মৎস্য
আশা জাগানিয়া কুঁচে মাছ
লেখক
নিজস্ব প্রতিনিধিবিশ্বের অনেক দেশেই সুস্বাদু ও উপাদেয় খাবার হিসেবে কুঁচে বা কুঁচিয়া খুবই জনপ্রিয়। এ কারণে আমাদের দেশে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা কুঁচে ধরে সেসব দেশে রপ্তানি করা হয়। শুধু সেই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকে টার্গেট করে সরকারিভাবে কুঁচে চাষের গবেষণা শুরু হয়। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) ময়মনসিংহের স্বাদুপানি কেন্দ্র এবং বগুড়ার সান্তাহার প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রে, নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে কুঁচে মাছ চাষের গবেষণা শুরু হয়েছিল ২০১১-১২ অর্থবছরে। তিন বছর প্রচেষ্টার পর ২০১৫ সালে সেই গবেষণায় প্রাথমিক সফল্য এসেছে। এখন বাণিজ্যিকভাবে কুঁচে চাষ সম্ভব। এর ফলে প্রাকৃতিক জলাধারের কুঁচে নিধন বন্ধ হয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পাবে। পাশাপাশি বিপন্ন প্রজাতির এই জলজপ্রাণী (মাছ) চাষের মাধ্যমে প্রজাতিটি টিকিয়ে রাখাসহ বৈদেশিক অর্থ উপার্জন করে স্বাবলম্বী হতে পারবে চাষিরা। লাভোবান হবে দেশ।
বিএফআরআই সূত্র জানায়, কুঁচে দেখতে অনেকটা সর্পিলাকৃতির, বাইন বা বাইম মাছের মতো। কোথাও তা কুঁচে, আবার কোথাও কুঁচিয়া, কুঁইচ্চা বা কুঁচে বাইম নামে পরিচিত। একসময় দেশের আগাছা, কচুরিপানা ও জলজউদ্ভিদে আচ্ছাদিত জলাভূমি, বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-ডোবা এমনকি বোরো ক্ষেতে প্রচুর কুঁচে দেখা যেত। দেশের আদিবাসী ও সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু মানুষ ছাড়া তেমন কেউ কুঁচে শিকার বা খেত না। কিন্তু পরবর্তী সময় তা বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধি, জলাধার কমে যাওয়া, অতিরিক্ত খরা, জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা, নিষিদ্ধ ঘোষিত ও মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে এটি বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়।
বিপন্ন প্রজাতি হলেও কুঁচে শিকার ও আহরণ বন্ধ হয়নি। কারণ এটি রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে। আর এর চাহিদাও ব্যাপক। বিশেষ করে আমাদের দেশ থেকে নিয়মিতভাবে চীন, হংকং, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা ও জাপানে কুঁচে রপ্তানি হয়। বিগত ২০১৩-১৪ অর্থবছরেই সরকারি অনুমোদন নিয়ে (মৎস্য অধিদপ্তর থেকে মান সনদ) বিদেশে কুঁচে রপ্তানি করা হয়েছে সাত হাজার ১৫৭ মেট্রিক টন।যার অর্থমূল্য এক কোটি ৪৯ লাখ ২১ হাজার মার্কিন ডলার। এবং ২০১৪- ১৫ অর্থ বসরে এর পরিমান আরো বৃদ্ধি পায়। একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার হাতছানি অন্যদিকে প্রজাতিটি বিপন্ন হওয়ায় সরকারিভাবে কুঁচের প্রজনন ও চাষের ওপর গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই গবেষণার কাজটি দেওয়া হয় বিএফআরআইয়ের ময়মনসিংহ স্বাদুপানি কেন্দ্র এবং বগুড়ার সান্তাহারের প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রকে।
বিএফআরআইয়ের সান্তাহার প্লাবনভূমি উপকেন্দ্র সূত্র জানায়, তারা প্রাথমিক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত (প্রাকৃতিক) ও কৃত্রিম উভয় পদ্ধতিতেই গবেষণা শুরু করে। কৃত্রিম পদ্ধতিটি পুরোপুরি সফল না হলেও নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে তিন বছরের ব্যবধানে সফলতা এসেছে। তাদের বিচরণক্ষেত্র, খাদ্যাভ্যাস, প্রজনন, পরিচর্যা সব ক্ষেত্রেই এই গবেষণা চালিয়ে সফল হয়েছেন এখানকার বিজ্ঞানীরা। বর্তমানে চাষ পদ্ধতির ওপর চৌবাচ্চায় (সিস্টার্ন) গবেষণা চলছে।
এই গবেষণা পরিচালনা করেন প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রের প্রধান ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিলুফা বেগম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মেহেদী হাসান প্রামাণিক, গোলাম সরোয়ার ও মাহমুদুর রহমান। গবেষণা সমন্বয়কারী হিসেবে আছেন স্বাদুপানি কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ।
নিলুফা বেগম ও মাহমুদুর রহমান জানান, তাঁরা প্রথমে রাজশাহী বিভাগের ছয়টি জেলায় কুঁচের বিচরণক্ষেত্র, শিকার এবং বাজারজাত প্রক্রিয়ার ওপরে কাজ করেন। এরপর প্রাকৃতিক উৎস থেকে বেশ কিছু সুস্থ-সবল কুঁচে সংগ্রহ করে তা উপকেন্দ্রের ভেতরে পুকুরে মজুদ করেন। সেখানে তাদের জীবনপ্রণালি ও থাকার পরিবেশ পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি প্রজনন উপযোগী করা হয়। এরপর কৃত্রিম পদ্ধতিতে চৌবাচ্চা ও পুকুরে বিভিন্ন হরমোন ডোজ প্রয়োগ করে ডিম ও রেণু উৎপাদনের ওপর গবেষণা করা হয়। কৃত্রিম পদ্ধতিতে পুকুরে ডিম ও রেণু উৎপাদন সম্ভব হলেও চৌবাচ্চায় এ পর্যন্ত শুধু অনুর্বর ডিম পাওয়া যায়। তবে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে পুকুরে কুঁচের ব্রুড (প্রজনন সক্ষম কুঁচে) লালন পালন করে রেণু (লার্ভা) সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।
উপকেন্দ্রের প্রধান ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিলুফা বেগম বলেন, এর আগে তাঁরা ভেদা মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশলে সফল হওয়ার পর কুঁচের গবেষণা কাজে হাত দেন। সেখানেও প্রাথমিক সফলতা এসেছে। চাষিপর্যায়ে কুঁচে চাষ শুরু হলে, একই জলাধারে অন্যান্য মাছের (তেলাপিয়া, রুই, কাতলা, মৃগেল) চাষও অব্যাহত রাখা যাবে। এতে করে স্থানীয় মাছের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি কুঁচে রপ্তানি করে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আসবে।
তথ্য সুত্রঃ বিএফআরআই।
( অনেকের মনে প্রশ্ন আছে, কুচিয়া হারাম না হালাল ? তার সমাধান—
প্রশ্নঃ মুহতারাম সালাম নিবেন। প্রশ্ন হল- কাকড়া, কুচে, কচ্ছপ, ব্যাঙ, চিংড়ি এগুলো খাওয়া এবং চাষ করা জায়েয আছে কি? @Abu Bakar Siddiq
জবাবঃ ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহ।
প্রাণী খাবার ব্যাপারে ইসলামি শরিয়তের মূলনীতি হলো :
০১. সমস্ত পবিত্র বস্তু হালাল।
০২. নোংরা প্রাণী হারাম।
০৩. আল্লাহ এবং আল্লাহর রসূল যেগুলো নির্দিষ্ট করে হারাম করেছেন সেগুলো হারাম। যেমন- শুকর, মৃত প্রাণী ইত্যাদি।
০৪. হিংস্র প্রাণী হারাম।
০৫. নখর দিয়ে শিকার করে এমন প্রাণী হারাম।
০৬. জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর খাদ্যবস্তু হারাম।
আপনি যেসব প্রাণীর নাম উল্লেখ করেছেন, আল্লাহ এবং আল্লাহর রসূল সেগুলো হারাম করেননি। তবে যারা মনে করেন সেগুলো নোংরা প্রাণী, তাদের দৃষ্টিতে সেগুলো খাওয়া জায়েয নয়।
সুতরাং এগুলো আল্লাহর বিধানে হারাম নয়। ফকীহগণের ইজতেহাদে কেউ জায়েয মনে করেন এবং কেউ না জায়েয মনে করেন। যেমন: সাপ, বন বিড়াল, কাক এগুলো খাওয়া হারাম নয়, কিন্তু কিছু ফকীহ মনে করেন এগুলো নোংরা প্রাণীর অন্তর্ভুক্ত, কিংবা হিংস্র প্রাণীর অন্তর্ভুক্ত। তাই তাদের দৃষ্টিতে এগুলো খাওয়া জায়েয নয়।
আপনি যেসব প্রাণীর নাম উল্লেখ করলেন, সেগুলো খাওয়া এবং সেগুলোর ব্যবসা করা হারাম নয়। তবে ফকীহদের মধ্যে এগুলোর বিষয়ে ইজতিহাদি মতভেদ আছে। কিন্তু ইজতেহাদি মতভেদ দ্বারা কোনো ‘মুবাহ’ জিনিস খাবার হারাম হয়ে যায় না। )
মাছ চাষ পদ্ধতি
ভূমিকা–বাংলাদেশে মৎস্য চাষ একটি দ্রুত বর্ধনশীল খাত। দেশের মানুষের সিংহভাগ আমিষের চাহিদা পুরন করে এই খাত। দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব দূরীকরণ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মৎস্য খাতের যথেষ্ট ভূমিকা ও গুরুত্ব রয়েছে। আধুনিক উন্নত প্রযুক্তি ব্যাবহার ও টেকসই পদ্ধতি অনুসরনের মাধ্যমে এই খাতকে আরো বেশী লাভজনক করা এবং একই পরিমান জায়গায় বর্তমানের তুলনায় অধিক উৎপাদন সম্ভব।ইতিমধ্যে অনেক মাছ চাষি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যাবহার করে সফলতা পেয়েছেন। আশার কথা হচ্ছে, এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলেই যে যার অবস্থান থেকে প্রযুক্তি উন্নয়নে সচেষ্ট। আধুনিক এই যুগে উন্নত প্রযুক্তি সংগ্রহ খুব বেশী কঠিন কাজ নয়। চাষিরা যত তারাতারি উন্নত প্রযুক্তি ও উপকরনে অভ্যাস্ত হবে, তত দ্রুত এই খাত এগিয়ে যাবে। মৎস্য খামারের মোট ব্যায়ের সিংহভাগ ব্যায় হয়ে থাকে খাদ্য সরবরাহে। তাই খাদ্যখরচ কমিয়ে আমারা উৎপাদন খরচ কমাতে পারি। সঠিক পুষ্টিগুণ ও কম এফসিআর সম্পন্ন খাদ্য প্রয়োগের মাধ্যমে খাদ্য খরচ কমিয়ে আনা যাবে। অপচয় রোধ ও ভালো মানের খাদ্য এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
মাছ চাষে করনীয়—-
আধুনিক পদ্ধতি ও বিজ্ঞানসম্মত ভাবে মাছ চাষের জন্য নিন্মে উল্লেখিত বিসয়গুলির প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরী—
কিভাবে পুকুর তৈরি করবেন—— ??
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উত্তমরূপে পুকুর প্রস্তুতির উপর মাছের উৎপাদন ও খামারের লাভ-লোকসান অনেকাংশে নির্ভরশীল। ভালো ভাবে পুকুর প্রস্তুত না হলে মাছ রোগাক্রান্ত হওয়া, মাছ মরে যাওয়া, মাছের বৃদ্ধি কম হওয়া ইত্যদি সমস্য সহ লোকসানের আশংকা বেশী থাকে। তাই পুকুর অবশ্যই ভালোভাবে প্রস্তুত করে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়-পার ও তলা মজবুত করন, আগাছা অপসারন, রাক্ষুসে মাছ ও অবাঞ্চিত প্রজাতির প্রাণী দমন। এ সকল কাজ পুকুর সেচ দিয়ে করাই উত্তম। তবে সেচ দেয়া সম্ভব না হলে, ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে অবাঞ্চিত মাছ বা প্রাণী দমন করা যায়। সকল প্রজাতির মাছ চাষের ক্ষেত্রেই পুকুরের তলা সমতল হওয়া ভালো।
পুকুরে কিভাবে চুন প্রয়োগ করবেন—–??
নিয়মানুযায়ী মাটি ও পানির পি,এইচ (ph)
বা অম্লত্ব/ক্ষারত্ব মানের উপর চুন প্রয়োগের মাত্রা নির্ভর করে। পুকুরে পানি ঢোকানোর আগে বা মাছ মজুদের আগেই পুকুর সংস্কার করে চুন প্রয়োগ করতে হয়। পুকুরে পানি ঢোকানোর আগে চাষ দিলে চুনের কার্যকারিতা বেশী হয়। সাধারণত এতেল মাটি, কাঁদা মাটি ও লাল মাটির ক্ষেত্রে চুন একটু বেশী দেয়া দরকার। মাটি ও পানির পি,এইচ ( অম্লত্ব/ক্ষারত্ব ) অনুযায়ী পুকুরে চুন প্রয়োগের মাত্রা নিন্মরুপঃ
পি,এইচ মান—আয়তন—পাথুরে চুন( caco3)—-পোড়া চুন (cao)
৩-৫———— ১ শতাংশ– ১২ কেজি————– ৬ কেজি
৫-৬————-ঐ———–৮ কেজি—————-৪ কেজি
৬-৭————-ঐ———–২ কেজি—————-১ কেজি
সার প্রয়োগের প্রয়জনিয়তা—–
পুকুরের মাটি ও পানির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য সার প্রয়োগ করা হয়। জৈব বা অজৈব সার জলাশয়ে প্লাঙ্কটন বৃদ্ধি তথা উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। পানিতে সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্লাঙ্কটন বা প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমান দেখে সারের পরিমান নির্ধারণ করতে হয়। তবে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষের ক্ষেত্রে সার প্রয়গে বেশী সতর্ক থাকতে হবে। অনেক সময় অধিক প্লাঙ্কটন খতির কারন হয়ে দাড়ায়। নিন্মে একটি সার প্রয়োগের মাত্রা দেখানো হলো—-
সারের নাম———- পুকুর প্রস্তুত কালীন প্রয়োগ—চাষ কালীন প্রয়োগ
জৈব সার———– ১ শতাংশে ৫-৭ কেজি——— ১-১.৫ কেজি
ইউরিয়া————১ শতাংশে ১০০ গ্রাম————৮০-১০০ গ্রাম
টিএসপি———–১ শতাংশে ১০০ গ্রাম———— ৫০-৭০ গ্রাম
( CAJ তথ্য সুত্র– ড. মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম, বি,এ,ইউ )
বিদ্রঃ মেঘলা দিন বা বৃষ্টির সময় সার প্রয়োগ না করে রৌদ্রজ্জল আবহাওয়ায় সার প্রয়োগ করা উচিৎ।
কিভাবে পোণা নির্বাচন করবেন—–??
পুকুরে পোণা মজুদের পূর্বে সঠিক পোণা নির্বাচন মাছ চাষের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুস্থ্য-সবল, রোগমুক্ত ও উন্নত জাতের, সঠিক বয়স ও ওজনের ব্রুড হতে উৎপাদিত পোণা সংগ্রহ করতে হবে। সঠিক মাত্রায় ও নির্ধারিত আকারের পোণা মজুদ করতে হবে। মাছ চাষের সফলতা নির্ভর করে আন্তঃপ্রজনন( inbreeding) মুক্ত সুস্থ্য-সবল ও ভালো জাতের পোণার উপর। যেহেতু বেশীর ভাগ চাষিকেই অন্যের হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোণার উপর নির্ভর করতে হয়, সেহেতু যে সকল হ্যাচারির সুনাম রয়েছে- তেমন হ্যাচারি থেকে পোণা সংগ্রহ করা উচিৎ।
কিভাবে পোণা নার্সিং করবেন—- ??
পোণা মজুদ পুকুরে দেয়ার পূর্বে ভালোভাবে নার্সিং করার উপর সফলতা নির্ভরশীল।সঠিক ব্যাবস্থাপনা ও আধুনিক প্রযুক্তি অবলম্বন করতে হলে পোণা নার্সিং এর বিকল্প নেই। সঠিক পরিমানে খাদ্য প্রয়োগের জন্য পুকুরে মাছের সংখ্যা অবশ্যই জানা থাকতে হবে। খাদ্যের পরিমান কম-বেশী হওয়া মাছ চাষে সফলতার অন্তরায়। সঠিক নার্সিং করলে মাছের মৃত্যু হার কমে যায়, মজুদ পুকুরে মাছের পরিমান জানা থাকে এবং একই আকারের পোণা বাছাই করে চাষে দেয়া যায়। কিভাবে পোণা মজুদ করবেন—??
মাছ চাষে পোণার মজুদ ঘনত্ব নির্ভর করে চাষ পদ্ধতি, পুকুরের আকার ও অবস্থান, মাছের জাত, খাদ্যের প্রকৃতি ইত্যদির উপর। পোণা মজুদ করার সময় পানির স্তর অনুযায়ী মাছের জাত বিন্নস্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সকল পুকুরের ধারন ক্ষমতা সমান নয়। পুকুরের পরিবেশ ও ব্যাবহার কৃত উপকরন অনুযায়ী ধারন ক্ষমতা ভিন্ন হবে। নিন্মে পোণা মজুদের ছক দেয়া হলো—-
মাছের প্রজাতি—–মাছের আকার———-একক চাষে—–মিশ্র চাষে
তেলাপিয়া———১-২ ইঞ্ছি———-২০০- ২২০ টি—— ৭০-৮০ টি
পাঙ্গাস————-৩-৫ ইঞ্চি ———১২৫- ১৫০ টি—— ৬০-৭০ টি
কৈ—————–১-১.৫ইঞ্চি——–৩০০- ৩৫০ টি—— ৭০-৮০ টি
শিং—————- ২-৩ ইঞ্চি——— ৪০০-৫০০ টি—— ৭০-৮০ টি
মাগুর————- ২-৩ ইঞ্চি——— ২০০-২৫০ টি——-৭০-৮০ টি
খাদ্য ব্যাবস্থাপনা——
মাছ চাষে সফল হতে হলে ভালো মানের সম্পুরক খাদ্য প্রয়োজন। পোণা মজুদ পরবর্তী ব্যাবস্থাপনার অংশ হিসেবে ভালো মানের সম্পুরক খাদ্য প্রয়োগ মাছ উৎপাদনের প্রধান শর্ত। মাছের দৈহিক ওজন, বয়স, সংখ্যা এবং প্রজাতিভেদে নিয়মিত প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ সুষম খাবার প্রয়োগ করতে হবে।
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
জানুন চৌবাচ্চায় বাগদা চিংড়ি মাছ চাষের কৌশল
-
কীভাবে খাদ্য প্রয়োগ করলে মাছের বৃদ্ধি বাড়বে, জেনে নিন কম খরচে মাছ পালনের পদ্ধতি
-
বাড়ছে মিল্কফিশ চাষ, জেনে নিন এর সহজ চাষ পদ্ধতি
-
রাতে বিক্রি হচ্ছে পায়রা ও বিষখালী নদীর ইলিশ
-
ঐতিহ্যবাহী দেশীয় মাছ
-
আশা জাগানিয়া কুঁচিয়া
-
দেশী প্রজাতীর মাছ চাষ ও সংরক্ষণ
-
দেশি সুস্বাদু লাভজনক শিং মাছের চাষ পদ্ধতি
-
ফরমালিনের বিকল্প চিংড়ির খোসা
-
পুকুরে কই মাছ চাষ করে অধিক উপার্জন করুন
এগ্রোটেক
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
লেখক
প্রথম আলোডাচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে দুই দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।
গতকাল সোমবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অনুষ্ঠিত কৃষি খাতের ব্যবসাবিষয়ক এক সম্মেলনে দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এগ্রি বিজনেস কনক্লেভে বাংলাদেশের প্রায় ৪০জন উদ্যোক্তা ডাচ কৃষি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি প্রযুক্তি সহযোগিতা ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছে ওয়েগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়।
আলোচনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তি কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি সহযোগিতা দিতে রাজি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে ডাচরা প্রস্তুত এবং বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও তাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া ডাচ সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বীজ, পশু খাদ্য, পোলট্রি, হর্টিকালচার ও এ্যাকুয়াকালচার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করেছে, যা ওই দেশের বেসরকারি খাতকে আরও উৎসাহিত করেছে।
আলোচনায় কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তৈরি আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্কয়ার, ইস্পাহানি এগ্রো, একে খান অ্যান্ড কোম্পানি, প্যারাগন গ্রুপ, এসিআই, জেমকন গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ডাচ প্রযুক্তির প্রয়োগ সরেজমিনে দেখতে যাবেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের পোল্ট্রিখাতে সহযোগিতার আলোচনা অনেকটা এগিয়েছে উল্লেখ করে মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দুই দেশের মধ্যে মৎস্য, পশুপালন ও হর্টিকালচারে সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা আছে।
কনক্লেভ আয়োজনে প্রথমবারের মতো দূতাবাসের সঙ্গে অংশীদার হয়েছে নেদারল্যান্ডসের কৃষি মন্ত্রণালয়, নেদারল্যান্ডস এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি, নেদারল্যান্ডস ফুড পার্টনারশিপ, ডাচ-গ্রিন-হাইজডেল্টা, লারিভ ইন্টারন্যাশনাল, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ।
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী নেদারল্যান্ডসের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কম। ২০২১-এ কৃষিপণ্য ও খাদ্য রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে।
মৎস্য
নিরাপদ খাদ্য: দেশি মাছ কাকিলাকে যেভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা
লেখক
বিবিসি বাংলাবাংলাদেশে গত কয়েক দশকে বেশ কিছু ছোট মাছের প্রজাতি বিপন্ন হয়ে পড়লেও এসব মাছের মোট উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে মৎস্য বিজ্ঞানীদের গবেষণায় ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে।
কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা উন্মুক্ত জলাশয়ের এরকম ৩১টি মাছকে বিলুপ্ত হওয়ার বিপদ থেকে রক্ষা করছেন। শুধু তাই নয়, এর ফলে পুষ্টিসমৃদ্ধ এসব মাছ এখন সহজে পুকুরেও চাষ করা সম্ভব হচ্ছে।
বাংলাদেশে স্বাদু পানিতে ২৬০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। তার মধ্যে ১৪৩টি মাছই ছোট মাছ। যেসব মাছ আকারে নয় সেন্টিমিটারের ছোট সেগুলোকে ছোট মাছ বা স্মল ইন্ডিজেনাস স্পেসিস কিম্বা এসআইএস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করে যে আন্তর্জাতিক সংগঠন আইইউসিএন, তারা বাংলাদেশের ৬৪টি প্রজাতির মাছকে ইতোমধ্যে বিপন্ন বলে উল্লেখ করেছে।
এসব মাছের মধ্যে রয়েছে মহাশোল, খরকি, পিপলা শোল, কালা পাবদা, বাঘ মাছ ইত্যাদি।
এ কারণে সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে অস্তিত্বের হুমকির মধ্যে পড়া এসব মাছের বেশ কয়েকটিকে রক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে গত কয়েক বছরে ৩০টি মাছকে বিলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে।
এসব মাছের মধ্যে রয়েছে শিং, মাগুর, পুঁটি, বাইম, টেংরা, ফলি, বাতাসি, ঢেলা, বৈরালি, গুতুম, খলিসা ইত্যাদি।
মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত এক দশকে ছোট মাছের উৎপাদন চারগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালে এই মাছের উৎপাদনের পরিমাণ যেখানে ছিল ৬৭,০০০ মেট্রিক টন, সেখানে ২০১৮ সালের উৎপাদন ছিল প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন।
বাংলাদেশের মত মিয়ানমারেও প্রজন্ম প্রজন্ম ধরে ইলিশ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন বহু জেলে।
কিন্তু বিবিসি বার্মিজ বিভাগের কো কো অং তার এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলছেন, নিয়ন্ত্রণহীন মাছ শিকার এবং সরু জালের ব্যবহারে হুমকিতে পড়েছে ইরাবতী নদীর ইলিশ।
বহুদিন ধরে ইরাবতী নদীতে ইলিশ মাছ ধরে জীবনধারণ করেন ৬৫ বছরের উ কাওক টিন। বিবিসিকে তিনি বলেন, “আমার বাবা ইলিশ ধরতো, আমিও ধরি। সেসময় অনেক মাছ পেতাম, বড় বড় ইলিশ পেতাম।”
“এখনো আমি এবং আমার ছেলেরা ইলিশ ধরতে যাই। কিন্তু মাছ খুব কম। আর যাও বা পাই সেগুলো ছোটো ছোটো।”
এফএও’র এক হিসাবে বিশ্বের মোট ইলিশের ৬০ ভাগ ধরা পড়ে বাংলাদেশে। আর মিয়ানমারে ১৫-২০ ভাগ।
এক সময় ইলিশ ছিলো মিয়ানমারের মাছ রপ্তানির শীর্ষে। কিন্তু এখন তা ইতিহাস।
সাগর থেকে ডিম পাড়তে নদীতে ঢোকে ইলিশ।
কিন্তু বাণিজ্যিক মাছ ধরার ট্রলারগুলো যেভাবে নতুন ধরনের সব জাল দিয়ে সাগরের একেবারে তল থেকে মাছ ছেঁকে আনছে তাতে ছোটবড় সব মাছ উঠে আসছে।
গবেষকরা বলছেন, আড়াই সেন্টিমিটারের ছোট ছিদ্রের জাল ব্যবহার হচ্ছে দেদারছে, যদিও আইন অনুযায়ী সেই ছিদ্র অন্তত ১০ সেমি হতে হবে।
আর এ কারণে ইলিশ মাছ সাগর থেকে নদীতে ঢোকারই সুযোগ পাচেছনা।
এখন যা পাওয়া যায় তার গড় ওজন ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম, অথচ একসময় দুই-তিন কেজি ওজনেরও মাছ হরহামেশা ধরা পড়তো।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের মাইকেল আকেসটার বলছেন, “কত ছোটো মাছ ধরা যাবে সে ব্যাপারে (মিয়ানমারে) কোনো বিধিনিষেধ নেই।” তার ফলে বাচ্চা ইলিশও ধরা হচ্ছে।
বাংলাদেশের মত মিয়ানমারেও ডিম পাড়ার সময় (মে থেকে জুলাই) নদীতে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে তা প্রয়োগ করা হচ্ছে, দারিদ্রের কথা বিবেচনা মিয়ানমার সরকার তা প্রয়োগ করেনা।
কিন্তু মিয়ানমার সরকারের মৎস্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলছেন নদী ও সাগরে এখনও প্রচুর ইলিশ। “এখনো প্রচুর ধরা পড়ছে, চিন্তার কোনো কারণ নেই।”
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে সাগরে ধরা পড়া ইলিশের পরিমাণ গত বছর বেড়েছে। কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই ছোটো সাইজের। যত বড় হওয়ার কথা, তার অর্ধেক।
ভারতের কেন্দ্রীয় মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে মিঠা পানির নদীতে ঢুকে বহু ইলিশই আর কখনও সাগরে ফিরে যাচ্ছে না।
ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, ঠিক এই কারণেই এখন গঙ্গার মোহনা থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার উজানেও সারা বছর ধরে ইলিশ মিলছে – এবং স্বাদে-গন্ধেও সেগুলো দারুণ ভাল।
মোহনায় পাতা মাছধরা জালের ভয়েই ইলিশের ঝাঁক মিষ্টি পানিতে রয়ে যাচ্ছে বলে তারা ধারণা করছেন। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের ইলিশ কেন আর কীভাবে মিঠাপানির স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণত হচ্ছে?
ইলিশ সাগরের মাছ হলেও ডিম পাড়তে ঝাঁকে ঝাঁকে তারা নদীতে ঢোকে – আবহমান কাল থেকে ইলিশ-প্রিয় বাঙালি সেটাই জেনে এসেছে।
কিন্তু ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেসের অর্থায়নে করা এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বহু ইলিশ ডিম পাড়তে গঙ্গায় ঢুকলেও আর কখনও বঙ্গোপসাগরে ফিরছে না।
ওই গবেষক দলের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী, অধ্যাপক অসীম কুমার নাথ বলছিলেন, ইলিশের ‘অটোলিথে’ বিভিন্ন রাসায়নিকের পরিমাণে তারতম্য দেখে তারা এর প্রমাণ পেয়েছেন।
তিনি বলছিলেন, “অটোলিথ মাছের একটা অর্গ্যান, যা ইলিশের ক্ষেত্রে মাথায় থাকে, কোনও কোনও মাছের ফ্যারিঞ্জিয়াল রিজিওনেও থাকে। এই অটোলিথ বিশ্লেষণ করে একটা মাছের মাইগ্রেটরি রুট সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়।
“আমরা এখন ইলিশের অটোলিথ কেটে দেখতে পাচ্ছি সেখানে বিভিন্ন রাসায়নিকের অনুপাত এমন যা থেকে স্পষ্ট অনেক ইলিশই আর সাগরে ফিরছে না। মিঠা জলে এগুলোর বেশ ওজনও হয়ে গেছে – পাঁচশো বা সাড়ে পাঁচশো গ্রাম – আবার ওদিকে ক্ষুদে সাইজের পাঁচ-দশ গ্রাম ওজনের ইলিশও মিলছে।”
আসলে সাগরে না-ফেরাটা এই ইলিশগুলোর এক ধরনের বেঁচে থাকার চেষ্টা বা ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ বলেই মনে করছেন ভারতের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ফিশারিজ এডুকেশনের মুখ্য বিজ্ঞানী বি কে মহাপাত্র।
“গলদা চিংড়ি হরিদ্বারেও দেখা যায়, সেখান থেকে ডিম পাড়তে তারা চলে আসে সুন্দরবনের মোহনাও। এই জাতীয় মাছকে বলে ক্যাটাড্রোমাস। কিন্তু ইলিশ হল অ্যানাড্রোমাস মাছ, তারা সাগর থেকে ডিম পাড়তে যায় নদীর ভেতর।”
“কিন্তু কেন এখন তারা আর ফিরতে চাইছে না? চাইছে না, কারণ গঙ্গার এসচুয়ারি জুড়ে বিছানো আছে চোদ্দ হাজারেরও বেশি জাল – তাই প্রাণে বাঁচতেই তারা রয়ে যাচ্ছে মিষ্টি জলে। এটাকে বিবর্তনবাদ বা ন্যাচারাল সিলেকশন হিসেবেই দেখা যায়,” বলছিলেন বি কে মহাপাত্র।
বহু বছর আগে গুজরাটে দেখা গিয়েছিল, তাপ্তী নদী বেয়ে ইলিশের ঝাঁক উকাই জলাধারে ঢুকে সেখানেই থাকতে শুরু করে, ডিম পাড়ে ও তাদের বাচ্চাও হয়।
এখন অনেকটা একই ধাঁচের জিনিস দেখা যাচ্ছে গঙ্গাতেও – জানাচ্ছেন অধ্যাপক অসীম কুমার নাথ।
“গঙ্গায় কাকদ্বীপের নিচে নিশ্চিন্দাপুরে যেখানে মিঠা পানি শুরু, সেখান থেকে ওপরে আপনি যদি দুশো কিলোমিটারেরও বেশি ওপরে বলাগড় অবধি যান, সেখানে ক্যালেন্ডার করে আমরা দেখতে পাচ্ছি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ-প্রাক মনসুন-মনসুন কিংবা পোস্ট-মনসুন … সারা বছরই কিন্তু এই পুরো এলাকা জুড়ে ইলিশ মিলছে।”
তবে অধ্যাপক নাথ সেই সঙ্গে বলছিলেন, বিশেষত বর্ষার পর কৃষিক্ষেতের কীটনাশক-যুক্ত জল যখন এসে নদীগুলোতে মেশে, তখন এই মিঠা পানির ইলিশগুলোর বিরাট ক্ষতিও হয়ে যাচ্ছে।
মিঠা জলের নদীতে পাকাপাকিভাবে থাকার জন্য এই ইলিশদের বেশি দূষণের শিকার হতে হচ্ছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তার পরেও স্বাদে-গন্ধে সেগুলো কিন্তু অন্য ইলিশের চেয়েও ভাল, বলছিলেন ড: মহাপাত্র।
তার কথায়, “মিঠা পানিতেই কিন্তু ইলিশের স্বাদ বাড়ে – কারণ নদীতে ঢোকার পরই তাদের শরীরে ফ্যাট বাড়ে, সেগুলো খেতেও অনেক ভাল হয়। গভীর সমুদ্রে ধরা ইলিশের স্বাদ কখনওই তেমন হয় না। ফলে এগুলোর স্বাদ নিয়ে কোনও সমস্যা নেই!”
ইলিশ কখনও সাগরে না সাঁতরালে তাকে আদৌ সত্যিকারের ইলিশ বলা যাবে কি না, তা নিয়ে অবশ্য মৎস্য বিজ্ঞানী আর খাদ্য-রসিকদের মধ্যে দু’রকম মত আছে।
কিন্তু ভারতীয় বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, বেশ কিছু ইলিশ আর কখনওই সাগরে ফেরার টান অনুভব করছে না – আর জেলেরা গঙ্গায় সেই ইলিশ পাচ্ছেন বছর জুড়েই!
বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে বেশ কয়েক প্রজাতির পরিচিত দেশীয় মাছ বাজার থেকে ‘প্রায় নেই’ হয়ে গেছে।
প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন বলছে, এর মধ্যে ‘প্রায় বিলুপ্ত’ হবার পথে বাঘাইর, পিপলা শোল বা বাক্কা মাছ, মহাশোল, নান্দিলা মাছ, চান্দা, ভাঙ্গান বাটা, খরকি মাছ, কালো পাবদা, চেনুয়া মাছসহ বেশ কিছু মাছ রয়েছে।
ময়মনসিংহে বাংলাদেশের একমাত্র মৎস্য জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক মোস্তফা আলী রেজা হোসেন জানিয়েছেন, এই মুহুর্তে দেশের ১১৮ প্রজাতির দেশীয় মাছ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
“আইইউসিএন বাংলাদেশের বিপন্ন প্রাণীর তালিকা করার জন্য দুটি জরিপ চালিয়েছিল, ২০০০ সালে প্রথম জরিপে ৫৪ প্রজাতির মাছ বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এরপর ২০১৫ সালে সর্বশেষ জরিপে তাতে আরো ৬৪ প্রজাতির মাছ যুক্ত হয়।”
“এই তালিকায় সেই সব মাছকেই চিহ্নিত করা হয়েছিল যেগুলো গত ১০ বা ২০ বছরে দেখা যায়নি।”
বিলুপ্ত মাছ নেই
বাংলাদেশে প্রায় বিলুপ্তির পথে ১০০র বেশি দেশীয় মাছ থাকলেও এখনো কোন মাছকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়নি।
আইইউসিএনের এ সংক্রান্ত নিয়মটি হচ্ছে, সর্বশেষ কোন একটি প্রজাতির মাছের দেখা পাবার পর পরবর্তী ২৫ বছরে যদি সেই প্রজাতির অস্তিত্বের কোন প্রমাণ না পাওয়া যায়, তাহলে সেটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
মৎস্য জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক হোসেন বলছিলেন, ময়মনসিংহ অঞ্চলে নান্দিল নামে এক সময় একটি মাছ দেখা যেত, কিন্তু গত ২০ বছরে সেটির অস্তিত্বের কোন প্রমাণ দেখা যায়নি।
আবার সিলেট অঞ্চলের পিপলা শোল নামে একটি মাছ দেখা যেত, যা এখন আর দেখা যায় না। গত ১০ বছরে দেখা যায়নি এই মাছ।
“দেখা যায়নি, কিন্তু তবু বিলুপ্ত ঘোষণা করার আগে আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।”
“যদি এর মধ্যে বিপন্ন মাছেদের অস্তিত্বের ব্যপারে কোন তথ্য না পাওয়া যায়, তাহলে হয়ত আইইউসিএনের পরবর্তী জরিপে এগুলোর ব্যপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা থাকতে পারে।”
প্রায় বিলুপ্ত কোন কোন প্রজাতি?
আইইউসিএনের ২০১৫ সালের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী কয়েকটি শ্রেণীতে মোট ৬৪ প্রজাতির মাছকে রেড লিস্ট বা লাল তালিকাভুক্ত করেছে, এর মানে হচ্ছে এসব প্রজাতির মাছ হয় প্রায় বিলুপ্ত, মহাবিপন্ন ও বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘আপডেটিং স্পেসিস রেড লিস্ট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রকল্পের অধীনে এই তালিকা করা হয়।
এ সংক্রান্ত প্রথম জরিপটি হয়েছিল ২০০০ সালে, সে সময় ৫৪টি প্রজাতিকে রেড লিস্টভুক্ত করা হয়েছিল।
জরিপে মূলত স্বাদু পানির এবং আধা লোনা পানির মাছকেই গণনায় ধরা হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ঐ ‘রেড লিস্ট’ তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন।
কী কী মাছ এখন আর তেমন দেখা যায় না?
বাংলাদেশে দেশীয় মাছের প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৩০০।
এর মধ্যে ২০১৫ সালে আইইউসিএন এর সর্বশেষ মূল্যায়নে ২৫৩ প্রজাতির মাছের ওপর জরিপ চালানো হয়েছিল।
তাতে দেখা গেছে সময়ের বিবর্তনে যেসব মাছ বিলুপ্তপ্রায় তার বেশির ভাগই নদীর মাছ মানে স্বাদু পানির মাছ।
তবে, ৩০০ প্রজাতির মাছের মধ্যে অন্তত ৪০ প্রজাতির মাছের ব্যাপারে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোন সংস্থার কাছে হালনাগাদ কোন তথ্য নেই।
আইইউসিএন কয়েকটি ভাগে মাছের অবস্থা ব্যাখ্যা করেছিল।
এর মধ্যে কিছু মাছ ক্রিটিক্যালি এনডেঞ্জারড বা প্রায় বিলুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ এগুলো সন্ধান ও সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে সেগুলো অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
এর বাইরে মহা বিপন্ন, বিপন্ন এবং সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে বহু প্রজাতি।
বাংলাদেশে বিপন্ন মাছের মধ্যে রয়েছে—পাঙ্গাস, দারি, ককসা, টিলা বা হিরালু, টিলা ককসা, রানি বা বউ মাছ, বেতাঙ্গি, বেটি বা পুতুল মাছ, কালা বাটা, ঘর পোয়া, ঘর পইয়া, ঘোড়া মাছ, এলানগা, কচুয়া পুটি, বোল, চিতল, গজার, টেংরা, রিটা, গাঙ্গিনা বা চাকা মাছ, বট শিং, ঘাউড়া, সাল বাইম।
এছাড়া সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে বাও বাইম, চাপিলা, গুতুম, পুঁইয়া, পিয়াসি, জারুয়া বা উট্টি, ছেপ চেলা, গোফি চেলা, বাটা মাছ, নারু মাছ বা গনিয়া, কাচকি, ফলি, শিল বাইলা, বেলে, শিং, আইড়, বোয়াল, তেলি, কুইচ্চা মাছ, বামোস মাছ।
কেন এই অবস্থা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কানিজ ফাতেমা বলছেন, মাছের প্রজাতি হারিয়ে যাওয়া বা কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে তিনি প্রথমেই জলাশয় কমে যাওয়াকে দায়ী করেন।
“শহর ও গ্রাম দুইখানেই নদী-খালসহ সব ধরণের জলাশয়ের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ কমার সঙ্গে দিনে দিনে কমছে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছের পরিমাণও।”
“কেবল দেশী জাত ও স্বাদের মাছই নয়, এর সঙ্গে কচ্ছপসহ নানা ধরণের জলজ প্রাণী ও সরীসৃপের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।”
সেই সঙ্গে রয়েছে জমিতে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি, যা বৃষ্টিতে ধুয়ে খাল বিলসহ জলাশয়গুলোতে পড়ে।
এর ফলে মাছের মৃত্যু ও প্রজনন হার মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। আছে কলকারখানার বর্জ্য নিকটস্থ জলাশয়ে ফেলা হয়, তার ফলেও মাছ মরে যায়, বলেন মিজ ফাতেমা।
এর সঙ্গে অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন-সক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, কারেন্ট জালের ব্যবহার এবং মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করাকেও কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে, বাংলাদেশ মৎস্য জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক হোসেন জানিয়েছেন, বিদেশী মাছের চাষের কারণেও দেশী প্রজাতির মাছ কমে গেছে।
“ধরুন এখানে তেলাপিয়া, কার্পজাতীয় মাছ আনা হয়েছে, আবার এক সময় আফ্রিকান মাগুর আনা হয়েছিল। কয়েক বছর আগে আনা হলো পিরানহা–এগুলো দেশী মাছের খাবার ও বাসস্থল দখল করতো। অনেক সময় দেশী মাছ খেয়ে ফেলতো কোন কোন বিদেশী প্রজাতি।”
যদিও পরে আফ্রিকান মাগুরের চাষ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু তারপরেও বিদেশী মাছের প্রজাতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে অনেক মাছ কমে গেছে।
কৃত্রিম প্রজনন ও চাষ কি সমাধান?
বাংলাদেশে দেশীয় অনেক প্রজাতির মাছের হার কমে যাবার প্রেক্ষাপটে গত দুই দশকে কৃত্রিম প্রজনন ও চাষের মাধ্যমে মাছের সরবারহ বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর সাড়ে ৪২ লাখ মেট্রিক টনের বেশি মাছ উৎপন্ন হচ্ছে।
এর মধ্যে নদী, বিল ও হাওরসহ উন্মুক্ত জলাশয় থেকে ২৫ শতাংশ, পুকুর, ডোবার মত বদ্ধ জলাশয় থেকে ৫৭ শতাংশ এবং বাকি অংশ সমুদ্র থেকে উৎপাদিত হচ্ছে।
দেশে ৮ লাখ হেক্টর বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ হয়।
বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিসের কর্মকর্তা বলরাম মহালদার জানিয়েছেন, কৃত্রিম প্রজনন ও চাষের মাধ্যমে বাজারে চাহিদা আছে এমন মাছই বেড়েছে।
“কিন্তু বাজারে চাহিদা কম এমন মাছ তো চাষ করছে না কেউ, ফলে সেগুলোর অস্তিত্ব সংকট আগের মতই থাকছে। যেমন খলিশা, চাপিলা, মেনি, ফলি, বাও বাইম, গুতুম, কুইচ্চা মাছ, বামোস ইত্যাদি ধরণের মাছ দেখতে পাবেন না।”
“এখন বাজারে পাবদা বা গুলশা মাছ বা পাঙ্গাস পাবেন আপনি, সেগুলোর চাহিদা আছে। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক না হলে, বিপন্ন মাছের ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।”
তবে ফসলি জমি নষ্ট করে দেশে মাছ চাষ করা নিয়ে পরিবেশবাদীদের এক ধরণের বিরোধিতাও রয়েছে।
তাদের পরামর্শ বিদ্যমান নদী ও পুকুরগুলোতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়াতে হবে।
তবে, সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই মনে করেন যদিও এখন কৈ, শিং, পাবদা, মাগুর, সর পুটি, চিতলসহ বেশ কয়েকটি প্রজাতির মাছ সহজলভ্য হয়েছে, কিন্তু সেই সব মাছের স্বাদ আগের মত নয়।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন