এগ্রোবিজ
‘শিক্ষিত কৃষক’ বলেই তাঁকে নিয়ে মানুষের আগ্রহটা বেশি
লেখক
প্রথম আলোরামের বাজারে প্লাস্টিকের টুলে বসে কচুর লতি বিক্রি করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবু বকর সিদ্দিক (প্রিন্স)। তাঁর এই ছবি একজন ফেসবুকে পোস্ট করলে তা ভাইরাল হয়েছিল। তাঁকে নিয়ে আলোচনা–সমালোচনায় যোগ দিয়েছিলেন বহু মানুষ। তবে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয় বলে জানালেন বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ কাউন্সিলের পরিচালনা পর্ষদের এই সদস্য।
নিজের বৌভাতের জন্য জমানো এক লাখ টাকা দিয়ে ২০০৬ সালে শ্বশুরবাড়ির এলাকা ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নে খামারের জন্য জমি কিনেছিলেন। পরে ধারদেনাসহ নানাভাবে অর্থ সংগ্রহ করে ২০১৪ সালে সেখানে ‘কৃষাণ সমন্বিত কৃষি উদ্যোগ’ নামে খামার চালু করেন তিনি। এই কাজ করতে গিয়ে বর্তমানে ব্যাংক এবং বিভিন্ন এনজিও থেকে নেওয়া তাঁর ঋণের পরিমাণ ২৫ লাখ টাকার মতো।
আবু বকরের কৃষিকাজের জন্য মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৮ একর। এর মধ্যে ৩ একর দীর্ঘ মেয়াদে ইজারা নেওয়া। বিভিন্ন জাতের ছয় হাজার ড্রাগনগাছ রয়েছে তাঁর খামারে। নয়জন স্থায়ী শ্রমিকের পাশাপাশি সেখানে কাজ করছেন অনেক অস্থায়ী শ্রমিক। আবু বকর সিদ্দিক তাঁর নামের আগে ডক্টরেট বা শিক্ষক এসবের চেয়ে ‘শিক্ষিত কৃষক’ বলতেই বেশি পছন্দ করেন। ড্রাগন চাষের জন্য এলাকাবাসীর পক্ষ থেকেই পেয়েছেন ‘ড্রাগন প্রিন্স’ উপাধি।
কৃষি–অন্তঃপ্রাণ আবু বকর সিদ্দিকের ফেসবুকের বেশির ভাগ পোস্টই কৃষিসংক্রান্ত। কালবৈশাখীর তাণ্ডবের পর গত শনিবার ভোরে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘কেমনে সম্ভব এইভাবে কৃষিকাজ করা?’
ওই ঝড়ের আগের দিন শুক্রবার মুঠোফোনে কথা হয় আবু বকরের সঙ্গে। ছবি ভাইরাল হওয়া প্রসঙ্গে হাসতে হাসতেই বলেন, ‘আমি তো আর আজ নতুন করে কাজ করছি না। এর আগেও বিভিন্ন সময় আমার কাজ ও ছবি নিয়ে ফেসবুকে আলোচনা হয়েছে। ২০১৬ সালেও একবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে ড্রাগন ফল বিক্রি করার সময় এমন আলোচনা হয়েছে।’
১৪ মে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নে বাবুলের বাজারে প্লাস্টিকের একটি টুলে বসে নিজের খামারে উৎপাদিত কচুর লতি বিক্রি করছিলেন আবু বকর সিদ্দিক। সেই ছবি তুলেছিলেন বেশ কয়েকজন। তাঁদেরই একজন ছবিটি ফেসবুকে দেন। এর দুই ঘণ্টা পর আবু বকর যখন ফেসবুকে ঢুকলেন, তখন দেখেন, তাঁকে ঘিরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
আবু বকর জানান, কচুর লতি বিক্রির ঘটনার দিন খামারের শ্রমিকদের খাবারের জন্য বাজার করার কথা ছিল। সেই সময় হাতে বাজার করার মতো টাকা ছিল না। যে লোকের কচুর লতি বিক্রি করতে যাওয়ার কথা ছিল, তখন তিনি উপস্থিত ছিলেন না। তাই আবু বকর নিজেই স্থানীয় বাজারে তা বিক্রি করার জন্য যান।
তিনি বলেন, ‘আমি বসে থাকলে তো আর কেউ লতি বিক্রি করে দিত না। আমার প্রয়োজনেই আমাকে আমার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে হয়েছে। ৫০ টাকা কেজি দরে ১৬ কেজি লতি বিক্রি করে বাজার করে ফিরেছি। কৃষকের জন্য যা স্বাভাবিক কাজ, শিক্ষিত বা নামের আগে ডক্টরেট থাকায় তা যখন আমি করতে গিয়েছি, তখন মানুষের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।’
আবু বকরের পৈতৃক বাড়ি ঝালকাঠি। বাবার চাকরি সূত্রে থেকেছেন ঢাকায়। বাবা মারা যাওয়ার আগে গাজীপুরে জমি কিনে বাড়ি করেছেন। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার হাতিলেইট গ্রামে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ির এলাকাতেই খামার গড়েছেন। আবু বকর ফুলবাড়িয়া ও ঢাকা—দুই জায়গায় যাতায়াতের মধ্যে থাকেন।
আবু বকরের বাবা ছিলেন সেনা কর্মকর্তা। তিনি বললেন, ‘চাচা–মামারাও কৃষির সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন, তাঁরা চাকরি, না হয় ব্যবসা করছেন। বলতে গেলে আমিই প্রথম কৃষিকাজ বেছে নিয়েছি। এ নিয়ে শুরুতে ঝামেলাও পোহাতে হয়েছে। তবে এখন পরিবারের সদস্যরা, বিশেষ করে ঢাকার উত্তরায় থাকা স্ত্রী মাকসুদা রুমি ও তিন ছেলেমেয়ে এখন আর কোনো আপত্তি করে না।’
এখন খামারের আয় থেকেই ঋণের কিস্তি পরিশোধের পাশাপাশি ঢাকায় ভালো স্কুলে ছেলেমেয়েদের পড়ানোসহ সংসারের অন্যান্য খরচ বেশ ভালোভাবেই মেটাতে পারছেন বলে জানান আবু বকর। গত বছর বরিশালের ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটিতে সহকারী অধ্যাপক ও মার্কেটিং বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। তবে এখানেও তাঁর কৃষি ও খামার প্রাধান্য পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির মালিকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার সুবাদে শুরুতেই বলে নিয়েছেন খামারে যে ছয় মাস কাজ বেশি থাকবে, সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে (দুই সেমিস্টার) তিনি ক্লাস নেবেন না। আবু বকর জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সম্মানী ভাতা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণ তহবিলে জমা দিয়ে দেন।
আবু বকর বললেন, কৃষিকাজ পুরোপুরি বিজ্ঞাননির্ভর। কৃষিতে সফল হতে হলে বুদ্ধি ও পরিশ্রম—এ দুটোকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
২০০২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ব্যবস্থাপনায় এমএ করেছেন আবু বকর। ২০০৮ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ থেকে কৃষি ব্যবসায় এমবিএ করেন। ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল, ২০১৮ সালে কৃষি সাপ্লাই চেইন এবং বাজারজাতকরণ বিষয়ে পিএইচডি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে। তাঁর মতে, কৃষক শিক্ষিত হলে অসুবিধার চেয়ে সুবিধাই বেশি।
তবে ওই শিক্ষিত কৃষককে লজ্জাটা ঝেড়ে ফেলতে হবে। কৃষিতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এগোতে হয়। তাঁর মতে, এই পরিকল্পনাই হলো আধুনিক টেকসই কৃষির মূলমন্ত্র।
আবু বকর জানালেন, গত বছর বিভিন্ন জাতের ধান, মাছ, গরুর মাংস, আম, ড্রাগন, মাল্টা, লটকন, লেবু, আনারসসহ প্রায় ২০০ টন কৃষিপণ্য বিক্রি করেছেন। আয় হয়েছিল ৫২ লাখ টাকা। এর বাইরে জৈব সার বিক্রি এবং খামারের মধ্যে ১২ শতাংশ জমিতে নিজস্ব নার্সারি থেকে ফলের গাছ বিক্রি হয়েছিল পাঁচ লাখ টাকার মতো। তবে আবহাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন জটিলতায় আগের তুলনায় কৃষির উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় বছরটিতে খামারের মোট খরচ ছিল ৪৭ লাখ টাকা। আস্তে আস্তে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা গেলে লাভের পরিমাণ বাড়বে বলেই আশাবাদী এ কৃষক।
পুরো খামারের কৃষি উৎপাদনে ৮০ শতাংশই জৈব সার ব্যবহার করছেন, আর এ সার নিজেই তৈরি করছেন। তাঁর সহজ স্বীকারোক্তি, ‘প্রথমে শতভাগ জৈব সার দিয়েই উৎপাদন শুরু করেছিলাম। কিন্তু এতে করে গাছগুলো ঠিকভাবে পুষ্টি পাচ্ছিল না। তাই সহনীয় মাত্রায় রাসায়নিক ও জৈব সারের সমন্বয়ে সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে। তবে সব পুষ্টিমান ঠিক রেখে কীভাবে শুধু জৈব সার দিয়ে উৎপাদন করা যায়, তার গবেষণা নিজেই করছি।’ তিনি জানালেন, তাঁর ছোট একটা গবেষণাগারে চারটি জৈব জীবাণু কালচার করছেন। ২০টির বেশি উপাদান দিয়ে উন্নত জৈব সার বানানোর নানা পরীক্ষা চালাচ্ছেন।
আবু বকরের আফসোস, কৃষিকাজে আগে থেকেই অভিজ্ঞতা থাকলে তাঁর সময় কম নষ্ট হতো। এখন তাঁকে ঠেকে ঠেকে শিখতে হচ্ছে। আর এই শিখতে আর বুঝতে গিয়েই তাঁর অতিরিক্ত সময় নষ্ট হচ্ছে, টাকা খরচ হচ্ছে। এমবিএ করার পর ভারতের পাঞ্জাবে ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম করার সুযোগ পেয়েছিলেন আবু বকর। তখন সেখানকার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশেষজ্ঞ-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপের সূত্রে কৃষির প্রতি আগ্রহটা বাড়ে। দেশের বিভিন্ন জেলায় ২০০টি বাণিজ্যিক বাগানের ২০০ জন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করেছেন আবু বকর। এই উদ্যোক্তারা আবু বকরের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন, তাঁর কাছ থেকে চারা নিচ্ছেন। আবু বকরের ভাষায়, এই বাগানমালিকদের অনেকেই তাঁর চেয়ে ভালো অবস্থানে পৌঁছে গেছেন। এই নতুন উদ্যোক্তা তৈরির বিষয়টিতেই তিনি বেশি তৃপ্তি পান।
নতুন কৃষি উদ্যোক্তার জন্য স্বল্প পুঁজির বিষয়টি অনেক বড় প্রতিবন্ধকতা বলে উল্লেখ করলেন আবু বকর।
তিনি জানান, শুরুতে কারও কাছে ২০০ টাকা চাইলেও পাওয়া যেত না। আর এখন ওই ব্যক্তিদের কাছে ১০ হাজার টাকা চাইলেও মুহূর্তের মধ্যে দিয়ে দিচ্ছেন। এ পর্যায়ে আসতে তাঁকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। নিজের আরাম–আয়েশ বাদ দিতে হয়েছে। পরিবারের জন্য বরাদ্দ করা সময়টুকু খামারের পেছনে দিতে হয়েছে।
উত্তরার বাসার বাজারের চেয়ে খামারের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে হয়েছে। ১৫ বছর বয়সী মেয়ে মুনিবা সিদ্দিক, ১১ বছর বয়সী ছেলে ইয়াফি আবদুল্লাহ সিদ্দিক আর ৫ বছরের ছেলে আদিব আবদুল্লাহকে সামলাচ্ছেন স্ত্রী মাকসুদা।
আবু বকর বললেন, তাঁর ইচ্ছা আছে, ভবিষ্যতে উৎপাদিত পণ্যের লাভের অংশ থেকে একটি তহবিল গঠন করবেন, যা থেকে নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা করা হবে।
তিনি বলেন, কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পান না বলেই অনিশ্চিত কাজে নিজের সন্তানদের তাঁরা কৃষি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চান।
আবু বকর জানালেন, গ্রাম্য রাজনীতি মোকাবিলা করেই তাঁকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হচ্ছে। গ্রামের অনেকেই চাননি বা চান না তিনি সেখানে খামার করেন। তবে অনেক নতুন কৃষক তাঁকে দেখে উৎসাহিত হচ্ছেন।
আবু বকর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনা মূল্যে গাছ দেন। নিজের ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসা বা যে পরিবারের প্রয়োজন, তাঁর পাশে দাঁড়াচ্ছেন। ভবিষ্যৎ খামারে মা ও শিশুদের জন্য একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু করতে চান। আবু বকরের মতে, এই ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলে ছেলেমেয়েরা বিপথে চলে যাবে, এ ভয় কম থাকে।
জীবনের এই পর্যন্ত আসার পেছনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক অধ্যক্ষ মরহুম চিকিৎসক কবির উদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী তাসলিমা কবিরের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানালেন। এই পরিবার তাঁকে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি মানসিকভাবে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সব সময় পাশে থেকেছে। এই দম্পতির ছেলের বিজ্ঞাপনী ফার্মে আবু বকর কাজ করেছেন। এই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া এক লাখ টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন বিয়ের পর বউভাতের খরচের জন্য। তবে বউভাতের অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে তখন ওই এক লাখ টাকা এবং শ্বশুরের সহায়তায় জমি কিনে কৃষি নিয়ে স্বপ্নের যাত্রা শুরু করেছিলেন। এক বছর পর স্বল্প পরিসরে বউভাতের আনুষ্ঠানিকতা পালন করেছিলেন। তখন স্ত্রী ছিলেন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
লাভজনক সবজি চাষ পদ্ধতি
-
কৃষকের বন্ধু ও কৃষি উন্নয়ন এর পথিকৃৎ শাইখ সিরাজের ৭০তম জন্মদিন আজ
-
যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে হতে পারে সারের সংকট
-
বিদেশ থেকে খালি হাতে ফিরে ড্রাগন চাষে সাফল্য
-
নাসিরনগরে বন্যায় তলিয়ে গেল কৃষকের বাদামখেত
-
পানি দিতে অতিরিক্ত টাকা
-
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
-
ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বীজ কিনে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত
-
বোরো কাটতে বাড়তি খরচ ঃ হাসি নেই কৃষকের মুখে
-
পেঁয়াজের ক্ষতি পুষিয়ে দিচ্ছে সাথি ফসল বাঙ্গি
চলতি বোরো মৌসুমে সার কিনতে কৃষকদের সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা করে বেশি দিতে হয়েছে। আর সরকারকেও সার বাবদ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বাজেটে বরাদ্দের তিন গুণের বেশি—প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ এখন মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) সার আমদানি নিয়ে বিপাকে পড়েছে।
ধান, আলু ও সবজি চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এমওপি সারের ৬০ শতাংশ আনা হতো রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে। ওই দুই দেশ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ায় এখন বাংলাদেশকে এমওপি কিনতে হচ্ছে কানাডা থেকে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া ও আমদানিতে অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশে সারের সংকট হতে পারে। ভর্তুকির চাপ সামলাতে বাংলাদেশকে সব ধরনের সারের খুচরা মূল্য বাড়াতে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশে সার সরবরাহ ও ব্যবহারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এমওপি সারের ২০ শতাংশ সরবরাহ কমানো হলে সামনের বোরো মৌসুমে ধান, গম ও রবি মৌসুমের অন্যান্য ফসলের উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমতে পারে। এতে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
এমনিতেই এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সারের কারণে নতুন করে যাতে আর সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এ এম এম শওকত আলী, সাবেক কৃষিসচিব
তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, দেশে চলতি বোরো মৌসুমে নতুন করে আর সারের দরকার হবে না। সামনে আলুর মৌসুমে ইউরিয়া, এমওপিসহ অন্যান্য সারের চাহিদা বাড়বে। ওই সময়ের জন্য সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ কানাডা ও মধ্যপ্রাচ্যের সার সরবরাহকারী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।
জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কানাডা থেকে মোট আট লাখ টন এমওপি সার আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি। এ ব্যাপারে ওই দেশের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা স্মারক হয়েছে। ফলে এই সার নিয়ে সরকারের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। তবে সার বাবদ সরকারের বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি বাড়ছে। এই চাপ নিয়েও সরকার ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ওই ভর্তুকি দিয়ে যাবে।’
কমানো হয়েছে চাহিদা
বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে ৬৯ লাখ টন রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি—এই চার ধরনের সার ব্যবহার হয় ৫৭ লাখ টন। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের ওই চার ধরনের সারের চাহিদা কমিয়ে ৫৫ লাখ ৫০ হাজার টনে নামিয়ে আনা হয়েছে।
দেশে প্রয়োজনীয় সারের ৮০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে এমওপি সারের বড় অংশ আসে রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে।
প্রসঙ্গত, ওই চারটি প্রধান সার কৃষকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। চলতি অর্থবছরে সরকার প্রাথমিকভাবে সারে ভর্তুকি বাবদ ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে গত ছয় মাসে সারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বেশির ভাগ সারের দাম তিন থেকে চার গুণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারকে ভর্তুকির পরিমাণ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা করতে হয়। কিন্তু অর্থবছরের শেষের দিকে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে হিসাব করে দেখা হয়েছে, ভর্তুকির পরিমাণ এবার বেড়ে কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকা গিয়ে দাঁড়াবে।
জিপসাম, জিংক সালফেট ও অ্যামোনিয়াম সালফেট ও ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সারে সরকার কোনো ভর্তুকি দেয় না। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কিনে ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছে তা বিক্রি করে থাকেন। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষককেও বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে।
সাবেক কৃষিসচিব এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতেই এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সারের কারণে নতুন করে যাতে আর সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সরকারের অন্যান্য খাতের ভর্তুকি কমিয়ে প্রয়োজনে সারে ভর্তুকি বাড়াতে হবে, যাতে সারের দাম কম থাকে। কারণ, কৃষকের হাতে এখন টাকা কম। বিশ্ববাজার থেকেও খাদ্য আমদানি করা সামনের দিনে আরও কঠিন হতে পারে। ফলে দেশের উৎপাদন ঠিক রাখতে সারের দাম ও জোগান ঠিক রাখা উচিত।
মিরাজুল ইসলাম (৩৩)। ১০ বছর সৌদি আরবে ছিলেন। আকামা জটিলতায় খালি হাতে দেশে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এক বছর বেকার থাকার পর ইউটিউবে পতিত জমিতে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখেন। বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে নেমে পড়েন ড্রাগন চাষে। দেড় বছরের ব্যবধানে এখন উপজেলার সবচেয়ে বড় ড্রাগন বাগান তাঁর। এ বছর খরচ বাদে আট থেকে নয় লাখ টাকা লাভের আশা করছেন তিনি।
পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার ইন্দুরকানি গ্রামের বাসিন্দা মিরাজুল। উপজেলার টগরা গ্রামে দেড় একর জমিতে তিনি ড্রাগনের বাগান তৈরি করেছেন। তাঁর বাগানে এখন সাড়ে তিন হাজার ড্রাগন ফলের গাছ আছে।
মিরাজুল ইসলাম বলেন, শ্রমিক হিসেবে ১০ বছর সৌদিতে কাজ করে ২০১৯ সালে দেশে ফেরেন তিনি। আকামা সমস্যার কারণে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কিছু একটা করবেন বলে ভাবছিলেন। একদিন ইউটিউবে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখতে পান। সেই থেকে ড্রাগন চাষে আগ্রহ জন্মে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দেড় একর পতিত জমি ড্রাগন চাষের উপযোগী করেন। গাজীপুর থেকে ৬০ টাকা দরে ৬০০ চারা নিয়ে আসেন। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে শুরু করেন চাষাবাদ। পরের বছর জুনে ফল পাওয়া শুরু করেন।
ড্রাগনের বাগান করতে মিরাজুলের খরচ হয়েছিল ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। ইতিমধ্যে ফল বিক্রি করে তাঁর খরচ উঠে গেছে। সাধারণত মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গাছে ফল আসে। বছরে ছয় থেকে সাতবার পাকা ড্রাগন সংগ্রহ করা যায়। এখন পরিপক্ব ও রোগমুক্ত গাছের শাখা কেটে নিজেই চারা তৈরি করেন। ড্রাগন চাষের পাশাপাশি বাগানে চুইঝাল, এলাচ, চায়না লেবুসহ মৌসুমি সবজি চাষ করেন। এ ছাড়া ড্রাগনের চারাও উৎপাদন করে বিক্রি করেন তিনি।
মিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাগানের বেশির ভাগ গাছে এ বছর ফল ধরেছে। গত মঙ্গলবার বাগান থেকে দেড় টন ফল সংগ্রহ করেছেন। ২৫০ টাকা কেজি দরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছেন। স্থানীয় বাজারে ৩০০ টাকা কেজি দরে ড্রাগন বিক্রি হয়। নভেম্বর পর্যন্ত আরও পাঁচ–ছয়বার বাগান থেকে ফল তোলা যাবে। আশা করছেন, খরচ বাদে এবার আট থেকে নয় লাখ টাকা লাভ থাকবে।
মিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমার বাগান থেকে চারা নিয়ে অনেকে বাড়িতে ও ছাদে ছোট পরিসরে ড্রাগনের বাগান করেছেন। আমি এ পর্যন্ত ৪০ টাকায় দেড় হাজার চারা বিক্রি করেছি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পূর্ণ বয়সের একটি ড্রাগনের চারা রোপণের পর ২৫ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। এর মৃত্যুঝুঁকি নেই বললেই চলে। তবে কয়েক দিন পরপর সেচ দিতে হয়। বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হয়। ড্রাগন ফল চাষে রাসায়নিক সার দিতে হয় না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইশরাতুন্নেছা বলেন, মিরাজুল ইসলামকে ড্রাগন চাষে নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে আসছে কৃষি বিভাগ। উপজেলায় তাঁর বাগানটি সবচেয়ে বড়। তিনি নিরলস পরিশ্রম করে ছোট থেকে বাগানটি বড় করেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার গোয়ালনগর ইউনিয়নে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে কৃষকের প্রায় ৩০ হেক্টর বাদাম চাষের জমি। কয়েক দিন আগে উজানের পানিতে তাঁদের পাকা ধানের জমি তলিয়ে গিয়েছিল। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকেরা বাদাম চাষ করেছিলেন। আবারও ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ার বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হলেন চাষিরা।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ এপ্রিল উপজেলায় শিলাবৃষ্টি এবং ১৪ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত উজানের পানিতে কৃষকের পাকা ধানের জমি তলিয়ে যায়। কৃষকেরা সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ২০০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করেছিলেন। এর মধ্যে উপজেলার গোয়ালনগর ইউনিয়নে ৩০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করা হয়। উপজেলায় এবার প্রায় ৫০ হাজার মণ বাদাম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু উজানের পানিতে হঠাৎ বন্যায় সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গোয়ালনগর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আজহারুল হক বলেন, ‘নাসিরনগর উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাদাম চাষ করা হয় আমাদের ইউনিয়নে। কিন্তু এ বছর আগাম বন্যার কারণে কৃষকেরা তাঁদের ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। তাঁদের সব ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে।’
ওই এলাকার বাদামচাষি মেরাজ মিয়া বলেন, তিনি ছয় বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করেন। দু-এক দিনের মধ্যে বাদাম তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু খেতে গিয়ে দেখেন সব বাদাম পানির নিচে। এখন এই বাদাম তুলে কোনো লাভ নেই। এগুলো গরুও খাবে না।
মো. রজব আলী নামের এক কৃষক বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের জামারবালি, সোনাতলা ও মাইজখোলা গ্রামে বাদামখেত আছে। গত তিন দিনে পাঁচ-ছয় ফুট পানি বাড়ায় সব তলিয়ে গেছে। এখন বাদাম তুলতে কাজের লোকও পাওয়া যাচ্ছে না।’
কৃষক ফতু মিয়া বলেন, গোয়ালনগর ইউনিয়নের বাদাম চাষের জমিগুলো হঠাৎ পানি আসায় তলিয়ে গেছে। ফসল তলিয়ে তাঁদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। কয়েক দিন আগেও পাকা ধান পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। কৃষকদের দাবি, গোয়ালনগরে বাদাম চাষের জমি তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকদের প্রায় কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবু সাইদ প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলার কয়েকটি চরাঞ্চলে বাদাম চাষ করা হয়। চরাঞ্চলের উঁচু জমিতে প্রথমে আলু চাষের পর বাদাম চাষ করা হয়। আগাম বন্যার কারণে নিচু এলাকার কিছু বাদামখেত পানিতে তলিয়ে গেছে।
আবু সাইদ আরও বলেন, ১৫-২০ দিন আগে উপজেলার প্রায় সব বাদাম উঠে গেছে। গোয়ালনগর ইউনিয়নে ৩০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করা হয়েছিল। এর মধ্যে এক হেক্টর জমির বাদাম তলিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ৭০ হাজার টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সিলেটে বন্যা হওয়ায় এমনটি হয়েছে বলে তিনি জানান।
ঠাকুরগাঁওয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) একটি গভীর নলকূপের সেচের পানি সরবরাহে কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে। ভুক্তভোগী কৃষকদের কাছ থেকে পাওয়া এমন অভিযোগের তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বড় বালিয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে।
ভুক্তভোগী কৃষকেরা বলছেন, সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের বাইরে কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু বিএমডিএর ১০৮ নম্বর গভীর নলকূপের অপারেটরের দায়িত্বে থাকা বিউটি বেগমের স্বামী আকতারুজ্জামান বোরো ধান চাষের জন্য প্রতি বিঘার জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা ও অন্য মৌসুমে ৩০০ টাকা নেন। ১০ বছর ধরে তিনি এভাবেই বাণিজ্য করে আসছেন।
সম্প্রতি রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে বিএমডিএর গভীর নলকূপ থেকে খেতে সেচের পানি পেতে হয়রানির শিকার দুই কৃষকের মৃত্যুর ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়।
ঠাকুরগাঁও জেলায় বিএমডিএর ১ হাজার ৪৩১টি গভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে সচল ১ হাজার ৪১৮টি। সেচের আওতায় ৭৬ হাজার ৫০০ পরিবারের জমি রয়েছে ৫৩ হাজার ৫০০ হেক্টর।
* সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের বাইরে কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই। * সেচের আওতায় ৭৬ হাজার ৫০০ পরিবারের জমি আছে। * কৃষকদের নলকূপের আবেদন পেলে যাচাই করে স্কিম তৈরি করা হয়।
বিএমডিএ সূত্রে জানা গেছে, কৃষকদের নলকূপের আবেদন পেলে যাচাই করে স্কিম তৈরি করা হয়। এরপর সমবায়ের ভিত্তিতে অংশীদারি ফি বাবদ এক লাখ টাকা জমা দিতে হয়। এই নলকূপ পরিচালনার জন্য বিএমডিএ একজন অপারেটর নিয়োগ দেন। প্রিপেইড মিটারিং পদ্ধতিতে কৃষকের নিজ নামে প্রিপেইড কার্ড থাকতে হয়। সেই কার্ড থেকে প্রতি ঘণ্টায় সেচের পানির জন্য ন্যূনতম ১১০ টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে নেওয়া হয়। এর বাইরে অতিরিক্ত কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই।
বড় বালিয়া এলাকার কৃষকেরা জানান, ২০১১ সালের দিকে বড় বালিয়া মণ্ডলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আকতারুজ্জামান এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ফি হিসেবে এক লাখ জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও কোনো কৃষক সেটা দিতে এগিয়ে আসেননি। ফলে আকতারুজ্জামান, দাউদুল ইসলাম ও জোবায়দুর রহমান মিলে অংশীদারি ফি দেন। আকতারুজ্জামানের ৮০ শতাংশ টাকা থাকায় গভীর নলকূপের নিয়ন্ত্রণ তিনিই পান। অপারেটর হিসেবে নিয়োগ পান তাঁর স্ত্রী বিউটি বেগম। যদিও কৃষকেরা আকতারুজ্জামানকেই অপারেটর হিসেবে জানতেন।
সেচের পানি পেতে হয়রানির শিকার হয়ে সদর উপজেলার বড় বালিয়া এলাকার ৫০ জন কৃষক গত ১৭ এপ্রিল বিএমডিএ সহকারী প্রকৌশলীর কাছে অভিযোগ দেন। সেখানে গিয়ে কৃষক ও অপারেটরের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।
ভুক্তভোগী কৃষকেরা বলেন, ২০১২ সালে নলকূপটি চালু হলে আওতাধীন কৃষকের কাছ থেকে আকতারুজ্জামান সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের অতিরিক্ত টাকা আদায় শুরু করেন। আর সেই টাকা থেকে তিনি মাঝেমধ্যে অন্য দুই অংশীদারকে কিছু টাকা ভাগ দেন।
ভুক্তভোগী কৃষক মো. শাহজাহান আলী বলেন, গভীর নলকূপটির আওতায় তাঁর ১০ বিঘা জমি রয়েছে। কার্ডের বাইরে টাকা দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও আকতারুজ্জামানকে প্রতি বিঘায় সেচের জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা দিতে হয়। এই টাকা না দিলে তিনি পানি দেন না।
ওই নলকূপের আওতায় চার বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করছেন কৃষক মো. হেলাল। তিনি অতিরিক্ত টাকা না দেওয়ায় অপারেটর খেতে পানি দেননি। এতে জমি ফেটে যায়। পরে তিনি শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে জমিতে সেচ দিয়ে খেত রক্ষা করেছেন।
আরেক ভুক্তভোগী মোকলেসুর রহমান বলেন, ১০ বছর ধরে সেচের পানির জন্য অতিরিক্ত টাকা দিয়ে আসছেন। এখন বিরক্ত হয়ে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। এরপরও কোনো বিচার পাননি।
এ বিষয়ে মো. আকতারুজ্জামান বলেন, তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর দেখেন গ্রামে কোনো গভীর নলকূপ নেই। পরে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে নলকূপটি স্থাপন করেন। কৃষকেরা অংশীদারত্বের টাকা দিতে রাজি না হলে তিনি বিএমডিএকে জানান। সে সময় তাঁরা টাকা দিয়ে দিতে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘পরে আপনি টাকাটা ধীরে ধীরে তুলে নেবেন।’ সেই পরামর্শেই সেচের পানি বাবদ প্রিপেইড কার্ডের অতিরিক্ত কিছু টাকা তিনি নিচ্ছেন। জোর করে কিছু নিচ্ছেন না।
বিএমডিএ ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, অভিযোগটি যাচাই করে সত্যতা পাওয়া গেছে। নলকূপটি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওই অপারেটরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এগ্রোটেক
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
লেখক
প্রথম আলোডাচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে দুই দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।
গতকাল সোমবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অনুষ্ঠিত কৃষি খাতের ব্যবসাবিষয়ক এক সম্মেলনে দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এগ্রি বিজনেস কনক্লেভে বাংলাদেশের প্রায় ৪০জন উদ্যোক্তা ডাচ কৃষি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি প্রযুক্তি সহযোগিতা ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছে ওয়েগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়।
আলোচনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তি কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি সহযোগিতা দিতে রাজি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে ডাচরা প্রস্তুত এবং বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও তাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া ডাচ সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বীজ, পশু খাদ্য, পোলট্রি, হর্টিকালচার ও এ্যাকুয়াকালচার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করেছে, যা ওই দেশের বেসরকারি খাতকে আরও উৎসাহিত করেছে।
আলোচনায় কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তৈরি আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্কয়ার, ইস্পাহানি এগ্রো, একে খান অ্যান্ড কোম্পানি, প্যারাগন গ্রুপ, এসিআই, জেমকন গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ডাচ প্রযুক্তির প্রয়োগ সরেজমিনে দেখতে যাবেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের পোল্ট্রিখাতে সহযোগিতার আলোচনা অনেকটা এগিয়েছে উল্লেখ করে মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দুই দেশের মধ্যে মৎস্য, পশুপালন ও হর্টিকালচারে সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা আছে।
কনক্লেভ আয়োজনে প্রথমবারের মতো দূতাবাসের সঙ্গে অংশীদার হয়েছে নেদারল্যান্ডসের কৃষি মন্ত্রণালয়, নেদারল্যান্ডস এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি, নেদারল্যান্ডস ফুড পার্টনারশিপ, ডাচ-গ্রিন-হাইজডেল্টা, লারিভ ইন্টারন্যাশনাল, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ।
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী নেদারল্যান্ডসের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কম। ২০২১-এ কৃষিপণ্য ও খাদ্য রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন