মৎস্য
চিংড়িতে এবার অনেক ‘কাঁটা’, সংকটে সবাই
লেখক
প্রথম আলো১৫ জুলাই, বেলা একটা। খুলনা নগরের অন্যতম প্রবেশদ্বার রূপসা ঘাট। পাশেই মাছের পাইকারি আড়ত। দোকানি সেলিম শিকদার কিছু পান বানিয়ে সাজিয়ে রাখছিলেন। কেমন চলছে জানতে চাইলে বললেন, ‘এখন বাগদা চিংড়ির ভরা মৌসুম। কিন্তু এবার মাছ কম। তাই ঘাটে ট্রলারও কম। আমারও বেচাবিক্রি কম।’
কথা বলতে বলতেই গোঁ গোঁ শব্দে একটা ট্রলার ঘাটে ভিড়ল। মুহূর্তেই বদলে গেল চারপাশের দৃশ্য। হইচই করে ঘাটের কুলি, শ্রমিকেরা ট্রলারে গেলেন। মাথায় মাছের ড্রাম নিয়ে ছুটতে লাগলেন পাইকারের দোকানের দিকে। সমানতালে চলতে থাকল হাঁকডাক, মাপজোখ, দরদাম।
ঘাটে ভেড়া ট্রলারটির মালিক শেখ রবিউল ইসলাম। দাকোপ থেকে ২০ বছর ধরে মাছ আনা-নেওয়া করেন। রবিউল বলেন, ‘দুই ঈদের দিন বাদে বছরের ৩৬৩ দিন ট্রলারে করে মাছ টানি। করোনায় অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। আগের বছর এ রকম সময়ে দিনে কমপক্ষে ১০০ ড্রাম করে মাছ এনেছি। এখন সর্বোচ্চ ২০-২৫ ড্রাম।’
কথার ফাঁকে হঠাৎই ঝুম বৃষ্টি। দৌড়ে তিন-চারজন সেলিমের দোকানে এসে পান চাইলেন। তাঁরা ফড়িয়া। এখান থেকে মাছ কিনে কোম্পানির কাছে বিক্রি করেন। তাঁদের একজন উত্তম মজুমদার। তিনি বললেন, ‘এখান থেকে চিংড়ি কিনে বিক্রি করলে কেজিতে ১০০ টাকার বেশি লাভ হইত। এখন ২০ টাকাও হচ্ছে না।’
মাছের দাম যে কমেছে, তা মুখের কথায় নয়, কাগজে-কলমে প্রমাণের তাগিদ দিলেন উত্তমের বন্ধু ব্যবসায়ী আনছার আলী। তাঁর তাগাদায় উত্তম বুকপকেট থেকে কিছু ক্যাশ মেমো বের করলেন। কিছু মেমো করোনার আগের ফেব্রুয়ারি, আর কয়েকটি জুনের। দুটি মেমো মিলিয়ে দেখালেন, ২৮ ফেব্রুয়ারি ৮ গ্রেডের গলদার দাম ছিল ২ হাজার ১০০ টাকা। একই দিন জুনে তা ১ হাজার ৩৩০ টাকা। ৮ গ্রেডের বাগদা আগে ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা, এখন ৮৪৫ টাকা। ১২, ১৫ ও ২০ গ্রেডের বাগদার দাম আগের চেয়ে দেড় শ-দুই শ টাকা ফারাক।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় সবচেয়ে বেশি চিংড়ি চাষ হয়। ঘেরের মালিক ও খামারিরা উৎপাদিত চিংড়ি নিজেরা আড়তে সরবরাহ করেন। আর হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো আড়তদার ও এজেন্টদের কাছ থেকে চিংড়ি সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি করেন।
চিংড়ির খামারি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে চিংড়ির রপ্তানি কমছে। বিশেষ করে এবার করোনার শুরুর দিকে রপ্তানিকারকদের একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হতে থাকে। এতে পরিস্থিতি আরও বেসামাল হয়ে পড়ে। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো চিংড়ি সংগ্রহ বন্ধ করে দেয়। সেই প্রভাব এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত লাখো চাষি, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের ওপর পড়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ৩০ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ কম। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৩৬ কোটি ১১ লাখ ডলারের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয়। তখনো রপ্তানি কমেছিল ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
হিমায়িত খাদ্য রপ্তারিকারকেরা বলছেন, এখন আবার নতুন করে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি শুরু হয়েছে। মূলত ইউরোপেই হচ্ছে। প্রথম দিকে ৬-৭টি কোম্পানি রপ্তানি শুরু করে আস্তে আস্তে বাড়ছে। এখন সব কারখানাই কমবেশি মাছ কিনছে। তবে গত বছরের এই সময়ের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম রপ্তানি হচ্ছে।
সংকটে আধা নিবিড় পদ্ধতির খামারিরা
কম জায়গায় অনেক বেশি উৎপাদিত হওয়ায় কয়েক বছর ধরে খুলনা অঞ্চলে আধা নিবিড় পদ্ধতির খামারের সংখ্যা বেড়েছে। চাষিরা কয়েক বছর ধরে ভালো ফল পেলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন।
বটিয়াঘাটা সেতু থেকে তিন কিলোমিটার পিচের রাস্তার পর ইট বিছানো রাস্তা। এই রাস্তা ধরে কিছুদূর যেতেই বিজয় বৈরাগীর আধা নিবিড় চিংড়ি উৎপাদন খামার। খামারের চারপাশ সুন্দর করে ঘেরা। পুকুরগুলোতে অ্যারেটর মেশিন চলছে। পুকুরের পাড়ে তিন-চারজন মানুষ বসা। গ্রামের নাম পাথরিঘাটা।
পুকুরে জাল ফেলতে ফেলতে বিজয় বললেন, ‘করোনার কারণে এ বছর লোক জোগাড় করতে পারিনি। তাই নিজেই মালিক, নিজেই কর্মচারী।’ দুবার জাল ফেলে অনেকগুলো চিংড়ি ধরে ২ কেজি মেপে দেখলেন, গড়ে ২৩টায় কেজি হচ্ছে। খুলনায় পরিচিত মাছের আড়তদারের কাছে ফোন করে দাম জানলেন। ফোন রেখে হতাশার সুরে বললেন, গত বছর এই সাইজের মাছ ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এবার ৬০০ টাকাও বলে না। গত বছর চারটি পুকুরে তাঁর ২৭ লাখ টাকার কেনাবেচা হয়েছিল। এ বছর এখন পর্যন্ত ৯ লাখ খরচ হয়েছে, এখনো অনেক খরচ বাকি।
যে চিংড়ি ধরা হয়েছিল, সেগুলোর বয়স ৪ মাস ১০ দিনের মতো। মাছগুলো বয়স অনুযায়ী নাকি বড় হয়নি। বিজয় বৈরাগী বলছিলেন, ‘এবার মাছের পোনা ছাড়ার সময় থেকে সমস্যা। ভালো মানের খাবার দিতে পারিনি। লোকাল খাবার দিয়েছি। যে ওষুধ যখন দেওয়ার কথা, তা দিতে পারলাম না। খাবারের সংকট এখনো। সব মিলিয়ে খুব আতঙ্কে আছি।’
সেখানে বসে কথাগুলো শুনছিলেন অসীম মণ্ডল। কাছারিবাড়ি হাটবাটি গ্রামে বাড়ি তাঁর। তাঁরও চিংড়ির খামার আছে। স্থানীয় খামারিদের সমিতির সাধারণ সম্পাদক তিনি। বললেন, মাছ ছাড়ার পর থেকে খাবার ঠিকমতো পায়নি। এই চিংড়ি খাবার আর ওষুধের ওপর নির্ভরশীল। এগুলো না মিললে যে কী খারাপ অবস্থা তৈরি হয়, তা চাষিই জানেন।
ফেরার পথে চক শোলমারী গ্রামের খামারি মানস মণ্ডলের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বললেন, ‘করোনার এই সময় আমাদের চরম ভুল হয়েছে পন্ডে (পুকুর) মাছ দেওয়া। এবার সবাই ধরা, কঠিন ধরা।’
আধা নিবিড় পদ্ধতির একজন বড় চাষি খুলনার দাকোপের আবুল ফিস প্রোডাক্টসের মালিক শেখ আবুল হোসেন। ৬৮টি পুকুরে এবার চাষ করেছেন। তিনি বললেন, চিংড়ি চাষের সব উপকরণ আমদানিনির্ভর। ভারত থেকে আমদানি দু-তিন মাস পুরো বন্ধ থাকায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
গলদা উৎপাদন কমার আশঙ্কা
দেশে মোট ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে গলদার চাষ হয়। পোনার প্রয়োজন হয় ১৬০ থেকে ১৭০ কোটি। তবে চলতি বছর গলদার পোনার চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বিরাট ফারাক থাকায় চাষিরা ঠিকমতো পোনা ছাড়তে পারেননি। এতে করে উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
মূলত তিনটি উৎস থেকে বাংলাদেশে গলদার পোনার চাহিদা মেটে। প্রাকৃতিক উৎস, হ্যাচারি ও ভারত থেকে বেআইনিভাবে আসা পোনার ওপর চাষিরা নির্ভরশীল থাকেন।
উইনরক ইন্টারন্যাশনালের গলদা বিশেষজ্ঞ সুকুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, সব উৎস থেকেই এবার পোনা অনেক কম ছিল। এবার উৎপাদনে থাকা দেশের ছয়টি বেসরকারি গলদার পোনার হ্যাচারি থেকে প্রায় দুই কোটি পোনা সংগ্রহ করা গেছে। নদী থেকে অন্যবার ৮০ থেকে ১০০ কোটি পোনা পাওয়া গেলেও এবার নদীতে খুব বেশি পোনা পাওয়া যায়নি। আর ভারত থেকে সাতক্ষীরা হয়ে যে পোনা আসে, তা–ও এবার আসেনি। উৎপাদনে এর একটা বড় প্রভাব পড়বে।
বাগেরহাটের ফকিরহাটের হিটলার গোলদার দুই যুগের বেশি সময় ধরে গলদা চিংড়ি চাষ করছেন। বর্তমানে ২৫ বিঘা জমিতে গলদার ঘের আছে তাঁর। কথায় ক্ষোভ ঝরল হিটলারের, ‘খাবারের দাম বেশি, পোনার দাম বেশি আবার গলদার দাম কম, এভাবে চাষি কীভাবে বাঁচবে! এ বছর পোনার সংকট প্রকট ছিল। দামও ছিল অনেক বেশি। চাহিদামতো পোনা ছাড়তে পারিনি।’
করোনার পর আম্পান
চিংড়িচাষি ও ব্যবসায়ীরা পুঁজিসংকট কাটিয়ে ওঠার আগেই ঘূর্ণিঝড় আম্পান বহু চিংড়িচাষির ক্ষতি করেছে। মৎস্য অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, খুলনা বিভাগের তিন জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় প্রায় ১ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ির চাষ হয়। আম্পানে ওই তিন জেলায় ২৭৯ কোটি টাকার চিংড়ির ক্ষতি হয়েছে।
পাইকগাছা উপজেলার ঘের ব্যবসায়ী ও খুলনা বিভাগীয় পোনা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘ঘেরে বড় বাগদা যেটা ছিল, আম্পানের পর সেটা আর পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে পোনার সংকট সারা বছর লেগে আছে। চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ পোনাও আমরা পাইনি। পোনার অতিরিক্ত দামও ছিল। যে পোনা গত বছর আড়াই শ, তিন শ টাকা ছিল, এবার নয় শ টাকা পর্যন্ত হয়েছে। আবার ঘেরের ইজারা মূল্য বেশি। অথচ বাগদার উৎপাদন যেমন কমেছে, দামও সে হারে কমেছে।’
খুলনা বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এইচ এম বদরুজ্জামান বলেন, আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত চাষি ও ঘেরমালিকদের তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
সংকটে রপ্তানিকারকেরা
করোনার শুরুতে রপ্তানিকারকদের ২৯৯টি ক্রয়াদেশ স্থগিত বা বাতিল হয়েছিল। চিংড়ির চাহিদা বিশ্ববাজারে এখনো বাড়েনি। দামও বেশ পড়ে গেছে। গত বছর ১৬ থেকে ২০ গ্রেডের যেসব হিমায়িত চিংড়ির প্রতি পাউন্ডের দাম ছিল গড়ে ৬ ডলার, সেখানে বর্তমানে ৪ ডলার ৮০ সেন্ট থেকে ৪ ডলার ৯০ সেন্টের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। একদিকে বাগদার পুরো মৌসুম চলছে, অন্যদিকে কারখানাগুলোতে পণ্য মজুত হয়ে গেছে। রপ্তানিকারকদের হাতে নগদ টাকা নেই।
ট্রাস্ট সি ফুড লিমিটেডের জিএম লুৎফর রহমান বলেন, ‘করোনাকালীন সংকট তো আছেই, তা ছাড়া কাঁচামালের অভাবে আমাদের কোম্পানিগুলো এমনিতেই রুগ্ণ হয়ে যাচ্ছে। অনেক চাষি এবার করোনার কারণে চাষে আসেননি।’
এদিকে আগের মজুত চিংড়ি পুনরায় বিক্রি করার চেষ্টা করছেন রপ্তানিকারকেরা। তবে এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে আগের ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী যেসব পণ্য প্রস্তুত করা হয়েছিল, নতুন ক্রেতার চাহিদার সঙ্গে তা পুরোপুরি মিলছে না। এতে ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, করোনা মোকাবিলায় সরকারঘোষিত প্রণোদনা এখনো কেউ পায়নি। ব্যাংকগুলো ১৩-১৪টা শর্ত দিচ্ছে। যে পরিমাণ ঋণ নিতে হবে, সেই পরিমাণ জামানত দিতে হবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো তো আগেই বিভিন্ন সময় ঋণ নেওয়ার বিপরীতে জামানত দিয়ে দিয়েছে। প্রণোদনার টাকা পেলে আরও কোম্পানি মাছ কিনতে পারত।
ভেনামিতে সমাধান দেখছেন রপ্তানিকারকেরা
সংকট থেকে উত্তরণ এবং রপ্তানি বাজার ধরে রাখতে অধিক উৎপাদনশীল ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেছেন রপ্তানিকারকেরা। বর্তমানে বিশ্বে রপ্তানি হওয়া চিংড়ির ৭৭ শতাংশই ভেনামি। এটি হচ্ছে হাইব্রিড জাত।
রপ্তানিকারকেরা বলছেন, ‘ভেনামি দামে খুব সস্তা। আর ক্রেতারা কম দামে পাওয়ায় ভেনামিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সে জন্য আমাদের চিংড়ির চাহিদা কমেছে। এ ছাড়া চিংড়ি উৎপাদন কমে যাওয়ায় তা রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আছিয়া সি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিকুল ইসলাম বলছিলেন, ভেনামি প্রচুর উৎপাদিত হয়। এতে চাষিরা লাভবান হচ্ছেন। যাদের একটা কারখানা ছিল, তাদের তিনটা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আগে বিশ্ববাজারে আমাদের চিংড়ির অবদান ছিল ৩০ শতাংশ, এখন সেটা ২-৩ শতাংশ। আমরা কাঁচামালের অভাবে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছি।’
বিএফএফইএর সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলছিলেন, মৎস্য অধিদপ্তর সম্প্রতি পরীক্ষামূলক ভেনামি চাষের অনুমতি দিয়েছে। যদিও আরও ১৫ বছর আগে অনুমোদন দেওয়া উচিত ছিল। পাইকগাছায় এটা পাইলট প্রকল্প আকারে শুরু করা হবে।
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে হতে পারে সারের সংকট
-
বিদেশ থেকে খালি হাতে ফিরে ড্রাগন চাষে সাফল্য
-
নাসিরনগরে বন্যায় তলিয়ে গেল কৃষকের বাদামখেত
-
পানি দিতে অতিরিক্ত টাকা
-
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
-
‘শিক্ষিত কৃষক’ বলেই তাঁকে নিয়ে মানুষের আগ্রহটা বেশি
-
ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বীজ কিনে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত
-
বোরো কাটতে বাড়তি খরচ ঃ হাসি নেই কৃষকের মুখে
-
পেঁয়াজের ক্ষতি পুষিয়ে দিচ্ছে সাথি ফসল বাঙ্গি
-
দেশের কৃষিতে নতুন সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে
এগ্রোটেক
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
লেখক
প্রথম আলোডাচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে দুই দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।
গতকাল সোমবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অনুষ্ঠিত কৃষি খাতের ব্যবসাবিষয়ক এক সম্মেলনে দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এগ্রি বিজনেস কনক্লেভে বাংলাদেশের প্রায় ৪০জন উদ্যোক্তা ডাচ কৃষি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি প্রযুক্তি সহযোগিতা ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছে ওয়েগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়।
আলোচনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তি কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি সহযোগিতা দিতে রাজি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে ডাচরা প্রস্তুত এবং বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও তাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া ডাচ সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বীজ, পশু খাদ্য, পোলট্রি, হর্টিকালচার ও এ্যাকুয়াকালচার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করেছে, যা ওই দেশের বেসরকারি খাতকে আরও উৎসাহিত করেছে।
আলোচনায় কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তৈরি আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্কয়ার, ইস্পাহানি এগ্রো, একে খান অ্যান্ড কোম্পানি, প্যারাগন গ্রুপ, এসিআই, জেমকন গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ডাচ প্রযুক্তির প্রয়োগ সরেজমিনে দেখতে যাবেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের পোল্ট্রিখাতে সহযোগিতার আলোচনা অনেকটা এগিয়েছে উল্লেখ করে মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দুই দেশের মধ্যে মৎস্য, পশুপালন ও হর্টিকালচারে সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা আছে।
কনক্লেভ আয়োজনে প্রথমবারের মতো দূতাবাসের সঙ্গে অংশীদার হয়েছে নেদারল্যান্ডসের কৃষি মন্ত্রণালয়, নেদারল্যান্ডস এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি, নেদারল্যান্ডস ফুড পার্টনারশিপ, ডাচ-গ্রিন-হাইজডেল্টা, লারিভ ইন্টারন্যাশনাল, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ।
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী নেদারল্যান্ডসের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কম। ২০২১-এ কৃষিপণ্য ও খাদ্য রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে।
মৎস্য
নিরাপদ খাদ্য: দেশি মাছ কাকিলাকে যেভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা
লেখক
বিবিসি বাংলাবাংলাদেশে গত কয়েক দশকে বেশ কিছু ছোট মাছের প্রজাতি বিপন্ন হয়ে পড়লেও এসব মাছের মোট উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে মৎস্য বিজ্ঞানীদের গবেষণায় ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে।
কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা উন্মুক্ত জলাশয়ের এরকম ৩১টি মাছকে বিলুপ্ত হওয়ার বিপদ থেকে রক্ষা করছেন। শুধু তাই নয়, এর ফলে পুষ্টিসমৃদ্ধ এসব মাছ এখন সহজে পুকুরেও চাষ করা সম্ভব হচ্ছে।
বাংলাদেশে স্বাদু পানিতে ২৬০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। তার মধ্যে ১৪৩টি মাছই ছোট মাছ। যেসব মাছ আকারে নয় সেন্টিমিটারের ছোট সেগুলোকে ছোট মাছ বা স্মল ইন্ডিজেনাস স্পেসিস কিম্বা এসআইএস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করে যে আন্তর্জাতিক সংগঠন আইইউসিএন, তারা বাংলাদেশের ৬৪টি প্রজাতির মাছকে ইতোমধ্যে বিপন্ন বলে উল্লেখ করেছে।
এসব মাছের মধ্যে রয়েছে মহাশোল, খরকি, পিপলা শোল, কালা পাবদা, বাঘ মাছ ইত্যাদি।
এ কারণে সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে অস্তিত্বের হুমকির মধ্যে পড়া এসব মাছের বেশ কয়েকটিকে রক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে গত কয়েক বছরে ৩০টি মাছকে বিলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে।
এসব মাছের মধ্যে রয়েছে শিং, মাগুর, পুঁটি, বাইম, টেংরা, ফলি, বাতাসি, ঢেলা, বৈরালি, গুতুম, খলিসা ইত্যাদি।
মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত এক দশকে ছোট মাছের উৎপাদন চারগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালে এই মাছের উৎপাদনের পরিমাণ যেখানে ছিল ৬৭,০০০ মেট্রিক টন, সেখানে ২০১৮ সালের উৎপাদন ছিল প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন।
বাংলাদেশের মত মিয়ানমারেও প্রজন্ম প্রজন্ম ধরে ইলিশ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন বহু জেলে।
কিন্তু বিবিসি বার্মিজ বিভাগের কো কো অং তার এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলছেন, নিয়ন্ত্রণহীন মাছ শিকার এবং সরু জালের ব্যবহারে হুমকিতে পড়েছে ইরাবতী নদীর ইলিশ।
বহুদিন ধরে ইরাবতী নদীতে ইলিশ মাছ ধরে জীবনধারণ করেন ৬৫ বছরের উ কাওক টিন। বিবিসিকে তিনি বলেন, “আমার বাবা ইলিশ ধরতো, আমিও ধরি। সেসময় অনেক মাছ পেতাম, বড় বড় ইলিশ পেতাম।”
“এখনো আমি এবং আমার ছেলেরা ইলিশ ধরতে যাই। কিন্তু মাছ খুব কম। আর যাও বা পাই সেগুলো ছোটো ছোটো।”
এফএও’র এক হিসাবে বিশ্বের মোট ইলিশের ৬০ ভাগ ধরা পড়ে বাংলাদেশে। আর মিয়ানমারে ১৫-২০ ভাগ।
এক সময় ইলিশ ছিলো মিয়ানমারের মাছ রপ্তানির শীর্ষে। কিন্তু এখন তা ইতিহাস।
সাগর থেকে ডিম পাড়তে নদীতে ঢোকে ইলিশ।
কিন্তু বাণিজ্যিক মাছ ধরার ট্রলারগুলো যেভাবে নতুন ধরনের সব জাল দিয়ে সাগরের একেবারে তল থেকে মাছ ছেঁকে আনছে তাতে ছোটবড় সব মাছ উঠে আসছে।
গবেষকরা বলছেন, আড়াই সেন্টিমিটারের ছোট ছিদ্রের জাল ব্যবহার হচ্ছে দেদারছে, যদিও আইন অনুযায়ী সেই ছিদ্র অন্তত ১০ সেমি হতে হবে।
আর এ কারণে ইলিশ মাছ সাগর থেকে নদীতে ঢোকারই সুযোগ পাচেছনা।
এখন যা পাওয়া যায় তার গড় ওজন ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম, অথচ একসময় দুই-তিন কেজি ওজনেরও মাছ হরহামেশা ধরা পড়তো।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের মাইকেল আকেসটার বলছেন, “কত ছোটো মাছ ধরা যাবে সে ব্যাপারে (মিয়ানমারে) কোনো বিধিনিষেধ নেই।” তার ফলে বাচ্চা ইলিশও ধরা হচ্ছে।
বাংলাদেশের মত মিয়ানমারেও ডিম পাড়ার সময় (মে থেকে জুলাই) নদীতে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে তা প্রয়োগ করা হচ্ছে, দারিদ্রের কথা বিবেচনা মিয়ানমার সরকার তা প্রয়োগ করেনা।
কিন্তু মিয়ানমার সরকারের মৎস্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলছেন নদী ও সাগরে এখনও প্রচুর ইলিশ। “এখনো প্রচুর ধরা পড়ছে, চিন্তার কোনো কারণ নেই।”
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে সাগরে ধরা পড়া ইলিশের পরিমাণ গত বছর বেড়েছে। কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই ছোটো সাইজের। যত বড় হওয়ার কথা, তার অর্ধেক।
ভারতের কেন্দ্রীয় মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে মিঠা পানির নদীতে ঢুকে বহু ইলিশই আর কখনও সাগরে ফিরে যাচ্ছে না।
ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, ঠিক এই কারণেই এখন গঙ্গার মোহনা থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার উজানেও সারা বছর ধরে ইলিশ মিলছে – এবং স্বাদে-গন্ধেও সেগুলো দারুণ ভাল।
মোহনায় পাতা মাছধরা জালের ভয়েই ইলিশের ঝাঁক মিষ্টি পানিতে রয়ে যাচ্ছে বলে তারা ধারণা করছেন। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের ইলিশ কেন আর কীভাবে মিঠাপানির স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণত হচ্ছে?
ইলিশ সাগরের মাছ হলেও ডিম পাড়তে ঝাঁকে ঝাঁকে তারা নদীতে ঢোকে – আবহমান কাল থেকে ইলিশ-প্রিয় বাঙালি সেটাই জেনে এসেছে।
কিন্তু ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেসের অর্থায়নে করা এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বহু ইলিশ ডিম পাড়তে গঙ্গায় ঢুকলেও আর কখনও বঙ্গোপসাগরে ফিরছে না।
ওই গবেষক দলের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী, অধ্যাপক অসীম কুমার নাথ বলছিলেন, ইলিশের ‘অটোলিথে’ বিভিন্ন রাসায়নিকের পরিমাণে তারতম্য দেখে তারা এর প্রমাণ পেয়েছেন।
তিনি বলছিলেন, “অটোলিথ মাছের একটা অর্গ্যান, যা ইলিশের ক্ষেত্রে মাথায় থাকে, কোনও কোনও মাছের ফ্যারিঞ্জিয়াল রিজিওনেও থাকে। এই অটোলিথ বিশ্লেষণ করে একটা মাছের মাইগ্রেটরি রুট সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়।
“আমরা এখন ইলিশের অটোলিথ কেটে দেখতে পাচ্ছি সেখানে বিভিন্ন রাসায়নিকের অনুপাত এমন যা থেকে স্পষ্ট অনেক ইলিশই আর সাগরে ফিরছে না। মিঠা জলে এগুলোর বেশ ওজনও হয়ে গেছে – পাঁচশো বা সাড়ে পাঁচশো গ্রাম – আবার ওদিকে ক্ষুদে সাইজের পাঁচ-দশ গ্রাম ওজনের ইলিশও মিলছে।”
আসলে সাগরে না-ফেরাটা এই ইলিশগুলোর এক ধরনের বেঁচে থাকার চেষ্টা বা ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ বলেই মনে করছেন ভারতের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ফিশারিজ এডুকেশনের মুখ্য বিজ্ঞানী বি কে মহাপাত্র।
“গলদা চিংড়ি হরিদ্বারেও দেখা যায়, সেখান থেকে ডিম পাড়তে তারা চলে আসে সুন্দরবনের মোহনাও। এই জাতীয় মাছকে বলে ক্যাটাড্রোমাস। কিন্তু ইলিশ হল অ্যানাড্রোমাস মাছ, তারা সাগর থেকে ডিম পাড়তে যায় নদীর ভেতর।”
“কিন্তু কেন এখন তারা আর ফিরতে চাইছে না? চাইছে না, কারণ গঙ্গার এসচুয়ারি জুড়ে বিছানো আছে চোদ্দ হাজারেরও বেশি জাল – তাই প্রাণে বাঁচতেই তারা রয়ে যাচ্ছে মিষ্টি জলে। এটাকে বিবর্তনবাদ বা ন্যাচারাল সিলেকশন হিসেবেই দেখা যায়,” বলছিলেন বি কে মহাপাত্র।
বহু বছর আগে গুজরাটে দেখা গিয়েছিল, তাপ্তী নদী বেয়ে ইলিশের ঝাঁক উকাই জলাধারে ঢুকে সেখানেই থাকতে শুরু করে, ডিম পাড়ে ও তাদের বাচ্চাও হয়।
এখন অনেকটা একই ধাঁচের জিনিস দেখা যাচ্ছে গঙ্গাতেও – জানাচ্ছেন অধ্যাপক অসীম কুমার নাথ।
“গঙ্গায় কাকদ্বীপের নিচে নিশ্চিন্দাপুরে যেখানে মিঠা পানি শুরু, সেখান থেকে ওপরে আপনি যদি দুশো কিলোমিটারেরও বেশি ওপরে বলাগড় অবধি যান, সেখানে ক্যালেন্ডার করে আমরা দেখতে পাচ্ছি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ-প্রাক মনসুন-মনসুন কিংবা পোস্ট-মনসুন … সারা বছরই কিন্তু এই পুরো এলাকা জুড়ে ইলিশ মিলছে।”
তবে অধ্যাপক নাথ সেই সঙ্গে বলছিলেন, বিশেষত বর্ষার পর কৃষিক্ষেতের কীটনাশক-যুক্ত জল যখন এসে নদীগুলোতে মেশে, তখন এই মিঠা পানির ইলিশগুলোর বিরাট ক্ষতিও হয়ে যাচ্ছে।
মিঠা জলের নদীতে পাকাপাকিভাবে থাকার জন্য এই ইলিশদের বেশি দূষণের শিকার হতে হচ্ছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তার পরেও স্বাদে-গন্ধে সেগুলো কিন্তু অন্য ইলিশের চেয়েও ভাল, বলছিলেন ড: মহাপাত্র।
তার কথায়, “মিঠা পানিতেই কিন্তু ইলিশের স্বাদ বাড়ে – কারণ নদীতে ঢোকার পরই তাদের শরীরে ফ্যাট বাড়ে, সেগুলো খেতেও অনেক ভাল হয়। গভীর সমুদ্রে ধরা ইলিশের স্বাদ কখনওই তেমন হয় না। ফলে এগুলোর স্বাদ নিয়ে কোনও সমস্যা নেই!”
ইলিশ কখনও সাগরে না সাঁতরালে তাকে আদৌ সত্যিকারের ইলিশ বলা যাবে কি না, তা নিয়ে অবশ্য মৎস্য বিজ্ঞানী আর খাদ্য-রসিকদের মধ্যে দু’রকম মত আছে।
কিন্তু ভারতীয় বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, বেশ কিছু ইলিশ আর কখনওই সাগরে ফেরার টান অনুভব করছে না – আর জেলেরা গঙ্গায় সেই ইলিশ পাচ্ছেন বছর জুড়েই!
বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে বেশ কয়েক প্রজাতির পরিচিত দেশীয় মাছ বাজার থেকে ‘প্রায় নেই’ হয়ে গেছে।
প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন বলছে, এর মধ্যে ‘প্রায় বিলুপ্ত’ হবার পথে বাঘাইর, পিপলা শোল বা বাক্কা মাছ, মহাশোল, নান্দিলা মাছ, চান্দা, ভাঙ্গান বাটা, খরকি মাছ, কালো পাবদা, চেনুয়া মাছসহ বেশ কিছু মাছ রয়েছে।
ময়মনসিংহে বাংলাদেশের একমাত্র মৎস্য জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক মোস্তফা আলী রেজা হোসেন জানিয়েছেন, এই মুহুর্তে দেশের ১১৮ প্রজাতির দেশীয় মাছ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
“আইইউসিএন বাংলাদেশের বিপন্ন প্রাণীর তালিকা করার জন্য দুটি জরিপ চালিয়েছিল, ২০০০ সালে প্রথম জরিপে ৫৪ প্রজাতির মাছ বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এরপর ২০১৫ সালে সর্বশেষ জরিপে তাতে আরো ৬৪ প্রজাতির মাছ যুক্ত হয়।”
“এই তালিকায় সেই সব মাছকেই চিহ্নিত করা হয়েছিল যেগুলো গত ১০ বা ২০ বছরে দেখা যায়নি।”
বিলুপ্ত মাছ নেই
বাংলাদেশে প্রায় বিলুপ্তির পথে ১০০র বেশি দেশীয় মাছ থাকলেও এখনো কোন মাছকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়নি।
আইইউসিএনের এ সংক্রান্ত নিয়মটি হচ্ছে, সর্বশেষ কোন একটি প্রজাতির মাছের দেখা পাবার পর পরবর্তী ২৫ বছরে যদি সেই প্রজাতির অস্তিত্বের কোন প্রমাণ না পাওয়া যায়, তাহলে সেটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
মৎস্য জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক হোসেন বলছিলেন, ময়মনসিংহ অঞ্চলে নান্দিল নামে এক সময় একটি মাছ দেখা যেত, কিন্তু গত ২০ বছরে সেটির অস্তিত্বের কোন প্রমাণ দেখা যায়নি।
আবার সিলেট অঞ্চলের পিপলা শোল নামে একটি মাছ দেখা যেত, যা এখন আর দেখা যায় না। গত ১০ বছরে দেখা যায়নি এই মাছ।
“দেখা যায়নি, কিন্তু তবু বিলুপ্ত ঘোষণা করার আগে আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।”
“যদি এর মধ্যে বিপন্ন মাছেদের অস্তিত্বের ব্যপারে কোন তথ্য না পাওয়া যায়, তাহলে হয়ত আইইউসিএনের পরবর্তী জরিপে এগুলোর ব্যপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা থাকতে পারে।”
প্রায় বিলুপ্ত কোন কোন প্রজাতি?
আইইউসিএনের ২০১৫ সালের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী কয়েকটি শ্রেণীতে মোট ৬৪ প্রজাতির মাছকে রেড লিস্ট বা লাল তালিকাভুক্ত করেছে, এর মানে হচ্ছে এসব প্রজাতির মাছ হয় প্রায় বিলুপ্ত, মহাবিপন্ন ও বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘আপডেটিং স্পেসিস রেড লিস্ট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রকল্পের অধীনে এই তালিকা করা হয়।
এ সংক্রান্ত প্রথম জরিপটি হয়েছিল ২০০০ সালে, সে সময় ৫৪টি প্রজাতিকে রেড লিস্টভুক্ত করা হয়েছিল।
জরিপে মূলত স্বাদু পানির এবং আধা লোনা পানির মাছকেই গণনায় ধরা হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ঐ ‘রেড লিস্ট’ তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন।
কী কী মাছ এখন আর তেমন দেখা যায় না?
বাংলাদেশে দেশীয় মাছের প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৩০০।
এর মধ্যে ২০১৫ সালে আইইউসিএন এর সর্বশেষ মূল্যায়নে ২৫৩ প্রজাতির মাছের ওপর জরিপ চালানো হয়েছিল।
তাতে দেখা গেছে সময়ের বিবর্তনে যেসব মাছ বিলুপ্তপ্রায় তার বেশির ভাগই নদীর মাছ মানে স্বাদু পানির মাছ।
তবে, ৩০০ প্রজাতির মাছের মধ্যে অন্তত ৪০ প্রজাতির মাছের ব্যাপারে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোন সংস্থার কাছে হালনাগাদ কোন তথ্য নেই।
আইইউসিএন কয়েকটি ভাগে মাছের অবস্থা ব্যাখ্যা করেছিল।
এর মধ্যে কিছু মাছ ক্রিটিক্যালি এনডেঞ্জারড বা প্রায় বিলুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ এগুলো সন্ধান ও সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে সেগুলো অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
এর বাইরে মহা বিপন্ন, বিপন্ন এবং সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে বহু প্রজাতি।
বাংলাদেশে বিপন্ন মাছের মধ্যে রয়েছে—পাঙ্গাস, দারি, ককসা, টিলা বা হিরালু, টিলা ককসা, রানি বা বউ মাছ, বেতাঙ্গি, বেটি বা পুতুল মাছ, কালা বাটা, ঘর পোয়া, ঘর পইয়া, ঘোড়া মাছ, এলানগা, কচুয়া পুটি, বোল, চিতল, গজার, টেংরা, রিটা, গাঙ্গিনা বা চাকা মাছ, বট শিং, ঘাউড়া, সাল বাইম।
এছাড়া সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে বাও বাইম, চাপিলা, গুতুম, পুঁইয়া, পিয়াসি, জারুয়া বা উট্টি, ছেপ চেলা, গোফি চেলা, বাটা মাছ, নারু মাছ বা গনিয়া, কাচকি, ফলি, শিল বাইলা, বেলে, শিং, আইড়, বোয়াল, তেলি, কুইচ্চা মাছ, বামোস মাছ।
কেন এই অবস্থা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কানিজ ফাতেমা বলছেন, মাছের প্রজাতি হারিয়ে যাওয়া বা কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে তিনি প্রথমেই জলাশয় কমে যাওয়াকে দায়ী করেন।
“শহর ও গ্রাম দুইখানেই নদী-খালসহ সব ধরণের জলাশয়ের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ কমার সঙ্গে দিনে দিনে কমছে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছের পরিমাণও।”
“কেবল দেশী জাত ও স্বাদের মাছই নয়, এর সঙ্গে কচ্ছপসহ নানা ধরণের জলজ প্রাণী ও সরীসৃপের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।”
সেই সঙ্গে রয়েছে জমিতে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি, যা বৃষ্টিতে ধুয়ে খাল বিলসহ জলাশয়গুলোতে পড়ে।
এর ফলে মাছের মৃত্যু ও প্রজনন হার মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। আছে কলকারখানার বর্জ্য নিকটস্থ জলাশয়ে ফেলা হয়, তার ফলেও মাছ মরে যায়, বলেন মিজ ফাতেমা।
এর সঙ্গে অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন-সক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, কারেন্ট জালের ব্যবহার এবং মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করাকেও কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে, বাংলাদেশ মৎস্য জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক হোসেন জানিয়েছেন, বিদেশী মাছের চাষের কারণেও দেশী প্রজাতির মাছ কমে গেছে।
“ধরুন এখানে তেলাপিয়া, কার্পজাতীয় মাছ আনা হয়েছে, আবার এক সময় আফ্রিকান মাগুর আনা হয়েছিল। কয়েক বছর আগে আনা হলো পিরানহা–এগুলো দেশী মাছের খাবার ও বাসস্থল দখল করতো। অনেক সময় দেশী মাছ খেয়ে ফেলতো কোন কোন বিদেশী প্রজাতি।”
যদিও পরে আফ্রিকান মাগুরের চাষ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু তারপরেও বিদেশী মাছের প্রজাতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে অনেক মাছ কমে গেছে।
কৃত্রিম প্রজনন ও চাষ কি সমাধান?
বাংলাদেশে দেশীয় অনেক প্রজাতির মাছের হার কমে যাবার প্রেক্ষাপটে গত দুই দশকে কৃত্রিম প্রজনন ও চাষের মাধ্যমে মাছের সরবারহ বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর সাড়ে ৪২ লাখ মেট্রিক টনের বেশি মাছ উৎপন্ন হচ্ছে।
এর মধ্যে নদী, বিল ও হাওরসহ উন্মুক্ত জলাশয় থেকে ২৫ শতাংশ, পুকুর, ডোবার মত বদ্ধ জলাশয় থেকে ৫৭ শতাংশ এবং বাকি অংশ সমুদ্র থেকে উৎপাদিত হচ্ছে।
দেশে ৮ লাখ হেক্টর বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ হয়।
বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিসের কর্মকর্তা বলরাম মহালদার জানিয়েছেন, কৃত্রিম প্রজনন ও চাষের মাধ্যমে বাজারে চাহিদা আছে এমন মাছই বেড়েছে।
“কিন্তু বাজারে চাহিদা কম এমন মাছ তো চাষ করছে না কেউ, ফলে সেগুলোর অস্তিত্ব সংকট আগের মতই থাকছে। যেমন খলিশা, চাপিলা, মেনি, ফলি, বাও বাইম, গুতুম, কুইচ্চা মাছ, বামোস ইত্যাদি ধরণের মাছ দেখতে পাবেন না।”
“এখন বাজারে পাবদা বা গুলশা মাছ বা পাঙ্গাস পাবেন আপনি, সেগুলোর চাহিদা আছে। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক না হলে, বিপন্ন মাছের ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।”
তবে ফসলি জমি নষ্ট করে দেশে মাছ চাষ করা নিয়ে পরিবেশবাদীদের এক ধরণের বিরোধিতাও রয়েছে।
তাদের পরামর্শ বিদ্যমান নদী ও পুকুরগুলোতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়াতে হবে।
তবে, সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই মনে করেন যদিও এখন কৈ, শিং, পাবদা, মাগুর, সর পুটি, চিতলসহ বেশ কয়েকটি প্রজাতির মাছ সহজলভ্য হয়েছে, কিন্তু সেই সব মাছের স্বাদ আগের মত নয়।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন