এগ্রোবিজ
আম রপ্তানি একটি স্বপ্নের সূচনা ও অপমৃত্যু
লেখক
শাইখ সিরাজআমের মিষ্টতা ও ঘ্রাণের প্রেমে পড়েনি এ দেশে এমন মানুষ পাওয়া যাবে কি? একটা রসালো আম ভুলিয়ে দিতে পারে সব ক্লান্তি। যেমন মহাবীর আলেকজান্ডার ভুলে গিয়েছিলেন। পৃথিবী জয় করতে নেমে ভারতবর্ষ অবধি এসে মজে গিয়েছিলেন আমের রসে। তাই ফিরে যাওয়ার সময় আলেকজান্ডার ঝুড়িতে করে আম নিয়ে গিয়েছিলেন সুদূর গ্রিসে। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস বলে আমের ইতিহাস আরও পুরনো। আম এ উপমহাদেশের এক নিজস্ব ফল। ভারতের কুউমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ড. ইন্দু মেহতার আমের ইতিহাস নিয়ে একটি গবেষণা পেপার পড়ছিলাম। সেখানে উল্লেখ আছে, হাজার বছরের আমের ইতিহাসের কথা। তবে ৬৩২-৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং যখন ভারতবর্ষে বেড়াতে আসেন, তখন পরিচিত হন এ অঞ্চলের ফল আমের সঙ্গে। প্রচলিত আছে- সে সময় তিনি ফল হিসেবে আমকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তোলেন। আমি এর আগে একটি লেখায় আম নিয়ে মুঘল সম্রাট আকবরের গল্পটি উল্লেখ করেছিলাম। সম্রাট আকবর তাঁর শাসনামলে ভারতের লাখবাগের দ্বারভাঙা এলাকায় প্রায় ১ লাখ আম গাছ রোপণ করেছিলেন। যেটিকে বলা হয় ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় আমবাগান। এরপর পর্তুগিজরা এসে আমের রস ও গন্ধে মজে ওঠে। তারাই আমকে ছড়িয়ে দেয় সারা বিশ্বে। যেখানে যেখানে তারা কলোনি গড়েছে সেখানেই নিয়ে গেছে আমকে, গড়েছে আমের বাগান। ১৬০০ সালের মধ্যে আম পৌঁছে যায় মেক্সিকোয়, ১৮৩৩ সালে আমেরিকার ফ্লোরিডায়। এ জনপদের আম ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।
বর্তমানে ৯০টির বেশি দেশে আমের ফলন হয়। আমের রসে মুগ্ধ পৃথিবীবাসী। আম জনপ্রিয় এক ফল। বিশ্বে কোটি কোটি টাকার আমের বাজার। কয়েকদিন আগেও ধারণা করা হচ্ছিল ২০২৯ সালের বৈশ্বিক আমের বাজার হবে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি ইউএস ডলারের। আম উৎপাদনকারী প্রথম ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম স্থানে আছে বটে কিন্তু আম রপ্তানিকারী প্রথম ২০ দেশের মধ্যেও বাংলাদেশ নেই। অথচ প্রতি বছর বাড়ছে আমের উৎপাদন। আম চাষিরা আগ্রহ নিয়ে প্রতি বছর আম উৎপাদন করে চলেছেন বড় একটি বাজার ধরবেন বলে। কিন্তু আমরা কেন বৈশ্বিক বাজারে আর সব শাকসবজি, ফলমূলসহ আম নিয়েও প্রবেশ করতে পারছি না? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে পাঠক, আপনাদের জানিয়ে রাখতে চাই, বছর দশেক আগেও এ দেশে প্রতিটি ফলের দোকান ভরে থাকত ভারতীয় আমে। বাংলাদেশে প্রধানত ভালো জাতের আম হতো রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে। তা ছাড়া সারা দেশের মানুষের গৃহস্থ ভিটায় যেসব আম গাছ থাকত সেগুলো ছিল সাধারণ জাতের। মানুষ বিশ্বাস করত, রাজশাহী-চাঁপাই ছাড়া ভালো আম কোনো মাটিতেই সম্ভব নয়। এমন বিশ্বাস ছিল বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও। কিন্তু এ দেশের কৌতূহলী কৃষক বাণিজ্যিক কৃষির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গেই ফল উৎপাদনের বিষয়টিকে লাভজনক হিসেবে গ্রহণ করেছে। উদ্যোক্তা কৃষকের হাত দিয়ে ফলের রাজা আম ছড়িয়ে গেছে সারা দেশে।
প্রচলিত বিখ্যাত জাতগুলোর পাশাপাশি আরও নতুন নতুন জাত এসেছে। দিনে দিনে সবখানে ছড়িয়ে গেছে আমবাগান। বাংলাদেশে আম উৎপাদন প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আমের বহুমুখী বাণিজ্যিকায়ন শুরু করে কৃষি শিল্প প্রতিষ্ঠান। মনে আছে, উত্তরাঞ্চলের মানুষ একসময় ‘আশ্বিনা’ আম নিয়ে বিপাকে ছিল। দাম পেত না। দেশে প্রথমবারের মতো আম থেকে শিল্পপণ্য তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল প্রাণ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আমজাদ খানচৌধুরী। প্রায় পনের বছর আগে হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে আপনাদের সামনে তুলে ধরেছিলাম নাটোরসহ উত্তরের বিভিন্ন জেলায় স্থানীয় জাতের টক আম ও আশ্বিনা আম কী করে যুক্ত হয় বাণিজ্যিক ধারায়। আগে যেসব আম গাছের নিচে পড়ে থেকে নষ্ট হতো, সেগুলোও হয়ে উঠল কৃষকের অর্থকরী পণ্য। আম এখন শুধু মিষ্টতায়, স্বাদে আমাদের মুগ্ধ করে না, বাণিজ্যেও বড় অঙ্কের কৃষি-অর্থনীতির স্বপ্ন দেখায়। আমাদের দেশে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার কৃষি অর্থনীতিতে যে মাত্রা যোগ করেছে, সেখানে রপ্তানি সম্ভাবনারও একটি বড় অবদান রয়েছে। বেশ ক’বছর আগে থেকেই আমাদের দেশের আম বিচ্ছিন্নভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। স্থানীয় ছোট ছোট বাজারে, যেগুলোকে বলা হয় এথনিক মার্কেট, সেগুলোয় প্রবাসীদের মাঝে বিক্রি হয়ে আসছে।
কিন্তু ইংল্যান্ড বা আমেরিকার হোলসেল মার্কেটগুলোয় বাংলাদেশের পণ্য আমি খুঁজে পাইনি। ২০১৫ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিক আম রপ্তানির একটি দ্বার উন্মোচিত হয়। বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যের বাজারে আম রপ্তানি শুরু হয়।
আম রপ্তানির প্রথম চালান যুক্তরাজ্যের ওয়ালমার্ট চেইনশপে পৌঁছায়। আমের রপ্তানি বাজার উন্মুক্ত করার পেছনে বড় ভূমিকাটি ছিল বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও)। এফএওর তৎকালীন প্রতিনিধি মাইক রবসন, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, হর্টেক্স ফাউন্ডেশনকে সঙ্গে নিয়ে আম রপ্তানির কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল এসে দেশের আম উৎপাদনকারী এলাকা সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী পরিদর্শন করেন। নয়টি জাতের আমের নমুনাও পাঠানো হয়। সেখান থেকে তারা তিনটি জাত- হিমসাগর, ল্যাংড়া ও আম্রপালি বাছাই করেন। এ সময়টিতে আমকে ঘিরে এক বিরাট বাণিজ্য সম্ভাবনা দানা বাঁধে। হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের পক্ষ থেকেও রপ্তানি উপযোগী আম উৎপাদন, ব্যাগিং পদ্ধতির ব্যবহার ও সচেতনতা নিয়ে একাধিক অনুষ্ঠান করি। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম চাষিদের নিয়ে নানাবিধ পরামর্শ সভা ও বৈঠকের আয়োজন করা হয়। আমরা শুধু আমের বাণিজ্য সম্ভাবনা নিয়ে রাজশাহীতে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এরও আয়োজন করি। সে আয়োজনেই কৃষক তুলে ধরেন আমের ‘ফ্রুট ফ্লাই’ সমস্যার কথা। ২০১৪-১৫ সাল থেকে টানা কয়েক বছর আম রপ্তানি কার্যক্রম চলেছে।
কিন্তু তারপর আকস্মিকভাবেই থমকে যায় এ উদ্যোগ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, ২০১৪-১৫ সালে যেখানে ৭৮৮ টন আম রপ্তানি হয়, সেখানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৮৮ টনে নেমে আসে এবং তারপর কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি পরিমাণে এসে পৌঁছে। আমের রপ্তানি বাণিজ্যে এ ভাটার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ আমাদের গাফিলতি। আমি কথা বলেছি যারা ওয়ালমার্টে প্রথম আম রপ্তানিতে অংশ নিয়েছিলেন তাদের কয়েকজনের সঙ্গে। তারা বলেছেন কীভাবে একটা সম্ভাবনা মুকুলেই নষ্ট করে দেওয়া হয়। কৃষক ও রপ্তানিকারকদের মাঝখানে থাকা কিছু মানুষের অসততার কারণেই একটা সম্ভাবনার দ্বারে প্রথম আঘাত আসে। কৃষক জানায়, তারা যে মানের আম দেন, তার সঙ্গে বাইরে থেকে কেনা আম মিশিয়ে কোয়ালিটি নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল। এমনও হয়েছে, তাদের কাছ থেকে আম না নিয়েই আম রপ্তানি সম্পন্ন করে ফেলেছে। পাঠক! আপনাদের জ্ঞাতার্থে বলে রাখতে চাই, আন্তর্জাতিক হোলসেল মার্কেটগুলোয় কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে চাইলে অবশ্যই গ্যাপ (গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস) সার্টিফাইড হতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কোনো দেশে পণ্য পাঠাতে চাইলে উৎপাদন থেকে প্যাকেটজাতকরণে ইইউর কমপ্লায়েন্স মেনে করতে হবে। এ রপ্তানি কার্যক্রমের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের উদাসীনতা, ইচ্ছার অভাবের কারণে এখন পর্যন্ত গ্যাপ সার্টিফিকেটপ্রাপ্তির বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়নি। যা হোক, বলছিলাম ওয়ালমার্টের সঙ্গে আম পাঠানোর চুক্তিটা কীভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে সেই কথা। ওয়ালমার্টের সঙ্গে চুক্তি ছিল লন্ডনের জামিল আহমেদের। তিনি এক বছর আগে থেকেই ওয়ালমার্টের ৭০০ টন আমের প্লেস বুকিং দিয়ে রাখেন। ওয়ালমার্টও চুক্তি অনুযায়ী প্লেস খালি রাখে এবং রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশের দ্বীপ ইন্টারন্যাশনালকে রেজিস্ট্রার করে এবং শর্ত অনুযায়ী দ্বীপ ইন্টারন্যাশনাল আম পাঠানোও শুরু করে। ৪-৫ টন আম পাঠানোর পর দ্বীপ ইন্টারন্যাশনাল ওয়ালমার্টে আম পাঠাতে ব্যর্থ হয়। কারণ জানতে কথা বলি দ্বীপ ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী পরিতোষ চন্দ্র দাস মানিক বাবুর সঙ্গে। তিনি জানান, হঠাৎ করে অন্য দেশের একটি এথনিক মার্কেটে রপ্তানি করা সবজিতে ফ্রুট ফ্লাই থাকার কথা বলে সরকারের কৃষিপণ্য রপ্তানির কোরাইন্টাইন বিভাগ দ্বীপ ইন্টারন্যাশনালের কৃষিপণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ফলে তার পক্ষে আর ওয়ালমার্টে আম পাঠানো সম্ভব হয় না। প্রসঙ্গতই আমি কথা বলি ওয়ালমার্টের সঙ্গে চুক্তিকারী জামিল আহমেদের সঙ্গে। তিনিও জানান, ফলের মান নিয়ে ওয়ালমার্টের প্রশ্ন ছিল না। এফএওর প্রতিনিধি চিঠিতে লিখে দিয়েছিলেন আমের উৎপাদন কমপ্লাইন্স মেনে মানসম্পন্নভাবেই হয়েছে। এতে ওয়ালমার্ট সে বছরের জন্য আম নিতে রাজি হয়, কিন্তু পরের বছর অবশ্যই গ্যাপ সার্টিফিকেট লাগবে এ কথাও জানিয়ে দেয়।
কিন্তু সবচেয়ে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় হঠাৎ করে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান দ্বীপ ইন্টারন্যাশনালের রপ্তানি করার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া। এর ফলে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হন জামিল আহমেদ। পাশাপাশি বাংলাদেশের আম রপ্তানির বড় একটি সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। সে সময় হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের কনসালট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ড. সালেহ আহমেদ। তিনি জানান, গ্যাপ সার্টিফিকেশনের জন্য তিনি চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু একক প্রচেষ্টায় অন্যান্য দফতরের সঙ্গে সমন্বয় করা সম্ভব হয়নি। আম রপ্তানির পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছি হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষিবিদ মনসুরুল হান্নানের সঙ্গে। প্রশ্ন ছিল, পাঁচ বছরেও একটি সার্টিফিকেশনের আওতায় কৃষিপণ্যকে আমরা আনতে পারিনি কেন? তার কথায়ও বোঝা গেল, মাঠ পর্যায়ে সমন্বয় করাটাই কঠিন। সর্বশেষ বিষয়টি জানতে ও জানাতে কথা বলি কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। তিনি সরলভাবেই জানিয়েছেন, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি জানতেন না। কেউ তাকে জানায়ওনি। সম্প্রতি জানার পর তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন। আশা করছেন খুব শিগগিরই গ্যাপ সার্টিফিকেশনের জটিলতা কেটে যাবে। গত বছর কৃষি মন্ত্রণালয়ে এক অনুষ্ঠানে জাপানের রাষ্ট্রদূত তাদের দেশে বাংলাদেশের আমদানির আগ্রহের কথা জানান। তবে জাপানের রাষ্ট্রদূত মি. নাওকি ইটো শর্ত দেন ফ্রুট ফ্লাই কিটমুক্ত আম হতে হবে। সে প্রক্রিয়া কতদূর অগ্রসর হয়েছে তাও মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। এ ব্যাপারেও তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, প্রক্রিয়া চলছে।
বহু আগে থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের কৃষিপণ্য উপেক্ষিত। রপ্তানির জন্য আমাদের আন্তরিকতাও একসময় ঝিমিয়ে পড়েছে। আমি গত এক দশকে ইংল্যান্ড তথা ইউরোপের বিভিন্ন হোলসেল মার্কেটে আমাদের কৃষিপণ্য খুঁজেছি। কিন্তু বারবারই হতাশ হয়েছি। আফ্রিকার ছোট্ট কোনো দেশ থেকেও পণ্য আসে কিন্তু আমরা সেখানে আমাদের পণ্য নিয়ে ঢুকতে পারি না। ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের সবচেয়ে বড় হোলসেল মার্কেটে গিয়ে জানলাম সে দেশের কৃষি ও খাদ্যের নিরাপত্তা বিধানকারী প্রতিষ্ঠান ডেফরার যথেষ্টই আন্তরিকতা রয়েছে আমাদের দেশের কৃষিপণ্যের ব্যাপারে, কিন্তু আমরা বারবারই তাদের বেঁধে দেওয়া নিয়ম ভঙ্গ করে চলেছি। আমাদের দেশের লেবু ও পানের ক্ষেত্রে সেই একই ঘটনা বারবার ঘটেছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের অক্টোবরে আমি ইংল্যান্ডের কেন্দ্রস্থলের একটি হোলসেল মার্কেটে গিয়েও আরও হতাশাজনক চিত্র খুঁজে পাই। দেখলাম সেখানে আমাদের দেশের পান ঠিকই পৌঁছে, কিন্তু তা আমাদের প্রতিবেশী দেশের পরিচয়ে। আমের ক্ষেত্রেও সেই একই হতাশা আমাদের গ্রাস করেছিল। গত এক দশকে আমরা ফল উৎপাদনে বিরাট এক সাফল্য অর্জন করেছি।
২০১৪-১৫ সালে আম রপ্তানি শুরু হতেই পৃথিবীতে আম রপ্তানিতে আমরা অষ্টম স্থানে পৌঁছে যাই। কিন্তু তার পরই থমকে যায়। করোনা পরিস্থিতি পৃথিবীর সামনে অনেক অনিশ্চয়তা টেনে এনেছে। গোটা পৃথিবী এক মহামারী ও দুর্ভিক্ষের শঙ্কার মধ্যে পড়ে গেছে। এ অবস্থায়ও কৃষিতে বহুমুখী সাফল্যের জায়গা থেকে আমরা আশার আলো দেখতে পাই। কিন্তু এ আশার আলো জ্বালিয়ে রাখতে পৃথিবীবাসীর মুখে খাদ্য পৌঁছে দিতে আমাদের অংশ নিতে হবে। বহুমুখী উদ্যোগ নিতে হবে। খাদ্য ও পুষ্টির প্রশ্নে আমদানিনির্ভর দেশগুলোর চাহিদা পূরণে আমাদের তৎপর হতে হবে। এখানে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক তৎপরতা দেখাতে হবে আমাদের। সৃষ্টি করতে হবে রপ্তানি বাজার। যেসব পণ্য রপ্তানিতে প্রশ্ন আছে, সেসব প্রশ্ন দূর করার জন্য সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে তৎপর হতে হবে সরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে। আশা করব সরকার আমসহ সব মৌসুমি ফলের রপ্তানি বাণিজ্যের দ্বার আবার উন্মুক্ত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
-
আম রপ্তানি একটি স্বপ্নের সূচনা ও অপমৃত্যু
-
আম চাষ ও বাগানের পরিচর্যা
-
আম রপ্তানি একটি স্বপ্নের সূচনা ও অপমৃত্যু
আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
কৃষকের বন্ধু ও কৃষি উন্নয়ন এর পথিকৃৎ শাইখ সিরাজের ৭০তম জন্মদিন আজ
-
পঞ্চাশে বাংলাদেশ: এক টেলিভিশন তারকা আর দরিদ্র কৃষকের সন্তান এক বিজ্ঞানী যেভাবে পাল্টে দিয়েছেন বাংলাদেশের কৃষি
-
আমের চারা তৈরি, চারা রোপণ,সার ব্যবস্থাপনা, সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা,রোগ ব্যবস্থাপনা, পোকা দমন ব্যবস্থাপনা – দা এগ্রো নিউজ
-
মাছ চাষে স্মার্ট প্রযুক্তির উদ্ভাবন বাংলাদেশি তরুণের
-
স্মার্ট ডিভাইসে মাছ চাষে বিপ্লব
-
ফুলকপির ১০ পুষ্টিগুণ
-
অভিনব আম চাষ!
-
যেভাবে করবেন আমবাগান
-
আমের ভালো ফলন নিশ্চিত করতে করণীয়
-
আম বাগানে মাসকলাইয়ের ব্যাপক ফলনের আশা
চলতি বোরো মৌসুমে সার কিনতে কৃষকদের সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা করে বেশি দিতে হয়েছে। আর সরকারকেও সার বাবদ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বাজেটে বরাদ্দের তিন গুণের বেশি—প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ এখন মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) সার আমদানি নিয়ে বিপাকে পড়েছে।
ধান, আলু ও সবজি চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এমওপি সারের ৬০ শতাংশ আনা হতো রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে। ওই দুই দেশ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ায় এখন বাংলাদেশকে এমওপি কিনতে হচ্ছে কানাডা থেকে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া ও আমদানিতে অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশে সারের সংকট হতে পারে। ভর্তুকির চাপ সামলাতে বাংলাদেশকে সব ধরনের সারের খুচরা মূল্য বাড়াতে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশে সার সরবরাহ ও ব্যবহারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এমওপি সারের ২০ শতাংশ সরবরাহ কমানো হলে সামনের বোরো মৌসুমে ধান, গম ও রবি মৌসুমের অন্যান্য ফসলের উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমতে পারে। এতে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
এমনিতেই এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সারের কারণে নতুন করে যাতে আর সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এ এম এম শওকত আলী, সাবেক কৃষিসচিব
তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, দেশে চলতি বোরো মৌসুমে নতুন করে আর সারের দরকার হবে না। সামনে আলুর মৌসুমে ইউরিয়া, এমওপিসহ অন্যান্য সারের চাহিদা বাড়বে। ওই সময়ের জন্য সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ কানাডা ও মধ্যপ্রাচ্যের সার সরবরাহকারী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।
জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কানাডা থেকে মোট আট লাখ টন এমওপি সার আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি। এ ব্যাপারে ওই দেশের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা স্মারক হয়েছে। ফলে এই সার নিয়ে সরকারের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। তবে সার বাবদ সরকারের বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি বাড়ছে। এই চাপ নিয়েও সরকার ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ওই ভর্তুকি দিয়ে যাবে।’
কমানো হয়েছে চাহিদা
বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে ৬৯ লাখ টন রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি—এই চার ধরনের সার ব্যবহার হয় ৫৭ লাখ টন। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের ওই চার ধরনের সারের চাহিদা কমিয়ে ৫৫ লাখ ৫০ হাজার টনে নামিয়ে আনা হয়েছে।
দেশে প্রয়োজনীয় সারের ৮০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে এমওপি সারের বড় অংশ আসে রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে।
প্রসঙ্গত, ওই চারটি প্রধান সার কৃষকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। চলতি অর্থবছরে সরকার প্রাথমিকভাবে সারে ভর্তুকি বাবদ ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে গত ছয় মাসে সারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বেশির ভাগ সারের দাম তিন থেকে চার গুণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারকে ভর্তুকির পরিমাণ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা করতে হয়। কিন্তু অর্থবছরের শেষের দিকে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে হিসাব করে দেখা হয়েছে, ভর্তুকির পরিমাণ এবার বেড়ে কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকা গিয়ে দাঁড়াবে।
জিপসাম, জিংক সালফেট ও অ্যামোনিয়াম সালফেট ও ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সারে সরকার কোনো ভর্তুকি দেয় না। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কিনে ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছে তা বিক্রি করে থাকেন। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষককেও বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে।
সাবেক কৃষিসচিব এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতেই এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সারের কারণে নতুন করে যাতে আর সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সরকারের অন্যান্য খাতের ভর্তুকি কমিয়ে প্রয়োজনে সারে ভর্তুকি বাড়াতে হবে, যাতে সারের দাম কম থাকে। কারণ, কৃষকের হাতে এখন টাকা কম। বিশ্ববাজার থেকেও খাদ্য আমদানি করা সামনের দিনে আরও কঠিন হতে পারে। ফলে দেশের উৎপাদন ঠিক রাখতে সারের দাম ও জোগান ঠিক রাখা উচিত।
মিরাজুল ইসলাম (৩৩)। ১০ বছর সৌদি আরবে ছিলেন। আকামা জটিলতায় খালি হাতে দেশে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এক বছর বেকার থাকার পর ইউটিউবে পতিত জমিতে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখেন। বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে নেমে পড়েন ড্রাগন চাষে। দেড় বছরের ব্যবধানে এখন উপজেলার সবচেয়ে বড় ড্রাগন বাগান তাঁর। এ বছর খরচ বাদে আট থেকে নয় লাখ টাকা লাভের আশা করছেন তিনি।
পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার ইন্দুরকানি গ্রামের বাসিন্দা মিরাজুল। উপজেলার টগরা গ্রামে দেড় একর জমিতে তিনি ড্রাগনের বাগান তৈরি করেছেন। তাঁর বাগানে এখন সাড়ে তিন হাজার ড্রাগন ফলের গাছ আছে।
মিরাজুল ইসলাম বলেন, শ্রমিক হিসেবে ১০ বছর সৌদিতে কাজ করে ২০১৯ সালে দেশে ফেরেন তিনি। আকামা সমস্যার কারণে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কিছু একটা করবেন বলে ভাবছিলেন। একদিন ইউটিউবে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখতে পান। সেই থেকে ড্রাগন চাষে আগ্রহ জন্মে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দেড় একর পতিত জমি ড্রাগন চাষের উপযোগী করেন। গাজীপুর থেকে ৬০ টাকা দরে ৬০০ চারা নিয়ে আসেন। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে শুরু করেন চাষাবাদ। পরের বছর জুনে ফল পাওয়া শুরু করেন।
ড্রাগনের বাগান করতে মিরাজুলের খরচ হয়েছিল ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। ইতিমধ্যে ফল বিক্রি করে তাঁর খরচ উঠে গেছে। সাধারণত মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গাছে ফল আসে। বছরে ছয় থেকে সাতবার পাকা ড্রাগন সংগ্রহ করা যায়। এখন পরিপক্ব ও রোগমুক্ত গাছের শাখা কেটে নিজেই চারা তৈরি করেন। ড্রাগন চাষের পাশাপাশি বাগানে চুইঝাল, এলাচ, চায়না লেবুসহ মৌসুমি সবজি চাষ করেন। এ ছাড়া ড্রাগনের চারাও উৎপাদন করে বিক্রি করেন তিনি।
মিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাগানের বেশির ভাগ গাছে এ বছর ফল ধরেছে। গত মঙ্গলবার বাগান থেকে দেড় টন ফল সংগ্রহ করেছেন। ২৫০ টাকা কেজি দরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছেন। স্থানীয় বাজারে ৩০০ টাকা কেজি দরে ড্রাগন বিক্রি হয়। নভেম্বর পর্যন্ত আরও পাঁচ–ছয়বার বাগান থেকে ফল তোলা যাবে। আশা করছেন, খরচ বাদে এবার আট থেকে নয় লাখ টাকা লাভ থাকবে।
মিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমার বাগান থেকে চারা নিয়ে অনেকে বাড়িতে ও ছাদে ছোট পরিসরে ড্রাগনের বাগান করেছেন। আমি এ পর্যন্ত ৪০ টাকায় দেড় হাজার চারা বিক্রি করেছি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পূর্ণ বয়সের একটি ড্রাগনের চারা রোপণের পর ২৫ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। এর মৃত্যুঝুঁকি নেই বললেই চলে। তবে কয়েক দিন পরপর সেচ দিতে হয়। বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হয়। ড্রাগন ফল চাষে রাসায়নিক সার দিতে হয় না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইশরাতুন্নেছা বলেন, মিরাজুল ইসলামকে ড্রাগন চাষে নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে আসছে কৃষি বিভাগ। উপজেলায় তাঁর বাগানটি সবচেয়ে বড়। তিনি নিরলস পরিশ্রম করে ছোট থেকে বাগানটি বড় করেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার গোয়ালনগর ইউনিয়নে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে কৃষকের প্রায় ৩০ হেক্টর বাদাম চাষের জমি। কয়েক দিন আগে উজানের পানিতে তাঁদের পাকা ধানের জমি তলিয়ে গিয়েছিল। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকেরা বাদাম চাষ করেছিলেন। আবারও ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ার বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হলেন চাষিরা।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ এপ্রিল উপজেলায় শিলাবৃষ্টি এবং ১৪ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত উজানের পানিতে কৃষকের পাকা ধানের জমি তলিয়ে যায়। কৃষকেরা সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ২০০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করেছিলেন। এর মধ্যে উপজেলার গোয়ালনগর ইউনিয়নে ৩০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করা হয়। উপজেলায় এবার প্রায় ৫০ হাজার মণ বাদাম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু উজানের পানিতে হঠাৎ বন্যায় সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গোয়ালনগর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আজহারুল হক বলেন, ‘নাসিরনগর উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাদাম চাষ করা হয় আমাদের ইউনিয়নে। কিন্তু এ বছর আগাম বন্যার কারণে কৃষকেরা তাঁদের ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। তাঁদের সব ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে।’
ওই এলাকার বাদামচাষি মেরাজ মিয়া বলেন, তিনি ছয় বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করেন। দু-এক দিনের মধ্যে বাদাম তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু খেতে গিয়ে দেখেন সব বাদাম পানির নিচে। এখন এই বাদাম তুলে কোনো লাভ নেই। এগুলো গরুও খাবে না।
মো. রজব আলী নামের এক কৃষক বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের জামারবালি, সোনাতলা ও মাইজখোলা গ্রামে বাদামখেত আছে। গত তিন দিনে পাঁচ-ছয় ফুট পানি বাড়ায় সব তলিয়ে গেছে। এখন বাদাম তুলতে কাজের লোকও পাওয়া যাচ্ছে না।’
কৃষক ফতু মিয়া বলেন, গোয়ালনগর ইউনিয়নের বাদাম চাষের জমিগুলো হঠাৎ পানি আসায় তলিয়ে গেছে। ফসল তলিয়ে তাঁদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। কয়েক দিন আগেও পাকা ধান পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। কৃষকদের দাবি, গোয়ালনগরে বাদাম চাষের জমি তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকদের প্রায় কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবু সাইদ প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলার কয়েকটি চরাঞ্চলে বাদাম চাষ করা হয়। চরাঞ্চলের উঁচু জমিতে প্রথমে আলু চাষের পর বাদাম চাষ করা হয়। আগাম বন্যার কারণে নিচু এলাকার কিছু বাদামখেত পানিতে তলিয়ে গেছে।
আবু সাইদ আরও বলেন, ১৫-২০ দিন আগে উপজেলার প্রায় সব বাদাম উঠে গেছে। গোয়ালনগর ইউনিয়নে ৩০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করা হয়েছিল। এর মধ্যে এক হেক্টর জমির বাদাম তলিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ৭০ হাজার টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সিলেটে বন্যা হওয়ায় এমনটি হয়েছে বলে তিনি জানান।
ঠাকুরগাঁওয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) একটি গভীর নলকূপের সেচের পানি সরবরাহে কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে। ভুক্তভোগী কৃষকদের কাছ থেকে পাওয়া এমন অভিযোগের তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বড় বালিয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে।
ভুক্তভোগী কৃষকেরা বলছেন, সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের বাইরে কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু বিএমডিএর ১০৮ নম্বর গভীর নলকূপের অপারেটরের দায়িত্বে থাকা বিউটি বেগমের স্বামী আকতারুজ্জামান বোরো ধান চাষের জন্য প্রতি বিঘার জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা ও অন্য মৌসুমে ৩০০ টাকা নেন। ১০ বছর ধরে তিনি এভাবেই বাণিজ্য করে আসছেন।
সম্প্রতি রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে বিএমডিএর গভীর নলকূপ থেকে খেতে সেচের পানি পেতে হয়রানির শিকার দুই কৃষকের মৃত্যুর ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়।
ঠাকুরগাঁও জেলায় বিএমডিএর ১ হাজার ৪৩১টি গভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে সচল ১ হাজার ৪১৮টি। সেচের আওতায় ৭৬ হাজার ৫০০ পরিবারের জমি রয়েছে ৫৩ হাজার ৫০০ হেক্টর।
* সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের বাইরে কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই। * সেচের আওতায় ৭৬ হাজার ৫০০ পরিবারের জমি আছে। * কৃষকদের নলকূপের আবেদন পেলে যাচাই করে স্কিম তৈরি করা হয়।
বিএমডিএ সূত্রে জানা গেছে, কৃষকদের নলকূপের আবেদন পেলে যাচাই করে স্কিম তৈরি করা হয়। এরপর সমবায়ের ভিত্তিতে অংশীদারি ফি বাবদ এক লাখ টাকা জমা দিতে হয়। এই নলকূপ পরিচালনার জন্য বিএমডিএ একজন অপারেটর নিয়োগ দেন। প্রিপেইড মিটারিং পদ্ধতিতে কৃষকের নিজ নামে প্রিপেইড কার্ড থাকতে হয়। সেই কার্ড থেকে প্রতি ঘণ্টায় সেচের পানির জন্য ন্যূনতম ১১০ টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে নেওয়া হয়। এর বাইরে অতিরিক্ত কোনো টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই।
বড় বালিয়া এলাকার কৃষকেরা জানান, ২০১১ সালের দিকে বড় বালিয়া মণ্ডলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আকতারুজ্জামান এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ফি হিসেবে এক লাখ জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও কোনো কৃষক সেটা দিতে এগিয়ে আসেননি। ফলে আকতারুজ্জামান, দাউদুল ইসলাম ও জোবায়দুর রহমান মিলে অংশীদারি ফি দেন। আকতারুজ্জামানের ৮০ শতাংশ টাকা থাকায় গভীর নলকূপের নিয়ন্ত্রণ তিনিই পান। অপারেটর হিসেবে নিয়োগ পান তাঁর স্ত্রী বিউটি বেগম। যদিও কৃষকেরা আকতারুজ্জামানকেই অপারেটর হিসেবে জানতেন।
সেচের পানি পেতে হয়রানির শিকার হয়ে সদর উপজেলার বড় বালিয়া এলাকার ৫০ জন কৃষক গত ১৭ এপ্রিল বিএমডিএ সহকারী প্রকৌশলীর কাছে অভিযোগ দেন। সেখানে গিয়ে কৃষক ও অপারেটরের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।
ভুক্তভোগী কৃষকেরা বলেন, ২০১২ সালে নলকূপটি চালু হলে আওতাধীন কৃষকের কাছ থেকে আকতারুজ্জামান সেচের পানির জন্য প্রিপেইড কার্ডের অতিরিক্ত টাকা আদায় শুরু করেন। আর সেই টাকা থেকে তিনি মাঝেমধ্যে অন্য দুই অংশীদারকে কিছু টাকা ভাগ দেন।
ভুক্তভোগী কৃষক মো. শাহজাহান আলী বলেন, গভীর নলকূপটির আওতায় তাঁর ১০ বিঘা জমি রয়েছে। কার্ডের বাইরে টাকা দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও আকতারুজ্জামানকে প্রতি বিঘায় সেচের জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা দিতে হয়। এই টাকা না দিলে তিনি পানি দেন না।
ওই নলকূপের আওতায় চার বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করছেন কৃষক মো. হেলাল। তিনি অতিরিক্ত টাকা না দেওয়ায় অপারেটর খেতে পানি দেননি। এতে জমি ফেটে যায়। পরে তিনি শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে জমিতে সেচ দিয়ে খেত রক্ষা করেছেন।
আরেক ভুক্তভোগী মোকলেসুর রহমান বলেন, ১০ বছর ধরে সেচের পানির জন্য অতিরিক্ত টাকা দিয়ে আসছেন। এখন বিরক্ত হয়ে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। এরপরও কোনো বিচার পাননি।
এ বিষয়ে মো. আকতারুজ্জামান বলেন, তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর দেখেন গ্রামে কোনো গভীর নলকূপ নেই। পরে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে নলকূপটি স্থাপন করেন। কৃষকেরা অংশীদারত্বের টাকা দিতে রাজি না হলে তিনি বিএমডিএকে জানান। সে সময় তাঁরা টাকা দিয়ে দিতে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘পরে আপনি টাকাটা ধীরে ধীরে তুলে নেবেন।’ সেই পরামর্শেই সেচের পানি বাবদ প্রিপেইড কার্ডের অতিরিক্ত কিছু টাকা তিনি নিচ্ছেন। জোর করে কিছু নিচ্ছেন না।
বিএমডিএ ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, অভিযোগটি যাচাই করে সত্যতা পাওয়া গেছে। নলকূপটি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওই অপারেটরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এগ্রোটেক
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের উদ্যোক্তারা এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি
লেখক
প্রথম আলোডাচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে দুই দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।
গতকাল সোমবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অনুষ্ঠিত কৃষি খাতের ব্যবসাবিষয়ক এক সম্মেলনে দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত এগ্রি বিজনেস কনক্লেভে বাংলাদেশের প্রায় ৪০জন উদ্যোক্তা ডাচ কৃষি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি প্রযুক্তি সহযোগিতা ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছে ওয়েগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়।
আলোচনায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তি কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি সহযোগিতা দিতে রাজি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে ডাচরা প্রস্তুত এবং বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও তাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া ডাচ সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বীজ, পশু খাদ্য, পোলট্রি, হর্টিকালচার ও এ্যাকুয়াকালচার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করেছে, যা ওই দেশের বেসরকারি খাতকে আরও উৎসাহিত করেছে।
আলোচনায় কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তৈরি আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্কয়ার, ইস্পাহানি এগ্রো, একে খান অ্যান্ড কোম্পানি, প্যারাগন গ্রুপ, এসিআই, জেমকন গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ডাচ প্রযুক্তির প্রয়োগ সরেজমিনে দেখতে যাবেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের পোল্ট্রিখাতে সহযোগিতার আলোচনা অনেকটা এগিয়েছে উল্লেখ করে মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দুই দেশের মধ্যে মৎস্য, পশুপালন ও হর্টিকালচারে সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা আছে।
কনক্লেভ আয়োজনে প্রথমবারের মতো দূতাবাসের সঙ্গে অংশীদার হয়েছে নেদারল্যান্ডসের কৃষি মন্ত্রণালয়, নেদারল্যান্ডস এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি, নেদারল্যান্ডস ফুড পার্টনারশিপ, ডাচ-গ্রিন-হাইজডেল্টা, লারিভ ইন্টারন্যাশনাল, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ।
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী নেদারল্যান্ডসের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কম। ২০২১-এ কৃষিপণ্য ও খাদ্য রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন