এগ্রোবিজ
সারের বস্তায় ওজনে কম, ঠকছেন চাষিরা
লেখক
প্রথম আলো- সারে ওজনে কম এবং চাঁদাবাজির অভিযোগে ১৪ আগস্ট বিসিআইসির চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে ডিলারদের সংগঠন বিএফএর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা
- ■ খোলাবাজারে এক কেজি ইউরিয়া সারের দাম ১৬ টাকা। এক বস্তা ৮০০ টাকা
সরকারি কারখানার সার কিনে ঠকছেন কৃষকেরা। দেশের একজন গরিব চাষি ৫০ কেজির এক বস্তা দানাদার ইউরিয়া সার কিনলে ওজনে এক থেকে আড়াই কেজি কম পাচ্ছেন। খোলাবাজারে এক কেজি ইউরিয়া সারের দাম ১৬ টাকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ও জামালপুরের যমুনা সার কারখানার বিরুদ্ধে সারের বস্তায় ওজনে কম দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
মূলত সার কারখানা দুটির পরিবেশক বা ডিলাররা ওজনে কম দেওয়ার অভিযোগ করে আসছিলেন। সম্প্রতি দুটি কারখানা থেকে বের হওয়া সারের ট্রাক থেকে বস্তা নামিয়ে এবং পরিবেশক ও খুচরা দোকানে বস্তার ওজন মেপে এই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। সার মাপার ভিডিও রয়েছে প্রথম আলোর কাছে।
আশুগঞ্জ সার কারখানা (আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড) নিজের উৎপাদিত ইউরিয়া সারেই ওজনে কম দিচ্ছে। অন্যদিকে যমুনার (যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড) নিজের উৎপাদিত সার নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। তবে তারা আমদানি করা যে সার পরিবেশকদের দেয়, সেখানে ওজনে কম পাওয়া গেছে।
শুধু ওজনে কম নয়, কারখানা দুটিতে সার নিতে গিয়ে ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হচ্ছে পরিবেশকদের। অভিযোগ আছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হয়।
আশুগঞ্জ ও যমুনা সার কারখানা শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) মালিকানাধীন। সংস্থাটির অধীনে মোট চারটি ইউরিয়া সার কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটিতে চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি বন্ধ রয়েছে। অন্যটি সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড। এটি অবশ্য চালু রয়েছে।
ওজনে কম দেওয়া এবং চাঁদা নেওয়ার অভিযোগে গত ১৪ আগস্ট বিসিআইসির চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক, আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছিল ডিলারদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা।
এ বিষয়ে বিসিআইসি বলছে, অতীতে সারে কম দেওয়ার অভিযোগ তারা পেত। সাম্প্রতিককালে পায়নি। এ বিষয়ে তারা কঠোর অবস্থান নিয়েছে। সংস্থাটির পরিচালক (বাণিজ্যিক) মো. আমিন উল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে বলা আছে যে ৫০০ গ্রাম সারও কম দেওয়া যাবে না। এ অভিযোগ আমরা খতিয়ে দেখব।’
জমির উর্বরতা শক্তি বাড়াতে কৃষকেরা ইউরিয়া সার ব্যবহার করেন। ধান, গমসহ প্রায় সব ধরনের ফসল চাষে দেশে এই সার ব্যবহার করেন কৃষকেরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহাজাদাপুর ইউনিয়নের কৃষক রাহুল ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, জমি চাষের জন্য প্রতি বছর ৫০ বস্তার মতো ইউরিয়া সার কিনতে হয় তাঁকে। অনেক দিন ধরেই তাঁর সন্দেহ হচ্ছিল বস্তায় এক থেকে দেড় কেজি সার কম থাকতে পারে। একবার বস্তার ওজনও করেছিলেন। প্রায় দুই কেজি সার কম থাকার কথা দোকানিকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। পরে তাঁর পরিচিত এক ডিলারকেও বস্তায় সার কম থাকার কথা বলেছিলেন।
ওজনে কতটুকু কম
আশুগঞ্জ সার কারখানা থেকে সরবরাহ করা প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় এক থেকে আড়াই কেজি সার কম দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন পরিবেশকেরা। এই কারখানা থেকে সারের বস্তা প্রথমে ট্রাকে করে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের নতুন ফেরিঘাট এলাকায় নিয়ে যান পরিবেশকেরা। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার সেখানে কথা হয় একাধিক পরিবেশকের সঙ্গে। তাঁদের অভিযোগের পর সত্যতা যাচাইয়ে ট্রাক থেকে নামিয়ে দুটি বস্তা মাপা হয়। দেখা যায়, বিসিআইসি লেখা ও আশুগঞ্জ সার কারখানার লোগোযুক্ত ৫০ কেজির একটি বস্তায় ৪৬ কেজি ৯৫০ গ্রাম এবং আরেকটিতে ৪৭ কেজি ৩৪০ গ্রাম দানাদার ইউরিয়া সার রয়েছে।
আশুগঞ্জ সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহাদাত হোসেন ওজনে কম থাকার একটি ব্যাখ্যা দেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বস্তায় সার ৫০ কেজির বেশি থাকে। দু-একটা বস্তায় হয়তো কম থাকে। পরিবেশকদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, কারখানায় সার মাপার যন্ত্রটি পুরোনো। মেরামত করে কাজ করতে হয়। তাই মাঝেমধ্যে কোনো বস্তায় বেশি, কোনোটায় কম যায়। তবে কমের পরিমাণ এক কেজির বেশি হয় না।
শাহাদাত হোসেন আরও বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানি। মাপার যন্ত্র মেরামত করতে বলেছি।’
অবশ্য পরিবেশকদের অভিযোগ, সব বস্তায়ই সার কম দেওয়া হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে কম পাওয়া যায়। শাহাদাত হোসেনের দাবির সত্যতা যাচাইয়ে গত শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের জগতবাজার এলাকার পুষ্প ট্রেডার্স, বাদল ট্রেডার্স, দাতা এন্টারপ্রাইজ ও রুহুল আমিন এন্টারপ্রাইজে গিয়ে সার মেপে এক থেকে দুই কেজি করে কম পাওয়া যায়। তবে কোথাও ৫০ কেজির বেশি পাওয়া যায়নি।
রুহুল আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যা চলছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় অভিযোগ জানানো হয়েছে। সমাধান হয়নি।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা বলছে, আশুগঞ্জ সার কারখানা থেকে বছরে গড়ে প্রায় দেড় লাখ টন দানাদার ইউরিয়া সার সাত জেলায় সরবরাহ করা হয়। হিসাব করে দেখা গেছে, গড়ে দেড় কেজি করে কম দেওয়া হলে মোট কম পাওয়া যায় সাড়ে চার হাজার টন। যার দাম প্রায় ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
বিএফএর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখার সভাপতি জালাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন-চার বছর ধরেই ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে। কতবার যে লিখিত অভিযোগ করেছি। কোনো লাভ হয়নি।’
আশুগঞ্জ সার কারখানা থেকে উৎপাদিত ইউরিয়া সার চাঁদপুর, কুমিল্লা, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সরবরাহ করা হয়। কিছু যায় সিলেট ও হবিগঞ্জে। ওই সব এলাকার কৃষকেরা ওজনে কম পেয়ে ঠকছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কৃষকেরা বস্তা দরে সার কিনে থাকেন। তাঁরা কখনো বস্তায় কতটুকু ওজন, তা মাপেন না। বিএফএর জেলা শাখার সভাপতি জালাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বস্তায় কম থাকায় কৃষকেরা কম পান। যেসব দোকানি বস্তা খুলে খুচরা সার বিক্রি করেন, তাঁরাও ঠকেন।
কারখানায় বস্তা ভরার পর গুদামে ও দোকানে দীর্ঘ সময় রাখার কারণে সারের ওজন কমে কি না, তা জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল সরকারি আরেকটি সার কারখানার একজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, রেখে দেওয়ার কারণে ওজন কমে না।
ঘাটতি যমুনায়ও
জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার যমুনা সার কারখানা থেকে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলাসহ মোট ১৯ জেলায় সার সরবরাহ করা হয়। ওই কারখানা থেকে পরিবেশকদের দুই ধরনের ইউরিয়া সার দেওয়া হয়। একটি যমুনার নিজস্ব উৎপাদিত সার, যা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই, ওজনও ঠিক থাকে। তবে আমদানি করা সারে ওজনে কম এবং নিম্নমানের সার দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
কারখানা সূত্র জানায়, খোলা আকাশের নিচে সার রাখার কারণে বৃষ্টিতে জমাট বেঁধে যায়। পরে ওই সার গুঁড়া করে পুনরায় বাজারজাত করা হয়। গত আগস্ট পর্যন্ত প্রতি ৯ টন যমুনার সারের সঙ্গে ৩ টন আমদানি করা যার নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। গত ২২ আগস্ট নষ্ট সার দেওয়ার অভিযোগে পরিবেশক সমিতি সার উত্তোলন বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর দুই টন করে আমদানি করা সার দেওয়ার নিয়ম করা হয়। অবশ্য বিসিআইসি বলছে, জমাট বাঁধলেও সারের গুণগত মান খারাপ হয় না। রং যদি পরিবর্তন হয়, তাহলে গুণগত মান খারাপ হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
পরিবেশকদের সমস্যা হলো কৃষকেরা আমদানি করা সার নিতে চান না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবেশক প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি করা সার নিম্নমানের। আবার আমদানি করা সারের প্রতি বস্তায় ওজন ৪ থেকে ৫ কেজি কম থাকে।
পরিবেশকদের দাবির সত্যতা যাচাইয়ে গত শুক্রবার দুপুরে জামালপুর সদর উপজেলার নান্দিনা বাজারের তিনটি দোকানে আমদানি করা সার মেপে দেখা যায়, একটি দোকানে (মুসলিম উদ্দিনের দোকান) সারের বস্তায় সাড়ে তিন কেজি কম পাওয়া যায়।
মুসলিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন,‘আমদানি করা সার বিক্রি করে আমাদের তেমন একটা লাভ হয় না। এসব সার নিম্নমানের। কৃষক নিতে চায় না। আবার আমদানি করা সারের প্রতিটি বস্তায় ওজনে কম থাকে।’
পরিবেশকেরা গত ২২ আগস্ট সার উত্তোলন বন্ধ করে যে আন্দোলন করেছিলেন, তাতে কিছুদিন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
অবশ্য যমুনা সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুদীপ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারখানায় আমি নতুন যোগদান করেছি। এখনো অনেক বিষয়ে আমি অবগত নই।’ তবে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখবেন বলে জানান তিনি।
আশুগঞ্জে সারের ট্রাকে চাঁদা
কারখানার ৩ নম্বর ফটক থেকে সারের বস্তা মাথায় করে নৌকায় ওঠাতে (হেডলোড) বস্তাপ্রতি সাড়ে সাত থেকে আট টাকা নেন ঠিকাদার ও কারখানার শ্রমিকেরা। এ ছাড়া কারখানার আরেকটি ফটক দিয়ে সারের বস্তা ট্রাকে ওঠাতে প্রতি বস্তার জন্য এক টাকা দিতে হয় ঠিকাদারের শ্রমিকদের। যদিও বস্তা ওঠাতে কারখানা কর্তৃপক্ষ প্রতিটি ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের ৬০ পয়সা করে দেয়। ট্রাকের সিরিয়াল পেতে দিতে হয় ৫০ টাকা। বস্তা ট্রাকে ওঠাতে ঠিকাদার নিয়োগ দেয় কারখানা কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয় ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মিন্টু মিয়া বলেন, শ্রমিকদের উন্নয়নের জন্য ট্রাকের সিরিয়াল বাবদ ৫০ টাকা করে রাখা হয়। আবার সেখান থেকে ৫০ শতাংশ টাকা ট্রাক মালিক সমিতিকে দেওয়া হয়।
অবশ্য বড় সমস্যা হলো ট্রাক ভাড়া বেশি, যা নির্ধারিত হয় ট্রাকমালিক ও শ্রমিকদের ইচ্ছায়। আশুগঞ্জ সার কারখানা থেকে নতুন ফেরিঘাট পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তা পরিবহনে ট্রাক মালিক সমিতিকে ট্রাকপ্রতি ১ হাজার ৯০০ টাকা করে দিতে হয়। পরিবেশকেরা বলছেন, এ ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।
ট্রাক মালিক সমিতির আহ্বায়ক বাদল সরকার বলেন, সার পরিবহনে ট্রাকপ্রতি ১ হাজার ৯০০ টাকার মধ্যে ৪০০ টাকা ‘লোডিং’ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিতে হয়। কারণ জানতে চাইলে লোডিং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম এন রহমানের স্বত্বাধিকারী তারেকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবেশকেরা খুশি হয়ে শ্রমিকদের বকশিশ দেন। এতে আমার কিছু করার নেই। আমাকে তাঁরা জানানও না। বাকি অভিযোগ সত্য নয়।’
যমুনায় ঘাটে ঘাটে চাঁদা
কৃষকেরা যেহেতু আমদানি করা সার কিনতে আগ্রহী নন, সেহেতু পরিবেশকেরাও যেকোনো উপায়ে এই সার নেওয়া এড়াতে চান। যমুনার সারের সঙ্গে আমদানি করা সার নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু আমদানি করা সার না নিয়ে (প্রতি ৯ টন যমুনার সারের সঙ্গে ২ টন আমদানি করা সার নিতে হয়) যমুনার শুধু নিজস্ব সার নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয় কারখানাকে ঘিরে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেট। এ জন্য দিতে হয় ট্রাকপ্রতি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা।
গত ২৪ আগস্ট কারখানায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পরিবেশকদের জন্য বরাদ্দকৃত সার উত্তোলন করা হচ্ছে। আমদানি করা সারের বদলে শুধু যমুনার সার ট্রাকে তোলার বিষয়ে কারখানার উপসহকারী কারিগরি কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেন, তারাকান্দি ট্রাক-ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি স্লিপ দেয়। পরে কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলেই শুধু এ কারখানায় উৎপাদিত সার দেওয়া হয়।
ট্রাক-ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির নেতা আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমাদের স্লিপ দেখালেই কর্তৃপক্ষ শুধু কারখানায় উৎপাদিত সার দেবে কেন?’
যমুনা সার কারখানা ঘিরে পরিবেশকদের কাছ থেকে চারটি ক্ষেত্রে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। ট্রাক বের করার সময় বস্তাপ্রতি দেড় টাকা করে নেয় তারাকান্দি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতি। ট্রাক ভাড়ার ১০ শতাংশ নেয় তারাকান্দি ট্রাক-ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি। তবে স্থানীয় ট্রাকের জন্য ছাড় আছে। কারখানায় ঢোকানোর জন্য ট্রাকপ্রতি ১২০ টাকা নেয় তারাকান্দি ট্রাক-ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান চালক শ্রমিক ইউনিয়ন এবং কারখানায় সার ট্রাকে ওঠাতে ট্রাকপ্রতি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা নেন কারখানা নিয়োজিত ঠিকাদারের শ্রমিকেরা। যদিও শ্রমিক নিয়োগ করা ঠিকাদারকে কারখানা কর্তৃপক্ষই মজুরি বাবদ টাকা দেয়।
পরিবেশকদের অভিযোগ, যমুনা সার কারখানাকে ঘিরে গড়ে ওঠা সংগঠনের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী তারাকান্দি ট্রাক-ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি। এ সমিতির নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন ওই সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম ওরফে মানিক। অন্য যেসব সংগঠন রয়েছে, সেগুলোও নিয়ন্ত্রণ করেন আশরাফুল ও তাঁর ঘনিষ্ঠ লোকজন। চাঁদা নেওয়াসহ সবকিছু তাঁরা করেন প্রকাশ্যে। সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের দু-তিনজন নেতা মিলে এসব টাকা খরচ করেন। প্রভাবশালীদের ভাগও দেন।
চাঁদা তোলার বিষয়টি অস্বীকার করেননি আশরাফুল আলমও। তবে তাঁর দাবি, এ টাকা তাঁর নেতৃত্বাধীন সমিতি নেয় না। এর ওপর তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণও নেই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে তারাকান্দি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি নামে একটি সমিতি আছে। তারাই সারের বস্তাপ্রতি এক থেকে দেড় টাকা চাঁদা নেয়। এজেন্সির নেতারা সেই টাকা শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করেন।’
মালিক সমিতির নামে প্রতিটি ট্রাক থেকে ১০ শতাংশ হারে চাঁদা নেওয়ার বিষয়ে আশরাফুল বলেন, এ টাকা শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করে সমিতি। সার কারখানায় ২৮ বছর ধরে এ নিয়ম চলছে।
আর ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির সভাপতি মোজাম্মেল হক বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই।’
নাম না প্রকাশের শর্তে যমুনা সার কারখানার একজন কর্মকর্তা বলেন, কারখানা কর্তৃপক্ষ ওই সিন্ডিকেটের কাছে আসলেই অসহায়। কিছু বলতে গেলে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
সারে ওজন কম দেওয়া এবং কারখানা থেকে সারের বস্তা ট্রাকে ওঠাতে ঘাটে ঘাটে চাঁদা দেওয়ার বিষয়টি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যাদের হাতেই ক্ষমতা আছে, তারাই মানুষকে হয়রানি করে। সারের বস্তায় ওজনে কম দেওয়া উদ্বেগজনক। কারণ, দেশের কৃষকেরা এমনিতেই তাঁদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না। আবার সারে ওজনে কম পেয়েও ঠকেন।
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে হতে পারে সারের সংকট
-
বিদেশ থেকে খালি হাতে ফিরে ড্রাগন চাষে সাফল্য
-
নাসিরনগরে বন্যায় তলিয়ে গেল কৃষকের বাদামখেত
-
পানি দিতে অতিরিক্ত টাকা
-
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
-
‘শিক্ষিত কৃষক’ বলেই তাঁকে নিয়ে মানুষের আগ্রহটা বেশি
-
ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বীজ কিনে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত
-
বোরো কাটতে বাড়তি খরচ ঃ হাসি নেই কৃষকের মুখে
-
পেঁয়াজের ক্ষতি পুষিয়ে দিচ্ছে সাথি ফসল বাঙ্গি
-
জিংক সমৃদ্ধ পুষ্টি ধানের চাষে কৃষকদের জামানতবিহীন ঋণ দেবে কৃষি ব্যাংক, কী লাভ এই চাল উৎপাদন বাড়লে?
চলতি বোরো মৌসুমে সার কিনতে কৃষকদের সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা করে বেশি দিতে হয়েছে। আর সরকারকেও সার বাবদ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বাজেটে বরাদ্দের তিন গুণের বেশি—প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ এখন মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) সার আমদানি নিয়ে বিপাকে পড়েছে।
ধান, আলু ও সবজি চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এমওপি সারের ৬০ শতাংশ আনা হতো রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে। ওই দুই দেশ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ায় এখন বাংলাদেশকে এমওপি কিনতে হচ্ছে কানাডা থেকে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া ও আমদানিতে অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশে সারের সংকট হতে পারে। ভর্তুকির চাপ সামলাতে বাংলাদেশকে সব ধরনের সারের খুচরা মূল্য বাড়াতে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশে সার সরবরাহ ও ব্যবহারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এমওপি সারের ২০ শতাংশ সরবরাহ কমানো হলে সামনের বোরো মৌসুমে ধান, গম ও রবি মৌসুমের অন্যান্য ফসলের উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমতে পারে। এতে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
এমনিতেই এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সারের কারণে নতুন করে যাতে আর সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এ এম এম শওকত আলী, সাবেক কৃষিসচিব
তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, দেশে চলতি বোরো মৌসুমে নতুন করে আর সারের দরকার হবে না। সামনে আলুর মৌসুমে ইউরিয়া, এমওপিসহ অন্যান্য সারের চাহিদা বাড়বে। ওই সময়ের জন্য সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ কানাডা ও মধ্যপ্রাচ্যের সার সরবরাহকারী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।
জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কানাডা থেকে মোট আট লাখ টন এমওপি সার আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি। এ ব্যাপারে ওই দেশের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা স্মারক হয়েছে। ফলে এই সার নিয়ে সরকারের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। তবে সার বাবদ সরকারের বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি বাড়ছে। এই চাপ নিয়েও সরকার ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ওই ভর্তুকি দিয়ে যাবে।’
কমানো হয়েছে চাহিদা
বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে ৬৯ লাখ টন রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি—এই চার ধরনের সার ব্যবহার হয় ৫৭ লাখ টন। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের ওই চার ধরনের সারের চাহিদা কমিয়ে ৫৫ লাখ ৫০ হাজার টনে নামিয়ে আনা হয়েছে।
দেশে প্রয়োজনীয় সারের ৮০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে এমওপি সারের বড় অংশ আসে রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে।
প্রসঙ্গত, ওই চারটি প্রধান সার কৃষকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। চলতি অর্থবছরে সরকার প্রাথমিকভাবে সারে ভর্তুকি বাবদ ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে গত ছয় মাসে সারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বেশির ভাগ সারের দাম তিন থেকে চার গুণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারকে ভর্তুকির পরিমাণ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা করতে হয়। কিন্তু অর্থবছরের শেষের দিকে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে হিসাব করে দেখা হয়েছে, ভর্তুকির পরিমাণ এবার বেড়ে কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকা গিয়ে দাঁড়াবে।
জিপসাম, জিংক সালফেট ও অ্যামোনিয়াম সালফেট ও ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সারে সরকার কোনো ভর্তুকি দেয় না। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কিনে ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছে তা বিক্রি করে থাকেন। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষককেও বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে।
সাবেক কৃষিসচিব এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতেই এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সারের কারণে নতুন করে যাতে আর সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সরকারের অন্যান্য খাতের ভর্তুকি কমিয়ে প্রয়োজনে সারে ভর্তুকি বাড়াতে হবে, যাতে সারের দাম কম থাকে। কারণ, কৃষকের হাতে এখন টাকা কম। বিশ্ববাজার থেকেও খাদ্য আমদানি করা সামনের দিনে আরও কঠিন হতে পারে। ফলে দেশের উৎপাদন ঠিক রাখতে সারের দাম ও জোগান ঠিক রাখা উচিত।
মিরাজুল ইসলাম (৩৩)। ১০ বছর সৌদি আরবে ছিলেন। আকামা জটিলতায় খালি হাতে দেশে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এক বছর বেকার থাকার পর ইউটিউবে পতিত জমিতে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখেন। বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে নেমে পড়েন ড্রাগন চাষে। দেড় বছরের ব্যবধানে এখন উপজেলার সবচেয়ে বড় ড্রাগন বাগান তাঁর। এ বছর খরচ বাদে আট থেকে নয় লাখ টাকা লাভের আশা করছেন তিনি।
পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার ইন্দুরকানি গ্রামের বাসিন্দা মিরাজুল। উপজেলার টগরা গ্রামে দেড় একর জমিতে তিনি ড্রাগনের বাগান তৈরি করেছেন। তাঁর বাগানে এখন সাড়ে তিন হাজার ড্রাগন ফলের গাছ আছে।
মিরাজুল ইসলাম বলেন, শ্রমিক হিসেবে ১০ বছর সৌদিতে কাজ করে ২০১৯ সালে দেশে ফেরেন তিনি। আকামা সমস্যার কারণে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কিছু একটা করবেন বলে ভাবছিলেন। একদিন ইউটিউবে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখতে পান। সেই থেকে ড্রাগন চাষে আগ্রহ জন্মে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দেড় একর পতিত জমি ড্রাগন চাষের উপযোগী করেন। গাজীপুর থেকে ৬০ টাকা দরে ৬০০ চারা নিয়ে আসেন। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে শুরু করেন চাষাবাদ। পরের বছর জুনে ফল পাওয়া শুরু করেন।
ড্রাগনের বাগান করতে মিরাজুলের খরচ হয়েছিল ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। ইতিমধ্যে ফল বিক্রি করে তাঁর খরচ উঠে গেছে। সাধারণত মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গাছে ফল আসে। বছরে ছয় থেকে সাতবার পাকা ড্রাগন সংগ্রহ করা যায়। এখন পরিপক্ব ও রোগমুক্ত গাছের শাখা কেটে নিজেই চারা তৈরি করেন। ড্রাগন চাষের পাশাপাশি বাগানে চুইঝাল, এলাচ, চায়না লেবুসহ মৌসুমি সবজি চাষ করেন। এ ছাড়া ড্রাগনের চারাও উৎপাদন করে বিক্রি করেন তিনি।
মিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাগানের বেশির ভাগ গাছে এ বছর ফল ধরেছে। গত মঙ্গলবার বাগান থেকে দেড় টন ফল সংগ্রহ করেছেন। ২৫০ টাকা কেজি দরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছেন। স্থানীয় বাজারে ৩০০ টাকা কেজি দরে ড্রাগন বিক্রি হয়। নভেম্বর পর্যন্ত আরও পাঁচ–ছয়বার বাগান থেকে ফল তোলা যাবে। আশা করছেন, খরচ বাদে এবার আট থেকে নয় লাখ টাকা লাভ থাকবে।
মিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমার বাগান থেকে চারা নিয়ে অনেকে বাড়িতে ও ছাদে ছোট পরিসরে ড্রাগনের বাগান করেছেন। আমি এ পর্যন্ত ৪০ টাকায় দেড় হাজার চারা বিক্রি করেছি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পূর্ণ বয়সের একটি ড্রাগনের চারা রোপণের পর ২৫ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। এর মৃত্যুঝুঁকি নেই বললেই চলে। তবে কয়েক দিন পরপর সেচ দিতে হয়। বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হয়। ড্রাগন ফল চাষে রাসায়নিক সার দিতে হয় না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইশরাতুন্নেছা বলেন, মিরাজুল ইসলামকে ড্রাগন চাষে নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে আসছে কৃষি বিভাগ। উপজেলায় তাঁর বাগানটি সবচেয়ে বড়। তিনি নিরলস পরিশ্রম করে ছোট থেকে বাগানটি বড় করেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার গোয়ালনগর ইউনিয়নে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে কৃষকের প্রায় ৩০ হেক্টর বাদাম চাষের জমি। কয়েক দিন আগে উজানের পানিতে তাঁদের পাকা ধানের জমি তলিয়ে গিয়েছিল। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকেরা বাদাম চাষ করেছিলেন। আবারও ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ার বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হলেন চাষিরা।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ এপ্রিল উপজেলায় শিলাবৃষ্টি এবং ১৪ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত উজানের পানিতে কৃষকের পাকা ধানের জমি তলিয়ে যায়। কৃষকেরা সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ২০০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করেছিলেন। এর মধ্যে উপজেলার গোয়ালনগর ইউনিয়নে ৩০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করা হয়। উপজেলায় এবার প্রায় ৫০ হাজার মণ বাদাম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু উজানের পানিতে হঠাৎ বন্যায় সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গোয়ালনগর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আজহারুল হক বলেন, ‘নাসিরনগর উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাদাম চাষ করা হয় আমাদের ইউনিয়নে। কিন্তু এ বছর আগাম বন্যার কারণে কৃষকেরা তাঁদের ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। তাঁদের সব ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে।’
ওই এলাকার বাদামচাষি মেরাজ মিয়া বলেন, তিনি ছয় বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করেন। দু-এক দিনের মধ্যে বাদাম তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু খেতে গিয়ে দেখেন সব বাদাম পানির নিচে। এখন এই বাদাম তুলে কোনো লাভ নেই। এগুলো গরুও খাবে না।
মো. রজব আলী নামের এক কৃষক বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের জামারবালি, সোনাতলা ও মাইজখোলা গ্রামে বাদামখেত আছে। গত তিন দিনে পাঁচ-ছয় ফুট পানি বাড়ায় সব তলিয়ে গেছে। এখন বাদাম তুলতে কাজের লোকও পাওয়া যাচ্ছে না।’
কৃষক ফতু মিয়া বলেন, গোয়ালনগর ইউনিয়নের বাদাম চাষের জমিগুলো হঠাৎ পানি আসায় তলিয়ে গেছে। ফসল তলিয়ে তাঁদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। কয়েক দিন আগেও পাকা ধান পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। কৃষকদের দাবি, গোয়ালনগরে বাদাম চাষের জমি তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকদের প্রায় কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবু সাইদ প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলার কয়েকটি চরাঞ্চলে বাদাম চাষ করা হয়। চরাঞ্চলের উঁচু জমিতে প্রথমে আলু চাষের পর বাদাম চাষ করা হয়। আগাম বন্যার কারণে নিচু এলাকার কিছু বাদামখেত পানিতে তলিয়ে গেছে।
আবু সাইদ আরও বলেন, ১৫-২০ দিন আগে উপজেলার প্রায় সব বাদাম উঠে গেছে। গোয়ালনগর ইউনিয়নে ৩০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করা হয়েছিল। এর মধ্যে এক হেক্টর জমির বাদাম তলিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ৭০ হাজার টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সিলেটে বন্যা হওয়ায় এমনটি হয়েছে বলে তিনি জানান।
ঠাকুরগাঁওয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) একটি গভীর নলকূপের সেচের পানি সরবরাহে কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে। ভুক্তভোগী কৃষকদের কাছ থেকে পাওয়া এমন অভিযোগের তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বড় বালিয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে।
ভুক্তভোগী কৃষকেরা বলছেন, সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের বাইরে কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু বিএমডিএর ১০৮ নম্বর গভীর নলকূপের অপারেটরের দায়িত্বে থাকা বিউটি বেগমের স্বামী আকতারুজ্জামান বোরো ধান চাষের জন্য প্রতি বিঘার জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা ও অন্য মৌসুমে ৩০০ টাকা নেন। ১০ বছর ধরে তিনি এভাবেই বাণিজ্য করে আসছেন।
সম্প্রতি রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে বিএমডিএর গভীর নলকূপ থেকে খেতে সেচের পানি পেতে হয়রানির শিকার দুই কৃষকের মৃত্যুর ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়।
ঠাকুরগাঁও জেলায় বিএমডিএর ১ হাজার ৪৩১টি গভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে সচল ১ হাজার ৪১৮টি। সেচের আওতায় ৭৬ হাজার ৫০০ পরিবারের জমি রয়েছে ৫৩ হাজার ৫০০ হেক্টর।
* সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের বাইরে কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই। * সেচের আওতায় ৭৬ হাজার ৫০০ পরিবারের জমি আছে। * কৃষকদের নলকূপের আবেদন পেলে যাচাই করে স্কিম তৈরি করা হয়।
বিএমডিএ সূত্রে জানা গেছে, কৃষকদের নলকূপের আবেদন পেলে যাচাই করে স্কিম তৈরি করা হয়। এরপর সমবায়ের ভিত্তিতে অংশীদারি ফি বাবদ এক লাখ টাকা জমা দিতে হয়। এই নলকূপ পরিচালনার জন্য বিএমডিএ একজন অপারেটর নিয়োগ দেন। প্রিপেইড মিটারিং পদ্ধতিতে কৃষকের নিজ নামে প্রিপেইড কার্ড থাকতে হয়। সেই কার্ড থেকে প্রতি ঘণ্টায় সেচের পানির জন্য ন্যূনতম ১১০ টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে নেওয়া হয়। এর বাইরে অতিরিক্ত কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই।
বড় বালিয়া এলাকার কৃষকেরা জানান, ২০১১ সালের দিকে বড় বালিয়া মণ্ডলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আকতারুজ্জামান এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ফি হিসেবে এক লাখ জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও কোনো কৃষক সেটা দিতে এগিয়ে আসেননি। ফলে আকতারুজ্জামান, দাউদুল ইসলাম ও জোবায়দুর রহমান মিলে অংশীদারি ফি দেন। আকতারুজ্জামানের ৮০ শতাংশ টাকা থাকায় গভীর নলকূপের নিয়ন্ত্রণ তিনিই পান। অপারেটর হিসেবে নিয়োগ পান তাঁর স্ত্রী বিউটি বেগম। যদিও কৃষকেরা আকতারুজ্জামানকেই অপারেটর হিসেবে জানতেন।
সেচের পানি পেতে হয়রানির শিকার হয়ে সদর উপজেলার বড় বালিয়া এলাকার ৫০ জন কৃষক গত ১৭ এপ্রিল বিএমডিএ সহকারী প্রকৌশলীর কাছে অভিযোগ দেন। সেখানে গিয়ে কৃষক ও অপারেটরের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।
ভুক্তভোগী কৃষকেরা বলেন, ২০১২ সালে নলকূপটি চালু হলে আওতাধীন কৃষকের কাছ থেকে আকতারুজ্জামান সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের অতিরিক্ত টাকা আদায় শুরু করেন। আর সেই টাকা থেকে তিনি মাঝেমধ্যে অন্য দুই অংশীদারকে কিছু টাকা ভাগ দেন।
ভুক্তভোগী কৃষক মো. শাহজাহান আলী বলেন, গভীর নলকূপটির আওতায় তাঁর ১০ বিঘা জমি রয়েছে। কার্ডের বাইরে টাকা দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও আকতারুজ্জামানকে প্রতি বিঘায় সেচের জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা দিতে হয়। এই টাকা না দিলে তিনি পানি দেন না।
ওই নলকূপের আওতায় চার বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করছেন কৃষক মো. হেলাল। তিনি অতিরিক্ত টাকা না দেওয়ায় অপারেটর খেতে পানি দেননি। এতে জমি ফেটে যায়। পরে তিনি শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে জমিতে সেচ দিয়ে খেত রক্ষা করেছেন।
আরেক ভুক্তভোগী মোকলেসুর রহমান বলেন, ১০ বছর ধরে সেচের পানির জন্য অতিরিক্ত টাকা দিয়ে আসছেন। এখন বিরক্ত হয়ে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। এরপরও কোনো বিচার পাননি।
এ বিষয়ে মো. আকতারুজ্জামান বলেন, তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর দেখেন গ্রামে কোনো গভীর নলকূপ নেই। পরে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে নলকূপটি স্থাপন করেন। কৃষকেরা অংশীদারত্বের টাকা দিতে রাজি না হলে তিনি বিএমডিএকে জানান। সে সময় তাঁরা টাকা দিয়ে দিতে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘পরে আপনি টাকাটা ধীরে ধীরে তুলে নেবেন।’ সেই পরামর্শেই সেচের পানি বাবদ প্রিপেইড কার্ডের অতিরিক্ত কিছু টাকা তিনি নিচ্ছেন। জোর করে কিছু নিচ্ছেন না।
বিএমডিএ ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, অভিযোগটি যাচাই করে সত্যতা পাওয়া গেছে। নলকূপটি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওই অপারেটরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এগ্রোটেক
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
লেখক
প্রথম আলোডাচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে দুই দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।
গতকাল সোমবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অনুষ্ঠিত কৃষি খাতের ব্যবসাবিষয়ক এক সম্মেলনে দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এগ্রি বিজনেস কনক্লেভে বাংলাদেশের প্রায় ৪০জন উদ্যোক্তা ডাচ কৃষি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি প্রযুক্তি সহযোগিতা ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছে ওয়েগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়।
আলোচনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তি কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি সহযোগিতা দিতে রাজি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে ডাচরা প্রস্তুত এবং বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও তাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া ডাচ সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বীজ, পশু খাদ্য, পোলট্রি, হর্টিকালচার ও এ্যাকুয়াকালচার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করেছে, যা ওই দেশের বেসরকারি খাতকে আরও উৎসাহিত করেছে।
আলোচনায় কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তৈরি আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্কয়ার, ইস্পাহানি এগ্রো, একে খান অ্যান্ড কোম্পানি, প্যারাগন গ্রুপ, এসিআই, জেমকন গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ডাচ প্রযুক্তির প্রয়োগ সরেজমিনে দেখতে যাবেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের পোল্ট্রিখাতে সহযোগিতার আলোচনা অনেকটা এগিয়েছে উল্লেখ করে মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দুই দেশের মধ্যে মৎস্য, পশুপালন ও হর্টিকালচারে সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা আছে।
কনক্লেভ আয়োজনে প্রথমবারের মতো দূতাবাসের সঙ্গে অংশীদার হয়েছে নেদারল্যান্ডসের কৃষি মন্ত্রণালয়, নেদারল্যান্ডস এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি, নেদারল্যান্ডস ফুড পার্টনারশিপ, ডাচ-গ্রিন-হাইজডেল্টা, লারিভ ইন্টারন্যাশনাল, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ।
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী নেদারল্যান্ডসের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কম। ২০২১-এ কৃষিপণ্য ও খাদ্য রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন