ফসল
সংকটের সময়কে সম্ভাবনায় রূপান্তর, শ্রদ্ধা সকল কৃষক ভাইদের প্রতি
লেখক
ঢাকা ট্রিবিউনযে মূল্য আমরা কৃষককে দিই তা সম্ভবত কখনোই যথেষ্ট নয়। শ্রদ্ধা সকল কৃষক ভাইদের প্রতি, যাদের অকৃত্রিম ভালোবাসায় আমাদের সভ্যতা টিকে আছে
“রুটি, মদ ফুরিয়ে যাবে। প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে কিন্তু বইখানা রয়ে যাবে অনন্ত- যৌবনা- যদি তেমন বই হয়।” – ওমর খৈয়াম। আমি বই পড়তে পছন্দ করি। বন্ধুরা বলে, বইয়ের সাথে নির্বাসনে দিলে আমি নাকি দিব্যি আনন্দে সময় কাটিয়ে দিতে পারবো। কথা সম্ভবত খুবই সত্যি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে শহর থেকে গ্রামে আসার সময় সবেমাত্র দুটি বই নিয়ে এসেছি। সিনেমা যা নিয়ে এসেছিলাম তাও শেষ প্রথম কয়েকদিনেই। তাই পুনরায় দেখা শুরু করলাম। বুঝতেই পারিনি এতোদিনের জন্য গ্রামের (কালীগঞ্জ, গাজীপুর) বাড়িতে আটকে যাবো। এখানের পরিস্থিতি ততোটা ভালো না। এখনো পর্যন্ত (২০ এপ্রিল) আমাদের উপজেলায় ৪৪ জনের করোনা পজিটিভ হয়েছে। তার মধ্যে শুধুমাত্র গত ২৪ ঘন্টায় ৩১ জন শনাক্ত হয়েছে। পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নে কয়েকজন সংক্রমিত হওয়ার পর এখানের চলাফেরায় অনেক কড়াকড়ি করা হয়েছে। সময় কিভাবে কাটাবো সে এক মহা আতংকের বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। প্রায় বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। অবশেষে চিন্তা করলাম, এই খারাপ সময়গুলোকে ভালো সময়ে রূপান্তরিত করার অন্তত একটা প্রচেষ্টা তো করতে পারি। হঠাৎ করেই নতুন কিছু একটা করার ঝোঁক তৈরি হল। তারপরেই দৃষ্টি পড়ল কৃষি কাজের দিকে।
এই সংকট আমাদের নিত্যদিনের গতানুগতিক জীবন যাপনের পদ্ধতিকে ভেঙে দিয়েছে। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে আমাদের যাবতীয় ব্যবস্থার প্রতি। বলে রাখা ভাল, আমাদের পরিবার সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করার চেষ্টা করছে, যদিও গ্রামে তা বেশ কঠিন। তবুও নিজেদের সীমানা আর পরিসরের মধ্যে থেকেই যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করছি আমরা।
এখানের সকালটা শুরু হয় ভিন্নরকম সৌন্দর্য দিয়ে। দোয়েলের শিস, কবুতরের ডাক, মোরগের ডাকসহ বিচিত্র পাখির কোলাহলে মুখরিত গ্রামের সকাল। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে প্রার্থনা করি। তারপর অল্প সময় মেডিটেশন। মনের চর্চার পর কিছুটা শরীরচর্চাও করি বটে। কারণ এই সময়ে মন এবং শরীর দুটো সুস্থ রাখাই গুরুত্বপূর্ণ। একাডেমিক পড়াশোনায় হাত দেওয়ার পূর্বে কখনো চা-বিস্কুট থাকে কখনো শুধুমাত্র বিস্কুট-ই থাকে। পড়াশোনা শেষে ঘড়ির কাঁটা যখন সকাল নটা ছুঁই ছুঁই তখন আমাদের নাস্তার সময়।
নাস্তার পরই মূলত শুরু হয় কৃষি সংক্রান্ত কার্যক্রম। এখন দিনের একটা বড় অংশ কৃষি কাজে ব্যয় হচ্ছে। বিভিন্ন গাছের যত্ন নেওয়া, আগাছা নিধন, ভূমি প্রস্তুত, বীজ রোপণ, মাচা মেরামত, গাছের ডালপালা কর্তন এই সবই আপাতত আমাদের কৃষি কাজের গুরুত্বের প্রধান সারণীতে। উল্লেখ্য যদিও আমি গ্রামে জন্মেছি তবুও এই ব্যাপারে আমার একেবারেই জানাশোনা ছিলো না। কারণ যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে এই ভয়ে শৈশবে মা-বাবা দূরে রেখেছিল। তাই নতুন করে অনেক কিছু জানতে হচ্ছে, শিখতে হচ্ছে।
এখন লেবু গাছ, আমগাছ, জাম্বুরা গাছ, জামগাছ, কাঁঠাল গাছ এবং পেয়ারা গাছের যত্ন দিচ্ছি। কোনোটাতে শুধুমাত্র গাছের গোড়ায় মাটি দিলেই হয়ে যাচ্ছে। আবার কোনোটাতে আগাছা পরিষ্কার করে, মাটি আলগা করে গোবর (জৈব সার) মিশিয়ে দিতে হয়েছে। আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে, ইতোমধ্যে লেবু, জাম্বুরা, আম, কাঁঠাল হয়েছে এবং বেড়ে উঠছে। পেয়ারা এবং জামগাছে ফুল হয়েছে। অন্যদিকে আমড়া গাছে ফুল হয়েছে, নারিকেল আছে গাছে, বেল প্রায় পরিণত হয়ে গেছে। কিন্তু কি এক অজানা কারণে এই বেল গাছে তিন কিংবা চারটির বেশি বেল কখনোই দেখা যায়নি। যেহেতু বাজার বন্ধ তাই আর নতুন করে কোনো গাছ লাগানো যাচ্ছে না। শুধুমাত্র একটি পেঁপে চারা এবং কয়েকটি সজনে ঢাল রোপণ করা হয়েছে। অবশ্য ২ দিন পূর্বে বেশ কয়েকটি কলা চারা রোপণ করা হয়েছে। এই সময়ে ত্রাণ চুরির ঘটনা দেখে উপলব্ধি করলাম, আঙুল ফুলে কিভাবে কলাগাছ হয়! যাই হোক সাগর, সবরি, চাম্পা, গেরা এই চার জাতের কলাগাছ রোপণ করা হয়েছে। মনে পড়ছে বিখ্যাত গ্রামীণ প্রবাদ, “কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।”
আমরা শাক-সবজি বাগানের পরিসর বৃদ্ধি করেছি। লাল শাক পরিণত হয়েছে৷ বেগুন হচ্ছে এবং ঢেঁড়শ চারা বড় হচ্ছে। চাল কুমড়া এবং করলা চারা রোপণ করা হয়েছে। শসা, বাঙ্গি এবং মেস্তা পাতা (চুকুর) চারা এখনো বীজতলায়, মাটি প্রস্তুত করা হচ্ছে। ধুন্দুল চারা সংগ্রহ করেছি। চিচিঙ্গা বীজ খুঁজছি কিন্তু এখনো পাইনি। পেস্তা রোপণ করা হয়েছে। কাকরোল চারা পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্প পরিসরে রোপণ করা হয়েছে। একটি মাচা প্রস্তুত করা হয়েছে। আরও সম্ভবত দুটি মাচা প্রস্তুত করতে হবে। বৃষ্টি পেয়ে ধনিয়া পাতা আরও সুন্দর হয়েছে। অতি সম্প্রতি আগাছা এবং বিচ্ছিন্ন জায়গা থেকে ১২টি টমেটো চারা উদ্ধার করেছি। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, অল্প কয়েকদিনের যত্নে এখন চারা প্রায় ফলবান হয়ে উঠেছে।
বাড়ির আশেপাশের আগাছা-ময়লা পরিষ্কার করে, দু-এক জায়গায় মাটি তুলেছি। জীবনে এই প্রথম এতোটা সময় ধরে মাটি কাটা এবং মাটি নেওয়ার অভিজ্ঞতা। কিছুটা কষ্টকর এবং আনন্দময় এই অভিজ্ঞতা। মাটি যেন অপসারিত না হয় সে জন্য দূর্বাঘাসও রোপণ করতে হয়েছে। বৈশাখ মাস বলে ঝড়ের প্রবল সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে, সেক্ষেত্র চারা গাছের জন্য ঠিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিককালে পুকুর পাড়ের সব আগাছা পরিষ্কার করেছি। মাছের জন্য খাবার কেনা হয়েছে। এমনকি মাছ লাউ পাতা খেতেও পছন্দ করে। প্রশ্ন করতে পারেন কিভাবে জানলাম? তিনদিন পূর্বে লাউ গাছ মাচা থেকে পুরোপুরি অপসারণ করা হয়েছে তারই কিছুটা অংশ পুকুরে পড়েছিল। দেখলাম লাউ গাছের পাতা একটিও নেই শুধুমাত্র ডাটা আছে! প্রায় বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করছি। অধিকাংশ সময় সরপুঁটি মাছ ধরে, তবে কখনো কখনো তেলাপিয়া, কার্প, শিং এবং অল্পবিস্তর রুই মাছের দেখাও মিলে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, পুকুরের পাড়গুলো মেরামত করবো এবং কিছুটা গুছিয়ে মাছ চাষ করবো।
সম্প্রতি ঘুঘুপাখি ঘরের পাশে বাসা বেঁধেছে। ঘুঘুপাখি একটানা ডাকে। কি যে মায়াবী সুর। মন কোথায় যেন হারিয়ে যায়! বক এবং মাছরাঙা পাখি পুকুরে প্রতিদিন মাছ শিকারের জন্য ঘাপটি মেরে বসে থাকে। ফিঙে পাখির নৃত্য কি অসাধারণ! পুকুরের পাশে ডুমুর গাছ, সেখানে বুলবুলি পাখির চারটি বাচ্চা হয়েছে। মা পাখিটা সারাদিন বাচ্চাদের খাবার সন্ধানরত। শালিক, চড়ুই, দোয়েল, টিয়া, হলদে পাখি, কাঠঠোকরা, বক, মাছরাঙা, কোকিল, টুনটুনি, বাবুই, খয়েরি হাঁড়িচাচাসহ নাম না জানা কতো পাখির কোলাহলে মুখরিত আমাদের আঙ্গিনা। গন্ধরাজ গাছে ফুল ফুটেছে। কি মিষ্টি গন্ধ! প্রজাপতির ছড়াছড়ি। অন্যদিকে ফসলের মাঠে অনেক ফড়িংয়ের দেখা মেলে। নানারকম ঘাস ফুলেদের সাথে নিয়মিত পরিচিত হচ্ছি। নাম না জানা কতো রঙিন ফুলের ঠিকানা এই আগাছা।
বিকেলে ঘন্টাখানেক নিদ্রাযাপন করি। তারপর কিছুটা সময় পুরাতন সিনেমাগুলোই দেখি। সম্প্রতি পছন্দের তালিকায় যোগ হয়েছে কয়েক ক্যাটাগরির সিনেমা। যেমন: সত্য কাহিনী অবলম্বনে, উৎসাহমূলক এবং রহস্যময়। ঘুম থেকে জেগেই ধানক্ষেত পরিভ্রমণ করি। অবারিত সবুজ, মুক্ত আকাশ এবং মুক্ত বাতাস। বুকভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। এসব করে ঘরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। দুপুরে যদিও তীব্র রোদ কিন্তু সন্ধ্যার নিকটবর্তী সময়ে তাপমাত্রা কমতে থাকে। সম্ভবত গ্রামে এখনো কিছু গাছ আছে বলেই রক্ষা।
সন্ধ্যায় হালকা নাস্তার পর অনলাইনে ইংরেজি শিখতে বসি। আপাতত এক মাসের একটি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি। সেখানে ৩০ দিনে ৩০টি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের উপর লিখতে হবে। ইতোমধ্যে ১২ দিন সম্পন্ন করেছি। উল্লেখ্য আমার ভাষা শিক্ষা সহযোগী লস এঞ্জেলস থেকে উনি খুবই সহযোগিতাপরায়ণ এবং আন্তরিক। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শেষ হলে, রাতের খাবার খেতে যাই।
রাতের খাবারের পর প্রায় লিখতে বসি। আজকাল ঝড়ের কারণে মাঝেমধ্যেই বিদ্যুৎ থাকছে না। প্রথম দিকে মোমের ব্যবহার শুরু করেছিলাম। তবে শেষ পর্যন্ত পুরাতন হারিকেন উদ্ধার করলাম। প্রয়োজন হলে কখনো কখনো হারিকেনও ব্যবহার করছি। হারিকেনের আলো সে এক ভিন্নরকম সৌন্দর্য। যদি কখনো লিখতে গেলে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায় তবে লেখা থামাচ্ছি না! অন্ধকারেই লিখছি। যদিও লেখা কিছুটা আঁকাবাঁকা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ব্যাপারটা দারুণ উপভোগ্য।
সারাদিনই অল্প বিস্তর আড্ডা চলে পরিবারের সাথে। রাতে আলোচনার পরিমাণ আরও বাড়ে। আলোচনার নানা রকম বিষয় থাকে। যেমন: রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, ধর্মীয় বিষয়, করোনাভাইরাস, আমাদের দায়িত্ব, কখনো আলোচনার বিষয় আমাদের সীমানাও ছাড়িয়ে যায় বটে। ছোটবোন কাজিনের নিকট থেকে বেশ কয়েকটি বই সংগ্রহ করেছে। তার দিনের বড় অংশ কেটে যায় এইসব বই পড়েই। ইউটিউবে ভিডিও দেখে নিত্যনতুন রেসিপি তৈরি করার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি সেলাই মেশিনে কাপড় বানানো শিখছে। মা যদিও প্রায় সারাদিনই রান্না-বান্না সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত। তবুও কাথা মেরামতে কিছুটা সময় ব্যয় করছে। মাঝেমধ্যে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড এবং পাওয়ার পয়েন্টও শেখার চেষ্টা করছে। বাবা আর আমি প্রায় সারাদিনই কৃষি কাজে ব্যস্ত। বাবা দুই একদিন পরপর শুধুমাত্র প্রয়োজনে বাজারে যাচ্ছে। বাজারে দোকান খোলা থাকে সকাল ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত। পরিবারের সবাই নামাজগুলো ঘরেই আদায় করছে। নিয়ম করে হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চেষ্টা করছে।
পরিচিতি, ঘনিষ্টজনসহ যারা এখনো শহরে স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছে তাদের সাথে মাঝেমধ্যে যোগাযোগ রাখছি। যোগাযোগ রাখছি আত্নীয়-স্বজন, পরিচিত লোকজনের সাথেও। এমনকি পরিচিতদের মধ্যে যারা চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত তাদের সাথেও যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছি। অনলাইনে অল্প বিস্তর স্বেচ্ছাসেবী কাজও করছি বটে। তবে তা খুবই সামান্য।
হঠাৎ করেই বিভিন্ন রকম কৃষি কাজে অনেক বেশি জড়িত হওয়ার ফলে সর্দির একটা প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাড়িতে কয়েকটি তুলশী গাছ আছে বলে, সেক্ষেত্রে আর কোনো ঔষধের প্রয়োজনও পড়ছে না। সারাদিন মাঝেমধ্যে অনলাইন পত্রিকা দেখে দেশের খোঁজ-খবর রাখছি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকাগুলোতে প্রায় ঢুঁ মারছি। আমাদের একটা পোষা বিড়াল আছে। তার নাম বিল্টু। বিল্টুর সাথেও কিছুটা সময় কাটাচ্ছি। এছাড়াও মা-বাবা, ছোটবোন এবং প্রতিবেশীকে সহযোগিতা করা তো হচ্ছেই।
এতোকিছুর পরেও ছোটবোন প্রায় ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। খুব সহজেই রেগে যাচ্ছে। বাবার মেজাজও প্রায় বিগড়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো আমার সাথেও জটিলতা হচ্ছে। এমনকি মা ও মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত দীর্ঘদিন ঘরে আটকে থাকার ফলেই এই অবস্থা। এইসব দেখে কখনো কখনো আমার মেজাজও বিগড়ে যাচ্ছে। তবুও আমাকে আরও বেশি ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিতে হচ্ছে।
সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে রাত দশটার মধ্যেই ঘুমের অতল সাগরে হারিয়ে যাই। গভীর রাতে প্রায় ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। অবশ্য নীরবতার জন্য গভীর রাত উত্তম সময়। নীরবতা, নিস্তব্ধতা আমার অসম্ভব পছন্দ। যদিও নীরবতা আর নিস্তব্ধতা মানে শব্দহীনতা নয় বরং বৈচিত্রময় প্রাকৃতিক শব্দের সমাহার বলেই মনে হয়। গভীর রাতে শীতল পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। হাজারও জোনাকির সমাহার হয়। যেন আলোর মেলা বসেছে। প্রায় রাতে অজস্র তারাদেরও মেলা বসে। কখনো কখনো তারা গণনা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি তবুও সংখ্যা শেষ হয় না। এই একাকী সময়গুলো নিজেকে উপলব্ধি করা এবং নিজেকে গভীরভাবে জানার সুযোগ তৈরি করে দেয়। সুবিশাল, বিস্তীর্ণ পৃথিবীতে আমাদের প্রজ্ঞা, জ্ঞান কতোটা সীমিত। খুব মনে পড়ছিলো, কার্ল সাগানের সেই বিখ্যাত লেখাটাঃ “Pale Blue Dot: A Vision of the Human Future in Space”। কতোই না ক্ষুদ্র আমরা! কতোই না ক্ষুদ্র আমাদের পৃথিবী!
এখানের প্রায় প্রতিটি দিন আলাদা। প্রথাগত পদ্ধতি এখানে প্রায় অকার্যকর বলা চলে। কৃষির সাথে জীবনের একটা গভীর সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক মাঠে থাকলে আরও গভীরভাবে আবিষ্কার করা যায়। আহমদ ছফার “পুস্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ” বইয়ের প্রতিটি লাইন এখন আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছি। ফসল উৎপাদন কি যে সীমাহীন পরিশ্রমের কাজ, সম্ভবত তা শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা মুশকিল! একটা ধান কিংবা একটা লাউ পরিণত হওয়া পর্যন্ত কতগুলো ধাপ যে সম্পন্ন করতে হয় তা যদি কেউ জানতো, তাহলে সম্ভবত কোনোদিন কেউ খাদ্যের অপচয় করতো না। আর যে মূল্য আমরা কৃষককে দিই তা সম্ভবত কখনোই যথেষ্ট নয়। শ্রদ্ধা সকল কৃষক ভাইদের প্রতি, যাদের অকৃত্রিম ভালোবাসায় আমাদের সভ্যতা টিকে আছে।
আমাদের গ্রামে (সাইলদিয়া) যুবকদের বেশ কিছু উদ্যোগ আশা জাগানিয়া। গ্রামের বাহির থেকে সকল ধরনের সাধারণ পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অতি প্রয়োজন ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারেন না। গ্রামের প্রবেশপথে দুজন পাহারাদার রাখা হয়েছে। যারা বাজার থেকে ফিরে কিংবা গ্রামে প্রবেশ করে তাদের প্রত্যেকের হাত সাবান দিয়ে ধৌত করে তারপর প্রবেশ করতে হয়। যদিও সামাজিক দূরত্ব ব্যাপারটা ততোটা মানা হচ্ছে না। তবে গ্রামের যে দুটি দোকান রয়েছে তা খোলা এবং বন্ধের সময় নির্ধারণ করা আছে।
সময়টা বেশ সংকটের। আগামী দিনে সংকট হয়তো গভীর থেকে আরও গভীরতর হবে। এখন নিজেদের সাথে বোঝাপড়া করার সময়। ধীরে-স্থীরে, ভেবেচিন্তে পথ চলাই উত্তম। তবে আশার কথা হল, রাত যত গভীর হয় প্রভাত ততোটাই নিকটবর্তী। কিন্তু নিরাশার বিষয় হল, এমনকি কখনো কখনো এটাও সত্যি কোনো কোনো প্রভাত রাতের তীব্র অন্ধকারের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে৷ ঝড়, তুফান, অন্ধকার রাত্রি, সংকট, ভয়, ব্যাথা, ভোগান্তি, ক্লান্তি, অবসাদ, বিরক্তি, একাকীত্ব এই সবই আমাদের জীবনের অংশ। কখনো কখনো আমারও খুবই ক্লান্তি লাগে। তখন মনে পড়ে, রুমীর বিখ্যাত পংক্তি, “I know you are tried, but come. This is the way” (আমি জানি তুমি ক্লান্ত তবুও আসো, কারণ এটাই জীবনের পথ)।
শুধু মন খারাপ হয় এই ভেবে প্রতিদিন ক্ষুধার্ত মানুষের আহাজারি বাড়ছে। মানুষ আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়ছে। সমগ্র পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে এক ভয়াবহ সংকটের দিকে। একদিকে ক্ষুধা, নিগ্রহ, নির্যাতন, নিপীড়ন, যুদ্ধ, সংঘাত, লোভ, হিংসা, ক্ষমতার উদগ্র বাসনা, শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই, পুঁজিবাজ, অবাধ ভোগবিলাস অন্যদিকে মহামারি। সমগ্র পৃথিবীতে মানুষের জন্য আর একখণ্ড নিরাপদ ভূমির অস্তিত্ব নেই! একথা আজ সর্বজনবিদিত, নিজেদের সীমানার মতো মধ্যে কেউ একা ভালো থাকতে পারে না। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরাশক্তিগুলো আজ অসহায়। মানবজাতি নিজেদের মধ্যে সীমানা আর শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে হানাহানি, বিভেদ বাড়িয়ে এই পৃথিবীর অস্তিত্বকে কি আরও সংকটের মধ্যে ফেলবে? নাকি এক দেশ আরেক দেশের পাশে, এক মানুষ আরেক মানুষের পাশে দাঁড়াবে। সম্ভবত এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়ে গেছে!
তবে এই কঠিন সময়ে মৃত্যুর আশংকা জেনেও অনেক স্বেচ্ছাসেবী, চিকিৎসক, প্রশাসক, আইন-শৃংখলা বাহিনী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অন্য মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। এইটুকুই হচ্ছে আশার কথা আর এইটুকুই মানবজাতির শক্তি। আমরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেও মানুষকে সহযোগিতা করতে পারি, মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কয়েকটি লাইন টেনেই শেষ করছি। “মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও, এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও, মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।”
যাই হোক, যখন সমাজে ভয়, অভাব আর ক্ষুধার রাজত্ব বাড়ে তখন গুজব, কুসংস্কার এবং অযৌক্তিক চিন্তার বিকাশ ঘটে। এই সময়টায় মানুষ কাল্পনিক মিথ্যা এবং গুজবের উপর ভর করে সত্য এবং বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে চায়। তাই আমি সতর্ক আছি, নিজের দুর্বলতাবশতঃ যেন অযাচিত কোনো চিন্তার বিকাশ না ঘটে। অন্যদেরও সতর্ক করতে পারলে ভালো। এই সময়ে গণমাধ্যম এবং যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন তাদের দায়িত্ব একটু বেশি। করোনায় কতোজন আক্রান্ত, কতোজনের মৃত্যু হয়েছে, কোন কোন জেলায় সংক্রমিত হয়েছে শুধুমাত্র এই জাতীয় সংবাদ গণমানুষের মধ্যে আতংক তৈরি করতে পারে। তাই কতোজন সুস্থ হয়েছে, সারাবিশ্বে সুস্থতার পরিমাণ কতোটা বেশি, গড় মৃত্যুহার কতোটা অল্প সেটাও গুরুত্বের সাথে প্রচারের দাবি রাখে। কোন দেশ করোনাকে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে এবং কি কারণে এইসব সংবাদ এবং বিশ্লেষণ সমাজে নতুন আশা তৈরি করতে পারে। কারণ সময় যখন অনেক বেশি প্রতিকূল থাকে তখন অনেক বেশি আশার প্রয়োজন।
প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, একথা দিনের আলোর মত পরিষ্কার আমাদের সবাইকেই একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। তাই ছোট-বড় যে কোনো কাজই যত্নের সাথেই সম্পাদন করতে চেষ্টা করি। যে কোনো কাজের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মহৎ। আমরা যতক্ষণ বাঁচবো ততক্ষণ আশা নিয়েই বাঁচবো। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করতে চেষ্টা করবো। আমরা সতর্ক থাকবো। খোদা আমাদের সকলকে নিরাপদে রাখুন। সকলের মঙ্গল কামনা করছি।
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
লাভজনক সবজি চাষ পদ্ধতি
-
পুইশাক চাষ পদ্ধতি
-
কৃষকের বন্ধু ও কৃষি উন্নয়ন এর পথিকৃৎ শাইখ সিরাজের ৭০তম জন্মদিন আজ
-
যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে হতে পারে সারের সংকট
-
বিদেশ থেকে খালি হাতে ফিরে ড্রাগন চাষে সাফল্য
-
নাসিরনগরে বন্যায় তলিয়ে গেল কৃষকের বাদামখেত
-
পানি দিতে অতিরিক্ত টাকা
-
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
-
‘শিক্ষিত কৃষক’ বলেই তাঁকে নিয়ে মানুষের আগ্রহটা বেশি
-
ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বীজ কিনে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত
সবজি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। কৃষি বিজ্ঞানের ভাষায় সবজিকে উদ্যানতাত্বিক ফসল (Horticultural crops) বলা হয়ে থাকে। পুষ্টিমানের দিক থেকে সবজি ফসল যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বাণিজ্যিকভাবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। সেজন্য সবজি চাষের আধুনিক কলাকৌশল জানা জরুরি।
আর আধুনিক কলাকৌশল বলতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদকেই বোঝানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু সবজি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তবে সারাদেশে যেমন সব ধরনের সবজি উৎপাদিত হয়না ঠিক তেমনি সকল সবজিই আবার সারাবছর উৎপাদিত হয়না। একেক অঞ্চলে একেক ধরনের শাকসবজি উৎপাদিত হয়ে থাকে। আবার বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ বিশেষ সবজির জাত উৎপাদন করা যায়।
সারাদেশে সারাবছরই যেসকল সবজি সহজে উৎপাদিত হয়ে থাকে তাদের কিছু শাকসবজির কথা এখানে তুলে ধরছি। লালশাক, ডাটাশাক, পুইশাক, কলমিশাক, মিষ্টিআলু শাক, ঢেড়শ, গাজর, বরবটি, টমেটো, লাউ ও লাউশাক, পাটশাক, শশা, কাঁচকলা, বেগুন, পেপে, করলা, কচুশাক, কচুর লতি, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা ইত্যাদি পরিচিত শাকসবজি। তাছাড়া অপরিচিত বিশেষ কিছু সবজি বিশেষ বিশেষ এলাকার বিশেষত্ব হিসেবে উৎপাদিত হয়ে থাকে। উপরোক্ত ফসলগুলোর মধ্যে কিছু শুধু শাক আর বাকীগুলো শাক এবং সবজি উভয় হিসেবেই প্রচলিত রয়েছে।
কৃষিতাত্বিকভাবে রবি (শীতকাল) ও খরিপ (গ্রীষ্মকাল)- এ দুধরনের মৌসুম রয়েছে। খরিপের আবার দুটি ভাগ, যথা- খরিপ-১ (আগাম গ্রীষ্ম) এবং খরিপ-২ (বর্ষাকাল)। তবে শীতকালীন শাকসবজির মধ্যে বাহারি ও রকমারি বৈচিত্র একটু বেশি। শুধুমাত্র শীতকালে উৎপাদিত হয় এমন ফসলগুলোর মধ্যে রয়েছে- টমেটো, শীতলাউ, ফুলকপি, বাধাকপি, গাজর, সীম, মূলা, ব্রকলি, বাটিশাক, ওলকপি, শালগম, বেগুন, গোল আলু ইত্যাদিই প্রধান। অপরদিকে শুধুমাত্র গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে উৎপাদিত হয় এমন ফসলের মধ্যে রয়েছে- বিভিন্ন ধরনের কচু, ওলকচু, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, কাকরোল, পটোল, করলা, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া ইত্যাদিই প্রধান।
সবজি ফসল উৎপাদন অন্যান্য ফসলের মতো নয়। সবজি ফসল উৎপাদনের জন্য বিশেষ ধরনের যত্নের প্রয়োজন হয়। আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবাদ করতে গেলে অল্প পরিমাণ জায়গায় অধিক পরিমাণ ফসল ফলিয়ে লাভবান হওয়া সম্ভব। সবজি আবাদেও জন্য বাড়ির আঙ্গিনায় অথবা অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গা বেছে নিতে হবে। সেখানে ভালোভাবে চাষ-মই দিয়ে জমির মাটি জো অবস্থায় ঝুরঝুরে করে সেখানে এক মিটার প্রশস্ত এবং প্রয়োজনমত জমির আকার-আকৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে লম্বা বেড তৈরী করে নিতে হবে। প্রতিটি বেডের মাঝখানে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি পরিমাণ গর্ত করে নালা সৃষ্টি করতে হবে। অর্থাৎ নালার মাটি তুলেই দুইপাশে বেড প্রয়োজনমত উঁচু করতে হবে।
এভাবে বেড তৈরীর একটি বিশেষত্ব হলো শাকসবজি চাষাবাদ অন্য সাধারণ ফসল আবাদের চেয়ে একটু ভিন্ন। এর জন্য প্রয়োজন হয় বাড়তি সতর্কতা ও যত্নের। শাকসবজির চাষাবাদে যেমন শুষ্ক মৌসুমে সেচের চাহিদা থাকে অপরদিকে বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি বের করে দেওয়ার প্রয়োজন হয়। সেজন্যই বেড তৈরী করে মাটি কিছুটা উঁচু করা হয় সেখানে আবার নালা তৈরী করে নিষ্কাষনের ব্যবস্থাও রাখা হয়। কিন্তু বেড এবং নালা তৈরী না করলে সেটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবাদ হয়না। সেঠা হয় সাধারণ শাকসবজি চাষ। এতে ফলন অনেক কমে যায়।
পেপে, কাঁচকলা- এ জাতীয় সবজি বসতবাড়ির আঙ্গিনায়, রাস্তা বা পুকুরের ধারে সহজেই আবাদ করা যায়। লালশাক, ডাটা শাক, পাটশাক, মূলাশাক, গাজর, শালগম ইত্যাদি সবজি তৈরীকৃত বেডে ছিটিয়ে বীজ বুনে দিলেই ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাছাড়া টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, বাধাকপি, ঢেড়শ, কচু, ওলকচু ইত্যাদি সবজি এক মিটারের বেডে দুই সারি করে নির্ধারিত দূরত্বে চারা লাগিয়ে আবাদ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। সেজন্য এসব সবজি উৎপাদনের জন্য আলাদাভাবে নার্সারিতে চারা তৈরী করে নিতে হয়। অপরদিকে লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শশা, চাল কুমড়া, পটোল, কাকরোল, করলা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, সীম, বরবটি ইত্যাদি লতাজাতীয় সবজি চাষের জন্য উক্ত বেডে দুইটি সারি করে সেখানে জাংলা দিয়ে দিতে হয়। সাধারণত বেডের দুইপাশে খুটি দিয়ে পরে তা ইংরেজি অক্ষর ‘এক্স’ আকৃতিতে বা ‘ভি’ আকৃতিতে বাঁকিয়ে বেঁধে দিতে হয়।
বেড ছাড়াও লতাজাতীয় এসব সবজি অতি সহজেই ক্ষেতের আইলে, রাস্তার ধারে, পুকুরের পাড়ে বিশেষ ব্যবস্থায় আবাদ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে অন্যান্য যেকোন ফসলের তুলনায় এসব সবজি ফসলের একটু বেশি যত্নের প্রয়োজন হয়। বিনা আবাদেই এসব সবজি চাষ করা যেতে পারে। সেজন্য বন্যা পরবর্তীতে পুনর্বাসনের সময় বিনাচাষে এসব আবাদের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ জৈবভাবেই এসব সবজি ফসল উৎপাদন সম্ভব। আবাদের পূর্বে সামান্য পরিমাণ প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার ব্যবহার করে বাকীটা মেটাতে হবে বাড়িতে উৎপাদিত জৈব সারের মাধ্যমে। তারপর আন্তপরিচর্যা এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতেও জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। তখন এসব উৎপাদিত ফসল সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
কাজেই এভাবেই সারাবছর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বষ্পপরিসরে শাকসবজি উৎপাদন করে নিজের চাহিদা মিটিয়ে তা বাণিজ্যিকভাবেও লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমাদের শারীরিক পুষ্টি চাহিদার একটি বিরাট অংশ শাকসবজি থেকে আসা দরকার। দৈনিক একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের গড়ে কমপক্ষে আড়াইশ গ্রাম শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। আর সেটা নিবিড়ভাবে এবং নিরাপদভাবে খেতে হলে নিজের উৎপাদিত শাকসবজি খাওয়াই সবচেয়ে উত্তম। কাজেই আমাদের সারাবছর অলস সময়টাকে কাজে লাগিয়ে আসুন নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় সবজির বাগান গড়ে তুলি।
চলতি বোরো মৌসুমে সার কিনতে কৃষকদের সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা করে বেশি দিতে হয়েছে। আর সরকারকেও সার বাবদ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বাজেটে বরাদ্দের তিন গুণের বেশি—প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ এখন মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) সার আমদানি নিয়ে বিপাকে পড়েছে।
ধান, আলু ও সবজি চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এমওপি সারের ৬০ শতাংশ আনা হতো রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে। ওই দুই দেশ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ায় এখন বাংলাদেশকে এমওপি কিনতে হচ্ছে কানাডা থেকে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া ও আমদানিতে অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশে সারের সংকট হতে পারে। ভর্তুকির চাপ সামলাতে বাংলাদেশকে সব ধরনের সারের খুচরা মূল্য বাড়াতে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশে সার সরবরাহ ও ব্যবহারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এমওপি সারের ২০ শতাংশ সরবরাহ কমানো হলে সামনের বোরো মৌসুমে ধান, গম ও রবি মৌসুমের অন্যান্য ফসলের উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমতে পারে। এতে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
এমনিতেই এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সারের কারণে নতুন করে যাতে আর সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এ এম এম শওকত আলী, সাবেক কৃষিসচিব
তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, দেশে চলতি বোরো মৌসুমে নতুন করে আর সারের দরকার হবে না। সামনে আলুর মৌসুমে ইউরিয়া, এমওপিসহ অন্যান্য সারের চাহিদা বাড়বে। ওই সময়ের জন্য সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ কানাডা ও মধ্যপ্রাচ্যের সার সরবরাহকারী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।
জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কানাডা থেকে মোট আট লাখ টন এমওপি সার আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি। এ ব্যাপারে ওই দেশের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা স্মারক হয়েছে। ফলে এই সার নিয়ে সরকারের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। তবে সার বাবদ সরকারের বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি বাড়ছে। এই চাপ নিয়েও সরকার ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ওই ভর্তুকি দিয়ে যাবে।’
কমানো হয়েছে চাহিদা
বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে ৬৯ লাখ টন রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি—এই চার ধরনের সার ব্যবহার হয় ৫৭ লাখ টন। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের ওই চার ধরনের সারের চাহিদা কমিয়ে ৫৫ লাখ ৫০ হাজার টনে নামিয়ে আনা হয়েছে।
দেশে প্রয়োজনীয় সারের ৮০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে এমওপি সারের বড় অংশ আসে রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে।
প্রসঙ্গত, ওই চারটি প্রধান সার কৃষকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। চলতি অর্থবছরে সরকার প্রাথমিকভাবে সারে ভর্তুকি বাবদ ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে গত ছয় মাসে সারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বেশির ভাগ সারের দাম তিন থেকে চার গুণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারকে ভর্তুকির পরিমাণ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা করতে হয়। কিন্তু অর্থবছরের শেষের দিকে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে হিসাব করে দেখা হয়েছে, ভর্তুকির পরিমাণ এবার বেড়ে কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকা গিয়ে দাঁড়াবে।
জিপসাম, জিংক সালফেট ও অ্যামোনিয়াম সালফেট ও ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সারে সরকার কোনো ভর্তুকি দেয় না। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কিনে ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছে তা বিক্রি করে থাকেন। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষককেও বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে।
সাবেক কৃষিসচিব এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতেই এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সারের কারণে নতুন করে যাতে আর সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সরকারের অন্যান্য খাতের ভর্তুকি কমিয়ে প্রয়োজনে সারে ভর্তুকি বাড়াতে হবে, যাতে সারের দাম কম থাকে। কারণ, কৃষকের হাতে এখন টাকা কম। বিশ্ববাজার থেকেও খাদ্য আমদানি করা সামনের দিনে আরও কঠিন হতে পারে। ফলে দেশের উৎপাদন ঠিক রাখতে সারের দাম ও জোগান ঠিক রাখা উচিত।
ঠাকুরগাঁওয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) একটি গভীর নলকূপের সেচের পানি সরবরাহে কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে। ভুক্তভোগী কৃষকদের কাছ থেকে পাওয়া এমন অভিযোগের তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বড় বালিয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে।
ভুক্তভোগী কৃষকেরা বলছেন, সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের বাইরে কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু বিএমডিএর ১০৮ নম্বর গভীর নলকূপের অপারেটরের দায়িত্বে থাকা বিউটি বেগমের স্বামী আকতারুজ্জামান বোরো ধান চাষের জন্য প্রতি বিঘার জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা ও অন্য মৌসুমে ৩০০ টাকা নেন। ১০ বছর ধরে তিনি এভাবেই বাণিজ্য করে আসছেন।
সম্প্রতি রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে বিএমডিএর গভীর নলকূপ থেকে খেতে সেচের পানি পেতে হয়রানির শিকার দুই কৃষকের মৃত্যুর ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়।
ঠাকুরগাঁও জেলায় বিএমডিএর ১ হাজার ৪৩১টি গভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে সচল ১ হাজার ৪১৮টি। সেচের আওতায় ৭৬ হাজার ৫০০ পরিবারের জমি রয়েছে ৫৩ হাজার ৫০০ হেক্টর।
* সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের বাইরে কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই। * সেচের আওতায় ৭৬ হাজার ৫০০ পরিবারের জমি আছে। * কৃষকদের নলকূপের আবেদন পেলে যাচাই করে স্কিম তৈরি করা হয়।
বিএমডিএ সূত্রে জানা গেছে, কৃষকদের নলকূপের আবেদন পেলে যাচাই করে স্কিম তৈরি করা হয়। এরপর সমবায়ের ভিত্তিতে অংশীদারি ফি বাবদ এক লাখ টাকা জমা দিতে হয়। এই নলকূপ পরিচালনার জন্য বিএমডিএ একজন অপারেটর নিয়োগ দেন। প্রিপেইড মিটারিং পদ্ধতিতে কৃষকের নিজ নামে প্রিপেইড কার্ড থাকতে হয়। সেই কার্ড থেকে প্রতি ঘণ্টায় সেচের পানির জন্য ন্যূনতম ১১০ টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে নেওয়া হয়। এর বাইরে অতিরিক্ত কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই।
বড় বালিয়া এলাকার কৃষকেরা জানান, ২০১১ সালের দিকে বড় বালিয়া মণ্ডলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আকতারুজ্জামান এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ফি হিসেবে এক লাখ জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও কোনো কৃষক সেটা দিতে এগিয়ে আসেননি। ফলে আকতারুজ্জামান, দাউদুল ইসলাম ও জোবায়দুর রহমান মিলে অংশীদারি ফি দেন। আকতারুজ্জামানের ৮০ শতাংশ টাকা থাকায় গভীর নলকূপের নিয়ন্ত্রণ তিনিই পান। অপারেটর হিসেবে নিয়োগ পান তাঁর স্ত্রী বিউটি বেগম। যদিও কৃষকেরা আকতারুজ্জামানকেই অপারেটর হিসেবে জানতেন।
সেচের পানি পেতে হয়রানির শিকার হয়ে সদর উপজেলার বড় বালিয়া এলাকার ৫০ জন কৃষক গত ১৭ এপ্রিল বিএমডিএ সহকারী প্রকৌশলীর কাছে অভিযোগ দেন। সেখানে গিয়ে কৃষক ও অপারেটরের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।
ভুক্তভোগী কৃষকেরা বলেন, ২০১২ সালে নলকূপটি চালু হলে আওতাধীন কৃষকের কাছ থেকে আকতারুজ্জামান সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের অতিরিক্ত টাকা আদায় শুরু করেন। আর সেই টাকা থেকে তিনি মাঝেমধ্যে অন্য দুই অংশীদারকে কিছু টাকা ভাগ দেন।
ভুক্তভোগী কৃষক মো. শাহজাহান আলী বলেন, গভীর নলকূপটির আওতায় তাঁর ১০ বিঘা জমি রয়েছে। কার্ডের বাইরে টাকা দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও আকতারুজ্জামানকে প্রতি বিঘায় সেচের জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা দিতে হয়। এই টাকা না দিলে তিনি পানি দেন না।
ওই নলকূপের আওতায় চার বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করছেন কৃষক মো. হেলাল। তিনি অতিরিক্ত টাকা না দেওয়ায় অপারেটর খেতে পানি দেননি। এতে জমি ফেটে যায়। পরে তিনি শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে জমিতে সেচ দিয়ে খেত রক্ষা করেছেন।
আরেক ভুক্তভোগী মোকলেসুর রহমান বলেন, ১০ বছর ধরে সেচের পানির জন্য অতিরিক্ত টাকা দিয়ে আসছেন। এখন বিরক্ত হয়ে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। এরপরও কোনো বিচার পাননি।
এ বিষয়ে মো. আকতারুজ্জামান বলেন, তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর দেখেন গ্রামে কোনো গভীর নলকূপ নেই। পরে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে নলকূপটি স্থাপন করেন। কৃষকেরা অংশীদারত্বের টাকা দিতে রাজি না হলে তিনি বিএমডিএকে জানান। সে সময় তাঁরা টাকা দিয়ে দিতে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘পরে আপনি টাকাটা ধীরে ধীরে তুলে নেবেন।’ সেই পরামর্শেই সেচের পানি বাবদ প্রিপেইড কার্ডের অতিরিক্ত কিছু টাকা তিনি নিচ্ছেন। জোর করে কিছু নিচ্ছেন না।
বিএমডিএ ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, অভিযোগটি যাচাই করে সত্যতা পাওয়া গেছে। নলকূপটি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওই অপারেটরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এগ্রোটেক
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
লেখক
প্রথম আলোডাচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে দুই দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।
গতকাল সোমবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অনুষ্ঠিত কৃষি খাতের ব্যবসাবিষয়ক এক সম্মেলনে দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এগ্রি বিজনেস কনক্লেভে বাংলাদেশের প্রায় ৪০জন উদ্যোক্তা ডাচ কৃষি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি প্রযুক্তি সহযোগিতা ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছে ওয়েগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়।
আলোচনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তি কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি সহযোগিতা দিতে রাজি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে ডাচরা প্রস্তুত এবং বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও তাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া ডাচ সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বীজ, পশু খাদ্য, পোলট্রি, হর্টিকালচার ও এ্যাকুয়াকালচার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করেছে, যা ওই দেশের বেসরকারি খাতকে আরও উৎসাহিত করেছে।
আলোচনায় কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তৈরি আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্কয়ার, ইস্পাহানি এগ্রো, একে খান অ্যান্ড কোম্পানি, প্যারাগন গ্রুপ, এসিআই, জেমকন গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ডাচ প্রযুক্তির প্রয়োগ সরেজমিনে দেখতে যাবেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের পোল্ট্রিখাতে সহযোগিতার আলোচনা অনেকটা এগিয়েছে উল্লেখ করে মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দুই দেশের মধ্যে মৎস্য, পশুপালন ও হর্টিকালচারে সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা আছে।
কনক্লেভ আয়োজনে প্রথমবারের মতো দূতাবাসের সঙ্গে অংশীদার হয়েছে নেদারল্যান্ডসের কৃষি মন্ত্রণালয়, নেদারল্যান্ডস এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি, নেদারল্যান্ডস ফুড পার্টনারশিপ, ডাচ-গ্রিন-হাইজডেল্টা, লারিভ ইন্টারন্যাশনাল, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ।
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী নেদারল্যান্ডসের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কম। ২০২১-এ কৃষিপণ্য ও খাদ্য রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে।
ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায় লাইসেন্সহীন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নিম্নমানের বীজ কিনে বোরো ধান আবাদ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকেরা। উপজেলার গাংগাইল ইউনিয়নের পাছবাড়িয়া গ্রামের কৃষকদের দাবি, এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কেনা বীজে ধান চাষ করে তাঁরা ধরা খেয়েছেন। ২০ জনের বেশি কৃষকের প্রায় ৮৫০ শতক জমির ৪ ভাগের ৩ ভাগ ধান নষ্ট হয়ে গেছে।
পাছবাড়িয়া গ্রামের কৃষক মো. তাইজুল ইসলাম ভূঁইয়া ও আতাউর রহমান জানান, তাঁরা স্থানীয় বাংলাবাজারের সোলাইমান এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. সোলাইমান মিয়ার কাছ থেকে বেঙ্গল সিড কোম্পানির ধানবীজ কিনে বীজতলা তৈরি করেছিলেন। সেই বীজতলার চারা নিজেদের জমিতে রোপণ করেন। উদ্বৃত্ত চারা গ্রামের অন্য কৃষকদের কাছে বিক্রি করেছেন। এখন তাঁদের সঙ্গে অন্য কৃষকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে আছেন মহসিন মিয়া, জাহাঙ্গীর মিয়া, আনোয়ার হোসেন, আবদুল হেকিম, আবদুস সালাম, আতাউর রহমান, রমজান আলীসহ আরও অনেকে।
অভিযোগের বিষয়ে বীজ ব্যবসায়ী সোলাইমান মিয়া বলেন, কৃষকেরা তাঁর কাছে বীজ চেয়েছিলেন। তাই তিনি নান্দাইল শহরের স্বপন মিয়ার বীজ বিক্রির দোকান বেঙ্গল সিডের ব্রি ধান-৮৯ জাতের বীজ কিনে এনে কৃষকদের কাছে বিক্রি করেছেন। বীজ বিক্রির লাইসেন্স আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বীজ বিক্রি করার জন্য তাঁর কোনো লাইসেন্স বা কৃষি বিভাগের অনুমতি নেই। সাত বছর ধরে তিনি লাইসেন্স ছাড়াই বীজ বিক্রির ব্যবসা করছেন।
সোমবার পাছবাড়িয়া গ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জমিতে গিয়ে দেখা যায়, একই বীজের চারা রোপণ করা হলেও জমিতে তিন ধরনের ধানগাছ গজিয়েছে। ধানের শিষ হয়েছে তিন প্রকারের।
এই ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ ও উপযুক্ত বিচার চান ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা। তাঁরা জানান, ধানের বীজ মানসম্পন্ন না হওয়ায় গ্রামের ৮৫০ শতকের বেশি জমির ফলন নষ্ট হয়ে গেছে। যেখানে প্রতি ১০ শতকে ১০-১১ মণ ধান ফলন হওয়ার কথা। সেখানে ফলন হতে পারে এক থেকে দেড় মণ। বোরো মৌসুমে এমন ক্ষতির মুখে পড়ে তাঁরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। বৃদ্ধ কৃষক মহসিন মিয়া বলেন, তিনিও সুলাইমানের দোকান থেকে বেঙ্গল সিডের বীজ কিনে ৭০ শতক জমি আবাদ করেছেন। তাঁর জমিতেও ফলন ভালো হয়নি।
এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে পাছবাড়িয়া গ্রামে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফয়জুর রহমান বীজ বিক্রেতা সুলাইমান ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের নিয়ে সালিসে বসার কথা।
নান্দাইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আনিসুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি একজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কাছে পাঠাবেন। তিনি বিষয়টি তদন্ত করে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। এই ঘটনার জন্য নিম্নমানের ধান বীজ দায়ী হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিষয়ে প্রতিবেদন পাঠাবেন।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন