ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি। মানবতা নাজুক পর্যায়ে। মানুষ তার স্রষ্টাকে ভুলে গিয়েছিল। আপনাকে, আপনার ভবিষ্যৎ ও পরিণতি সম্পর্কে বিস্মৃত হয়েছিল। মানুষের দিল-দেমাগ হারিয়ে বসেছিল অতলে। পরকাল নিয়ে ছিল না কোনো চিন্তা। একটি লোকও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না যে এক আল্লাহর ইবাদত করবে। শিরক করবে না। মানবতার জন্য এক দরদি বন্ধুর প্রয়োজন পড়ে ছিল। যিনি ভয়াল পরিণতির জন্য অস্থির হয়ে উঠবেন। আঁধার থেকে নিয়ে আসবেন আলোর পথে। অনিবার্য প্রয়োজন দেখা দিল তখন একজন নবীর। নবী প্রেরিত হলেন ধরাধামে।
বহুকাল আগে মহানবীর পূর্বপুরুষদের শ্রেষ্ঠ সন্তান নবী ইব্রাহিম (আ.) পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে নিয়ে কাবার দেয়াল তুলতে তুলতে প্রার্থনা করেছিলেন তাঁদের বংশে নবী প্রেরণের। সেই নবী বা প্রেরিত পুরুষ যেন সবাইকে পরিশুদ্ধ করতে পারেন এবং দিগভ্রান্ত মানুষকে সুপথে আনেন—তাই ছিল পিতা-পুত্রের আকুতি। এ কথার নজির রয়েছে কালাম শরিফে।
বলা হচ্ছে, ‘স্মরণ করো, যখন ইব্রাহিম ও ইসমাইল কাবাঘরের প্রাচীর তুলেছিল, তখন তারা বলেছিল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এই কাজ কবুল করো; নিশ্চয় তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে তোমার একান্ত অনুগত করো এবং আমাদের বংশধর থেকে তোমার এক অনুগত উম্মত করো। আর আমাদের ইবাদতের নিয়ম-পদ্ধতি দেখিয়ে দাও এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হও। তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের মধ্য থেকে তাদের নিকট একজন রাসুল পাঠাও, যে তোমার আয়াতসমূহ তাদের নিকট তিলাওয়াত (আবৃত্তি) করবে, তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদের পবিত্র করবে। তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা বাকারা: ১২৭-২৯)বিজ্ঞাপন
মহানবী (সা.) আরব দুনিয়ায় এলেও অল্প দিনের মধ্যে সব মানবতার করুণাধারা হয়ে উঠেছিলেন। এর স্বীকৃতি পবিত্র কোরআনে আছে, ‘আমি তোমাকে পৃথিবীর রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।’ (সুরা আম্বিয়া: ১০৭)
নবীজীবনের নানা অধ্যায় আমাদের সামনে উন্মোচিত হওয়া দরকার। কেননা পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তুলনাহীন এক পুরুষ তিনি। আঞ্জাম দিয়েছেন নানা কাজের। কখনো ব্যক্তি হিসেবে, কখনো নবী হিসেবে। এ কথা তিনি স্মরণও করিয়ে দিয়েছেন অনুসারীদের। ‘আমি তোমাদের মতো একজন মানুষ, শুধু পার্থক্য আমার ওপর ওহি নাজিল হয়।’ (সুরা হা-মিম সিজদা: ০৬)
নবীর পরিবারে কবিতার চর্চা আমরা নবীর জীবনের নানা বিষয় জানি ও বুঝি। কবিতা ও সাহিত্যে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কী তাঁর ভূমিকা ছিল, সেটাও একালে অনেকের অজানা নয়। উৎসুক পাঠকমাত্রই সেটার খোঁজ জানেন। সেই জানার মধ্যে উদগ্র বাসনা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উদয় হয়েছে—মহানবী (সা.)–এর পরিবারে কি কবিতাচর্চার কোনো রেওয়াজ ছিল?
এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখতে পাই, স্ত্রী হজরত আয়েশা বিনতে আবু বকর (রা.), জামাতা আলী ইবন আবু তালিব (রা.) ও কন্যা ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ (রা.) কবিতাচর্চার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এ ছাড়া পেছন ফিরে দেখি, মহানবীর বংশের গোড়ার লোকেরাও কবিতাচর্চায় এগিয়ে ছিলেন। মেয়েদেরও দেখা যাচ্ছে কবিতাচর্চায় পারদর্শী হিসেবে। এ নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ কম। এ প্রবন্ধে আমরা একটি ক্ষুদ্র অংশ তুলে ধরব। মহানবী (সা.)–এর দাদা যখন ইন্তেকাল করেন, তাঁর আগে কন্যাদের জড়ো করে তিনি মার্সিয়া বা শোকগাথা শুনতে চেয়েছিলেন। সেটাই আমরা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করতে চাই।
মুত্তালিবকন্যাদের শোকগাথা আবদুল মুত্তালিব ছিলেন নবীজির দাদা। তাঁর কন্যারা সম্পর্কে নবীজির ফুফু। তাঁরা প্রত্যেকে ছিলেন আরবের প্রতিভাধর নারী। সিরাত বা মহানবীর জীবনচরিত বিশেষজ্ঞ ইবনে হিশাম তাঁর গ্রন্থে ইবনে ইসহাকের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ইবনে ইসহাক বলেন, ‘আব্বাস ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মা’বাদ ইবনে আব্বাস তাঁর পরিবারের কারও সূত্রে আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যুকালে রাসুল (সা.)-এর বয়স ছিল আট বছর।’
ইবনে ইসহাক বলেন, ‘সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (র.)-এর পুত্র মুহাম্মদ আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে যখন আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু আসন্ন হলো এবং তিনি বুঝতে পারলেন যে মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে, তখন তাঁর সব কন্যাকে একত্র করলেন। তাঁর সর্বমোট ছয় কন্যা ছিলেন। তাঁদের নাম যথাক্রমে সাফিয়্যা, বাররা, আতিকা, উম্মে হাকিম আল বায়শা, উমায়মা ও আরওয়া। তিনি তাঁদের বললেন, আমার মৃত্যুর পর তোমরা কে কী বলে বিলাপ করবে বলো, আমি মরার আগে সেটা একটু শুনে যেতে চাই।’ ইবনে হিশাম বলেন, ‘আমি কবিতা সম্পর্কে অভিজ্ঞ এমন কোনো কবি দেখিনি, যিনি এসব শোকগাথা সম্পর্কে জানেন। তবে মুহাম্মদ ইবনে সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব থেকে কিছু কবিতা বর্ণিত হয়েছে, যা আমরা এখানে উদ্ধৃত করছি।’
সাফিয়্যার শোকগাথা ছয় কন্যার মধ্যে সাফিয়্যা রচিত শোকগাথাটি এই— ‘কবরের পাশ দিয়ে চলে গেছে যে রাস্তা, সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে শোকে মুহ্যমান এক নারী; মহান ব্যক্তির জন্য তার কান্নাধ্বনিতে ঘুম ভেঙেছে আমার। তার বিলাপ শুনে চোখের পানি কপোল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়ছে অবিরল মুক্তার মতো। এমন বিলাপ মান্যবর এক ব্যক্তির প্রতি যিনি মিথ্যা দাবি করে হননি অন্য কোনো বংশের লোক। ছিলেন আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে অতিউত্তম, শায়বার প্রতি মহাদানশীল, আরও আরও গুণের অধিকারী। মুত্তালিব যে পিতার সন্তান, সে তো বড় ভালো লোক। বদান্যতায় কে আছে তাহার সমান। আমি বিলাপ করছি সেই ব্যক্তির জন্য সঙ্গীদের পেছনে নয়, থাকতেন সমুখে। রণাঙ্গনে তুমুল বীরত্বে শত্রুকে করতেন মোকাবিলা। ছিলেন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং বংশীয়। এই শোকগাথা তাঁর জন্য যিনি ছিলেন দানবীর, দরাজহস্ত, সৌন্দর্য ও বীরত্বে সমাসীন, নিজের গোত্র— যাকে গ্রাহ্য করেছে প্রশংসার পাত্ররূপে। শোকতাপ করছি এমন ব্যক্তির, যিনি উঁচু বংশের সুদর্শন চেহারাঅলা বহুগুণে গুণান্বিত। ছিলেন মন্বন্তরে আর্তজনের প্রতি মহাদানশীল। শোক তাঁর প্রতি, যিনি অতিশয় ধৈর্যশীল ও সম্মানিতদের দলে, মর্যাদা ও বাহাদুরিতে শ্রেষ্ঠ গোত্রসমূহের পৃষ্ঠপোষক। বিধির বিধান যদি হতো—পুরোনো ইজ্জত সম্মানের বশবর্তীলোক থাকবেন অমর; তবে নিশ্চয়ই আপনিই হতেন তা। কিন্তু তাতো হবার নয় পিতা!’
এভাবে একে একে বাকি ছয় কন্যা শোকগাথা আবৃত্তি করলেন। ইবনে হিশাম ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, এরপর আবদুল মুত্তালিবের বাক্শক্তি রহিত হয়ে যায় এবং তিনি কন্যাদের মর্সিয়া বা শোকগাথা শুনে মাথা নেড়ে ইশারা করে বলেন, ঠিক আছে, এভাবেই বিলাপ ও শোক প্রকাশ করো। আবদুল মুত্তালিবের প্রিয় পুত্র ছিলেন আবদুল্লাহ। তাঁরই উরশে আলো করে এসেছিলেন আহমদে মুজতাবা মহানবী মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ (সা.)।
সূত্র: ০১. ইবনে হিশাম: সিরাতুন নবী (সা.) ০২. সাইয়িদ আবুল হাসান আলি নাদভি: নবীয়ে রহমত ০৩. ড. আবদুল জলিল: কবি ও কবিতা সম্পর্কে রাসুল ও সাহাবিদের মনোভাব ০৪. কবিতার অনুবাদ বর্তমান লেখকের নিজস্ব
দেশের আকাশে ১৪৪৩ হিজরি সালের পবিত্র রবিউস সানি মাসের চাঁদ দেখা গিয়েছে। ফলে রবিবার থেকে পবিত্র রবিউস সানি মাস গণনা করা হবে।
সেই হিসেবে দেশে আগামী ১১ রবিউস সানি ১৪৪৩ হিজরি (১৭ নভেম্বর, বুধবার) পবিত্র ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম পালিত হবে।
শনিবার ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এদিন সন্ধ্যায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পূর্ব সাহানে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী এনামুল হাসান।
সভায় সব জেলা প্রশাসন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়, বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে পবিত্র রবিউস সানি মাসের চাঁদ দেখার ব্যাপারে নিশ্চিত হয় চাঁদ দেখা কমিটি।
নামাজে থাকাকালীন কারও মনে সংশয় জাগে কত রাকাত হলো, রাকাত ভুলে ছুটে যায়নি তো? কিংবা নামাজের পরেও সন্দেহ জাগতে পারে রাকাত পূর্ণ হয়েছে নাকি হয়নি। নামাজের রাকাতসংখ্যায় সন্দেহ হলে কী করবেন- সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা:
নামাজ পড়ার সময়ে রাকাতসংখ্যা নিয়ে সন্দেহ হলে এবং এই সন্দেহ প্রথমবারের মতো হলে ওই নামাজ বাতিল হয়ে যাবে। নামাজ পুনরায় পড়া আবশ্যক। (ইবনে আবি শায়বা, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২৮)
নামাজের সালাম ফেরানোর পর যদি রাকাতসংখ্যা নিয়ে সন্দেহ হয়, তবে তার নামাজ বাতিল হয়ে যাবে। (ইবনে আবি শায়বা, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২৮)
কারও যদি নামাজের পর দৃঢ়বিশ্বাস হয় যে কিছু রাকাত পড়া হয়নি এবং যদি নামাজ পরিপন্থী কোনো কাজ না হয়ে থাকে, তাহলে ছুটে যাওয়া রাকাত পড়ে নেবে। যদি নামাজ পরিপন্থী কোনো কাজ হয়ে যায়, তাহলে ওই নামাজ পুনরায় পড়বে। (ইবনে আবি শায়বা, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২৪)
যে ব্যক্তির প্রায় সময় সন্দেহ হয় এবং সন্দেহ তার অভ্যাসে পরিণত হয়, তবে যেদিকে তার মন বেশি যায়, সেটার ওপর আমল করবে। যদি সব বিষয়ে ধারণা সমান হয়, তবে কমটির ওপর আমল করবে এবং প্রতি রাকাতকে নামাজের শেষ মনে করে বসবে এবং শেষে সিজদায়ে সাহু করবে। (মুসলিম, হাদিস: ৮৮৮)
তিন রাকাত পড়া হয়েছে নাকি চার রাকাত- সে ব্যাপারে সন্দেহ হলে তিন রাকাত মনে করে চতুর্থ রাকাত পড়বে। এরপর শেষে সিজদায়ে সাহু করবে। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৬৭৭)
প্রিয় নবির ঘর সুমহান আদর্শের কেন্দ্রবিন্দু। এ ঘর থেকে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তম আদর্শ, পরিপূর্ণ আদব, অতুলনীয় শিষ্টাচার ও স্বাধীন সমাজ ব্যবস্থা। নবিজীর যুগে এমন সমাজ ব্যবস্থা প্রবতির্তত হয়েছিল যে, পরিবারের সবাই সমভাবে কাজ করতেন। পুরুষরা স্ত্রীদের কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন। আর একটি সময় হলেই সবাই একত্রিত হতেন। তা ছিল নামাজের আজান। আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুহূর্তের মধ্যে সবাই কাজ রেখে নামাজ পড়তে মসজিদে একত্রিত হতেন।
স্বয়ং বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিবারিক কাজে সময় দিতেন। স্ত্রীদের কাজে সহযোগিতা করতেন। নামাজের আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ ছেড়ে দিতেন। হাদিসে পাকের একাধিক বর্ণনা থেকে প্রমাণিত যে-
১. হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ঘরে কী কী কাজ করতেন? তিনি উত্তর দেন-
كان بشرًا من البشر: يفلي ثوبه ويحلب شاته، ويخدم نفسه
‘তিনি একজন মানুষ ছিলেন, তিনি তাঁর কাপড় সেলাই করতেন, ছাগলের দুধ দহন করতেন এবং নিজের কাজ নিজেই করতেন।’ (মুসনাদে আহমাদ)
তিনি কি শুধু সাধারণ মানুষের মতো মানুষ ছিলেন? না তিনি ছিলেন চারিত্রিক মাদুর্য ও বিনয়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কোনো গুণেই কেউ তার সমকক্ষ ছিল না। তিনি যেমন বিনয়ী ছিলেন, তেমনি ছিলেন অহংকারমুক্ত মানুষ।
প্রিয় নবি কেমন মানুষ ছিলেন? তিনি কোনো দিন কাউকে কষ্ট দেননি। তিনি ছিলেন প্রতিটি কাজে অংশগ্রহণকারী সেরা মানুষ। অন্যকে সেরা সাহায্যকারী ও শ্রেষ্ঠ মানুষ। ইবাদত-বন্দেগি ও আল্লাহর হুকুম পালনে তিনি ছিলেন অনুকরণীয় আদর্শ। তাঁর প্রতি নাজিল হয়েছে এ আয়াত-
‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর (চরিত্রের) মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ২১)
আজান শোনার পর প্রিয় নবির সুন্নাত
কোরআনের ঘোষণার পরও তিনি আল্লাহর ইবাদাত ও তার অনুসরণ থেকে কখনো বিরত হতেন না। বরং মসজিদে আজান হওয়ার ধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তাতে সাড়া দিয়ে সব কাজ রেখে মসজিদে ছুটে যেতেন। হাদিসের বর্ণনায় এসেছে-
হজরত আসওয়াদ বিন ইয়াজিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাড়ীতে কি কি ধরনের কাজ করতেন? উত্তরে তিনি বললেন-
كان يكون في مهن أهله، فإذا سمع بالأذان خرج
‘তিনি তার পরিবারের সব কাজে নিয়োজিত থাকতেন, তবে আজান শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতেন।’ (বুখারি)
ফরজ নামাজ মসজিদে পড়ার গুরুত্ব
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে, তিনি বাড়িতে ফরজ নামাজ পড়েছেন। তবে তিনি মৃত্যুর আগ মুহূর্তে যখন প্রচণ্ড রোগাক্রান্ত; শোয়া থেকে উঠতে পারছিলেন না; যখন মসজিদে যেতে অপরাগ ছিলেন তখন বাড়িতে নামাজ আদায় করেছেন। কিন্তু তিনি দরজা দিয়ে মসজিদে নামাজ পড়ার দৃশ্য অস্রুসিক্ত নয়নে অবলোকন করতেন।
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের প্রতি খুবই দয়াশীল ছিলেন। কিন্তু নামাজের জামাতের অংশগ্রহণের ব্যাপারে তাঁর মতো এতো কঠোর দ্বিতীয় আর কেউ ছিল না। তিনি জামাতে অনুপস্থিত ব্যক্তিদের ব্যাপারে এভাবে কঠোর শাস্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে-
لقد هممت أن آمر بالصلاة فتقام ثم آمر رجلاً أن يصلي بالناس ثم أنطلق معي برجال معهم حزم من حطب إلى قوم لا يشهدون الصلاة فأحرق عليهم بيوتهم
‘আমার ইচ্ছা হয় যে, আমি কাউকে নামাজের ইমামতি করার আদেশ দেই আর আমি কাঠসহ কিছু লোককে সঙ্গে নিয়ে ঐ সব লোকদের বাড়িতে যাই; যারা জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়ার জন্য উপস্থিত হয়নি। এরপর তারাসহ তাদের বাড়ি-ঘরকে জালিয়ে দেই।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মসজিদে না গেলে নামাজ কবুল হবে না!
মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ পড়ার প্রতি ছিল নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ গুরুত্ব। শরিয়তের ওজর ছাড়া আজান শোনার পর মসজিদে না গেলে নামাজ কবুল হবে মর্মেও প্রিয় নবি ঘোষণা করেছেন-
من سمع النداء فلم يجب فلا صلاة له إلا من عذر، والعذر خوف أو مرض
‘শরিয়তের ওজর ব্যতিত যে ব্যক্তি আজান শোনার পর জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করলো না, তার নামাজ কবুল হবে না।’ (তিরমিজি) আর ওজর বলতে: শত্রুর ভয় অথবা রোগকে বুঝানো হয়েছে।
প্রিয় নবির যুগের সে দৃশ্য আজ কোথায়? কোথায় সেই নামাজি? মসজিদে আজান হয় ঠিকই কিন্তু মসজিদের কাতারপূর্ণ হয় না। অথচ বর্তমান সময়ে মসজিদে নামাজ পড়তে না যাওয়ার পেছনে নেই কোনো শরিয়তের ওজর। না কোনো শত্রুর ভয় কিংবা বিপদের ভয়।
মুমিন মুসলমান মাত্রই উচিত, আজান হলে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সোনালী যুগের মতো কাজ রেখে মসজিদে উপস্থিত হওয়া। একত্রে নামাজ আদায় করা। প্রিয় নবির প্রিয় সুন্নাতকে জাগ্রত করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের উপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মানসিক চাপ, বিষন্নতা ও জীবনের নানা কষ্ট থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর সাহায্যের বিকল্প নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের ঝুঁকির মুহূর্তে আল্লাহর নির্দেশে মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সময় চরম বিপদের মুহূর্তে প্রশান্তি স্বরূপ এ আয়াতটি নাজিল হয়। যা সত্যিই প্রশান্তির। এ আয়াতটি পড়লে এমনিতেই কঠিন বিপদে মিলে প্রশান্তি ও নিরাপত্তা। তাহলো-
অর্থ : ‘হে আমার প্রভু! তুমি আমাকে কল্যাণসহ প্রবেশ করাও এবং কল্যাণসহ বের কর। আর তোমার কাছ থেকে আমাকে দান কর সাহায্যকারী শক্তি।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ৮০)
উল্লেখ্য, এ আয়াতটি প্রিয় নবির হিজরতের সময় নাজিল হয়েছিল। যখন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে বের হওয়ার এবং মদিনাতে প্রবেশ করার সময় উপস্থিত হয়েছিল।
কেউ কেউ বলেন, এ প্রার্থনামূলক আয়াতের মর্মার্থ হলো- সত্যের উপর আমার মৃত্যু দিও এবং সত্যের উপর আমাকে কেয়ামতের দিন উত্থিত করো।
আবার কেউ কেউ বলেন, সত্যতার সঙ্গে আমাকে কবরে প্রবিষ্ট করো এবং কেয়ামতের দিন সত্যতার সঙ্গে আমাকে কবর থেকে বের করো ইত্যাদি।
ইমাম শাওকানি বলেন, এ আয়াতটি যেহেতু দোয়া; বিধায় এর ব্যাপকতায় উল্লিখিত সব কথাই এসে যায়।
কেউ কেউ বলেন, যারা বিভিন্ন কষ্ট ভোগ করেন, তারাও এ দোয়াটি প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজের পর পড়তে পারেন। আশা করা যায়, এতে তার উল্লেখিত রোগ ও সমস্যাগুলো সমাধান হয়ে যাবে।
আবার কেউ কেউ বলেছেন, যদি কারো ডায়বেটিস রোগ হয়; তবে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম ও শৃঙ্ক্ষলাবদ্ধ জীবনের পাশাপাশি এ দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। এ রোগ থেকে মুক্ত থাকতে এটিকে কোরআনি আমল মনে করা হয়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বিভিন্ন রোগ মুক্তিতে কোরআনের এ আয়াতের আমলটি বেশি বেশি করার তাওফিক দান করুন। দুনিয়ার ও পরকালের সব বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
শিরকমুক্ত ঈমান এবং নেক আমল ছাড়া কেয়ামতের দিন মুক্তির বিকল্প নেই। কেয়ামতের ময়দানে সব মানুষ আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকবে। এমনকি নবি-রাসুলগণও আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকবেন। কারণ কেউ জানেন না আল্লাহ তাআলা সে দিন কার সঙ্গে কীরূপ ব্যবহার করবেন।
হাদিসের বর্ণনায় যদিও কেয়ামতের দিনের ভয়বাহতার বর্ণনা দিয়েছেন প্রিয়নবি। তিনি সেদিন সেজদায় থাকবেন। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাকে সেজদা থেকে উঠতে বলবেন। তিনি সেজদা থেকে মাথা উঠিয়ে বিচার কাজ শুরু করার জন্য সুপারিশ করবেন। তারপরই শুরু হবে পরকালের বিচারকার্য।
সেদিন যার আমলনামা ভালো হবে সে সফল হবে। শুধু মানুষ নয়, সেদিন নবি-রাসুলরা কতটা ভয়াবহ সময় কাটাবেন তা হাদিসের একটি বর্ণনা থেকেই সুস্পষ্ট- হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যখন এ আয়াত নাজিল হয়- وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ (হে রাসুল!) আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন।’ (সুরা শুআরা : আয়াত ২১৪) তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন- > হে কুরাইশ দল! (তোমরা আল্লাহর একত্ববাদ ও ইবাদতের ধারায়) নিজেদের আত্মাকে প্রস্তুত কর। আমি আল্লাহর কাছে তোমাদের কোনো কাজে আসতে পারব না। > হে বনি আবদে মানাফ! আমি আল্লাহর কাছে তোমাদের কোনো উপকার করতে পারব না। > হে আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র আব্বাস! আমি আল্লাহর কাছে তোমার কোনো উপকার করতে পারব না। > হে রাসুলের ফুফু সাফিয়্যাহ! আমি আল্লাহর কাছে আপনার কোনো কাজে আসব না। > হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যা ফাতেমা! তুমি আমার সম্পদ থেকে যা ইচ্ছা চেয়ে নাও। আমি আল্লাহর কাছে তোমার কোনো কাজে আসব না।’ (বুখারি)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের করণীয়- এ সতর্কবার্তা ঘোষণার পরপরই মহান আল্লাহ তাআলা পরবর্তী আয়াতে প্রিয়নবিকে অনুসরণ ও অনুকরণ করার যে ঘোষণাগুলো দিয়েছেন, সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা। আর তাহলো- ‘আর মুমিনদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করে, তাদের প্রতি তোমার বাহুকে অবনত কর। তারপর যদি তারা তোমার অবাধ্য হয়, তাহলে বল, তোমরা যা কর, নিশ্চয় আমি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আর তুমি মহাপরাক্রমশালী পরম দয়ালু (আল্লাহর) উপর তাওয়াক্কুল কর। যিনি তোমাকে দেখেন যখন তুমি (নামাজে) দণ্ডায়মান হও এবং সেজদাকারীদের মধ্যে তোমার ওঠা-বসা। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা মহাজ্ঞানী।’ (সুরা শুআরা : আয়াত ২১৫-২২০)
আল্লাহর একত্ববাদ ও ইবাদতে যদি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নিজ বংশধর, চাচা, ফুফু ও কন্যার ব্যাপারে এমন ঘোষণা দেন তবে অন্যান্য মুসলমান কিভাবে আল্লাহর নাফরমানি করে প্রিয়নবির শাফায়াত লাভের আশা করতে পারে!
কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা থেকে এ কথা প্রমাণিত যে, শিরক মুক্ত ঈমান ও নেক আমল ছাড়া কোনো আদম সন্তানই পরকালে মুক্তি পাবে না। যারাই প্রিয় নবির অনুসরণ ও অনুকরণ করবে তাদের মুক্তি হবে নিরাপদ ও সহজ।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, শিরকমুক্ত ঈমান ও নেক আমলে নিজেদের জীবন সাজানো। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবন পরিচালনা করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে শিরকমুক্ত ঈমান লাভ ও তার ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেদের নিয়োজিত করার তাওফিক দান করুন। হাশরের ময়দানে হাদিসে ঘোষিত সব ধরনের শাফায়াত লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন