বিশ্ব
যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন ২০২০: গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুতে ট্রাম্প ও বাইডেনের অবস্থান কী
লেখক
বিবিসি বাংলাতেসরা নভেম্বর আমেরিকায় ভোটাররা সিদ্ধান্ত নেবেন আগামী চার বছর হোয়াইট হাউজে তারা কাকে দেখতে চান। তারা কি চান ডোনাল্ড ট্রাম্প আরো চার বছরের জন্যে ক্ষমতায় থাকুক নাকি সেখানে তারা নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনকে বসাতে চান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আমেরিকার ইতিহাসে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে অনেক ব্যতিক্রম এবং প্রার্থীদের জন্য অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।
আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ, আন্তর্জাতিক পটপরিবর্তন, তার সাথে দেশটিতে করোনাভাইরাস মহামারির মারাত্মক প্রকোপের কারণে বদলে গেছে অনেক হিসেব নিকাশ।
নভেম্বরের নির্বাচনে যেসব বিষয়ের ওপর বিচার বিশ্লেষণ করে ভোটাররা তাদের রায় দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে করোনাভাইরাস, চাকরি-বাকরি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, পররাষ্ট্র নীতি, অভিবাসন ইত্যাদি।
করোনাভাইরাস:
ডোনাল্ড ট্রাম্প: সারা বিশ্বের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। দেশটিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃত্যুও হয়েছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের।
মি. ট্রাম্প শুরু থেকেই করোনাভাইরাসের হুমকিকে খাটো করে দেখিয়েছেন। ভাইরাসটিকে তিনি খুব একটা গুরুত্ব দেননি। এমনকি মহামারি মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগের ব্যাপারেও তিনি বারবার বাধা দিয়েছেন। বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের সমালোচনাতেও তিনি কখনও কখনও মুখর হয়েছেন।
জানুয়ারি মাসে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও গোয়েন্দাদের সতর্কতা সত্ত্বেও তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তু মার্চ মাসের পর থেকে ধীরে ধরে তার অবস্থানের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে।
তখন থেকে মহামারি মোকাবেলায় জাতীয়ভাবে কিছু তৎপরতা শুরু হয়। বিভিন্ন রাজ্যের সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া হয় পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য।
জো বাইডেন: তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তার প্রথম কাজই হবে মহামারি মোকাবেলা করা।
এজন্য তিনি একটি জাতীয় পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন। ফ্রি নমুনা পরীক্ষা, টেস্ট সহজলভ্য করা, কন্টাক্ট ট্রেসিং-এর জন্য এক লাখ কর্মী মোতায়েন, চিকিৎসা- এসবের জন্য সর্বোচ্চ খরচের ব্যাপারেও তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রত্যেক রাজ্যের গভর্নরকে তার এলাকার লোকজনের মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার বিষয়েও জোর দিয়েছেন তিনি।
ভবিষ্যতের যে কোন মহামারি মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিয়ে রাখার কথাও বলেছেন জো বাইডেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নির্বাচিত হলে এই সঙ্কট মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি বিশ্ব নেতৃত্বের অবস্থানে নিয়ে আসবেন। তার প্রশাসন আবারও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যোগ দিয়ে মহামারি মোকাবেলায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা গ্রহণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি
ডোনাল্ড ট্রাম্প: করোনাভাইরাসের কারণে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা মি. ট্রাম্পের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি।
‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা সবকিছুতে আমেরিকা অগ্রাধিকার পাবে এই নীতির পক্ষে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণা দীর্ঘ দিনের। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি কর্মসংস্থান সৃষ্টিরও চেষ্টা করেছেন।
আগের বারের নির্বাচনী প্রচারণায় মি. ট্রাম্প কর্মজীবী আমেরিকানদের কর হ্রাসের অঙ্গীকার করেছিলেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কর্পোরেট ট্যাক্স কমানোর। একই সাথে তিনি কল কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির ওপরেও জোর দিয়েছিলেন।
এসব প্রতিশ্রুতির কিছু কিছু তিনি পূরণও করেছেন। গত চার বছরে বাণিজ্য সংক্রান্ত আইন কানুনে পরিবর্তন এনেছেন, কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত আয়কর হ্রাস করেছেন এবং দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিয়ে নির্বাহী আদেশও জারি করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের পর থেকে চার লাখ ৮০ হাজারেরও বেশি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, এই খাতে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে এবং মি. ট্রাম্পের নীতির কারণে তেমন মৌলিক কোন পরিবর্তন ঘটেনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন মহামারি শেষ হওয়ার সাথে সাথে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। যদিও সমালোচকরা বলছেন, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় তার গৃহীত পদক্ষেপের কারণে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতি আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জো বাইডেন: করোনাভাইরাসের তাৎক্ষণিক ধাক্কা সামাল দিতে যতো অর্থের প্রয়োজন ততো অর্থ খরচ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মি. বাইডেন। এসবের মধ্যে রয়েছে ছোট খাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া এবং পরিবারগুলোকে নগদ অর্থ সাহায্য প্রদান।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সামাজিক নিরাপত্তা হিসেবে প্রতি মাসে তিনি আরো ২০০ ডলার করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রস্তাব করেছেন, শিক্ষার্থীদের ১০,০০০ ডলার ঋণ মওকুফের।
তার অর্থনৈতিক নীতিমালার স্লোগান হচ্ছে: বিল্ড ব্যাক বেটার। এর মাধ্যমে মূলত তিনি তরুণ-তরুণী ও শ্রমজীবী ভোটারদের আকৃষ্ট করতে চাইছেন।
তিনি ন্যূনতম মজুরি ঘণ্টায় ১৫ ডলারে উন্নীত করতে চান। তরুণদের কাছে এই প্রচারণা খুবই জনপ্রিয়। আর একারণে এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের প্রচারণায় এটিকে অন্যতম ইস্যু বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
এছাড়াও পরিবেশ-বান্ধব জ্বালানীর পেছনে দুই ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কথা বলেছেন তিনি।
আমেরিকান পণ্য ক্রয়ের জন্যেও তিনি ৪০০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন। এসংক্রান্ত একটি আইনের (আমেরিকান পণ্য ক্রয় করুন বা ‘বাই আমেরিকান’) কথাও বলছেন।
উত্তর আমেরিকা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নাফটাকে সমর্থন দেয়ায় এর আগে জো বাইডেনের সমালোচনা হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, এই চুক্তির ফলে দেশের চাকরি-বাকরি বিদেশে চলে গেছে।
মি. বাইডেনের পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পণ্য, সেবা, গবেষণা ও প্রযুক্তির পেছনে ৩০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাণিজ্য
ডোনাল্ড ট্রাম্প: চীনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের পণ্য টিকিয়ে রাখা ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরো একটি নির্বাচনী স্লোগান।
তার কথা হলো, নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে। তার পর অন্য কিছু। তিনি বলেন, ‘আমেরিকা প্রথম’ এই কথার অর্থ এই নয় যে ‘আমেরিকা একা।’
বাণিজ্য ইস্যুতে মি. ট্রাম্প চীনের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। বিদেশি প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের পণ্যকে রক্ষা করতে তিনি কিছু নীতিমালাও গ্রহণ করেছেন।
প্রথম মেয়াদে তিনি পুরনো কিছু বাণিজ্য চুক্তির ব্যাপারে নতুন করে সমঝোতার ওপর জোর দিয়েছেন। তার মতে, এসব চুক্তি ভারসাম্যপূর্ণ নয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডা ও মেক্সিকোর মধ্যে নাফটা বা উত্তর আমেরিকা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। তাই তিনি এই সমঝোতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। সরিয়ে নিয়েছেন ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশীপ বা টিপিপি থেকেও।
আগের নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি বাণিজ্য ঘাটতি (আমদানি ও রপ্তানির ব্যবধান) দূর করার ব্যাপারেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। গত ছয় বছরের মধ্যে এই ঘাটতি ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো হ্রাসও পেয়েছে। তবে এর ফলে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে অর্থনীতিবিদরা সেটা মানতে রাজি নন।
চীন থেকে কারখানা সরিয়ে আনার ব্যাপারে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করতে অগাস্ট মাসে তিনি ট্যাক্স ক্রেডিট দেয়ার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছেন, “এর মাধ্যমে চীনের ওপর আমাদের নির্ভরতার অবসান ঘটবে।”
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপরেও কর বসিয়েছেন মি. ট্রাম্প। এসবের মধ্যে রয়েছে ইস্পাত থেকে শুরু করে ফরাসী ওয়াইন। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানির ওপর কর আরোপেরও হুমকি দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি তিনি কানাডা থেকে অ্যালুমিনিয়াম পণ্য আমদানির ওপরেও নতুন করে কর আরোপ করেছেন।
জো বাইডেন: বাণিজ্যের ব্যাপারে মি. বাইডেন এক জটিল ও অনিশ্চিত অবস্থানে আছেন।
চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধের জন্য একদিকে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আক্রমণ করছেন আবার অন্যদিকে ডেমোক্র্যাট এই প্রার্থী চীনের ব্যাপারে নমনীয় ভূমিকাও দেখাতে চান না।
তিনি যে খুব বেশি মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে তাও প্রকাশ করতে চান না। আর এসব কারণেই তিনি ‘যুক্তরাষ্ট্রপন্থী এক বাণিজ্য কৌশলের’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
পররাষ্ট্র নীতি
ডোনাল্ড ট্রাম্প: শুধু বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই নয়, পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থান ‘আমেরিকা ফার্স্ট।’
হোয়াইট হাউজ এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেয় এভাবে: যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব পুন-প্রতিষ্ঠা এবং প্রত্যেকটি দেশের যার যার ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার। বিশেষ করে নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি। কিন্তু বাস্তবে কি এর অর্থ এরকমই?
বাস্তবে যা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্যারিস চুক্তি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেয়া।
ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকেও ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছেন।
এছাড়াও তিনি প্রতিরক্ষা জোট নেটোর মতো আন্তর্জাতিক কিছু জোট নিয়েও প্রশ্ন তুলে বলেছেন, এর সদস্য দেশগুলোকে আরো বেশি অর্থ দিতে হবে।
বিদেশে মোতায়েন মার্কিন সৈন্য সংখ্যা কমিয়ে আনারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
তার সমালোচকরা বলছেন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে গিয়ে মি. ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছেন।
পররাষ্ট্র নীতির বিষয়ে তার কিছু সাফল্যও আছে। সম্প্রতি ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরিতে তিনি সহায়তা করেছেন।
ইসলামিক স্টেটের নেতা আবু বকর আল-বাগদাদি এবং ইরানের সামরিক কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার ব্যাপারেও তার ভূমিকা উল্লেখ করার মতো।
জো বাইডেন: মি. বাইডেন বলেছেন, নির্বাচিত হলে তিনি জাতীয় ইস্যুকে অগ্রাধিকার দেবেন। তিনি বলেছেন, তার কোন পররাষ্ট্র নীতি নেই কিন্তু বিশ্বে আমেরিকার নেতৃত্ব পুন-প্রতিষ্ঠা করার জন্য তার একটি পরিকল্পনা আছে।
তার এই বক্তব্য থেকে এটা বলা যাবে না যে মি. বাইডেনের পররাষ্ট্র নীতি বিশ্ব পর্যায়ে ‘বহু দেশের অংশগ্রহণের নীতি’ থেকে দূরে সরে গেছে। কিন্তু মি. ট্রাম্পের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার পক্ষে। মি. বাইডেন বলেছেন, তার কাজ হবে এই বিচ্ছিন্নতা দূর করে আবারও আন্তর্জাতিক চুক্তি, পরিকল্পনা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রশক্তির সাথে সম্পর্ক মেরামতের কথাও বলেছেন জো বাইডেন। বিশেষ করে প্রতিরক্ষা জোট নেটোর সঙ্গে।
সাবেক এই ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেছেন, বাণিজ্যে ভারসাম্যহীন পরিবেশের জন্যে চীনকে জবাবদিহি করতে হবে। তবে তিনি বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে মিলে একটি আন্তর্জাতিক জোট করার কথা বলেছেন যা চীন উপেক্ষা করতে পারবে না।
তবে তার এই প্রস্তাবের অর্থ কী সেটা খুবই অস্পষ্ট।
অভিবাসন
ডোনাল্ড ট্রাম্প: মি. ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অন্যতম একটি ভিত্তি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন কমিয়ে আনা।
এবারও তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, পুন-নির্বাচিত হলে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের কাজ অব্যাহত থাকবে। এখনও পর্যন্ত তিনি ৭২২ মাইল সীমান্তের মধ্যে ৪৪৫ মাইল প্রাচীর নির্মাণের অর্থ সংস্থান করতে পেরেছেন।
এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বসবাসরত অভিবাসীদের পরিবারের সদস্যদেরকে তাদের নিজেদের দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসার নীতির অবসান ঘটানোরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
মি. ট্রাম্প লটারি ভিসা পদ্ধতি বাতিল করে যোগ্যতার ভিত্তিতে ভিসা ব্যবস্থা চালু করার কথা বলেছেন।
অভিবাসন নীতি সংস্কারে তার পরিকল্পনা সম্প্রতি বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চেয়েছিলেন এরকম একটি আইন বাতিল করতে যাতে শিশু বয়সে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে আসা সাড়ে ছয় লাখ লোককে আশ্রয় দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট ট্রাম্প প্রশাসনের ওই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে।
জো বাইডেন: মি. বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে নির্বাচিত হলে ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসন সংক্রান্ত অনেক সিদ্ধান্ত, যেগুলো তিনি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জারি করেছিলেন, সেগুলো বাতিল করে দেবেন।
তার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর সীমান্তে শিশুদেরকে তাদের পিতামাতার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার নীতি। যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় চেয়ে আবেদনের সংখ্যার ওপর মি. ট্রাম্প যে সীমা বেঁধে দিয়েছেন সেটাও বাতিল করার কথা বলছেন তিনি। বলেছেন, বেশ কয়েকটি মুসলিমপ্রধান দেশ থেকে লোকজনের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার কথাও।
এছাড়াও সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে শিশু বয়সে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে আসা যেসব লোকজনকে থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছিল তাদেরকেও রক্ষার কথা বলেছেন তিনি।
স্বাস্থ্য
ডোনাল্ড ট্রাম্প: সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার গৃহীত এক স্বাস্থ্য সেবা ‘অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট’ যা ওবামা কেয়ার নামে পরিচিত সেটা বাতিল করার জন্য ২০১৬ সালে প্রচারণা চালিয়েছেন মি. ট্রাম্প।
পুরোপুরি বাতিল করতে ব্যর্থ হলেও ট্রাম্প প্রশাসন এর কিছু কিছু অংশ প্রত্যাহার করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধের দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। জুলাই মাসে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন যার ফলে বিদেশ থেকে কম মূল্যে ওষুধ আমদানি করা যাবে। তবে কোন কোন বিশ্লেষক বলছেন যে বাজারে এর তেমন একটা প্রভাব পড়বে না।
মি. ট্রাম্প অপিওয়েড ড্রাগ সমস্যাকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য খাতে জরুরি অবস্থা বলে ঘোষণা করেছিলেন ২০১৭ সালে। এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে তিনি প্রায় দুশো কোটি ডলারের এক অর্থ তহবিলেরও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রোগের চিকিৎসায় অপিওয়েডকে প্রেসক্রাইব করা বন্ধ করতেও তিনি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন।
কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, ওবামা কেয়ার বাতিল করে দেয়া হলে এই ড্রাগ সমস্যা মোকাবেলা আরো কঠিন হয়ে পড়বে।
জো বাইডেন: মি. বাইডেন বলেছেন, ক্ষমতায় এলে তিনি স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প সম্প্রসারণ করবেন। প্রেসিডেন্ট ওবামার আমলে তিনি যখন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন এই প্রকল্পটি গৃহীত হয়েছিল।
সকল আমেরিকানের ৯৭%কে এই ইনস্যুরেন্সের আওতায় নিয়ে আসারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
সবার জন্য তিনি মেডিকেয়ারের মতো স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলেছেন যাতে বয়স্ক মানুষের জন্য স্বাস্থ্য সেবার কথা বলা হয়েছে।
একটি গবেষণা গ্রুপ বলছে, এজন্য আগামী ১০ বছরে মি. বাইডেনের খরচ হতে পারে সোয়া দুই ট্রিলিয়ন ডলার।
জলবায়ু পরিবর্তন
ডোনাল্ড ট্রাম্প: ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে মি. ট্রাম্প পরিবেশ রক্ষাকারী বেশ কিছু বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে জ্বালানী কেন্দ্র ও যানবাহনের কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের সীমা। আগের বারের নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি এসবের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
একই সঙ্গে তিনি জলবায়ু পরিবর্তন রোধে করা আন্তর্জাতিক প্যারিস চুক্তি থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তার যুক্তি হলো এই চুক্তি থেকে তার দেশ লাভবান হচ্ছে না, বরং অন্য দেশগুলো এথেকে সুবিধা নিচ্ছে।
তবে এই চুক্তি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরে আসার কাজ সম্পন্ন হবে নভেম্বরের নির্বাচনের পর।
অতি সম্প্রতি তিনি আলাস্কা আর্কটিক ন্যাশনাল ওয়াইল্ড-লাইফ রিফিউজে তেল ও গ্যাসের জন্যে ড্রিলিং-এর অনুমোদন দিয়েছেন। কিন্তু পরিবেশের কথা বিবেচনা করে সেখানে এতদিন ড্রিলিং নিষিদ্ধ ছিলো।
জো বাইডেন: জলবায়ুর পরিবর্তনকে অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে উল্লেখ করেছেন জো বাইডেন। তিনি বলেছেন, কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমিয়ে আনার জন্য তিনি সারা বিশ্বকে সাথে নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন।
তার প্রথম কাজ হবে প্যারিস চুক্তিতে পুনরায় যোগ দেওয়া। এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা ২০২৫ সালের মধ্যে ২০০৫ সালের তুলনায় ২৮% কমিয়ে আনার অঙ্গীকার করা হয়েছে।
পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তির গবেষণায় তিনি প্রায় পৌনে দুই ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছেন।
তিনি চান ২০৫০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন শূন্যের মাত্রায় নামিয়ে আনতে। ২০১৯ সালে ৬০টিরও বেশি দেশের মধ্যে হওয়া এক সমঝোতায় এই অঙ্গীকার করা হয়েছিল।
পরিবেশ দূষণকারী আরো দুটো বৃহৎ দেশ চীন এবং ভারত এখনও এই সমঝোতার পক্ষে সায় দেয়নি।
বর্ণবাদ ও ফৌজদারি বিচার
ডোনাল্ড ট্রাম্প: ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়ায় সংস্কারের কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন মি. ট্রাম্প যাতে বিচারকদের বাড়তি কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
আগের নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি আইন প্রয়োগের ওপর জোর দিয়েছিলেন। ক্ষমতায় থাকা কালেও তিনি একই অবস্থানে ছিলেন। সম্প্রতি পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর সারা দেশে বর্ণবাদবিরোধী ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন শুরু হলে পুলিশের পক্ষে তার সমর্থন আরো জোরালো হয়।
জুন মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে সই করেন যেখানে পুলিশ বাহিনীতে কিছু সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে পুলিশের হাতে নির্যাতনের ঘটনার তথ্যভাণ্ডার বা ডেটাবেইজ তৈরি করা।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, সন্দেহভাজন কোন অপরাধীকে থামাতে তার গলা চেপে ধরা (যা চোকহোল্ড নামে পরিচিত) বন্ধ করতে হবে। তবে তিনি এর ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন নি।
জো বাইডেন: পুলিশের নির্যাতনে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর সারা দেশে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মুখে মি. বাইডেন বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ আছে এবং বৃহৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের সমর্থন দেয়ার মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে।
তার বিল্ড ব্যাক প্রোগ্রামের একটি বিষয় হচ্ছে ৩,০০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের জন্যে ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করা।
ফৌজদারি অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে তিনি তার আগের কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। ৯০-এর দশকে তার কথা ছিলো অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে।
কিন্তু এখন তিনি বর্ণবাদ, লিঙ্গ, আয় বৈষম্য, কারাগারে বন্দী থাকা এসব কমিয়ে আনা ও বন্দীদের মুক্তির পর তাদের পুনর্বাসনের জন্য বিচার ব্যবস্থায় কিছু নীতিমালা গ্রহণের প্রস্তাব করছেন।
মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিল করার কথাও বলেছেন তিনি।
মি. বাইডেন বলেছেন, পুলিশের কাজের মান বজায় রাখতে হলে এই বাহিনীর পেছনে অর্থ বিনিয়োগের প্রয়োজন।
-
কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আন্দোলনও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
-
প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
-
ডোনাল্ড ট্রাম্প ওবামা কেয়ারের বিপক্ষে, পক্ষে জো বাইডেন।
-
হোয়াইট হাউজে কে বসবেন - সিদ্ধান্ত হবে ৩রা নভেম্বর।
-
অভিবাসন বিষয়ে দুই প্রার্থীর অবস্থানের অনেক তফাৎ।
-
জো বাইডেন বলছেন প্রেসিডেন্ট হলে তিনি বিশ্বে আমেরিকার নেতৃত্ব পুন-প্রতিষ্ঠা করবেন।
-
পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থান আমেরিকা ফার্স্ট।
-
চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধও নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
-
চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধও নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
-
জো বাইডেনের স্লোগান: বিল্ড ব্যাক বেটার।
-
ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা: আমেরিকা ফার্স্ট।
-
করোনাভাইরাস বদলে দিয়েছে নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ।
-
ট্রাম্প ও বাইডেন
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
নিরাপদ খাদ্য: দেশি মাছ কাকিলাকে যেভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা
-
জিংক সমৃদ্ধ পুষ্টি ধানের চাষে কৃষকদের জামানতবিহীন ঋণ দেবে কৃষি ব্যাংক, কী লাভ এই চাল উৎপাদন বাড়লে?
-
নিপাহ্ ভাইরাসঃ খেজুরের রস খাওয়ার আগে সতর্ক থাকতে যা করণীয়
-
বাংলাদেশে বাড়ছে ইলিশ, মিয়ানমারে কেন কমছে – দা এগ্রো নিউজ
-
ইলিশ কি মিঠা পানির মাছ হয়ে যাচ্ছে? – দা এগ্রো নিউজ
-
বাংলাদেশে ‘প্রায় বিলুপ্তি’র পথে ১০০-এর বেশি দেশীয় মাছ – দা এগ্রো নিউজ
-
বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের আবিস্কৃত ইলিশের ‘জীবন রহস্য’ কীভাবে এর উৎপাদন বাড়াবে
-
বাংলাদেশে গরুর দুধে অ্যান্টিবায়োটিক আসে কীভাবে – দা এগ্রো নিউজ
-
আপেল-স্ট্রবেরির দরকার নেই, বাঙালিরা পেয়ারা বা বরই খেলেও একই উপকার পাবেন
-
যুক্তরাষ্ট্রে এমন একটি আপেলের চাষ শুরু হয়েছে যা ‘এক বছর সতেজ থাকবে’
সবজি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। কৃষি বিজ্ঞানের ভাষায় সবজিকে উদ্যানতাত্বিক ফসল (Horticultural crops) বলা হয়ে থাকে। পুষ্টিমানের দিক থেকে সবজি ফসল যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বাণিজ্যিকভাবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। সেজন্য সবজি চাষের আধুনিক কলাকৌশল জানা জরুরি।
আর আধুনিক কলাকৌশল বলতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদকেই বোঝানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু সবজি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তবে সারাদেশে যেমন সব ধরনের সবজি উৎপাদিত হয়না ঠিক তেমনি সকল সবজিই আবার সারাবছর উৎপাদিত হয়না। একেক অঞ্চলে একেক ধরনের শাকসবজি উৎপাদিত হয়ে থাকে। আবার বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ বিশেষ সবজির জাত উৎপাদন করা যায়।
সারাদেশে সারাবছরই যেসকল সবজি সহজে উৎপাদিত হয়ে থাকে তাদের কিছু শাকসবজির কথা এখানে তুলে ধরছি। লালশাক, ডাটাশাক, পুইশাক, কলমিশাক, মিষ্টিআলু শাক, ঢেড়শ, গাজর, বরবটি, টমেটো, লাউ ও লাউশাক, পাটশাক, শশা, কাঁচকলা, বেগুন, পেপে, করলা, কচুশাক, কচুর লতি, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা ইত্যাদি পরিচিত শাকসবজি। তাছাড়া অপরিচিত বিশেষ কিছু সবজি বিশেষ বিশেষ এলাকার বিশেষত্ব হিসেবে উৎপাদিত হয়ে থাকে। উপরোক্ত ফসলগুলোর মধ্যে কিছু শুধু শাক আর বাকীগুলো শাক এবং সবজি উভয় হিসেবেই প্রচলিত রয়েছে।
কৃষিতাত্বিকভাবে রবি (শীতকাল) ও খরিপ (গ্রীষ্মকাল)- এ দুধরনের মৌসুম রয়েছে। খরিপের আবার দুটি ভাগ, যথা- খরিপ-১ (আগাম গ্রীষ্ম) এবং খরিপ-২ (বর্ষাকাল)। তবে শীতকালীন শাকসবজির মধ্যে বাহারি ও রকমারি বৈচিত্র একটু বেশি। শুধুমাত্র শীতকালে উৎপাদিত হয় এমন ফসলগুলোর মধ্যে রয়েছে- টমেটো, শীতলাউ, ফুলকপি, বাধাকপি, গাজর, সীম, মূলা, ব্রকলি, বাটিশাক, ওলকপি, শালগম, বেগুন, গোল আলু ইত্যাদিই প্রধান। অপরদিকে শুধুমাত্র গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে উৎপাদিত হয় এমন ফসলের মধ্যে রয়েছে- বিভিন্ন ধরনের কচু, ওলকচু, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, কাকরোল, পটোল, করলা, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া ইত্যাদিই প্রধান।
সবজি ফসল উৎপাদন অন্যান্য ফসলের মতো নয়। সবজি ফসল উৎপাদনের জন্য বিশেষ ধরনের যত্নের প্রয়োজন হয়। আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবাদ করতে গেলে অল্প পরিমাণ জায়গায় অধিক পরিমাণ ফসল ফলিয়ে লাভবান হওয়া সম্ভব। সবজি আবাদেও জন্য বাড়ির আঙ্গিনায় অথবা অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গা বেছে নিতে হবে। সেখানে ভালোভাবে চাষ-মই দিয়ে জমির মাটি জো অবস্থায় ঝুরঝুরে করে সেখানে এক মিটার প্রশস্ত এবং প্রয়োজনমত জমির আকার-আকৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে লম্বা বেড তৈরী করে নিতে হবে। প্রতিটি বেডের মাঝখানে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি পরিমাণ গর্ত করে নালা সৃষ্টি করতে হবে। অর্থাৎ নালার মাটি তুলেই দুইপাশে বেড প্রয়োজনমত উঁচু করতে হবে।
এভাবে বেড তৈরীর একটি বিশেষত্ব হলো শাকসবজি চাষাবাদ অন্য সাধারণ ফসল আবাদের চেয়ে একটু ভিন্ন। এর জন্য প্রয়োজন হয় বাড়তি সতর্কতা ও যত্নের। শাকসবজির চাষাবাদে যেমন শুষ্ক মৌসুমে সেচের চাহিদা থাকে অপরদিকে বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি বের করে দেওয়ার প্রয়োজন হয়। সেজন্যই বেড তৈরী করে মাটি কিছুটা উঁচু করা হয় সেখানে আবার নালা তৈরী করে নিষ্কাষনের ব্যবস্থাও রাখা হয়। কিন্তু বেড এবং নালা তৈরী না করলে সেটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবাদ হয়না। সেঠা হয় সাধারণ শাকসবজি চাষ। এতে ফলন অনেক কমে যায়।
পেপে, কাঁচকলা- এ জাতীয় সবজি বসতবাড়ির আঙ্গিনায়, রাস্তা বা পুকুরের ধারে সহজেই আবাদ করা যায়। লালশাক, ডাটা শাক, পাটশাক, মূলাশাক, গাজর, শালগম ইত্যাদি সবজি তৈরীকৃত বেডে ছিটিয়ে বীজ বুনে দিলেই ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাছাড়া টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, বাধাকপি, ঢেড়শ, কচু, ওলকচু ইত্যাদি সবজি এক মিটারের বেডে দুই সারি করে নির্ধারিত দূরত্বে চারা লাগিয়ে আবাদ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। সেজন্য এসব সবজি উৎপাদনের জন্য আলাদাভাবে নার্সারিতে চারা তৈরী করে নিতে হয়। অপরদিকে লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শশা, চাল কুমড়া, পটোল, কাকরোল, করলা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, সীম, বরবটি ইত্যাদি লতাজাতীয় সবজি চাষের জন্য উক্ত বেডে দুইটি সারি করে সেখানে জাংলা দিয়ে দিতে হয়। সাধারণত বেডের দুইপাশে খুটি দিয়ে পরে তা ইংরেজি অক্ষর ‘এক্স’ আকৃতিতে বা ‘ভি’ আকৃতিতে বাঁকিয়ে বেঁধে দিতে হয়।
বেড ছাড়াও লতাজাতীয় এসব সবজি অতি সহজেই ক্ষেতের আইলে, রাস্তার ধারে, পুকুরের পাড়ে বিশেষ ব্যবস্থায় আবাদ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে অন্যান্য যেকোন ফসলের তুলনায় এসব সবজি ফসলের একটু বেশি যত্নের প্রয়োজন হয়। বিনা আবাদেই এসব সবজি চাষ করা যেতে পারে। সেজন্য বন্যা পরবর্তীতে পুনর্বাসনের সময় বিনাচাষে এসব আবাদের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ জৈবভাবেই এসব সবজি ফসল উৎপাদন সম্ভব। আবাদের পূর্বে সামান্য পরিমাণ প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার ব্যবহার করে বাকীটা মেটাতে হবে বাড়িতে উৎপাদিত জৈব সারের মাধ্যমে। তারপর আন্তপরিচর্যা এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতেও জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। তখন এসব উৎপাদিত ফসল সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
কাজেই এভাবেই সারাবছর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বষ্পপরিসরে শাকসবজি উৎপাদন করে নিজের চাহিদা মিটিয়ে তা বাণিজ্যিকভাবেও লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমাদের শারীরিক পুষ্টি চাহিদার একটি বিরাট অংশ শাকসবজি থেকে আসা দরকার। দৈনিক একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের গড়ে কমপক্ষে আড়াইশ গ্রাম শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। আর সেটা নিবিড়ভাবে এবং নিরাপদভাবে খেতে হলে নিজের উৎপাদিত শাকসবজি খাওয়াই সবচেয়ে উত্তম। কাজেই আমাদের সারাবছর অলস সময়টাকে কাজে লাগিয়ে আসুন নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় সবজির বাগান গড়ে তুলি।
একজন টেলিভিশন তারকা, কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের জন্মদিন আজ। তিনি ১৯৫৪ সালের এদিনে জন্মগ্রহণ করেন চাঁদপুরে (সার্টিফিকেট অনুযায়ী তার জন্মতারিখ ২৮শে জুন ১৯৫৬)। শাইখ সিরাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ভূগোলে। ছাত্রজীবনেই সম্পৃক্ত হন বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতার ও সংবাদপত্রের সঙ্গে।
শাইখ সিরাজ ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড, চ্যানেল আই-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও বার্তা প্রধান। টানা সাড়ে চার দশক ধরে তিনি গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে দেশের কৃষি ও কৃষক তথা উৎপাদন-অর্থনৈতিক খাতে অপরিসীম ভূমিকা রেখে চলেছেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সকল শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে বিপুল গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেন তিনি। পরে তার নিজস্ব পরিচালনাধীন টেলিভিশন ‘চ্যানেল আই’তে শুরু করেন কৃষি কার্যক্রম হৃদয়ে মাটি ও মানুষ। উন্নয়ন সাংবাদিকতার জন্য তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দু’টি রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৮) ও একুশে পদক (১৯৯৫) লাভ করেন।
টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রায় চার দশকের একনিষ্ঠ পথচলার মধ্য দিয়ে শাইখ সিরাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন উন্নয়ন সাংবাদিকতার এক অগ্রপথিক হিসাবে। গণমাধ্যমে তার উদ্বুদ্ধকরণ প্রচারণায় আমূল পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশের কৃষিতে। বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে বৈপ্লবিক সাফল্য।
গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। একইসঙ্গে শহর-নগরের মানুষকে করেছেন কৃষিমুখি। ফলে দেশের অর্থনীতিতে কৃষির বহুমুখি অবদান সূচিত হয়েছে।
‘মাটি ও মানুষ’
বাংলাদেশের কৃষিতে গত কয়েক দশকে যে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে, শাইখ সিরাজকে বর্ণনা করা হয় সেই পরিবর্তনের পেছনে অন্যতম প্রধান এক চরিত্র হিসেবে।
বাংলাদেশে যখন বিজ্ঞানীরা একের পর এক নতুন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করে চলেছেন, কৃষিতে নতুন ধ্যান ধারণা এবং কৌশল চালুর জন্য সরকারের নানা পর্যায় থেকে চেষ্টা চলছে, সেগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে বিরাট ভূমিকা রাখে তার কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান, ‘মাটি ও মানুষ।’
“শুরুতে এই অনুষ্ঠানটা হতো আমার দেশ নামে। তখন এটি ৫০ মিনিটের পাক্ষিক অনুষ্ঠান। পরে এটিকেই ‘মাটি ও মানুষ’ নামে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করি। আমার মনে হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের চেয়ে বেশি দরকার শিক্ষামূলক মোটিভেশনাল অনুষ্ঠান। কৃষকদের যদি নতুন বীজ, নতুন প্রযুক্তি, নতুন কৌশল, এসব ঠিকমত বোঝানো যায়, তাহলে কৃষিতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব।”
গত চার দশক ধরে শাইখ সিরাজ হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে কৃষি বিষয়ক তথ্যের প্রধান উৎস। উনিশ’শ আশির দশকে, যখনো টেলিভিশন ঘরে ঘরে পৌঁছায়নি, তখনো গ্রামের হাটেবাজারে, কমিউনিটি সেন্টারে প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় ‘মাটি ও মানুষ’ দেখার জন্য ভিড় করতো মানুষ।
তবে কৃষকদের নতুন ধরণের কৃষিতে উৎসাহিত করার কাজটা সহজ ছিল না।
“আজকের কৃষক এবং তিরিশ বছর আগের কৃষকের মধ্যে তফাৎ আকাশ আর পাতাল। তখন কৃষকের কাছে একজন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা যে কথা বলতেন, একজন টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে আমি যেকথা বলতাম, সেটা তারা মানতে চাইতো না। তারা ভাবতো, আমরা যেধরণের কৃষির কথা বলছি, যদি সেটাতে ভালো ফসল না হয়? এ কারণে সে সহজে মোটিভেট হতে চাইতো না। সহজে নতুন প্রযুক্তি নিতে চাইতো না।”
“আমি যখন আশির দশকে উচ্চফলনশীল নতুন জাতের ধানের কথা বলছি, গমের কথা বলছি, তখন পরিস্কার তারা আমাকে বলতো এই রাবার ভাত খাবো না। তখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধানের মান তেমন ভালো ছিল না। ভাতটা ছিল রাবারের মতো, ভাতের দানা উপর থেকে থালার উপর ফেললে সেটি রাবারের মতো ড্রপ করতো।”
কিন্তু বিজ্ঞানীরা যখন তাদের গবেষণায় নতুন নতুন সাফল্য পাচ্ছিলেন, আর সেই সঙ্গে শাইখ সিরাজও তার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকদের মন জয় করার জন্য নতুন কৌশল নিচ্ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অশোকা ফেলো শাইখ সিরাজ খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র বিমোচন বিষয়ে সাংবাদিকতায় অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসাবে তিনি ২০০৯ সালে অর্জন করেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এ এইচ বুর্মা এ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া তিনি পেয়েছেন এশিয়ার মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার গুসি পিস প্রাইজ, বৃটেনের বিসিএ গোল্ডেন জুবিলি অনার এ্যাওয়ার্ডস। বৃটিশ হাউজ অব কমন্স তাকে প্রদান করেছে বিশেষ সম্মাননা, বৃটিশ-বাংলাদেশ ব্যবসায়ী সংগঠন তাকে দিয়েছে গ্রীন এ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া পেয়েছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির স্বর্ণপদক, ডা. ইব্রাহিম মেমোরিয়াল স্বর্ণপদক, রণদা প্রসাদ সাহা স্বর্ণপদকসহ অর্ধশত দেশি-বিদেশি পুরস্কার ও সম্মাননা।
চ্যানেল আই ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখে থাকেন। তিনি এদেশে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে নিরস বিষয় হিসাবে উপেক্ষিত কৃষিতে জাতীয় সংবাদের প্রধান খবরের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শাইখ সিরাজের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- মৎস্য ম্যানুয়েল, মাটি ও মানুষের চাষবাস, ফার্মার্স ফাইল, মাটির কাছে মানুষের কাছে, বাংলাদেশের কৃষি: প্রেক্ষাপট ২০০৮, কৃষি ও গণমাধ্যম, কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট (সম্পাদিত), আমার স্বপ্নের কৃষি, কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট (২০১১), সমকালীন কৃষি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (২০১১), কৃষি ও উন্নয়ন চিন্তা (২০১৩) ইত্যাদি।
চলতি বোরো মৌসুমে সার কিনতে কৃষকদের সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা করে বেশি দিতে হয়েছে। আর সরকারকেও সার বাবদ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বাজেটে বরাদ্দের তিন গুণের বেশি—প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ এখন মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) সার আমদানি নিয়ে বিপাকে পড়েছে।
ধান, আলু ও সবজি চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এমওপি সারের ৬০ শতাংশ আনা হতো রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে। ওই দুই দেশ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ায় এখন বাংলাদেশকে এমওপি কিনতে হচ্ছে কানাডা থেকে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া ও আমদানিতে অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশে সারের সংকট হতে পারে। ভর্তুকির চাপ সামলাতে বাংলাদেশকে সব ধরনের সারের খুচরা মূল্য বাড়াতে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশে সার সরবরাহ ও ব্যবহারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এমওপি সারের ২০ শতাংশ সরবরাহ কমানো হলে সামনের বোরো মৌসুমে ধান, গম ও রবি মৌসুমের অন্যান্য ফসলের উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমতে পারে। এতে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
এমনিতেই এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সারের কারণে নতুন করে যাতে আর সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এ এম এম শওকত আলী, সাবেক কৃষিসচিব
তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, দেশে চলতি বোরো মৌসুমে নতুন করে আর সারের দরকার হবে না। সামনে আলুর মৌসুমে ইউরিয়া, এমওপিসহ অন্যান্য সারের চাহিদা বাড়বে। ওই সময়ের জন্য সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ কানাডা ও মধ্যপ্রাচ্যের সার সরবরাহকারী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।
জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কানাডা থেকে মোট আট লাখ টন এমওপি সার আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি। এ ব্যাপারে ওই দেশের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা স্মারক হয়েছে। ফলে এই সার নিয়ে সরকারের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। তবে সার বাবদ সরকারের বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি বাড়ছে। এই চাপ নিয়েও সরকার ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ওই ভর্তুকি দিয়ে যাবে।’
কমানো হয়েছে চাহিদা
বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে ৬৯ লাখ টন রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি—এই চার ধরনের সার ব্যবহার হয় ৫৭ লাখ টন। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের ওই চার ধরনের সারের চাহিদা কমিয়ে ৫৫ লাখ ৫০ হাজার টনে নামিয়ে আনা হয়েছে।
দেশে প্রয়োজনীয় সারের ৮০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে এমওপি সারের বড় অংশ আসে রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে।
প্রসঙ্গত, ওই চারটি প্রধান সার কৃষকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। চলতি অর্থবছরে সরকার প্রাথমিকভাবে সারে ভর্তুকি বাবদ ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে গত ছয় মাসে সারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বেশির ভাগ সারের দাম তিন থেকে চার গুণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারকে ভর্তুকির পরিমাণ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা করতে হয়। কিন্তু অর্থবছরের শেষের দিকে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে হিসাব করে দেখা হয়েছে, ভর্তুকির পরিমাণ এবার বেড়ে কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকা গিয়ে দাঁড়াবে।
জিপসাম, জিংক সালফেট ও অ্যামোনিয়াম সালফেট ও ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সারে সরকার কোনো ভর্তুকি দেয় না। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কিনে ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছে তা বিক্রি করে থাকেন। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষককেও বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে।
সাবেক কৃষিসচিব এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতেই এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সারের কারণে নতুন করে যাতে আর সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সরকারের অন্যান্য খাতের ভর্তুকি কমিয়ে প্রয়োজনে সারে ভর্তুকি বাড়াতে হবে, যাতে সারের দাম কম থাকে। কারণ, কৃষকের হাতে এখন টাকা কম। বিশ্ববাজার থেকেও খাদ্য আমদানি করা সামনের দিনে আরও কঠিন হতে পারে। ফলে দেশের উৎপাদন ঠিক রাখতে সারের দাম ও জোগান ঠিক রাখা উচিত।
এগ্রোটেক
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
লেখক
প্রথম আলোডাচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে দুই দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।
গতকাল সোমবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অনুষ্ঠিত কৃষি খাতের ব্যবসাবিষয়ক এক সম্মেলনে দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এগ্রি বিজনেস কনক্লেভে বাংলাদেশের প্রায় ৪০জন উদ্যোক্তা ডাচ কৃষি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি প্রযুক্তি সহযোগিতা ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছে ওয়েগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়।
আলোচনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তি কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি সহযোগিতা দিতে রাজি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে ডাচরা প্রস্তুত এবং বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও তাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া ডাচ সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বীজ, পশু খাদ্য, পোলট্রি, হর্টিকালচার ও এ্যাকুয়াকালচার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করেছে, যা ওই দেশের বেসরকারি খাতকে আরও উৎসাহিত করেছে।
আলোচনায় কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তৈরি আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্কয়ার, ইস্পাহানি এগ্রো, একে খান অ্যান্ড কোম্পানি, প্যারাগন গ্রুপ, এসিআই, জেমকন গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ডাচ প্রযুক্তির প্রয়োগ সরেজমিনে দেখতে যাবেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের পোল্ট্রিখাতে সহযোগিতার আলোচনা অনেকটা এগিয়েছে উল্লেখ করে মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দুই দেশের মধ্যে মৎস্য, পশুপালন ও হর্টিকালচারে সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা আছে।
কনক্লেভ আয়োজনে প্রথমবারের মতো দূতাবাসের সঙ্গে অংশীদার হয়েছে নেদারল্যান্ডসের কৃষি মন্ত্রণালয়, নেদারল্যান্ডস এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি, নেদারল্যান্ডস ফুড পার্টনারশিপ, ডাচ-গ্রিন-হাইজডেল্টা, লারিভ ইন্টারন্যাশনাল, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ।
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী নেদারল্যান্ডসের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কম। ২০২১-এ কৃষিপণ্য ও খাদ্য রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে।
মেহেরপুর: পতিত ও অনুর্বর বেলে মাটির জমিতে চিনাবাদাম চাষ করে লাভবান হচ্ছেন মেহেরপুরের চাষিরা। ফলন ও বাজার দর ভালো এবং কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় দিন দিন এই এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাদামের চাষ।
সদর উপজেলার মদনাডাঙ্গা, শ্যামপুর, টেংগারমাঠ ও গোপালপুর গ্রামের অধিকাংশ জমির মাটি বেলে। ফলে এই এলাকার চাষিরা ধান, গম, পাটসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করে খুব একটা লাভবান হতে পারেন না।
ধান কাটার পর এ সব জমি সাধারণত পতিত থাকে। এজন্য ৯০ দিনের ফসল হিসেবে অল্প খরচে বাদাম চাষ করছেন এলাকার চাষিরা।
মেহেরপুর জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলায় এবার বাদাম চাষ হয়েছে ১৫ হেক্টর জমিতে। এবার এক বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করতে চাষিদের খরচ হয়েছে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা সেক্ষেত্রে বাদামের ফলন হয়েছে ৬ থেকে ৭ মণ। আর এ ফলনে প্রায় ২০ হাজার টাকা ঘরে তুলছেন তারা। বাজারে প্রতিমণ বাদাম বিক্রি হচ্ছে ২৭শ’ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। সদর উপজেলার মদনাডাঙ্গা গ্রামের বাদাম চাষি খাঁজা আহমেদ, কাওছার আলী ও ফিরোজ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, এলাকার মাটি বেলে হওয়ায় সাধারণত সবজি, আলু ও অন্যান্য ফসল চাষ করার পর জমি পতিত থাকে। সে সময়ে চিনা বাদামের চাষ করা হয়। বাদাম চাষে খরচ কম এবং উৎপাদন ও বাজার দর ভাল। তাই দিন দিন চাষিরা তাদের পতিত জমিতে চিনা বাদামের চাষ শুরু করছেন।
এছাড়া বাদাম ছাড়ানো, শুকানোসহ যাবতীয় কাজ করে থাকেন এখানকার নারীরা। বাদামের গাছ আবার শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করছেন গৃহিণীরা।
নারী শ্রমিক সাহানা খাতুন ও জরিমন নেছা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বাদাম ছাড়ানো ও শুকানোর কাজ করে থাকি। এলাকার ২৫/৩০ জন নারী শ্রমিক এ কাজ করে আসছেন।
গৃহিণী সাজেদা খাতুন ও জামেলা খাতুন জানান, বাদামের লতা জালানি হিসেবে বেশ ভাল। তাই লতাও বিক্রি হচ্ছে।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আক্তারুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, চিনা বাদামের চাষ সাধারণত পতিত জমিতে হয়ে থাকে। এলাকার চাষিরা এই জমিতে বাদামের চাষ করে বাড়তি আয় করছেন। তাই বাদাম চাষ যাতে আরও সম্প্রসারিত হয় সেজন্য কৃষি বিভাগ চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছে।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন