাছ দিতে হবে। পানি শুকিয়ে এলে কাঁচা মরিচের ফালি ও সবশেষে ধনেপাতা দিয়ে নামিয়ে ফেলতে হবে।
উপকরণ: চিংড়ি মাছ ২০০ গ্রাম, সয়াবিন তেল পরিমাণমতো, বাঁধাকপি কুচি ১ কাপ, ক্যাপসিকাম কুচি ১ কাপ, টমেটো কুচি আধা কাপ, পেঁয়াজপাতা কুচি ১ কাপ, কাঁচা মরিচবাটা ১ চা-চামচ, ধনেপাতাবাটা ১ চা-চামচ, হলুদের গুঁড়া পরিমাণমতো, চিলি সস ২ চা-চামচ, টমেটো সস ২ চা-চামচ, বাঁধাকপির ভেতরের পাতা ৪টি, ভিনেগার ২ চা-চামচ, রসুন ১ চা-চামচ ও লবণ স্বাদমতো।
প্রণালি: বাঁধাকপির শক্ত অংশ ফেলে দিন। পাতার ভেতরের অংশ একটু ভাপিয়ে রাখুন। মাছ ধুয়ে ভিনেগার মাখিয়ে রাখুন। এবার কড়াইয়ে সয়াবিন তেল গরম হলে তাতে রসুন কুচি দিয়ে মাছগুলো দিন। একে একে কোঁচানো বাঁধাকপি, ক্যাপসিকাম, টমেটো ও পেঁয়াজপাতা দিয়ে নেড়েচেড়ে নিন। এরপর কাঁচা মরিচবাটা, ধনেপাতাবাটা, চিলি সস ও টমেটো সস দিয়ে নেড়ে নিন। পানি শুকিয়ে এলে নামিয়ে বাঁধাকপির পাতায় অল্প করে চিংড়ি মাছ সুতা দিয়ে বেঁধে স্টিমারে ভাপিয়ে নিন। সুতো কেটে পাতা খুলে পরিবেশন করুন।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন