এগ্রোটেক
অ্যাকোয়াপনিকস: মাছ চাষ ও মাটি ছাড়া সবজি আবাদ করার যে সমন্বিত পদ্ধতি বাংলাদেশে জনপ্রিয় হচ্ছে
লেখক
বিবিসি বাংলাছোট একটি জায়গায় কেবল একটি অবকাঠামো ব্যবহার করে মাছ এবং সবজি চাষের একটি পদ্ধতি বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং বিশেষ করে তরুণ উদ্যোক্তাদের অনেকেই এখন এটা ব্যবহার করছেন।
এই পদ্ধতিটি পরিচিত অ্যাকোয়াপনিকস হিসেবে, যেখানে মাটি ছাড়াই সবজি উৎপাদন হয়।
বাংলাদেশ সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, অ্যাকোয়াপনিকস হলো মাছ ও সবজি চাষের একটি সমন্বিত পদ্ধতি।
আর বাংলাদেশে এ পদ্ধতির অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য চাষ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এম এ সালামকে।
তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরও আগে থেকেই অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে।
অধ্যাপক সালাম মনে করেন যে বাংলাদেশে যেহেতু চাষযোগ্য জমির পরিমান ক্রমশই কমে আসছে, তাই এ দেশে অ্যাকোয়াপনিকস-এর একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত রয়েছে মাছ চাষ ও সবজি আবাদের ক্ষেত্রে।
“যারা ছাদ বাগান করেন বা অল্প জায়গায় মাছ চাষ বা সবজি আবাদ করেন, তাদের জন্য এটি একটি দারুণ বিষয়। একই জায়গায় মাছ ও সবজির ফলন করা সম্ভব এবং তাও একেবারে কম খরচে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
অধ্যাপক সালাম সেই ২০১০ সালে নিজের বাড়ির ছাদে সবজি চাষ শুরু করেছিলেন, আর পরে এর সাথে ২০১১ সালে যোগ করেন মাছ। তবে অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতি তাকে যে সাফল্য এনে দিয়েছে, তা তাকে তাকে কৃষিক্ষেত্রে পদকও এনে দিয়েছে।
অ্যাকোয়াপনিকস কী?
সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে যে অ্যাকোয়াপনিকস হলো টেকসই একটি খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা।
এতে মাছ চাষ থেকে আসা ময়লা তথা দূষিত পানি গাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং সেখান থেকে স্বচ্ছ পরিষ্কার পানি পুনরায় মাছের ট্যাংকে ফিরে আসে।
এখানে লক্ষণীয় যে, এ পদ্ধতিতে মাটি ছাড়াই সবজি উৎপাদন করা যায় এবং ব্যাকটেরিয়া পানির সমুদয় বর্জ্য, ময়লা ইত্যাদি তাৎক্ষণিকভাবে দূরীভূত করে – যেভাবে প্রাণীর কিডনি ও লিভার এ কাজটি সম্পন্ন করে থাকে।
অধ্যাপক সালাম বলছেন যে এটি পুরোপুরি একটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি।
তিনি বলেন, মূলত মাটি ছাড়া পানিতে গাছপালা ও শাক-সবজি উৎপাদন করার একটি কৌশল হলো অ্যাকোয়াপনিকস। এখানে প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া অনুঘটক হিসাবে কাজ করে মাছের বর্জ্য থেকে গাছকে নিজের খাদ্য উৎপাদনে সহায়তা করে থাকে।
যেভাবে কাজ করে এই পদ্ধতি
অধ্যাপক সালাম জানান, হাইব্রিড এই পদ্ধতি একবার স্থাপন করা গেলে এরপর আর খুব একটা রক্ষণাবেক্ষণের দরকার হয় না।
তার মতে, অ্যাকোয়াপনিকসের প্রাথমিক মূলনীতি হলো মাছ বর্জ্য উৎপাদন করে গাছকে খাদ্যের জোগান দেয় আর গাছপালা মাছের জন্য পানি পরিষ্কার করে – এইভাবে এটি একটি ক্রমাগত চক্র তৈরি করে চলতে থাকে।
তিনি বলেন, যখন মাছ বর্জ্য (অ্যামোনিয়া) উৎপাদন করে, তখন ব্যাকটেরিয়া তাকে নাইট্রেটে পরিণত করে। একটি পাম্প তারপরে এই পানি বহন করে গাছের ট্রেতে নিয়ে যায়। গাছ ওই পানি থেকে নাইট্রোজেন গ্রহন করে পানি পরিষ্কার করে এবং ওই পরিষ্কার পানি আবার মাছের ট্যাঙ্কে ফিরে আসে, যা মাছের জন্য নিরাপদ পানি হিসেবে বিবেচিত হয়।
“এই চক্রটি বারবার নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে”, বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
“একদিকে মাছ যেমন ব্যাকটেরিয়ার জন্য পুষ্টি সরবরাহ করে, অন্যদিকে ব্যাকটেরিয়া মাছের বর্জ্য ভেঙ্গে নাইট্রেট তৈরি করে গাছের খাদ্যের যোগান দেয়। গাছ আবার পানি পরিষ্কার করে মাছের বসবাস নিরাপদ করে তোলে”।
অ্যাকোয়াপনিকসের বৈশিষ্ট্য:
বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতিতে মাছ ও সবজি চাষ করে নিচের সুবিধাগুলো পাওয়া যায় –
* সহজ প্রযুক্তি ও সম্পূর্ণ পরিবেশ বান্ধব
* অ্যাকোয়াপনিকস কোন বর্জ্য উৎপাদন করে না
* জৈব খাদ্য উৎপাদন পদ্ধতি হওয়ায় পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনের সুযোগ
* কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সবজি উৎপাদন সম্ভব
* পলিথিন দিয়ে ঘর তৈরি করে সারা বছরই মাছ ও সবজি চাষ করা যায়
* পানি সাশ্রয়ী
* অনুর্বর মাটির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে
* অনুর্বর এবং পতিত জমির সদ্ব্যবহার করে
* পদ্ধতিটি প্রাকৃতিক এবং সারের উৎসস্থল
* খাদ্য পরিবহনজনিত দূষণ হ্রাস করে
* একবার সিস্টেম দাড়িয়ে গেলে পরে আর খরচ নেই
* যে কোন এলাকায় ও যে কোনো আবহাওয়ায় এটি করা সম্ভব
* কোন ধরণের সার ক্রয়-বিক্রয় বা গুদামজাতের দরকার হয় না
অ্যাকোয়াপনিকসের চ্যালেঞ্জ:
তবে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই কেবল অ্যাকোয়াপনিকসে সাফল্য পাওয়া যেতে পারে। এগুলো হলো –
* নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা
* প্রযুক্তি-নির্ভর পদ্ধতি, তাই এ সম্পর্কে ভালোভাবে জানা
* যন্ত্রপাতি সময়মত রক্ষণাবেক্ষণ ও পরীক্ষা করা
* মাছকে ঠিক মতো খাবার দেয়া
* মাছ ও সবজি দ্রুততম সময়ে বাজারজাতের ব্যবস্থা
উৎপাদন কেমন হয়?
কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতিতে চাষের জন্য তেলাপিয়া মাছই সবচেয়ে উপযোগী, কারণ এই মাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এগুলো অধিক ঘনত্বেও চাষ করা সম্ভব।
এতে করে দুই হাজার লিটারের একটি ট্যাংক থেকে আট মাসেই ১০০-১২০ কেজি তেলাপিয়া উৎপাদন সম্ভব। এর সাথে পুরো বছর ধরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে টমেটো, লেটুস, কচু ও পুদিনা ইত্যাদি ফসল উৎপাদন করাও সম্ভব।
অধ্যাপক এম এ সালাম বিবিসি বাংলাকে অবশ্য বলেন যে তেলাপিয়ার পাশাপাশি কই মাছের চাষের জন্যও দারুণ কার্যকর অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতি, আর এর সঙ্গে থাকতে পারে যে কোন ধরণের সবজি।
তিনি জানান, পুকুরে বা অন্য পদ্ধতিতে চাষের চেয়ে দশগুনের বেশি পরিমাণ মাছ উৎপাদন হতে পারে অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতিতে।
অন্য উদ্যোক্তারা যা বলছেন
তিন বছর ধরে মিরপুরে নিজের বাড়ির ছাদে অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতি সবজি ও মাছ চাষ করছেন বাংলাদেশ বিমানের সাবেক কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান।
মিস্টার রহমান বিবিসি বাংলাকে জানান যে তিনি তেলাপিয়া মাছ চাষের সাথে সবজি হিসেবে ধুন্ধুল, চিচিঙ্গা, লাউ, ঢেঁরস, শিম, কচুশাক, পালংশাক ও কলমিশাক আবাদ করেন।
“ঠিকভাবে যত্ন নিলে দারুণ ফল পাওয়া যায়। আমার আটশো’ লিটারের দু’টি ড্রামে মাছ আছে। ভালোভাবে খাবার দিলেন ৩/৪ মাসেই মাছ প্রত্যাশিত আকার নেয়। আসলে এটিই আগামীর কৃষি হিসেবে জনপ্রিয় হবে,” বলছিলেন তিনি।
তিনি জানান, তার জানা মতে আরও অনেকেই এখন এ পদ্ধতিতে চাষাবাদে এগিয়ে আসছেন, এমনকি দু’একটি প্রতিষ্ঠানও এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত পণ্য বাজারে আনতে শুরু করেছে।
অ্যাকোয়াপনিকসের যত পদ্ধতি:
বাংলাদেশ সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইটে অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে বেশ কিছু পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
পুকুরে মাচা পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে বাঁশের চটি দিয়ে মাচা তৈরি করা হয়। মাচাটি প্রতিটি আধা লিটার পানি ভর্তি চল্লিশটি বোতল দিয়ে ভাসিয়ে রাখতে হয়। এরপর বোতলের তলায় অনেক ছিদ্র করে তার মধ্যে নারিকেলের ছোবড়া ও নুড়ি পাথর স্তরে স্তরে সাজিয়ে তাতে সবজির চারা লাগিয়ে মাছের পুকুরে স্থাপন করতে হয়।
প্রতিটি মাচায় চারটি করে কচু, পুদিনা, কলমিশাক, ঢেঁড়স ও টমেটোর সর্বমোট ২০টি চারা ব্যবহার করা যায়।
প্লাস্টিকের ড্রাম পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে প্লাস্টিকের ড্রাম লম্বালম্বিভাবে কেটে অর্ধেক করে নুড়ি পাথর ও মাটি স্তরে স্তরে সাজিয়ে কচু, পেঁপে ও বেগুনের চারা রোপণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে মাছের ট্যাংকের ময়লা পানি পাম্প করে প্রতিদিন দু’বার ড্রামের নুড়ি পাথরের মাঝে সরবরাহ করা হয়।
এ প্রক্রিয়ায় গাছের শেকড় প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করে এবং পরিষ্কার পানি পুনরায় মাছের ট্যাংকে ফিরে আসে। এ পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন অন্য যে কোনো পদ্ধতির চেয়ে ফলপ্রসূ ও আশাব্যঞ্জক প্রতীয়মান হয়েছে বলে কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে।
আলনা পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বোতল ভবনের ছাদে আলনায় স্থাপন করা হয়। সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট একটি কাঠের আলনায় আনুভূমিকভাবে ৬টি, উপরে নিচে তিন সারিতে ১৮টি এবং উভয় পাশে মোট ৩৬টি বোতল সাজিয়ে রাখা হয়।
বোতলগুলোর ছিপির ভেতরে এক টুকরো স্পঞ্জ দিয়ে তার ওপর নুড়ি পাথর বসিয়ে প্রতি বোতলে দু’টি করে সবজির চারা রোপণ করতে হয়। এতে একটি আলনায় ৩৬টি বোতলে ৭২টি চারা লাগানো যায়।
এভাবে ৫০০ লিটার পানির ট্যাংকে ৩৫০ লিটার পানি দিয়ে তাতে ৬০টি তেলাপিয়া মাছ মজুদ করা যায়।
গ্যালভানাইজড পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে গ্যালভানাইজড পাত দ্বারা ৫”x২”-৫”x১০” আকারের ট্রে তৈরি করে সেখানে পানি নির্গমনের জন্য একটি ৪ ইঞ্চি লম্বা পাইপ স্থাপন করা হয়। এরপর পানিভর্তি একটি ট্রের সাহায্যে ভাসমান মাচা পদ্ধতিতে এবং অপর একটিতে নুড়ি পাথর সাজিয়ে সবজি চাষ করা হয়।
ট্রেগুলোকে একটি ভাসমান বাঁশের মাচার ওপর রাখা হয়। ভাসমান মাচা পদ্ধতিতে চারটি করে টমেটো, লেটুস ও পুদিনার চারা একটি শোলার পাতের মাঝে রোপণ করা হয়। অন্যদিকে, নুড়ি পাথরের ট্রেতে কচু, টমাটো, লেটুস ও কলমিশাক রোপণ করে যথা নিয়মে মাছের ট্যাংকের পানি সরবরাহ করা হয়।
এভাবে আরও কিছু পরিচর্যা করার পর উভয় পদ্ধতিতেই সবজির চারা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায় বলে কৃষি তথ্য সার্ভিস জানিয়েছে।
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
লাভজনক সবজি চাষ পদ্ধতি
-
অর্গানিক খাদ্য: বাংলাদেশে বাড়ছে চাহিদা কিন্তু মান নিশ্চিত হচ্ছে কী?
-
পুইশাক চাষ পদ্ধতি
-
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
-
নিরাপদ খাদ্য: দেশি মাছ কাকিলাকে যেভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা
-
জিংক সমৃদ্ধ পুষ্টি ধানের চাষে কৃষকদের জামানতবিহীন ঋণ দেবে কৃষি ব্যাংক, কী লাভ এই চাল উৎপাদন বাড়লে?
-
নিপাহ্ ভাইরাসঃ খেজুরের রস খাওয়ার আগে সতর্ক থাকতে যা করণীয়
-
বাংলাদেশে বাড়ছে ইলিশ, মিয়ানমারে কেন কমছে – দা এগ্রো নিউজ
-
ইলিশ কি মিঠা পানির মাছ হয়ে যাচ্ছে? – দা এগ্রো নিউজ
-
কই মাছে বাঁধাকপির ছেঁচকি – দা এগ্রো নিউজ
এগ্রোটেক
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
লেখক
প্রথম আলোডাচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে দুই দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।
গতকাল সোমবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অনুষ্ঠিত কৃষি খাতের ব্যবসাবিষয়ক এক সম্মেলনে দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এগ্রি বিজনেস কনক্লেভে বাংলাদেশের প্রায় ৪০জন উদ্যোক্তা ডাচ কৃষি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি প্রযুক্তি সহযোগিতা ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছে ওয়েগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়।
আলোচনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তি কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি সহযোগিতা দিতে রাজি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে ডাচরা প্রস্তুত এবং বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও তাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া ডাচ সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বীজ, পশু খাদ্য, পোলট্রি, হর্টিকালচার ও এ্যাকুয়াকালচার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করেছে, যা ওই দেশের বেসরকারি খাতকে আরও উৎসাহিত করেছে।
আলোচনায় কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তৈরি আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্কয়ার, ইস্পাহানি এগ্রো, একে খান অ্যান্ড কোম্পানি, প্যারাগন গ্রুপ, এসিআই, জেমকন গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ডাচ প্রযুক্তির প্রয়োগ সরেজমিনে দেখতে যাবেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের পোল্ট্রিখাতে সহযোগিতার আলোচনা অনেকটা এগিয়েছে উল্লেখ করে মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দুই দেশের মধ্যে মৎস্য, পশুপালন ও হর্টিকালচারে সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা আছে।
কনক্লেভ আয়োজনে প্রথমবারের মতো দূতাবাসের সঙ্গে অংশীদার হয়েছে নেদারল্যান্ডসের কৃষি মন্ত্রণালয়, নেদারল্যান্ডস এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি, নেদারল্যান্ডস ফুড পার্টনারশিপ, ডাচ-গ্রিন-হাইজডেল্টা, লারিভ ইন্টারন্যাশনাল, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ।
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী নেদারল্যান্ডসের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কম। ২০২১-এ কৃষিপণ্য ও খাদ্য রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে।
এগ্রোটেক
পঞ্চাশে বাংলাদেশ: এক টেলিভিশন তারকা আর দরিদ্র কৃষকের সন্তান এক বিজ্ঞানী যেভাবে পাল্টে দিয়েছেন বাংলাদেশের কৃষি
লেখক
বিবিসি বাংলাশাইখ সিরাজ
বাংলাদেশে আধুনিক কৃষি প্রচলনের প্রথম চেষ্টা হয়েছিল কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে, ষাটের দশকে। এটির প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খানের উদ্যোগে জাপান থেকে আনা উন্নত জাতের একটি ধানের পরীক্ষামূলক চাষের উদ্যোগ নেয়া হলো। কিন্তু এই ধানের চাষের জন্য কৃত্রিম সেচের দরকার হবে। গ্রামে সেজন্য গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছিল।
“নলকূপ দিয়ে যখন মাটির নীচ থেকে পানি তোলা হচ্ছিল, তখন গ্রামের কিছু মানুষ ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তারা এটিকে দেখেছিল আল্লাহর ওপর খবরদারি হিসেবে। বুঝতেই পারছেন কৃষিতে নতুন প্রযুক্তি বা ধ্যানধারণার ব্যাপারে শুরুতে বাংলাদেশের কৃষকের মনোভাব কেমন ছিল”, বলছিলেন শাইখ সিরাজ, বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় এক টেলিভিশন উপস্থাপক।
হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে, জলপাই সবুজ রঙের ট্রেডমার্ক শার্ট পরে ক্যামেরা হাতে শাইখ সিরাজ এখন বাংলাদেশের যেখানেই যান, সেখানেই তাকে কৃষকরা সাদরে বরণ করে নেন।
কিন্তু যখন তিনি প্রথম রাষ্ট্রায়ত্ব বাংলাদেশ টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন, তখন পরিস্থিতি ছিল একেবারেই প্রতিকূল।
“তখন আমরা যেসব বিশাল ক্যামেরা নিয়ে গ্রামে যেতাম, সেগুলো দেখে লোকে ভয় পেত। তারা ভাবতো এটা বুঝি কামান। মাইক্রোফোনকে ভাবতো বন্দুকের নল। গ্রামগুলো আর্থ সামাজিক দিক দিয়ে তখন এতটাই পিছিয়ে। ক্যামেরার সামনে লোকজনকে কথা বলানো কঠিন ছিল, এতটাই লাজুক তখন গ্রামের মানুষ,” তিনি বলেন।
‘মাটি ও মানুষ’
বাংলাদেশের কৃষিতে গত কয়েক দশকে যে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে, শাইখ সিরাজকে বর্ণনা করা হয় সেই পরিবর্তনের পেছনে অন্যতম প্রধান এক চরিত্র হিসেবে।
বাংলাদেশে যখন বিজ্ঞানীরা একের পর এক নতুন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করে চলেছেন, কৃষিতে নতুন ধ্যান ধারণা এবং কৌশল চালুর জন্য সরকারের নানা পর্যায় থেকে চেষ্টা চলছে, সেগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে বিরাট ভূমিকা রাখে তার কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান, ‘মাটি ও মানুষ।’
“শুরুতে এই অনুষ্ঠানটা হতো আমার দেশ নামে। তখন এটি ৫০ মিনিটের পাক্ষিক অনুষ্ঠান। পরে এটিকেই ‘মাটি ও মানুষ’ নামে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করি। আমার মনে হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের চেয়ে বেশি দরকার শিক্ষামূলক মোটিভেশনাল অনুষ্ঠান। কৃষকদের যদি নতুন বীজ, নতুন প্রযুক্তি, নতুন কৌশল, এসব ঠিকমত বোঝানো যায়, তাহলে কৃষিতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব।”
গত চার দশক ধরে শাইখ সিরাজ হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে কৃষি বিষয়ক তথ্যের প্রধান উৎস। উনিশ’শ আশির দশকে, যখনো টেলিভিশন ঘরে ঘরে পৌঁছায়নি, তখনো গ্রামের হাটেবাজারে, কমিউনিটি সেন্টারে প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় ‘মাটি ও মানুষ’ দেখার জন্য ভিড় করতো মানুষ।
তবে কৃষকদের নতুন ধরণের কৃষিতে উৎসাহিত করার কাজটা সহজ ছিল না।
“আজকের কৃষক এবং তিরিশ বছর আগের কৃষকের মধ্যে তফাৎ আকাশ আর পাতাল। তখন কৃষকের কাছে একজন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা যে কথা বলতেন, একজন টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে আমি যেকথা বলতাম, সেটা তারা মানতে চাইতো না। তারা ভাবতো, আমরা যেধরণের কৃষির কথা বলছি, যদি সেটাতে ভালো ফসল না হয়? এ কারণে সে সহজে মোটিভেট হতে চাইতো না। সহজে নতুন প্রযুক্তি নিতে চাইতো না।”
“আমি যখন আশির দশকে উচ্চফলনশীল নতুন জাতের ধানের কথা বলছি, গমের কথা বলছি, তখন পরিস্কার তারা আমাকে বলতো এই রাবার ভাত খাবো না। তখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধানের মান তেমন ভালো ছিল না। ভাতটা ছিল রাবারের মতো, ভাতের দানা উপর থেকে থালার উপর ফেললে সেটি রাবারের মতো ড্রপ করতো।”
কিন্তু বিজ্ঞানীরা যখন তাদের গবেষণায় নতুন নতুন সাফল্য পাচ্ছিলেন, আর সেই সঙ্গে শাইখ সিরাজও তার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকদের মন জয় করার জন্য নতুন কৌশল নিচ্ছিলেন।
ভাষার পরিবর্তন
“তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে প্রমিত উচ্চারণে কথা বলতে হতো। আমি বুঝতে পারছিলাম গ্রামের মানুষের সঙ্গে আমার একটা দূরত্ব থেকে যাচ্ছিল। কৃষক আমার কথা কিছু বুঝতে পারছে, কিছু বুঝতে পারছে না। অন্যদিকে আমি যখন কৃষকের সঙ্গে কথা বলছি, সেও নিজেকে প্রকাশ করতে পারছে না,” তিনি বলেন।
টেলিভিশন অনুষ্ঠানে শাইখ সিরাজ তার মুখের ভাষায় পরিবর্তন আনলেন, গ্রামের মানুষের সঙ্গে তাদের কথ্য ভাষার ব্যবহার শুরু করলেন। পরিবর্তন এলো তার পোষাকেও। কেতাদুরস্থ শহুরে পোষাকের জায়গা নিল তার এখনকার ট্রেডমার্ক জলপাই রঙা শার্ট।
টাঙ্গাইলের এক গ্রামে ঝকঝকে নতুন টিনের চালার এক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে শহর থেকে আসা কজন মানুষ। ফসলের মাঠ ঘুরে দেখে এসে ক্লান্ত হয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন। স্থানীয় জাতের চামারা ধানের জায়গায় উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান-চাষ শুরু হওয়ার পর এলাকাটির অবস্থা কী, সেটা দেখতে গেছেন তারা।
শহুরে মানুষ দেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলেন গৃহস্থ। জানতে চাইলেন, আপনারা কারা।
“আমরা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের লোক,” জানালেন তারা।
“এরপর যা ঘটলো তার জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না”, বলছিলেন ডঃ এম এ সালাম, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক বিজ্ঞানী।
“লোকটি খুশিতে চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বললো, আল্লাহ আপনাদের ফেরেশতা হিসেবে পাঠিয়েছেন। আমরা হতচকিত। কী ঘটছে বুঝতে পারছি না।”
ঘটনাটি ১৯৯৬ সালের। যমুনা সেতু নির্মাণের জন্য যে নদী শাসন করা হয়েছে, তার ফলে এলাকাটি তখন বন্যামুক্ত। আগে সেখানে চাষ হতো কেবল স্থানীয় জাতের চামারা ধান, যেটি বন্যার পানির সঙ্গে বাড়ে, তিন-চার ফুট পানিতেও চাষ করা যায়। কিন্তু ফলন হতো খুব কম। বন্যামুক্ত এলাকায় সেই প্রথম কৃষকরা উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ শুরু করেছেন।
সেই কৃষক এরপর ডঃ সালাম এবং তার সহকর্মীদের হাত ধরে টানতে টানতে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলেন। বললেন, “এই যে টিনের চালার বাড়ি দেখছেন, এটা আমি ধান বিক্রির টাকায় করেছি। আমার চৌদ্দ পুরুষ কুঁড়েঘরে থাকতো। চামারা ধান চাষ করে আমাদের দিন চলতো খেয়ে-না খেয়ে। এখন দেখেন আমার কত ধান। আপনারা আমাদের জীবন বদলে দিয়েছেন।”
একজন সফল ধান বিজ্ঞানী হিসেবে কয়েক দশকের দীর্ঘ কর্মজীবনে এটি ডঃ সালামের সবচেয়ে মধুর স্মৃতিগুলোর একটি।
“আউশ, আমন এবং বোরো- এই তিন মৌসুম মিলে এখন আমাদের দেশে মোট ১১ হতে সাড়ে ১১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে চাষ হয়। এখন গড়ে আমরা প্রতি হেক্টরে চার টন ফলন পাই। যার ফলে এখন আমরা ধান উৎপাদনে উদ্বৃত্তে এসেছি। তা না হলে, আমরা যদি প্রতি হেক্টরে দেড় হতে দুই টন ফলনে থেকে যেতাম, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষকে খাওয়ানো-পরানো অসম্ভব ছিল,” বলছিলেন তিনি।
দুর্ভিক্ষের স্মৃতি
ময়মনসিংহ শহর থেকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী পেরিয়ে চর ইশ্বরদিয়া গ্রাম। উনিশ’শ চুয়াত্তর সালের শরৎকালে বাংলাদেশ যখন তার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর এক খাদ্য সংকটের মোকাবেলা করছে, তখন সেই গ্রামেও হানা দিয়েছে তীব্র অভাব।
চর ইশ্বরদিয়ার রশিদা তখন কিশোরী। প্রতিদিন খাবারের জন্য তাকে লাইনে দাঁড়াতে হতো বাড়ির কাছের এক লঙ্গরখানায়।
“লাইনে দাঁড়াইলে কোনদিন রুটি দিত, কোনদিন গোলা আটা দিত। অভাব চলছে মনে করেন প্রায় বছরখানিক। চাউল থাকলেও আমরা কিন্যা আইনা খাওনের মতো সামর্থ্য আছিল না। ফরে আটা আইন্যা খাই, আলু আইন্যা খাই। কোনদিন না খাইয়া থাকি। কোনদিন মনে করেন কচুর শাক তুইল্যা খাই। এইরকম কইরা দিন কাটাইছি।”
এম এ সালাম তখন চর ঈশ্বরদিয়া থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। লজিং থাকেন যে পরিবারের সঙ্গে, তাদের আর্থিক অবস্থাও খুবই খারাপ।
“ওরা তখন যা করছিল, সেটা আমি কোনদিন ভুলিনি। প্রতিদিন তারা কষ্ট করে হলেও আমাকে ভাত খেতে দিত, কিন্তু তারা নিজেরা জাউ খেয়ে থাকতো। এত ভালোবাসতো ওরা আমাকে।”
এম এ সালাম স্বপ্ন দেখছিলেন একজন কৃষি বিজ্ঞানী হওয়ার। অল্প বয়সে তার মধ্যে এই স্বপ্ন উস্কে দেন দরিদ্র কৃষক পিতা।
“আমি যখন ক্লাশ থ্রীতে পড়ি, তখন একদিন ধান কাটার মওসুমে আমার বাবার সঙ্গে আমি গরুর গাড়িতে করে মাঠে গেছি ধান তুলতে। কিছুক্ষণ পর আমার গাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। তখন আমার বাবা বলছে, দ্যাখো বাবা, কৃষিকাজ কত কঠিন। কত পরিশ্রমের। তুমি যদি লেখাপড়া শিখতে পারো, তাহলে তোমার এই পরিশ্রম করা লাগবে না। তুমি ভালো থাকবে, আমরাও ভালো থাকবো,” শৈশবের কথা বলতে গিয়ে ডঃ সালামের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে।
ডঃ এম এ সালাম এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে কৃতি ধানবিজ্ঞানীদের একজন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে যত রকমের উন্নত জাতের ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে, তার অন্তত ২০টির গবেষণায় সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি।
তাদের উদ্ভাবন পাল্টে দিয়েছে বাংলাদেশের কৃষি। ঢাকার গুলশানে যে প্রতিষ্ঠানে তিনি এখন নতুন গবেষণায় নিয়োজিত সেখানে বসে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে।
উনিশ’শ সাতাত্তর সালে যখন তিনি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে যোগ দিলেন, তখন দুর্ভিক্ষ পরবর্তী বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, কীভাবে এই দেশটির বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যের সংস্থান করা যায়।
“তখন বাংলাদেশে একজন মানুষ হয়তো সারাদিনে একবারই খায় এবং সেটা হয়তো এক সের চালের ভাত। ভাতই তার প্রোটিন, ভাতই তার ভিটামিন, এটাই তার সবকিছু। বাংলাদেশ ধানের দেশ। অথচ কী দুর্ভিক্ষ আমাদের, কী করুণ অবস্থা।”
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের সামনে তখন বড় চ্যালেঞ্জ কীভাবে ধানের উৎপাদন বাড়ানো যায়।
“আমি যখন কাজে যোগ দিলাম, তখন আমাদের সিনিয়র বিজ্ঞানীরা বললেন, আমাদেরকে এটা করতেই হবে। আমাদেরও প্রতিজ্ঞা, এই দেশকে আমরা বদলে দেব।”
বিআর-৩ বিপ্লব
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর শুরুর দিকে একটি মাত্র উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ হচ্ছিল পরীক্ষামূলক ভাবে, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত ইরি-৮।
কিন্তু বাংলাদেশে এই জাতটির চাষের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা ছিল এটির জীবনকাল ছিল বেশ দীর্ঘ। তা ছাড়া বোরো মওসুমে চাষ করতে হলে জমিতে সেচের দরকার ছিল, তখনো বাংলাদেশে আধুনিক সেচের পদ্ধতি গড়ে উঠেনি।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা তখন ইরি-৮ এর সঙ্গে বাংলাদেশের একটি স্থানীয় জাতের লতিশাইল ধানের সংকর ঘটিয়ে উদ্ভাবন করলেন নতুন জাত বিআর-৩, যেটির আরেক নাম ছিল বিপ্লব।
কিন্তু এটিও ধান চাষে প্রত্যাশিত সাফল্য আনতে ব্যর্থ হলো।
“মূল সমস্যা হলো ফটো পিরিয়ড সেনসিটিভিটি, অর্থাৎ আলোক সংবেদনশীলতা। বাংলাদেশে রোাপা আমন মওসুমে যত স্থানীয় জাতের ধান লাগানো হতো, তার সবগুলোই ছিল আলোক সংবেদনশীল। যার ফলে এগুলো মাঠে লাগানোর পর হতে ধান কাটার আগে পর্যন্ত সময়টা ছিল অনেক দীর্ঘ। আমাদের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ হলো, কীভাবে স্থানীয় জাতের ধানগুলো থেকে আমরা আলোক সংবেদনশীলতা তুলে নিতে পারি।”
উনিশ’শ পঁচাশি সালে এম এ সালাম ঠিক এই ফটো পিরিয়ড সেনসিটিভিটি বা আলোক সংবেদনশীলতা নিয়ে পিএইচডি করতে গেলেন ফিলিপিন্সে। ফিরে এলেন ১৯৮৮ সালে।
“এবার আমাদের চেষ্টা শুরু হলো কীভাবে স্থানীয় জাতের ধান থেকে আমরা ফটো পিরিয়ড সেনসিটিভিটি আলাদা করতে পারি। এটা যদি করা যায়, এই ধানের চাষ তিন মাসেই করা সম্ভব। এটার বিজ্ঞান আমাদের জানা। এটা পিউর জেনেটিক্স।”
ব্রি-২৯ ঘটালো বিপ্লব
ধান গবেষণায় বাংলাদেশে ধীরে ধীরে সাফল্য আসতে শুরু করলো। একের পর এক উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের প্রচলনের ফলে বাড়তে শুরু করলো খাদ্য উৎপাদন। সবচেয়ে বড় সাফল্য আসলো নব্বুই এর দশকের মাঝামাঝি। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন ব্রি-২৮ এবং ব্রি-২৯ অবশেষে বিপ্লব ঘটিয়ে দিল।
“বাংলাদেশে এখন বছরে যত ধান উৎপাদন হয়, তার অর্ধেক আসে কেবল এই দুটি উফশী জাতের ধান থেকে। ব্রি-২৮ থেকে প্রতি হেক্টরে পাঁচ টন পর্যন্ত ফলন হয়। আর ব্রি-২৯ থেকে প্রতি হেক্টরে ফলন পাওয়া যায় ছয় টন পর্যন্ত। এটা প্রমানিত।”
ডঃ সালাম এ পর্যন্ত যত জাতের ধান গবেষণায় জড়িত ছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম সফল একটি উদ্ভাবন হচ্ছে ব্রি-৫০। ২০০৮ সালে উদ্ভাবিত এই জাতটির জনপ্রিয় নাম বাংলামতি। এই সুগন্ধি জাতের চালের মান অনেকটা বাসমতির মতো।
ধান গবেষণায় তার অবদানের জন্য ডঃ এম এ সালাম ২০০৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রাইস কংগ্রেসে সেরা বিজ্ঞানীর পুরস্কার পান।
মনে পড়ছে সেই আশির দশকে যখন পুকুরে মাছ চাষের কথা গ্রামের কৃষককে বলতাম তখন কৃষক অবাক হতো। বলত, মাছের আবার চাষ কী? চাষ তো হয় ধান-পাটের। কৃষক ধান-পাট ছাড়া আর কোনো কিছু চাষের কথা চিন্তাও করত না। রংপুর ও পার্বত্য এলাকায় তামাক চাষ হতো। কোথাও কোথাও চাষ হতো পানের। খালে-বিলে হতো মাছের প্রাকৃতিক বংশবিস্তার। কৃষক পুকুর ব্যবহার করত কাপড় ধোয়া আর গোসলে। অথচ এই পুকুরে মাছ চাষ মেটাতে পারে তার পারিবারিক আমিষের চাহিদা, পাশাপাশি জোগান দিতে পারে বাড়তি অর্থ। কৃষককে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারণার জন্য নির্মাণ করেছিলাম ‘হাকিম আলীর মাছ চাষ’ নিয়ে ফিলার। খুব জনপ্রিয় হয়েছিল সেটি। এরপর বলা চলে সারা দেশে মাছ চাষের বিপ্লব শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় দেশ এখন মাছ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়। অন্যদিকে আমাদের বিজ্ঞানীদের গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন মাছের জাত আবিষ্কৃত হয়েছে। সরকারের মাছ চাষের সম্প্রসারণ নীতি ও উদ্বুদ্ধকরণমূলক প্রচারণার ফলে মাছ চাষ এগিয়েছে অনেকটা। মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে, বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ২০১৭ সালে দেশে ৪১ দশমিক ৩৪ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে।
১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৭.৫৪ লাখ মেট্রিক টন। ৩৩ বছরের ব্যবধানে ২০১৬-১৭ সালে এ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৪১.৩৪ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ, এই সময়ের ব্যবধানে মোট মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের মানুষের মাছ খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। আগে জনপ্রতি প্রতিদিন গড়ে ৬০ গ্রাম মাছ খেত, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম। মাছে এতসব সাফল্যের পরও মাছের খামারিদের সঙ্গে কথা বলে বেশ কিছু সমস্যার কথা শুনেছি বিগত বছরগুলোয়। এ বছরও কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেটে মাচের খামারিরা বেশ কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেন। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে কৃষিশ্রমিকের অপর্যাপ্ততা, পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, অক্সিজেন কমে যাওয়া, মাছের খাদ্যের উচ্চমূল্য, খাদ্যে পুষ্টি উপাদান যা থাকার কথা তা অনেক ক্ষেত্রেই না পাওয়া। এ অভিযোগগুলো শতকরা ৯০ ভাগ মাছ চাষির।
সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়ে এসেছেন এক কৃষকের সন্তান। নাম শফিউল আলম। পেশায় সফটওয়্যার প্রকৌশলী। তার কথাই আজ বলব, পাঠক।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দক্ষিণ কোরিয়ায় যাই এশিয়ার বৃহত্তম বার্ষিক উদ্ভাবনী মেলা দেখার জন্য। কোরিয়ার তাপমাত্রা তখন মাইনাসের নিচে। প্রচ- শীত। ঝকঝকে রোদের দিন। অথচ শীত গিয়ে যেন হাড়ে বিঁধছে। ব্যক্তিজীবনে আমি প্রচ- শীতকাতুরে মানুষ। শীতের পোশাক-আশাক যা ছিল সব নিয়েই হাজির হই সিউলে। এয়ারপোর্টে নেমেই দেখলাম সেখানকার তাপমাত্রা মাইনাস ৮। শীতের ভয়ের চেয়ে মনের ভয়েই কাবু হয়ে গেলাম অনেকখানি। ধরে নিলাম এভাবেই চলতে হবে একটি সপ্তাহ। যাই হোক, বার্ষিক উদ্ভাবনী মেলাটি বসেছে গ্যাঙনাম শহরে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ইউটিউবের ইতিহাসে সাড়া ফেলানো গ্যাঙনাম স্টাইল গানটির কথা। গ্যাঙনাম স্টাইলের সেই গ্যাঙনাম শহরে কোয়েক্স হলে আয়োজন করা হয় উদ্ভাবনী মেলার। তারুণ্য, উদ্ভাবন, প্রযুক্তির অগ্রগতি আর বিশ্ববাণিজ্য সবকিছুর এক অন্যরকম মিশেল এ প্রদর্শনী ক্ষেত্র। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসারের কারণেই এ প্রদর্শনী বিশ্বব্যাপী জাগিয়েছে ব্যাপক সাড়া। পৃথিবীর ৩৩টি দেশের ৬০৬টি উদ্ভাবনের ভিতর থেকে বহুভাবে বাছাইয়ের পর মাত্র ৪০টি উদ্ভাবনী প্রকল্প প্রদর্শনের জন্য স্থান পেয়েছে। আয়োজনটি প্রধানত তত্ত্বাবধান করেছে কোরিয়ার আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়। আর এতে সহায়তা করেছে কোরিয়ার ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন ও ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ইনভেনটরস অ্যাসোসিয়েশন। জীবনকে সুন্দর ও সহজ করার এই উদ্ভাবনী মেলায় আমাদের জন্য গর্বের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন শফিউল আলম। অন্যদিকে বিশাল আয়োজনে এটিই একমাত্র কৃষিভিত্তিক উদ্ভাবন। আর সেটি আমাদের শফিউল আলমের। পৃথিবীতে মাছ উৎপাদনে বিশাল সাফল্যের বিবেচনায় আমাদের বাংলাদেশের জন্য এটি বড় রকমের সুখবর। উদ্ভাবক শফিউল এ মেলায় প্রতিনিধিত্ব করছেন বাংলাদেশের এ প্রজন্মের উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া অগণিত তরুণের।
মেলায় প্রদর্শিত হচ্ছে শফিউলের উদ্ভাবনের প্রটোটাইপটি। প্রকল্পটির প্রটোটাইপ দেখে বুঝে ওঠার উপায় নেই, এর উপযোগিতা বা বিশেষত্ব কত বড়। মেলায় শফিউলের সঙ্গে তার উদ্ভাবন নিয়ে কথা হয় বিস্তারিত। শফিউল বলেন, তার বাবা কৃষক, দাদাও কৃষক ছিলেন। উঠে এসেছেন এক কৃষকের পরিবার থেকেই। পাশাপাশি শৈশব-কৈশোরে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘মাটি ও মানুষ’ তাকে জুগিয়েছে কৃষি নিয়ে স্বপ্ন দেখার অনুপ্রেরণা। তিনি ও তার স্ত্রী তানিয়া চৌধুরী দুজনই সফটওয়্যার প্রকৌশলী। দুজনের গবেষণার ফল একটি স্মার্ট ডিভাইস। যেটি অ্যারেটর (মাছের পুকুরে পানি কাটার দুটি প্রপেলার সমন্বয়ে একটি যন্ত্র যা অক্সিজেন তৈরিতে সাহায্য করে) হিসেবে কাজ করবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। পাশাপাশি খাদ্য সরবরাহ, অক্সিজেন সরবরাহ ও পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ, মাছের গতিবিধি সম্পর্কেও ধারণা দেবে। অটো চার্জিং ব্যবস্থা থাকায় যন্ত্রটি ব্যবহারেও সুবিধাজনক। অগণিত তরুণ উদ্যোক্তা চাষির হাত ধরে বিশাল সাফল্যে পৌঁছেছে আমাদের মৎস্য চাষ খাত। অভ্যন্তরীণ মৎস্য উৎপাদনে পৃথিবীতে তৃতীয় স্থানে পৌঁছে যাওয়ার এ কৃতিত্ব আমাদের উদ্যোগী চাষিদের। যারা একের পর এক বহু সংকট মোকাবিলা করে এ খাত এগিয়ে নিচ্ছেন। রীতিমতো একটি শিল্পে রূপ নেওয়া এ খাতের সঙ্গে যুক্ত উদ্যোক্তারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিকে বরাবরই স্বাগত জানিয়ে আসতৃণ। মাছের খামারের পুকুর সংস্কার, পানি পরিবর্তন থেকে শুরু করে একসময় উন্নত বিশ্বের ধারাবাহিকতায় অ্যারেটর যন্ত্রের সঙ্গেও পরিচয় ঘটে তাদের। মাছ চাষের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা কারিগরি সংযোজনের সঙ্গে সঙ্গেই স্বয়ংক্রিয় উপায়ে মাছের পুুকুরে খাদ্য দেওয়ার ব্যবস্থাও আসে একসময়। প্রযুক্তির এ ধারাবাহিক বিবর্তনের হাত ধরেই এসেছে সফটওয়্যার প্রকৌশলী শফিউল আলমের এ প্রকল্পটি। প্রকল্পটি নিয়ে বিশাল প্রদর্শনীর পর্যায়ে আসার পেছনে রয়েছে অনেক বড় গল্প। এটি কোরিয়া ইনভেনশন প্রমোশন অ্যাসোসিয়েশন কাইপা ও কোরিয়া প্রডাকটিভিটি সেন্টার কেপিসির আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণকারী হিসেবে বৃত্তি লাভ করেছে এবং অ্যা বিগ থিঙ্ক প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ পুরস্কার লাভ করেই এখানে আসতে পেরেছে। কারিগরি প্রযুক্তি ও তথ্য যোগাযোগে বহুদূর অগ্রসর কোরিয়া পৃথিবীব্যাপী উন্নত গবেষণা আর কারিগরি সাফল্য খুঁজে ফিরছে। তারা বহুভাবে মূল্যায়ন করছে প্রকৃত সৃজনশীল উদ্ভাবককে। সে হিসেবে বাণিজ্যিক বিবেচনায় শফিউলের উদ্ভাবিত প্রকল্পটির স্বত্ব থাকবে কোরিয়ার কাছে।
কোয়েক্সে প্রশস্ত আর রঙিন প্রদর্শনী ক্ষেত্রের আবিষ্কার আর উদ্ভাবনের এ মেলায় অনেকেরই দৃষ্টি এ প্রকল্পের দিকে। দেখা হলো বাংলাদেশের কয়েকজনের সঙ্গেও; যার মধ্যে রয়েছেন প্রযুক্তিকে স্বাগত জানানো প্রগতিশীল মাছ চাষি থেকে শুরু করে তরুণ গবেষক পর্যন্ত। সেখানেই কথা হয় জয়পুরহাটের কৃষক রফিকুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলছেন, শফিউলের এ আবিষ্কার সময়োপযোগী। এর উদ্ভাবনী উৎকর্ষ নিয়ে ভাবছেন তরুণ গবেষকরাও। কথা হলো কোরিয়ার চুংবক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে গবেষণারত ওবায়দুল্লাহ অভি ও স্বপন কুমার রায়ের সঙ্গে। তারাও গর্বিত শফিউলের এ সাফল্যে।
কোরিয়ার গবেষণা, উন্নয়ন এমনকি বাণিজ্যিক খাতের বড় বড় ব্যক্তির কাছেও এ উদ্ভাবনটি পেয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। বিশেষ করে কোরিয়ার ফিশারিজ ইনফরমেশন অ্যান্ড কন্ট্যান্ট টেকনোলজি অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক পার্ক ইয়ং জন এ কাজটিকে দেখছেন বিশাল এক বৈজ্ঞানিক সাফল্য হিসেবে। তিনি জানান, শফিউলের এ আবিষ্কার দক্ষিণ কোরিয়া, বাংলাদেশসহ বিশ্বের মাছ চাষিদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগামী বছরের মাঝামাঝি যন্ত্রটি পেটেন্ট পেয়ে যাবে। তারপর শুরু হবে বাণিজ্যিক উৎপাদন। পার্ক জানালেন, কোরিয়ায় শুধু মাছ নয়, সামগ্রিক কৃষি খাতেই স্মার্ট প্রযুক্তি সম্প্রসারণ হচ্ছে। বিশেষ করে ২০২২ সালের মধ্যে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে স্মার্ট প্রযুক্তি সংযোজনের বিশাল এক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা। আর এ ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টি বিশ্বের তরুণ বিজ্ঞানী, গবেষক এবং তাদের স্টার্টাপ উদ্যোগগুলোর দিকে। আমরাও কাজ করতে গিয়ে এর বাস্তবতা দেখেছি। বিশেষ করে একেকটি পুরস্কারপাপ্ত উদ্ভাবন ও উদ্ভাবকের জন্য পৃষ্ঠপোষকতার অনন্য নজির গড়ে তুলেছে হুন্দাই কার্ড ব্ল্যাক স্টুডিও নামের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। ঠিক এ যুগের তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উদ্ভাবকদের জন্য মনোলোভা পরিবেশ। দিনরাত কাজে মগ্ন থাকার সব ব্যবস্থাই রয়েছে সেখানে। যেখানে কাজ করছেন বাংলাদেশের তরুণ আইসিটি বিশেষজ্ঞ শফিউল। পাঠক! আপনাদের আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই, এ মেলাতেই শফিউলের উদ্ভাবনটি সিলভার মেডেল পেয়েছে।
উন্নত দেশগুলো এখন অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বিশ্বব্যাপী মেধা, বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষ, উদ্ভাবন কিংবা ধারণা সংগ্রহে নিয়োজিত। আর এ বিবেচনায় বহুদূর এগিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া। প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় তারা বিনিয়োগ করছে সর্বোচ্চ অর্থ ও মনোযোগ। তাই পেয়েও যাচ্ছে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পথের নতুন নতুন দিকনির্দেশনামূলক উদ্ভাবন আর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। এখানে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অনেক অনুসরণীয় নজির রয়েছে। আমাদের সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের উচিত হবে শফিউলদের মতো উদ্ভাবক এবং তাদের উদ্ভাবনগুলোর যথাযথ মূল্যায়ন করা। আজ মৎস্য খাতের জন্য অত্যন্ত জরুরি এ প্রযুক্তিটির গর্বিত দাবিদার আমরা হলেও এর বাণিজ্যিক স্বত্ব কোরিয়া লাভ করতে সমর্থ হয়েছে। এখানে আমাদের সম্ভাবনাময় তরুণদের কাজ ও চিন্তা বিশ্বায়নের দিকে যতটা সাফল্যের সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে, দেশের অর্জন দেশে রাখার জন্য ততটা নীতিগত প্রস্তুতিও দরকার।
ফলমূল এবং সবজি মাঠে চাষ করেন না ইয়ুচি মোরি। তার ক্ষেত্রে আসলে মাটি বলে কোন জিনিস নেই।
বরং এই জাপানি বিজ্ঞানী চাষাবাদের জন্য এমন একটি জিনিসের ওপর নির্ভর করেন, যেটি আসলে মানুষের বৃক্ক বা কিডনির চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হতো- আর তা হছে পরিষ্কার এবং সহজ ভেদ্য পলিমারের ঝিল্লি।
ওই ঝিল্লির ওপরে উদ্ভিদ বড় হয়ে ওঠে, যা তরল এবং পুষ্টি মজুদ করে রাখে।
যেকোনো পরিবেশে সবজি গাছগুলোকে বড় হওয়ার সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি, এই প্রযুক্তি প্রচলিত কৃষিকাজের তুলনায় ৯০ শতাংশ কম পানি ব্যবহার করে। সেই সঙ্গে কীটনাশকও ব্যবহার করতে হয় না- কারণ পলিমার নিজেই ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে।
এটি একটি উদাহরণ মাত্র, যা দিয়ে ভূমি এবং কর্ম শক্তির ঘাটতিতে থাকা জাপান কৃষি কাজে বিপ্লব ঘটিয়ে দিচ্ছে।
”কিডনি ডায়ালাইসিসের কাজে যে ঝিল্লি ব্যবহার করা হতো, আমি সেসব বস্তু এখানে ব্যবহার করছি,” বিবিসিকে বলেছেন এই বিজ্ঞানী।
তার কোম্পানি মেবাইওল প্রায় ১২০টি দেশে এই আবিষ্কারের পেটেন্ট বা স্বত্বাধিকার নিশ্চিত করেছে।
এটা আসলে জাপানের অব্যাহত একটি কৃষি বিপ্লবকে সামনে তুলে ধরেছে। মাঠগুলো এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট আর সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একেকটা টেকনোলজি সেন্টারে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।
কৃষিকাজে ব্যবহৃত প্রযুক্তি অদূর ভবিষ্যতে ভালোভাবে ফসলের নজরদারি এবং রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা আরো বাড়িয়ে দেবে।
এ বছর পানিসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক জাতিসংঘের বিশ্ব প্রতিবেদনে ধারণা করা হয়েছে যে, বর্তমানে যে হারে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে এবং পানির ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় ৪০ শতাংশ শস্য উৎপাদন এবং ৪৫ শতাংশ বিশ্বের দেশজ পণ্য উৎপাদন ঝুঁকিতে পড়বে।
ইয়ুচি মোরির আবিষ্কৃত কৃষি পদ্ধতি এর মধ্যেই জাপানের ১৫০টি এলাকায় ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে আরব আমিরাতের মতো অনেক দেশ এই প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে।
বড় ভূমিকম্প প্রবণ এবং ২০১১ সালের মার্চে পারমাণবিক বিপর্যয়ে পড়া এলাকাগুলোয় নতুন করে কৃষিকাজ শুরু করার জন্য এই পদ্ধতি বিশেষভাবে সহায়তা করছে।
রোবট ট্র্যাক্টর
ধারণা করা হয়, বিশ্বের জনসংখ্যা সাতশো সত্তর কোটি থেকে বেড়ে ২০৫০ সাল নাগাদ নয়শো আশি কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে। ফলে বিশ্বের খাদ্য চাহিদা মেটানোর বিষয়টিকে বড় ব্যবসায়িক সুযোগ হিসাবে দেখছে কোম্পানিগুলো, পাশাপাশি যন্ত্রপাতির বড় বাজারও তৈরি হচ্ছে।
বর্তমানে বিশ ধরণের রোবট তৈরির ব্যাপারে ভর্তুকি দিয়ে সহায়তা করছে জাপানের সরকার, যেগুলো কৃষিকাজের নানা পর্যায়ে সহায়তা করতে পারবে। নানা ধরণের ফসলের বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল সংগ্রহের কাজ করবে এসব রোবট।
হাক্কাইডো ইউনিভার্সিটির সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মেশিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইয়ানমার একটি রোবট ট্র্যাক্টর তৈরি করেছে, যেটি এর মধ্যেই ক্ষেতে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
একজন ব্যক্তি একই সময়ে দুইটি ট্র্যাক্টর চালাতে পারবে। সেন্সরের কারণে এসব ট্র্যাক্টর সামনে বাধা সনাক্ত করতে পারে এবং সংঘর্ষ এড়িয়ে যেতে পারে।
এ বছরের শুরুর দিকে গাড়ি নির্মাতা নিশান সৌর শক্তি চালিত একটি রোবট তৈরি করে যেটি জিপিএস এবং ওয়াইফাই রয়েছে। ডাক নামের ওই বাক্স আকৃতির রোবটটি বন্যার শিকার হওয়া ধান ক্ষেতে ঢুকে পানি নিষ্কাশন, কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস আর পরিবেশগত প্রভাব নির্ণয়ে সহায়তা করেছে।
কম মানুষকে নিয়ে খামারের কাজ
প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে জাপানের সরকার তরুণ প্রজন্মকে আকর্ষিত করতে চায়, যাদের সরাসরি কৃষি ক্ষেতে কাজ করার আগ্রহ নেই, কিন্তু প্রযুক্তিতে দক্ষতা রয়েছে।
এটি আসলে অর্থনীতির এমন একটি খাতকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা, যেখানে শ্রম শক্তি হারিয়ে যেতে বসেছে।
গত এক দশকে জাপানে কৃষিকাজের সাথে জড়িত জাপানির সংখ্যা বাইশ লাখ থেকে কমে সতেরো লাখে দাঁড়িয়েছে।
আরো জটিল ব্যাপার হলো, এখন একজন কৃষকের গড় বয়স হলো ৬৭ বছর এবং বেশিরভাগ খামারি খণ্ডকালীন কাজ করেন।
জমির সংকট জাপানের কৃষিকাজের আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা, যেখান থেকে দেশটির মোট খাদ্য চাহিদার মাত্র চল্লিশ শতাংশ এসে থাকে।
দেশটির প্রায় ৮৫ শতাংশ জমি হচ্ছে পাহাড়ি। চাষযোগ্য বেশিরভাগ জমিতে ধান চাষ করা হয়।
ধান জাপানের প্রধান খাদ্য এবং এটি চাষের জন্য ধানচাষীদের ভর্তুকি দিয়ে থাকে সরকার।
কিন্তু মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলে গেছে।
আকাশ থেকে ছিটানো
১৯৬২ সালে একজন জাপানি বছরে ১১৮ কেজি চাল খেতেন। ২০০৬ সালে সেটি নেমে দাঁড়িয়েছে ৬০ কেজিতে। এর ফলে জাপানের কৃষিকাজেও ধানের বাইরে গিয়ে বৈচিত্র্য আনার উদ্যোগ শুরু হয়েছে।
কিন্তু শ্রমিক সংখ্যা কম থাকায় জাপানের কৃষকদের যন্ত্র এবং জৈবপ্রযুক্তির দ্বারস্থ হতে হচ্ছে।
চালক বিহীন যান বা ড্রোনের মাধ্যমে আকাশ থেকে বীজ বা কীটনাশক জমিতে ছিটিয়ে দেয়া হচ্ছে। একটি ড্রোন যা মাত্র আধঘণ্টা করতে পারে, একজন মানুষের হয়তো সেটা করতে পুরো একটি দিন লাগবে।
উন্নত প্রযুক্তির ফলে এমনকি জমি ছাড়াই ফসলের বিস্তৃতিও ঘটানো যায়।
গ্রিনহাউজ প্রযুক্তি এবং জল-চাষ প্রযুক্তি (যাতে মাটির পরিবর্তে খনিজ সমৃদ্ধ পানিতে উদ্ভিদ চাষ করা হয়) প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাপান ফলমূল এবং সবজি উৎপাদন করছে।
চিবার একটি প্রতিষ্ঠান, মিরাই গ্রুপ মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত তাক তাক করে খাদ্যশস্য উৎপাদন শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে প্রতিদিন ১০ হাজার লেটুস সংগ্রহ করছে।
প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় এভাবে প্রায় একশোগুণ বেশি ফসল পাওয়া যায়।
একটি সেন্সর যন্ত্রের মাধ্যমে কোম্পানি কৃত্রিম আলো, তরল পুষ্টি, কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা এবং তাপমাত্রা পরিমাপ করতে পারে।
কৃত্রিম আলো এসব উদ্ভিদকে দ্রুত বেড়ে উঠতে সাহায্য করে এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা রোগবালাইয়ের সম্ভাবনা দূর করে দেয়।
তবে অতিরিক্ত শক্তি খরচের পরেও, জাপানে এ ধরণের ‘ উদ্ভিদ কারখানা গত এক দশকে তিনগুণ বেড়ে গেছে। বর্তমানে এরকম দুইশো প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
বিশ্ব বাজারে বর্তমানে জল-চাষ প্রযুক্তিতে দেড়শ কোটি ডলারের ব্যবসা হচ্ছে। কিন্তু পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অ্যালিয়েড মার্কেট রিসার্চ ভবিষ্যতবাণী করেছে যে, ২০২৩ সাল নাগাদ এই বাজারের আকার দাঁড়াবে ছয়শ চল্লিশ কোটি ডলারে।
প্রযুক্তির হস্তান্তর
জাপান প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে আফ্রিকান দেশগুলোর বার্ষিক ধান উৎপাদনের হার দ্বিগুণ করে বছরে পাঁচ কোটি টনে নিয়ে যাওয়া হবে। এজন্য বেশ কিছু প্রকল্পও গ্রহণ করা হচ্ছে।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সেনেগালে জাপান কৃষি প্রযুক্তি প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করেছে এবং সেচ বিষয়ক প্রযুক্তি হস্তান্তর করেছে।
ফলে, দেশটিতে প্রতি হেক্টরে ধানের উৎপাদন চার টন থেকে বেড়ে সাত টন হয়েছে এবং কৃষকদের আয় বিশ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাপানের কৌশল হলো, বেসরকারি বিনিয়োগ বিস্তারে সহায়তা করা এবং আফ্রিকা মহাদেশে টেকসই কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবসা বিস্তৃত করা।
ভিয়েতনাম, মিয়ানমার এবং ব্রাজিলের সঙ্গেও দেশটির সহযোগিতার নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
কিন্তু জাপানের কৃষি বিপ্লবের আসল উদ্দেশ্য হলো নিজেদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ২০৫০ সালের মধ্যে দেশটি মোট খাদ্য চাহিদার অন্তত ৫৫ শতাংশ নিজেরা উৎপাদন করতে চায়।
আর সেটি তারা প্রযুক্তির সহায়তায় বাস্তবায়ন করতে চায়।
সেই দিন কি তাহলে প্রায় এসে গেল, যখন এমন খাবার বিক্রি হবে দোকানে – যা তৈরি কৃত্রিম মাংস দিয়ে, কিন্তু তা থেকে আসল মাংসের মতোই ‘রক্ত’ বেরোয়?
সম্প্রতি কিছু কিছু দেশে ‘মিট-ফ্রি’ খাবার সহজলভ্য হয়ে ওঠায় বিশেষজ্ঞরা এমন কথাই বলছেন।
মানুষের খাদ্য কিভাবে পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে – তা নিয়ে একদিকে যেমন উদ্বেগ বাড়ছে, অন্যদিকে নিরামিষভোজী হবার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।
এই ভেজিটেরিয়ানরা যে খাবার খান তাকে বলে ভেগান ফুড। বিভিন্ন মাংস-জাত খাবারের ভেগান সংস্করণ বের হতে যাচ্ছে এখন। যেমন: ভেগান সসেজ-রোল বা ভেগান বার্গার।
এতে যে মাংস ব্যবহৃত হবে – তা দেখতে চিরাচরিত মাংসের মতোই। এই ‘নিরামিষ মাংসের’ গন্ধ ও স্বাদও আসল মাংসের মতো। এ থেকে আসল মাংসের মতো ‘রক্ত’ও বেরোয়।
এগুলো তৈরি হচ্ছে উদ্ভিদজাত প্রোটিন থেকে। সাধারণত এ কাজে ব্যবহার হচ্ছে গম, মটরশুঁটি বা আলু থেকে। আর এই মাংসের ‘রক্ত’ তৈরি হচ্ছে বীটের রস দিয়ে।
গরুর মাংসের রঙ এবং স্বাদ তৈরি হয় যে প্রাণীজ উপাদানটি থেকে তার নাম হচ্ছে ‘হেম’। ইম্পসিবল ফুডস নামে একটি আমেরিকান ফার্ম সম্প্রতি উদ্ভিজ্জ ‘হেম’ তৈরি করেছে – যা কৃত্রিম মাংসকে আসলের চেহারা এনে দেবে বলেই তারা মনে করছেন।
বিজ্ঞানীরা এখন ল্যাবরেটরিতেও কৃত্রিম মাংস তৈরি করছেন। এটা তৈরি হচ্ছে প্রাণীর স্টেম সেল দিয়ে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে এমন স্তরের কৃত্রিম মাংস তৈরি করা যা রান্না করা বা খাওয়ার অভিজ্ঞতা হবে একেবারেই আসল মাংসের মতো – এর পার্থক্য ধরাই প্রায় অসম্ভব হবে।
এখন পাশ্চাত্যের কিছু সুপারস্টোরে একটা মাংস-মুক্ত শাখাও দেখা যাচ্ছে।
তবে কৃত্রিম মাংস দিয়ে তৈরি খাদ্য পণ্য এখনো বাজারে বা রেস্তোরাঁয় না এলেও কয়েক বছরের মধ্যেই তা পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
‘জাস্ট’ নামে একটি ফার্ম বলছে, ২০১৯ সাল শেষ হবার আগেই তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপার স্টোরগুলোতে ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা চিকেন বা ‘মুরগির মাংস’ আনতে পারবে বলে তারা আশা করছে।
অবশ্য এ জন্য আমেরিকার ফুড এ্যান্ড ড্রাগ এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অনুমতি লাগবে।
তা ছাড়া সে অনুমতি পাওয়া গেলেও ল্যাবরেটরিতে তৈরি মাংস সম্পর্কে মানুষের যে বিরূপ ধারণা বা ‘ছি ছি’ করে ওঠার প্রবণতা – তা একটি বড় বাধা হবে, এমনটাই অনেকের ধারণা।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন