বাংলাদেশ
বলবয় থেকে বিশ্বমাতানো ম্যারাডোনা
লেখক
জাগোনিউজ২৪.কমগত ৩০ অক্টোবর ছিল ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা, আর্জেন্টিনার মহানায়ক দিয়েগো ম্যারাডোনার ৬০তম জন্মদিন। তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সারাদিনই একের পর ছবি পোস্ট করে গেছে আন্তর্জাতিক ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা।
তখন কি তারা ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে পেরেছিল, মাত্র ২৫ দিনের মাথায় চিরবিদায় জানাতে হবে ফুটবল বিশ্বের অবিসংবাদিত কিংবদন্তিকে? বুধবার (২৫ নভেম্বর) রাতে পুরো ফুটবল বিশ্বকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন এই ফুটবল মহানায়ক। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।
মাত্র কয়েকদিন আগেই রক্ত জমাট বেধে যাওয়ায় মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। কয়েকদিন হাসপাতালে থাকার পর ডাক্তাররা তাকে পূনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই বুধবার স্থানীয় সময় বিকেলে হৃদরোগে আক্রান্ত আর্জেন্টাইন এই কিংবদন্তি। যেখান থেকে আর ফিরলেন না তিনি।
ম্যারাডোনার বিদায়ে ফুটবল বিশ্ব হারাল এক বর্ণিল চরিত্রকে, এক সাফল্যে মোড়া কিংবদন্তি ফুটবলারকে। ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর বুয়েন্স আয়ার্সের লানুসে অবস্থিত পলিক্লিনিক এভিটা হাসপাতালে জন্ম নেয়া ম্যারাডোনা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ২০২০ সালে ২৫ নভেম্বর বুয়েন্স আয়ার্সে তিগ্রের নিজ বাসায়।
নিজের ৬০ বছরের জীবনে ফুটবল খেলে কাটিয়েছেন ২১ বছর, ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদে কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আরও প্রায় ৭ বছর। জীবনের মোট ২৮ বছর যেই ফুটবল মাঠের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন ম্যারাডোনা, সেই খেলাটি তাকে দিয়েছে দুই হাত ভরে। জিতেছেন ফুটবল বিশ্বকাপ, ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে নিজেকে নিয়ে গেছেন সবার ওপরে।
ম্যারাডোনা বেড়ে উঠেছেন আর্জেন্টিনার খুবই দারিদ্র্যপিড়িত একটি এলাকা থেকে। বুয়েন্স আয়ার্সের শহরতলীয়তে বসবাস করতেন তিনি। আর্জেন্টিনার তখনকার সবচেয়ে দরিদ্র ফুটবলাররা স্বপ্ন দেখতেন বোকা জুনিয়র্সের হয়ে খেলার। দিয়েগো ম্যারাডোনাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন বলে তিনি বোকা জুনিয়র্সে খেলার স্বপ্ন দেখতেন।
শিশুকাল থেকেই খেলার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ এবং দুর্দান্ত প্রতিভার কারণে সবার নজরে ছিলেন তিনি। নিজে যেমন খেলতেন, মাঠে ছুটে যেতেন বড়দের খেলা দেখার জন্য। মাঠের পাশে বসে বল কুড়িয়ে দিতেন। বলবয় হিসেবে মাঠের সঙ্গে সখ্যতা শুরু। সেই বয়লবয় দিয়েগোর জীবনটা শেষ হলো ক্যারিয়ারের এভারেস্টে উঠে।
মাত্র ১২ বছর বয়সে আর্জেন্টিনার রাজধানী শহরের অন্যতম প্রধান ক্লাব আর্জেন্টিনো জুনিয়র্সের জুনিয়র টিম লস সেবোলিটাসের মূল খেলোয়াড়ে পরিণত হন ম্যারাডোনা। তখন প্রথম ডিভিশন ম্যাচগুলোর বিরতির সময় বল নিয়ে কারিকুরি দেখিয়ে মাঠে উপস্থিত দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিতেন অবিশ্বাস্য প্রতিভাধর এ ফুটবলার।
শৈশবের যার পায়ের জাদুতে মুগ্ধ হতে থাকেন সবাই, তার পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু হতে যে বেশি সময় লাগবে না তা সহজেই অনুমেয়। হয়েছেও ঠিক তাই। নিজের ১৬তম জন্মদিনেরও ১০ দিন আগে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনার প্রিমিয়ার ডিভিশন ইতিহাসে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের প্রথম ম্যাচেই হুয়ান ডোমিঙ্গো কাবরেরার দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে ‘নাটমেগ’ করে সবার চক্ষু ছানাবড়া করে দেন ম্যারাডোনা। পরে এই নাটমেগকে নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম ট্রেডমার্ক স্কিলে পরিণত করেন এ কিংবদন্তি ফুটবলার।
অভিষেকের ২৫ দিনের মাথায় পেশাদার ক্যারিয়ারে প্রথম গোলটি করেন ম্যারাডোনা। মারপ্লেনটেনসের ক্লাব সান লোরেঞ্জোর নাম চিরকালের জন্য লেখা হয়ে যায় ম্যারাডোনার প্রথম গোলের সঙ্গে। আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সে পাঁচ বছর কাটান তিনি, ১৬৬টি ম্যাচ খেলে করেন ১১৬টি গোল।
১৯৮১ সালে ৪ মিলিয়ন ইউএস ডলারের চুক্তিতে নাম লেখার আর্জেন্টিনার আরেক ক্লাব বোকা জুনিয়র্সে। তখন আর্জেন্টিনার সেরা ক্লাব রিভারপ্লেটও নিতে চেয়েছিল ম্যারাডোনাকে, তাও দলের চেয়ে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক দেয়ার প্রস্তাব দিয়ে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বোকার হয়ে খেলার স্বপ্ন পূরণ করতে অন্য কোন প্রস্তাবে সাড়া দেননি ম্যারাডোনা।
বোকার হয়ে নিজের অভিষেক ম্যাচেই করেন জোড়া গোল, পরে রিভারপ্লেটকে ৩-০ গোলে হারানোর ম্যাচেও তার পা থেকে দৃষ্টিনন্দন এক গোল। সমস্যা বাঁধে কোচের সঙ্গে, কখনও যেন ম্যারাডোনার ওপর আস্থাই রাখতে পারেননি বোকার কোচ সিলভিও মারজোলিনি। তবু সাফল্যবঞ্চিত হয়নি বোকা। সে মৌসুমে লিগ শিরোপাও জিতে নেয় তারা।
কিন্তু ম্যারাডোনার বোকা জুনিয়রস ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত হয়নি। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপের পর তখনকার বিশ্বরেকর্ড ৭.৬ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে বার্সেলোনায় নাম লেখান তিনি। সে মৌসুমেই বার্সেলোনার হয়ে জেতেন কোপা দেল রে ও স্প্যানিশ সুপার কাপ শিরোপা।
১৯৮৩ সালের ২৬ জুন মর্যাদার এল ক্লাসিকো ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদের মাঠ থেকে জয় নিয়ে ফিরেছিল বার্সেলোনা। সেই ম্যাচে গোলরক্ষককেও কাটিয়ে বল পায়ে অপেক্ষা করছিলেন ম্যারাডোনা। ডিফেন্ডার হুয়ান হোস দৌড়ে এসে গোল বাঁচানোর চেষ্টায় ধাক্কা খান গোলবারের সঙ্গে, ম্যারাডোনা বল ঢোকান জালে। এই গোলের পর সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর দর্শকরা দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়েছেন ম্যারাডোনাকে। রিয়ালের মাঠে বার্সেলোনার কোনো খেলোয়াড়ের এত বড় সম্মান পাওয়ার প্রথম ঘটনা সেটি। এরপর শুধুমাত্র রোনালদিনহো (২০০৫) ও আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাই (২০১৬) পেয়েছেন এই সম্মান।
বার্সেলোনার হয়েও ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত করতে পারেননি ম্যারাডোনা। প্রথমত হেপাটাইটিসজনিত অসুস্থতা ও গোড়ালির ইনজুরি, এর সঙ্গে যোগ হয় উদ্দাম জীবনযাপন। যে কারণে মাত্র দুই মৌসুম খেলতে পেরেছেন বার্সার হয়ে। এ সময়ে ৩৬ ম্যাচ খেলে ২২টি গোল করেছেন ম্যারাডোনা।
স্পেনের যাত্রা লম্বা না হলেও, একটুও কমেনি ম্যারাডোনার কদর। দুই মৌসুম বার্সার জার্সি মাতিয়ে ১৯৮৪ সালে তিনি চলে যান ইতালির ক্লাব নাপোলিতে। যথারীতি এবারও বিশ্বরেকর্ড ট্রান্সফার ফি, অঙ্কটা ১০.৪৮ মিলিয়ন ডলার। এই চড়া মূল্যের প্রতিদানটাও কড়ায় গণ্ডায় দিয়েছেন ম্যারাডোনা। নাপোলির হয়ে খেলা ৭ মৌসুমে নিজেকে পরিণত করেছেন ক্লাবের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে।
আর্জেন্টিনো জুনিয়র্সে থাকতে আন্তর্জাতিক ফুটবলে নাম লেখালেও, নাপোলিতে নাম লেখানোর পরেই মূলতঃ আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে নিজের সেরা সময়টা কাটান ম্যারাডোনা। এ সময় নাপোলিকে যেমন জেতান একের পর এক শিরোপা। তেমনি আর্জেন্টিনার হয়ে প্রায় একক নৈপুণ্য দেখিয়ে জেতেন বিশ্বকাপ শিরোপা।
একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতানোর পর থেকেই ফুটবল বিশ্বে অবিসংবাধিত কিংবদন্তিতে পরিণত হন তিনি। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যে দুটি গোল করেছিলেন, সে দুটিই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে। প্রথমটি করেছিলেন হাত দিয়ে। যে কারণে এটাকে বলা হয় ‘দ্য হ্যান্ড অব গড’। অন্যটি করেছিলেন মাঝমাঠ থেকে এককভাবে টেনে নিয়ে গিয়ে। সেই গোলটি পেয়ে যায় ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’র খেতাব।
পাশাপাশি ক্লাব ফুটবলে নাপোলির হয়েও সাফল্যের খাতা ভারী করতে থাকেন ম্যারাডোনা। ইতালির ক্লাবটির হয়ে ১৯৮৬-৮৭ ও ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে জিতেছেন লিগ শিরোপা, কোপা ইতালিয়া জিতেছেন ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে, ইউরোপিয়ান মর্যাদার আসর উয়েফা কাপের (পরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ) শিরোপা জিতেছেন ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে এবং ১৯৯০ সালে জিতেছেন সুপারকোপা।
নাপোলিকে এত এত শিরোপা জেতানোর মূল কারিগরই ছিলেন ম্যারাডোনা। যে কারণে প্রায় তিন দশক পরেও এখনও নাপোলিতে চলে ম্যারাডোনা বন্দনা। শুধু তাই নয়, ম্যারাডোনার সম্মানে আনুষ্ঠানিকভাবে ১০ নম্বর জার্সিটিকে অবসরে পাঠিয়েছে নাপোলি। এ দলের হয়ে ২৫৯ ম্যাচে ১১৫ গোল করেছেন আর্জেন্টাইন জাদুকর। ১৯৯০-৯১ মৌসুমে শেষবারের মতো নাপোলির হয়ে মাঠে নামের ম্যারাডোনা।
এরপর আর সে অর্থে ফুটবলার ম্যারাডোনার ঝলক দেখানোর কিছু বাকি ছিল না। বিশেষ করে কোকেইন সেবনের দায়ে ১৫ মাস নিষিদ্ধ থাকার কারণে তারকাখ্যাতিতেও ভাটা পড়ে খানিক। এতে অবশ্য দমে যাননি বর্ণিল চরিত্রের অধিকারী ম্যারাডোনা। ফের ফুটবলে ফেরেন স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়ায় নাম লিখিয়ে। যেখানে এক মৌসুম কাটিয়ে ফিরে আসেন দেশের ফুটবলে।
নিজ দেশের ক্লাব আর্জেন্টিনো জুনিয়র্সের হয়ে ক্যারিয়ার শুরুর পর শেষটাও আর্জেন্টিনায়ই করেন ম্যারাডোনা। ১৯৯৫-৯৬ মৌসুমে থেকে ১৯৯৭-৯৮ পর্যন্ত বোকা জুনিয়র্সের হয়ে খেলে নিজের বুটজোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এর আগেই অবশ্য ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে দুই দফায় কোচিংও করান ম্যারাডোনা।
ক্লাব ফুটবলে সবমিলিয়ে ৫৮৮ ম্যাচ ৩১২ গোল করা ম্যারাডোনার আন্তর্জাতিক ফুটবলে গোলসংখ্যা ৯১ ম্যাচে ৩৪টি। জাতীয় দলের হয়ে তার ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৭৭ সালে, যা শেষ হয় ১৯৯৪ সালে। মাঝের সময়টাতে নিজেকে আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে অমর করে রাখেন ম্যারাডোনা।
শুধু ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ জেতানোই নয়, পরের আসরে আবার আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুলেছিলেন তিনি, পারেননি চ্যাম্পিয়ন হতে। তবে পরের বিশ্বকাপেই বিতর্ক হয় তার সঙ্গী, যা ছায়ার মতো লেগে থাকে জীবনের বাকি সময়টায়। ১৯৯৪ সালের সেই আসরে দুই ম্যাচ খেলার পরই দেশে ফিরতে হয় তাকে।
কেননা ডোপ টেস্টে উত্তীর্ণ হতে পারেননি তিনি। পরে আর জাতীয় দলেও ফেরা হয়নি। যে কারণে বিশ্বকাপে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে খেলা ম্যাচটিই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার শেষ ম্যাচ হয়ে থাকে। সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনার ২-১ গোলের জয় একবার লক্ষ্যভেদের পাশাপাশি অন্যটিতে এসিস্টও করেন ম্যারাডোনা।
ফুটবল বুটজোড়া তুলে রেখে একের পর এক নতুন নতুন ঘটনার জন্ম দিতে শুরু করেন তিনি। খেলোয়াড়ি জীবনেই দুই দফা কোচিং করালেও, পুরোপুরি পেশাদার কোচ হিসেবে যাত্রা শুরু করেন ২০০৮ সালের নভেম্বরে, তাও কি না সরাসরি আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে। তার অধীনে ২০১০ সালের বিশ্বকাপে চরম ভরাডুবি হয় আর্জেন্টিনার। ফলে দায়িত্ব থেকে অব্যাহিত দেয়া হয় ম্যারাডোনাকে।
খেলোয়াড়ি জীবনে যতটা সাফল্য পেয়েছেন ম্যারাডোনা। কোচ হিসেবে যেন ঠিক ততটাই ব্যর্থ ম্যারাডোনা। তার সময়ে খেলা ২৪ ম্যাচের ১৮টিতেই জিতেছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু কোনো টুর্নামেন্টের শিরোপা ওঠেনি আলবিসেলেস্তেদের ঘরে। আন্তর্জাতিক কোচিংয়ের পাঠ চুকিয়ে তিনি চলে যান সংযুক্ত আরব আমিরাতে। সেখানেও পাননি সাফল্যের দেখা।
সবশেষ গতবছরের সেপ্টেম্বরে নিজ দেশের ক্লাব জিমনেশিয়া লা প্লাটার হয়ে দায়িত্বগ্রহণ করে ম্যারাডোনা। সে মৌসুমটি ভালো যায়নি জিমনেশিয়ার। তবু ম্যারাডোনার সঙ্গে ২০২০-২১ মৌসুমের জন্যও চুক্তি নবায়ন করে জিমনেশিয়া লা প্লাটা। কিন্তু এ মেয়াদের পুরোটা সময় আর শেষ করতে পারলেন না ম্যারাডোনা। জীবনের অমোঘ সত্যের প্রমাণ দিয়ে পুরো বিশ্বকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
লাভজনক সবজি চাষ পদ্ধতি
-
কৃষকের বন্ধু ও কৃষি উন্নয়ন এর পথিকৃৎ শাইখ সিরাজের ৭০তম জন্মদিন আজ
-
যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে হতে পারে সারের সংকট
-
বিদেশ থেকে খালি হাতে ফিরে ড্রাগন চাষে সাফল্য
-
নাসিরনগরে বন্যায় তলিয়ে গেল কৃষকের বাদামখেত
-
পানি দিতে অতিরিক্ত টাকা
-
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
-
‘শিক্ষিত কৃষক’ বলেই তাঁকে নিয়ে মানুষের আগ্রহটা বেশি
-
ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বীজ কিনে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত
-
বোরো কাটতে বাড়তি খরচ ঃ হাসি নেই কৃষকের মুখে
সবজি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। কৃষি বিজ্ঞানের ভাষায় সবজিকে উদ্যানতাত্বিক ফসল (Horticultural crops) বলা হয়ে থাকে। পুষ্টিমানের দিক থেকে সবজি ফসল যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বাণিজ্যিকভাবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। সেজন্য সবজি চাষের আধুনিক কলাকৌশল জানা জরুরি।
আর আধুনিক কলাকৌশল বলতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদকেই বোঝানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু সবজি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তবে সারাদেশে যেমন সব ধরনের সবজি উৎপাদিত হয়না ঠিক তেমনি সকল সবজিই আবার সারাবছর উৎপাদিত হয়না। একেক অঞ্চলে একেক ধরনের শাকসবজি উৎপাদিত হয়ে থাকে। আবার বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ বিশেষ সবজির জাত উৎপাদন করা যায়।
সারাদেশে সারাবছরই যেসকল সবজি সহজে উৎপাদিত হয়ে থাকে তাদের কিছু শাকসবজির কথা এখানে তুলে ধরছি। লালশাক, ডাটাশাক, পুইশাক, কলমিশাক, মিষ্টিআলু শাক, ঢেড়শ, গাজর, বরবটি, টমেটো, লাউ ও লাউশাক, পাটশাক, শশা, কাঁচকলা, বেগুন, পেপে, করলা, কচুশাক, কচুর লতি, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা ইত্যাদি পরিচিত শাকসবজি। তাছাড়া অপরিচিত বিশেষ কিছু সবজি বিশেষ বিশেষ এলাকার বিশেষত্ব হিসেবে উৎপাদিত হয়ে থাকে। উপরোক্ত ফসলগুলোর মধ্যে কিছু শুধু শাক আর বাকীগুলো শাক এবং সবজি উভয় হিসেবেই প্রচলিত রয়েছে।
কৃষিতাত্বিকভাবে রবি (শীতকাল) ও খরিপ (গ্রীষ্মকাল)- এ দুধরনের মৌসুম রয়েছে। খরিপের আবার দুটি ভাগ, যথা- খরিপ-১ (আগাম গ্রীষ্ম) এবং খরিপ-২ (বর্ষাকাল)। তবে শীতকালীন শাকসবজির মধ্যে বাহারি ও রকমারি বৈচিত্র একটু বেশি। শুধুমাত্র শীতকালে উৎপাদিত হয় এমন ফসলগুলোর মধ্যে রয়েছে- টমেটো, শীতলাউ, ফুলকপি, বাধাকপি, গাজর, সীম, মূলা, ব্রকলি, বাটিশাক, ওলকপি, শালগম, বেগুন, গোল আলু ইত্যাদিই প্রধান। অপরদিকে শুধুমাত্র গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে উৎপাদিত হয় এমন ফসলের মধ্যে রয়েছে- বিভিন্ন ধরনের কচু, ওলকচু, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, কাকরোল, পটোল, করলা, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া ইত্যাদিই প্রধান।
সবজি ফসল উৎপাদন অন্যান্য ফসলের মতো নয়। সবজি ফসল উৎপাদনের জন্য বিশেষ ধরনের যত্নের প্রয়োজন হয়। আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবাদ করতে গেলে অল্প পরিমাণ জায়গায় অধিক পরিমাণ ফসল ফলিয়ে লাভবান হওয়া সম্ভব। সবজি আবাদেও জন্য বাড়ির আঙ্গিনায় অথবা অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গা বেছে নিতে হবে। সেখানে ভালোভাবে চাষ-মই দিয়ে জমির মাটি জো অবস্থায় ঝুরঝুরে করে সেখানে এক মিটার প্রশস্ত এবং প্রয়োজনমত জমির আকার-আকৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে লম্বা বেড তৈরী করে নিতে হবে। প্রতিটি বেডের মাঝখানে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি পরিমাণ গর্ত করে নালা সৃষ্টি করতে হবে। অর্থাৎ নালার মাটি তুলেই দুইপাশে বেড প্রয়োজনমত উঁচু করতে হবে।
এভাবে বেড তৈরীর একটি বিশেষত্ব হলো শাকসবজি চাষাবাদ অন্য সাধারণ ফসল আবাদের চেয়ে একটু ভিন্ন। এর জন্য প্রয়োজন হয় বাড়তি সতর্কতা ও যত্নের। শাকসবজির চাষাবাদে যেমন শুষ্ক মৌসুমে সেচের চাহিদা থাকে অপরদিকে বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি বের করে দেওয়ার প্রয়োজন হয়। সেজন্যই বেড তৈরী করে মাটি কিছুটা উঁচু করা হয় সেখানে আবার নালা তৈরী করে নিষ্কাষনের ব্যবস্থাও রাখা হয়। কিন্তু বেড এবং নালা তৈরী না করলে সেটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবাদ হয়না। সেঠা হয় সাধারণ শাকসবজি চাষ। এতে ফলন অনেক কমে যায়।
পেপে, কাঁচকলা- এ জাতীয় সবজি বসতবাড়ির আঙ্গিনায়, রাস্তা বা পুকুরের ধারে সহজেই আবাদ করা যায়। লালশাক, ডাটা শাক, পাটশাক, মূলাশাক, গাজর, শালগম ইত্যাদি সবজি তৈরীকৃত বেডে ছিটিয়ে বীজ বুনে দিলেই ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাছাড়া টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, বাধাকপি, ঢেড়শ, কচু, ওলকচু ইত্যাদি সবজি এক মিটারের বেডে দুই সারি করে নির্ধারিত দূরত্বে চারা লাগিয়ে আবাদ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। সেজন্য এসব সবজি উৎপাদনের জন্য আলাদাভাবে নার্সারিতে চারা তৈরী করে নিতে হয়। অপরদিকে লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শশা, চাল কুমড়া, পটোল, কাকরোল, করলা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, সীম, বরবটি ইত্যাদি লতাজাতীয় সবজি চাষের জন্য উক্ত বেডে দুইটি সারি করে সেখানে জাংলা দিয়ে দিতে হয়। সাধারণত বেডের দুইপাশে খুটি দিয়ে পরে তা ইংরেজি অক্ষর ‘এক্স’ আকৃতিতে বা ‘ভি’ আকৃতিতে বাঁকিয়ে বেঁধে দিতে হয়।
বেড ছাড়াও লতাজাতীয় এসব সবজি অতি সহজেই ক্ষেতের আইলে, রাস্তার ধারে, পুকুরের পাড়ে বিশেষ ব্যবস্থায় আবাদ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে অন্যান্য যেকোন ফসলের তুলনায় এসব সবজি ফসলের একটু বেশি যত্নের প্রয়োজন হয়। বিনা আবাদেই এসব সবজি চাষ করা যেতে পারে। সেজন্য বন্যা পরবর্তীতে পুনর্বাসনের সময় বিনাচাষে এসব আবাদের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ জৈবভাবেই এসব সবজি ফসল উৎপাদন সম্ভব। আবাদের পূর্বে সামান্য পরিমাণ প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার ব্যবহার করে বাকীটা মেটাতে হবে বাড়িতে উৎপাদিত জৈব সারের মাধ্যমে। তারপর আন্তপরিচর্যা এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতেও জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। তখন এসব উৎপাদিত ফসল সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
কাজেই এভাবেই সারাবছর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বষ্পপরিসরে শাকসবজি উৎপাদন করে নিজের চাহিদা মিটিয়ে তা বাণিজ্যিকভাবেও লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমাদের শারীরিক পুষ্টি চাহিদার একটি বিরাট অংশ শাকসবজি থেকে আসা দরকার। দৈনিক একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের গড়ে কমপক্ষে আড়াইশ গ্রাম শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। আর সেটা নিবিড়ভাবে এবং নিরাপদভাবে খেতে হলে নিজের উৎপাদিত শাকসবজি খাওয়াই সবচেয়ে উত্তম। কাজেই আমাদের সারাবছর অলস সময়টাকে কাজে লাগিয়ে আসুন নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় সবজির বাগান গড়ে তুলি।
একজন টেলিভিশন তারকা, কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের জন্মদিন আজ। তিনি ১৯৫৪ সালের এদিনে জন্মগ্রহণ করেন চাঁদপুরে (সার্টিফিকেট অনুযায়ী তার জন্মতারিখ ২৮শে জুন ১৯৫৬)। শাইখ সিরাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ভূগোলে। ছাত্রজীবনেই সম্পৃক্ত হন বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতার ও সংবাদপত্রের সঙ্গে।
শাইখ সিরাজ ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড, চ্যানেল আই-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও বার্তা প্রধান। টানা সাড়ে চার দশক ধরে তিনি গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে দেশের কৃষি ও কৃষক তথা উৎপাদন-অর্থনৈতিক খাতে অপরিসীম ভূমিকা রেখে চলেছেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সকল শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে বিপুল গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেন তিনি। পরে তার নিজস্ব পরিচালনাধীন টেলিভিশন ‘চ্যানেল আই’তে শুরু করেন কৃষি কার্যক্রম হৃদয়ে মাটি ও মানুষ। উন্নয়ন সাংবাদিকতার জন্য তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দু’টি রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৮) ও একুশে পদক (১৯৯৫) লাভ করেন।
টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রায় চার দশকের একনিষ্ঠ পথচলার মধ্য দিয়ে শাইখ সিরাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন উন্নয়ন সাংবাদিকতার এক অগ্রপথিক হিসাবে। গণমাধ্যমে তার উদ্বুদ্ধকরণ প্রচারণায় আমূল পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশের কৃষিতে। বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে বৈপ্লবিক সাফল্য।
গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। একইসঙ্গে শহর-নগরের মানুষকে করেছেন কৃষিমুখি। ফলে দেশের অর্থনীতিতে কৃষির বহুমুখি অবদান সূচিত হয়েছে।
‘মাটি ও মানুষ’
বাংলাদেশের কৃষিতে গত কয়েক দশকে যে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে, শাইখ সিরাজকে বর্ণনা করা হয় সেই পরিবর্তনের পেছনে অন্যতম প্রধান এক চরিত্র হিসেবে।
বাংলাদেশে যখন বিজ্ঞানীরা একের পর এক নতুন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করে চলেছেন, কৃষিতে নতুন ধ্যান ধারণা এবং কৌশল চালুর জন্য সরকারের নানা পর্যায় থেকে চেষ্টা চলছে, সেগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে বিরাট ভূমিকা রাখে তার কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান, ‘মাটি ও মানুষ।’
“শুরুতে এই অনুষ্ঠানটা হতো আমার দেশ নামে। তখন এটি ৫০ মিনিটের পাক্ষিক অনুষ্ঠান। পরে এটিকেই ‘মাটি ও মানুষ’ নামে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করি। আমার মনে হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের চেয়ে বেশি দরকার শিক্ষামূলক মোটিভেশনাল অনুষ্ঠান। কৃষকদের যদি নতুন বীজ, নতুন প্রযুক্তি, নতুন কৌশল, এসব ঠিকমত বোঝানো যায়, তাহলে কৃষিতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব।”
গত চার দশক ধরে শাইখ সিরাজ হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে কৃষি বিষয়ক তথ্যের প্রধান উৎস। উনিশ’শ আশির দশকে, যখনো টেলিভিশন ঘরে ঘরে পৌঁছায়নি, তখনো গ্রামের হাটেবাজারে, কমিউনিটি সেন্টারে প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় ‘মাটি ও মানুষ’ দেখার জন্য ভিড় করতো মানুষ।
তবে কৃষকদের নতুন ধরণের কৃষিতে উৎসাহিত করার কাজটা সহজ ছিল না।
“আজকের কৃষক এবং তিরিশ বছর আগের কৃষকের মধ্যে তফাৎ আকাশ আর পাতাল। তখন কৃষকের কাছে একজন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা যে কথা বলতেন, একজন টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে আমি যেকথা বলতাম, সেটা তারা মানতে চাইতো না। তারা ভাবতো, আমরা যেধরণের কৃষির কথা বলছি, যদি সেটাতে ভালো ফসল না হয়? এ কারণে সে সহজে মোটিভেট হতে চাইতো না। সহজে নতুন প্রযুক্তি নিতে চাইতো না।”
“আমি যখন আশির দশকে উচ্চফলনশীল নতুন জাতের ধানের কথা বলছি, গমের কথা বলছি, তখন পরিস্কার তারা আমাকে বলতো এই রাবার ভাত খাবো না। তখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধানের মান তেমন ভালো ছিল না। ভাতটা ছিল রাবারের মতো, ভাতের দানা উপর থেকে থালার উপর ফেললে সেটি রাবারের মতো ড্রপ করতো।”
কিন্তু বিজ্ঞানীরা যখন তাদের গবেষণায় নতুন নতুন সাফল্য পাচ্ছিলেন, আর সেই সঙ্গে শাইখ সিরাজও তার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকদের মন জয় করার জন্য নতুন কৌশল নিচ্ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অশোকা ফেলো শাইখ সিরাজ খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র বিমোচন বিষয়ে সাংবাদিকতায় অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসাবে তিনি ২০০৯ সালে অর্জন করেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এ এইচ বুর্মা এ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া তিনি পেয়েছেন এশিয়ার মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার গুসি পিস প্রাইজ, বৃটেনের বিসিএ গোল্ডেন জুবিলি অনার এ্যাওয়ার্ডস। বৃটিশ হাউজ অব কমন্স তাকে প্রদান করেছে বিশেষ সম্মাননা, বৃটিশ-বাংলাদেশ ব্যবসায়ী সংগঠন তাকে দিয়েছে গ্রীন এ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া পেয়েছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির স্বর্ণপদক, ডা. ইব্রাহিম মেমোরিয়াল স্বর্ণপদক, রণদা প্রসাদ সাহা স্বর্ণপদকসহ অর্ধশত দেশি-বিদেশি পুরস্কার ও সম্মাননা।
চ্যানেল আই ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখে থাকেন। তিনি এদেশে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে নিরস বিষয় হিসাবে উপেক্ষিত কৃষিতে জাতীয় সংবাদের প্রধান খবরের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শাইখ সিরাজের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- মৎস্য ম্যানুয়েল, মাটি ও মানুষের চাষবাস, ফার্মার্স ফাইল, মাটির কাছে মানুষের কাছে, বাংলাদেশের কৃষি: প্রেক্ষাপট ২০০৮, কৃষি ও গণমাধ্যম, কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট (সম্পাদিত), আমার স্বপ্নের কৃষি, কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট (২০১১), সমকালীন কৃষি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (২০১১), কৃষি ও উন্নয়ন চিন্তা (২০১৩) ইত্যাদি।
মেহেরপুর: পতিত ও অনুর্বর বেলে মাটির জমিতে চিনাবাদাম চাষ করে লাভবান হচ্ছেন মেহেরপুরের চাষিরা। ফলন ও বাজার দর ভালো এবং কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় দিন দিন এই এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাদামের চাষ।
সদর উপজেলার মদনাডাঙ্গা, শ্যামপুর, টেংগারমাঠ ও গোপালপুর গ্রামের অধিকাংশ জমির মাটি বেলে। ফলে এই এলাকার চাষিরা ধান, গম, পাটসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করে খুব একটা লাভবান হতে পারেন না।
ধান কাটার পর এ সব জমি সাধারণত পতিত থাকে। এজন্য ৯০ দিনের ফসল হিসেবে অল্প খরচে বাদাম চাষ করছেন এলাকার চাষিরা।
মেহেরপুর জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলায় এবার বাদাম চাষ হয়েছে ১৫ হেক্টর জমিতে। এবার এক বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করতে চাষিদের খরচ হয়েছে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা সেক্ষেত্রে বাদামের ফলন হয়েছে ৬ থেকে ৭ মণ। আর এ ফলনে প্রায় ২০ হাজার টাকা ঘরে তুলছেন তারা। বাজারে প্রতিমণ বাদাম বিক্রি হচ্ছে ২৭শ’ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। সদর উপজেলার মদনাডাঙ্গা গ্রামের বাদাম চাষি খাঁজা আহমেদ, কাওছার আলী ও ফিরোজ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, এলাকার মাটি বেলে হওয়ায় সাধারণত সবজি, আলু ও অন্যান্য ফসল চাষ করার পর জমি পতিত থাকে। সে সময়ে চিনা বাদামের চাষ করা হয়। বাদাম চাষে খরচ কম এবং উৎপাদন ও বাজার দর ভাল। তাই দিন দিন চাষিরা তাদের পতিত জমিতে চিনা বাদামের চাষ শুরু করছেন।
এছাড়া বাদাম ছাড়ানো, শুকানোসহ যাবতীয় কাজ করে থাকেন এখানকার নারীরা। বাদামের গাছ আবার শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করছেন গৃহিণীরা।
নারী শ্রমিক সাহানা খাতুন ও জরিমন নেছা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বাদাম ছাড়ানো ও শুকানোর কাজ করে থাকি। এলাকার ২৫/৩০ জন নারী শ্রমিক এ কাজ করে আসছেন।
গৃহিণী সাজেদা খাতুন ও জামেলা খাতুন জানান, বাদামের লতা জালানি হিসেবে বেশ ভাল। তাই লতাও বিক্রি হচ্ছে।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আক্তারুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, চিনা বাদামের চাষ সাধারণত পতিত জমিতে হয়ে থাকে। এলাকার চাষিরা এই জমিতে বাদামের চাষ করে বাড়তি আয় করছেন। তাই বাদাম চাষ যাতে আরও সম্প্রসারিত হয় সেজন্য কৃষি বিভাগ চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছে।
সিলেট বিভাগের উচ্চমাত্রার অ্যাসিডিক জমিতে গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধাসহ বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কৃষি বিজ্ঞানিরা মৌলভীবাজারের আকবরপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে ফুল চাষ করে সফল হয়েছেন। এ ফুল চাষ মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে ১০০ চাষিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে কৃষি গবেষণা কেন্দ্র।
কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যমতে, যশোরে বাণিজ্যিকভাবে গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল চাষ হয়। যার বাজার দর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। যশোরের ফুল সারাদেশের পাশাপাশি সিলেটেও আসে প্রচুর। সিলেটে ফুলের বাজার শত কোটি টাকার উপরে। কিন্তু সিলেটে ফুলের চাষ বাণিজ্যিকভাবে হয় না।
সিলেট বিভাগের মাটি অ্যাসিডিক হওয়ায় ফুল চাষ করা যাবে না, সেটাই ছিল প্রচলিক ধারণা। কিন্তু এ ধারণাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যদিয়ে ভুল প্রমাণ করেছেন মৌলভীবাজার আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের একদল গবেষক। মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এস এম শরিফুজ্জামানের নেতৃত্বে উচ্চমাত্রার অ্যাসিডিটিক জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে ফুল চাষ করে সফল হয়েছেন তারা। এ পরীক্ষামূলক চাষে ফলনও হয়েছে ভালো। তাই সিলেট অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট অঞ্চলে অনেক জায়গা অনাবাদি ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। প্রবাসীরা দেশের বাইরে অবস্থান করায় তাদের অনেক জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। এ জমিকে আবাদের আওতায় আনতে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষের উদ্যোগ নিয়ে আগ্রহী ১০০ চাষিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে আমন ধান কাটার পর এ অঞ্চলের অনেক জমি পতিত থাকে। ফলে ফুল চাষ করে অনাবাদি জমি থেকে কোটি টাকা উপার্জন সম্ভব।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মিরানা আক্তার সুমি জানান, চাষিরা প্রশিক্ষণ শেষে অনেক কিছু শিখেছেন। কী পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে হয়, তা জেনেছেন। ধানের চেয়ে যেহেতু ফুলের দাম বেশি, তাই ফুল চাষে তাদের আগ্রহ বাড়ছে।
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সরফ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভালোভাবে জমি চাষ করে নির্দেশিত মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হয়। অন্য ফসলের মতোই এর চাষ পদ্ধতি সহজ। বেড তৈরি করে ফুল চাষ করতে হয়। প্রতিটি বেডের দৈর্ঘ যে কোন মাপের হতে পারে। তবে প্রস্থে ১.২-১.৫ মিটার হলে ভালো।’
তিনি বলেন, ‘কলম (বীজ) লাগানো থেকে তিন মাস পর স্টিক সংগ্রহ শুরু হয়। সংগ্রহ করা যাবে পরবর্তী ২৫ দিন। গ্লাডিওলাস ৫টি জাতসহ মোট ১২টি প্রজাতির ফুলের পরীক্ষা করে আমরা সফল হয়েছি।
সবুজ বিপ্লবের সময়ে পেস্টিসাইড ব্যবহারকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জীব বৈচিত্র্য, মাটির স্বাস্থ্য ও ফসলের গুণমানতা। এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে, এত রাসায়নিক পেস্টিসাইড ব্যবহার করা কি ঠিক হচ্ছে? এ প্রশ্ন শুধু ভারতে নয়, সারাবিশ্বের কৃষকসমাজ ও শস্যবিজ্ঞানীদের কাছে। তাই মনে হয় জৈব নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্ব দিয়ে সুসংহত রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণ আগামী দিনে একমাত্র সমাধানের রাস্তা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
চলমান খরিফ মরসুমে আমাদের রাজ্যে প্রধানত ধান, খরিফ পেঁয়াজ, জুট, ইক্ষু, তিল ইত্যাদি ফসলের চাষ হয়ে থাকে। এ রাজ্যে ধানে ঝলসা রোগের আক্রমণ একটি গুরুতর বিষয়।
জৈব পদ্ধতিতে এই রোগ দমন করার একটি সহজ উপায় রয়েছে। ৫০ মিলিলিটার কেরোসিন তেলে ৮৫ গ্রাম থেঁতলানো রসুন মিশিয়ে ২৪ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এরপর ৯৫০ মিলি. জল ও ১০ মিলি. তরল সাবান মিশিয়ে ভালোভাবে নেড়ে নিয়ে বোতলে রেখে দিতে হবে। ১৯ লিটার জলের সাথে ১ ভাগ মিশ্রণ মিশিয়ে সকালে/বিকেলে স্প্রেয়ার দিয়ে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করতে হবে।
এই মিশ্রণটি আমেরিকান বোল ওয়ার্ম, আর্মি ওয়ার্ম, পেঁয়াজ-এর চিরুনি পোকা, আলুর টিউবার মথ, রুট নট নিমাটোড (কৃমি), আখের কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা, ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ, ডাউনি মিলডিউ ও ধানের ঝলসা রোগ প্রতিরোধে খুবই কার্যকরী।
এছাড়া বিভিন্ন ধরণের পাতা খেকো পোকা ও জাব পোকা নিয়ন্ত্রণে ১ কেজি পেঁয়াজ থেঁতো করে ১ লিটার জলের সাথে মিশিয়ে ২৪ ঘণ্টা রেখে দেবার পর কচলিয়ে রস নিংড়ে নিতে হবে। প্রাপ্ত নির্যাসের সাথে ১০ লিটার জল মিশিয়ে আক্রান্ত ফসলে স্প্রে করতে হবে।
জৈব সার প্রয়োগ ও জৈব কীটনাশক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন খরচ শতকরা ২৫-৩০ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব। উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন প্রযুক্তিতে উৎপাদিত জৈব সার, শাকসব্জী ও অন্যান্য ফসলের প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম-এর সাথে অণুখাদ্যের যোগান দেয়।
জৈব পদ্ধতিতে উৎপন্ন কীটনাশক ও ছত্রাকনাশকগুলি ফসলে কোনওরকম দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ব্যতিরেকে, পোকা ও রোগ দমনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এতে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও উর্বরতা দীর্ঘমেয়াদী হয়। উৎপাদিত ফসল হয় স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ।
বন্ধুপোকা মাকড়ের (পরজীবি ও পরভোজী) সংরক্ষণের জন্য জমির পাশে অব্যবহৃত জায়গায় ত্রিধারা, উঁচুটি, শালিঞ্চে ইত্যাদি আগাছা জাতীয় গাছের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
দূরদর্শী পদক্ষেপের মাধ্যমে রাসায়নিক কৃষি বর্জন করে প্রাণ বৈচিত্র্য নির্ভর জৈব কৃষির মাধ্যমে খাদ্যে সার্বভৌমত্ব আনা সম্ভব। তাই জৈব কৃষির পথে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে কৃষিবিষমুক্ত, স্বাস্থ্যসম্মত সমাজ গড়ে তোলাই বাঞ্ছনীয়।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন