মৎস্য
করোনায় মহাসঙ্কটে চিংড়ি চাষীরা
লেখক
নয়া দিগন্তহিমায়িত চিংড়ি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত। অথচ উচ্চ মূল্যে চিংড়ির পোনা ক্রয়, মাছের খাবারের মূল্য বৃদ্ধি ও চিংড়ির দাম অর্ধেকে নেমে যাওয়ায় খুলনার চিংড়ি চাষীরা মহাসঙ্কটে পড়েছেন।
ইতোমধ্যে চাষীদের লোকসান পুষিয়ে নিতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। করোনার প্রথম কয়েক মাস চিংড়ি রফতানিতে ভাটা পড়লেও সেটি এখন কেটে গেছে।
মৎস্য কর্মকর্তা, হিমায়িত চিংড়ি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ও চাষীরা জানান, দেশের সবচেয়ে বেশি খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় চিংড়ি চাষ হয়। ঘের মালিকরা চাষকৃত চিংড়ি আড়তগুলোতে সরবরাহ করেন। হিমায়িত চিংড়ি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় মৎস্য আড়তদারদের কাছ থেকে বাগদা অথবা গলদা চিংড়ি সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে রফতানি করে। কিন্তু করোনার কারণে চিংড়ি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো আড়তগুলো থেকে চিংড়ি সংগ্রহ বন্ধ করে দেয়। ফলে পাইকারি বাজারে মাছের দরপতন হয়। সেই প্রভাব পড়ে ঘের ব্যবসায়ীদের ওপর।
খুলনা অঞ্চলের মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ পরিদর্শক তৌফিক মাহমুদ বলেন, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে খুলনা অঞ্চল থেকে ২৯ হাজার ৫৪০ মেট্রিক টন মাছ রফতানি হয়েছে। যার মূল্য দুই হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত রফতানি হয়েছে ২১ হাজার ৪৯০ মেট্রিক টন মাছ। যার মূল্য এক হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। করোনার মধ্যেই চলতি অর্থবছরের সাত মাসে রফতানি খুবই ভালো।
খুলনা অঞ্চলের মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ অফিস সূত্র জানায়, খুলনা থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৯ হাজার ৬.৮২১ মেট্রিক টন চিংড়ি রফতানি থেকে আয় দুই হাজার ২৯০ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৯ হাজার ২০০.৭৮৮ মেট্রিক টন চিংড়ি রফতানি থেকে আয় ২ হাজার ৪৮৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩০ হাজার ২১৭.০৭ মেট্রিক টন চিংড়ি রফতানি থেকে আয় দুই হাজার ৫৮৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩১ হাজার ৬৮৬.৭৪ মেট্রিক টন চিংড়ি রফতানি থেকে আয় দুই হাজার ৫৪২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩১ হাজার ৬৮৬.৭৪ মেট্রিক টন চিংড়ি রফতানি থেকে আয় দুই হাজার ৫৪২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩২ হাজার ৮০২.৮১ মেট্রিক টন চিংড়ি রফতানি থেকে আয় দুই হাজার ৭০০ কোটি ২২ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩৮ হাজার ৫৫১.৫৩ মেট্রিক টন চিংড়ি রফতানি থেকে আয় দুই হাজার ২৪৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ও ২০১১-১২ অর্থবছরে ৪২ হাজার ৪৮৯.১০৩ মেট্রিক টন চিংড়ি রফতানি থেকে আয় দুই হাজার ৫৩৩ কোটি ৪ লাখ টাকা।
খুলনা মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের উপপরিচালক মোঃ মজিনুর রহমান বলেন, করোনার কারণে প্রথম দুই তিন মাস রফতানিতে ভাটা পড়ে। তবে পরবর্তীতে আবার রফতানি স্বাভাবিক হয়ে যায়। সামগ্রিকভাবে এখন রফতানি ভালো।
ডুমুরিয়া উপজেলার চিংড়ি চাষি কৌশিক বাগচি বলেন, ‘গলদা-বাগদা চাষ লাভজনক ব্যবসা। ১৯৯৭ সাল থেকে চিংড়ি চাষ করে আসছি। খুবই ভালো যাচ্ছিল। সম্প্রতি করোনার প্রভাবে মাছের দাম কমে গেছে। ২০ গ্রেডের যে মাছ ৮৩০-৮৪০ টাকায় বিক্রি করেছি, সেই মাছ বিক্রি করতে হয় ৫২০-৫৩০ টাকায়। মাছের মূল্য অর্ধেকে নেমে এসেছে। অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আমরা। মাছ চাষে মাসে দেড় লাখ টাকা আয় ছিল। কিন্তু করোনাকালীন সেই আয় ৫০ হাজার টাকায় নেমেছে। এর মধ্যে ২০২১ সালে ভালো লাভের আশায় প্রস্তুতি নিয়েছি। সেই অনুযায়ী ঘের প্রস্তুতও করছি।’
একই এলাকার মৎস্য চাষী হৃদয় সিং বলেন, করোনার আগে মাছ চাষ মোটামুটি ভালো ছিল। গত কয়েক মাস লোকসান গেছে। নতুন বছরে ভেবেছিলাম পরিবর্তন হবে। তা আর হয়নি।
ডুমুরিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, চাষীদের রেণু বেশি দামে কিনতে হয়। আগে এক হাজার রেণু কিনতে হতো এক হাজার টাকায়। এখন সেটি তিন হাজার টাকায় কিনতে হয়। মাছ চাষের যে খাদ্য সেটিরও দাম বেড়েছে। অন্যদিকে মাছ বিক্রি করতে গিয়ে লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষীদের। আগে যে মাছ বিক্রি হতো ১৬০০- ১৮০০ টাকা। সেই মাছ এখন ৫০০-৭০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে হয়। এসব কারণে চিংড়ি চাষিরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সেই সাথে করোনার প্রভাব তো রয়েছেই। করোনার কারণে যেসব চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। ডুমুরিয়ার চার হাজার ১১৪ জন চাষিকে ছয়টি ক্যাটাগরিতে বাছাই করে ছয় কোটি ২২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা প্রণোদনা দেয়া হয়।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আবু ছাইদ বলেন, করোনার কারণে চিংড়ি চাষীরা সঠিক সময়ে মৎস্য আহরণ করতে পারছেন না। সেই সাথে চিংড়ি উৎপাদনের যে উপকরণ সামগ্রী, করোনাকালীন যে প্রতিবন্ধকতা ছিল, তার জন্য চাষীরা খাদ্য ঠিকমতো কিনতে পারেননি। সেই সময় শ্রমিক সঙ্কট ছিল। যে কারণে অধিক শ্রম দিয়ে শ্রমিক নিতে হয়েছে। এসব কারণে চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, সরকার সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে; কীভাবে সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া যায়।
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
জানুন চৌবাচ্চায় বাগদা চিংড়ি মাছ চাষের কৌশল
-
কীভাবে খাদ্য প্রয়োগ করলে মাছের বৃদ্ধি বাড়বে, জেনে নিন কম খরচে মাছ পালনের পদ্ধতি
-
বাড়ছে মিল্কফিশ চাষ, জেনে নিন এর সহজ চাষ পদ্ধতি
-
রাতে বিক্রি হচ্ছে পায়রা ও বিষখালী নদীর ইলিশ
-
ঐতিহ্যবাহী দেশীয় মাছ
-
আশা জাগানিয়া কুঁচিয়া
-
দেশী প্রজাতীর মাছ চাষ ও সংরক্ষণ
-
দেশি সুস্বাদু লাভজনক শিং মাছের চাষ পদ্ধতি
-
ফরমালিনের বিকল্প চিংড়ির খোসা
-
পুকুরে কই মাছ চাষ করে অধিক উপার্জন করুন
এগ্রোটেক
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
লেখক
প্রথম আলোডাচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে দুই দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।
গতকাল সোমবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অনুষ্ঠিত কৃষি খাতের ব্যবসাবিষয়ক এক সম্মেলনে দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এগ্রি বিজনেস কনক্লেভে বাংলাদেশের প্রায় ৪০জন উদ্যোক্তা ডাচ কৃষি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি প্রযুক্তি সহযোগিতা ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছে ওয়েগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়।
আলোচনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তি কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি সহযোগিতা দিতে রাজি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে ডাচরা প্রস্তুত এবং বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও তাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া ডাচ সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বীজ, পশু খাদ্য, পোলট্রি, হর্টিকালচার ও এ্যাকুয়াকালচার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করেছে, যা ওই দেশের বেসরকারি খাতকে আরও উৎসাহিত করেছে।
আলোচনায় কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তৈরি আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্কয়ার, ইস্পাহানি এগ্রো, একে খান অ্যান্ড কোম্পানি, প্যারাগন গ্রুপ, এসিআই, জেমকন গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ডাচ প্রযুক্তির প্রয়োগ সরেজমিনে দেখতে যাবেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের পোল্ট্রিখাতে সহযোগিতার আলোচনা অনেকটা এগিয়েছে উল্লেখ করে মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দুই দেশের মধ্যে মৎস্য, পশুপালন ও হর্টিকালচারে সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা আছে।
কনক্লেভ আয়োজনে প্রথমবারের মতো দূতাবাসের সঙ্গে অংশীদার হয়েছে নেদারল্যান্ডসের কৃষি মন্ত্রণালয়, নেদারল্যান্ডস এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি, নেদারল্যান্ডস ফুড পার্টনারশিপ, ডাচ-গ্রিন-হাইজডেল্টা, লারিভ ইন্টারন্যাশনাল, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ।
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী নেদারল্যান্ডসের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কম। ২০২১-এ কৃষিপণ্য ও খাদ্য রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে।
মৎস্য
নিরাপদ খাদ্য: দেশি মাছ কাকিলাকে যেভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা
লেখক
বিবিসি বাংলাবাংলাদেশে গত কয়েক দশকে বেশ কিছু ছোট মাছের প্রজাতি বিপন্ন হয়ে পড়লেও এসব মাছের মোট উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে মৎস্য বিজ্ঞানীদের গবেষণায় ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে।
কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা উন্মুক্ত জলাশয়ের এরকম ৩১টি মাছকে বিলুপ্ত হওয়ার বিপদ থেকে রক্ষা করছেন। শুধু তাই নয়, এর ফলে পুষ্টিসমৃদ্ধ এসব মাছ এখন সহজে পুকুরেও চাষ করা সম্ভব হচ্ছে।
বাংলাদেশে স্বাদু পানিতে ২৬০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। তার মধ্যে ১৪৩টি মাছই ছোট মাছ। যেসব মাছ আকারে নয় সেন্টিমিটারের ছোট সেগুলোকে ছোট মাছ বা স্মল ইন্ডিজেনাস স্পেসিস কিম্বা এসআইএস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করে যে আন্তর্জাতিক সংগঠন আইইউসিএন, তারা বাংলাদেশের ৬৪টি প্রজাতির মাছকে ইতোমধ্যে বিপন্ন বলে উল্লেখ করেছে।
এসব মাছের মধ্যে রয়েছে মহাশোল, খরকি, পিপলা শোল, কালা পাবদা, বাঘ মাছ ইত্যাদি।
এ কারণে সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে অস্তিত্বের হুমকির মধ্যে পড়া এসব মাছের বেশ কয়েকটিকে রক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে গত কয়েক বছরে ৩০টি মাছকে বিলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে।
এসব মাছের মধ্যে রয়েছে শিং, মাগুর, পুঁটি, বাইম, টেংরা, ফলি, বাতাসি, ঢেলা, বৈরালি, গুতুম, খলিসা ইত্যাদি।
মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত এক দশকে ছোট মাছের উৎপাদন চারগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালে এই মাছের উৎপাদনের পরিমাণ যেখানে ছিল ৬৭,০০০ মেট্রিক টন, সেখানে ২০১৮ সালের উৎপাদন ছিল প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন।
বাংলাদেশের মত মিয়ানমারেও প্রজন্ম প্রজন্ম ধরে ইলিশ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন বহু জেলে।
কিন্তু বিবিসি বার্মিজ বিভাগের কো কো অং তার এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলছেন, নিয়ন্ত্রণহীন মাছ শিকার এবং সরু জালের ব্যবহারে হুমকিতে পড়েছে ইরাবতী নদীর ইলিশ।
বহুদিন ধরে ইরাবতী নদীতে ইলিশ মাছ ধরে জীবনধারণ করেন ৬৫ বছরের উ কাওক টিন। বিবিসিকে তিনি বলেন, “আমার বাবা ইলিশ ধরতো, আমিও ধরি। সেসময় অনেক মাছ পেতাম, বড় বড় ইলিশ পেতাম।”
“এখনো আমি এবং আমার ছেলেরা ইলিশ ধরতে যাই। কিন্তু মাছ খুব কম। আর যাও বা পাই সেগুলো ছোটো ছোটো।”
এফএও’র এক হিসাবে বিশ্বের মোট ইলিশের ৬০ ভাগ ধরা পড়ে বাংলাদেশে। আর মিয়ানমারে ১৫-২০ ভাগ।
এক সময় ইলিশ ছিলো মিয়ানমারের মাছ রপ্তানির শীর্ষে। কিন্তু এখন তা ইতিহাস।
সাগর থেকে ডিম পাড়তে নদীতে ঢোকে ইলিশ।
কিন্তু বাণিজ্যিক মাছ ধরার ট্রলারগুলো যেভাবে নতুন ধরনের সব জাল দিয়ে সাগরের একেবারে তল থেকে মাছ ছেঁকে আনছে তাতে ছোটবড় সব মাছ উঠে আসছে।
গবেষকরা বলছেন, আড়াই সেন্টিমিটারের ছোট ছিদ্রের জাল ব্যবহার হচ্ছে দেদারছে, যদিও আইন অনুযায়ী সেই ছিদ্র অন্তত ১০ সেমি হতে হবে।
আর এ কারণে ইলিশ মাছ সাগর থেকে নদীতে ঢোকারই সুযোগ পাচেছনা।
এখন যা পাওয়া যায় তার গড় ওজন ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম, অথচ একসময় দুই-তিন কেজি ওজনেরও মাছ হরহামেশা ধরা পড়তো।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের মাইকেল আকেসটার বলছেন, “কত ছোটো মাছ ধরা যাবে সে ব্যাপারে (মিয়ানমারে) কোনো বিধিনিষেধ নেই।” তার ফলে বাচ্চা ইলিশও ধরা হচ্ছে।
বাংলাদেশের মত মিয়ানমারেও ডিম পাড়ার সময় (মে থেকে জুলাই) নদীতে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে তা প্রয়োগ করা হচ্ছে, দারিদ্রের কথা বিবেচনা মিয়ানমার সরকার তা প্রয়োগ করেনা।
কিন্তু মিয়ানমার সরকারের মৎস্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলছেন নদী ও সাগরে এখনও প্রচুর ইলিশ। “এখনো প্রচুর ধরা পড়ছে, চিন্তার কোনো কারণ নেই।”
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে সাগরে ধরা পড়া ইলিশের পরিমাণ গত বছর বেড়েছে। কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই ছোটো সাইজের। যত বড় হওয়ার কথা, তার অর্ধেক।
ভারতের কেন্দ্রীয় মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে মিঠা পানির নদীতে ঢুকে বহু ইলিশই আর কখনও সাগরে ফিরে যাচ্ছে না।
ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, ঠিক এই কারণেই এখন গঙ্গার মোহনা থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার উজানেও সারা বছর ধরে ইলিশ মিলছে – এবং স্বাদে-গন্ধেও সেগুলো দারুণ ভাল।
মোহনায় পাতা মাছধরা জালের ভয়েই ইলিশের ঝাঁক মিষ্টি পানিতে রয়ে যাচ্ছে বলে তারা ধারণা করছেন। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের ইলিশ কেন আর কীভাবে মিঠাপানির স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণত হচ্ছে?
ইলিশ সাগরের মাছ হলেও ডিম পাড়তে ঝাঁকে ঝাঁকে তারা নদীতে ঢোকে – আবহমান কাল থেকে ইলিশ-প্রিয় বাঙালি সেটাই জেনে এসেছে।
কিন্তু ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেসের অর্থায়নে করা এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বহু ইলিশ ডিম পাড়তে গঙ্গায় ঢুকলেও আর কখনও বঙ্গোপসাগরে ফিরছে না।
ওই গবেষক দলের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী, অধ্যাপক অসীম কুমার নাথ বলছিলেন, ইলিশের ‘অটোলিথে’ বিভিন্ন রাসায়নিকের পরিমাণে তারতম্য দেখে তারা এর প্রমাণ পেয়েছেন।
তিনি বলছিলেন, “অটোলিথ মাছের একটা অর্গ্যান, যা ইলিশের ক্ষেত্রে মাথায় থাকে, কোনও কোনও মাছের ফ্যারিঞ্জিয়াল রিজিওনেও থাকে। এই অটোলিথ বিশ্লেষণ করে একটা মাছের মাইগ্রেটরি রুট সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়।
“আমরা এখন ইলিশের অটোলিথ কেটে দেখতে পাচ্ছি সেখানে বিভিন্ন রাসায়নিকের অনুপাত এমন যা থেকে স্পষ্ট অনেক ইলিশই আর সাগরে ফিরছে না। মিঠা জলে এগুলোর বেশ ওজনও হয়ে গেছে – পাঁচশো বা সাড়ে পাঁচশো গ্রাম – আবার ওদিকে ক্ষুদে সাইজের পাঁচ-দশ গ্রাম ওজনের ইলিশও মিলছে।”
আসলে সাগরে না-ফেরাটা এই ইলিশগুলোর এক ধরনের বেঁচে থাকার চেষ্টা বা ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ বলেই মনে করছেন ভারতের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ফিশারিজ এডুকেশনের মুখ্য বিজ্ঞানী বি কে মহাপাত্র।
“গলদা চিংড়ি হরিদ্বারেও দেখা যায়, সেখান থেকে ডিম পাড়তে তারা চলে আসে সুন্দরবনের মোহনাও। এই জাতীয় মাছকে বলে ক্যাটাড্রোমাস। কিন্তু ইলিশ হল অ্যানাড্রোমাস মাছ, তারা সাগর থেকে ডিম পাড়তে যায় নদীর ভেতর।”
“কিন্তু কেন এখন তারা আর ফিরতে চাইছে না? চাইছে না, কারণ গঙ্গার এসচুয়ারি জুড়ে বিছানো আছে চোদ্দ হাজারেরও বেশি জাল – তাই প্রাণে বাঁচতেই তারা রয়ে যাচ্ছে মিষ্টি জলে। এটাকে বিবর্তনবাদ বা ন্যাচারাল সিলেকশন হিসেবেই দেখা যায়,” বলছিলেন বি কে মহাপাত্র।
বহু বছর আগে গুজরাটে দেখা গিয়েছিল, তাপ্তী নদী বেয়ে ইলিশের ঝাঁক উকাই জলাধারে ঢুকে সেখানেই থাকতে শুরু করে, ডিম পাড়ে ও তাদের বাচ্চাও হয়।
এখন অনেকটা একই ধাঁচের জিনিস দেখা যাচ্ছে গঙ্গাতেও – জানাচ্ছেন অধ্যাপক অসীম কুমার নাথ।
“গঙ্গায় কাকদ্বীপের নিচে নিশ্চিন্দাপুরে যেখানে মিঠা পানি শুরু, সেখান থেকে ওপরে আপনি যদি দুশো কিলোমিটারেরও বেশি ওপরে বলাগড় অবধি যান, সেখানে ক্যালেন্ডার করে আমরা দেখতে পাচ্ছি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ-প্রাক মনসুন-মনসুন কিংবা পোস্ট-মনসুন … সারা বছরই কিন্তু এই পুরো এলাকা জুড়ে ইলিশ মিলছে।”
তবে অধ্যাপক নাথ সেই সঙ্গে বলছিলেন, বিশেষত বর্ষার পর কৃষিক্ষেতের কীটনাশক-যুক্ত জল যখন এসে নদীগুলোতে মেশে, তখন এই মিঠা পানির ইলিশগুলোর বিরাট ক্ষতিও হয়ে যাচ্ছে।
মিঠা জলের নদীতে পাকাপাকিভাবে থাকার জন্য এই ইলিশদের বেশি দূষণের শিকার হতে হচ্ছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তার পরেও স্বাদে-গন্ধে সেগুলো কিন্তু অন্য ইলিশের চেয়েও ভাল, বলছিলেন ড: মহাপাত্র।
তার কথায়, “মিঠা পানিতেই কিন্তু ইলিশের স্বাদ বাড়ে – কারণ নদীতে ঢোকার পরই তাদের শরীরে ফ্যাট বাড়ে, সেগুলো খেতেও অনেক ভাল হয়। গভীর সমুদ্রে ধরা ইলিশের স্বাদ কখনওই তেমন হয় না। ফলে এগুলোর স্বাদ নিয়ে কোনও সমস্যা নেই!”
ইলিশ কখনও সাগরে না সাঁতরালে তাকে আদৌ সত্যিকারের ইলিশ বলা যাবে কি না, তা নিয়ে অবশ্য মৎস্য বিজ্ঞানী আর খাদ্য-রসিকদের মধ্যে দু’রকম মত আছে।
কিন্তু ভারতীয় বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, বেশ কিছু ইলিশ আর কখনওই সাগরে ফেরার টান অনুভব করছে না – আর জেলেরা গঙ্গায় সেই ইলিশ পাচ্ছেন বছর জুড়েই!
বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে বেশ কয়েক প্রজাতির পরিচিত দেশীয় মাছ বাজার থেকে ‘প্রায় নেই’ হয়ে গেছে।
প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন বলছে, এর মধ্যে ‘প্রায় বিলুপ্ত’ হবার পথে বাঘাইর, পিপলা শোল বা বাক্কা মাছ, মহাশোল, নান্দিলা মাছ, চান্দা, ভাঙ্গান বাটা, খরকি মাছ, কালো পাবদা, চেনুয়া মাছসহ বেশ কিছু মাছ রয়েছে।
ময়মনসিংহে বাংলাদেশের একমাত্র মৎস্য জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক মোস্তফা আলী রেজা হোসেন জানিয়েছেন, এই মুহুর্তে দেশের ১১৮ প্রজাতির দেশীয় মাছ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
“আইইউসিএন বাংলাদেশের বিপন্ন প্রাণীর তালিকা করার জন্য দুটি জরিপ চালিয়েছিল, ২০০০ সালে প্রথম জরিপে ৫৪ প্রজাতির মাছ বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এরপর ২০১৫ সালে সর্বশেষ জরিপে তাতে আরো ৬৪ প্রজাতির মাছ যুক্ত হয়।”
“এই তালিকায় সেই সব মাছকেই চিহ্নিত করা হয়েছিল যেগুলো গত ১০ বা ২০ বছরে দেখা যায়নি।”
বিলুপ্ত মাছ নেই
বাংলাদেশে প্রায় বিলুপ্তির পথে ১০০র বেশি দেশীয় মাছ থাকলেও এখনো কোন মাছকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়নি।
আইইউসিএনের এ সংক্রান্ত নিয়মটি হচ্ছে, সর্বশেষ কোন একটি প্রজাতির মাছের দেখা পাবার পর পরবর্তী ২৫ বছরে যদি সেই প্রজাতির অস্তিত্বের কোন প্রমাণ না পাওয়া যায়, তাহলে সেটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
মৎস্য জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক হোসেন বলছিলেন, ময়মনসিংহ অঞ্চলে নান্দিল নামে এক সময় একটি মাছ দেখা যেত, কিন্তু গত ২০ বছরে সেটির অস্তিত্বের কোন প্রমাণ দেখা যায়নি।
আবার সিলেট অঞ্চলের পিপলা শোল নামে একটি মাছ দেখা যেত, যা এখন আর দেখা যায় না। গত ১০ বছরে দেখা যায়নি এই মাছ।
“দেখা যায়নি, কিন্তু তবু বিলুপ্ত ঘোষণা করার আগে আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।”
“যদি এর মধ্যে বিপন্ন মাছেদের অস্তিত্বের ব্যপারে কোন তথ্য না পাওয়া যায়, তাহলে হয়ত আইইউসিএনের পরবর্তী জরিপে এগুলোর ব্যপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা থাকতে পারে।”
প্রায় বিলুপ্ত কোন কোন প্রজাতি?
আইইউসিএনের ২০১৫ সালের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী কয়েকটি শ্রেণীতে মোট ৬৪ প্রজাতির মাছকে রেড লিস্ট বা লাল তালিকাভুক্ত করেছে, এর মানে হচ্ছে এসব প্রজাতির মাছ হয় প্রায় বিলুপ্ত, মহাবিপন্ন ও বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘আপডেটিং স্পেসিস রেড লিস্ট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রকল্পের অধীনে এই তালিকা করা হয়।
এ সংক্রান্ত প্রথম জরিপটি হয়েছিল ২০০০ সালে, সে সময় ৫৪টি প্রজাতিকে রেড লিস্টভুক্ত করা হয়েছিল।
জরিপে মূলত স্বাদু পানির এবং আধা লোনা পানির মাছকেই গণনায় ধরা হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ঐ ‘রেড লিস্ট’ তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন।
কী কী মাছ এখন আর তেমন দেখা যায় না?
বাংলাদেশে দেশীয় মাছের প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৩০০।
এর মধ্যে ২০১৫ সালে আইইউসিএন এর সর্বশেষ মূল্যায়নে ২৫৩ প্রজাতির মাছের ওপর জরিপ চালানো হয়েছিল।
তাতে দেখা গেছে সময়ের বিবর্তনে যেসব মাছ বিলুপ্তপ্রায় তার বেশির ভাগই নদীর মাছ মানে স্বাদু পানির মাছ।
তবে, ৩০০ প্রজাতির মাছের মধ্যে অন্তত ৪০ প্রজাতির মাছের ব্যাপারে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোন সংস্থার কাছে হালনাগাদ কোন তথ্য নেই।
আইইউসিএন কয়েকটি ভাগে মাছের অবস্থা ব্যাখ্যা করেছিল।
এর মধ্যে কিছু মাছ ক্রিটিক্যালি এনডেঞ্জারড বা প্রায় বিলুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ এগুলো সন্ধান ও সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে সেগুলো অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
এর বাইরে মহা বিপন্ন, বিপন্ন এবং সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে বহু প্রজাতি।
বাংলাদেশে বিপন্ন মাছের মধ্যে রয়েছে—পাঙ্গাস, দারি, ককসা, টিলা বা হিরালু, টিলা ককসা, রানি বা বউ মাছ, বেতাঙ্গি, বেটি বা পুতুল মাছ, কালা বাটা, ঘর পোয়া, ঘর পইয়া, ঘোড়া মাছ, এলানগা, কচুয়া পুটি, বোল, চিতল, গজার, টেংরা, রিটা, গাঙ্গিনা বা চাকা মাছ, বট শিং, ঘাউড়া, সাল বাইম।
এছাড়া সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে বাও বাইম, চাপিলা, গুতুম, পুঁইয়া, পিয়াসি, জারুয়া বা উট্টি, ছেপ চেলা, গোফি চেলা, বাটা মাছ, নারু মাছ বা গনিয়া, কাচকি, ফলি, শিল বাইলা, বেলে, শিং, আইড়, বোয়াল, তেলি, কুইচ্চা মাছ, বামোস মাছ।
কেন এই অবস্থা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কানিজ ফাতেমা বলছেন, মাছের প্রজাতি হারিয়ে যাওয়া বা কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে তিনি প্রথমেই জলাশয় কমে যাওয়াকে দায়ী করেন।
“শহর ও গ্রাম দুইখানেই নদী-খালসহ সব ধরণের জলাশয়ের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ কমার সঙ্গে দিনে দিনে কমছে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছের পরিমাণও।”
“কেবল দেশী জাত ও স্বাদের মাছই নয়, এর সঙ্গে কচ্ছপসহ নানা ধরণের জলজ প্রাণী ও সরীসৃপের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।”
সেই সঙ্গে রয়েছে জমিতে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি, যা বৃষ্টিতে ধুয়ে খাল বিলসহ জলাশয়গুলোতে পড়ে।
এর ফলে মাছের মৃত্যু ও প্রজনন হার মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। আছে কলকারখানার বর্জ্য নিকটস্থ জলাশয়ে ফেলা হয়, তার ফলেও মাছ মরে যায়, বলেন মিজ ফাতেমা।
এর সঙ্গে অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন-সক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, কারেন্ট জালের ব্যবহার এবং মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করাকেও কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে, বাংলাদেশ মৎস্য জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক হোসেন জানিয়েছেন, বিদেশী মাছের চাষের কারণেও দেশী প্রজাতির মাছ কমে গেছে।
“ধরুন এখানে তেলাপিয়া, কার্পজাতীয় মাছ আনা হয়েছে, আবার এক সময় আফ্রিকান মাগুর আনা হয়েছিল। কয়েক বছর আগে আনা হলো পিরানহা–এগুলো দেশী মাছের খাবার ও বাসস্থল দখল করতো। অনেক সময় দেশী মাছ খেয়ে ফেলতো কোন কোন বিদেশী প্রজাতি।”
যদিও পরে আফ্রিকান মাগুরের চাষ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু তারপরেও বিদেশী মাছের প্রজাতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে অনেক মাছ কমে গেছে।
কৃত্রিম প্রজনন ও চাষ কি সমাধান?
বাংলাদেশে দেশীয় অনেক প্রজাতির মাছের হার কমে যাবার প্রেক্ষাপটে গত দুই দশকে কৃত্রিম প্রজনন ও চাষের মাধ্যমে মাছের সরবারহ বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর সাড়ে ৪২ লাখ মেট্রিক টনের বেশি মাছ উৎপন্ন হচ্ছে।
এর মধ্যে নদী, বিল ও হাওরসহ উন্মুক্ত জলাশয় থেকে ২৫ শতাংশ, পুকুর, ডোবার মত বদ্ধ জলাশয় থেকে ৫৭ শতাংশ এবং বাকি অংশ সমুদ্র থেকে উৎপাদিত হচ্ছে।
দেশে ৮ লাখ হেক্টর বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ হয়।
বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিসের কর্মকর্তা বলরাম মহালদার জানিয়েছেন, কৃত্রিম প্রজনন ও চাষের মাধ্যমে বাজারে চাহিদা আছে এমন মাছই বেড়েছে।
“কিন্তু বাজারে চাহিদা কম এমন মাছ তো চাষ করছে না কেউ, ফলে সেগুলোর অস্তিত্ব সংকট আগের মতই থাকছে। যেমন খলিশা, চাপিলা, মেনি, ফলি, বাও বাইম, গুতুম, কুইচ্চা মাছ, বামোস ইত্যাদি ধরণের মাছ দেখতে পাবেন না।”
“এখন বাজারে পাবদা বা গুলশা মাছ বা পাঙ্গাস পাবেন আপনি, সেগুলোর চাহিদা আছে। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক না হলে, বিপন্ন মাছের ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।”
তবে ফসলি জমি নষ্ট করে দেশে মাছ চাষ করা নিয়ে পরিবেশবাদীদের এক ধরণের বিরোধিতাও রয়েছে।
তাদের পরামর্শ বিদ্যমান নদী ও পুকুরগুলোতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়াতে হবে।
তবে, সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই মনে করেন যদিও এখন কৈ, শিং, পাবদা, মাগুর, সর পুটি, চিতলসহ বেশ কয়েকটি প্রজাতির মাছ সহজলভ্য হয়েছে, কিন্তু সেই সব মাছের স্বাদ আগের মত নয়।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন