এগ্রোবিজ
কৃষিপণ্য উৎপাদনে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা প্রয়োজন
লেখক
যুগান্তরচাহিদার মাত্রার বিপরীতে সরবরাহের পরিমাণের ওপর কোনো পণ্যের মূল্য নির্ভর করে। চাহিদা বেশি কিন্তু সরবরাহ কম-এমন পরিস্থিতিতে পণ্যের মূল্য বাড়ে। অধিক মূল্য দিয়ে পণ্য কিনতে হলে ভোক্তা চাপে পড়েন। আবার চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হলে পণ্যের মূল্য কমে যায়। তখন উৎপাদক ক্ষতিগ্রস্ত হন। কাজেই চাহিদা ও সরবরাহের ভেতর ভারসাম্য বজায় থাকা প্রয়োজন, যাতে ভোক্তা ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারেন; অন্যদিকে বিক্রেতাও পরিমিত মাত্রায় লাভবান হন। আমাদের দেশে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহে এই ভারসাম্য প্রায়ই থাকে না। কোনো কৃষিপণ্য অধিক উৎপাদিত হলে বাজারদর পড়ে যায়। তখন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিপরীতে কোনো পণ্যের জোগান কমে গেলে ভোক্তাদের চড়ামূল্য গুনতে হয়।
একজন কৃষক লাভের আশায় চাষবাষে প্রবৃত্ত হন; কিন্তু তিনি ফসল উৎপাদন করে আদৌ লাভবান হবেন কিনা, সে নিশ্চয়তা নেই। হয়তো তার মতো এত বেশি সংখ্যক কৃষক একই ফসলের চাষে ঝুঁকেন যে, অধিক উৎপাদনের দরুন ওই পণ্যের বাজারদর পড়ে যায়। তখন উৎপাদন খরচও আর উঠে না। বাজারে অন্য ফসলের উচ্চমূল্য দেখে সেটা চাষ না করায় কৃষককে তখন আফসোস করতে দেখা যায়। কৃষিপণ্যের বাজার যেন এক জুয়ার দান। কখন কোন পণ্যের মূল্য বাড়বে আর কখন কমবে, আগেভাগে তা বোঝা মুশকিল।
আমাদের দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্য যেমন-খাদ্যশস্য, ডাল, শাকসবজি, মসলা, ফল, ফুল এ রকম কয়েকটি শাখায় ভাগ করা যায়। এর ভেতর খাদ্যশস্য, ডাল ও মসলাজাতীয় কৃষিপণ্য সহজে নষ্ট হয় না। কাজেই উৎপাদনের পরপরই উচিত মূল্য পাওয়া না গেলে বাজারদর ওঠার অপেক্ষায় একটা সময় পর্যন্ত এসব পণ্য রেখে দেওয়া যায়। অবশ্য গরিব কৃষক অর্থের টানাটানির ভেতর থাকেন। তার পক্ষে এই অপেক্ষা সম্ভব হয় না। সংরক্ষণযোগ্য কৃষিপণ্য একটা সময় পর্যন্ত রেখে দিলে পরবর্তী সময়ে মূল্য বাড়লে বিক্রি করা যায়। অন্যদিকে শাকসবজি, ফল, ফুল এসব পচনশীল কৃষিপণ্য। আমাদের দেশে আলু ছাড়া আর কোনো কৃষিপণ্য হিমাগারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ফলে এসবের বাজার মূল্য যা-ই হোক না কেন, ক্ষেত থেকে উঠিয়েই বাজারে বিক্রি করতে হয়।
গেল শীত মৌসুমে এক কেজি সিম ৫ টাকা এবং একই মূল্যে একটি ফুলকপি বিক্রি হয়েছিল। ২ মাস আগেও ১০ টাকা কেজি দরে বেগুন পাওয়া গেছে। অথচ এখন বেগুন ৫০ টাকা কেজি। বলা বাহুল্য, বেশি সস্তায় পণ্য বিক্রি করলে কৃষকের উৎপাদন খরচ ওঠে না। বাজারে মুলা নিয়ে গিয়ে কৃষক বেচতে না পারায় রাস্তার ধারে ফেলে গেছেন-শীত মৌসুমে প্রায়ই এ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে, আলু ও পেঁয়াজের উৎপাদন কম হওয়ায় গত বছর এ দুটি পণ্যের মূল্য খুব বেড়ে গিয়েছিল। প্রশাসনিক উদ্যোগে তখন মূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সরবরাহ কম থাকায় ব্যবসায়ীদের শাস্তির ভয় দেখিয়েও সে চেষ্টা সফল হয়নি। চাহিদা থেকে উৎপাদন কম হওয়ায় রমজানে তরমুজ সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে ছিল।
যশোর অঞ্চলে গত দুই দশকে ফল চাষের প্রবণতা বেড়েছে। আগে ঝোঁকটা ছিল আম চাষের দিকে। এখন আম চাষ আর লাভজনক হচ্ছে না। ফলে আমবাগান কমছে। কুল চাষ আর করবেন কিনা, অনেক চাষির ভেতর সেই দ্বিধা। পেয়ারা চাষও করছেন অনেকে। ইদানীং দেখছি, অনেক ড্রাগনের ক্ষেত। ড্রাগন চাষ বেশ ব্যয়বহুল। প্রতিটি গাছে পাকা খুঁটি দিতে হয়। এক বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষে ৫০-৬০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। দেশে এ ফলের চাহিদা কী পরিমাণ, কে জানে? অন্যত্রও চাষিরা একই চাষে ঝুঁকলে এই ফলের মূল্য পড়ে যাবে, চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
দেশে কোনো কৃষিপণ্যের কী পরিমাণ চাহিদা আছে এবং সম্ভাব্য কী পরিমাণ উৎপাদন হতে যাচ্ছে, আগেভাগে সেটি জানা সম্ভব হলে কৃষক সেই ফসল চাষে নামা কিংবা না নামার বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারতেন। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আগাম সেই বার্তা দিয়ে কৃষককে সহযোগিতা করা গেলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হতেন না। অন্যদিকে বাজারে চাহিদা এবং সরবরাহের ভেতর ভারসাম্য বজায় থাকলে ভোক্তাও নায্যমূল্যে পণ্যটি কিনতে পারতেন। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আমরা সম্ভবত এ কাজটি করতে পারি। বিষয়টি হবে অনেকটা আবহাওয়া অফিসের আগাম আবহাওয়া বার্তা দেওয়ার মতো। সমুদ্রগামী জেলেরা যেমন আবহাওয়া বার্তা জেনে সাগরে যাবেন, কী যাবেন না-তা ঠিক করেন; তেমনি কৃষকরা উৎপাদন প্রবণতার বার্তা জেনে কোনো ফসল চাষ করবেন কী, করবেন না-সেই সিদ্ধান্তে আসবেন।
কৃষিপণ্য উৎপাদনের আগাম তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রস্তাবটি হলো-কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ‘কৃষিপণ্য উৎপাদন পূর্বাভাস’ নামে একটি অ্যাপ চালু করবে। এই অ্যাপে প্রতিটি কৃষিপণ্যের পাশে একটি আনুভূমিক মোটা রেখা সম্ভাব্য উৎপাদন নির্দেশ করবে। ধরা যাক, দেশে একটি ফসল ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হলে উৎপাদিত পণ্য বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। এর চেয়ে বেশি জমিতে চাষ হলে কৃষকের লাভের সম্ভাবনা থাকে না। আর ওই ফসলের চাষ ৫০ হাজার হেক্টর জমির উপর উঠলে অধিক উৎপাদনের দরুন পণ্যটির বাজার পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। চাষ মৌসুমে প্রতিদিন কী পরিমাণ জমি একটি ফসল চাষের আওতায় আসছে এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাব্য উৎপাদন মূল্যের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, সেই সমীকরণের ফলাফল আগেভাগে উপস্থাপন করা গেলে কৃষকের পক্ষে সঠিক চাষের ফসল নির্বাচন করা সম্ভব হবে। এই অ্যাপের কাজ হবে, প্রতিদিন গ্রাফের ভিতর দিয়ে সম্ভাব্য উৎপাদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ বাজারের অবস্থা উপস্থাপন করা। ফসল চাষ মৌসুমের সূচনায় উৎপাদন রেখা হবে গাঢ় সবুজ রঙের। এরপর চাষ মৌসুম যত এগোবে, বেশি জমি চাষের আওতায় আসবে; ততই উৎপাদন রেখা প্রসারিত হতে থাকবে। সেই সঙ্গে সবুজ রংটাও ফিকে হয়ে আসবে। এর মানে হলো, একটি ফসল কম জমিতে চাষ হলে উৎপাদন কম হবে। তখন উৎপাদনে কৃষক বেশি লাভবান হবেন। আর চাষের জমির পরিমাণ বেড়ে গেলে উৎপাদনও বাড়বে। ফলে বাজারদর পড়ে যওয়ার দরুন কৃষকের কম মূল্য পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিবে।
উদাহরণে উল্লেখিত ফসলটি ৪০ হাজার হেক্টর পর্যন্ত জমিতে চাষ হলে উৎপাদন রেখা সবুজ থাকবে। এর চেয়ে জমির পরিমাণ বাড়লে, ফসল চাষ লাভ-ক্ষতির সন্ধিক্ষণে দাঁড়ালে উৎপাদন রেখা হলুদ রং ধারণ করবে। হলুদ রঙের অংশটুকু ফিকে থেকে গাঢ় হবে। আর ৫০ হাজার হেক্টরের অধিক জমিতে চাষ হলে উৎপাদন রেখা লাল রং ধারণ করবে। তখন কৃষক ওই ফসল চাষে নামলে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং ইতোমধ্যে যারা চাষ করেছেন তারাও ক্ষতিতে পড়বেন। এ পর্যায়ে যত অধিক জমিতে চাষ হবে, উৎপাদন রেখা প্রসারিত হওয়ার পাশাপাশি লাল রং ততই গাঢ় হতে থাকবে। কোনো চাষি ফসল তালিকায় গিয়ে তখন পর্যন্ত উৎপাদনের সম্ভাবনার ভবিষ্যৎ জেনে চাষের ফসল নির্বাচন করবেন। পণ্যের পাশের উৎপাদন রেখা লাল রঙের দেখলে স্বভাবতই তিনি ওই ফসল বাদ দিয়ে সবুজ রেখার কোনো ফসল নির্বাচন করবেন। ঢাকা শহরে পিক আওয়ারে গন্তব্যে যেতে আমরা যেমন ইন্টারনেটে রাস্তার জ্যামের অবস্থা জেনে নিই। রাস্তা লাল রঙের দেখলে গন্তব্যে যাওয়ার বিকল্প পথ খুঁজি।
প্রশ্ন হলো, তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করার কাজ কিভাবে সম্পন্ন হবে? এ কাজ খুব সুষ্ঠু এবং সুচারুভাবে চাষ মৌসুমে প্রতিদিন সম্পন্ন করতে হবে। ইউনিয়নে ব্লকে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিয়োজিত আছেন। তিনি সাধারণত কোন মৌসুমে ওই ব্লকে কতটুকু জমি কোন চাষের আওতায় এসেছে, সে হিসাব সংগ্রহ করে থাকেন। সাধারণত চাষ মৌসুমের শেষে এই হিসাব সম্পন্ন হয়। অ্যাপ চালু হলে প্রতিদিন কতটুকু জমি কোন ফসলের আওতায় আসছে, সেই হিসাব প্রতিদিনই আপলোড করতে হবে। এ কাজে প্রতিটি ইউনিয়নে ২-৩ জন জরিপকর্মী নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। উপজেলা ও জেলা কৃষি কর্মকর্তা হয়ে সংগৃহীত তথ্য দিনের পর দিন কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারে জমা হবে। এ তথ্য প্রক্রিয়াজাত হয়ে সম্ভাব্য উৎপাদন রেখায় প্রদর্শিত হবে। এজন্য বিশেষ ধরনের সফটওয়্যারের প্রয়োজন পড়বে। দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে। ২৪ ঘণ্টার ভিতর দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়া যায়। এখন পুরা বাংলাদেশকেই কৃষিপণ্যের একটা বাজার ধরা যায়। সে কারণে দেশের মানুষের মোট চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে উৎপাদিত পণ্যের হিসাব কষলে তেমন বিচ্যুতি ঘটবে না।
কারও কারও কাছে বিষয়টি ‘আদার ব্যাপারির জাহাজের খবর নেওয়া’ অর্থে প্রচলিত বাগধারাটির কথা মনে হতে পারে। কিন্তু দূরদর্শী আদার ব্যাপারির ব্যবসার ভবিষ্যৎ বুঝতে জাহাজের খবর নেওয়াটাই সঙ্গত। ব্যাপারির পুঁজি সামান্যই। ব্যবসায়ে মার খেলে তিনি দেউলিয়া হয়ে পড়েন। সে কারণে জাহাজে আদা আসছে জানলে হিসাবি ব্যাপারি মাল খালাসের আগেই বাজারে আদা ছেড়ে দেন। অন্যদিকে জাহাজে আদা না এলে আদা জমিয়ে রেখে ধীরে ধীরে উঁচুমূল্যে আদা বেচেন।
তথ্যই শক্তি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি তথ্য সার্ভিস নামে একটি বিভাগ আছে। এখান থেকে তথ্য সংগ্রহ এবং তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে ‘কৃষিপণ্য উৎপাদন পূর্বাভাস’ অ্যাপ পরিচালিত হতে পারে। বীজ বপন, কী চারা রোপণের প্রাক্কালে ভবিষ্যতে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বাজারের এই পূর্বাভাসদান ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
-
কাঁঠালের আইসক্রিম জ্যাম ও চিপস
-
পতিত জমিতে চিনাবাদাম চাষে লাভবান হচ্ছেন কৃষক
-
টি ব্যাগের ব্যবসা করে আয় করুন প্রচুর অর্থ
-
গো-বর্জ্য থেকে শুরু করুন এই চার ব্যবসা, আয় হবে লক্ষাধিক
-
ওষধি উদ্ভিদ কালমেঘ চাষে ব্যাপক আয়
-
নির্দিষ্ট পুঁজিতে মিশ্র চাষে কৃষকদের ব্যাপক আয়ের সুযোগ
-
কেমন হবে আগামীর কৃষি:
-
সুদান ঘাস চাষ করবেন যেভাবে
-
৩ অর্থবছরে ৪৫ হাজার মেট্রিক টন কাঁকড়া-কুচিয়া রপ্তানিতে আয় প্রায় ৯৮৯ কোটি টাকা
চলতি বোরো মৌসুমে সার কিনতে কৃষকদের সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা করে বেশি দিতে হয়েছে। আর সরকারকেও সার বাবদ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বাজেটে বরাদ্দের তিন গুণের বেশি—প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ এখন মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) সার আমদানি নিয়ে বিপাকে পড়েছে।
ধান, আলু ও সবজি চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এমওপি সারের ৬০ শতাংশ আনা হতো রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে। ওই দুই দেশ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ায় এখন বাংলাদেশকে এমওপি কিনতে হচ্ছে কানাডা থেকে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া ও আমদানিতে অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশে সারের সংকট হতে পারে। ভর্তুকির চাপ সামলাতে বাংলাদেশকে সব ধরনের সারের খুচরা মূল্য বাড়াতে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশে সার সরবরাহ ও ব্যবহারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এমওপি সারের ২০ শতাংশ সরবরাহ কমানো হলে সামনের বোরো মৌসুমে ধান, গম ও রবি মৌসুমের অন্যান্য ফসলের উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমতে পারে। এতে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
এমনিতেই এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সারের কারণে নতুন করে যাতে আর সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এ এম এম শওকত আলী, সাবেক কৃষিসচিব
তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, দেশে চলতি বোরো মৌসুমে নতুন করে আর সারের দরকার হবে না। সামনে আলুর মৌসুমে ইউরিয়া, এমওপিসহ অন্যান্য সারের চাহিদা বাড়বে। ওই সময়ের জন্য সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ কানাডা ও মধ্যপ্রাচ্যের সার সরবরাহকারী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।
জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কানাডা থেকে মোট আট লাখ টন এমওপি সার আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি। এ ব্যাপারে ওই দেশের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা স্মারক হয়েছে। ফলে এই সার নিয়ে সরকারের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। তবে সার বাবদ সরকারের বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি বাড়ছে। এই চাপ নিয়েও সরকার ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ওই ভর্তুকি দিয়ে যাবে।’
কমানো হয়েছে চাহিদা
বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে ৬৯ লাখ টন রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি—এই চার ধরনের সার ব্যবহার হয় ৫৭ লাখ টন। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের ওই চার ধরনের সারের চাহিদা কমিয়ে ৫৫ লাখ ৫০ হাজার টনে নামিয়ে আনা হয়েছে।
দেশে প্রয়োজনীয় সারের ৮০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে এমওপি সারের বড় অংশ আসে রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে।
প্রসঙ্গত, ওই চারটি প্রধান সার কৃষকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। চলতি অর্থবছরে সরকার প্রাথমিকভাবে সারে ভর্তুকি বাবদ ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে গত ছয় মাসে সারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বেশির ভাগ সারের দাম তিন থেকে চার গুণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারকে ভর্তুকির পরিমাণ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা করতে হয়। কিন্তু অর্থবছরের শেষের দিকে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে হিসাব করে দেখা হয়েছে, ভর্তুকির পরিমাণ এবার বেড়ে কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকা গিয়ে দাঁড়াবে।
জিপসাম, জিংক সালফেট ও অ্যামোনিয়াম সালফেট ও ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সারে সরকার কোনো ভর্তুকি দেয় না। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কিনে ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছে তা বিক্রি করে থাকেন। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষককেও বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে।
সাবেক কৃষিসচিব এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতেই এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সারের কারণে নতুন করে যাতে আর সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সরকারের অন্যান্য খাতের ভর্তুকি কমিয়ে প্রয়োজনে সারে ভর্তুকি বাড়াতে হবে, যাতে সারের দাম কম থাকে। কারণ, কৃষকের হাতে এখন টাকা কম। বিশ্ববাজার থেকেও খাদ্য আমদানি করা সামনের দিনে আরও কঠিন হতে পারে। ফলে দেশের উৎপাদন ঠিক রাখতে সারের দাম ও জোগান ঠিক রাখা উচিত।
মিরাজুল ইসলাম (৩৩)। ১০ বছর সৌদি আরবে ছিলেন। আকামা জটিলতায় খালি হাতে দেশে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এক বছর বেকার থাকার পর ইউটিউবে পতিত জমিতে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখেন। বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে নেমে পড়েন ড্রাগন চাষে। দেড় বছরের ব্যবধানে এখন উপজেলার সবচেয়ে বড় ড্রাগন বাগান তাঁর। এ বছর খরচ বাদে আট থেকে নয় লাখ টাকা লাভের আশা করছেন তিনি।
পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার ইন্দুরকানি গ্রামের বাসিন্দা মিরাজুল। উপজেলার টগরা গ্রামে দেড় একর জমিতে তিনি ড্রাগনের বাগান তৈরি করেছেন। তাঁর বাগানে এখন সাড়ে তিন হাজার ড্রাগন ফলের গাছ আছে।
মিরাজুল ইসলাম বলেন, শ্রমিক হিসেবে ১০ বছর সৌদিতে কাজ করে ২০১৯ সালে দেশে ফেরেন তিনি। আকামা সমস্যার কারণে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কিছু একটা করবেন বলে ভাবছিলেন। একদিন ইউটিউবে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখতে পান। সেই থেকে ড্রাগন চাষে আগ্রহ জন্মে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দেড় একর পতিত জমি ড্রাগন চাষের উপযোগী করেন। গাজীপুর থেকে ৬০ টাকা দরে ৬০০ চারা নিয়ে আসেন। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে শুরু করেন চাষাবাদ। পরের বছর জুনে ফল পাওয়া শুরু করেন।
ড্রাগনের বাগান করতে মিরাজুলের খরচ হয়েছিল ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। ইতিমধ্যে ফল বিক্রি করে তাঁর খরচ উঠে গেছে। সাধারণত মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গাছে ফল আসে। বছরে ছয় থেকে সাতবার পাকা ড্রাগন সংগ্রহ করা যায়। এখন পরিপক্ব ও রোগমুক্ত গাছের শাখা কেটে নিজেই চারা তৈরি করেন। ড্রাগন চাষের পাশাপাশি বাগানে চুইঝাল, এলাচ, চায়না লেবুসহ মৌসুমি সবজি চাষ করেন। এ ছাড়া ড্রাগনের চারাও উৎপাদন করে বিক্রি করেন তিনি।
মিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাগানের বেশির ভাগ গাছে এ বছর ফল ধরেছে। গত মঙ্গলবার বাগান থেকে দেড় টন ফল সংগ্রহ করেছেন। ২৫০ টাকা কেজি দরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছেন। স্থানীয় বাজারে ৩০০ টাকা কেজি দরে ড্রাগন বিক্রি হয়। নভেম্বর পর্যন্ত আরও পাঁচ–ছয়বার বাগান থেকে ফল তোলা যাবে। আশা করছেন, খরচ বাদে এবার আট থেকে নয় লাখ টাকা লাভ থাকবে।
মিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমার বাগান থেকে চারা নিয়ে অনেকে বাড়িতে ও ছাদে ছোট পরিসরে ড্রাগনের বাগান করেছেন। আমি এ পর্যন্ত ৪০ টাকায় দেড় হাজার চারা বিক্রি করেছি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পূর্ণ বয়সের একটি ড্রাগনের চারা রোপণের পর ২৫ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। এর মৃত্যুঝুঁকি নেই বললেই চলে। তবে কয়েক দিন পরপর সেচ দিতে হয়। বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হয়। ড্রাগন ফল চাষে রাসায়নিক সার দিতে হয় না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইশরাতুন্নেছা বলেন, মিরাজুল ইসলামকে ড্রাগন চাষে নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে আসছে কৃষি বিভাগ। উপজেলায় তাঁর বাগানটি সবচেয়ে বড়। তিনি নিরলস পরিশ্রম করে ছোট থেকে বাগানটি বড় করেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার গোয়ালনগর ইউনিয়নে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে কৃষকের প্রায় ৩০ হেক্টর বাদাম চাষের জমি। কয়েক দিন আগে উজানের পানিতে তাঁদের পাকা ধানের জমি তলিয়ে গিয়েছিল। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকেরা বাদাম চাষ করেছিলেন। আবারও ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ার বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হলেন চাষিরা।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ এপ্রিল উপজেলায় শিলাবৃষ্টি এবং ১৪ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত উজানের পানিতে কৃষকের পাকা ধানের জমি তলিয়ে যায়। কৃষকেরা সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ২০০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করেছিলেন। এর মধ্যে উপজেলার গোয়ালনগর ইউনিয়নে ৩০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করা হয়। উপজেলায় এবার প্রায় ৫০ হাজার মণ বাদাম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু উজানের পানিতে হঠাৎ বন্যায় সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গোয়ালনগর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আজহারুল হক বলেন, ‘নাসিরনগর উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাদাম চাষ করা হয় আমাদের ইউনিয়নে। কিন্তু এ বছর আগাম বন্যার কারণে কৃষকেরা তাঁদের ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। তাঁদের সব ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে।’
ওই এলাকার বাদামচাষি মেরাজ মিয়া বলেন, তিনি ছয় বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করেন। দু-এক দিনের মধ্যে বাদাম তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু খেতে গিয়ে দেখেন সব বাদাম পানির নিচে। এখন এই বাদাম তুলে কোনো লাভ নেই। এগুলো গরুও খাবে না।
মো. রজব আলী নামের এক কৃষক বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের জামারবালি, সোনাতলা ও মাইজখোলা গ্রামে বাদামখেত আছে। গত তিন দিনে পাঁচ-ছয় ফুট পানি বাড়ায় সব তলিয়ে গেছে। এখন বাদাম তুলতে কাজের লোকও পাওয়া যাচ্ছে না।’
কৃষক ফতু মিয়া বলেন, গোয়ালনগর ইউনিয়নের বাদাম চাষের জমিগুলো হঠাৎ পানি আসায় তলিয়ে গেছে। ফসল তলিয়ে তাঁদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। কয়েক দিন আগেও পাকা ধান পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। কৃষকদের দাবি, গোয়ালনগরে বাদাম চাষের জমি তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকদের প্রায় কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবু সাইদ প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলার কয়েকটি চরাঞ্চলে বাদাম চাষ করা হয়। চরাঞ্চলের উঁচু জমিতে প্রথমে আলু চাষের পর বাদাম চাষ করা হয়। আগাম বন্যার কারণে নিচু এলাকার কিছু বাদামখেত পানিতে তলিয়ে গেছে।
আবু সাইদ আরও বলেন, ১৫-২০ দিন আগে উপজেলার প্রায় সব বাদাম উঠে গেছে। গোয়ালনগর ইউনিয়নে ৩০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করা হয়েছিল। এর মধ্যে এক হেক্টর জমির বাদাম তলিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ৭০ হাজার টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সিলেটে বন্যা হওয়ায় এমনটি হয়েছে বলে তিনি জানান।
ঠাকুরগাঁওয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) একটি গভীর নলকূপের সেচের পানি সরবরাহে কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে। ভুক্তভোগী কৃষকদের কাছ থেকে পাওয়া এমন অভিযোগের তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বড় বালিয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে।
ভুক্তভোগী কৃষকেরা বলছেন, সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের বাইরে কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু বিএমডিএর ১০৮ নম্বর গভীর নলকূপের অপারেটরের দায়িত্বে থাকা বিউটি বেগমের স্বামী আকতারুজ্জামান বোরো ধান চাষের জন্য প্রতি বিঘার জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা ও অন্য মৌসুমে ৩০০ টাকা নেন। ১০ বছর ধরে তিনি এভাবেই বাণিজ্য করে আসছেন।
সম্প্রতি রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে বিএমডিএর গভীর নলকূপ থেকে খেতে সেচের পানি পেতে হয়রানির শিকার দুই কৃষকের মৃত্যুর ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়।
ঠাকুরগাঁও জেলায় বিএমডিএর ১ হাজার ৪৩১টি গভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে সচল ১ হাজার ৪১৮টি। সেচের আওতায় ৭৬ হাজার ৫০০ পরিবারের জমি রয়েছে ৫৩ হাজার ৫০০ হেক্টর।
* সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের বাইরে কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই। * সেচের আওতায় ৭৬ হাজার ৫০০ পরিবারের জমি আছে। * কৃষকদের নলকূপের আবেদন পেলে যাচাই করে স্কিম তৈরি করা হয়।
বিএমডিএ সূত্রে জানা গেছে, কৃষকদের নলকূপের আবেদন পেলে যাচাই করে স্কিম তৈরি করা হয়। এরপর সমবায়ের ভিত্তিতে অংশীদারি ফি বাবদ এক লাখ টাকা জমা দিতে হয়। এই নলকূপ পরিচালনার জন্য বিএমডিএ একজন অপারেটর নিয়োগ দেন। প্রিপেইড মিটারিং পদ্ধতিতে কৃষকের নিজ নামে প্রিপেইড কার্ড থাকতে হয়। সেই কার্ড থেকে প্রতি ঘণ্টায় সেচের পানির জন্য ন্যূনতম ১১০ টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে নেওয়া হয়। এর বাইরে অতিরিক্ত কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই।
বড় বালিয়া এলাকার কৃষকেরা জানান, ২০১১ সালের দিকে বড় বালিয়া মণ্ডলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আকতারুজ্জামান এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ফি হিসেবে এক লাখ জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও কোনো কৃষক সেটা দিতে এগিয়ে আসেননি। ফলে আকতারুজ্জামান, দাউদুল ইসলাম ও জোবায়দুর রহমান মিলে অংশীদারি ফি দেন। আকতারুজ্জামানের ৮০ শতাংশ টাকা থাকায় গভীর নলকূপের নিয়ন্ত্রণ তিনিই পান। অপারেটর হিসেবে নিয়োগ পান তাঁর স্ত্রী বিউটি বেগম। যদিও কৃষকেরা আকতারুজ্জামানকেই অপারেটর হিসেবে জানতেন।
সেচের পানি পেতে হয়রানির শিকার হয়ে সদর উপজেলার বড় বালিয়া এলাকার ৫০ জন কৃষক গত ১৭ এপ্রিল বিএমডিএ সহকারী প্রকৌশলীর কাছে অভিযোগ দেন। সেখানে গিয়ে কৃষক ও অপারেটরের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।
ভুক্তভোগী কৃষকেরা বলেন, ২০১২ সালে নলকূপটি চালু হলে আওতাধীন কৃষকের কাছ থেকে আকতারুজ্জামান সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের অতিরিক্ত টাকা আদায় শুরু করেন। আর সেই টাকা থেকে তিনি মাঝেমধ্যে অন্য দুই অংশীদারকে কিছু টাকা ভাগ দেন।
ভুক্তভোগী কৃষক মো. শাহজাহান আলী বলেন, গভীর নলকূপটির আওতায় তাঁর ১০ বিঘা জমি রয়েছে। কার্ডের বাইরে টাকা দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও আকতারুজ্জামানকে প্রতি বিঘায় সেচের জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা দিতে হয়। এই টাকা না দিলে তিনি পানি দেন না।
ওই নলকূপের আওতায় চার বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করছেন কৃষক মো. হেলাল। তিনি অতিরিক্ত টাকা না দেওয়ায় অপারেটর খেতে পানি দেননি। এতে জমি ফেটে যায়। পরে তিনি শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে জমিতে সেচ দিয়ে খেত রক্ষা করেছেন।
আরেক ভুক্তভোগী মোকলেসুর রহমান বলেন, ১০ বছর ধরে সেচের পানির জন্য অতিরিক্ত টাকা দিয়ে আসছেন। এখন বিরক্ত হয়ে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। এরপরও কোনো বিচার পাননি।
এ বিষয়ে মো. আকতারুজ্জামান বলেন, তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর দেখেন গ্রামে কোনো গভীর নলকূপ নেই। পরে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে নলকূপটি স্থাপন করেন। কৃষকেরা অংশীদারত্বের টাকা দিতে রাজি না হলে তিনি বিএমডিএকে জানান। সে সময় তাঁরা টাকা দিয়ে দিতে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘পরে আপনি টাকাটা ধীরে ধীরে তুলে নেবেন।’ সেই পরামর্শেই সেচের পানি বাবদ প্রিপেইড কার্ডের অতিরিক্ত কিছু টাকা তিনি নিচ্ছেন। জোর করে কিছু নিচ্ছেন না।
বিএমডিএ ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, অভিযোগটি যাচাই করে সত্যতা পাওয়া গেছে। নলকূপটি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওই অপারেটরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এগ্রোটেক
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
লেখক
প্রথম আলোডাচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে দুই দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।
গতকাল সোমবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অনুষ্ঠিত কৃষি খাতের ব্যবসাবিষয়ক এক সম্মেলনে দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এগ্রি বিজনেস কনক্লেভে বাংলাদেশের প্রায় ৪০জন উদ্যোক্তা ডাচ কৃষি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি প্রযুক্তি সহযোগিতা ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছে ওয়েগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়।
আলোচনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তি কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি সহযোগিতা দিতে রাজি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে ডাচরা প্রস্তুত এবং বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও তাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া ডাচ সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বীজ, পশু খাদ্য, পোলট্রি, হর্টিকালচার ও এ্যাকুয়াকালচার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করেছে, যা ওই দেশের বেসরকারি খাতকে আরও উৎসাহিত করেছে।
আলোচনায় কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তৈরি আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্কয়ার, ইস্পাহানি এগ্রো, একে খান অ্যান্ড কোম্পানি, প্যারাগন গ্রুপ, এসিআই, জেমকন গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ডাচ প্রযুক্তির প্রয়োগ সরেজমিনে দেখতে যাবেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের পোল্ট্রিখাতে সহযোগিতার আলোচনা অনেকটা এগিয়েছে উল্লেখ করে মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দুই দেশের মধ্যে মৎস্য, পশুপালন ও হর্টিকালচারে সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা আছে।
কনক্লেভ আয়োজনে প্রথমবারের মতো দূতাবাসের সঙ্গে অংশীদার হয়েছে নেদারল্যান্ডসের কৃষি মন্ত্রণালয়, নেদারল্যান্ডস এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি, নেদারল্যান্ডস ফুড পার্টনারশিপ, ডাচ-গ্রিন-হাইজডেল্টা, লারিভ ইন্টারন্যাশনাল, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ।
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী নেদারল্যান্ডসের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কম। ২০২১-এ কৃষিপণ্য ও খাদ্য রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন