আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন

ফসল

পাটেশ্বরী: বাঙালির প্রধান অর্থকরী ফসলের গল্প

ধলসুন্দর, বাও, বিদ্যাসুন্দর, কেউত্রা, পাইধা, কাইটাবাও, কাজলা ইত্যাদি নামের স্থানীয় জাতের পাট ছিল আমাদের। ছবি: প্রথম আলো
ধলসুন্দর, বাও, বিদ্যাসুন্দর, কেউত্রা, পাইধা, কাইটাবাও, কাজলা ইত্যাদি নামের স্থানীয় জাতের পাট ছিল আমাদের। ছবি: প্রথম আলো

ধলসুন্দর, বাও, বিদ্যাসুন্দর, কেউত্রা, পাইধা, কাইটাবাও, কাজলা—এগুলো আমাদের গর্বের নাম, যার গরবে বাঙালি গর্বিত ছিল বহুকাল। পাকেচক্রে সে গর্ব এখন বিগত। সোনারং পাট আনত কাঁচা টাকা। আর সে টাকায় সমৃদ্ধ হয়েছিল একটি পুরো জাতি! সে জন্যই তার নাম ছিল ‘সোনালি আঁশ’। প্রায় দুই শ বছর পৃথিবীকে একচ্ছত্রভাবে পাটের জোগান দিয়ে গেছে এই বাংলাভূমি। এখন গল্পের মতো শোনালেও সেটাই ছিল বাস্তবতা।

প্রাচীন বইপত্রে সূক্ষ্ম পট্টবস্ত্র বা পাটের শাড়ি, পাটশাকের তরকারি কিংবা বিদেশি ভ্রমণকারীদের বর্ণনায় পাটের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে শত শত বছর ধরে বৃহত্তর বাংলা অঞ্চলে পাট উৎপন্ন হতো এবং সে পাট অর্থনৈতিকভাবে বাংলা অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের প্রধান ফসল ধান, পাট, গম, যব এবং নানা ধরনের ডাল। এগুলো বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদিত হলেও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ফলত সবচেয়ে বেশি। কারণ, পলিবিধৌত ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা প্রাকৃতিকভাবে উর্বর অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকা এবং উজানের আসাম অংশের ব্রহ্মপুত্র, বিশেষ করে ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া জেলার ব্রহ্মপুত্র সন্নিহিত অঞ্চলগুলো বিশ্বের প্রধান পাট উৎপাদনের এলাকা। কিন্তু এই বিপুল পাট দেশীয় চাহিদা মেটালেও একটা দীর্ঘ সময় বাংলার প্রধান অর্থকরী সম্পদ হয়ে ওঠেনি। পাট বাংলার প্রধান অর্থকরী ফসল হয়ে ওঠার পেছনে বেশ কিছু ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক ঘটনা জড়িয়ে আছে, তার মধ্যে দুটি যুদ্ধও আছে!

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশের কাঁচা পাটকে সর্বপ্রথম একটি কৃষিপণ্য হিসেবে বাজারজাত করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোগো। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশের কাঁচা পাটকে সর্বপ্রথম একটি কৃষিপণ্য হিসেবে বাজারজাত করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোগো। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পাটের আন্তর্জাতিক বাজার
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের কাঁচা পাটকে সর্বপ্রথম একটি কৃষিপণ্য হিসেবে বাজারজাত করে। ফলে পাট আন্তর্জাতিকভাবে একটি রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবে বিশ্বের বাজারে পরিচিতি পায়। কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা জাহাজের জন্য শক্ত রশি তৈরি করার কাজে কোন ধরনের তন্তু কার্যকরি হবে, তার খোঁজ করছিলেন বেশ আগ্রহের সঙ্গে। শেষে তাঁরা এ দেশের পাটকে আবিষ্কার করলেন জাহাজের মজবুত রশি তৈরির কাঁচামাল হিসেবে। কোম্পানির লোকেরা যখন পাট দিয়ে জাহাজের রশি তৈরির কথা চিন্তা করছেন, তখনো বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালু হয়নি।

যাহোক, বেঙ্গল বোর্ড অব ট্রেডের উদ্যোগে সর্বপ্রথম ১৭৯১ সালে পাটের নমুনা পাঠানো হয় ইংল্যান্ডে। কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরস পাঠানো পাটের নমুনা দেখে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এরই ফলে ১৭৯৩ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম এক হাজার টন কাঁচা পাট ইংল্যান্ডে রপ্তানি করা হয়। এর তিন বছর পর ১৭৯৬ সালে, বাংলা থেকে ৬৫ টন কাঁচা পাট দ্বিতীয়বারের মতো রপ্তানি করা হয়েছিল ইংল্যান্ডে। একই বছর ৪০ টন পাট জার্মানিতে এবং ৬ টন পাট যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। পরবর্তী বছরগুলোতেও বাংলা থেকে পাট রপ্তানি হতে থাকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায়।

সে আমলে পাট থেকে প্রস্তুত করা হতো জাহাজের রশি, পাকানো দড়ি, পাপোশ, ডোর ম্যাটস ইত্যাদি। এর কয়েক বছর পরেই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হয়ে গেল পাটকে কেন্দ্র করে। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডশায়ার জেলার অ্যাবিংডনে ১৮২০ সালে পাটের তন্তু থেকে সুতা তৈরির কৌশল উদ্ভাবন হয়। এ ঘটনার কয়েক বছর পর ১৮৩৫ সালে স্কটল্যান্ডের ডান্ডি নামক শহরে বিশ্বের প্রথম পাটের কারখানায় পাটের তন্তু বা আঁশ থেকে সুতা তৈরি করে বাজারজাতকরণ শুরু হয়। প্রকৃতপক্ষে সে সময় থেকেই ইংল্যান্ডে পাটের চাহিদা ক্রমাগত বাড়তে শুরু করে।

কফি ব্যাগ তৈরি
ইংরেজদের মতো ডাচরাও বহির্বিশ্বে বাংলার পাটের চাহিদা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছিল। পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ডাচদের উপনিবেশগুলোয় কফি উৎপাদন হতো। ১৮৩৮ সালে ডাচ সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, শণের পরিবর্তে কফি ব্যাগ তৈরি হবে পাট দিয়ে। এ ঘটনায় বহির্বিশ্বে পাট রপ্তানির কার্যক্রম আরও প্রসারিত হয়।

বাংলার অভ্যন্তরীণ রপ্তানিমুখী শিল্প
পূর্ববঙ্গের, বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলায় পাটের সুতা থেকে বয়নশিল্পীরা উন্নত মানের কাপড়সহ পাটজাত নানা ধরনের পণ্য তৈরি করতেন। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হতো সেসব পণ্য। স্থানীয়ভাবে পাটের আঁশ থেকে পাওয়া সুতায় তৈরি কাপড় ইউরোপের যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স; উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বার্মা, জাভা, চীন এসব দেশে রপ্তানি হতে থাকে। ১৮৫০ সালে পূর্ববঙ্গে হস্তচালিত তাঁতে উৎপন্ন সর্বমোট ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৭১৩ পিস কাপড় উল্লিখিত দেশগুলোয় রপ্তানি হয়েছিল। সে আমলে এর বাজারমূল্য ছিল ২ লাখ ১৫৯ হাজার ৭৮২ রুপি।

১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ সালের মধ্যে চলা ক্রিমিয়ার যুদ্ধ পাটকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। শিল্পী ফন্স হুবোর আঁকা চিত্রকর্ম ‘দ্য সিজ অব সিভাসটোপল’ (১৯০৪)। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ সালের মধ্যে চলা ক্রিমিয়ার যুদ্ধ পাটকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। শিল্পী ফন্স হুবোর আঁকা চিত্রকর্ম ‘দ্য সিজ অব সিভাসটোপল’ (১৯০৪)। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

ক্রিমিয়ার যুদ্ধ, রাশিয়ার ফ্ল্যাক্স এবং আমেরিকার গৃহযুদ্ধ
১৮২০ থেকে ১৮৩৮ সালের মধ্যে স্কটল্যান্ডে পাটের সুতা আবিষ্কার হয়ে গেছে। সে সুতা দিয়ে স্কটল্যান্ডের ডান্ডি শহরের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে সীমিত পরিসরে বিভিন্ন রকম পণ্য তৈরিও শুরু হয়ে গেছে তত দিনে। তারপরও ডান্ডির টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি ছিল ফ্ল্যাক্স–নির্ভর। রাশিয়া থেকে ফ্ল্যাক্স ডান্ডির মিলগুলোয় রপ্তানি হতো।

এ সময় তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে শুরু হয় ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (১৮৫৩-১৮৫৬)। ১৮৫৩ সালে তুরস্কের সহায়তায় এগিয়ে আসে ইংল্যান্ড। এর ফলে রাশিয়া ইংল্যান্ডে ফ্ল্যাক্স রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এ ঘটনায় পাটের ভাগ্য খুলে যায়। ফ্ল্যাক্স তন্তুর বিকল্প হিসেবে ব্রিটিশ ভারতের পাট তন্তু ব্যবহার করা শুরু হয় বিভিন্নভাবে, যে পাটের বেশির ভাগ উৎপন্ন হতো বাংলায়।

এর পাঁচ বছরের মধ্যে পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধে শুরু হয় আমেরিকার গৃহযুদ্ধ (১৮৬১-১৮৬৫)। এর ফলে সরাসরি পাটের গুরুত্ব বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ফেডারেল ও কনফেডারেট এ দুটি বাহিনী লড়ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। পরস্পর যুদ্ধরত এ দুটি দলের সৈন্যবাহিনীর জন্য ব্যাপক প্রয়োজন দেখা দিল পাটের তৈরি ব্যাগের। আগে উভয় সেনাবাহিনী তুলা থেকে তৈরি ব্যাগ দিয়ে প্রয়োজন মেটাত। তুলার ব্যাগের চেয়ে গানি ব্যাগ বা পাটের তৈরি ব্যাগ অনেক বেশি কার্যকর হওয়ার ফলে উভয় দল যুদ্ধ চলাকালীন প্রচুর পরিমাণে পাট বাংলা থেকে আমদানি শুরু করে। উনিশ শতকের এসব আন্তর্জাতিক ঘটনা বাংলার পাটকে আরও বেশি বৈশ্বিক করে তোলে।

এর প্রমাণ মেলে উনিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকে শুরু করে সত্তরের দশক পর্যন্ত পাওয়া পরিসংখ্যানে। উল্লিখিত সময়ে বাংলায় পাটের চাষ ও চাষের আওতাধীন মোট জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে।

বছরজমির পরিমাণ/ একররপ্তানি/মণ
১৮৩৫-১৮৪০৮,৩৫৭১২৫,৩৬২
১৮৪০-১৮৪৫১৫,৮৪২২৩৭,৬৩৯
১৮৪৫-১৮৫০১৯,৩৬৫২৯০,৪৭৭
১৮৫০-১৮৫৫৪৮,৭৭০৭৩১,৫৪৭
১৮৬০-১৮৬৫১৮২,৪১৭২,০০৩,৪১৭
পাটেশ্বরী: বাঙালির প্রধান অর্থকরী ফসলের গল্প

পরিসংখ্যান জানিয়ে দিচ্ছে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ, আমেরিকা গৃহযুদ্ধ এবং পাটের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য ফ্লাক্সের চেয়ে অনেক কম হওয়ার কারণে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলায়, বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা-পদ্মা অববাহিকায় পাট চাষে রীতিমতো বিপ্লব এনে দিয়েছিল। পাট চাষের ইতিহাসে এটি অভূতপূর্ব ঘটনা।

ডাচরাও বহির্বিশ্বে বাংলার পাটের চাহিদা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছিল। ডাচদের তৈরি একটি জাহাজের প্রতিকৃতি। এসব জাহাজ অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে পাটও পরিবহন করত। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
ডাচরাও বহির্বিশ্বে বাংলার পাটের চাহিদা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছিল। ডাচদের তৈরি একটি জাহাজের প্রতিকৃতি। এসব জাহাজ অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে পাটও পরিবহন করত। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

পাটকল স্থাপন এবং চটের বস্তা তৈরি
পাটের গুরুত্ব বাড়ার জন্য পৃথিবীব্যাপী পাটকল স্থাপন এবং চটের বস্তা তৈরি শুরু হওয়া একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এর ফলে রাতারাতি পাটের প্রয়োজন বিশ্ববাজারে বেড়ে যায় কয়েক গুণ। এ সময় পূর্ববঙ্গসহ সমগ্র বাংলা এবং আসামের ব্রহ্মপুত্র সন্নিহিত কয়েকটি জেলায় পাটের চাষ শুরু হয় ব্যাপকভাবে। প্রকৃতপক্ষে এ দেশে বাণিজ্যিকভাবে পাটের চাষ শুরু হয় ১৮৩৮ সাল থেকে। এরপরেই বাংলার বিভিন্ন নদীবন্দরে, বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা-পদ্মা তীরবর্তী নদীবন্দরগুলো কাঁচা পাটের বড় মোকাম হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে। ইংল্যান্ড থেকে দলে দলে পাটের কারবারিরা এ দেশে আসতে শুরু করে এ সময়। এরা কাঁচা পাটের বেল বা বড় বড় গাঁইট বাঁধার জন্য মেশিন নিয়ে এসে নৌবন্দরগুলোয় স্থাপন করে।

১৮৫৪ সালে হুগলির নিকটবর্তী রিষড়া নামক স্থানে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম পাটকল স্থাপিত হয়। জর্জ অকল্যান্ড নামক একজন সিলোন কফি বাগানের মালিকের উদ্যোগে এ পাটকলটি স্থাপিত হয়েছিল। এর নাম ছিল বেঙ্গল অকল্যান্ডস মিল। এটি উৎপাদন শুরু করে ১৮৫৫ সালে। এর কয়েক বছরের মধ্যে পৃথিবীর বহু স্থানে একের পর এক পাটকল স্থাপিত হতে থাকে। ১৮৫৭ সালে ফ্রান্সে জুট স্পিনিং মিল চালু হয়। জার্মানি, বেলজিয়াম এবং অস্ট্রেলিয়ায় যথাক্রমে ১৮৬১, ১৮৬৫ ও ১৮৭০ সালে পাটকল স্থাপন হয়। এই মিলগুলোর কাঁচামালের একমাত্র জোগান ছিল বাংলার পাট। সে সময়কার ব্রিটিশ ভারত সরকারের একটি নীতিমালা ছিল, বিনা শুল্কে পৃথিবীর যেকোনো দেশের ব্যবসায়ীরা বিনা বাধায় বাংলাদেশ থেকে পাট কিনে যেকোনো দেশে নিয়ে যেতে পারতেন। এভাবেই সমগ্র বিশ্বের পাটের চাহিদা এককভাবে বাংলার মাধ্যমেই মেটানো হতে থাকে।

ব্রিটিশ ভারতে বর্তমান বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ ছিল বৃহত্তর বাংলায় পাটের বড় মোকাম। এর পরেই ছিল ভৈরববাজার ও চাঁদপুরের অবস্থান। এই বন্দরগুলোতে ইউরোপীয়, ভারতীয় এবং দেশি পাট ব্যবসায়ীরা একাধিক জুট প্রেসিং ও বেলিং যন্ত্র স্থাপন করেন। ফলে শত শত মানুষ এসব জায়গায় বিভিন্ন ধরনের কাজ করার সুযোগ পায়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, পূর্ববঙ্গে পাট উৎপাদন হলেও ১৯৫০ সালের আগে এই অঞ্চলে কোনো পাটকল ছিল না।

প্রখ্যাত শিল্পগোষ্ঠী আদমজি ১৯৫১ সালে নারায়ণগঞ্জে প্রথম জুটমিল স্থাপন করে। এর অল্প দিনের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে সব মিলিয়ে ৯টি পাটকল নির্মিত হয়। এ মিলগুলোয় তৈরি হতো চট ও চটের বস্তা। এগুলোর কাঁচামাল ছিল ব্রহ্মপুত্র-যমুনা-পদ্মা-মেঘনা ও তিস্তা অববাহিকায় উৎপাদিত পাট। এভাবে নতুন নতুন জুটমিল তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের নারায়ণগঞ্জ, খুলনা (দৌলতপুর), টঙ্গী, সিরাজগঞ্জ, যশোর ও চট্টগ্রামে গড়ে উঠতে থাকে। প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে গঙ্গা তীরবর্তী পশ্চিম বাংলার অনেক পাটকল এ সময় বন্ধ হয়ে যায়।

আমেরিকার গৃহযুদ্ধের জন্য বিশ্ববাজারে বেড়েছিল বাংলার পাটের দাম। ‘অন্টিটামের যুদ্ধ’, ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৬২। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
আমেরিকার গৃহযুদ্ধের জন্য বিশ্ববাজারে বেড়েছিল বাংলার পাটের দাম। ‘অন্টিটামের যুদ্ধ’, ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৬২। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

পাটকলগুলো শুধু বস্তা উৎপাদনের মধ্যে তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রাখেনি। পাটের সুতা দিয়ে উন্নত মানের ম্যাট ও কার্পেটও উৎপাদন করত তারা। পাট দিয়ে শুধু যে চটের বস্তা তৈরি হতো, তা নয়। ময়মনসিংহসহ বাংলাদেশের অনেক জেলায় পাটের মণ্ড প্রস্তুত করে কাগজ তৈরি করা হতো। ময়মনসিংহের আটিয়ায় ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম পাট থেকে কাগজ তৈরির কৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন এই এলাকার কয়েকজন অগ্রগামী মানুষ।

পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী ইংরেজ এবং ডাচদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, ক্রিমিয়ার যুদ্ধ ও আমেরিকার গৃহযুদ্ধ এবং ব্যাপক কারিগরি উন্নতি—এসব কারণে বাংলার পাট প্রায় পুরো পৃথিবীতে রাজত্ব করে আনুমানিক দুই শ বছর। এরপর অবশ্য ১৯৩০ সালের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পাট রপ্তানির বজারে ক্ষতি ডেকে আনে ভীষণভাবে। ১৯৪৪-৪৫ সালের সরকারি পরিসংখ্যানমতে জানা যাচ্ছে যে সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে উৎপাদিত পাটের মধ্যে শুধু বৃহত্তর বাংলায় উৎপাদিত হতো শতকরা ৮১.৬ ভাগ পাট। অবশিষ্ট পাট উৎপাদন হতো বিহার, আসাম, ওডিশা, বর্তমানের উত্তর প্রদেশ, বোম্বে এসব এলাকায়।

সে সময়কার পাক-ভারত উপমহাদেশের বাইরেও বেশ কয়েকটি দেশে পাট উৎপাদিত হতো। তবে তার পরিমাণ ছিল সামান্য। এই দেশগুলো হচ্ছে তখনকার ফরমোজা বর্তমানের তাইওয়ান, নেপাল, থাইল্যান্ড, ইরান, মিসর, সুদান, তুরস্ক, পশ্চিম আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপ, প্যারাগুয়ে, ব্রাজিল ও মেক্সিকো। ১৯৪০ সালে ইন্ডিয়ান সেন্ট্রাল জুট কমিটির দেওয়া পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ব্রিটিশ ভারতে সে বছর ৪০ হাজার টন পাট উৎপাদিত হয়েছিল। এর তুলনায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের সম্মিলিত উৎপাদন ছিল মাত্র শতকরা ২.৬ ভাগ।

পাট পরিবহনের জন্য নদীপথ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার প্যানোরমায় নদীপথ, ১৮৭৮। ছবি: ন্যাশনাল মেরিটাইম মিউজিয়াম, গ্রিনউইচ, লন্ডন
পাট পরিবহনের জন্য নদীপথ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার প্যানোরমায় নদীপথ, ১৮৭৮। ছবি: ন্যাশনাল মেরিটাইম মিউজিয়াম, গ্রিনউইচ, লন্ডন

পাট এবং বাঙালি
বিশ্ববাজারে পাটের ক্রমাগত চাহিদা এবং ব্রিটিশ ভারতের সরকার কর্তৃক পাট চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করার ফলে পাট তৎকালীন বাংলায় একটি শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় দ্রুততার সঙ্গে। এ ব্যবসায় লাভবান হতে থাকেন ইউরোপীয় বণিকশ্রেণিসহ এ দেশের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। শুধু তা–ই নয়, এই ব্যবসা সামনে রেখে বাংলায় ফড়িয়া, ব্যাপারী, আড়তদার ও দালাল শ্রেণির সৃষ্টি হয়। নদীতীরবর্তী শত শত গঞ্জ, বন্দর মুখর হয়ে ওঠে পাট বাণিজ্যের সংস্পর্শে এসে। ‘শিপার’ নামক বিদেশি পাট রপ্তানিকারকদের আবির্ভাব ঘটে সে সময়ে।

পাটের ব্যবসায় শুধু ব্যবসায়ীরাই যে এককভাবে সম্পদের মালিক হয়েছিলেন, তা নয়। পাট উৎপাদন করে বাংলার নিম্ন–মধ্যবিত্ত এবং ধনী কৃষককুল যারপরনাই উপকৃত হয়েছিলেন। কৃষিপণ্য বিক্রি করে উদ্বৃত্ত অর্থ সঞ্চয় করা যায়—বাংলার কৃষকেরা এ কথা স্বপ্নেও কোনো দিন ভাবতে পারেননি। যুগ যুগ ধরে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা বাংলার লাখ লাখ কৃষক পরিবার পাট উৎপাদন করে কার্যকরভাবে সর্বপ্রথম আর্থিক সচ্ছলতার পথে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সন্ধান পেয়েছিলেন। বিশেষ করে তৎকালীন বাংলার অনগ্রসর হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠী পাট নামক এই ‘ক্যাশ ক্রপে’র কল্যাণে নিজেরা কোমর শক্ত করে দাঁড়াতে পেরেছিল। তারা নিজেদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর উচ্চাশা পূরণ করতে সক্ষম হয় ধীরে ধীরে। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের শুরু, এই সময়কালের মধ্যে বাংলার হাজার হাজার মুসলিম পরিবারের শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি অতিক্রম করে মূলত পাট বিক্রির টাকায়। শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া সমগ্র বাংলার বৃহৎ এই সম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁরা ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে তাঁরাই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিভিন্ন পরিবর্তনের।

ফলে পাট বাঙালির জীবনে শুধুই একটি অর্থকরী ফসল নয়। এটি বাঙালিকে সমৃদ্ধ করেছিল অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে। আজ যখন ‘পরিবেশবান্ধব’ উপকরণের চাহিদা রয়েছে পুরো পৃথিবীতে, তখন আমরা আমাদের পরিবেশবান্ধব ফসলটির সব সম্ভাবনা গলা টিপে হত্যা করেছি। আমরা কি এতটাই আত্মঘাতী?

সূত্র:
1. Nafis Ahmed : An Economic Geography of East Pakistan : Oxford University Press, London-Page 108, 109

2. Sinha : The Economic Annals of Bengal, London 1927, P-259.

3. A.J. Warden : ‘The Linen Trade’ : Longman, Roberts and Green, London, 1864, PP. 646-653

  • পাট পরিবহনের জন্য নদীপথ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার প্যানোরমায় নদীপথ, ১৮৭৮। ছবি: ন্যাশনাল মেরিটাইম মিউজিয়াম, গ্রিনউইচ, লন্ডন

    পাট পরিবহনের জন্য নদীপথ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার প্যানোরমায় নদীপথ, ১৮৭৮। ছবি: ন্যাশনাল মেরিটাইম মিউজিয়াম, গ্রিনউইচ, লন্ডন

  • আমেরিকার গৃহযুদ্ধের জন্য বিশ্ববাজারে বেড়েছিল বাংলার পাটের দাম। ‘অন্টিটামের যুদ্ধ’, ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৬২। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

    আমেরিকার গৃহযুদ্ধের জন্য বিশ্ববাজারে বেড়েছিল বাংলার পাটের দাম। ‘অন্টিটামের যুদ্ধ’, ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৬২। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

  • ডাচরাও বহির্বিশ্বে বাংলার পাটের চাহিদা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছিল। ডাচদের তৈরি একটি জাহাজের প্রতিকৃতি। এসব জাহাজ অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে পাটও পরিবহন করত। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

    ডাচরাও বহির্বিশ্বে বাংলার পাটের চাহিদা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছিল। ডাচদের তৈরি একটি জাহাজের প্রতিকৃতি। এসব জাহাজ অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে পাটও পরিবহন করত। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

  • ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ সালের মধ্যে চলা ক্রিমিয়ার যুদ্ধ পাটকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। শিল্পী ফন্স হুবোর আঁকা চিত্রকর্ম ‘দ্য সিজ অব সিভাসটোপল’ (১৯০৪)। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

    ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ সালের মধ্যে চলা ক্রিমিয়ার যুদ্ধ পাটকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। শিল্পী ফন্স হুবোর আঁকা চিত্রকর্ম ‘দ্য সিজ অব সিভাসটোপল’ (১৯০৪)। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

  • ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশের কাঁচা পাটকে সর্বপ্রথম একটি কৃষিপণ্য হিসেবে বাজারজাত করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোগো। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

    ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশের কাঁচা পাটকে সর্বপ্রথম একটি কৃষিপণ্য হিসেবে বাজারজাত করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোগো। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

  • ধলসুন্দর, বাও, বিদ্যাসুন্দর, কেউত্রা, পাইধা, কাইটাবাও, কাজলা ইত্যাদি নামের স্থানীয় জাতের পাট ছিল আমাদের। ছবি: প্রথম আলো

    ধলসুন্দর, বাও, বিদ্যাসুন্দর, কেউত্রা, পাইধা, কাইটাবাও, কাজলা ইত্যাদি নামের স্থানীয় জাতের পাট ছিল আমাদের। ছবি: প্রথম আলো

  • পাট পরিবহনের জন্য নদীপথ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার প্যানোরমায় নদীপথ, ১৮৭৮। ছবি: ন্যাশনাল মেরিটাইম মিউজিয়াম, গ্রিনউইচ, লন্ডন
  • আমেরিকার গৃহযুদ্ধের জন্য বিশ্ববাজারে বেড়েছিল বাংলার পাটের দাম। ‘অন্টিটামের যুদ্ধ’, ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৬২। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
  • ডাচরাও বহির্বিশ্বে বাংলার পাটের চাহিদা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছিল। ডাচদের তৈরি একটি জাহাজের প্রতিকৃতি। এসব জাহাজ অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে পাটও পরিবহন করত। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
  • ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ সালের মধ্যে চলা ক্রিমিয়ার যুদ্ধ পাটকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। শিল্পী ফন্স হুবোর আঁকা চিত্রকর্ম ‘দ্য সিজ অব সিভাসটোপল’ (১৯০৪)। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
  • ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশের কাঁচা পাটকে সর্বপ্রথম একটি কৃষিপণ্য হিসেবে বাজারজাত করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোগো। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
  • ধলসুন্দর, বাও, বিদ্যাসুন্দর, কেউত্রা, পাইধা, কাইটাবাও, কাজলা ইত্যাদি নামের স্থানীয় জাতের পাট ছিল আমাদের। ছবি: প্রথম আলো
বিজ্ঞাপন
মন্তব্য করুন

অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন

Leave a Reply

ফসল

লাভজনক সবজি চাষ পদ্ধতি

সবজি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। কৃষি বিজ্ঞানের ভাষায় সবজিকে উদ্যানতাত্বিক ফসল (Horticultural crops) বলা হয়ে থাকে। পুষ্টিমানের দিক থেকে সবজি ফসল যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বাণিজ্যিকভাবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। সেজন্য সবজি চাষের আধুনিক কলাকৌশল জানা জরুরি।

আর আধুনিক কলাকৌশল বলতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদকেই বোঝানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু সবজি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তবে সারাদেশে যেমন সব ধরনের সবজি উৎপাদিত হয়না ঠিক তেমনি সকল সবজিই আবার সারাবছর উৎপাদিত হয়না। একেক অঞ্চলে একেক ধরনের শাকসবজি উৎপাদিত হয়ে থাকে। আবার বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ বিশেষ সবজির জাত উৎপাদন করা যায়।

সারাদেশে সারাবছরই যেসকল সবজি সহজে উৎপাদিত হয়ে থাকে তাদের কিছু শাকসবজির কথা এখানে তুলে ধরছি। লালশাক, ডাটাশাক, পুইশাক, কলমিশাক, মিষ্টিআলু শাক, ঢেড়শ, গাজর, বরবটি, টমেটো, লাউ ও লাউশাক, পাটশাক, শশা, কাঁচকলা, বেগুন, পেপে, করলা, কচুশাক, কচুর লতি, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা ইত্যাদি পরিচিত শাকসবজি। তাছাড়া অপরিচিত বিশেষ কিছু সবজি বিশেষ বিশেষ এলাকার বিশেষত্ব হিসেবে উৎপাদিত হয়ে থাকে। উপরোক্ত ফসলগুলোর মধ্যে কিছু শুধু শাক আর বাকীগুলো শাক এবং সবজি উভয় হিসেবেই প্রচলিত রয়েছে।

কৃষিতাত্বিকভাবে রবি (শীতকাল) ও খরিপ (গ্রীষ্মকাল)- এ দুধরনের মৌসুম রয়েছে। খরিপের আবার দুটি ভাগ, যথা- খরিপ-১ (আগাম গ্রীষ্ম) এবং খরিপ-২ (বর্ষাকাল)। তবে শীতকালীন শাকসবজির মধ্যে বাহারি ও রকমারি বৈচিত্র একটু বেশি। শুধুমাত্র শীতকালে উৎপাদিত হয় এমন ফসলগুলোর মধ্যে রয়েছে- টমেটো, শীতলাউ, ফুলকপি, বাধাকপি, গাজর, সীম, মূলা, ব্রকলি, বাটিশাক, ওলকপি, শালগম, বেগুন, গোল আলু ইত্যাদিই প্রধান। অপরদিকে শুধুমাত্র গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে উৎপাদিত হয় এমন ফসলের মধ্যে রয়েছে- বিভিন্ন ধরনের কচু, ওলকচু, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, কাকরোল, পটোল, করলা, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া ইত্যাদিই প্রধান।

সবজি ফসল উৎপাদন অন্যান্য ফসলের মতো নয়। সবজি ফসল উৎপাদনের জন্য বিশেষ ধরনের যত্নের প্রয়োজন হয়। আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবাদ করতে গেলে অল্প পরিমাণ জায়গায় অধিক পরিমাণ ফসল ফলিয়ে লাভবান হওয়া সম্ভব। সবজি আবাদেও জন্য বাড়ির আঙ্গিনায় অথবা অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গা বেছে নিতে হবে। সেখানে ভালোভাবে চাষ-মই দিয়ে জমির মাটি জো অবস্থায় ঝুরঝুরে করে সেখানে এক মিটার প্রশস্ত এবং প্রয়োজনমত জমির আকার-আকৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে লম্বা বেড তৈরী করে নিতে হবে। প্রতিটি বেডের মাঝখানে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি পরিমাণ গর্ত করে নালা সৃষ্টি করতে হবে। অর্থাৎ নালার মাটি তুলেই দুইপাশে বেড প্রয়োজনমত উঁচু করতে হবে।

এভাবে বেড তৈরীর একটি বিশেষত্ব হলো শাকসবজি চাষাবাদ অন্য সাধারণ ফসল আবাদের চেয়ে একটু ভিন্ন। এর জন্য প্রয়োজন হয় বাড়তি সতর্কতা ও যত্নের। শাকসবজির চাষাবাদে যেমন শুষ্ক মৌসুমে সেচের চাহিদা থাকে অপরদিকে বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি বের করে দেওয়ার প্রয়োজন হয়। সেজন্যই বেড তৈরী করে মাটি কিছুটা উঁচু করা হয় সেখানে আবার নালা তৈরী করে নিষ্কাষনের ব্যবস্থাও রাখা হয়। কিন্তু বেড এবং নালা তৈরী না করলে সেটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবাদ হয়না। সেঠা হয় সাধারণ শাকসবজি চাষ। এতে ফলন অনেক কমে যায়।

পেপে, কাঁচকলা- এ জাতীয় সবজি বসতবাড়ির আঙ্গিনায়, রাস্তা বা পুকুরের ধারে সহজেই আবাদ করা যায়। লালশাক, ডাটা শাক, পাটশাক, মূলাশাক, গাজর, শালগম ইত্যাদি সবজি তৈরীকৃত বেডে ছিটিয়ে বীজ বুনে দিলেই ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাছাড়া টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, বাধাকপি, ঢেড়শ, কচু, ওলকচু ইত্যাদি সবজি এক মিটারের বেডে দুই সারি করে নির্ধারিত দূরত্বে চারা লাগিয়ে আবাদ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। সেজন্য এসব সবজি উৎপাদনের জন্য আলাদাভাবে নার্সারিতে চারা তৈরী করে নিতে হয়। অপরদিকে লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শশা, চাল কুমড়া, পটোল, কাকরোল, করলা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, সীম, বরবটি ইত্যাদি লতাজাতীয় সবজি চাষের জন্য উক্ত বেডে দুইটি সারি করে সেখানে জাংলা দিয়ে দিতে হয়। সাধারণত বেডের দুইপাশে খুটি দিয়ে পরে তা ইংরেজি অক্ষর ‘এক্স’ আকৃতিতে বা ‘ভি’ আকৃতিতে বাঁকিয়ে বেঁধে দিতে হয়।

বেড ছাড়াও লতাজাতীয় এসব সবজি অতি সহজেই ক্ষেতের আইলে, রাস্তার ধারে, পুকুরের পাড়ে বিশেষ ব্যবস্থায় আবাদ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে অন্যান্য যেকোন ফসলের তুলনায় এসব সবজি ফসলের একটু বেশি যত্নের প্রয়োজন হয়। বিনা আবাদেই এসব সবজি চাষ করা যেতে পারে। সেজন্য বন্যা পরবর্তীতে পুনর্বাসনের সময় বিনাচাষে এসব আবাদের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ জৈবভাবেই এসব সবজি ফসল উৎপাদন সম্ভব। আবাদের পূর্বে সামান্য পরিমাণ প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার ব্যবহার করে বাকীটা মেটাতে হবে বাড়িতে উৎপাদিত জৈব সারের মাধ্যমে। তারপর আন্তপরিচর্যা এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতেও জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। তখন এসব উৎপাদিত ফসল সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

কাজেই এভাবেই সারাবছর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বষ্পপরিসরে শাকসবজি উৎপাদন করে নিজের চাহিদা মিটিয়ে তা বাণিজ্যিকভাবেও লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমাদের শারীরিক পুষ্টি চাহিদার একটি বিরাট অংশ শাকসবজি থেকে আসা দরকার। দৈনিক একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের গড়ে কমপক্ষে আড়াইশ গ্রাম শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। আর সেটা নিবিড়ভাবে এবং নিরাপদভাবে খেতে হলে নিজের উৎপাদিত শাকসবজি খাওয়াই সবচেয়ে উত্তম। কাজেই আমাদের সারাবছর অলস সময়টাকে কাজে লাগিয়ে আসুন নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় সবজির বাগান গড়ে তুলি।

সম্পূর্ণ খবরটি পড়ুন

এগ্রোবিজ

যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে হতে পারে সারের সংকট

সারের সংকট
সারের সংকট
সারের সংকট

চলতি বোরো মৌসুমে সার কিনতে কৃষকদের সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা করে বেশি দিতে হয়েছে। আর সরকারকেও সার বাবদ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বাজেটে বরাদ্দের তিন গুণের বেশি—প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ এখন মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) সার আমদানি নিয়ে বিপাকে পড়েছে।

ধান, আলু ও সবজি চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এমওপি সারের ৬০ শতাংশ আনা হতো রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে। ওই দুই দেশ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ায় এখন বাংলাদেশকে এমওপি কিনতে হচ্ছে কানাডা থেকে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া ও আমদানিতে অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশে সারের সংকট হতে পারে। ভর্তুকির চাপ সামলাতে বাংলাদেশকে সব ধরনের সারের খুচরা মূল্য বাড়াতে হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশে সার সরবরাহ ও ব্যবহারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এমওপি সারের ২০ শতাংশ সরবরাহ কমানো হলে সামনের বোরো মৌসুমে ধান, গম ও রবি মৌসুমের অন্যান্য ফসলের উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমতে পারে। এতে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।

এমনিতেই এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সারের কারণে নতুন করে যাতে আর সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

এ এম এম শওকত আলী, সাবেক কৃষিসচিব

তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, দেশে চলতি বোরো মৌসুমে নতুন করে আর সারের দরকার হবে না। সামনে আলুর মৌসুমে ইউরিয়া, এমওপিসহ অন্যান্য সারের চাহিদা বাড়বে। ওই সময়ের জন্য সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ কানাডা ও মধ্যপ্রাচ্যের সার সরবরাহকারী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।

জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কানাডা থেকে মোট আট লাখ টন এমওপি সার আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি। এ ব্যাপারে ওই দেশের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা স্মারক হয়েছে। ফলে এই সার নিয়ে সরকারের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। তবে সার বাবদ সরকারের বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি বাড়ছে। এই চাপ নিয়েও সরকার ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ওই ভর্তুকি দিয়ে যাবে।’

কমানো হয়েছে চাহিদা

বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে ৬৯ লাখ টন রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি—এই চার ধরনের সার ব্যবহার হয় ৫৭ লাখ টন। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের ওই চার ধরনের সারের চাহিদা কমিয়ে ৫৫ লাখ ৫০ হাজার টনে নামিয়ে আনা হয়েছে।

দেশে প্রয়োজনীয় সারের ৮০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে এমওপি সারের বড় অংশ আসে রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে।

প্রসঙ্গত, ওই চারটি প্রধান সার কৃষকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। চলতি অর্থবছরে সরকার প্রাথমিকভাবে সারে ভর্তুকি বাবদ ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে গত ছয় মাসে সারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বেশির ভাগ সারের দাম তিন থেকে চার গুণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারকে ভর্তুকির পরিমাণ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা করতে হয়। কিন্তু অর্থবছরের শেষের দিকে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে হিসাব করে দেখা হয়েছে, ভর্তুকির পরিমাণ এবার বেড়ে কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকা গিয়ে দাঁড়াবে।

জিপসাম, জিংক সালফেট ও অ্যামোনিয়াম সালফেট ও ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সারে সরকার কোনো ভর্তুকি দেয় না। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কিনে ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছে তা বিক্রি করে থাকেন। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষককেও বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে।

সাবেক কৃষিসচিব এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতেই এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সারের কারণে নতুন করে যাতে আর সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সরকারের অন্যান্য খাতের ভর্তুকি কমিয়ে প্রয়োজনে সারে ভর্তুকি বাড়াতে হবে, যাতে সারের দাম কম থাকে। কারণ, কৃষকের হাতে এখন টাকা কম। বিশ্ববাজার থেকেও খাদ্য আমদানি করা সামনের দিনে আরও কঠিন হতে পারে। ফলে দেশের উৎপাদন ঠিক রাখতে সারের দাম ও জোগান ঠিক রাখা উচিত।

সম্পূর্ণ খবরটি পড়ুন

এগ্রোবিজ

পানি দিতে অতিরিক্ত টাকা

পানি দিতে অতিরিক্ত টাকা
পানি দিতে অতিরিক্ত টাকা

ঠাকুরগাঁওয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) একটি গভীর নলকূপের সেচের পানি সরবরাহে কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে। ভুক্তভোগী কৃষকদের কাছ থেকে পাওয়া এমন অভিযোগের তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বড় বালিয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে।

ভুক্তভোগী কৃষকেরা বলছেন, সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের বাইরে কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু বিএমডিএর ১০৮ নম্বর গভীর নলকূপের অপারেটরের দায়িত্বে থাকা বিউটি বেগমের স্বামী আকতারুজ্জামান বোরো ধান চাষের জন্য প্রতি বিঘার জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা ও অন্য মৌসুমে ৩০০ টাকা নেন। ১০ বছর ধরে তিনি এভাবেই বাণিজ্য করে আসছেন।

সম্প্রতি রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে বিএমডিএর গভীর নলকূপ থেকে খেতে সেচের পানি পেতে হয়রানির শিকার দুই কৃষকের মৃত্যুর ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়।

ঠাকুরগাঁও জেলায় বিএমডিএর ১ হাজার ৪৩১টি গভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে সচল ১ হাজার ৪১৮টি। সেচের আওতায় ৭৬ হাজার ৫০০ পরিবারের জমি রয়েছে ৫৩ হাজার ৫০০ হেক্টর।

* সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের বাইরে কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই। * সেচের আওতায় ৭৬ হাজার ৫০০ পরিবারের জমি আছে। * কৃষকদের নলকূপের আবেদন পেলে যাচাই করে স্কিম তৈরি করা হয়।

বিএমডিএ সূত্রে জানা গেছে, কৃষকদের নলকূপের আবেদন পেলে যাচাই করে স্কিম তৈরি করা হয়। এরপর সমবায়ের ভিত্তিতে অংশীদারি ফি বাবদ এক লাখ টাকা জমা দিতে হয়। এই নলকূপ পরিচালনার জন্য বিএমডিএ একজন অপারেটর নিয়োগ দেন। প্রিপেইড মিটারিং পদ্ধতিতে কৃষকের নিজ নামে প্রিপেইড কার্ড থাকতে হয়। সেই কার্ড থেকে প্রতি ঘণ্টায় সেচের পানির জন্য ন্যূনতম ১১০ টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে নেওয়া হয়। এর বাইরে অতিরিক্ত কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই।

বড় বালিয়া এলাকার কৃষকেরা জানান, ২০১১ সালের দিকে বড় বালিয়া মণ্ডলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আকতারুজ্জামান এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ফি হিসেবে এক লাখ জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও কোনো কৃষক সেটা দিতে এগিয়ে আসেননি। ফলে আকতারুজ্জামান, দাউদুল ইসলাম ও জোবায়দুর রহমান মিলে অংশীদারি ফি দেন। আকতারুজ্জামানের ৮০ শতাংশ টাকা থাকায় গভীর নলকূপের নিয়ন্ত্রণ তিনিই পান। অপারেটর হিসেবে নিয়োগ পান তাঁর স্ত্রী বিউটি বেগম। যদিও কৃষকেরা আকতারুজ্জামানকেই অপারেটর হিসেবে জানতেন।

সেচের পানি পেতে হয়রানির শিকার হয়ে সদর উপজেলার বড় বালিয়া এলাকার ৫০ জন কৃষক গত ১৭ এপ্রিল বিএমডিএ সহকারী প্রকৌশলীর কাছে অভিযোগ দেন। সেখানে গিয়ে কৃষক ও অপারেটরের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।

ভুক্তভোগী কৃষকেরা বলেন, ২০১২ সালে নলকূপটি চালু হলে আওতাধীন কৃষকের কাছ থেকে আকতারুজ্জামান সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের অতিরিক্ত টাকা আদায় শুরু করেন। আর সেই টাকা থেকে তিনি মাঝেমধ্যে অন্য দুই অংশীদারকে কিছু টাকা ভাগ দেন।

ভুক্তভোগী কৃষক মো. শাহজাহান আলী বলেন, গভীর নলকূপটির আওতায় তাঁর ১০ বিঘা জমি রয়েছে। কার্ডের বাইরে টাকা দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও আকতারুজ্জামানকে প্রতি বিঘায় সেচের জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা দিতে হয়। এই টাকা না দিলে তিনি পানি দেন না।

ওই নলকূপের আওতায় চার বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করছেন কৃষক মো. হেলাল। তিনি অতিরিক্ত টাকা না দেওয়ায় অপারেটর খেতে পানি দেননি। এতে জমি ফেটে যায়। পরে তিনি শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে জমিতে সেচ দিয়ে খেত রক্ষা করেছেন।

আরেক ভুক্তভোগী মোকলেসুর রহমান বলেন, ১০ বছর ধরে সেচের পানির জন্য অতিরিক্ত টাকা দিয়ে আসছেন। এখন বিরক্ত হয়ে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। এরপরও কোনো বিচার পাননি।

এ বিষয়ে মো. আকতারুজ্জামান বলেন, তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর দেখেন গ্রামে কোনো গভীর নলকূপ নেই। পরে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে নলকূপটি স্থাপন করেন। কৃষকেরা অংশীদারত্বের টাকা দিতে রাজি না হলে তিনি বিএমডিএকে জানান। সে সময় তাঁরা টাকা দিয়ে দিতে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘পরে আপনি টাকাটা ধীরে ধীরে তুলে নেবেন।’ সেই পরামর্শেই সেচের পানি বাবদ প্রিপেইড কার্ডের অতিরিক্ত কিছু টাকা তিনি নিচ্ছেন। জোর করে কিছু নিচ্ছেন না।

বিএমডিএ ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, অভিযোগটি যাচাই করে সত্যতা পাওয়া গেছে। নলকূপটি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওই অপারেটরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সম্পূর্ণ খবরটি পড়ুন

এগ্রোটেক

কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি

ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষকেরাফাইল ছবি
ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষকেরাফাইল ছবি

ডাচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে দুই দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।

গতকাল সোমবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অনুষ্ঠিত কৃষি খাতের ব্যবসাবিষয়ক এক সম্মেলনে দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।

নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এগ্রি বিজনেস কনক্লেভে বাংলাদেশের প্রায় ৪০জন উদ্যোক্তা ডাচ কৃষি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি প্রযুক্তি সহযোগিতা ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছে ওয়েগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়।

আলোচনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তি কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি সহযোগিতা দিতে রাজি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে ডাচরা প্রস্তুত এবং বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও তাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া ডাচ সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বীজ, পশু খাদ্য, পোলট্রি, হর্টিকালচার ও এ্যাকুয়াকালচার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করেছে, যা ওই দেশের বেসরকারি খাতকে আরও উৎসাহিত করেছে।

আলোচনায় কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তৈরি আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্কয়ার, ইস্পাহানি এগ্রো, একে খান অ্যান্ড কোম্পানি, প্যারাগন গ্রুপ, এসিআই, জেমকন গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ডাচ প্রযুক্তির প্রয়োগ সরেজমিনে দেখতে যাবেন।

বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের পোল্ট্রিখাতে সহযোগিতার আলোচনা অনেকটা এগিয়েছে উল্লেখ করে মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দুই দেশের মধ্যে মৎস্য, পশুপালন ও হর্টিকালচারে সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা আছে।

কনক্লেভ আয়োজনে প্রথমবারের মতো দূতাবাসের সঙ্গে অংশীদার হয়েছে নেদারল্যান্ডসের কৃষি মন্ত্রণালয়, নেদারল্যান্ডস এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি, নেদারল্যান্ডস ফুড পার্টনারশিপ, ডাচ-গ্রিন-হাইজডেল্টা, লারিভ ইন্টারন্যাশনাল, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ।

কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী নেদারল্যান্ডসের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কম। ২০২১-এ কৃষিপণ্য ও খাদ্য রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে।

সম্পূর্ণ খবরটি পড়ুন

ফসল

ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বীজ কিনে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা তাঁদের জমির ধানের ফলন খারাপের চিত্র দেখিয়ে দিচ্ছেন। গত সোমবার বিকেলে নান্দাইল উপজেলার গাংগাইল ইউনিয়নের পাছবাড়িয়া গ্রামে
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা তাঁদের জমির ধানের ফলন খারাপের চিত্র দেখিয়ে দিচ্ছেন। গত সোমবার বিকেলে নান্দাইল উপজেলার গাংগাইল ইউনিয়নের পাছবাড়িয়া গ্রামে

ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায় লাইসেন্সহীন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নিম্নমানের বীজ কিনে বোরো ধান আবাদ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকেরা। উপজেলার গাংগাইল ইউনিয়নের পাছবাড়িয়া গ্রামের কৃষকদের দাবি, এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কেনা বীজে ধান চাষ করে তাঁরা ধরা খেয়েছেন। ২০ জনের বেশি কৃষকের প্রায় ৮৫০ শতক জমির ৪ ভাগের ৩ ভাগ ধান নষ্ট হয়ে গেছে।

পাছবাড়িয়া গ্রামের কৃষক মো. তাইজুল ইসলাম ভূঁইয়া ও আতাউর রহমান জানান, তাঁরা স্থানীয় বাংলাবাজারের সোলাইমান এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. সোলাইমান মিয়ার কাছ থেকে বেঙ্গল সিড কোম্পানির ধানবীজ কিনে বীজতলা তৈরি করেছিলেন। সেই বীজতলার চারা নিজেদের জমিতে রোপণ করেন। উদ্বৃত্ত চারা গ্রামের অন্য কৃষকদের কাছে বিক্রি করেছেন। এখন তাঁদের সঙ্গে অন্য কৃষকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে আছেন মহসিন মিয়া, জাহাঙ্গীর মিয়া, আনোয়ার হোসেন, আবদুল হেকিম, আবদুস সালাম, আতাউর রহমান, রমজান আলীসহ আরও অনেকে।

অভিযোগের বিষয়ে বীজ ব্যবসায়ী সোলাইমান মিয়া বলেন, কৃষকেরা তাঁর কাছে বীজ চেয়েছিলেন। তাই তিনি নান্দাইল শহরের স্বপন মিয়ার বীজ বিক্রির দোকান বেঙ্গল সিডের ব্রি ধান-৮৯ জাতের বীজ কিনে এনে কৃষকদের কাছে বিক্রি করেছেন। বীজ বিক্রির লাইসেন্স আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বীজ বিক্রি করার জন্য তাঁর কোনো লাইসেন্স বা কৃষি বিভাগের অনুমতি নেই। সাত বছর ধরে তিনি লাইসেন্স ছাড়াই বীজ বিক্রির ব্যবসা করছেন।

সোমবার পাছবাড়িয়া গ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জমিতে গিয়ে দেখা যায়, একই বীজের চারা রোপণ করা হলেও জমিতে তিন ধরনের ধানগাছ গজিয়েছে। ধানের শিষ হয়েছে তিন প্রকারের।

এই ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ ও উপযুক্ত বিচার চান ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা। তাঁরা জানান, ধানের বীজ মানসম্পন্ন না হওয়ায় গ্রামের ৮৫০ শতকের বেশি জমির ফলন নষ্ট হয়ে গেছে। যেখানে প্রতি ১০ শতকে ১০-১১ মণ ধান ফলন হওয়ার কথা। সেখানে ফলন হতে পারে এক থেকে দেড় মণ। বোরো মৌসুমে এমন ক্ষতির মুখে পড়ে তাঁরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। বৃদ্ধ কৃষক মহসিন মিয়া বলেন, তিনিও সুলাইমানের দোকান থেকে বেঙ্গল সিডের বীজ কিনে ৭০ শতক জমি আবাদ করেছেন। তাঁর জমিতেও ফলন ভালো হয়নি।

এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে পাছবাড়িয়া গ্রামে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফয়জুর রহমান বীজ বিক্রেতা সুলাইমান ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের নিয়ে সালিসে বসার কথা।
নান্দাইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আনিসুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি একজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কাছে পাঠাবেন। তিনি বিষয়টি তদন্ত করে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। এই ঘটনার জন্য নিম্নমানের ধান বীজ দায়ী হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিষয়ে প্রতিবেদন পাঠাবেন।

সম্পূর্ণ খবরটি পড়ুন
বিজ্ঞাপন

শীর্ষ সংবাদ

সম্পাদক ও প্রকাশক: শাইখ সিরাজ
© ২০২১ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। দা এগ্রো নিউজ, ফিশ এক্সপার্ট লিমিটেডের দ্বারা পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। ৫১/এ/৩ পশ্চিম রাজাবাজার, পান্থাপথ, ঢাকা -১২০৫
ফোন: ০১৭১২-৭৪২২১৭
ইমেইল: info@agronewstoday.com, theagronewsbd@gmail.com